নে আদরে জড়িয়ে মন পর্ব ৪০

নে আদরে জড়িয়ে মন পর্ব ৪০
সিনথিয়া

আরশির দিনদুনিয়ার খেয়াল নেই। আপতত পৃথিবীর সবচেয়ে ভরসার একটা বুকজুড়ে দখল তার। লুকিয়ে ঠোঁটে চুমু খাওয়ার খুশির ভেলকি চোখমুখে। সরু নাকটা ফুলালো গরিমায়। ফিক করে হেসেও ফেললো তারপর। খানিকবাদেই নিটল অক্ষিপুট আটকালো মানুষটার খুরখার চিবুকে।
দুষ্টুমিতে ক্ষীণ তর্জনীটা আরেকদফা উঠে এলো শেহজাদকে ছোঁয়ার জন্য। শাণের মতো ধারালো চিবুকের মাঝবরাবর হতে ধীরে ধীরে নামলো গলা অবধি। ছোট্ট ঢিবির মতো এ্যাডাম এ্যাপলটাতে আঙুল বোলাতেই ঢোক গেলার মতো নড়ে উঠলো ওটা।
থমকালো আরশি। ত্রস্ত হাতটা সরানোর আগেই কব্জিতে থাবা বসালো শেহজাদ। তড়াক করে মেলে বসলো নীললোচন। ঘুমের রেশ জড়ানো কন্ঠে বলে উঠলো,

“কী করছিলে?”
গমগমে স্বরে হতবিহ্বল আরশি। মস্তিষ্কের নিউরনে শর্টসার্কিট হওয়ার মতো স্তম্ভিত হলো চোখজোড়া। তুরন্ত উঠে বসতে চাইলেও হ্যাঁচকা টানে ফের বুকে এনে ফেললো শেহজাদ। হাড্ডিসার হাতটা আঁকড়ে ধরলো পোক্ত কাঁধ। গলায় আওয়াজ নেই! উত্তর দিলে যেনো প্রাণটা বেরিয়ে যাবে ভিতর থেকে!
সুদৃঢ় কপালখানায় ভাজ ফেললো শেহজাদ। চোখ সরু করে দেখলো আরশিকে। আড়ম্বরহীন ফিরতি প্রশ্নটাও সোজাসাপ্টা ছুড়লো তখন,
“কী করছিলে যে বলতে পারছো না?”
“স-সত্যি বলছি! আমি চুমু খাইনি!”
মনে মনে কপাল চাপড়ালো আয়ান। জারা অসহায় শ্বাস ফেললো। ঘুমের ভান ধরে আছে ওরা। তবুও আলগোছে মাথা নাড়লো দুপাশে।
ওদিকে চোখ খিঁচে বন্ধ আরশির। কল্পনার জটলা খিচুড়ি পাকালো ছোট্ট মাথায়।
দেখবে না সে শেহজাদকে। যা বলে ফেলেছে তারপর আর তাকানোর কোনো মানে হয় না! চুরি করে চুমু খেয়ে ধরা পড়া? লজ্জায় ফেঁপে উঠলো ফর্সা গাল। তখনই কানে এলো শেহজাদের পুরু স্বর। কন্ঠে দুষ্টুমি মেশানো এক-একটা শব্দ,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“ইটস ওকে আরশি! আফটার অল আমার বউ লয়্যাল চোর। চুরি করে চুমু খাওয়ার আগেও ভদ্রতার খাতিরে আগে সরি তো বলে!”
সেকেন্ড পার হতে না হতেই চোখ খুললো আরশি। একরাশ বিস্ময় ভর করলো ঐ কৃষ্ণ গহ্বরে। মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ার মতো দশা হলো আদলের। বিমূঢ় স্বরে থেমে থেমে আওড়ালো,
“আপনি…জেগে ছিলেন?”
বউকে নকল করে শ্বাস ফেললো প্রফেসর। প্রহসনটুকু কায়দা করে আড়াল করলো ঐ খাঁড়া খাঁড়া মুখ। মাথা দুলিয়ে ছোট করে বললো,
“পুরোটা সময়!”
আঁতকে উঠলো আরশি। চাইলো আর্ত চোখে। ঢোক গিলে শুধালো,
“যা যা বলেছি; সবটা শুনেছেন?”
শেহজাদ হাসি আঁটকে রাখতে ওস্তাদ। সহজে না হাসার গুণেই হয়তো নামটা জাম্বুবান রেখেছিল আরশি। সেই গুণটা কাজে লেগে গেলো আজ।
পাতলা ঠোঁট একে অপরকে পিষলো হাসি আঁটকাতে।
পরপর খুব স্বাভাবিকভাবে বললো,

“আমি তোমাকে খুব জ্বালাই, কস্মিনকালেও জানতে পারবো না তুমি আমাকে চুমু খেয়েছ, সেসব?”
পীবর স্বরের বিদ্রুপটুকু তীরের মতো বিঁধল আরশির বুকে। বিদ্রোহ শুরু হলো ব্রীড়ার। লাজবন্তী মাথা নোয়ালো। ভাষা হারিয়ে ফেললো গলবিল। রাইফেলের এলোপাতাড়ি গুলির মতো কানে এলো,
“সরি টু সে বাট সত্যিই সবটা শুনে ফেলেছি! এবার কি হবে? এটা তো ওয়ান কাইন্ড অফ অপরাধ রাইট? কারোর অগোচরে তার সাথে এসব করা?”
শেহজাদের প্রশ্নের উদ্বেগটুকুর মধ্যে মিশে ছিল নিছক কৌতুক। তবে তা ধরতে পারলো না আরশি। রাগ হলো। গাল ফুললো।
তবে হুট করেই খেয়ালে এলো অন্য কথা। ক্ষীণ আশাটুকু বুকে বেঁধে মাথা তুললো ও। জিজ্ঞেস করলো,
“আপনাকে আমি একটা কেনো? হাজারটা চুমু খেতে পারি! এটা আমার বউগত অধিকার!”
“ইজ ইট? তাহলে আমিও তো অনেককিছু করতে পারি তোমার সাথে! অধিকার খাটিয়ে? করবো?”
আরশি থতমত খেলো। তোরজোর কমে এলো গলার। বিস্ময়ের ভারে চোখের পাতা ফেললো ঘনঘন। কি বলতে চাইলো আর কি হয়ে গেলো এটা?

তাবৎ জড়বুদ্ধ শরীরটা ঝাঁকুনি দিলো কয়েকবার। আসন্ন বিপদের আশঙ্কায় আগেভাগেই আত্মসমর্পণ জানালো বিদ্বেষী সত্তাটা। বৃদ্ধা আর তর্জনী আঙুল দিয়ে চিমটি কাঁটলো গলায়! বিপন্ন স্বরে শুধোলো,
“এবারের মতো ছেড়ে দিন! আর করবো না! কোণ আইসক্রিমের দিব্বি!”
“আনফরচুনেটলি ফর ইউ, এখন আর মুড নেই ছেড়ে দেয়ার! চুরি করে চুমু যখন খেয়েছো, মাশুল তো দিতেই হবে!”
উল্টে কিছু বলতে গিয়েও থামলো মেয়েটা। বিনা প্রতিবাদে নামিয়ে ফেললো চোখজোড়া। সত্যিই তো দোষটা ওর! কি দরকার ছিল যেচে পড়ে এমন করার? তবুও মন মানলো না! অক্ষিকোটরজুড়ে ছলছল করে উঠলো অভিমান৷
একটু চুমুই তো খেয়েছে ঘুমের মধ্যে। তাই বলে এভাবে কথা শোনাবে ওকে? এই আরশি কানে ধরলো। দরকার পড়লে বিরিয়ানির এলাচি খেয়ে নেবে তবুও এই হারবজ্জাত জাম্বুবানকে চুমু খাবে না! কক্ষনো না!
আরশি যখন এসব খেয়ালি পোলাও বানাতে ব্যস্ত তখনই শেহজাদ ঘটিয়ে ফেললো অন্য ঘটনা! আচমকা উত্তাল ঢেউয়ের ন্যায় ধেয়ে এসে আঁকড়ে ধরলো নরম তুলতুলে ঠোঁট। নিজদখলে নিয়ে ভিজিয়ে দিলো প্রেমের উষ্ণতায়।
গোল গোল চোখগুলো দৃষ্টিশূন্য আরশির। এক শেহজাদ বাদে বাকিসব আবছা হলো মূহুর্তেই। শরীর ছেড়ে দিলো ঐ এক চুমুতে। ভাগ্যিস নিশ্বাস আঁটকে
ঢলে পড়ার আগেই ক্ষান্ত হলো মানুষটা। তবে ঠোঁট সরাতেই অধরপুটে ভূমিকম্প উঠলো আরশির।
ফ্যালফ্যালে চোখ পলক ফেলতে ভুলে জিজ্ঞেস করলো,

“এটা কি ছিল?”
শেহজাদের চোখ হাসছে। ফর্সা কানদুটো লাল হয়ে আছে কেমন। অথচ মুখটা গম্ভীর রেখে বললো,
“তোমার মাশুল!”
দপ করে জ্বলে উঠলো আরশি। এইভাবে ফেঁসে গেলো নিজের জালে? তেঁতে উঠে বললো,
“আরেকটু হলে চোখে তারা দেখতাম! এভাবে কেউ মাশুল তোলে?”
শেহজাদের ভেজা ঠোঁটের ভাজে সূক্ষ্ম হাসির রেখা। কামনার তরঙ্গে উদ্বেলিত সমুদ্রের ন্যায় নীলাভচোখ জোড়া। দৈবাৎ টান বসালো ডান হাতে ধরে রাখা কব্জিতে। যতটুকু যা দূরত্ব ছিল তাও মিটে গেলো এক লহমায়।
ফ্যাসফ্যাসে স্বরে থেমে থেমে আওড়ালো,

“নেক্সট টাইম…আ’ল মেইক ইউ সি দ্য রিয়াল স্টার মিসেস শেহজাদ! বাট অন আওয়ার বেড!”
আর নিতে পারলো না আয়ান। বিষম খেয়ে কেশে উঠলো সহসা। একেবারে যাকে বলে নাকে মুখে কাশি। তালুতে হাত রেখেও শেষের কথাগুলো হজম করতে পারলো না ছেলেটা! এসব কি? এরা কারা?
আওয়াজ কানে যেতেই ছিটকে সরে এলো আরশি। উঠে বসলো সোজা হয়ে। চিবুক নেমে গলায় ঠেকলো। একাকার হলো কুন্ঠায়।
শেহজাদের চোখেমুখে বিরক্তি। বিগতস্পৃহায় উঠে বসে বললো,
“পানি খা!”
আয়ান থামলো না। কাশতেই কাশতেই বললো,
“আর পানি! তুই তো আমাদের মতো দুজন মুরুব্বি সামনে থাকতেও বাচ্চা মেয়েটাকে গিলে ফেলছিলি! এ্যানাকোন্ডা কোথাকার!”
জারা আর পাশে বসে থাকতে পারলো না। উঠে দাঁড়াতেই আয়ান ফের হড়বড়ালো,
“হ্যাঁ বাটারফ্লাই! চলো চলে যাই! এসব অশ্লীল এ্যানাকোন্ডার বাসায় আমরা থাকবো না!”
শেহজাদ বসে থেকেই পায়ের উপর পা তুললো। দু’হাতে হাঁটু আঁকড়ে সোজাসাপ্টা দৃষ্টি ফেললো আয়ানের দিকে। জিভ দিয়ে গাল ঠেলে বললো,

“কিন্তু গতকাল তো তুই আমাকে আদা ছেঁচা বলে ডেকেছিলি? ইফ আ’ম নট রং!”
আয়ান চলে যেতে নিয়েও থামলো। কিড়মিড় করে বললো,
“হ্যাঁ তখন ডেকেছিলাম! কিন্তু এখন সিচুয়েশন চেঞ্জ! তাই তোর নাম এ্যানাকোন্ডা। না না শুধু এ্যানাকোন্ডা নয়! অশ্লীল এ্যানাকোন্ডা! সিনিয়র হিসেবে আমার মান সম্মান একেবারে সব অ্যামাজনে পাঠিয়ে দিলি! ছিহ্!”
“তুই আমার সিনিয়র?”
“আলবৎ!”
“তবে রে!”
শেহজাদ সোফা ছেড়ে উঠতেই ভোঁ দৌড় লাগালো আয়ান। শেহজাদও ছুটলো পিছন পিছন। পুরো বসার ঘর এভাবে চক্কর কেটে আরশির পিছনে এসে দাঁড়াল
অফিসার। ঘনঘন শ্বাস ফেলে বললো,
“ভাবি…থামাও তোমার বরকে! নয়তো এ্যারেস্ট করে একেবারে জেলে ভরে রেখে দেবো!”
শেহজাদও বড় বড় দম নিলো সামনে দাঁড়িয়ে।
“আয়ান! আমি ধরলে কিন্তু মার খাবি!”

“তুই মারলে আমি কি বসে থাকবো? আমারও পা আছে!”
“কী করবি তুই?”
“ক-কী আর করবো? দ-দৌঁড় দেবো! আমি তো আর তোর মতো দয়া-মায়াহীন এ্যানাকোন্ডা নই!”
শুধু দুই সুঠাম পুরুষের মাঝে ফেঁসে স্যান্ডউইচ হওয়ার উপক্রম আরশির। অপ্রস্তুতে একবার শেহজাদকে দেখছে তো একবার আয়ানকে।
জারা পেট চেপে ধরে নুয়ে পড়লো। হাসতে হাসতে চোখে মুছলো বা হাতের পিঠ দিয়ে। সেদিকে আড়চোখে তাকালো আয়ান। সুতনু আদলে ভেসে উঠলো একরাশ নরম মুগ্ধতা। এই যে ওর বাটারফ্লাই হাসছে! এতে ও হাজার তাড়া খেতেও প্রস্তুত!

তবে এতো হাসিঠাট্টার মাঝেও একমাত্র নারাজ স্নোবল। সেই কখন উঠেছে ও! বাটিতে প্যালেটস নেই। ঘাস নেই। পানি নেই। অথচ এদের হাসি থামে না। সেই রাত থেকেই তো হাসছে। আর কত হাসবে এরা?
ঠিক তখনই বেল বাজলো সদরদরজায়। হাওয়ায় ভেসে বেড়ানো খিলখিল শব্দ থেমে গেলো একযোগে। কিছু একটা মনে পড়তেই প্রশস্ত হাসলো আরশি। রোগাপাতলা মুখটা চকচক করে উঠলো আনন্দে। স্ফূর্ত কন্ঠে আওড়ালো,
“আঙ্কেল আন্টি এসেছে!”
জারা কাছেই দাঁড়ানো ছিল দরজার। ইতস্তত ভাবটা কাটিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
“আমি খুলবো দরজাটা?”
তিন জোড়া চোখের সম্মতি পেতেই মেয়েটা ছুটে গেলো সদরদরজায়! মনটা বারবার বললো কিছু একটা ঘটবে। খুব ভালো কিছু!
বড়সড় দম নিয়ে দরজার হাতল ঘোরাতেই ঘরের ভিতর ব্যস্ত কদম বাড়ালেন মরিয়ম। কিন্তু বিধিবাম!
মখমলের শাড়িটায় পা আঁটকে গেলো হুড়োহুড়িতে। পেঁচিয়ে ভারসাম্য হারালো শরীরটা। আর তখনই তড়াক করে প্রৌঢ় হাতটা চেপে ধরলো জারা। সামলে নিলো মরিয়ম বেগমকে।
পিছন থেকে শোনা গেলো মেহমেদ হাসানের সন্ত্রস্ত কন্ঠস্বর,

“মরিয়ম! দেখে চলবে তো! এতো তাড়াহুড়ো করলে হয় বলো তো? কোথায় লাগলো দেখি?”
আয়ান, শেহজাদ, আরশি তিনজনই তটস্থ এগিয়ে এলো দরজার কাছে। উদবাস্তু আননে স্পষ্ট উদ্বেগ প্রত্যেকের! দুশ্চিন্তাটুকু গিলে কোনোমতে শুধোলো শেহজাদ,
“ মা লাগেনি তো কোথাও?”
কি করে লাগবে? একটা আদুরে হাত যে বহু আগেই সামলে নিয়েছে সবটা। মরিয়ম চোখ তুলে চাইলেন পাশে দাঁড়িয়ে থাকা সেই হাতের অধিকারিণীর দিকে। অমনি কিছু একটা হলো বুকের ভিতর। মুখটা কোনো কারণে ভীষণ চেনা লাগলো! ভীষণ! মায়া জড়ানো কন্ঠে অস্ফুটে আওড়ালো,
“তুমি?”
আয়ান সবে হা করেছিল “আমার বউ” বলার জন্য। তারআগেই শক্তপোক্ত একটা কনুইয়ের গুঁতো খেয়ে মুখটা বন্ধ হয়ে গেলো ওর। তপ্ত চোখে কার কনুই দেখার জন্য চাইতেই দৃষ্টি আঁটাকালো শেহজাদে৷ মানুষটা নির্বিকার উত্তর দিলো,

“আরশির ফ্রেন্ড মা! ওর নাম জারা! আমাদের ফ্যাকাল্টিরই স্টুডেন্ট!”
আয়ান মাথা দোলাতে গিয়েও থামলো। আদা ছেঁচাটা সবকিছু বললো অথচ জারা যে ওর হবু বউ সেটা বললো না?
জিজ্ঞেস করার জন্য ঝুঁকে এলো শেহজাদের কানের পাশে!
“আর ‘আয়ানের হবু বউ!’ এটা কি তোর শ্বশুর এসে বলে দেবে?”
শেহজাদের কন্ঠ ধীর। স্বর নামিয়ে বললো,
“আমার শ্বশুর বাংলাদেশে! তোর কি মনে হয়? উনি তোর হয়ে কথা বলতে এখানে আসবে?”
অধৈর্য হলো মানুষটা। ছ’ফুট গতর অস্থির হয়ে বায়না জুড়লো,
“তাহলে বল না বেটা! বাটারফ্লাই আর আমার বিয়েতে আঙ্কেল আন্টির এপ্রুভাল ভীষণ ইম্পর্ট্যান্ট!”
“এতো ইম্পর্ট্যান্ট হলে তুই বল! সব জায়গা আমাকে টানিস কেনো?”
আয়ানের আলাভোলা মুখটা নিভে গেলো দপ করে। ঠোঁট উল্টোলো। এ পর্যায়ে জোরাজুরি থামিয়ে চাইলো মরিয়ম বেগমের দিকে।

সে এক নাগাড়ে দেখে যাচ্ছেন জারাকে। বিশ্রামহীন জারার চোখ দুটোও ঐ ঘুরে ফিরে আঁটকে রইলো মমতাময়ীর মুখে। মেহমেদ পিছন থেকে এসে স্ত্রীর পাশে দাঁড়িয়েছিলেন কেবল। হুট করেই চোখ গেলো জারার দিকে। মূহুর্তেই খামচি মারলো বাম পাশের অলিন্দটা। মনে মনে বিড়বিড় করলো,
“অবিকল আমাদের ছোট্ট রুশা?”
কিন্তু দৈবাৎ মনে পড়ে গেলো সেই ফোন কল। মনে পড়ে গেলো, রুশা তো নেই। সে তো কবে ছেড়ে চলে গেছে তাদের ছেড়ে।

ফেব্রুয়ারীর শীতটা জাঁকিয়ে বসলো সকালে। রোদের মুখ দেখলেও ঠান্ডার প্রকোপে জবুথবু নিউইয়র্ক।
হাসান ভিলার ডাইনিং টেবিল এখন ভরপুর। সাত সাতজন মানুষের মিলনমেলায় মুখরিত চারপাশ। সকালের নাস্তা সার্ভ করলো বাড়ির কাজে সাহায্য করা মেয়েটা।
ঝড়ের তান্ডবে রাতে আসতে না পারলেও সক্কাল সক্কাল একেবারে কোমর বেঁধে চলে এসেছে সে।
মরিয়ম বেগম আর মেয়েদের মুখোমুখি হয়ে বসলো ছেলেরা। সবার মধ্যে এ্যামিই চুপচাপ; মুখ ভার তার। বুঝিয়ে দিলো নতুন মানুষ দেখে আহামরি খুশি হয়নি সে৷ তাতে অবশ্য খুব একটা পাত্তা দিলো না কেউ।
মরিয়ম বেগম যতটা ব্যতিব্যস্ত হয়েছিলেন তার অনেকটাই কমেছে শেহজাদকে সুস্থ দেখে।
শুধু আঁতকে উঠেছিলেন হাতে আর কাঁধে সেলাই লেগেছে শুনে। কিন্তু আয়ান সামলে নিলো সবটা। সবাইকে খুলে বললো পুরো ঘটনা।
দাঁড়ি কমা কিচ্ছু বাদ রাখেনি। যদিও ভেবেছিল ওর শেষের প্ল্যানটার কথা শুনে আঙ্কেল আন্টি হয়তো বকবেন। কিন্তু তেমন কিছুই হলো না। উল্টে মেহমেদ হাসান হেসে বলে উঠলেন,
“দেখেছো মরিয়ম! একেই একেবারে যাকে বলে কি না ইয়াং ব্লাড! কি বুদ্ধি খাটিয়ে প্রমানটা জোগাড় করে ফেললো ওরা। এবার আর আদির জেল থেকে বের হওয়ার কোনো চান্স নেই!”
শ্বাস ফেললেন মরিয়ম। হাসি থামলো মেহমেদেরও। চশমা খুলে ভেজা চোখটা মুছলেন দু আঙুল দিয়ে। আহত গলায় বললেন,

“আমারই ভুল! আমিই মানুষ চিনতে পারিনি! নয়তো যারা আমার পরিবারের ক্ষতি করতে চেয়েছে তাদের সাথেই কি না আত্মীয় পাতাতে গিয়েছিলাম আমি? ভাগ্যিস তোদের কারোর তেমন কোনো ক্ষতি হয়নি। নয়তো আমরা বুড়ো-বুড়ি–!”
মরিয়ম বেগম স্বামীর হাতে হাত রাখলেন। ভরসা দিলেন নীরবে। কথা থামিয়ে সেদিকে চেয়ে মলিন হাসলো প্রৌঢ় আনন।
পরপরই তাকালেন জারার দিকে। পরিবারের কথা জিজ্ঞেস করতেই অপ্রস্তুত হলো কিশোরী। শুধু আড়চোখে একবার
আয়ানের দিকে তাকাতেই সে মানুষটা বলে উঠলো,
“আমিই ওর পরিবার আঙ্কেল। আর জারা আমার। এন্ড উইথ অল ইয়র ব্লেসিংস উই উইল বি এ্যাঙ্গেজড সুন!”
ভারী পুুরুষালী স্বরে কিছুক্ষনের জন্য পিনপতন নীরবতা নামলো বসার ঘরে। তবে সে নীরবতা মুগ্ধতার। সবার মুখে ভিড় করলো একফালি ভালোলাগা। শুধু জারার মাথা নোয়ানো।
তখনই হেসে উঠলেন মরিয়ম! বললেন,

“আর আমরা বুঝি তোদের কেউ নই?”
একটু থেমে জারার দিকে তাকিয়ে আওড়ালেন,
“আজ থেকে আমার চারটা ছেলেমেয়ে নয়! আমার পাঁচটা ছেলেমেয়ে। আমরাই তোমাদের পরিবার। মনে থাকবে?”
জারার নীল অক্ষিকোটর চিকচিক করে উঠলো খুশিতে। গাল ভিজতেই মাথা দোলালো মেয়েটা। মরিয়ম মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে চুলে চুমু খেলেন।
আরশিও তখন ওপাশ হতে মাথাটা বাড়িয়ে দিলো। আবদার ছুড়ে বললো,
“শুধু জারাকেই আদর করবে? আমাকে আদর করবে না আন্টি?”
মরিয়ম ঘুরে বসলেন। মুখটা কঠোর করে বললেন,
“না!”
সবাই স্তব্ধ। একযোগে চাইলো আরশি আর মরিয়মের দিকে। শেহজাদ কিছু বলে ওঠার আগেই প্রৌঢ়া আওড়ালেন,
“আগে মা ডাকবি। তারপর আদর করবো! সেই কবে ছেলের বউ বানালাম! আর এখনও কেমন আন্টি আন্টি করে ডাকিস! এসব শুনতে ভালো লাগে বল?”
এতক্ষণে একটা ভারি পাথর নেমে গেলো সবার বুক থেকে। স্মিত হাসলো আরশি।

“বেশ! আর আন্টি আন্টি ডাকবো না!”
“তাহলে কি বলে ডাকবি শুনি?”
আরশি লাজুক চোখ তুলে একবার চেয়ে দেখলো সামনে বসে থাকা তার একান্ত পুরুষটিকে। সৌষ্ঠব আদলে কি প্রখর দৃঢ়তা। একচোট দুশ্চিন্তায় কপালে যে এখনো ভাজ পড়ে আছে, সেটা হয়তো খেয়ালই করেনি প্রফেসর।
তারপরই সেই চোখজোড়া নামালো আরশি। আদুরে স্বরে ডাকলো,
“মা!”
মেহমেদ বেশ গদগদ কন্ঠে বলে উঠলেন,
“মা জননী! তাহলে এই বুড়ো ছেলেটাকেও কিন্তু এখন থেকে বাবা বলে ডাকতে হবে! উমমম..নইলে কিন্তু এটা পার্শিয়ালটি হয়ে যাবে! বলে দিলাম!”
আবারও একদফা হাসির রোল পড়লো বসার ঘরে। শুধু হাসলো না এ্যামি। খাবার টেবিল ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে সোজা হাঁটা দিলো নিজের রুমের দিকে।
মরিয়ম বেগম হাসি থামালেন। পিছু ডাকলেন মেয়েটার,
“কীরে? খাওয়াই তো শেষ করলি না তুই? উঠে গেলি কেনো?”
বড্ড তাচ্ছিল্যের জবাব এলো সঙ্গে সঙ্গে,
“তোমরা খাচ্ছো খাওনা! আমার ক্ষিদে নেই!”

এ্যামি কে আর ঘাটালো না কেউ। শুধু একপরত নিস্তব্ধতা ভেঙে শেহজাদ বলে উঠলো,
“আরশির সেমিস্টার ফাইনালের আর মাত্র কয়েকদিন বাকি। এন্ড আ’ম ড্যাম শিয়র ও পড়াশুনো কিছু করছে না। হয়তো বইগুলোও এখনো ছুঁয়ে দেখেনি!
আরশি সরু সরু চোখে চাইলো বরের দিকে। মুখ ভেঙিয়ে বিড়বিড় করে বললো,
“বলেছে ওনাকে আমি বই ছুঁইনি! হুহ!”
শেহজাদ গুরুত্ব দিলো না সেসব! নিজের মতো করে বলে গেলো,
“তাই আমি ঠিক করেছি, এক্সামের এ কদিন ওকে নিয়ে আমাদের পুরোনো এপার্টমেন্টটায় গিয়ে থাকবো! এখানে থাকলে সারাদিন ও বইয়ের কাছে ঘেঁষবে না। হয় তোমার সাথে গল্প করবে নয়তো বাবার সাথে দাবা খেলবে! কিন্তু ওখানে থাকলে বকা খেয়ে অন্তত পড়তে তো বসবে!”
আয়ান পাশেই বসা ছিল। কানের কাছে এসে চিবিয়ে চিবিয়ে বললো,
“হ্যাঁ হ্যাঁ! ওসবই বোঝাও সবাইকে! কদ্দূর যে তুমি ওকে পড়াবে আমার জানা আছে। মেয়েটাকে একা বাসায় নিয়ে আবার এ্যানাকোন্ডার মতো হামলে পড়ার মতলব! তাই না রে? ”
শেহজাদ তপ্ত চোখে ঘাড় ঘোরাতেই বাঁধ সাধলেন মরিয়ম,
“না না! আমার মেয়ে আমার কাছে থেকেও পড়তে বসবে। কোত্থাও নিয়ে যেতে হবে না ওকে তোর! কি রে আরশি? পড়বি না এখন থেকে?”

মেহমেদও সায় দিলেন স্ত্রীর কথায়। আরশি জোরে জোরে মাথা দুলিয়ে বোঝালো আলবাত পড়বে সে।
অগত্যা হার মানলো শেহজাদ। মাথা নুইয়ে শ্বাস ঝাড়লো। ভেবেছিল এই প্রথমবার ওদের ম্যারেজ অ্যানিভার্সারিটা একটু স্পেশাল ভাবে সেলিব্রেট করবে। কিন্তু মেয়ে তো যেতেই রাজি হলো না ওর সাথে?
নেহাৎ সবার মাঝে তাই কিছু বলতে পারলো না মানুষটা। তৃষ্ণার্ত চোখজোড়া একবার চাইলো আরশির দিকে। ম্যাডাম ভীষণ ব্যস্ত। সবার সাথে গল্প করছে অথচ ওর দিকেই যেনো তাকানোর সময় নেই। এই মেয়ে কি কোনোদিন বুঝবে না ওকে?

নে আদরে জড়িয়ে মন পর্ব ৩৯

পরপরই কিছু একটা ভাবলো শেহজাদ। খাওয়া শেষ করে উঠে দাঁড়ালো। আরশিকে পাশ কাটিয়ে যাওয়ার সময় থামলো পা জোড়া। আচমকা কানের পাশে নুয়ে এলো লম্বা চওড়া গতর! পাতলা ওষ্ঠপুট সরে গেলো একপাশে। কন্ঠ খাদে নামালো! বাঁকা হেসে বললো,
“ওয়েল মিসেস শেহজাদ! আইডিয়ালি আমি তোমারই হাজবেন্ড! আমাকে যত বেশি ইগনোর করবে, রাতগুলোও তত বেশি লম্বা হবে তোমার জন্য! নাও চয়েজ ইজ ইউয়র্স!”

নে আদরে জড়িয়ে মন পর্ব ৪১