যতনে রাখিলাম যাতনা পর্ব ২০
মম সাহা
বুকের ভেতর জমে গিয়েছে গুমোট নিশীথির দুঃখ। যেই দুঃখদের ভাসানো যায় না উত্তুরের হাওয়ায়। লুকানো যায় না ল্যাম্পপোস্টের বিপরীতে থাকা অন্ধকারের নিচে। বিষাতের এক উত্তপ্ত শ্বাস ঘুরে-ফিরে যায় চিত্রার শরীরের আশ-পাশ দিয়ে। সে মিনিট কয়েক দাঁড়িয়ে থাকে ঠাঁই। অপরিচিত এক বনফুলকে দেখে তার সতেজ হৃদপিণ্ড মূর্ছা যায় যাতনায়।
ঘোর ভাঙতেই ছুটে যায় বনফুলের কাছে। বুকের সবটুকু ভালোবাসা দিয়ে জাপটে ধরে বনফুলকে। কতদিন পর চিত্রা হাউমাউ করে কেঁদে উঠে। ঘোরগ্রস্তদের মতন বারংবার বলতে থাকে,
“তোর কী হয়েছে, বনফুল? তোর এ কী হাল? তোর কী হয়েছে, বাবুই?”
বনফুলের স্মৃতির পাতায় চিত্রা ততদিনে ঝাপসা হয়ে গিয়েছে। সে অবুঝ শিশুটির মতন তাকিয়ে রইলো চিত্রার পানে। কিচ্ছুটি যেন বোধগম্য হলো না তার।
চিত্রা আবার বললো, “কথা বল, বনফুল। আমার বনফুল, তোর কী হয়েছে? এই যে আমি, তোর চিতাবাঘ। আমাকে চিনতে পারলি না? এই যে আমি!”
বনফুল নির্বোধের মতন তাকিয়ে রইলো। চিত্রার দিকে তাকালো কয়েকবার তারপর তাকালো বাহার ভাইয়ের দিকে। শুধালো,
“ও কে? তুমি চেনো বুঝি?”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
বনফুলের করা এহেন প্রশ্নে চিত্রার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লো। তাজ্জব হয়ে তাকিয়ে রইলো কেবল। অস্ফুটস্বরে বলল, “তুই আমাকে চিনছিস না, বনফুল? আমি তোর চিতাবাঘ। তোর সবচেয়ে প্রিয় বন্ধুটি!”
বনফুল সুন্দর ভাবে মাথা ঝুলালো। ঠোঁট উল্টালো বাচ্চাদের মতন। কাঁদো কাঁদো হয়ে বলল, “না। তুমি যাও তো। তুমি কাঁদছো কেন? আমার ভালো লাগে না। তুমি যাও।”
চিত্রা ততক্ষণ নিজের লাগাম হারিয়ে ফেলেছে। বনফুলকে জাপটে ধরে তার দুনিয়া ভেঙে কান্না শুরু হলো। নিজের কথা মনে করানোর আপ্রাণ চেষ্টা চললো। বলল,
“আমায় চিনছিস না কেন? তোর কি আমাদের মনে নেই? আমি, চাঁদনী আপা, অহি আপা… চেরির কথা মনে আছে তোর? চেরি বড়ো হয়েছে তো।”
চিত্রার এত প্রচেষ্টার পরেও বনফুলের বোধকরি কিছুই মনে পড়লো না। সে ফ্যাকাসে দৃষ্টিতে তাকিয়েই রইলো। চিত্রা সেই দৃষ্টির মানে বুঝে আরও মরিয়া হয়ে উঠল। আচমকা বলে বসলো, “তুহিন ভাই..তুহিন ভাইয়ের কথা মনে আছে তোর?”
বনফুলের ফ্যাকাসে দৃষ্টির বদল ঘটলো এবার। চমকে তাকালো সে। কিন্তু রইলো নীরবই।
ঝড়ের আগে যেমন নীরব রয় নদী, সমুদ্র কিংবা প্রকৃতি… ঠিক তেমন নীরব। বাহার চিত্রার হাত টেনে ধরলে। আতঙ্কিত স্বরে বলল, “ঘরের বাহিরে যাও তুমি, চিত্রা। এই মুহূর্তে বের হও।”
চিত্রা এই আতঙ্কের কারণ বুঝলো না। তবে বাহার ভাইয়ের টানে উঠে দাঁড়ালো। বুঝতে না পেরে বলল, “কেন? কী হয়েছে?”
“কিছু হয়নি। তুমি বাহিরে যাও এখুনি।”
চিত্রা আর কিছু বলতে পারলো না। বাহার ভাইয়ের টান পা নড়লো। এক পা এগুতেই বিশাল জোরে তার কপালে এসে কিছু পড়লো। চিৎকার করে উঠল চিত্রা। আর্তনাদ করে উঠলো। পুরো দুনিয়া যেন তার ঘুরে উঠলো নিমিষেই। চোখ-মুখের সামনে সব হয়ে গেলো অদেখা। লুটিয়ে পড়লো মাটিতে।
হেমন্তের রোদে পুড়ে যাওয়ার উত্তপ্ততা থাকার কথা নয়। দবুও জনজীবন পুড়ে যাচ্ছে যেন। গরমে বেশ নাজেহাল অবস্থা। মুনিয়া বেগম কিছুক্ষণ আগেই কলেজ থেকে এসেছেন। তিনি কলেজের শিক্ষকতা করছেন বহু বছর যাবত। তবে আজকাল এত ক্লান্ত লাগে! বয়স হচ্ছে কি-না! অল্প বয়সে যা করেছে তা তো আর এখন করা যায় না।
ফ্রেশ হয়েই ঢুকলেন রান্নাঘরে। বিকেল সাড়ে চারটা বাজছে। সন্ধ্যার নাস্তার যোগাড়যন্ত্র শুরু করতে লাগলেন। যেহেতু দুপুরের রান্নাটা বড়োজা আর ছোটোজা মিলে করে সেহেতু বিকেলের রান্নার দায়িত্ব তার উপর।
মুনিয়া বেগম পাকোড়া বানানোর জন্য বিভিন্ন কাটাকুটি করলেন। চুলোয় বসিয়ে দিলেন জল ফুটতে। তখনই অবনী বেগম এলেন। পাশেই দাঁড়ালেন। ফুটতে থাকা জলে একটু নুন আর তেল দিয়ে দাঁড়ালেন। হাসিমুখে অন্যান্য দিনের মতনই জিজ্ঞেস করলেন,
“কখন এসেছো, আপা?”
“এই তো আধা ঘন্টা হলো। তুই ঘুমাস না কেন বিকেলে? সেই কোন সকালে উঠিস! চোখে ঘুম নেই নাকি?”
অবনী বেগম মুচকি হেসে কথাে পিঠে জবাব দিলেন, “আর ঘুম! এত ঘুম পায় না আমার। আমি তো তোমার আসার অপেক্ষা করছিলাম। জানি তো, এসেই রান্না বসাবে। এতটা খাঁটনি করে এসে একা একা এত কাজ করবে কীভাবে? তোমারও তো মানুষের শরীর।”
“আমার কোনো সমস্যা হয় না, অনি। তুই বেশি বেশি ভাবিস আমার ব্যাপারে। এটা তো আমার দায়িত্ব। দু’বেলা তোরা তো রান্নাবান্না করিস। বড়ো আপা আমাকে এতটুকু দায়িত্ব দিয়েছেন, সেটাও বা না করলে কীভাবে হয়!”
অবনী বেগম মুখ ভেঙচালেন এবার। ফিসফিসিয়ে বললেন, “বড়ো আপার হলো পেট ভর্তি হিংসে। কেবল বড়ো ভাই সাহেবের ভয়ে হিংসেটা বের করতে পারে না। নয়তো দেখতে এই সংসারে কবে হাঁড়ি আলাদা হতো!”
অবনী বেগমের লাগাম ছাড়া সত্যি কথায় জিভ কাটলো মুনিয়া বেগম। সাবধানী স্বরে বললেন, “আস্তে বল। বড়ো আপা শুনলে বাড়ি মাথায় তুলবে।”
“তুললে, তুলুক। আমি এসব ভয় পাই না, আপা। বড়ো আপা জানেন ভালো করে আমার মুখের ধার কেমন।”
“সে তো তুই সবার সাথেই পারিস। কেবল অহির বাবার কাছে এলেই আর কিছু বলতে পারিস না।”
অবনী বেগম এবার চুপ করে গেলেন। নিঃশ্বাস নিলেন বড়ো করে। ফুটন্ত জলে বড়ো দু প্যাকেট নুডলস ঢেলে নাড়তে নাড়তে বললেন,
“অধিকার যে জায়গায় আছে সে জায়গায় কিছু বলা যায়, আপা। অহির আব্বুর সাথে যখন বিয়ে হলো তখন থেকে আমাকে অনুভব করানো হলো যে আমি আরেক জনের সংসারে কেবল শূন্যস্থান পূরণ করতে এসেছি। এই সংসারের উপর আমার কোনো অধিকার নেই। দাবী নেই। এরপরে আর কিছু বলা যায় বলো? যেখানে আমি জানিই আমার কোনো মূল্য নেই সেখানে কী বলবো, আপা? অধিকার থেকেই কথা জন্মে। আর যেদিকে অধিকারই নেই সেদিকে আর কীসের কথা?”
কথা থামতেই দীর্ঘশ্বাস ভেসে এলো দু’জনের। মুনিয়া বেগম আরও কিছু বলবার আগেই কলিংবেলের শব্দ পাওয়া গেলো। অবনী বেগম যেন হাঁপ ছেড়ে বাঁচলেন। দরজা খোলার অজুহাতে বেরিয়ে গেলেন রান্নাঘর থেকে। হয়তো চোখের জলটাকে আলগোছে লুকিয়ে ফেললেন এই ফাঁকে।
মুনিয়া বেগম মনযোগ দিলেন তার কাজে। ঠিক সেই মুহূর্তেই অবনী বেগম কিছুটা ছুটেই এলেন। স্তব্ধ, বিমূর্ত তার কণ্ঠ,
“আপা, নিরু আসছে। তাড়াতাড়ি চলো।”
মুনিয়া বেগম অবনী বেগমের এমন ঘাবড়ে যাওয়া গলার স্বরে ভ্রু কুঁচকালেন, “নিরু আসছে ঠিক আছে। তাই বলে তুই এমন হাঁপাচ্ছিস কেন?”
“তুমি তাড়াতাড়ি আসো তো, আপা। নিজেই দেখে যাও।”
মুনিয়া বেগমের মনে কু ডাকলো। তিনি চুলের জ্বালটা বন্ধ করেই অবনী বেগমের পেছন পেছন বেড়িয়ে এলেন। ড্রয়িং রুমে আসতেই বিস্ময়ে তার মুখ হা হয়ে গেলো। নিরু দাঁড়িয়ে আছে গাঢ় খয়েরী রঙের একটি শাড়িতে। মাথায় গুঁজে আছে বেলি ফুলের মালা। হাত ভর্তি লাল কাঁচের চুড়ি। নাকে জ্বলজ্বল করছে স্বর্ণের নাকফুল। কী সুন্দর লাগছে এই মেয়েটিকে! নব্য বিবাহিতা লাগছে।
মুনিয়া বেগমের মুখের ভাষা যেন গলা চেপে আটকে আছে। তবুও বড়ো কষ্টে উচ্চারণ করলেন,
“আরে নিরু যে! এতদিন পর এলে? কত গুলো দিন হলো বলো তো? মাস ঘনিয়ে গেছে। আন্টিদের দেখতে ইচ্ছে করে না বুঝি?”
নিরু কথার বিপরীতে খুব মিষ্টি করে হাসলো। মাথা নাড়িয়ে বলল,
“দেখতে তো ইচ্ছে করেই, আন্টি। কিন্তু সব ইচ্ছে আর পূর্ণতা পায় বলো? তার উপর নতুন সংসার নিয়ে তো ব্যস্ত থাকতেই হয়।”
‘নতুন সংসার’- শব্দটি অবনী বেগম ও মুনিয়া বেগমের কানে বারংবার প্রতিধ্বনিত হতে থাকলো। মুনিয়া বেগম কিংকর্তব্যবিমূঢ় স্বরে বললেন, “নতুন সংসার মানে? বিয়ে হয়ে গেছে তোমার? কবে?”
মুনিয়া বেগমের এমন প্রশ্নে যেন এবার অবাক হলো নিরুও। কৌতূহল নিয়ে জিজ্ঞেস করলো, “আপনাদের তুহিন কিছু বলেনি? আমার বিয়ের ব্যাপারে?”
মুনিয়া বেগম যন্ত্রের মতন বললেন, “না তো।”
নিরু ফুস করে শ্বাস ফেললো। রুদ্ধ কণ্ঠে বলল, “হয়তো বলতো পরে। তুহিন কি আজ বাড়িতে আছে? কথা ছিলো।”
অবনী বেগম মাথা নাড়িয়ে কেবল জানাল- “হ্যাঁ। আছে। যাও।”
নিরু চলে গেলো তুহিনের ঘরে। মুনিয়া বেগম ধপ করে বসে পড়লেন সোফাতে। অবিশ্বাস্য ভঙ্গিতে দু’হাতে চেপে ধরলেন নিজের মুখ। ব্যথিত স্বরে বললেন,
“আমার ছেলে-মেয়ের সাথেই কেন প্রতিবার এমন হয়? ওরাই কেন প্রতিবার এতটা কষ্ট পায়? এজন্য তো বলি আমার তুহিন বদলে গেলো কীভাবে! আমার তুহিনের কী হলো! কিন্তু আমার তুহিন যে ভেঙে গেছে ভেতর ভেতর, সে তো আমরা বুঝলামই না!”
অবনী বেগম ঠোঁট চেপে দাঁড়িয়ে রইলেন। কী বলবেন খুঁজেই পেলো না ভাষা।
চিত্রার মাথায় একটি ব্যান্ডেজ হলো। মোটামুটি ভারি ব্যান্ডেজই। সেই মেয়ের এই ব্যথার দিকে কোনো খেয়াল নেই। সে কেবল বার বার বাহার ভাইয়ের হাতটা টেনে ধরছে। বার বার কেবল অবিশ্বাস্য ভঙ্গিতে বলছে,
“বনফুলের কী হইলো? ও শেষমেশ কি-না পাগলাগারদে ঠাঁই পেলো? আমার নরম বনফুল এভাবে শেষ হয়ে গেলো? ওর কী হলো বাহার ভাই?”
বাহার ভাই মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো চিত্রার। চিন্তিত স্বরে বলল, “ব্যথা করছে আর তোমার? কেন যে তোমাকে এনেছিলাম এখানে। আমার আনা উচিত হয়নি।”
“আপনি প্লিজ বলেন, ওর কীভাবে এমন হলো? কী হয়েছে?”
বাহার ভাই তপ্ত শ্বাস ফেললেন। চিত্রার মাথায় অনবরত হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললেন,
যতনে রাখিলাম যাতনা পর্ব ১৯
“বনফুলটা প্রেম করে একবারে নিজেকে হারিয়ে ফেলেছে, রঙ্গনা। ওর ভালোবাসা ওরে ভেঙেচুরে ফেলেছে এতটাই যে ও আর সেই ভাঙা টুকরো গুছিয়ে উঠতে পারেনি। আমরা বুঝতেও পারিনি আমাদের বনফুল আমাদের অগোচরে নেশার জগতে বুদ হয়ে গিয়েছিলো। যতদিনে জানলাম দেখলাম, আমাদের বনফুলকে আমরা হারিয়ে ফেলেছি। ভালোবাসা না-কি বাঁচতে শেখায় অথচ তুমি আর বনফুল নিজেদের এভাবে শেষ করে দিতে চাইলে কেনো? তোমাদের এ কেমন ভালোবাসা যে তোমাদের সর্বনাশ করে দিলো? আমার বনফুলটাকে করে দিলো চির উন্মাদ! এত বছর যে নামের প্রতি তার তীব্র ভালোবাসা ছিলো সেই নামেই আজ ওকে উন্মাদ করে দেয়। ও দিক ভুলে যায়। মরিয়া হয়ে যায়। প্রেম কিনা শেষমেশ বনফুলকে নিজের থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে নিলো। হাহ্!”
“আর আন্টি কোথায়? উনি ঠিক আছেন তো?”
মানুষটা জবাব দিলেন না এই প্রশ্নের। কেবল চোখ থেকে তার অশ্রু গড়িয়ে পড়লো।