একজোড়া আগুন পাখি পর্ব ৩৫ (৩)
রনীতা তুশ্মি
ব্যস্থ শহরকে ছাড়িয়ে এক নির্জন প্রান্তে অবস্থানরত বিলাসবহুল রিসোর্টে এক জমজমাট পার্টির আয়োজন করা হয়েছে। চারপাশে গাছপালা আর সবুজে ঘেরা রিসোর্টটি রাতের আঁধারে এক মায়াবী রূপ ধারণ করেছে।
রিসোর্টের প্রধান লনে আলো ঝলমলে বাতি আর নানান রঙের ফেইরি লাইটে সাজানো। বাতাসে হালকা সুরেলা সঙ্গীতের ভেসে আসা সুর গুলো যেন রাতের অতিথিদের আমন্ত্রণ জানাচ্ছে। এক কোণায় ড্রিংকস কাউন্টার, সেখানে ওয়েটাররা নিপুণভাবে নানা রকম ককটেল তৈরি করছে। আরেক পাশে বুফে সাজানো, যেখানে স্থানীয় আর বিদেশি সবধরনের খাবারের আয়োজন।
মধ্যখানে একটি ছোট ড্যান্সফ্লোর। ডিজে মঞ্চে জনপ্রিয় গান বাজাচ্ছে, আর মানুষজন তালে তালে নাচছে। কেউ কেউ হাসি-ঠাট্টায় ব্যস্ত, আবার কেউ গাছের নিচে আরামদায়ক চেয়ার নিয়ে গভীর আলাপ করছে।
এসব ছাড়িয়ে একপাশে গাছের সাথে হেলান দিয়ে খানিকটা কাত হয়ে দাঁড়িয়ে রইছে কেনীথ। বুকে দু-হাত গুঁজে রাখা। চুলগুলো একদম সুন্দর ভাবে জেল দিয়ে সেট করা। কিন্তু পরনে তার সেই একরকমের কালো হুডি আর কালো প্যান্ট। হুডির টুপিটা পিঠের উপর উল্টো হয়ে ঝুলছে।
কেনীথের চোখেমুখে খানিকটা চিন্তার ছাপ। নজর তার আশেপাশে সবকিছুর দিকে হলেও সে ভিন্ন কিছু ভাবতে বসেছে। এখানে আসার পর মেয়ে ব্যতীত মোটামুটি সব ধরনের অতিথিদের সাথে তার সৌজন্যেমূলক কথাবার্তা হয়েছে। কেনীথের এই বিষয়টা সবার জানা। কেনীথ এমনিতে কোনো মেয়ের সাথে তেমন কথা বলবে না।এছাড়া ছেলেদের সাথেও সে তেমন প্রয়োজন ছাড়া কিছু বলে না।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
এই যেমন, হালকা একটু দেখা সাক্ষাৎ করে সবার থেকে দূরে গিয়ে একাই দাঁড়িয়ে রইছে। লোকেও আর তাকে বেশি বিরক্ত করে না। না জানে রেগে গিয়ে কখন কি করে।
কেনীথ নিজের বুকে গুঁজে রাখা দুহাত থেকে ডান হাতটা তুলে নিয়ে নিজের কপালে বুড়ো আঙ্গুল দিয়ে কয়েকবার ঘষলো। চিন্তার ছাপ যেন চেহেরা থেকে সরছেই না। কেনীথ চারপাশে একবার নজর বুলিয়ে নিলো। আপাতত পাভেলকে খুঁজছে। কেনীথ খেয়াল করে দেখলো, পাভেল বুফের কাছে প্লেটে খাবার সাজিয়ে নিয়ে খাওয়া দাওয়াতে প্রচুর ব্যস্থ হয়ে পড়েছে৷
পাভেলের পরনে আজ আর কোনো হুডি নেই। কেনীথের অনুমতি নিয়ে ইচ্ছে মতো সেজেগুজে একদম ক্যাজুয়াল ফরমাল লুকে পার্টিতে এসেছে। পরনে টাইট ফিটিং গ্রে কালারে শার্ট, কালো রংএর প্যান্ট আর জুতো। কোঁকড়ানো চুলগুলো পরিপাটি করে গোছানো।সবমিলিয়ে পাভেলকে একদম স্টাইলিশ আর ক্লাসি লাগছে। অথচ কেনীথের কাছে ওকে পুরো বলদের মতো লাগছে। মনে মনে ভাবছে, ও কি খাবার দাবার চোখে দেখেনি? যেখানেই যায় সেখানেই এমন হাঁদারামের মতো হয়ে থাকার কোনো মানে হয়? একটা কাজও ঠিকমতো হয় না।উল্টো সব জায়গায় কোনো না কোনো ঝামেলা বাঁধিয়ে রাখে। আর এখানে এসে বিন্দাসে খেতে বসেছে।
কেনীথ প্যান্টের পকেট থেকে নিজের ফোনটা বের করলো। অতঃপর পাভেলকে দূর থেকে দেখতে দেখতেই একটা মেসেজ পাঠালো। কেনীথ খেয়াল করে দেখলো পাভেল নিজের প্যান্টের পকেট থেকে ফোনটা তো ঠিকই বের করলো কিন্তু কোনোভাবেই ফোনের স্ক্রিনটা দেখে নিয়েই পুনোরায় ফোনটা নিজের পকেটে ঢুকিয়ে নিলো। অতঃপর আবারও খাবার খেতে ব্যস্থ হয়ে পড়লো।
এদিকে এসব দেখে কেনীথ পুরো হতবাক। এতোক্ষণ গাছে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে হইলেও এখন সম্পূর্ণ সোজা হয়ে পাভেলকে লক্ষ করছে। মেজাজটাও তার তুঙ্গে চলে গিয়েছে। ইচ্ছে করছে পাভেলকে ধরে এনে ইচ্ছে মতো কয়েকটা দিতে। কেনীথের নিজের রা*গ কন্ট্রোল করলো। এবার কোনো মেসেজ না দিয়ে সোজা কল করলো। কেনীথ পুনোরায় বুকে হাত গুঁজে গাছের সাথে হেলান দিলো। তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে রইলো পাভেলের দিকে।
এদিকে ফোন বেজে উঠতেই পাভেল প্রচন্ড বিরক্তি নিয়ে কিছু বিরবির করতে করতে, ফোন বের করলো। রা’গের বশে ফোন কাটতে নিয়ে হঠাৎ নামটা দেখে কলিজা ছ্যাত করে উঠলো। ফোনের স্ক্রিনে স্পষ্ট ভেসে রইছে “পি’শা’চরাজ কেনীথ পীর”
পাভেল জানে না এই বিষয়টা কখনো কেনীথের চোখে পড়লে কেনীথ ওর ঠিক কি হাল করবে। কিন্তু গত দু-তিন বছর ধরে সে কেনীথের নাম এটা দিয়েই সেভ করে রেখেছে। পাভেল তড়িঘড়ি করে আশেপাশে তাকালো। নজর পড়লো দূরে গাছের সাথে দাঁড়িয়ে থাকা কেনীথের দিকে। পাভেল কেনীথের দিকে তাকাতেই কেনীথ বিস্তৃত মুচকি হাসলো।
ওর হাসি দেখে পাভেল ঢোক গিললো। তবে ইতস্ততভাবে পাভেলও একগাল হেঁসে ফেললো। এটা দেখামাত্রই কেনীথ চোখমুখ শক্ত করে চোখ দিয়ে ইশারা করলো ফোন ধরতে। পাভেলও তড়িঘড়ি করে ফোন ধরতেই কেনীথ রুক্ষ কন্ঠে বললো,
“এক মূহুর্তও দেরী না করে এখানে আয়”
পাভেলও যথারীতি কেনীথের কাছে ছুটে এলো। তবে সঙ্গে করে খাবারের প্লেটটাও নিয়ে আসতে ভুললো না। কেনীথের কাছে আসতেই কেনীথ গম্ভীর সুরে বললো,
“কাহিনি কি তোর?”
পাভেল ঠোঁট চেপে ইতস্তত হেসে হাসার চেষ্টা করলো।
“রাম ছাগলের মতো হাসবি না।”
নিমিষেই পাভেল স্বাভাবিক হয়ে বললো,
“ঠিক আছে।”
—“কি ঠিক আছে!মেসেজ দিলাম খেয়াল করেও দেখছি না। ফোনও কেটে দিতে নিয়েছিলি। খাওয়া দাওয়া কখনো করিস না নাকি?আমি তোকে কোনো দিন অভুক্ত রেখেছিলাম যে এখানে এসে…”
—“ছি’হ ব্রো, এসব কি বলো। তুমি আমার সাথে কখনো এমনটা করতে পারো নাকি! আর এখানে তো সবাই এভাবেই পার্টি এনজয় করছে। শুধু তুমি বাদে…!”
কেনীথ বিরক্তির চাহনিতে পাভেলের দিকে তাকালো। মনটা চাচ্ছে এখানেই মে’রে গেঁ’ড়ে রাখতে।
—“ফালতু কথা না বলে কাজের কথা বল! যা করতে বলেছিলাম তা হয়েছে?”
পাভেল এবার থতমত খেয়ে গেলো। আমতাআমতা করে বলতে নিলো।
—“না মানে হ্যাঁ…”
—“যা বলার ঠিক মতো… ”
কেনীথের কথা এবার আর শেষ হলো না। বরং এর আগেই আশেপাশে হৈচৈ পড়ে গেলো। রিসোর্টের ভেতর গুনে গুনে তিনটা বিলাসবহুল গাড়ি প্রবেশ করেছে। প্রথম গাড়িটা লাল রংএর আর পেছনের দুটো কালো। গাড়ি গুলো থেমে যেতেই বেশিরভাগ লোকেরই সেদিকে গিয়ে ভীর জমালো।
কেনীথ আর পাভেলের নজরও এখন সেদিকেই। তবে কেনীথের কপাল কুঁচকে গিয়েছে। ও পাভেলকে উদ্দেশ্য করে বললো,
“এখানে আমি বাদে আরো কোনো গেস্ট আসার কথা ছিলো?”
পাভেল খানিকটা ইতস্তত হয়ে বললো,
“হুম, ঐ যে রকস্টার অ্যানা রয়েছে না!যার দেশে আসার কথা ছিলো।সেই এখানে এসেছে।”
কেনীথ ভ্রু উচিয়ে বললো,
“এ.টি.?
পাভেল মাথা ঝাঁকিয়ে বললো,
” হুম।”
কেনীথ যেন খানিকটা বিরক্ত হলো।
—“আমায় আগে বলিসনি কেনো?”
পাভেল এবার কি বলতে বুঝতে পারছে না। তবুও ইতস্ততভাবে বললো,
“আমি তো ভেবেছি এটা তেমন গুরুত্বপূর্ণ কিছু না তাই আর…”
কেনীথ তাচ্ছিল্যের সাথে হেসে বললো,
“কোনটা গুরুত্বপূর্ণ আর কোনটা অপ্রয়োজনীয় তা তুই বুঝলে তো কাজই হতো। সকল অপ্রয়োজনীয় জিনিসই তো কাজে গুরুত্বপূর্ণ আর সকল গুরুত্বপূর্ণ জিনিস তোর কাছে অপ্রয়োজনীয়। ভালোই করেছিস, ভাগ্য করে আমার কপালেই জুটেছিস।”
পাভেলের আর এতে কিছু বলার নেই। ছোট ভাই হিসেবে বড় ভাইয়ের দুই তিনটা গা’লাগা’লি হজম করা ব্যাপার না। অবশ্য সে নিজেও জানে, সে কাজকর্ম সত্যিই ঠিকঠাক করতে পারে না। ভুল জায়গায় সঠিক কাজ আর সঠিক জায়গায় ভুল কাজটা করে ফেলে।
তবে তাদের নজর গিয়ে পুনোরায় গাড়ির দিকে পড়লো। কালো গাড়ি দুটো থেকে ৮-১০ জন নেভী ব্লু রং-এর পোশাক পড়া বডি গার্ড বেড়িয়েছে। এরা সকলেই লাল গাড়ির সামনে সারিবদ্ধ হয়ে দাড়িয়ে। কেনীথ মনে মনে কিঞ্চিৎ হাসলো। মেয়ে মানুষ হলে যা হয়। একজনের জন্যই ৮-১০ জন বডিগার্ড।
এরপর লক্ষ করলো চকচকে লাল গাড়িটার দিকে। একজন গিয়ে দরজা খুলে দিতেই একটা অত্যাধিক স্টাইলিশ মেয়ে দৃশ্যমান হলো। একদম ফিনফিনে চিকন শরীরের উপর সিল্কের ডার্ক চেরী রেড কালারের স্লিট ড্রেস। যেটাও কিনা এক্সপেন্সিভ ডিজাইনার ব্র্যনান্ড এলি সাব নামক লেবানিজ ফ্যাশন ব্রান্ডের। এছাড়া দু কাঁধে উপর আলগা ভাবে ঝুলিয়ে রাখা কালো রংএর স্টাইলিশ জ্যাকেট। চোখে মুখে সেই বিশেষ মাস্কারেড মাস্ক।
অ্যানা গাড়ি হতে বের হয়েই সুনিপুণ ভঙ্গিতে নিজের বড় বড় চুল ঠিক করে নিলো। তার হাতে একটি মিনিমালিস্ট ক্লাচ। পায়ে ক্রিশ্চিয়ান লুবউটিন নামক প্রিমিয়াম ফ্যাশান ব্র্যান্ডের সিগনেচার স্টাইলের লাল সোলের কালো রংএর উঁচু হাই হিল। সে বের হওয়ার সাথে সাথেই বডিগার্ড গুলো সারিবদ্ধ হয়ে তাকে রাস্তা বানিয়ে দিলো। ক্যাটওয়াক স্টাইলে দক্ষতার সাথে হাঁটতে গিয়ে প্রতিবার কানে ঝুলতে থাকা দুটো চেরী ফল আকৃতির ইয়ার রিং গুলো নেচে উঠছে।
তবে আরো একটা জিনিস রয়েছে যা বারবার সদৃশ হচ্ছিলো। যে কারণে কেনীথ অনেকটা বিরক্ত হয়েই নিজের চোখ ফিরিয়ে নিলো।অ্যানার হাঁটা, তার অঙ্গভঙ্গি—সবকিছুতেই আভিজাত্যের পাশাপাশি আধুনিকতার ছাপ তা অবিশ্বাসের কিছু নয়। কিন্তু স্লিট ড্রেস পড়ায় প্রতিবার সমান তালে হাঁটার দরূন তার বাম পাশের সরু পায়ের হাঁটু থেকে খানিকটা উপর পর্যন্ত দৃশ্যমান হচ্ছিলো। যেটা নিত্যন্তই কেনীথের কাছে অনেক বেশি বিরক্তিকর লাগলো। আপাতত এসব মেয়ের দিকে ঘুরে তাকানোর আর কোনো ইচ্ছে নেই।
কেনীথ সেখান থেকে চলে যেতে নিলেই পাভেল জিজ্ঞেস করলো,
“হেই ব্রো, কোথায় যাচ্ছো?ওদের সাথে কথা বলবে না?”
কেনীথ গম্ভীর সুরে বললো,
“মুড নেই!”
—“মুড নেই মানে,একটু…”
—“বললাম তো, এসবে আমার কোনো ইন্টারেস্ট নেই।”
এই বলে কেনীথ চলে যেতে নিলেই দেখলো ওরা তাদের দিকে আসছে। পাভেল এটা দেখে হতভম্ব হয়ে বললো,
“ব্রো ওরা তো এদিকেই আসছে।”
কেনীথ নির্বিকার হয়ে বললো,
“আমি যাচ্ছি। ওদের বলে দিস আমাকে যেন বিরক্ত না করে।”
এটা বলেই কেনীথ আর এক মূহুর্তও দেরী করলো না । সেখান থেকে সোজা ড্রিংকস কাউন্টারের দিকে চলে গেলো। এদিকে পাভেল পুরো ইতস্তত হয়ে হাসার চেষ্টা করছে। কেননা অ্যানার সাথে থাকা পার্টি এরেঞ্জমেন্টের লোকগুলোও বিষয়টা বুঝে গিয়েছে। অ্যানাও বিষয়টা ভালো করেই বুঝেছে। কিঞ্চিৎ হাসলোও সে।
কেনীথ আর ওর সমস্যাটা অদ্ভুত। কেউই কাউকে চেনে না অথচ তবুও তাদের মধ্যে এক অদৃশ্য শ’ত্রুতা। মূলত কেনীথ পুনোরায় রকস্টার ইন্ডাস্ট্রিতে ফেরার পর যখনই ইন্টারন্যাশনাল ভাবে বাহিরে কনসার্ট করার কথা উঠেছে তখনই সে জায়গায় অ্যানা নিয়ে গিয়েছে। মূলত কেনীথের কনসার্ট বাতিল হয়ে সেখানে অ্যানার কনসার্ট হয়েছে। এছাড়া আরো ছোট-বড় কিছু ইন্ডাস্ট্রিয়াল ইস্যু ক্রিয়েট হয়েছে। যেসব কিছুতে ঘুরেফিরে কেনীথের বাঁধা হয়ে গিয়েছে অ্যানা। এটাই দুজনের মধ্যে সমস্যার মূল কারণ। অথচ এখন পর্যন্ত কেউ কারো সাথে কথাটাও পর্যন্ত বলেনি। কিন্তু কেনীথের বিশ্বাস এই মেয়ে ইচ্ছে করেই তার পিছনে লেগেছে। কেনীথ চলে গিয়েছে বিধায় অ্যানারাও অন্যদিকে ঘুরে ফিরে গেলো। তবে পাভেল সৌজন্যতা বজায় রাখতে অ্যানার সাথে দেখা করতে চলে গেলো।
Darlin’, can I be your favorite?
I’ll be your girl, let you taste it
I know what you want, yeah, just take it (take it)
Darlin’, can I be your favorite?
Want you to tell me you crave it
My name’s whatever you make it (make it)
I swear you’re heaven, but boy, you’re no angel
You take me places only we go
You’re so pretty, God, I swear that it’s painful
I whisper things only we know, put your hands around my neck, make me faithful….
আশেপাশে গানবাজনা শুরু হয়ে গিয়েছে। অ্যানা গান গাইছে, মিউজিক বাজছে, কেউ কেউ নাচছে, কেউ খাচ্ছে। সবমিলিয়ে গভীর রাতের জমজমাট পরিবেশ।পাভেল আপাতত কেনীথের পাছে এসে দাঁড়িয়ে রইছে ড্রিংকস কাউন্টারের কাছে। হাতে একটা ককটেল নিয়ে মজায় মজায় খেয়ে যাচ্ছে। অন্যদিকে কেনীথ তার পাশে দাঁড়িয়ে আজ অনেক দিন পর কয়েকবার ড্রিংকস করে নিয়েছে। মুডটা কেমন যেন বিগড়ে গিয়েছে। কারণটা তার জানা নেই।
এদিকে আজ কেনীথেরও গান গাওয়ার কথা ছিলো কিন্তু ও একদম পরিষ্কার করে পাভেলকে জানিয়ে দিয়েছে যে ও কোনো গান গাইবে না। যথারীতি পাভেলও বাধ্য হয়ে সবাইকে এ কথা বলে দিয়েছে। আপাতত এই নিয়ে কেনীথকে জোরাজুরি করে বিরক্ত করার মতো সাহস কারো নেই।
কিন্তু এমনিতেই প্রচুর বিরক্ত হচ্ছে। এই অ্যানা মেয়েটাকে চোখের সামনেই দেখতে ইচ্ছে হচ্ছে না। যদিও কেনীথ স্টেজের উল্টোদিকে ঘুরে ড্রিংকস করছে। তবুও অ্যানা এহেন গানের লিরিক্স শুনেই যেন শরীর জ্বলে যাচ্ছে। গান তো দুনিয়াতে বহুত রয়েছে, এসব ফালতু গান এখানে গাওয়ার কোনো মানে হয়।
এদিকে এই গান শেষ হতে না হতেই কেনীথ আরেটু ড্রিংকস করে নিয়েছি। পাভেলও কোনো নিষেধ করেনি। ও নিজেই পার্টি এনজয় করতে ব্যস্ত। কিন্তু কেনীথের নেশাগ্রস্ত হতে থাকা মস্তিষ্ক খানিকটা পর বিগড়ে গেলো। আচমকা অ্যানার ভিন্ন একটা গান শুনে। ও বাংলা গান গাইছে তবে সেটাও কিনা কেনীথের সিগনেচার সং “ভ্রমর কইও গিয়া”।
ভাইবে রাধারমণ বলে শোন রে কালিয়া
নিভা ছিল মনের আগুন কে দিলাই জ্বালাইয়ারে…
ভ্রমর কইও গিয়া।
ভ্রমর কইও গিয়া…
শ্রীকৃষ্ণ বিচ্ছেদের অনলে…
অঙ্গ যায় জলিয়ারে ভ্রমর কইও গিয়া
ভ্রমর কইও গিয়া…
শ্রীকৃষ্ণ বিচ্ছেদের অনলে…
অঙ্গ যায় জলিয়ারে ভ্রমর কইও গিয়া…
কেনীথ খানিকটা রাগান্বিত আর বিস্ময়ের সাথে পেছনে ফিরে অ্যানাকে দেখলো। কেনীথের মনে হলো সে পেছনে ফিরে তাকাতেই অ্যানা অন্যদিকে মুখ ফেরালো। এরমানে অ্যানার নজর হয়তো কেনীথকেই লক্ষ করছিলো। আবার কেনীথ এটাও খেয়াল করছে অ্যানা মুচকি মুচকি অদ্ভুত ভাবে হাসছে আর গান গাইছে।
এদিকে কেনীথ পাশে ফিরে তাকিয়ে পাভেলকে দেখলো। পাভেল একদম নির্বিকারে ককটেল খাচ্ছে। কেনীথ পাভেলকে এলোমেলো ভাবে জিজ্ঞেস করলো,
“হেই, ও কেনো এই গান গাইছে?”
পাভেল তব্দা খেয়ে কেনীথের দিকে তাকালো।কেনীথের প্রশ্নের উত্তরে কি বলা উচিত বুঝতে পারছে না। ইতস্তত হয়ে তবুও বলতে থাকলো,
“কেনো ব্রো! ভালোই তো গাইয়ে…”
—“দুনিয়ায় আর কোনো গান নেই। এটাই গাইয়ে হবে? এই মেয়ে চায় টা কি?”
—“কোনো সমস্যা হলে…আমি কি না করে আসবো?”
কেনীথ কপাল কুঁচকে কিছু একটা ভেবে বললো,
“থাক, দরকার নেই।”
এই বলেই কেনীথ আবারও ড্রিংকস করতে শুরু করলো। একেবারে উম্মাদের মতো তিন চার গ্লাস খেয়ে নিলে পাভেল তাড়াহুড়ো করে বাঁধা দেয়। ও ধান্দায় খেয়াল করেনি প্রথমে। এদিকে কেনীথের অবস্থা খারাপ হয়েছে। মাথা রীতিমতো চক্কর দিচ্ছে। নিয়মিত ড্রিংকস করার অভ্যাস নেই তার। মাঝেমধ্যে বেশি খেয়ে নিলে আর নিজের মধ্যে থাকে না।
পাভেল গিয়ে কেনীথকে ধরতেই কেনীথ ওকে বললো যেন তাকে রিসোর্টের ভেতরে নিয়ে যাওয়া হয়। এমনিতেই এখানে অনেক বেশি অস্থির লাগছে তার। পাভেলও যথারীতি কেনীথকে নিয়ে রিস্টার্টের ভেতরে চলে গেলো। কেনীথের জন্য আলাদা রুম ঠিক করে রাখা হয়েছে। পাভেল ওকে নিয়ে সেখানেই গেলো।
রুমে পৌঁছাতেই কেনীথ কোনোমতে জুতোটা খুলে বিছানায় লেপ্টে শুয়ে পড়লো। পাভেলকেও নিষেধ করলো যেন ওকে কোনো বিরক্ত না করা হয়। পাভেলও কেনীথের কথা মতো রুমের লাইটটা বন্ধ করে, দরজাটা পেছন থেকে লাগিয়ে দিয়ে চলে গেলো।
তবে কেনীথের কিছুটা অদ্ভুত লাগছে। যতই সে নেশা করুক না কেনো আজ যেন একটু বেশিই খারাপ লাগছে।আনায়া চলে যাওয়ার পর দেড় বছর তো কম নেশা করেনি সে। তখন তো এতো এমনটা হয়নি। অথচ আজ মাথাই যেন তুলতে পারছে না। তার সবকিছুই যেন আপনা-আপনি অচল হয়ে যাচ্ছে। নিমিষেই কেনীথ অন্ধকার ঘরে নিদ্রার অতলে ডুবে গেলো।
গায়ে ধবধবে সাদা রংএর কমফোর্টার জড়িয়ে উপর হয়ে শুয়ে রইছে কেনীথ। অতিরিক্ত নেশার দরুন এখন চোখজোড়াও খুলতে পারছে না। ঘুম অনেকটাই ভেঙ্গে গিয়েছে তার। কিন্তু নেশার রেশ এখনো কাটেনি। মূলত কেনীথ এসবে খুব বেশি অভস্ত্য নয়। আনায়ার চলে যাওয়ার পর মাঝেমধ্যে খেয়েছে। আবার কখনো একেবারে ছেড়ে দিয়েছে। এভাবেই চলতো। কিন্তু গতকাল রাতে হয়তো একটু বেশিই অভার ডোজ হয়ে গিয়েছিলো।
কেনীথ কোনমতে চোখখুলে উঠে বসার চেষ্টা করলো। বাহির থেকে দিনে আলো হুড়মুড়িয়ে রুমে ঢুকছে। আচমকা আলোর প্রতিফলন চোখে পড়তেই কেনীথের মাথায় পুরো ঘুরে গেলো। খানিকটা সময় নিয়ে নিজেকে স্বাভাবিক করার পর খেয়াল করলো সে আজ একদম ঠিকঠাক নেই। সম্পূর্ণ বস্ত্রহীন সে। কেনীথের মাথা আসছে না কাল রাতে ঠিক কি হয়েছে। ওর কেনো এই অবস্থা! মস্তিষ্কে খানিকটা জোর খাটাতেই কেনীথ পুরো আঁতকে উঠলো। আগে-পিছে সব ছেড়ে মাথায় শুধু একটা নামই এলো, তা হলো ইনায়া।
কেনীথ পাগলের মতো অস্থির হয়ে আশেপাশে তাকাতেই তার নজর পড়লো বিছানারই একপাশের কোণায় উল্টো ঘুরে গুটিসুটি বসে থাকা একটি মেয়ের দিকে। মেয়েটির পরনে ধবধবে সাদা রংএর বাথরোব। বড় বড় সিল্কি চুল হতে টপটপ করে পানি ঝড়ছে।
কেনীথ সম্পূর্ণ হতভম্ব হয়ে গেলো। এসব তো হওয়ার কথা ছিলো না তবে সে কি করে…! কেনীথ হিতাহিতজ্ঞানশূন্য হয়ে পড়লো। দ্রুত প্যান্টটা খুঁজে নিয়ে পড়ে নিয়ে দাঁড়িয়ে গেলো। দুহাত দিয়ে মুখ ঢেকে জোরে জোরে কয়েকবার দীর্ঘ শ্বাস ফেললো। মেয়েটির কাছে এগিয়ে যাওয়ার সাহস হচ্ছে না। একে তো নেশাগ্রস্ত মস্তিষ্ক, এর উপর এক অপ্রত্যাশিত সকালের সূচনা।
কেনীথ তবুও মেয়েটির দিকে এগিয়ে গেলো। মেয়েটি মাথা খানিকটা নিচু করে রেখেছে। চুলগুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে। মুখটা সরাসরি দেখা যাচ্ছে না। কেনীথ মেয়েটির কাছে গিয়ে কি করবে,কি বলবে বুঝে উঠতে পারছে না। নিজেকেই তো তার অসহ্য লাগছে। কেনীথ অস্থির হয়ে গিয়েছে; মেয়েটির সামনে গিয়েই হাঁটু গেঁড়ে নিচে বসে পড়লো।
আগে-পিছে কোনো কিছুর ভাবার সময় নেই এখন। প্রবল অনুশোচনা নিয়ে মাথা ঝুকিয়েই বলতে থাকলো,
“আ’ম সরি ইরা। আই রিয়েলি ডোন্ট আন্ডারস্ট্যান্ড…ইরা আমি… ”
কেনীথ কি বলবে জানে না। এমনিতেই সে কিছু বলে উঠতে পারছে না।বলার মতো যেন কোনো ভাষাই খুঁজে পাচ্ছে না। মাথা উঁচু করে তাকিয়ে যে ক্ষমা চাইবে সেই সক্ষমতাও হচ্ছে না তার। এদিকে তাকে এক প্রকার বিস্মিত করে দিয়ে মেয়েটি কেনীথের চুলে নির্বিকার ভঙ্গিমায় নিজের হাত বুলিয়ে দিতে দিতেই বললো,
“হোয়াই আর ইউ ফিলিং সো গিলটি, বেইবি?”
এহেন কন্ঠস্বরে কেনীথ সম্পূর্ণরুপে চমকে উঠলো। নিমিষেই কপালে ভাজ পড়ে গেলো। মাথা উঁচিয়ে মেয়েটিকে দেখে নেওয়ার আগেই মেয়েটি নিজের ডান হাতের তর্জনী আর বৃদ্ধা আঙ্গুলের সাহায্যে কেনীথের গ্রীবার খানিকটা নিচে নরম অংশে জোরে চেপে ধরলো। মেয়েটির হাতের সুদক্ষ ভাবে সাজানো হাতের ডার্ক চেরী রেড কালারে বড় বড় নখগুলোর দরূন কেনীথের পাতলা চামড়া ভেদ করে যেন মাং’সে ডেবে যাবে।
মেয়েটি নিজ থেকেই গ্রীবায় আরেকটু জোরে চাপ দিয়েই নিজের দিকে কেনীথের মুখ উঁচিয়ে ধরলো। মেয়েটির ঠোঁটের কোণায় দিব্বি বিস্তৃত রুক্ষ হাসি ঝুলছে। একজোড়া শান্ত চোখে এক অদ্ভুত চাহনি। এদিকে মেয়েটির নখ কেনীথের গলার চামড়া ভেদ করে মাং’সে ডেবে গিয়ে অনবরত র”ক্তের ফোঁটা ঝড়ছে। অথচ কেনীথের এসবে কোনো হুস নেই।
একজোড়া আগুন পাখি পর্ব ৩৫ (২)
কপাল কুঁচকানো চেহেরায় এখন সর্বস্ব জুরে প্রগাঢ় বিস্ময়। সামান্য কিছু ভাবনা চিন্তা করার মতোও সক্ষমতা নেই। ভেবে উঠতে পারছে না এটা সপ্ন নাকি সত্যি। মস্তিষ্ক যেন কাজ করাই বন্ধ করে দিয়েছে। এদিকে তাকে আরেকটু অবাক করে দিতে মেয়েটি মুচকি হেঁসে চোখ মে’রে বললো,
“মাই ডিয়ার হাব্বি! তুমি আমায় দেখে খুশি হওনি? ইট’স মি,…ইয়োর বিলােভড ব্লাড।”