আযদাহা সিজন ২ পর্ব ৩০
সাবিলা সাবি
গভীর রাত। এল্ড্র রাজ্যেতের আকাশ আজ অন্ধকার, ভেনাসটুকু সেঁটে রাখা হয়েছে এক কালো চাদরে। বাইরে বৃষ্টি ঝরছিল অনবরত, বিশাল বিশাল ফোঁটায়।এ এক মন্ত্রমুগ্ধ রাত,যেখানে সিলুয়েটের মতো ভেসে ওঠা প্রাসাদ আর ভিজে জমে থাকা মাটি মনে হচ্ছিল এক আশ্চর্য জগৎ।
দূরের প্রাসাদে টিম টিম করে জ্বলছে আভা, কিন্তু পাহাড়ঘেরা সেই একান্ত এল্ড্র প্রাসাদের কক্ষে, জ্যাসপার আর ফিওনা একসঙ্গে।
বৃষ্টিতে পুরো ভিজে গিয়েছিল ফিওনা চেহারা ম্লান হয়ে আছে বৃষ্টির কুয়াশায়। বৃষ্টির জলে ভিজে থাকা ফিওনার দিকে তাকিয়ে, জ্যাসপার চুপ করে উঠে গেলো। চুপচাপ এগিয়ে এসে তার পাশে দাঁড়িয়ে ফিওনার চুলের দিকে তাকালো।এরপর, খুবই সাবধানে, তোয়ালে তুলে ফিওনার চুলের দিকে নিয়ে গেলো।
এক হাতে চুলগুলো টাওয়াল দিয়ে মুছে দিতে শুরু করলো,অন্য হাতে টাওয়েলটা মৃদু করে চালাচ্ছিল,
ফিওনার চোখে কোনো কথা ছিল না,তবে তার দেহের প্রতিটি অংশ, চুপচাপ স্বেচ্ছায়,জ্যাসপারের আদরের মধ্যে হারিয়ে যাচ্ছিল।
কিছুক্ষণ পর, যখন ফিওনার চুল বেশ শুকিয়ে গেছে, তখন জ্যাসপার তার হেয়ার ড্রায়ার নিয়ে আসলো আর ধীরে ধীরে ফিওনার ভেজা চুলগুলো শুষ্ক করে দিলো। প্রতিটি হাওয়া,প্রতিটি দম ফিওনার চুলে অদ্ভুতভাবে সজীবতা এনে দিচ্ছিল। তার গায়ে এখন জ্যাসপারের বড় একটি সাদা শার্ট, যেটা হাঁটু পর্যন্ত নেমে এসেছে। তার ছোট্ট শরীরটি শার্টের মধ্যে পুরোপুরি হারিয়ে গেছে, নতুন এক আবরণে। ফিওনার চোখ মুহুর্তেই ফাঁকা হয়ে আসে, গভীর কোনো চিন্তায় সে মগ্ন হয়ে যায়।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
— “ফিওনা?” জ্যাসপার চিন্তিত কণ্ঠে ডাকল।
কিন্তু ফিওনার চোখে এখন অতীতের ছায়া।
হঠাৎ, ফিওনা চুপচাপ বলে উঠলো,
— “আমি… তোমাকে আগের জন্মেও ভালোবাসতাম, তাই না?”
জ্যাসপার থমকে গেলো।
— “কিভাবে?”
ফিওনার কণ্ঠ কাঁপছে, চোখে অশ্রু।
— “অতীতে…যখন তুমি আমাকে প্রথমবার চিঠি দিয়েছিলে…আর আমার সব পছন্দের ফুল দিয়েছিলে সেদিন তোমার দেয়া চিঠিটা যখন পড়েছিলাম আমার হ্নদস্পন্দন থেমে গিয়েছিলো।
জ্যাসপার নিঃশব্দে বসে রইলো।
তার ঠোঁট নড়লো না, কিন্তু চোখে ফুটে উঠলো ব্যথা।
ফিওনা ধীরে ধীরে তার দিকে এগিয়ে এল।
— “তুমি তখনও এমন উন্মাদ ছিলে,তাই না? তখনও আমার কাছাকাছি ছিলে, অথচ আমি কিছুই বুঝিনি।”
জ্যাসপার কিছু না বলে মাথা নিচু করল।
ফিওনা হঠাৎ তার মুখটা জোর করে উপরের দিকে তুললো।
— “তুমি কী জানো, আমি কতো বছর ধরে সেই মিথ্যা একটা সম্পর্কে ছিলাম, ভুল একটা মায়ায় জড়িয়ে ছিলাম?” তার কণ্ঠে অভিমান, চোখে জল।
— “আজ এতদিন পর আমার সব মনে পড়ে গেলো আর অতীতের সেই ভুলটাও আমি বুঝতে পারলাম,আর আমি বুঝলাম, আমি সবসময় তোমাকেই খুঁজছিলাম, তোমাকেই ভালোবেসেছিলাম।”
জ্যাসপারের ঠোঁট নড়লো, গলার স্বর কাঁপছে।
— “তুমি যদি সব জানো… তবে আমাকে ঘৃণা করা উচিত তোমার কারন আমি অনেক ঘৃ*ণিত কাজ করেছিলাম।”
ফিওনা জবাব দিলো না। শুধু ধীরে ধীরে জ্যাসপারের দিকে এগিয়ে গিয়ে তার বুকের উপর মাথা রাখলো।
চুপচাপ। নিঃশব্দে।
তারপর বলল,
— “আমি তোমাকে ঘৃণা করতে পারিনি কখনোই প্রিন্স… আমি তো তোমায় ভালোবেসে ফেলেছিলাম অনেক আগেই…”
জ্যাসপারের হাতগুলো ধীরে ফিওনার পিঠে জড়িয়ে এলো। তার গলার স্বরে কেমন এক ভাঙা সুখ,
— “তুমি এমন একজনকে ভালোবেসেছো হামিংবার্ড… যে তোমাকে পাওয়ার জন্যে, যে কাউকে নৃ*শংস ভাবে মারতে পারে সে যতোই নির্দোষ হোক না কেনো…”
বাইরে বৃষ্টি থেমেছে। মেঘের আড়ালে ফুটে উঠেছে তারার আলো।…
গভীর রাত, এল্ড্র রাজ্যর অন্ধকারে এক নিঃশব্দ শান্তি। ফিওনা আর জ্যাসপার বিছানায় পাশাপাশি শুয়ে ছিল, একে অপরের কাছে আসার জন্য প্রস্তুত। ফিওনার শরীর ক্লান্ত, তার মনে অদ্ভুত এক শূন্যতা, কিন্তু তার পাশেই জ্যাসপার—যে তার মানসিক শান্তি এনে দেয়।
ফিওনা ধীরে ধীরে তার হাত দিয়ে জ্যাসপারকে নিজের দিকে টানল। একে অপরকে কাছাকাছি পেলো, কিন্তু ঠিক তখনই জ্যাসপার তার কপালে এক কোমল চুমু দিয়ে বললো, “তোমার শরীর এখন ক্লান্ত। সবেমাত্র ট্রমা থেকে উঠে এসেছো, এখন বিশ্রাম করো।”
ফিওনার চোখে মায়ার ঝিলিক, তার শরীরের সমস্ত ক্লান্তি যেন এক মুহূর্তে দূরে চলে গেলো। তার ভিতরে এক অদ্ভুত প্রশান্তি প্রবাহিত হচ্ছিল।
“পরের রাতে আর ছাড় দিবো না তোমাকে হামিংবার্ড,”—জ্যাসপার মিষ্টি কণ্ঠে বললো, প্রেমময় প্রতিজ্ঞা ছিল তার কথায়।
ফিওনা হালকা এক হাসি দিয়ে চোখ বন্ধ করলো। তার মনে ছিল না আর কিছু, শুধু তার পাশে জ্যাসপার, তার সমস্ত সমর্থন, ভালোবাসা।
এরপর তারা একে অপরকে আরও কাছে টেনে নিয়ে একে অপরের শরীরে জড়িয়ে ঘুমিয়ে পড়লো। দুটি হৃদয়, একসাথে, এক গভীর ভালোবাসায়।
সকাল বেলা, সূর্যের প্রথম রশ্মি এল্ড্র রাজ্যে প্রবাহিত হতে শুরু করলো। ফিওনা মৃদু চোখ মেললো। তার শরীর এখনও কিছুটা ক্লান্ত, কিন্তু এক অদ্ভুত শান্তি অনুভব করছিল।
জ্যাসপার ঘুমন্ত অবস্থায় পাশে ছিল।নিস্তব্ধতায় তার নিঃশ্বাস আসছিল।
ফিওনা জ্যাসপারকে ডেকে তুললো। দুজনে একসাথে ওয়াশ রুমে প্রবেশ করেছে। ফিওনা জ্যাসপার একসাথে ওয়াশরুমে দাঁড়িয়ে ছিল। চারপাশে স্নিগ্ধ আলো আর স্নানঘরের নিরবতা ছিল তাদের একে অপরের প্রতি ঘনিষ্ঠতা আরো বাড়িয়ে দিচ্ছিল।
জ্যাসপার মৃদু হাসি দিয়ে ফিওনার দিকে তাকিয়ে বলল, “এটা প্রথম সময় এল্ড্র রাজ্যর প্রাসাদে আমাদের একসাথে দাঁত ব্রাশ করা, তাই না?”
ফিওনা একটু লজ্জা পেয়ে মাথা নিচু করে বলল, “হ্যাঁ, আমি কখনো ভাবিনি এরকম কিছু ঘটবে।”
জ্যাসপার তার হাত দিয়ে টুথপেস্ট লাগাতে লাগলো, তারপর ধীরে ধীরে ফিওনার কাছে এগিয়ে এসে তার টুথব্রাশে টুথপেস্ট লাগিয়ে দিলো। ফিওনা তার দৃষ্টি এড়িয়ে কিছুটা নীরব হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল, কিন্তু এক মুহূর্তে তার হাতটাও জ্যাসপারের হাতের সাথে স্পর্শ হয়ে গেল। সেই স্পর্শে ফিওনা অনুভব করলো, তার হৃদয়ের প্রতিটি স্পন্দন আরও দ্রুত হয়ে উঠছে।
জ্যাসপার তার চোখে মুচকি হাসি নিয়ে বলল, “তুমি জানো, আমি তোমাকে যতই কাছে পেতে চাই, ততই তোমার জন্য একটু বেশি অপেক্ষা করতে ইচ্ছুক। কারণ, তুমি যখন আমার কাছে থাকবে, তখন ভেনাস আমার কাছে সবচেয়ে সুন্দর হয়ে উঠবে।”
ফিওনার চোখে চমক জাগলো,সে ধীরে ধীরে তার চোখে চোখ মেললো। “আমাদের কাছাকাছি থাকার মাঝে আর কোনো বাধা আসবেনা,কারন যতক্ষণ আমরা একসাথে আছি ততক্ষণ আর কোনো কিছুর পরোয়া আমি করিনা।” ফিওনা তাঁর দিকে একটু ঝুঁকে এসে বলল,নিজের অনুভূতি প্রকাশ করলো।
একটু পরে তারা দুজনেই দাঁত ব্রাশ করতে করতে একে অপরকে চোখে চোখে কিছু কথার পরিমাণ শেয়ার করতে লাগলো, তারা দুইজনই একে অপরের মধ্যে এক গভীর সম্পর্ক অনুভব করছিল। একে অপরের মুখের ছোট ছোট হাসি আর অনুভূতি পুরো ভেনাসকে পেছনে ফেলে রেখেছিল। তাদের মধ্যে এমন এক শান্তি ছিল,যে শান্তি বাইরে থেকে দেখা যাবেনা,কিন্তু একে অপরকে অনুভব করতে পারা এই মুহূর্তে ছিল তাদের জীবনের সবচেয়ে সুন্দর অনুভূতি।
হালকা রোদ যখন এল্ড্র রাজ্যের আকাশে ফুটতে শুরু করলো, তখন সার্ভেন্ট এসে খাবার দিয়ে গেলো। কিন্তু জ্যাসপার নিজেই উঠে,এক হাতে ট্রে ধরে, অন্য হাতে একটি সোনালী চামচ নিয়ে ফিওনার কাছে এল।
“ফিওনা,” সে মৃদু হাসল, “ব্রেকফাস্ট চলে এসেছে, আমি নিজের হাতে খাওয়াবো তোমাকে।”
ফিওনা একটু অবাক হয়ে তাকালো। কিন্তু জ্যাসপার তার দিকে এমনভাবে তাকাচ্ছিল তার চোখে পুরো ভেনাসটাই ছিল। ফিওনা কিছু বলার আগেই, জ্যাসপার চামচে পোর্ট করা ফল তার মুখের কাছে নিয়ে গেলো। “খাও, তোমার পছন্দের ফল,” সে বললো।
জ্যাসপার ধীরে ধীরে তাকে আরও কিছু খাবার খাইয়ে দিতে লাগলো। ফিওনার মনের মধ্যে অদ্ভুত উষ্ণতা ছড়িয়ে পড়লো, কত কত মাস সে এই সময়গুলো অনুভব করেনি।
ফিরে তাকিয়ে, জ্যাসপার বললো, “তোমার রাতের ড্রেসটা আমি ভালো করে ধুয়ে শুকিয়ে রেখেছি। এখন রেডি হয়ে নাও।”
ফিওনা সেদিকে তাকালো, তারপর ড্রেসটি হাতে নিয়ে ওয়াশরুমে গিয়ে পরতে শুরু করলো। যখন সে তৈরি হয়ে বের হয়ে এলো,তখন জ্যাসপার মৃদু হেসে বললো,
“তোমাকে ফ্লোরাস রাজ্যে নিয়ে যাবো। আগামীকাল, ড্রাকোনিসকে নিয়ে তোমাদের প্রাসাদে যাবো। ভেনাসের নিয়মে আমাদের বিয়ে হবে। তারপর তুমি আর আমি একসাথে পুরোপুরি মিলিত হয়ে যাবো। কোনো বাধা আর আমাদের ভালোবাসাকে আটকে রাখতে পারবে না।”
ফিওনার চোখে একটু আর্দ্রতা ছিল, কিন্তু সে মৃদু হাসলো আর বললো, “আম রেডি, প্রিন্স।”
এল্ড্র রাজ্য থেকে ফ্লোরাস রাজ্যের দিকে গন্তব্যে রওনা হওয়ার সময়, জ্যাসপার আর ফিওনা গাড়ির সিটে বসে শান্তভাবে চলছিল। পেছনে, এল্ড্র রাজ্যের রহস্যময় পাহাড়ি রাস্তা ক্রমেই তাদের ছেড়ে যেতে লাগলো, আর ফ্লোরাস রাজ্যের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল তারা। তবে হঠাৎ, একটা অদ্ভুত উপস্থিতি তাদের পথ আটকায়।
গাড়ির সামনে একটা দীর্ঘ, তীক্ষ্ণ ছায়া দেখা দেয়। লিউ ঝান। তার মুখে এক তীব্র আর অপ্রত্যাশিত রূদ্ধতা ছিল। তার চোখের গহীনতা প্রতিটি মুহূর্তকে জ্বালিয়ে দিতে চাচ্ছিল।
জ্যাসপার গাড়ি থেকে নেমে দ্রুত বের হয়ে এল, তারপর ফিওনাকে তার পাশে দাঁড় করিয়ে, গম্ভীর সুরে বলল, “তোর সাথে হিসেব বাকি। তবে এখানে না, চল পাহাড়ের ওপর।” তার কণ্ঠে রাগ আর দৃঢ়তার এমন এক মিশ্রণ ছিল, যা লিউ ঝানকে প্রভাবিত না করেই থাকতে পারবে না।
ফিওনা কিছুটা শঙ্কিত, তবে তাকে এই পরিস্থিতিতে সামলানোর অভ্যস্ত জ্যাসপারকে অনুসরণ করলো। তারা তিনজন একসাথে, পাহাড়ের পথে পা বাড়ালো।
ভেনাসের এক দুর্গম পাহাড়ের শীর্ষে, তারা মুখোমুখি দাঁড়িয়ে ছিল।এখন, দুই পুরুষ—জ্যাসপার আর লিউ ঝান—মুখোমুখি দাঁড়িয়ে ছিল। কিন্তু ফিওনা, তার অবিশ্বাস্য সাহসিকতার সাথে, জ্যাসপারের পাশে দাঁড়িয়ে ছিল। তার হৃদয় মনে হচ্ছিল ধুকপুক করছিল, কিন্তু সে জানতো—এই মুহূর্তে তাকে শক্ত থাকতে হবে।
জ্যাসপার আর লিউ ঝান একে অপরকে গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল, মনে হচ্ছে শত্রু নয়, দুটি পুরনো বন্ধুর মধ্যে এক অনির্ণীত যুদ্ধের প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
ফিওনা সেদিকে তাকাল, সবার মধ্যে একটা অদ্ভুত বিরোধের অনুভূতি ছিল, কিন্তু সে কোন কিছুই বলল না। শুধু জ্যাসপারের পাশে দাঁড়িয়ে, চোখে তার অস্বস্তি ছিল, কিন্তু মন যেন এই যাত্রার জন্য প্রস্তুত ছিল।
পাহাড়ের শীর্ষে হঠাৎ হাওয়ার গতি আরও বেড়ে যায়। চারপাশে কুয়াশার মতো এক থমথমে নীরবতা। ঠিক তখনই, লিউ ঝান এক পলকে এগিয়ে আসে ফিওনার দিকে, তার হাতটা শক্ত করে ধরে টেনে বলে ওঠে—
“চলো ফিওনা। তোমাকে জোর করে ওর সাথে থাকতে হবেনা। যতই ও তোমাকে ভয় দেখাক, ওর কাছে তোমার ভয় পেয়ে থাকার দরকার নেই। এবার যা হয় হোক, শেষ পর্যন্ত লড়বো আমরা—আমাদের জন্য,আমাদের মুক্তির জন্য।”
ফিওনা হতবাক। তার হাতটা লিউ ঝানের শক্ত মুঠোয়, কিন্তু সে কিছু বলার আগেই, এক ঝড়ের গতিতে জ্যাসপার এগিয়ে আসে। তার চোখে আগুন, দৃষ্টিতে শীতল ক্রোধ। সে এক ঝটকায় লিউ ঝানের হাত চেপে ধরে, তার কণ্ঠ তীক্ষ্ণ আর কম্পমান—
“তোর সাহস তো কম না… আমার ফিওনার হাত ধরেছিস?”
তার চোখে রক্তিম আভা খেলে যায়, মুহূর্তেই আগুনে পরিণত হবে সে।
“ওর হাত ছাড়, লিউ ঝান… না হলে তোর হাত, তোর সাথেই থাকবে না।”
সেই মুহূর্তে পাহাড়ের বাতাস থমকে যায়। তিনজন দাঁড়িয়ে—দুজন মুখোমুখি, আর ফিওনা দাঁড়িয়ে আছে মাঝখানে, এক অস্থিরতার কেন্দ্রে। তাদের চারপাশে কেবল নিঃশব্দ পাহাড় আর দিনের তেজি আলো আর মাঝখানে জমে ওঠা অদৃশ্য এক যুদ্ধের সূচনা।
পাহাড়ের চূড়ায় বাতাস তখনও কাঁপছে আগুনের উত্তাপে। জ্যাসপার আর লিউ ঝান মুখোমুখি দাঁড়িয়ে, মাঝখানে ফিওনা—তার চোখে কষ্টের ছায়া, বুকজুড়ে ভার।
হঠাৎই ফিওনা হাতটা ঝাড়া মেরে মুক্ত করে নিজেকে। তার কণ্ঠ শান্ত কিন্তু দৃঢ়—
“সরি, লিউ ঝান… আমার সব মনে পড়ে গেছে। আমার স্মৃতি ফিরে এসেছে।”
লিউ ঝান স্তব্ধ। তার চোখে বিস্ময় আর বেদনার একসাথে ঢেউ খেলে যায়। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে সে ফিসফিস করে বলে—
“তাহলে আমাদের অতীত? তার কী হবে, ফিওনা? তুমি তো আমাকে ভালোবাসতে। অতীতের জন্মের ভালোবাসার চেয়ে কি বর্তমানের ভালোবাসা বেশি গুরুত্বপূর্ণ তোমার কাছে?”
ফিওনার চোখ নিচু হয়ে যায়। সে নিঃশব্দে একটুখানি হাসে, এক নিঃশ্বাসে বলে ওঠে—
“সরি… আমি বুঝে গেছি, লিউ ঝান। আর তুমিও বোঝো, প্লিজ। আমি আগের জন্মেও জ্যাসপারকেই ভালোবাসতাম। একটা ভুল বোঝাবুঝিতে আমি তোমার সাথে জড়িয়ে পড়েছিলাম। তবে… তোমার প্রতি আমার যে মায়া ছিল, তা কখনও মিথ্যা ছিল না। আমরা একসাথে অনেক সুন্দর সময় কাটিয়েছি… অনেক স্মৃতি আছে আমাদের। কিন্তু সেটা শত বছর আগের কথা। অতীত মানেই অতীত।
বর্তমানে… আমার বর্তমান আর ভবিষ্যতে আছে কেবল প্রিন্স। আগের জন্মে যা-ই হয়ে থাকুক, এই জন্মে… ফিওনা শুধুই জ্যাসপারকেই ভালোবেসেছে।”
তার গলার শব্দ ভিজে যায়, কিন্তু সে শক্ত থাকে। লিউ ঝানের চোখে তখন এক নিঃশব্দ বিদায়ের ধোঁয়া। পাহাড়ের ওপরে এক অতীত চিরতরে হারিয়ে যায়, আর সামনে দাঁড়িয়ে থাকা দুটি হৃদয় গড়ে তোলে এক নতুন ভবিষ্যৎ।
পাহাড়ের শীর্ষে দাঁড়িয়ে থাকা তিনটি প্রাণ, তিনটি হৃদয়ের টানাপোড়েন মুহূর্তেই জমাট বাধে। বাতাস স্তব্ধ, আকাশ নীরব। তখন লিউ ঝান হঠাৎ বলে ওঠে—
“তুমি কীভাবে ভুলে যাচ্ছো, ফিওনা? আমাদের সেই সব মুহূর্ত… হোক না শত বছর আগের, আমি এখনো তোমাকে মন থেকে মুছে ফেলতে পারিনি। তাহলে তুমি পারলে কিভাবে?”
ফিওনার চোখে জল চিকচিক করে ওঠে, কিন্তু তার কণ্ঠে থাকে দৃঢ়তা। ধীরে ধীরে সে বলে—
“লিউ ঝান… একটা সত্যি কথা বলি, শুনে হয়তো তোমার খারাপ লাগবে, তবুও বলতেই হবে।
আমি প্রেমে পড়েছিলাম… কিন্তু তোমার নয়। আমি প্রেমে পড়েছিলাম সেই চিঠির, সেই ফুলের, সেই অনুভবের… যে আমাকে কখনো দেখা দেয়নি, তবুও প্রতিবার অনুভব করিয়েছে তার উপস্থিতি। আমি তাকে স্বপ্নে দেখতাম, অনুভব করতাম… আর ভাবতাম তুমি-ই সে। কিন্তু না—সেই ছায়া, সেই অনুভব… আসলে ছিল থেরন।”
তার চোখ ভিজে যায়, সে এক মুহূর্ত থেমে আবার বলে—
“আগের জন্মে আমি থেরনকে ঘৃণা করতাম। কারণ সে ছিল অন্যরকম—অহংকারী, রুক্ষ। আর তুমি ছিলে নরম, শান্ত তোমার প্রতি আলাদা ভালো লাগা কাজ করতো মায়া কাজ করতো। তোমার প্রতি প্রেমের যে অনুভূতি আমার জন্মেছিল, তা শুধু চিঠি থেকে এসেছিল। কিন্তু লিউ ঝান… সেই চিঠি তুমি লেখোনি।
সবকিছু বাদ দাও… আমি একটা কথাই পরিষ্কার করে বলি।
আগের জন্মে কায়রা জাইরনকে যতোটা ভালোবাসতো, তার থেকেও অনেক… অনেক অনেক বেশি ভালোবাসে ফিওনা তার প্রিন্স জ্যাসপারকে।
তুমি আমাদের মাঝে থেকো না, লিউ ঝান। আমাদের ভালোবাসার পথ থেকে সরে দাঁড়াও। আমাকে ক্ষমা করে দিও। প্লিজ… আমাদের মিলনে বাধা হয়ো না।
আমি সারাজীবন তোমাকে আমার প্রিয় বন্ধুর চোখে দেখব—এই প্রমিজ রইলো।”
জ্যাসপার তখন ফিওনার হাত শক্ত করে ধরে। আর লিউ ঝান… এক নিঃশ্বাসে হারিয়ে যায় তার সমস্ত আশা, কিন্তু ফিওনার মুখের সেই দৃঢ়তা দেখে সে বুঝে যায়—ভালোবাসা কখনো জোরে ধরে রাখা যায় না। ভালোবাসা মানেই মুক্তি।
লিউ ঝান গভীর নিঃশ্বাস নিলো, চোখে একরাশ বিষাদ। ফিওনার দিকে তাকিয়ে বলল,
“কারো মনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে কাউকে হাসিল করা যায় না। আমি সেক্রিফাইস করতে জানি। যাকে ভালোবাসি, তার সুখ আমার কাছে সবচেয়ে আগে।”
তার কণ্ঠে একধরনের তিক্ত প্রশান্তি। ফিওনার চোখ বড় হয়ে গেলো।
“তোমাকে আমার জীবন, আমার মস্তিষ্ক থেকে আজকে মুক্ত করে দিলাম। তবে হৃদয় থেকে হয়তো মুক্ত করতে পারবো না, ফিওনা। কারণ তোমার বসবাস আমার হৃদয়ে শত বছরের,” লিউ ঝানের কণ্ঠে হালকা কম্পন, সে নিজেকেই বোঝানোর চেষ্টা করছে।
সে ফিওনার চোখের গভীরে একবার দেখল,তার স্মৃতিতে সেই চাহনিটা স্থায়ী করে রাখতে চাইলো। তারপর একরাশ ক্লান্তি নিয়ে বলে উঠল,
“তবে তুমি যদি জ্যাসপারকে নিয়ে সুখে থাকো, তাতে আমি বাধা দেওয়ার কে? আমি আর কোনদিন তোমার আর তোমার ভালোবাসার মাঝে বাধা হয়ে দাঁড়াবো না।”
লিউ ঝান এক মুহূর্ত স্তব্ধ থাকে। বাতাস তার বুকের ভার টেনে নিচ্ছে। তারপর নিচু গলায়, হালকা হাসির ছায়া চোখে এনে সে বললো— “আসলে আজকে আমি বুঝতে পারলাম… আমি সবসময়ই ছিলাম তৃতীয় ব্যক্তি। ভেবেছিলাম তুমি আমার ছিলে, কিন্তু বাস্তবে কখনই ছিলে না। আমি শুধু তোমার জীবনের এক ছোটো অধ্যায় ছিলাম, আর তোমার পুরো উপন্যাসটা… সবটাই ওর নামে লেখা ছিলো।”
সে একবার ফিওনার দিকে, একবার জ্যাসপারের দিকে তাকিয়ে হালকা মাথা নেড়ে বলল,”ভালো থেকো, ফিওনা। তোমার ভালোবাসা তুমি ফিরে পেয়েছো—এটাই সবচেয়ে বড় জয়।আমার হার মানাটাও আজকে বোধহয় সঠিক সিদ্ধান্ত।”
ফিওনার চোখ দিয়ে টপ টপ করে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে। সে লিউ ঝানের দিকে তাকিয়ে কাঁপা কণ্ঠে বললো,
“আমি দুঃখিত লিউ ঝান… সত্যি দুঃখিত। তোমার মনটা আমি অনেকবার কষ্ট দিয়েছি… আমাকে ক্ষমা করে দিও।”
লিউ ঝান ফিওনার দিকে এক পা এগিয়ে এসে শান্ত কণ্ঠে বললো,“ফিওনা… তুমি কাঁদবে না, প্লিজ। আমি সব বুঝি… আমি চাইলেও তোমার হৃদয়ে স্থান নিতে পারতাম না, কারণ সেটা তো আর আমার জন্য ছিল না কখনো…”
সে ধীরে ধীরে ফিওনার কাঁধে হাত রাখতে এগিয়ে এলো শান্তনা দেওয়ার জন্য—ঠিক সেই মুহূর্তে, জ্যাসপার তার হাতটা ধরে ফেললো শক্ত করে। ঠান্ডা গলায় বললো,
“দূর থেকে কথা বল। ওকে টাচ করার দরকার নেই। যা বলার, দূর থেকেই বল।”
লিউ ঝান প্রথমে একটু থমকে গেল, লিউ ঝান মুখে হালকা বিরক্তির ছাপ নিয়ে একটা ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেললো। তারপর জ্যাসপারের চোখে চোখ রেখে বললো,
“ইউ আর সাচ আ চাইল্ডিশ! এতটা পজেসিভ হওয়ার মানে কী? তুই কি বিশ্বাস করিসনা ফিওনা তোরই?”
তার কণ্ঠে হতাশা ছিল, কিন্তু সেই সঙ্গে একটা ব্যঙ্গও লুকিয়ে ছিল। জ্যাসপার ঠাণ্ডা গলায় উত্তর দিলো,
“বিশ্বাস করি। কিন্তু কিছু জিনিস শুধু বিশ্বাস করে বসে থাকা যায় না, প্রমাণও রাখতে হয়।”
ফিওনা চুপচাপ দাঁড়িয়ে শুনছিল, আর ভেতরে ভেতরে অনুভব করছিল দুই পুরুষের একান্ত লড়াই—যেখানে ভালোবাসা, অহংকার আর হারানোর ভয় মিলেমিশে এক অদ্ভুত টানাপোড়েন তৈরি করেছে।
পাহাড়ের শান্ত বাতাস আচমকা থমকে যায়।
এক মুহূর্তে চারপাশ থমথমে—তারপর হঠাৎ—
“ফিশ্!” একটা তীক্ষ্ণ শব্দ।
দূর থেকে ছুটে আসা এক তির সোজা গিয়ে লিউ ঝানের বুকে বিধলো।
লিউ ঝানের মুখ ফ্যাকাশে হয়ে যায়, পা ডগমগ করে, আর সে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে।
ফিওনা বিস্ময়ে চিৎকার করে ওঠে,
“লিউ ঝান!”
জ্যাসপার চোখ বড় বড় করে দূরের পাথুরে ঢালে তাকায়।
সেখানে দাঁড়িয়ে আছে এথিরিয়ন।
তার হাতে ধরা ধনুক, চোখে আগুনের মত রাগ।
“তুমি আবার এসেছো তাদের মাঝে!”—এথিরিয়নের কণ্ঠে বিদ্বেষ। সে আরেকটা তির ধরে ধনুকে চড়াতে যাচ্ছে ঠিক তখনই—
ফিওনা দৌড়ে গিয়ে লিউ ঝানকে আড়াল করে দাঁড়িয়ে পড়ে।
“না! থামো! আর একটাও তীর নয়!”
জ্যাসপার সঙ্গে সঙ্গে তার হাতে ইশারা করে বললো—
“এথিরিয়ন, থেমে যাও।”
এথিরিয়নের চোখে দ্বিধা, কিন্তু সে ধনুক নামিয়ে আনে।
জায়গাটা আবার স্তব্ধ।
লিউ ঝান কষ্ট করে নিজের বুক থেকে তিরটা টেনে বের করে।
র*ক্তে ভেজা হাতে।
ফিওনা তাকে ধরে রাখতে যায়, কিন্তু জ্যাসপার তাকে টেনে সরিয়ে রাখে। “তুমি সরে যাও, হামিংবার্ড।” —তার গলায় ছিলো অভিজাত অথচ কোমল আদেশ।
তারপর সে নিজেই হাত বাড়িয়ে দিলো লিউ ঝানের দিকে।
এক মুহূর্তের নীরবতা, লিউ ঝান প্রথমে দ্বিধা করে কিন্তু পরক্ষনেই জ্যাসপারের হাতটা ধরে। সে ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ায়।
একটা অদ্ভুত নীরব সম্মানবোধ তাদের দুজনের চোখে।
দুই প্রতিদ্বন্দ্বী, কিন্তু মুহূর্তটাতে ছিলো কিছুটা গ্রহণযোগ্যতা…
আর ফিওনার চোখে ততক্ষণে জলের ধারা—
কারণ প্রেম, প্রতিযোগিতা আর ক্ষমার এই ত্রিভুজে সে প্রথমবার অনুভব করলো, যে পুরনো সব ঘৃণা এবার শেষ হতে পারে… যদি সবাই চায়।
এথিরিয়ন ধীরে ধীরে সামনে এগিয়ে আসে। তার চোখ জ্বলছে রাগে, কণ্ঠটা থরথর করে উঠে।
— “জ্যাসু ভাইয়া, তুমি ওকে মারতে বাধা দিচ্ছো কেনো? ও তো আবারও তোমাদের মাঝে আসার চেষ্টা করছে!”
জ্যাসপার চুপচাপ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে লিউ ঝানের দিকে।তারপর শান্ত গলায় বলে,
— “ও কথা দিয়েছে। ও আমাদের মাঝে আর আসবে না। আমি বিশ্বাস করেছি।”
এথিরিয়নের কণ্ঠ আরও চড়ে যায়,
— “তুমি ভুলে গেছো, ভাইয়া? ওর ছলনায় ফিওনা তোমাকে সেই ফুলের রস খাইয়েছিলো… তোমার প্রাণই তো চলে যাচ্ছিলো! আর তুমি এখন ওকে ছেড়ে দিচ্ছো?”
জ্যাসপার ধীরে ধীরে মাথা ঘুরিয়ে এথিরিয়নের চোখে চোখ রাখে।তার ঠোঁটে একটুকরো বাঁকা হাসি খেলে যায়।
আর সে গম্ভীর গলায় বলে—
— “এভরিথিং ইজ ফেয়ার ইন লাভ এন্ড ওয়ার.”
পেছনে দাঁড়ানো ফিওনা তখন নিঃশব্দে তাকিয়ে থাকে জ্যাসপারের দিকে।তার চোখে তখন বিস্ময়, প্রশ্রয় আর গভীর কৃতজ্ঞতা…কারণ প্রিন্স ক্ষমা করতেও শিখে গেছে।
জ্যাসপার তখন ধীরে ধীরে সামনে এগিয়ে আসে। তার চোখ গম্ভীর, কণ্ঠ ভারী।
— “আমি জানি, এথিরিয়ন। তুই ওর ওপর কোনো কেমিকেলের তির ছুড়েছিস। ওর শরীরে এখন বিষ ছড়িয়ে পড়ছে।”
জ্যাসপার এক পলক লিউ ঝানের দিকে তাকায়, তারপর ফিরে এথিরিয়নকে নির্দেশ দেয়—
— “তুই ওকে এখনই এল্ড্র রাজ্যে নিয়ে যা। ওকে বাঁচাতে হলে সময় নষ্ট করা যাবে না।”
এথিরিয়ন কিছু বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু জ্যাসপার তর্জনী তুলে থামিয়ে দেয়—
— “আমি ফিওনাকে ফ্লোরাস রাজ্যের প্রাসাদে পৌঁছে দিয়ে আসছি। তারপর আমি এল্ড্র রাজ্যে ফিরে আসব।”
ফিওনার চোখে এক ঝলক চিন্তার ছায়া নেমে আসে, কিন্তু সে কিছু বলে না।
জ্যাসপার তখন ফিওনার দিকে হাত বাড়িয়ে বলে—
— “চলো, হ্যামিংবার্ড। এখন আমাদের যাত্রা আবার শুরু হবে।”
আর এথিরিয়ন ধীরে ধীরে আহত লিউ ঝানকে ধরে জ্যাসপারের নির্দেশ মতো রওনা হয় এল্ড্র রাজ্যের পথে।
এথিরিয়ন ধীরে ধীরে লিউ ঝানকে ধরে এল্ড্র রাজ্যের প্রাসাদের ভিতরে ঢোকে। তার মুখে কোনো আবেগ নেই, চোখে কেবল দায়িত্বের ছাপ। সে লিউ ঝানকে অতিথি কক্ষের নরম সাদা বিছানায় শুইয়ে দিয়ে দরজার দিকে তাকিয়ে জোরে বলে ওঠে—
— “অ্যাকুয়ারা! কোথায় তুমি? দ্রুত এসো!”
কিছুক্ষণের মধ্যেই হালকা নীল গাউন পরা অ্যাকুয়ারা ঘরে প্রবেশ করে।
— “রিয়ন? কী হয়েছে ওনার?”
— “কেমিকেলের তির লেগেছে।” — এথিরিয়নের কণ্ঠে ক্লান্তি, কিন্তু গম্ভীরতা এখনো বজায়।
— “এখনই শক্তিশালী ভেষজ ঔষধ বানাও। ওর শরীরের ভেতর যে বিষ ছড়িয়ে পড়ছে, তা থামাতে হবে।”
অ্যাকুয়ারা হালকা হেসে সম্মতির চিহ্ন দেয়—
— “ঠিক আছে,আমি ঔষধ তৈরি করে নিয়ে আসছি। তবে এ কাজ সহজ হবে না। বিষ অনেক পুরনো আর গভীর মনে হচ্ছে ”
এথিরিয়নের ঠোঁটের কোণে হালকা হাসি, তবে চোখে কঠিন সতর্কতা—
— “তোমার কাছেই ভরসা, অ্যাকুয়ারা। তুমি পারবে।”
ঘরের বাতাস ভারী হয়ে ওঠে, সময় যেন থেমে থাকে লিউ ঝানের নিঃশ্বাসের অপেক্ষায়…
এথিরিয়ন দরজার পাশে দাঁড়িয়ে একবার ঘুরে তাকায় লিউ ঝানের দিকে। তারপর ধীরে ধীরে অ্যাকুয়ারার দিকে ফিরে বলে—
— “আমি একটা জরুরি কাজে যাচ্ছি।”
তার কণ্ঠে আগের মতোই দৃঢ়তা, কিন্তু চোখে লুকানো একটা ক্লান্তি।
— “তুমি ওর খেয়াল রেখো, অ্যাকু।
অ্যাকুয়ারা শান্ত গলায় মাথা নেড়ে সম্মতি জানায়—
— “আমি আছি। তুই নিশ্চিন্তে যা।”
এথিরিয়ন একটু থেমে বলে—
— “যা যা দরকার হয় করো। চিকিৎসা, সুরক্ষা, সব। শুধু একটা কথা মনে রেখো, ফিওনা আর জ্যাসু ভাইয়ার কারণে হলেও… ও আমাদের রাজ্যের অতিথি।”
এই বলে এথিরিয়ন কক্ষ থেকে বেরিয়ে যায়, আর দরজা ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে আসে…
ঘরের ভেতরে পড়ে থাকে নিস্তব্ধতা, আর সেই নিস্তব্ধতার মাঝে অ্যাকুয়ারা কিছুক্ষন চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকলো।
.জ্যাসপার ফ্লোরাস রাজ্যের প্রাসাদের সামনে গাড়ি থামিয়ে ধীরে ফিওনার দিকে তাকালো। তার চোখে ছিলো এক অদ্ভুত কোমলতা, যেন সে কিছু বলতে চায়, কিন্তু শব্দ হারিয়ে ফেলেছে। ফিওনা নিচে নামার আগে এক মুহূর্ত চুপ করে বসে থাকে, তারপর দরজা খুলে গাড়ি থেকে নেমে পড়ে।
— “ভালো থেকো, প্রিন্স।” ফিসফিস করে বলে সে।
জ্যাসপার মাথা হেলিয়ে সম্মতি জানায়, গাড়ি ঘুরিয়ে ফিরে যায় এল্ড্র রাজ্যের পথে।
ফিওনা ধীরে ধীরে ফ্লোরাস প্রাসাদের বিশাল ফটক দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করে। তার শরীর ভেজা নয়, কিন্তু চোখে মুখে ক্লান্তির ছাপ স্পষ্ট। প্রবেশ করতেই চোখে পড়ে ড্রইং রুমে বসে আছেন লিয়ারা, রাজা জারেন, অ্যালিসা আর সিলভা। সবাই যেন অনেকক্ষণ ধরে তার অপেক্ষায় ছিলো।
লিয়ারা সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়ান, কণ্ঠে রাগ আর চিন্তার মিশ্র প্রতিফলন:
— “তুমি কী করেছো, ফিওনা? কাল রাতে কারো কথা না শুনে, দৌড়ে বেরিয়ে গেলে! তারপর শুনি, তুমি সোজা গিয়েছো এল্ড্র প্রাসাদে? জ্যাসপারের কাছে? কেনো?”
ঘরের মধ্যে এক মুহূর্তের জন্য নীরবতা নেমে আসে।
ফিওনা এগিয়ে এসে মাথা নিচু করে বলে:
— “আমি জানি, আমার ব্যবহার অনুচিত ছিলো। কিন্তু… আমার সব স্মৃতি ফিরে এসেছে মা। আমি বুঝতে পেরেছি আমি আসলে কাকে ভালোবাসি। আমি জ্যাসপারকে ভালোবাসি। আর পৃথিবীর নিয়মে… আমাদের বিয়ে আগেই হয়ে গেছে। জ্যাসপার আমার স্বামী।”
তার এই কথায় ঘরে ছড়িয়ে পড়ে বিস্ময়ের নিস্তব্ধতা। লিয়ারা হতবাক, অ্যালিসা স্তব্ধ, আর রাজা জারেন চোখ বন্ধ করে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলেন।
এই মুহূর্তে কেউ কিছু বলে না। শুধু নিঃশব্দে, ধীরে ধীরে—ফিওনার সত্য উচ্চারণ করে ফেলে চিরন্তন এক সম্পর্কের স্বীকৃতি।
লিয়ারা দাঁড়িয়ে ছিলেন, চোখে রাগ আর অভিমান মিলিয়ে এক অদ্ভুত অভিব্যক্তি।
— “তুমি বুঝতে পারছো না, ফিওনা! ওর মতো ছেলের সঙ্গে থাকা তোমার জন্য কতটা বিপদজনক! সে অহংকারী, রুক্ষ, আর আমাদের চোখে ধুলো দিয়ে ঠিক তোমার বিয়ের দিন তোমাকে তুলে নিয়ে গিয়েছিলো। এমন কেউ কি বিশ্বাসযোগ্য হতে পারে?”
ফিওনা মায়ের সামনে গিয়ে ধীরে গলা নামিয়ে বললো,
— “আমি জানি, মা… ও যা করেছে সেটা সহজে মেনে নেওয়ার মতো না। কিন্তু আমি তার হয়ে ক্ষমা চাইছি… প্লিজ। ওর মধ্যে যা দেখেছো তুমি, তার বাইরে আরও অনেক কিছু আছে। ও আমাকে ভালোবাসে তাই এসব করেছে।”
একটা থেমে যাওয়া নিঃশ্বাসের পর ফিওনা আরও বললো,
— “আর লিউ ঝানও সব মেনে নিয়েছে, মা। সে নিজেই আমাদের থেকে সরে এসেছে। তাহলে তুমি কেনো আটকাচ্ছো? আমার কাছে ভালোবাসা মানে শুধু অনুভূতি না, সেটা একটা প্রতিশ্রুতি। আর আমি সেই প্রতিশ্রুতি জ্যাসপারকে দিয়েছি, এই জন্মে, হয়তো অজান্তে আগের জন্মেও। প্লিজ মা… তুমিও মেনে নাও না।”
লিয়ারার চোখের কোণে অশ্রু জমে ওঠে, কিন্তু তিনি মুখ ঘুরিয়ে নেন। তাঁর ভেতরে দ্বন্দ্ব—একদিকে মেয়ের ভবিষ্যতের চিন্তা, অন্যদিকে তার ভালোবাসার দৃঢ়তা।
প্রাসাদে একটা ভারী নীরবতা নেমে আসে।
লিয়ারা মুখে কিছু না বলেই ধীরে ধীরে সরে যান, তাঁর চলার ভঙ্গিমাতেই হতাশা আর অভিমান জমে থাকে। দরজার চৌকাঠ পেরিয়ে নিজ কক্ষে ঢুকে তিনি দরজাটা ধীরে করে বন্ধ করে দেন। ফিওনার চোখের কোণে অশ্রু জমে ওঠে, কিন্তু সে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে।
অ্যালিসা রাগে ঠোঁট কামড়ে ফেলে। মুখটা লাল হয়ে গেছে ক্ষোভে।
— “তুমি সবকিছুর তোয়াক্কা না করে ওর কাছে গিয়েছিলে! একজন প্রিন্সেস হিসেবে কীভাবে এতটা দায়িত্বহীন হও?” — বলে ঝড়ের মতো বেরিয়ে যায় সে।
ফিওনা মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকে, কিছুই বলে না।
ঠিক তখনই সিলভা ধীরে ধীরে ফিওনার পাশে এসে দাঁড়ায়। কোমলভাবে ফিওনার কাঁধে হাত রাখে, তারপর মায়াভরা কণ্ঠে বলে,
— “তুমি ঠিক আছো তো, ফিওনা?”
ফিওনা কিছু না বললেও চোখের জলে জবাব দেয়। সিলভা ফিসফিস করে বলে,
— “ভালোবাসা সহজ পথ নয়, জানি। কিন্তু তুমি যদি সত্যিই প্রিন্সকে ভালোবাসো, তবে একে ধরে রাখার শক্তিটাও তোমারই থাকতে হবে। আমি তোমার পাশে আছি। সবসময়।”
এই ছোট্ট শান্তনাই যেন ফিওনার মনে এক টুকরো আশার আলো ছড়িয়ে দেয়।
অতিথি কক্ষের দরজার পাশে দাঁড়িয়ে অ্যাকুয়ারা গভীর দৃষ্টিতে লিউ ঝানের দিকে তাকালো। তার হাতে ছিলো গন্ধযুক্ত সবুজ রঙের ভেষজ পেস্ট আর কিছু তুলো ও কাপড়। লিউ ঝানের ব্লেজার আর শার্ট র*ক্তে ভিজে গেছে, বুকের মাঝখানে র*ক্ত এখনো গড়িয়ে পড়ছে।
সে কষ্টে চোখ মুখ শক্ত করে উঠে বসতেই অ্যাকুয়ারা বললো,
“আপনার ড্রেস খুলতে হবে। ঔষধ লাগাবো?”
লিউ ঝান ভ্রু কুঁচকে এক হাত বুকের ওপর চেপে ধরে ব্যথায় গলা শক্ত করে বললো, “আর ইউ ক্রেজি? তোমার সামনে আমি কীভাবে আমার পোশাক খুলবো?”
অ্যাকুয়ারা বিরক্ত চোখে তার দিকে তাকিয়ে এক ধাপ এগিয়ে এলো,”আজব! তাহলে আপনি কি চান র*ক্তে ভিজে এভাবেই মরতে? আমি চিকিৎসক না হলেও আপনার জীবনের দাম জানি। আমি মেয়ে বলে কি আমার সামনে শার্ট খুলতে সমস্যা? তবে এখন আমাকে মেয়ে না ভেবে নার্স ভাবুন।”
লিউ ঝান ঠোঁট কামড়ে কিছু বলছিলো না, তার চোখে এক ধরনের দ্বিধা—লজ্জা, অসম্মান।
অ্যাকুয়ারা এবার সোজা হয়ে বললো,
“শোনুন,আমি যুদ্ধের ময়দানে র*ক্ত দেখেছি, শরীরের ক্ষত সেলাই করেছি। আপনি আমার কাছে আর পাঁচজনের মতোই একজন আহত যো*দ্ধা। আমি ‘মেয়ে’ এই পরিচয়ে আপনার মৃ*ত্যুর কারণ হতে চাই না।”
লিউ ঝান ধীরে ধীরে মাথা নিচু করে। তারপর এক হাত দিয়ে নিজের ব্লেজারটা খুলতে লাগলো, কষ্টে কাঁপছিলো শরীর।
আযদাহা সিজন ২ পর্ব ২৯
অ্যাকুয়ারা পেছন ঘুরে গেলো, বললো,
“আপনি তৈরি হলে বলুন,আমি পিঠের দিকটা আগে পরিষ্কার করে দেই।”
কক্ষটা তখন হালকা নিঃশব্দ, কিন্তু বাতাসে একটা অদ্ভুত স্নিগ্ধতা—দুই বিপরীত মনের ড্রাগনের মধ্যে নতুন এক বিশ্বাসের সূচনা হচ্ছিলো।