হ্যালো 2441139 পর্ব ১২

হ্যালো 2441139 পর্ব ১২
রাজিয়া রহমান

রজনী দেয়ালে থাকা ঘড়ির দিকে তাকায়। ঘড়িতে এখন রাত ১১:৪৪।আষাঢ় এখনো ফিরে নি।রজনী রাগ করতে গিয়ে ও নিজেকে সংবরণ করে। আষাঢ় যখন ইন্টারমিডিয়েট এ ভর্তি হয় তখনই সে আগ্রহী হয় রাজনীতির ব্যাপারে।
রজনী জানে এই দিনটা আসারই ছিলো। রক্তে যাদের রাজনীতি তাকে আটকায় কে?
আষাঢ়ের বাবা সিরাজুল ইসলাম ছেলেকে পূর্ণ স্বাধীনতা দিয়েছেন সব ব্যাপারে।
যদিও বাবা ছেলের দল আলাদা তবুও সিরাজুল ইসলাম মনে করেন যার যার ব্যক্তি স্বাধীনতা আছে।তিনি একটা দলকে সমর্থন করেন বলে যে ছেলেকে ও তার দলে ভিড়তে হবে তা সম্পূর্ণ অযৌক্তিক। প্রতিটি মানুষেরই ভিন্ন সত্তা,ভালো মন্দের বিচার বিবেচনা বোধ আলাদা।

সিরাজুল ইসলামের এসব জ্ঞানী জ্ঞানী কথা শুনলে রজনীর হাসি পায় মাঝেমাঝে। এই মানুষটা সবার ব্যাপারটা বুঝতে পারে শুধু নিজের স্ত্রীর ব্যক্তি স্বাধীনতাটাই বুঝে না।
সিরাজুল ইসলামের বাবা ও রাজনীতি করতেন।মজার ব্যাপার হচ্ছে তখনও তাদের বাবা ছেলের দল বিপরীত ছিলো।
রজনী সোফায় বসে রইলো একটা ম্যাগাজিন হাতে নিয়ে। বসে থাকতে থাকতে দেখলেন নির্জন এসেছে নিচে।হাতে একটা বই।ফ্রিজ থেকে একটা ঠান্ডা পানির বোতল নিয়ে দুই ঢোক পানি খেয়ে আবারও চলে গেলো। রজনী মুগ্ধ হয়ে দেখে।ছেলেটা এসব উল্টাপাল্টা কোনো কাজে নেই।সবসময় বাড়িতে থাকবে,পড়বে।
অথচ তার নিজের ছেলে,তাকে হারিকেন দিয়ে খুঁজে ও পাওয়া যায় না। কোনো সামাজিক অনুষ্ঠানে তার খোঁজ পাওয়া যায় না। সবসময় সে ব্যস্ত থাকে।
কোনো সামাজিক অনুষ্ঠানে নার্গিস যখন হাসিমুখে তার ছেলেকে সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দেয় রজনী তখন আশাহত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

মাঝেমাঝে ভীষণ অভিমান হয় স্বামীর উপর। কি দরকার ছিলো ছোট বেলা থেকেই ছেলের সাথে এসব আলোচনা করার।কেনো ছেলেটাকে কখনো শাসন করেন নি।
রাত বিরাতে বাড়ি ফেরার জন্য কেনো কখনো প্রশ্ন করেন না!
উল্টো বলেন, তার ছেলের উপর তার ভরসা আছে। তার ছেলে যদি কখনো মানুষ খু ন করে ও আসে তাহলে ও তিনি বুঝবেন অকারণে তার ছেলে খু ন করে নি,নিশ্চয় কোনো যৌক্তিক আর জোরালো কারণ আছে।
রজনী বলতে বলতে হাঁপিয়ে গেছে। কেউ পাত্তা দেয় নি।
আষাঢ় বাড়িতে ঢুকে বরাবর ১২টা বাজে।রজনী সদর দরজা খুলতেই দেয়াল ঘড়িটা ঢংঢং করে জানান দেয় এখন মধ্যরাত। ক্যালেন্ডারের তারিখ পাল্টে গেছে।
আষাঢ় চিৎকার করে বললো, “হ্যাপি বার্থডে মা।”

রজনী চমকায়।আজ কতো তারিখ? দিন তারিখ মাসের হিসেব রজনী ভুলেই যাচ্ছেন। রান্নাঘরে যার জীবন আটকে আছে তার জন্য দিন তারিখে কি আসে যায়!
যারা চাকরি করে তাদের জন্য দিন তারিখের গুরুত্ব আছে।তাদের ছুটিছাটা আছে তাই হিসেব রাখতে হয়।রজনীর যেই চাকরি সেখানে মৃত্যু ছাড়া কোনো ছুটি নেই।তাই এখানে দিন তারিখের কোনো হিসেব নেই।
তবুও কেনো জানি মনটা আনন্দিত হয়ে উঠে। এতো বড় বাড়িতে,এতো মানুষ, এতো ব্যস্ততার মধ্যে ও অন্তত নিজের ছেলেটা তো মা’য়ের কথা মনে রেখেছে।
রজনীর দুই চোখ ভিজে উঠে। আষাঢ় কেক,একটা শপিং ব্যাগ আর ফুল নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।রজনী চোখের জল আড়াল করে বললো, “এসবের মানে কি?”
আষাঢ় হেসে বললো, “তোমার জন্মদিন মা।আমরা সেলিব্রেট করবো না?”
রজনীর মনের আনন্দ হুট করে বেদনায় রূপ নিলো।ছেলের মনে আছে অথচ যেই মানুষের সংসার করছেন তিনি বেমালুম ভুলে আছেন।

আষাঢ় বললো, “বাবা কই মা?বাবাকে ডাকো।”
“তার কি দরকার? সে সবসময় এসব ভুলেই থেকেছে আজও ভুলে থাক।”
“না মা,এভাবে বলো না।বাবা-ই তো আমাকে বলেছিলো আজকের কথা।তুমি দাঁড়াও আমি বাবাকে ডাকছি ”
রজনী হতবাক হয়।কি বলছে ছেলে!
আষাঢ় ছুটে যায় বাবাকে ডাকতে।সিরাজুল ইসলাম শুয়ে পড়েছেন।আষাঢ় এসে ঝাঁকি দিয়ে তাকে ডাকলো।
হঠাৎ ঝাঁকুনি খেয়ে সিরাজুল ইসলামের মনে হলো ভূমিকম্প হচ্ছে বুঝি।লাফিয়ে উঠে বললেন,”ভূমিকম্প, ভূমিকম্প! ”
আষাঢ় বাবার হাত ধরে বললো, “আরে বাবা,আস্তে।কোনো ভূমিকম্প হয় নি,তবে একটু পর হবে।”
সিরাজুল ইসলাম ধাতস্থ হয়ে বললেন,”কি বলছিস?ভূমিকম্প হবে?”

“আজকে মায়ের জন্মদিন, তুমি নিশ্চিত ভুলে গেছো ”
সিরাজুল ইসলাম দাঁত দিয়ে জিভ কাটেন সত্যি ভুলে গেছেন।
আষাঢ় হেসে বললো, “নো চিন্তা, ডু ফূর্তি বাবা।তোমার ছেলে আছে না।আমি মায়ের জন্য কেকে,ফুল,গিফট নিয়ে এসেছি।মা’কে বলে এসেছি এসব তুমি আনতে বলেছো।”
সিরাজুল ইসলাম উঠে দাঁড়িয়ে বললেন,”শাবাশ ব্যাটা!এই তো যোগ্য পিতার যোগ্য পুত্র।তোর এই ঋণ বাবা একদিন শোধ করে দিবো দেখিস।”
আষাঢ় হেসে বললো, “কবে বাবা?”
“ব্যাটা,জীবনের আসল শিক্ষা সফর তো বাকি রয়ে গেছে। বিয়ের পর মানুষের জীবনের আসল শিক্ষা সফর শুরু হয় আর জীবনের আসল শিক্ষক হলো বউ।যেদিন তুই এই বিপদে পড়বি,সুপার ম্যানের মতো গিয়ে আমি ও তোকে উদ্ধার করবো।”
“থাক বাবা,আগে তুমি নিজের ইয়া নাফসি করো।মা রণমুর্তি নিয়ে অপেক্ষা করছে।”
বাবা ছেলে হাসতে হাসতে নিচে গেলো।

সিরাজুল ইসলাম ফুলের তোড়া রজনীর হাতে দিয়ে বললো, “শুভ জন্মদিন বউ।আমার যদি ক্ষমতা থাকতো তবে আজকের দিনটাকে আমি পুরো বিশ্বের জন্য সবচেয়ে আনন্দের দিন হিসেবে ঘোষণা করতাম।কারণ আজকের দিনে তুমি জন্মেছো,তুমি জন্মেছো বলেই আমি আমার জীবনে এরকম একজন চমৎকার জীবন সঙ্গী পেয়েছি যার কাছে আমি আজীবন কৃতজ্ঞ।”
রজনী সন্দিহান দৃষ্টিতে ছেলের দিকে তাকায়। তার বিশ্বাস হচ্ছে না এটা সিরাজুল ইসলামের কাজ হতে পারে। ছেলে নিশ্চয় বাবাকে বাঁচানোর জন্য এটা করেছে।
কি আশ্চর্য, তবুও রজনীর কেনো জানি ভালো লাগছে ব্যাপারটা।একটা সন্তানকে দুনিয়ার আলো দেখাতে বাবা মা’কে অনেক বেশি কষ্ট করতে হয়।মায়ের কষ্ট যতটা বুঝা যায় বাবার টা বুঝা যায় না।কিন্তু দুজনেই নিজ নিজ জায়গা থেকে সন্তানের জন্য করে যায়।মানুষ যতোই বলুক সন্তানকে মানুষ করা তাদের দায়িত্ব তার থেকে কোনো প্রতিদান আশা করে না কিন্তু বাস্তবিক কি তা হয়!

সন্তানের থেকে এটুকু প্রায়োরিটি, এটুকু আন্ডারস্ট্যান্ডিং সব বাবা মা-ই চায়।
রজনীর হুট করে মনে হলো, ছেলেকে নিয়ে মনে যেটুকু আক্ষেপ ছিলো তা সম্পূর্ণ অমূলক। সিরাজুল ইসলাম ঠিক কথাই বলেন। তার ছেলেকে তিনি অবাধ স্বাধীনতা দিয়েছেন এই জন্যই যে তিনি জানেন তার ছেলে কখনো স্বাধীনতার অপব্যবহার করবে না।নিজের লিমিট ক্রস করবে না।
তিনি মা হয়ে ও হয়তো ছেলেকে এতটা বুঝতে পারেন নি, সিরাজুল ইসলাম ঠিকই বুঝেছেন।বুঝেছেন বলেই যে পাখিকে আকাশে ডানা মেলে উড়াউড়িতেই মানায় তাকে তিনি খাঁচায় বন্দী করেন নি যার কারণে দিনের শেষে খাঁচার মায়ায় পাখি আবারও ফিরে আসে।
বাবা ছেলেকে নিয়ে রজনী কেক কাটলো।মনে মনে বললো, “আল্লাহ, আমার এই বিশেষ দিনে তোমার কাছে এটুকুই চাই,বাবা ছেলের এই বন্ধুর মতো সম্পর্ক যাতে আজীবন এভাবেই থাকে।বাবার শেষ বয়সে ও যাতে এভাবে ছেলে তার বাবার পাশে থাকে।”
নারীজাতির চিরায়ত স্বভাব এটাই।সবসময় সব অবস্থায় সে নিজের কথা বাদ দিয়ে স্বামী সন্তানের কল্যাণের কথা ভেবে যায়।

আষাঢ় রুমে ঢুকে দেখে রুম পরিপাটি করে গুছিয়ে রাখা।তার রুমে সে কাউকে এলাউ করে না।এই রুম কাউকে গুছাতে দেয় না।এরকম এলোমেলো করে থাকতেই তার ভালো লাগে। আষাঢ় জানে এটা কার কাজ।সেটা বুঝতে পেরেই আষাঢ়ের চোয়াল শক্ত হয়।
এতো সাহস কিভাবে দেখায় মিরা?
আষাঢ় রুমে ঢুকেই পুরো রুম এলোমেলো করে দিলো।বালিশ সরাতেই বালিশের নিচে একটা চিঠি পেলো আষাঢ়।
লাইটার দিয়ে চিঠিটা পুড়িয়ে দিলো না পড়েই।
ঘুমাতে গেলো মাথা গরম করে।
সকালে ঘুম থেকে উঠে আষাঢ় ঝুনি খালাকে বললো, “খালা মিরাকে ডেকে বলো আমার সাথে দেখা করতে। ”
ঝুনি আতংকিত হয়ে বললো, “ও বাপ,কি কও?সাত সকালে কালনাগিনীর লগে কথা কইবা?”
“হ খালা,ও কাল নাগিনী হলে আমি ও সাপুড়ে। তুমি চিন্তা কইরো না।”
ঝুনি খালা সন্তুষ্ট হয়। এদের মা মেয়ে কাউকেই ঝুনির পছন্দ না।এরা সারাক্ষণ ঝামেলা পাকাতে ওস্তাদ। লোকে বলে,গাই ভালো তার বাছুর ভালো,দুধ ভালো তার ঘি।

বাপ ভালো তার ব্যাটা ভালো, মা ভালো তার ঝি।
এদের মায়ের অন্তরের ভিতরে যেমন নিকষকালো এরা তিন মেয়েও হইছে তেমন।
গায়ের রঙ একটু সাদা, ভিতরে একেবারে কালা।
অমাবস্যার মতো কালা।
আষাঢ় ভাই ডাকছে শুনে মিরা লজ্জা পায়।
এই নিয়ে তৃতীয় চিঠি দিয়েছে সে আষাঢ় ভাইকে।আজকে অবশেষে তার ডাক পড়লো।
মিরা উঠে পরনের জামা পালটে একটা হলুদ থ্রিপিস পরলো।চোখে কাজল দিলো।
গায়ে হালকা পারফিউম দিয়ে বের হলো রুম থেকে।
আষাঢ়ের হাতে ফিজিক্স বই।আজকে কোথাও বের হবে না আর।
মিরা রুমে ঢুকে হতবাক হয়। গতকাল কতো যত্ন করে সে রুমটা গুছিয়েছে। অথচ আষাঢ় ভাই সব এলোমেলো করে দিয়েছেন !
মিরার চোখ ভিজে উঠে।
আষাঢ় বইয়ের দিকে তাকিয়ে বললো, “তোর এসএসসি পরীক্ষার প্রিপারেশন কেমন?”
“ভালো।”
“ইংরেজিতে কেমন তুই?”
“মোটামুটি। ”
“আমি একটা বাক্য বলি এটাকে ইংরেজিতে ট্রান্সলেট কর।”
“কি?”

“আমি একটা গায়ে পড়া,অভদ্র মেয়ে।বিশেষ করে ছেলেমানুষ দেখলেই গায়ে পড়ে যাই।উপরে উপরে ভালোমানুষ সেজে থাকলেও ভেতরে ভেতরে আমি ছেলে মানুষ দেখলে মোমের মতো গলে যাই।”
মিরার মুখ থমথমে হয়ে গেলো মুহূর্তে।
“কি হলো?পারছিস না?ইংরেজিতে কাঁচা না-কি তুই?”
লজ্জায় মিরার দুই চোখে জল এলো।
আষাঢ় বই রেখে বললো, “ছোট বেলা থেকে এই বাড়িতে আমরা সবাই এক সাথে বড় হয়েছি।আমার কাছে আমার বড় আপা যেমন, নিরা আপা যেমন, বর্ষা যেমন, পিংকি যেমন, তুই ও তেমন। বোন ছাড়া অন্য কিছু আমি ভাবি না কখনো। আমি যাতে তোকে আর কখনো আমার সাথে এরকম বেহায়াপনা করতে না দেখি।আমার রুমের চৌহদ্দিতেও তুই আসবি না।যদি এসেছিস আমি বুঝতে পারি তবে মনে রাখিস,এই বাড়িতে সেদিনই তোদের সবার শেষ দিন।আমার মাথা গরম করিস না।”
মিরা এতো লজ্জা পায় নি আগে।এতো অপমান কেউ করে নি তাকে।
কাঁদতে কাঁদতে মিরা রুমে গেলো।
শিরিন মেয়েকে কাঁদতে দেখে জিজ্ঞেস করলো ঘটনা কি।

হ্যালো 2441139 পর্ব ১১

মিরা মা’কে বলতেই শিরিন মেয়ের গালে থাপ্পড় বসায়। তারপর বললো, “হারামজাদি, তোরে এরকম চিঠি লিখতে বলছে কে?এতো গাধা ক্যান তুই?আমি তোরে এভাবে আগাইতে বলছি?”
মিরা চুপ করে থাকে।মা-ই মিরাকে বুঝিয়েছে কোনোভাবে যদি আষাঢ়ের সাথে সেটিং করতে পারে তাহলে রানীর মতো থাকতে পারবে মিরা।
মিরাও তাই ভেবে এগিয়েছে। কিন্তু আষাঢ় তাকে যেভাবে অপমান করলো এরপর আর মিরার সাহস নেই আষাঢ়ের সামনে যাওয়ার।
কিন্তু শিরিন হাল ছাড়ে না।মিরা বা মিনি,যেকোনো একজনকে ভাইয়ের ছেলের কাছে বিয়ে দিবেই শিরিন।যেভাবেই হোক।

হ্যালো 2441139 পর্ব ১৩