হামিংবার্ড পর্ব ৪৭

হামিংবার্ড পর্ব ৪৭
তাসমিয়া তাসনিন প্রিয়া

স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ল অরা। ভদ্রলোক ঘুমালেই শান্তি। ছটফট করতে করতে একসময় অরার চোখে ঘুম নেমে এলো। কিন্তু আরিশ এখনো জেগে আছে। তবে সেটা অরাকে বুঝতে দেয়নি। অরা ঘুমিয়ে গেছে এটা বুঝতে পেরে, ধীরে ধীরে উঠে বসলো আরিশ। মনমেজাজ খারাপ তার। বিছানা ত্যাগ করে ওয়াশরুমের দিকে এগোল সে। আপাতত ঠান্ডা পানিতে গোসল করতে হবে। তবেই যদি মন ও শরীর শান্ত হয়!
“ গুড মর্নিং তামান্না ভাটিয়া। “
সকাল সকাল রান্নাঘরে এসে উপস্থিত হলো তালহা। তামান্না নাস্তা তৈরি করতে ব্যস্ত। আজকে বাড়িতে অনেক কাজ৷ সন্ধ্যায় অরার জন্মদিন উপলক্ষে পার্টি আছে।
“ শুভ সকাল। আপনার অফিস নেই আজ?”
তালহা ইতিমধ্যেই ফলের ঝুড়ি থেকে একটি লাল আপেল তুলে নিয়ে খেতে শুরু করেছে। তার পরনে ছিল অ্যাশ রঙের একটি শার্ট ও নীল জিন্সের প্যান্ট।

“ না। ভাবির জন্মদিন উপলক্ষে গোটা অফিস বন্ধের ঘোষণা দিয়েছে ভাইয়া। “
“ মাঝে মধ্যে অবাক হই। “
“ কেন?”
“ প্রথম প্রথম ভাবির সাথে কতো খারাপ ব্যবহার করতেন ভাইয়া! ভাবিও কয়েকবার পালিয়ে গিয়েছিলেন, থাকবে না বলে। অথচ এখন দেখুন, দু’জনের মধ্যে কতো ভালোবাসা! “
“এটাই তো পবিত্র সম্পর্কের আসল শক্তি, তামু। বিয়ে একটা পবিত্র বন্ধন – স্বামী আর স্ত্রীর মধ্যে একটা স্বাভাবিক টান নিজে থেকেই গড়ে ওঠে।”
“ হুহ্। “
তামান্না নিজের কাজেই ব্যস্ত। তালহার দিকে না তাকিয়েই কথা বলে যাচ্ছে। ফলে আচমকাই তালহা পেছন থেকে জড়িয়ে ধরল তাকে। চমকাল তামান্না।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“ এই! কেউ দেখে ফেলবে তো! ছাড়ুন। “
“ তাহলে তুমি আমার দিকে দেখো একবার।“
তামান্নাকে নিজের দিকে ফেরালো তালহা। ভয়ে গলা শুকিয়ে আসছে মেয়েটার৷ যদি কেউ দেখে ফেলে মহা মুশকিল হয়ে যাবে। তামান্নার এক বান্ধবী – সে-ও অন্যের বাসায় কাজ করে। সেই মেয়েটিও বাড়ির মালিকের ছেলের সাথে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েছিল। তারপর একদিন সেটা বাড়িতে জানাজানি হয়ে যায় এবং মেয়েটিকে কাজ থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়। মালিকের ছেলেটি কেবলই মেয়েটির সাথে সময় কাটিয়েছিল। এই ঘটনায় মেয়েটি অনেক কষ্ট পেয়েছিল। গতকালই তামান্না তার বান্ধবীর থেকে এসব জানতে পারে। ফলশ্রুতিতে ভেতর ভেতর তামান্নার ভীষণ চিন্তা হচ্ছে। যদি তালহাও ওই ছেলের মতো তার সাথে শুধু সময় কাটানোর জন্য সম্পর্কে জড়িয়ে থাকে– তখন কী হবে? তামান্না তো সত্যি তালহাকে মন দিয়ে ফেলেছে! তার ওপর বিষয়টা জানাজানি হলে যদি আরিশ তাকে বাড়ি থেকে বের করে দেয় তখন তামান্না কোথায় গিয়ে উঠবে?

“ তামান্না! কী হয়েছে তোমার? এতো অন্যমনস্ক হয়ে কী ভাবছো?”
আচমকা তালহার স্পর্শে নড়েচড়ে উঠল সে। গালে হাত রেখে, তামান্নার দিকে তাকিয়ে আছে তালহা।
“ আপনি এখন যান এখান থেকে। আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে । “
তালহা ছাড়লো না তাকে। উপরন্তু কী হয়েছে সেসব জিজ্ঞেস করতে ব্যস্ত হয়ে উঠলো।
দু’দিন ধরে সাবিহার সাথে কথা হচ্ছে না তাসলিমা খাতুনের। সেই নিয়ে ভীষণ চিন্তিত তিনি। এককাপ চা খেলে যদি একটু ফ্রেশ লাগে সেই উদ্দেশ্যে রান্নাঘরের দিকে এগোচ্ছেন তাসলিমা।
“ তোমাকে এতো চিন্তিত দেখতে ভালো লাগে না আমার। “
তালহা তামান্নার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল। তামান্না মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। কীভাবে বলবে সে, তার মনে সন্দেহ বাসা বেঁধেছে? কীভাবে বলবে তালহাকে সে বিশ্বাস করতে পারছে না। মনের মধ্যে ভয় সৃষ্টি হয়েছে তার।

“ তালহা!”
আচমকা মায়ের কণ্ঠস্বর পেয়ে চমকাল তালহা। তামান্নাও তালহার থেকে দূরে সরে দাঁড়াল। যে ভয় পাচ্ছিল ঠিক সেটাই হলো আজ। তাসলিমা খাতুনের চোখে-মুখে রাগের ঝলকানি। তালহা পরিস্থিতি সামলে নিতে মায়ের কাছে এগিয়ে গেলো।
“ মা, চলো আমরা বসে কথা বলছি। “
তাসলিমা খাতুন কোনো কথা না বলে হনহনিয়ে ড্রইং রুমের দিকে এগোলেন। তামান্না তালহার দিকে অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো কেবল। তালহা কিছু না বলে মায়ের পেছনে ছুটলো। পেছনে পড়ে রইলো তামান্না।
“ আরিশ! আরিশ!”
ড্রইং রুমে এসেই চিৎকার-চেঁচামেচি জুড়ে দিলেন তাসলিমা খাতুন। অরা কেবলই সিড়ি বেয়ে নিচতলায় আসছিল, চাচি শ্বাশুড়িকে এভাবে চেঁচাতে শুনে দ্রুত ড্রইং রুমে পৌঁছল সে। তালহা এরমধ্যে মায়ের কাছে এসে দাঁড়াল।

“ মা এসব কী করছো? ভাইয়াকে কেন ডাকছো? যা করেছি, আমি করেছি। আমার সাথে কথা বলো প্লিজ। “
“ আমি তোর সাথে পড়ে কথা বলবো। আগে পই কাজের মেয়েকে বাড়ি থেকে বের করার ব্যবস্থা করতে হবে। “
“ মা! “
“ চুপ কর তুই। ওসব মেয়েরা সব পারে। নিশ্চয়ই তোর মাথাটা খেয়েছে। “
মায়ের মুখের ওপর আরকিছুই বলতে পারলোনা তালহা। ঘটনা অনেক দূরে যাবে এখন, এ বিষয় ভালো করেই বুঝতে পারছে সে। অরা তাসলিমা খাতুনের সামনে এসে দাঁড়াতেই বললেন তিনি,
“ তোমার স্বামীকে ডেকে নিয়ে এসো, অরা। “
“ কিন্তু কী হয়েছে চাচি? সকাল সকাল এভাবে রাগারাগি করছেন কেন?”
“ কী হয়েছে সেটা ওই কাজের মেয়েকে গিয়ে জিজ্ঞেস করো। তোমার সাথে তো তার খাতির আছে। “
অরা কিছু বুঝতে পারছে না। তামান্না কী এমন করলো যার জন্য তাসলিমা খাতুন এতো রাগারাগি করছেন! অরা তামান্নার সাথে কথা বলার জন্য সোজা রান্নাঘরের দিকে এগোল এবার।
ঘুম ঘুম চোখে বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়াল আরিশ। চাচির চেঁচামিচিতে ঘুমানো মুশকিল। কিন্তু কথা হলো ভদ্রমহিলা এতো ক্ষেপলেন কেন? অরাও রুমে নেই! ভ্রু কুঁচকে ফেলল আরিশ। কোনোমতে ফ্রেশ হয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো সে।

অরা তামান্নার সাথে কথা বলে যা বোঝার বুঝে গেছে। ড্রইং রুমে একপাশে তাকে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে অরা। তালহা মা’কে শান্ত করতে অনেক চেষ্টা করছে। কিন্তু কিছুতেই তাসলিমাকে থামানো যাচ্ছে না। মা’কে ভীষণ ভালোবাসে ছেলেটা। তার ওপর বোনটাও দেশে নেই এখন। সবমিলিয়ে মা’কে কোনো কড়া কথাও বলতে পারছে না তালহা।
“ কী হয়েছে? সকাল সকাল এতো চিৎকার-চেঁচামেচি করছেন কেন?”
আরিশকে দেখে চুপ করে গেলেন তাসলিমা। তামান্না ও অরাসহ তালহাও আরিশের দিকে তাকিয়ে আছে। চাচির মুখোমুখি এসে দাঁড়াল আরিশ। তাসলিমা খাতুন কান্নায় ভেঙে পড়লেন। বললেন,
“ তোমার চাচা দুনিয়া ছাড়ার পর এই ছেলেটাই আমার একমাত্র ভরসা। আজ সেই ছেলেটার জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলছে, ওই কাজের মেয়েটা। “
তাসলিমা তামান্নার দিকে ইশারা করলেন। পরক্ষণেই ফের বলে উঠলেন,

“ তুমি এক্ষুণি ওকে বাড়ি থেকে বের করে দাও, বাবা। নইলে আমি চলে যাচ্ছি…. “
“ শান্ত হোন। আমি দেখছি। “
আরিশ অরার দিকে তাকাল একবার, তারপর তামান্নার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
“ কী হয়েছে, তামান্না? তুই কী করেছিস তালহার সাথে? “
তামান্না তালহার দিকে তাকাল, তালহা চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। তাসলিমা খাতুন ছেলের দিকে চোখ পাকিয়ে তাকিয়ে আছেন। অরা তামান্নার হাতটা শক্ত করে ধরলো। তাতে কিছুটা ভরসা পেলো মেয়েটা।
“ আমি কিছু করিনি ভাইয়া। “
“ কিছু না হলে চাচি এসব কী বললেন? “
“ ভাইয়া আমি বলছি। “
আচমকা তালহা এমন কথা বলায় কিছুটা বিরক্তি প্রকাশ করলেন তাসলিমা খাতুন। ছেলের দিকে দ্বিগুণ রাগান্বিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন তিনি।

“ হ্যাঁ, বল। “
“ আমি তামান্নাকে পছন্দ করি, ভালোবাসি ওকে। আমরা রান্নাঘরে দাঁড়িয়ে কথা বলছিলাম , মা সেটাই দেখে ফেলেছে। “
“ তালহা! একটা কাজের মেয়েকে কখনোই মানতে পারবোনা আমি। “
রাগে থরথর করে কাঁপছেন তাসলিমা। তামান্নার ঠোঁটের কোণে ম্লান হাসির রেখা। তালহা তো তার পাশে আছে, এটাই অনেক।
“ চাচি শান্ত হোন। কাজের মেয়ে কারো জন্মগত পরিচয় নয়। তামান্না আমার বোনের মতো। এ বাড়িতে আছে অনেকগুলো বছর। শুধু কাজ নয়, বোনের মতো খেয়াল রেখেছে আমার। “
“ তারমানে কী বলতে চাইছো তুমি? ওই মেয়েকে তালহার বউ করে নেবো?”
“ সমস্যা কোথায় চাচি? ওরা দু’জন দু’জনকে পছন্দ করে, ভালোবাসে। “
“ সমস্যা নেই? ওই মেয়ের কোনো পরিবার আছে? “
“ আমার বোন সে। তামান্না এদিকে আয়।”

অরা তামান্নাকে ইশারায় আরিশের কাছে যেতে বলল। তামান্না ধীরপায়ে এগিয়ে গেলো আরিশের কাছে।
“ আজ থেকে তামান্না আমার বোন। আর তেজরিন খান আরিশের বোন মানে বংশমর্যাদা, সম্পত্তি সবকিছুই থাকবে তার। আশা করি এখন আপনার কোনো সমস্যা হবে না, চাচি। “
তাসলিমা খাতুন অবাক হচ্ছেন। একটা কাজের মেয়েকে নিজের বোনের মর্যাদা দিয়ে দিচ্ছে আরিশ! এতটা উদার কবে থেকে হলো সে? সবকিছু ওই অরার জন্য হয়েছে।
তালহা মায়ের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। শান্তস্বরে বলল,
“ মা পারিবারিক মর্যাদা, জায়গাজমি দিয়ে কী করবে? তোমার ছেলের সুখের থেকেও কি এসব বড়ো? আমি তো কোনো আরিশের বোনকে ভালোবাসিনি। আমি ভালোবেসেছি একটা সাধারণ মেয়েকে। হাসিখুশি, সবার কথা ভাবে, আমাকে ভালোবাসে সে– এতটুকুই আমার জন্য যথেষ্ট। “
“ যা ইচ্ছে তাই করো তুমি। আমি তোমার কোনো বিষয় থাকবো না আর। “
তাসলিমা খাতুন হনহনিয়ে ড্রইং রুম থেকে চলে গেলেন। তামান্না ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। আরিশ তার মাথায় হাত রাখল।

“ কাঁদছিস কেন? বোকা মেয়ে। আস্তে আস্তে ঠিক হয়ে যাবে সব। সন্ধ্যায় পার্টি আছে। সবাই যার যার কাজ কর গিয়ে। তালহা? “
“ জি ভাইয়া। “
“ ডেকোরেশনে যেনো কোনো ত্রুটি না থাকে। আর কেকটাও ঠিক সময় যেনো আসে৷ “
“ আমি সবকিছু দেখে নেবো। নো টেনশন। “
“ ওকে, অরা রুমে চলো। “
অরা মাথা নেড়ে সম্মতি জানিয়ে সিঁড়ির দিকে এগোল। আরিশও ধীরে ধীরে এগোল অরার সাথে। ড্রইং রুমে দাঁড়িয়ে রইলো কেবল তালহা ও তামান্না। মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে মেয়েটা, চোখে জল। তালহা আশেপাশে নজর বুলিয়ে এগিয়ে গেলো তার দিকে। তারপর আচমকাই কোলে তুলে নিয়ে রান্নাঘরের দিকে এগোল। তামান্না অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো কেবল।
রুমে ঢুকেই দরজা আঁটকে দিয়ে অরাকে দেয়ালের সাথে চেপে ধরল আরিশ। কিছুটা ভড়কে গেলো অরা।

“ আপনার কী হলো!”
“ আমার আগে রুম থেকে বেরিয়ে গিয়েছিলে কেন? ঘুম থেকে উঠে তোমার মুখ দেখতে পেলাম না কেন, হামিংবার্ড?”
অরা থতমত খেয়ে তাকিয়ে আছে। এটাও কোনো কথা! আরিশ অরার ঘাড়ে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিলো। আস্তেধীরে ঠোঁটের কারুকার্য বৃদ্ধি পেতে লাগলো। অরা চোখ বন্ধ করে ঘনঘন নিঃশ্বাস ফেলে আরিশের পিঠ শক্ত করে আঁকড়ে ধরল। আচমকাই মৃদু চিৎকার করে উঠলো মেয়েটা। আরিশের ঠোঁটের কোণে ক্রুর হাসি। অরাকে ছেড়ে বিছানায় গিয়ে বসলো সে। অরা আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে, কাঁধের দিকে তাকাল। রক্ত বের হচ্ছে। কপাল কুঁচকে ফেলল অরা। মাঝে মধ্যে আরিশকে অসহ্য লাগে তার। ব্যথায় চেহারা ফ্যাকাসে হয়ে যাচ্ছে মেয়েটার।

“ মলম লাগবে?”
“ আপনি….. “
অরা কথা শেষ করতে পারে না। আরিশ তার আগেই অরার কোমরে হাত রেখে নিজের সাথে মিশিয়ে ফেলে, ঠোঁটে ঠোঁট ছুঁইয়ে দেয়। বড়ো বড়ো চোখ করে তাকিয়ে রইলো অরা। এতো দ্রুত কীভাবে কাছে এলেন ভদ্রলোক?
আরিশ অরাকে দাঁড় করিয়ে, পাশের ড্রয়ার থেকে একটা মলম বের করলো। তারপর ডান হাতের আঙুলের সাহায্যে অরার কাঁধে মলম লাগাতে লাগলো।
“ আমি সাপ হয়ে দংশন করি, ওঝা হয়ে বিষ ঝাড়ি। বুঝলে?”
“ নাহ। আপনাকে বোঝা আমার ক্ষমতার বাইরে। “
“ অনলাইনে খাবার অর্ডার করিয়ে দিয়েছি। ফ্রেশ হয়ে আসো। “
“ ফ্রেশ হলাম তো। “
“ আবার হও। “

কিছু বলল না অরা। চুপচাপ ওয়াশরুমের দিকে এগোল গেলো কেবল। মাঝে মধ্যে অরার মনে সংশয় দেখা দেয়। আরিশের সাথে আদৌও কি সারাজীবন থাকতে পারবে অরা?
দু’দিন ধরে সাবিহার সাথে কথা হয়নি মেহরাবের। সেজন্য বড্ড অস্থির হয়ে আছে তার মন৷ হুট করে কী হলো মেয়েটার? ভাবতে ভাবতে ফোন হাতে নিয়ে আরেকবার কল করলো সাবিহার নম্বরে। এবার কল ঢুকেছে! অধীর আগ্রহে ফোন কানে ধরে শোয়া থেকে উঠে বসলো সে।
“ হ্যালো! “
“ কী হ্যালো? কী হয়েছে তোমার? দুদিন ধরে ফোন বন্ধ ছিলো কেন? “
“ আরে আমার ফোনে সমস্যা হয়েছিল। নতুন ফোন কিনতে কিনতে একটু সময় লাগলো। “
স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ল মেহরাব। সাবিহার ঠোঁটের কোণে হাসি। এক ছিলো আরিশ, যার জন্য সাবিহা সারাক্ষণ চাতক পাখির মতো অপেক্ষা করলেও সে কখনো সাবিহার দিকে তাকাতো না পর্যন্ত। আর মেহরাব? সে সদাসর্বদা সাবিহাকে নিয়ে ভাবে।

“ আচ্ছা, বুঝতে পেরেছি। তুমি ভালো আছো তো?”
“ হ্যাঁ, আমি ঠিক আছি। আপনার কথা বলুন। “
“ আমিও ভালো আছি। “
“ আচ্ছা রাতে কল দিচ্ছি। আমি আগে মায়ের সাথে কথা বলে নেই একবার। উনিও নিশ্চয়ই চিন্তা করছেন। ‘
“ ওকে। আমিও বের হবো, অরার জন্মদিন উপলক্ষে পার্টি আছে। আরিশ ইনভাইট করলো। তোমাকে মিস করবো। “
“ কেন?”
থতমত খেলো মেহরাব। কেন মিস করে এটা কী বলতে হয়?
“ এমনি। সবাই থাকবে, তুমি নেই সেজন্য। “
“ ওহ আচ্ছা। ওকে, বায়।”
“ বায়। “
কল কেটে মুচকি মুচকি হাসছে মেহরাব। কীভাবে যে এই সাবিহার প্রতি এতটা অনুভূতি প্রবল হলো সে নিজেও জানে না।

সন্ধ্যার মিষ্টি বাতাস খান বাড়ির বিশাল আঙিনায় হালকা দুল খাচ্ছে। সাদা-সোনালি রঙের ফেয়ারি লাইটে সাজানো গোটা বাগান যেন কোনো পরীদের রাজ্য। গেটের বাইরে থেকে তাকালেই মনে হয় – এ যেন এক রাজপ্রাসাদে ঢোকার আমন্ত্রণ।
আজ অরার জন্মদিন। মাত্র বিশে পা দিয়েছে সে। পুরো বাড়ি আলোয় ঝলমল, সাজে-গানে-গেস্টে জমজমাট পরিবেশ। মেহরাব এসেছে, তালহা ও তামান্না ব্যস্ত একেক কোণে। অরা তখনও নিজের ঘরে, আয়নার সামনে বসে পার্টির জন্য তৈরি হচ্ছে। নয়না ইতোমধ্যেই তৈরি হয়ে পার্টিতে যোগ দিয়েছে।
বিছানার কোণে দাঁড়িয়ে আরিশ তাকিয়ে আছে অরার দিকে, গভীরভাবে। তার চোখ অরাকে পা থেকে মাথা পর্যন্ত ধীরে ধীরে স্ক্যান করছে, যেন প্রথমবার দেখছে । আরিশের পরনে ছিল কালো সিল্ক শার্ট, যার বোতাম খোলা ছিল একদুটি– রুচিশীল অথচ একটু বেপরোয়া। তার ওপর ধূসর টেক্সচার্ড ব্লেজার, নিখুঁতভাবে কাটানো। হাতে রোলেক্স ঘড়ি, কালো ডায়ালের অভিজাততা যেন চুপিচুপি কিছু বলছে। পায়ে চকচকে লেদার লোফার, চোখে হালকা ব্রাউন কন্ট্রাস্টেড সানগ্লাস। যা সে কেবল কপালে ঠেলে রেখেছে।
চুলে জেল দেওয়া হলেও সেটার সেটিং ন্যাচারাল ওয়েভের মতোই। গালের হালকা দাড়ি-গোঁফে শৌখিনতা, ঠোঁটের কোণে অদ্ভুত এক রহস্যময়তা।
অরা কানে অর্নামেন্ট পরে নিতে ব্যস্ত।

“আমি হেল্প করছি।”
হঠাৎ বলে উঠল আরিশ।
অরার হাত থেকে কানের দুল নিয়ে নিল সে। পার্লার থেকে লোক আনতে বলেছিল আরিশ, কিন্তু অরার আপত্তিতে তা সম্ভব হয়নি।
“আমি নিজেই করে নিতাম তো।”
“চুপ করে বসো।”
হালকা গম্ভীর কণ্ঠে বলল আরিশ।
অরা কোনো আপত্তি না করে চুপ করে বসল।
আরিশ ধীরে ধীরে তার কানে দুল পরিয়ে দিতে লাগল। কানের লতিতে আরিশের আঙুলের কোমল স্পর্শে কেঁপে উঠল অরা। আরিশ যেন ইচ্ছেমতো সময় নিচ্ছে, ইচ্ছেমতো তাকে জ্বালাচ্ছে।
অবশেষে দুল পরিয়ে দিয়ে এক পলক তাকাল আয়নায়।
“সব ঠিক আছে?”
অরা নিজের প্রতিবিম্বের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল।

আয়নার দিকেই তাকিয়ে আরিশ হালকা মাথা নাড়িয়ে আর হাত দিয়ে ইশারা করল—সবকিছু একদম ঠিকঠাক।
ক্রিম কালারের ফ্লোর-লেংথ গাউনটা যেন অরার শরীরে নিজে থেকেই লেপ্টে গেছে। নরম স্যাটিন আর চিকন জর্জেটের মিশেলে বানানো সেই গাউন, কোমরের কাছে ছিল হালকা কুঁচি, আর বুকের ওপর সূক্ষ্ম সিকুয়েন্স কাজ। গাউনের পেছনে লম্বা ট্রেইন, হাঁটার সময় যেটা রাজকীয় একটা ছাপ রাখছিল।
চুলগুলো ঢেউখেলানো করে খুলে রাখা, কাঁধ ছুঁয়ে নেমে এসেছে। পেছনে একটা সাদা ফুলের ক্লিপে চুলের অল্প একপাশ আটকে রাখা। চোখে হালকা স্মোকি আই মেকআপ, তবে খুব সফট। যাতে তার বড় বড় চোখ দুটো আরও গভীর আর আবেগময় লাগে। ঠোঁটে মেরুন লিপস্টিক, যা তার গাউন আর গলার রঙের সঙ্গে অসাধারণভাবে মানিয়ে গেছে।

গলায় ছিল চিকন ডায়মন্ড চেইন, হাতে হালকা ব্রেসলেট, আর কানে ঝুলন্ত পার্ল-ড্রপ দুল– যা আরিশ নিজে পরিয়ে দিয়েছে। পায়ের পাতায় হালকা হিল, আর তার নখগুলো ম্যাচিং ম্যারুন শেডে রাঙানো।
আরিশের ইশারায় অরা মুচকি হাসল।
“চলো, পার্টিতে যাওয়ার সময় হয়েছে।”
“হুম, চলুন।”
আরিশের হাতটা নিজের হাতের মধ্যে রেখে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল অরা।
অরা আর আরিশ হাত ধরে বেরিয়ে এলো ঘর থেকে। করিডোরজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে গোলাপি আর সাদা বেলুনের ছায়া। কাঁচের জানালা দিয়ে দেখা যাচ্ছে, গার্ডেনে থাকা গেস্টদের হাসি-আনন্দে মেতে ওঠা মুখগুলো। হালকা বাজছে ইংলিশ জ্যাজ মিউজিক।
তাদের দেখে প্রথম এগিয়ে এলো নয়না, চোখে মুখে উৎফুল্লতা—

“ আপাই, ইউ লুক স্টানিং!”
“তুইও কম না।”
মুচকি হেসে বলল অরা।
মেহরাব তখনই পাশ থেকে এগিয়ে এসে বলল,
“হ্যাপি বার্থডে, অরা।”
হাত বাড়িয়ে ফুলের একটা ছোট্ট টব দিলো সে।
অরা মৃদু হাসল,
“থ্যাঙ্ক ইউ।”
আরিশ আঁড়চোখে তাকিয়ে দেখছে সব।
তালহা মাইক্রোফোন হাতে নিয়ে বলল,
“লেডিস অ্যান্ড জেন্টলম্যান, প্লিজ ওয়েলকাম দ্য বার্থডে গার্ল!”
সবাই করতালি দিয়ে উঠল।
অরা আর আরিশ ধীরে ধীরে নামলো সিঁড়ি বেয়ে নিচে। যেন রূপকথার কোনো রাজকন্যা তার রাজপুত্রের হাত ধরে প্রবেশ করছে আলোকোজ্জ্বল মঞ্চে।

সবার করতালির মাঝে কেক সামনে এগিয়ে আনা হলো। কেকটা ছিল একেবারে রাজকীয়– তিন স্তরের ভ্যানিলা-স্ট্রবেরি ফিউশন কেক, যার প্রতিটা স্তরে ছিল শিল্পীর মতো করে সাজানো কাজ। নিচের বড় স্তরটা ছিল হালকা গোলাপি রঙের, তার ওপর সোনালি এডিবল পেইন্ট দিয়ে আঁকা ফুলের লতাপাতা। মাঝের স্তর ছিল ক্রিম কালারে, জড়ানো ছিল সাদা মুক্তোর মতো ছোট ছোট চকোলেট বল। আর ওপরের স্তরটা পুরোপুরি সাদা, যার চারদিকে লাইট পিঙ্ক রোজ ফ্লাওয়ার তৈরি করা হয়েছিল ফ্রেশ ক্রিম দিয়ে।
সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল কেকের মাথায় বসানো ছোট্ট একটা সোনালি ক্রাউন—যেন অরার রাজরানী হয়ে ওঠার প্রতীক। কেকের এক পাশে চকোলেটে লেখা ছিল,
“Happy 20th, Our Moonlight Aura!”
চারপাশে ছিল স্নোফ্লেক ও তারার ছোট ছোট এডিবল ডিজাইন। কেকের চারপাশে প্যালেটের মতো ছড়িয়ে দেওয়া ছিল রোজ পেটেলস আর মিনি ম্যাকারুনস।
আরিশ ঝুঁকে গিয়ে অরার কানে কানে বললো,

“তোমার হাসিটা আজ আলাদা লাগছে, হামিংবার্ড। ”
অরা হেসে বললো,
“কারণ আপনার সাথে এটা আমার জীবনের প্রথম জন্মদিন। ।”
আরিশ হাসল কেবল, কিছু বলল না।
কেক কেটে প্রথম টুকরোটা তুলে ধরল অরা, আরিশের মুখের সামনে। আরিশ একটুখানি হাসে, সেটা খেয়ে নিয়ে বলল,
“হ্যাপি বার্থডে, মিসেস খান। তোমায় পেয়ে আমার জীবন পূর্ণ।”
“ সেইম টু ইউ। “

এরপর মা-বাবা, বোন, তালহা, তামান্নাকে কেক খাইয়ে দিলো অরা।৷
রাতের আকাশে আতশবাজি ফুটছে। মেহরাব, নয়না, তালহা, তামান্না, সবাই মিলে দোল খাচ্ছে আনন্দে। অরা একটু দূরে এসে দাঁড়াল, একা। আকাশের দিকে তাকিয়ে।
আরিশ পেছন থেকে এসে ওর পাশে দাঁড়াল।
“কী ভাবছো?”
“ভাবছি, আমার জীবনে এমন মানুষ না থাকলে হয়তো আজকের এই রাতটার কোনো মানে থাকত না।”
আরিশ ওর কাঁধে হাত রাখল,
“আমি আছি। সবসময় হামিংবার্ড। তুমি থাকবে তো?”

হামিংবার্ড পর্ব ৪৬

আরিশের চোখেমুখে ভয় ফুটে উঠেছে। দিন যতই এগোচ্ছে ততই অরাকে হারানোর ভয় জেঁকে বসছে তার মনে।
অরা তাকাল আরিশের চোখে, গভীরভাবে।
“ আপনি এভাবে রেখে দিলে আমি কীভাবে না থেকে পারবো? আপনি তো জোর করেই ধরে রাখবেন আমাকে। “
ফিক করে হেসে উঠল অরা। আরিশও হাসলো। এটাই বাস্তব, আরিশ কখনোই অরাকে দূরে সরতে দেবে না।

হামিংবার্ড পর্ব ৪৮