প্রণয়ের সন্ধিক্ষণে পর্ব ৩৪

প্রণয়ের সন্ধিক্ষণে পর্ব ৩৪
আদ্রিতা নিশি

রাতময় ঝড়, বৃষ্টি শহর জুড়ে তান্ডব চালিয়েছে। বজ্রপাত, ঝড়ো দমকা হাওয়া পরিবেশ অশান্ত করে তুলেছিলো। রাত পেরিয়ে ভোর হয়েছে। ঝড়,বৃষ্টি নেই এখন। পরিবেশ অশান্ত থেকে শান্ত হয়ে গেছে। রাতে ঝড় যেনো বিধ্বংসী রুপ ধারণ করেছিলো। শহরের বিভিন্ন স্থানে রাস্তার পাশের গাছপালা রাস্তার মাঝখানে ভেঙে পরেছে। গাড়ি চলাচল আপাতত অনেক জায়গায় বন্ধ। নেটওয়ার্কের ও খুবই করুণ অবস্থা। ভয়ংকর ঝড়ের তান্ডবলীলা শেষে ভোর থেকে অবশেষে জনমানস একটু স্বস্তি পেয়েছে। কিন্তু প্রেমিক পুরুষের বুকের ঝড় এখনো থামেনি। তান্ডব চালিয়ে যাচ্ছে ইচ্ছেমতো। কখন প্রেয়সীকে খুঁজে পাবে?
সারহান সারারাত থানায় কাটিয়েছে। সে ভার্সিটি থেকে সরাসরি থানায় পুলিশের সাথে কথা বলতে এসেছিলো।পুলিশ পরিচিত তাই ইনভেস্টিকেশন তখনি শুরু করার চান্স বেশী ছিলো।সারারাত জেগে থাকার আর দুশ্চিন্তা করার কারণে সারহানের চোখ রক্তবর্ণ ধারণ করেছে। মুখশ্রী অতিশয় গম্ভীর, চুলগুলো উসকো খুসকো,কপালের রগ গুলো দৃশ্যমান। রাতে বৃষ্টিতে ভিজে উবুজুবু অবস্থা হয়েছিলো। ভেজা শরীরেরই ছুটে এসেছিলো থানায়। সারারাতে ভেজা শার্ট শুকিয়ে গিয়েছে। অথচ এসব দিকে তার খেয়াল নেই। গভীর ভাবনায় মত্ত সে। গতরাতের কথা মনে পরলো তার।

মুন আর রাইয়ের সাথে অরিত্রিকা আর ইশরাকে না দেখতে পেয়ে সকলে গভীর চিন্তায় পরে যায়।যে যার মতো খুঁজতে শুরু করে।কিছু সময় পরেই আকাশ হতে ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামে। বজ্রের হুংকার প্রতিধ্বনিত হচ্ছিলো। বৃষ্টির তোয়াক্কা না করে দুজনকে খুঁজতে উদগ্রীব হয়ে যায়। সারহান চিন্তিত হলেও তার মনে হয়েছিলো হয়তো আশে পাশে কোথাও গিয়েছে। খুঁজলেই পেয়ে যাবে। অরিত্রিকার ফোনে সারহান কল দিয়েছিলো সেই মুহুর্তে ফোন বন্ধ দেখাচ্ছিলো। ইশরাকে কল করলেও ফোন বেজে যাচ্ছিলো অথচ কেউ কল ধরছিলো না। এতেই সারহানের টেনশনে মাত্রা বৃদ্ধি পায়। মাথায় একটায় চিন্তা ঘুরতে থাকে দুজনের কোনো বিপদ হয়নি তো?

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

পৃহাল আর সারহান বৃষ্টির মাঝে হাঁটতে হাঁটতে আম বাগানের কাছে আসে। নির্জন স্থান।ল্যাম্পপোস্টের আলোয় হালকা আশপাশ দেখা যাচ্ছে। চারিদিকে তীক্ষ্ণ নজরে অবলোকন করে সামনের দিকে এগিয়ে যেতেই দুজনে দেখতে পেলো কেউ একজন আম গাছের কাছে পরে আছে। তারা দৌড়ে সেখানে গেলো। সারহান কাছে গিয়ে খেয়াল করতেই বুঝতে পারলো এটা ইশরা। ইশরার মুখের ওপর চুল এলোমেলো হয়ে হয়ে পড়ে থাকায় সারহান তা সরিয়ে দেখলো রক্তে পুরো মুখ লাল হয়ে আছে। তা দেখে সারহান আর পৃহাল বিচলিত হলো। সারহান পৃহালকে ইশরাকে নিয়ে হসপিটালের নিয়ে যাওয়ার কথা বললে পৃহাল দৌড়ে গাড়ি আনতে যায়। মিনিট খানেক পরেই গাড়ি নিয়ে ফিরতেই সারহান ইশরাকে পাজাকোলে তুলে গাড়িতে তুলে দিলো। ভেতরে রাই বসে ছিলো। সে ইশরাকে ভালোভাবে শুইয়ে দিলো সিটে।ইশরার মাথা আস্তে করে নিজের কোলের ওপর রাখলো। ইশরার করুণ অবস্থা দেখে কেঁদে উঠলো রাই। পৃহাল এক মুহুর্ত দেরি না করে গাড়ি স্টার্ট দেয়।রওনা দিয়েছিলো হাসপাতালের দিকে।

সারহান,মুন, ইফাত পুরো ভার্সিটি খুঁজেও অরিত্রিকার কোনো হদিস পায় নি। শুধু অরিত্রিকার ভাঙাচোরা ফোনটা রাস্তায় পেয়েছিলো।সারহান বাহিরে নিজেকে শক্ত রাখার চেষ্টা করলেও ভেতরে ভেতরে সে মূর্ছে পরেছিলো। তার মনের মাঝে অরিত্রিকা কে হারানোর ভয় জেঁকে ধরেছিলো। মনের অবস্থা মুর্মুর্ষ, দগ্ধ, বিচলিত। মন বলছিলো অরিত্রিকার যেনো কিছু না হোক।প্রেয়সী যেনো সুস্থ থাকে ভালো থাকে। মনে পরছিলো অরিত্রিকার করা নানা পাগলামীর কথা। চঞ্চল পায়ে সারাদিন বাড়ি মাতিয়ে রাখে। আজ সে কোথায় হারালো?সারহানের চোখ বেয়ে একফোঁটা নোনা পানির বিন্দু বেয়ে পরেছিলো। পাষন্ড,যন্ত্র মানবও বুঝি কাউকে হারানোর ভয়ে অশ্রু ফেলে?
~ সারহান রাস্তার গাছপালা সরিয়ে ফেলা হয়েছে। আমরা এখন এখান থেকে বের হতে পারি। প্রায় ভোর হয়ে এসেছে।

সারহানের ভাবনার সমাপ্তি ঘটলো আবিরের কথায়। সে আবিরের দিকে তাকালো নির্জীব দৃষ্টিতে।আবির সারহানের মনের অবস্থা বুঝলো। সে কখনো সারহানকে এতোটা ভেঙ্গে পরতে দেখেনি। আজই প্রথম। তার ভাবতেই অবাক লাগছে কঠোর ব্যক্তিত্বের মানুষের মন ও নরম হয়।
সারহান ভিজে গলায় শুধালো ~ পুলিশ নিশাদের কোনো খোঁজ পেয়েছে?
আবির উদাস হয়ে বললো~ নাহ। ফোন ট্রেক করা যাচ্ছে না। নেটওয়ার্ক ইস্যু আর ফোনও বন্ধ।
সারহানের ভাবমূর্তির পরিবর্তন হলো। সে উত্তেজিত হয়ে বলে উঠলো ~ আ’ম সিউর ওই বাস্টার্ডটা অরিত্রিকা কে কিড ন্যাপ করেছে। আমার একটু সতর্ক হওয়া উচিত ছিলো। ওই বিচ টা যে অরিত্রিকার পিছু ছাড়ে নি এটা আমি কিভাবে ভুলে গেলাম। ড্যামেট।

~ এতো উত্তেজিত না হয়ে শান্ত হো।পুলিশ তো তেমন একটা সুবিধা করতে পারলো না। আমাদের লোকজন বৃষ্টি থাকায় তেমন খোঁজ নিতে পারেনি। এতো টেনশন করিস না অরিত্রিকাকে পেয়ে যাবো।
~ ওই নিশাদকে পেলে আমি জানে মে রে দেবো। ও জানে না কার কলিজায় হাত দিয়েছে। যে হাত অরিত্রিকার দিকে বাড়িয়েছে সে হাত ভেঙে দিবো। শা*লা কু*ত্তা।
সারহান উঠে দাঁড়ালো। শার্ট টেনে বললো~ পুলিশের আসায় থেকে লাভ নেই। যা করার আমাকেই করতে হবে চল।
সারহান থানা থেকে বেরিয়ে পরলো। পিছে পিছে আবিরও গেলো। ভোরের আলো ফুটছে।হিমেল হাওয়া বইছে। আজ পাখির কলরব তেমন নেই।সারহান পার্কিং প্লেস থেকে তার গাড়ি আবির কে বের করতে বললো। আবির সারহানের কথা মতো গাড়ি বের করলো। সারহান গাড়িতে উঠে বসতেই আবির গাড়ি ছাড়লো।
সারহান সিটবেল্ট বেঁধে পকেট হাতড়ে ফোন বের করলো। ফোনে পানি ঢুকে একাকার অবস্থা। ফোন বন্ধ হয়ে আছে। বেজায় বিরক্ত হলো সে।

সারহান আবির কে বললো~ তোর ফোনটা দে তো।
আবির গাড়ি চালাতে চালাতেই পকেট হতে ফোন বের করে সারহানের হাতে দিলো। আবিরের ফোনের পেছনে ফোনের ব্যাকপার্টের মাঝে পিন থাকায় সিম খুলতে অসুবিধা হলো না সারহানের। তার ফোন হতে সিম খুলে আবিরের ফোনে লাগিয়ে দিলো। তার ফোনটা পকেটে রেখে দিলো। ফোনের সকল সেটিংস নিজের ফোনের ন্যায় করলো আপাতত।
সারহান আবির কে বললো~ আপাতত তোর ফোনটা ইউজ করছি।আমার ফোন বন্ধ হয়ে গেছে।
আবির বললো~ ঠিক আছে।
সারহান পৃহালকে কল দিলো। ফোন বন্ধ। তার খেয়াল হলো বৃষ্টিতে দুজনে ভিজে গিয়েছিলো। হয়তো ফোন নষ্ট হয়ে গেছে। ইফাতকে কল দিলেও ইফাত ফোন তুললো না।
আবির বললো~ আমরা কোথায় যাবো?
সারহান ফোনে দৃষ্টি রেখে বললো~ নিশাদের বাড়িতে।

~ তোর কি মনে হয় নিশাদ ওর বাড়িতে আছে?
~ নিশাদ বাড়িতে না থাকলেও ওর বাবা মা আছে তো। কোনো না কোনো ক্লু পাবো।
আবির চুপচাপ মনোযোগ দিয়ে গাড়ি চালাতে লাগলো।
সারহান চলন্ত গাড়ি হতে কাচ ভেদ করে বাহিরে তাকালো।বক্ষ কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। অস্থিরতা কাজ করছে ভেতরে। মস্তিষ্কশূণ্য হয়ে পরেছে সে। এতোটা দিশেহারা সে কখনো হয়নি। কিন্তু আজ অরিত্রিকার জন্য সে বিচলিত, চিন্তিত। ঝড়ের কবলে পরে বাড়ির অবস্থাও জানা হয়নি। বাড়িতে সকলে কি অবস্থায় আছে কে জানে? নিশ্চয়ই অনেকটা ভেঙে পরেছে।ইশরার খবর টাও পাচ্ছে না। চারিদিকের উত্তপ্ত পরিস্থিতিতে সে দগ্ধ।
এর মাঝেই সারহানের হাতে থাকা ফোনটি বেজে উঠলো।আননোন নাম্বার ভেসে উঠেছে ফোন স্কিনে। সারহান তা দেখে ভ্রু কুঁচকালো। এতো ভোরে কে কল করছে তাকে? কল রিসিভ করবে না ভেবেও অবশেষে রিসিভ করলো।
ফোন কানে রাখতেই ভেসে এলো মেয়েলী কন্ঠস্বর ~ আমার কথা শুনতে পাচ্ছেন সারহান?
ফোনে নেটওয়ার্কের সমস্যার কারণে অস্পষ্ট শুনালো।সারহান কিছুটা বুঝতে পেরে গম্ভীর কণ্ঠে উত্তর দিলো ~ হুমম শুনছি।আপনি কে বলছেন?

~ আপাতত আমার পরিচয় দেওয়ার সময় নেই। আমি যা বলছি মন দিয়ে শুনুন। বগুড়া ফাইভ স্টার হোটেলে অরিত্রিকা আছে। ওকে কিড ন্যাপ করা হয়েছে। আপনারা যত দ্রুত পারুন উদ্ধার করুন। সময় কিন্তু বেশী নেই। আর হ্যা এখানে কিন্তু অরিত্রিকাকে পাহারা দেওয়ার জন্য কয়েকজন আছে। দরকার হয় পুলিশ নিয়ে আসবেন।রুম নাম্বার – ২০।আমার কথা অবিশ্বাস করবে না দয়া করে। আমি আপনাদের শুভাকাঙ্ক্ষী হয়ে হেল্প করছি। সময় হলে পরিচয় দেবো। আপনার ফোনে হোয়াটসঅ্যাপে কয়েকটা ছবি পাঠিয়েছি দেখুন। আর যত দ্রুত পারুন আপনার ভালোবাসার মানুষটিকে উদ্ধার করুন।
অচেনা মেয়েটি কল কেটে দিলো।সারহান অরিত্রিকার নাম শুনে চমকে গিয়েছিলো। সে হন্তদন্ত হয়ে ডাটা অন করে ছবি চেক করার জন্য হোয়াটসঅ্যাপে প্রবেশ করলো। অচেনা নাম্বার হতে কয়েকটি ছবি দেখলো সে। ছবিতে অরিত্রিকা হোটেল রুমে ঘুমিয়ে আছে। বিছানার ওপরে দেয়ালে হোটেলের নেমপ্লেট লাগানো। সারহান একটু চিন্তামুক্ত হলো। অরিত্রিকার খোঁজ পেয়েছে এটাই অনেক। তারমানে মেয়েটি তাকে মিথ্যা বলেনি।
সারহান আর দেরি না করে আবির কে বললো ~ বগুড়া ফাইফ স্টার হোটেলে চল। ফাঁকা রাস্তা দ্রুত গাড়ি চালাবি।
আবির অবাক হয়ে বললো~ কেনো?
~ ওখানে অরিত্রিকা আছে।

অরিত্রিকার চেতনা ফিরেছে একটু আগে। চোখ খুলতেই আবিষ্কার করেছে অচেনা একটা রুম। সে আতংকগ্রস্থ বিছানা থেকে লাফিয়ে উঠলো। ভীত চোখে চারিদিকে চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে অবলোকন করছে। বিছানার একপাশে গুটিশুটি হয়ে বসে আছে। ভয়ে হাত পা শীতল হয়ে আসছে। বারবার ঢোক গিলছে।চোখ ভিজে আসছে নোনা পানিতে দেওয়ালে টানানো হোটেলের নাম দেখে এতোটুকুও বুঝেছে সে রাজশাহীতে নেই। এতেই ভয়ের মাত্রা বেড়ে গেছে তার। তাকে কে কিড ন্যাপ করতে পারে? তার তো তেমন শ ত্রু নেই যে প্রতি শোধ নিবে? তাহলে কি রাজনৈতিক কারণে সে শিকার হয়েছে। ভাবতেই গলা শুকিয়ে আসলো অরিত্রিকার। নিশ্চয়ই তাকে মে রে ফেলবে। ভাবতেই কান্না পেলো তার। সে কি করে বাঁচবে? তাকে কে বাঁচাবে?
দরজা খোলার শব্দে অরিত্রিকা আরও গুটিশুটি হয়ে বসলো। ভীত চোখে দরজার দিকে তাকালো। দরজা খুলে মানবটি প্রবেশ করলো।অরিত্রিকা মানুষটিকে দেখে হতবাক হয়ে গেলো।
অরিত্রিকা হতবম্ব হয়ে জোরে বলে উঠলো ~ আপনি?
অরিত্রিকার কন্ঠে অবাকতার রেষ।সে নিজ চোখে বিশ্বাস করতে পারছে না এই মানুষটি তাকে কিড ন্যাপ করেছে।
নিশাদ দরজা বন্ধ করে অরিত্রিকার দিকে এগিয়ে আসলো। প্রাণখোলা হাসি দিয়ে বললো~ হুমম আমি। আমায় দেখে অবাক হলে বুঝি?

অরিত্রিকার নিশাদের প্রতি ক্ষোভ, ঘৃণা জন্মানো।তার রাগে মাথা ফেটে যাচ্ছে।এই নিশাদের বাচ্চা এখনো তার পিছু ছাড়িনি।সে রাগে রিরি করে উঠে বললো ~ আপনি আমায় কিড ন্যাপ করেছেন?আমি আপনার কি ক্ষতি করেছি?
নিশাদ যেনো মজা পেলো।সে রুমে থাকা সোফায় নাটকীয় ভঙ্গিতে বসলো। হেসে বললো~ তুমি আমার মন চুরি করেছো বুঝলে এতেই আমার বিরাট ক্ষতি হয়েছে। ক্ষতিপূরণ হিসেবে তোমায় বিয়ে করবো বুঝলে।
অরিত্রিকার ভীষণ রেগে গেলো। তার বিরক্তির মাত্রা চরম হলো।সে তেজি গলায় বললো~ আপনি কি আমার সাথে মশকরা করছেন?
নিশাদ দু দিকে মাথা নাড়িয়ে বললো~ মশকরা কেনো করবো বলো তো? বিয়ে নিয়ে কেউ মশকরা করে?
অরিত্রিকা চিল্লিয়ে বললো~ আমি আপনাকে কখনো বিয়ে করবো না।
নিশাদ কিটকিটিয়ে হেসে বললো~ তোমার আমাকে বিয়ে করা লাগবে না। আমি তোমায় বিয়ে করবো ।এবার একটু শান্ত হও। একটু পরেই খাবার দিয়ে যাবে খেয়ে সুস্থ হও। তারপর আমাদের বিয়ে হবে। ইস।
অরিত্রিকা বিরক্তি নিয়ে বললো~ আপনাকে কে বিয়ে করবে? আমি কখনোই বিয়ে করবো না। দরকার হলে ম রে যাবো।

নিশাদ হাসা বাদ দিয়ে গম্ভীর কণ্ঠে বলে উঠলো~ আমায় ভয় দেখাচ্ছে?এসব মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলো। বিয়ে তো তোমার আমাকেই করতে হবে। এছাড়া তো তোমার কাছে কোনো উপায় খোলা নেই।
অরিত্রিকা চোখ মুখ শক্ত করে চুপ করে বসে রইল।সে কখনোই এই গায়ে পরা ছাগলকে বিয়ে করবে না। উহহ শখ কতো তাকে বিয়ে করবে। বিয়ের ভূত ছাড়ানো জন্য সারহান ভাই তো আছে। একবার শুধু আসুক তারপর ছাগলের কাবাব বানাবে। তখন বুঝবে কিড ন্যাপ করার ফল।
নিশাদ অরিত্রিকা কে চুপ থাকতে দেখে হাতে থাকা ঘড়িতে সময় দেখে বললো~ সাড়ে ছয়টা বাজে। একঘন্টা সময় দিচ্ছি ফ্রেশ হয়ে খাওয়া দাওয়া করে নাও। আলমারিতে তোমার জন্য শাড়ি আছে পরে নিও।
অরিত্রিকা মুখ বাঁকিয়ে বললো~ আপনাকে বিয়ে করবো না। শাড়িও পরবো না। আপনি বিদায় হোন তো চোখের সামনে থেকে।
নিশাদ রেগে গেলেও প্রকাশ করলো না। সে শান্ত কন্ঠে বললো~ আমি মিহিকে পাঠিয়ে দিচ্ছি তোমায় শাড়ি পরিয়ে সাজিয়ে দেবে।

অরিত্রিকা নিশাদের মুখে মিহির নাম শুনে ধাক্কা খেলো।তারমানে মিহি নিশাদের পরিচিত।? তার সবকিছু গোলমাল হয়ে যাচ্ছে। নিশ্চয়ই নিশাদের সাথে জড়িত আছে।নিশাদ এক পলক অরিত্রিকার দিকে তাকিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো।দরজা বাহির হতে আঁটকে দিলো। মিনিট দশেক পর রুম খুলে প্রবেশ করলো মিহি। দরজা আঁটকে খাবার নিয়ে অরিত্রিকার কাছে আসলো। ছোট টেবিলে খাবার রেখে বসলো সে। অরিত্রিকা রাগান্বিত দৃষ্টিতে মিহির দিকে তাকালো।মিহি তা দেখে হাসলো।হাসিতে প্রাণ নেই কেমন মলিন দেখাচ্ছে।
মিহি মলিন হেসে বললো~ আবারও দেখা হয়ে গেলো তোমার সাথে। কি ভাগ্য আমার।
অরিত্রিকা নিজের রাগ সংবরণ করার চেষ্টা করছে। মিহিকে তার অসহ্য লাগছে। মন চাইছে জানালা দিয়ে এই মেয়েকে ফেলে দিতে। হাত পা ভেঙে পরে থাকতো।
মিহি অরিত্রিকাকে তার দিকে রাগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে দেখে বললো~ খাবার খেয়ে নাও।
অরিত্রিকা ত্যাড়া স্বরে বললো~ আপনি খান আপু।আমার খাওয়ার ইচ্ছা নাই। ওই নিশাদকে দেখে আমার খাবার ইচ্ছে ম রে গেছে।

মিহি বললো ~ বুঝলাম তাহলে আর কি শাড়ি পরিয়ে দেই তোমায়। কিছুক্ষণ পরেই তো বিয়ে।
অরিত্রিকা ক্ষুদ্ধ হয়ে বললো~ আমি ওই ছাগলকে বিয়ে করবো না।
~ নিশাদ রেগে গেলে কিন্তু তুমি সমস্যায় পরবে।
~ আপনার ভাবতে হবে না। আগে বলুন আপনিও নিশাদের সাথে যুক্ত আছেন তাই না?
~ তোমার কি মনে হচ্ছে?
~ আমি জানি আপনিও যুক্ত আছেন। ওই নিশাদ আমার পিছু কেনো ছাড়ছে না?
~ তোমায় ভালোবাসে তাই।
অরিত্রিকা উত্তেজিত হয়ে ছলছল চোখে বলে উঠলো ~ আমি উনাকে ভালোবাসি না। আমি সারহান ভাইকে ভালোবাসি।
মিহি বললো~ জানি তো। তুমি মিস্টার সারহানকে ভালোবাসো।
অরিত্রিকা বিস্ময় নিয়ে মিহির দিকে তাকালো। সে মিহির কথা শুনে হতবম্ব হয়ে গেছে। মিহি স্বাভাবিক। মনে হচ্ছে আগে থেকেই জানতো সে।
অরিত্রিকা মিহির হাত ধরে মিনতির স্বরে বললো~ আপু আমি নিশাদকে বিয়ে করতে চাই না।আমি এখান থেকে বের হতে চাই। হেল্প করেন প্লিজ। আপনি তো জানেন আমি সারহান ভাইকে খুব ভালোবাসি। আমি এখন কোথায় আছি? এটা কোন জায়গা?
মিহি শুকনো মুখে বললো~ তুমি এখন বগুড়ায় আছো। এই রুমের বাহিরে বেশ কয়েকজন পাহারায় আছে।আমি তোমায় বের হওয়ার জন্য হেল্প করতে পারবো না। কারণ এই রুমে আসার আগে আমার ফোন নিশাদ নিয়ে নিয়েছে।

অরিত্রিকার দিশেহারা লাগছে কি করবে সে? এতোক্ষণ মন স্থির, শক্ত রাখলেও এখন ভয় লাগছে। কি করবে সে? এখান থেকে পালানোর উপায় ও নেই। চিন্তায় মাথা ফেটে যাচ্ছে তার।
” সারহান ভাই আপনি কোথায়? আমায় নিশাদের থেকে বাঁচান। আমি আপনাকে ছাড়া অন্য মানুষকে বিয়ে করতে পারবো না। “অরিত্রিকা মনে মনে বলেই ডুকরে কেঁদে উঠলো।মিহি অরিত্রিকার কান্নার শব্দে চমকে উঠলো।
বাহির হতে দরজায় কেউ ধাক্কা দিচ্ছে। মিহি অরিত্রিকার হাত ছাড়িয়ে দরজা খুলতে গেলো।দরজা খুলেই দেখলো নিশাদ দাঁড়িয়ে আছে। নিশাদ মিহিকে পাত্তা না দিয়ে ভিতরে প্রবেশ করলো। অরিত্রিকাকে কাঁদতে দেখে তার মেজাজ খিঁচে এলো।
নিশাদ খিঁচে যাওয়া মেজাজ নিয়ে মিহিকে আদেশ করলো ~ সাড়ে সাতটা বাজে। আধা ঘণ্টা সময় দিলাম। অরিত্রিকাকে শাড়ি পরিয়ে সাজিয়ে গুজিয়ে রেডি করো। আটটায় বিয়ে পরানো হবে।
মিহি এগিয়ে এসে বললো~ ঠিক আছে।এতো রাগ করো না। বিয়ের দিনে বরকে রাগ করা মানায় না।

~ বেশি কথা না বলে যা করতে বলেছি তাই করো।
অরিত্রিকা জোরে কেঁদে উঠলো। চোখ লাল হয়ে এসেছে। কষ্টে, দুঃখে বুক ফেটে যাচ্ছে।
নিশাদ অরিত্রিকার দিকে তাকালো। মেয়েটার অশ্রু সহ্য হচ্ছে না। কিন্তু উপায় নেই। এভাবে বিয়ে না করলে সারহানের জন্য কখনো বিয়ে হতো না।
~ স্যার কাজি সাহেব এসেছেন।
রুমের বাহির হতে নিশাদের দলের একজন ডেকে বললো।
নিশাদ তা শুনে মিহিকে বললো~ থাক শাড়ি পরিয়ে দিতে হবে না।এভাবেই বিয়ে হবে।

নিশাদ হাসি মুখে গিয়ে দরজা খুলতেই সজোরে এক লাথি তার পেট বরাবর পরলো। সে মেঝেতে ছিটকে পরলো। মিহি আর অরিত্রিকা চমকে তাকালো দরজার দিকে। অরিত্রিকার কান্না থেকে গেছে। সারহান রক্ষ চক্ষুতে তাকিয়ে আছে নিশাদের দিকে। রাগে চোয়াল শক্ত হয়ে আছে। সে ভেতরে ঢুকেই হিংস্র বাঘের ন্যায় ফুসে নিশাদের শার্ট টেনে দাড়া করিয়ে মুখ বরাবর কয়েকটা ঘুষি মার লো। সারহান সজোরে নাক বরাবর ঘুষি মার তেই নিশাদের নাক ফেটে গলগল করে র ক্ত বেরোতে লাগলো।তার মাথা ঘুরিয়ে উঠলো। নিশাদ হঠাৎ আক্রমণে খেই হারিয়ে ফেলেছে। বুঝতে পারছে না সারহান কিভাবে এলো এখানে। পাল্টা আক্রমণের সুযোগ ও পাচ্ছে না। সারহান শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে বেদম পিটাচ্ছে নিশাদকে। নিশাদের অবস্থা করুণ।নাক, মুখ দিয়ে র ক্ত বেরোচ্ছে।ব্যথায় মেঝেতে বসে কাতরাতে লাগলো।সারহান হাঁপিয়ে গিয়েছে মার’তে মা’রতে। থেমে জোরে জোরে শ্বাস টেনে নিয়ে আবারও মা’রতে যাবে এমন সময় আবির সারহানকে পেছন থেকে চেপে ধরলো।মিহি গিয়ে নিশাদকে আগলে নিলো। চোখ দিয়ে অশ্রু গড়িয়ে পরছে।চোখের সামনে ভালোবাসার মানুষটিকে মার খেতে দেখতে পারলো না সে।
মিনি কান্না করতে করতে সারহানের কাছে আকুতি মিনতি করে বললো~ মিস্টার সারহান নিশাদকে আর মার’বেন না প্লিজ। ওর কিছু হয়ে গেলে আমি নিঃস্ব হয়ে যাবো।

নিশাদ দুর্বল চোখে মিহির কন্দনরত মুখশ্রীর দিকে তাকালো।মেয়েটি তার জন্য কাঁদছে?
সারহান মিহির কথা কানে তুললো না বজ্র কন্ঠে বলে উঠলো~ আবির ছাড় একে আজ আমি মে রেই ফেলবো। কতো বড়ো কলিজা হয়েছে আমি আজ ওর বুক চিরে দেখবো।
আবির শক্ত করে সারহানকে ধরে রেখে বললো~ তুই শান্ত হো। নিজের হাতে আইন তুলে নিবি নাকি? আইন ওকে শাস্তি দিবে।

সারহান মেজাজ খুইয়ে অশ্রাব্য কয়েকটা গালি দিলো। সারহান কিছুটা কিছুটা শান্ত হয়ে আসতেই আবির ছেড়ে দিলো। সেও হাপিয়ে গিয়েছে। আবির নিশাদের দিকে তাকালো। একদম আধ ম রা অবস্থা।
সারহান অন্যদিকে তাকিয়ে হুংকার ছেড়ে বললো~ এই আবর্জনার ব্যবস্থা কর। চোখের সামনে হতে নিয়ে যা।
অরিত্রিকা সারহানকে দেখে বাকরুদ্ধ হয়ে গেছে। এতোক্ষণ পরে সে কিছুটা স্বস্তি পেয়েছে।সে আর চুপচাপ বসে থাকতে পারলো না। বিছানা থেকে নেমে দৌড়ে কারো নজরের তোয়াক্কা না করে আবেগী হয়ে সারহানকে জরিয়ে ধরলো।জরিয়ে ধরেই কেঁদে উঠলো সে।

প্রণয়ের সন্ধিক্ষণে পর্ব ৩৩

দু’হাতের বাঁধনে পুরুষালী দেহটি শক্ত করে ধরেছে। মনে হচ্ছে এইতো এটাই তার নিরাপদ স্থান। সারহান কিছুটা পর বুঝলো অরিত্রিকা তাকে আলিঙ্গন করেছে।সারহানের রাগ মুহুর্তেই পানির ন্যায় শান্ত হয়ে গেলো।প্রশান্তিতে ভরে গেলো বক্ষস্থল।সে অরিত্রিকার দিকে মায়া ভরা নজরে তাকালো। তাকে আঁকড়ে ধরে কেঁদে চলেছে।সে আর বাঁধা দিলো না। নিজেও নির্দিধায় প্রেয়সীকে আগলে নিলো।

প্রণয়ের সন্ধিক্ষণে পর্ব ৩৫