একজোড়া আগুন পাখি পর্ব ৩৭ (২)

একজোড়া আগুন পাখি পর্ব ৩৭ (২)
রনীতা তুশ্মি

“অলিভার কি এখনো, ফেরেনি?”
ইনায়ার শান্ত কন্ঠস্বরের প্রশ্নতে জারা নামক মেয়েটি ভেতর হতে অনেকটা চমকে উঠলো। কিঞ্চিৎ ভয়ার্ত চেহারা বানিয়ে ঢোক গিলে তড়িঘড়ি উত্তর দিলো,
“নাহ, না ম্যাম। এখনো আসেনি?”
ইনা শান্ত চোখের তির্যক দৃষ্টিতে মেয়েটির দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতেই বললো,
“বাচ্চাগুলো ঠিকঠাক ভাবে নিয়ে গিয়েছে তো? এতোক্ষণে তো ফিরে আসার কথা ছিলো।”
—“জ্বী… মানে উনি বলেছিলেন উনার আসতে হয়তো এবার একটু দেরী হবে। আপনি চিন্তা করবেন, উনি হয়তো ঠিকঠাক ভাবেই বাচ্চাগুলো নিয়ে গিয়েছে। ফিরেও আসবে হয়তো তাড়াতাড়ি,আজকেই ফিরবে।তবে একটু বেশি রাত হতে পারে।”

জারা সম্পূর্ণ ভয়ে ভয়ে নিজের কথাগুলো কোনোমতে এলোমেলো ভাবে শেষ করে আড় চোখে ইনায়াকে দেখলো। ইনা সবার কাছেই একটা আ”তংক। এই মূহুর্তে ইনার সামনে থেকে সরে যেতে পারলেই যেন সব মঙ্গল। তবে ইনা কিছু না বলে চুপচাপ রইছে দেখে জারা আরো বেশি অস্থির হয়ে উঠলো। এরই মাঝে হঠাৎ অকপটে বলতে লাগলো,
“আমি আজ একটু বাহিরে যাবো। অলিভার ফিরে আসার আগেই চলে আসবো।”
ইনার কথা শোনা মাত্রই জারা তড়িঘড়ি করে বলতে লাগলো,
“কিন্তু ম্যাম, আপনার তো বাহিরে যাওয়াটা নিষেধ মানে অলিভার স্যারই তো একদম মানা করেছে তার পারমিশন…”
জারার কথা শেষ হওয়ার আগেই ইনা রাগান্বিত স্বরে বলতে লাগলো,
“আমি কোনো বাচ্চা না। এমনিতেও শপিং করতে যাবো আমি। এছাড়া আর কোনো বিশেষ কারণ নেই।”
ইনার এহেন কন্ঠে জারা প্রথমে খানিকটা কেঁপে উঠলেও পরবর্তীতে ইতস্ততভাবে বলতে লাগলো,
“ঠিক আছে ম্যাম। কিন্তু একবার যদি স্যার…”
“অলিভার কাজে গিয়েছে। ওর কাজে মাঝে বিরক্ত করতে চাই না। আশা করি, আমার শপিং করতে যাওয়া নিয়ে ওর তেমন কোনো প্রবলেম হবে না। এমনিতেও বেশি দেরী করবো না আমি। তুমি যেতে পারো।”
ইনার কথা শুনে মেয়েটির আর বেশি কিছু বলার রইলো না। মাথাটা কিঞ্চিৎ ঝুকিয়ে ইনাকে কুর্নিশ করেই চলে গেলো। এদিকে জারার চলে যাওয়ার দিকে অপলক চেয়ে থাকতে থাকতেই ইনা মনে মনে আওড়ালো,
“অনেক তো চেষ্টা হলো, ভিকে! বারবার ম”রতে গিয়েও ম” রলে না তুমি।এবারের শেষ চেষ্টাটা না হয় আমি করি। আশা রাখছি, এরপর আর কষ্ট করে তোমায় এই দুনিয়ায় বেঁচে থাকতে হবে না।”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

সাত বছর আগে যখন ইনায়াকে আলাদা করে খুব অল্প কিছুদিনের জন্য একটি আশ্রমে নিয়ে রাখা হয়; তার কিছুদিন পরই কেনীথের পরিকল্পনা অনুযায়ী সে ইনায়াকে আলাদা করে নিজের কাছে নয়তো পরিস্থিতি ভেদে আনায়ার সাথে অন্যকোথাও পাঠিয়ে দেওয়ার উদ্দেশ্যে। তবে আশ্রমে খুব বেশিদিন সে থাকতে পারেনি। বরং এর আগেই হুট করেই আনায়া পালিয়ে যায়। এটি কেনীথদের কাছে পুরো ঘটনায় ইনায়ার আশ্রম থেকে পালিয়ে যাওয়াটাই উল্লেখ হলেও আদতে এটিও ছিলো একটি ভুল তথ্য। কেননা ইনায়া একাই কোথাও পালিয়ে যায়নি বরং তাকে খুব কৌশলে আশ্রম থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছিলো রাতের আঁধারে। আর ইনায়ার আশ্রম থেকে হঠাৎ উধাও হওয়াতে সবাই ভেবেছিলো ও হয়তো পালিয়ে গিয়েছিলো।

অথচ ঠিক এখান থেকেই ইনায়ার সম্পূর্ণ জীবনের মোড় নিমিষেই পাল্টে গিয়েছিলো। অচেনা আজানা জায়গায় দিনের পর দিন সেই অল্প বয়সে প্রতিনিয়ত নানান অত্যাচার সহ্য করেছে। শুরুতে তাকে তেমন কিছু করা হতো না। কিন্তু তার মতো তেজী জেদি মেয়ে চুপচাপ কোনো কিছু সহ্য করার মতো নয়। চিল্লাচিল্লি কিংবা নিজের তেজ-ক্ষো’ভ দেখাতে গিয়ে হুট করেই সেই অল্প বয়সে নানান নির্মমতার স্বীকার হতে হয়েছে তাকে। এক অন্ধকার ছোট্টো ঘরে দিনের পর দিন তাকে না খাইয়ে রাখা হয়েছে। ২-৩ দিন পর্যন্ত না খেয়ে থাকার পর অল্প একটু খাবার পানির সাথে জোর করে শরীরে ইনজেকশন পুশ করে দেওয়া হতো কড়া ডোজের নানান সব ড্রা”গ। ইনায়া জানতো না তার সাথে ঠিক কি হচ্ছে, আর কেনই বা হচ্ছে । তবে সেসময় যারা তাকে মা’রধর কিংবা খাবার-পানি, ড্রা’গ দিতো; তাদের কাছ থেকে সে প্রায়ই শুনতো, এসব নাকি কেনীথের নির্দেশেই হচ্ছে; ইনায়ার পরিবার-জীবন তছনছ করে দেওয়া সেই ভিকে।
ইনায়ার পিঠে আজও সেই গরম লোহার রড দিয়ে মা”রার কালচে দাগগুলো স্পষ্ট ফুটে রইছে। সেসময় পিঠের নরম ফর্সা মাংস যেন উত্তপ্ত লোহার দরূন ঝলসে গিয়ে খানিকটা মাংস সহ চামড়া উঠে গিয়েছিলো। সময়ের বিবর্তনে আজ হয়তো সেই ব্যহ্যিক ক্ষতগুলো সেরে গিয়ে আজ তা পোশাকের আদলে ঢেকে থাকে। কিন্তু জ্যান্ত ইনায়ার সাথে হওয়া প্রতিটা নির্মম ঘটনা আজও ইনায়া অত্যন্ত যত্নের সাথে তার বিকৃত মন-মস্তিষ্কের পুষে আসছে।

বিকেল গড়িয়ে আর কিছুক্ষণ পড় সন্ধ্যা নামবে।একটি সম্পূর্ণ ফাঁকা রেস্টুরেন্টের শেষ প্রান্তের টেবিলে চুপচাপ গম্ভীর্যের সাথে পায়ের উপর পা তুলে বসে রইছে আনায়া। পড়নে একদম ক্যাজুয়াল শার্ট আর প্লাজো। এমনিতে তেমন কোনো সাজগোজ নেই আর। তবে চোখেমুখে এক অদ্ভুত চিন্তার ছাপ।
আনায়ার পাশে আরো কয়েকজন লোক দাঁড়িয়ে রইছে। পোশাকের ধরনে বোঝা যাচ্ছে তারা সবাই বডিগার্ড। আনায়া একবার নিজের বাম হাতের ঘড়িটায় চোখ বুলিয়ে সময়টা দেখে নিলো। আনায়া হয়তো মনে মনে এবার কিছুটা বিরক্ত। একজনকে আনতে এতো দেরী তো লাগার কথা না।
এরই মাঝে আচমকা রেস্টুরেন্টের ভেতরে দুজন বডিগার্ড একটা লোকের চোখে কাপড় বেঁধে দুজন দুপাশ থেকে ধরে নিয়ে এলো। যা দেখা মাত্রই আনায়ার ঠোঁটে কিঞ্চিৎ হাসি ফুটে উঠলো। সেই দুজন বডিগার্ড চোখে কাপড় বেঁধে দেওয়া লোকটিকে ধরে আনায়ার সামনে চেয়ারে বসিয়ে দিলো। অতঃপর একটানে চোখের কাপড়টা সরিয়ে দিয়ে দুজন দুপাশে দৃঢ় ভাবে দাঁড়িয়ে পড়লো।

এদিকে সেই চোখে কাপড় বাঁধা লোকটি আর কেউ না বরং রেহান। পরনে সাদামাটা সাদা টিশার্ট আর তার উপর ব্রাউন কালারের জ্যাকেট। এরই মাঝে রেহান আনায়ার দিকে তাকানো মাত্রই আকস্মিক বিস্মিত হতো। বুঝে উঠতে পারছে না এসব সপ্ন না সত্যি।
রেহানকে এহেন ভাবে বিস্মিত হতে দেখে আনায়া কিঞ্চিৎ মুচকি হাসলো। অতঃপর দু’হাত টেবিলের উপর রেখে এক করে নির্বিকার ভঙ্গিতে বলতে লাগলো,
“কেমন আছো রেহান?”
রেহান এখনো তার চোখের সামনে বসে থাকা হাস্যজ্জ্বল নারীটির দিকে বিস্ময়ের সাথে তাকিয়ে। ওর চোখের পলক পড়ছে না। চোখমুখ হতে বিস্ময়ও সরছে না। এতোগুলো বছর ধরে যাকে সে মৃ”ত জেনে এসেছে সেই কিনা আজ তার চোখে সামনে বসে রইছে। দিব্যি স্বাভাবিক ভাবে কথাও বলছে।
—“অবাক হচ্ছো? এতো অবাক হওয়ার কিছু নেই। বেঁচে রয়েছি আমি।”
রেহান নিজেকে এবার যথাসাধ্য তটস্থ করার চেষ্টা করলো। চোখের পলক ফেলে ঠোঁট ভিজিয়ে ইতস্ততভাবে বলতে লাগলো,

“আ…আনা…আনায়া, এটা কি সত্যিই তুমি?”
রেহানের কথায় আনায়া আবারও রুক্ষ ভাবে হেসে বললো,”হুম।”
এই পর্যায়ে রেহান কিছুক্ষণ আনায়ার দিকে অপলক তাকিয়ে থাকার পর চোখ অন্যদিকে ফিরিয়ে শিরদাঁড়া সোজা করে জোর জোর কয়েকবার নিশ্বাস নিতে লাগলো। আকস্মিকতায় হতভম্ব হয়ে গিয়েছে সে। কোনোমতে নিজেকে স্বাভাবিক করে কিছু বলার চেষ্টা করলো। তবে হয়তো পারলো না। ওর এতো প্রচেষ্টা দেখে আনায়া নিজেই অকপটে বলতে লাগলো,
“এতো হাইপার হওয়ার কিছু নেই। যা দেখছো তা সত্যিই। দেখো পূর্বে যা ছিলো তা পূর্বেই সমাপ্ত হয়েছে। আপাতত নতুন করে পুরোনো কোনো কিছুকে টেনে এনে সময় নষ্ট করতে চাই না। আমার কাছে সময় কম। কিছু কথা বলবো এরপর চলে যাবো।”
রেহান আনায়ার কথাবার্তা ভাবভঙ্গিতে খানিকটা অবাক। এ যেন বিস্ময় কাটতে না কাটতেই সে নতুন করে বিস্মিত হচ্ছে। তবুও রেহান বলার মতো কিছু খুঁজে পাচ্ছে না। এমন বাকরুদ্ধ হয়ে যাবে সে নিজেও ভাবেনি। তবে এবার আনায়া কিছু বলার আগেই রেহান তড়িঘড়ি করে বললো,
“আনায়া আমার এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না এটা তুমি। এটা কিভাবে…ওরা তো বলেছিলো তুমি নাকি ম…রে গিয়েছো। আমি নিজেও তোমার কত খোঁজ করেছি কিন্তু…এতোদিন কোথায় ছিলে তুমি?”

—“কারা বলেছিলো আমি ম…রে গিয়েছি?”
—“আ…ঐ ভিকে যাদের আমার আশেপাশে নজরদারির জন্য রেখেছিলো। কয়েকবছর আগে তোমায় কোথাও খুঁজে না পেয়ে শেষমেষ ওদেরকেই জিজ্ঞেস করেছিলাম। তখন ওরাই জানায় যে তুমি… যদিও আমার তখন বিশ্বাস হয়নি কিন্তু তোমায় কোথাও খুঁজে না পাওয়ার পর… ”
রেহান আর কিছু না বলে দীর্ঘ নিশ্বাস ফেললো। অন্যদিকে আনায়া কিছুক্ষণ রেহানের দিকে একজনের তাকিয়ে থাকার পর খেয়াল করলো রেহানের চোখজোড়ায় জল এসে ভীড় জমিয়েছে। যা দেখলামই আনায়া কিঞ্চিৎ তাচ্ছিল্যের সাথে হেসে বললো,
“এখনো ভালোবাসো আমায়?”
আনায়া কথাটা অকপটে বললেও রেহান শোনা মাত্রই আকস্মিক খানিকটা কেঁপে উঠলো। কিঞ্চিৎ ঢোক গিয়ে মলিন হাসিতে মুচকি হেঁসে আনায়ার দিকে তাকালো। অন্যদিকে আনায়া হাতের ইশারায় তার আশেপাশে দাঁড়িয়ে থাকা লোকগুলোকে দূরে সরে যেতে বললো। বডিগার্ড গুলোও যথারীতি আনায়ার আদেশ মতো দূরে সরে যেতেই আনায়া আবারও বললো,

” বিয়ে-শাদি করেছো?”
রেহান তাচ্ছিল্যের সাথে মুচকি হেসে বললো,
“নাহ।”
—“জানতে তো তোমার আনায়া ম”রে গিয়েছিলো। তবে বিয়ে কেনো করলে না?”
—“জানি না। কারণ আমার জীবনে আমি একজনকেই ভালো বেসেছিলাম।
—“এতো বছর পর আমায় দেখে কি আবারও আমায় পাওয়ার আশা রাখছো?”
রেহান কিছু বললো না। বরং আনায়ার দিকে অপলকভাবে তাকিয়ে রইলো। অন্যদিকে আনায়া আবারও বলতে লাগলো,

“রেহান, তুমি কি জানো আমি অন্য কারো। বরং আমি কখনো তোমার ছিলামই না। হয়তো বা ছিলাম, আনায়া হয়ে। কিন্তু সে আনায়া তো বহু বছর হলে মৃত। মৃত মানুষ তো আর কখনো ফিরে আসে না রেহান।
তোমার সাথে পরিচয় হওয়ার বহু আগেই আমি অন্যকারো হয়ে গিয়েছিলাম। যার জন্য আজ আমি-তুমি সব হারিয়ে নিঃস্ব। সেই মানুষটারই বউ আমি।এরপরও কি তুমি আমায় চাইলেও তো আমি তোমার হতে পারবো না রেহান।”
রেহানের চোখ থেকে আকস্মিক কেমন যে জল গড়িয়ে পড়লো৷ নিজেকে হিতাহিতজ্ঞানশূন্য মনে হচ্ছে। তবে তার মতো ছেলে মানুষের চোখে এমন কান্না যে সত্যিই বেমানান। আনায়া নিজেও তা অনুভব করে বললো,
“তোমার চোখে জল মানায় না রেহান। পৃথিবীটা স্বার্থপর, সাথে আমিও। হয়তো অন্য কোথাও স্বার্থ্য খুঁজে পেয়েছি তাই তোমায় ছেড়ে দিয়েছি। এই বলেই নিজের মন মস্তিষ্ককে শান্তনা দিয়ে দিও। দেখবে আর কোনো সমস্যা হবে না। আমি এখন অনেকের কাছেই খারাপ,নিজের কাছেও। এবার না হয় তোমার কাছেও হয়ে গেলাম। খুব বেশি কি ক্ষতি হবে?”

রেহান এবার নিজের চোখের পানি নিমিষেই মুছে নিয়ে অকপটে বলতে লাগলো,
“কোথায় থেকে কিভাবে শুরু করবো জানি না। এখনো আমার কাছে এসব অবিশ্বাস্য। এই আনায়াকে সত্যিই আমি কেমন যেন চিনতে পারছি না। তবে…আমি সত্যিই বলার মতো কিছু খুঁজে পাচ্ছি না।”
—“থাক, তবে আমিই না হয় কাজের কথায় আসছি। বেশিদিন থাকবো না আমি, খুব তাড়াতাড়িই হয়তো আবার সবাইকে ছেড়ে দূরে কোথাও সরে যাবো।
যাই হোক,তোমার পরিবারের কি অবস্থা। তারা সবাই কেমন আছেন?যদিও আঙ্কেলের মৃ”ত্যু জন্য আজও নিজেকে দায়ী করবো আমি। সেক্ষেত্রে তুমিও চাইলে আমাকে নিজের বাবার খু”নি ভাবতে পারো। তোমার জীবনের সাথে না জড়ালে হয়তো… ”
এই পর্যায়ে আনায়ার কথা শেষ হওয়ার পূর্বেই রেহান খানিকটা তাচ্ছিল্যের সাথে হেসে বলতে লাগলো,
“এতোদিন তুমি ঠিক কোথায় ছিলে বলো তো? না মানে তুমি বাবার মৃ”ত্যুর জন্য নিজেকে দায়ী করছো। আমি এই রেহান নামক জীবন্ত লা”শের কথা না হয় বাদই দিলাম। আমার মা আর ভাইয়ের পরিনতির জন্যও কি তোমার নিজেকে দায়ী করা উচিত না?”
আনায়া কিছুটা কপাল কুঁচকে বললো,

“মানে? আন্টি আর রোহান…”
—“বাবার মৃ”ত্যুর মা বেশিদিন বাঁচেনি। অসুস্থতায় আমাকে আর আমার ভাইকে একা রেখে তিনিও চলে যান। এরপর রেহানও…?”
আনায়া রেহানের কথায় অনেকটা হতভম্ব হয়ে পড়লো। এবার যেন রেহানের কথাগুলো তার বিশ্বাস হচ্ছে না।
—“মানে, কি বলতে চাইছো। আমি তো জানতাম তোমার মা তোমাদের গ্রামের বাড়িতে আর রেহান তোমার সাথেই…”
রেহান চোখের পানি চিকচিক করছে। অথচ মুখে এক ফালি হাসি ঝুলিয়ে বলতে লাগলো,
“তুমি দেখছি কিছুই জানো না।হঠাৎ কি ভেবে আজ পুরোনো ঘা-এর খোঁজ নিতে এসেছো? আমার হয়ে তো আর ফিরে আসনি, তবে কখনো আর নাই ফিরতে। বাকিটা জীবন এভাবেই কাটিয়ে নিতাম আমি।
জানোই তো,যে ভালোবাসে সে কখনো একা থাকে না। তার সঙ্গী থাকে তার হৃদয়। যা বিধ্বস্ত হলেও গ্রহনযোগ্য।”

—“রেহান প্লিজ বলো, রোহানের কি হয়েছে? ও কিভাবে…”
—“জানি না, ম’রে গিয়েছে নাকি বেঁচে রইছে তা সত্যিই জানি না। দুবছর আগে হুট করেই গায়েব হয়ে যায়। তোমার মতো ওকেও কোথাও খুঁজে পায়নি। এবার তোমায় দেখার পর শুধু ওর আশায় রয়েছি। যদি কখনো ফিরে আসে তবে আমিও সবকিছু ছেড়ে ওকে নিয়ে দূরে সরে যাবো। আর হ্যাঁ,ভুলেও এই সবকিছুর জন্য নিজেকে দায়ী করো না। আর কি বলবো, এইটুকুই। প্রার্থনা করি, যেখানেই যেভাবে থাকো সবসময় হাসিখুশি থাকো। আমায় যেতে হবে, স্টুডেন্ট পড়াতে যেতে হবে। ওরা আমার অপেক্ষায়।”
রেহান কথাগুলো অকপটেই বলে ফেললো। যেন নিষ্প্রাণ দেহের কোনো নিষ্প্রাণ মানব কথা বলছে। সঙ্গে এটাও মনে হচ্ছে রেহান আনায়ার সামনে হতে পালাতে চাইছে। তার বলার হয়তো ছিলো অনেক কিছুই কিন্তু শেষমেশ যেন আর কিছুই বলতে পারলো না। এরই মাঝে আনায়া আবারও রেহানের ভাবভঙ্গি দেখে অকপটে বললো,
“তুমি কি পালাতে চাইছো?”

—“হঠাৎ এমনটা কেন মনে হচ্ছে তোমার? শোনো মেয়ে অতিথি পাখি, এই জীবনে আমি শুধু আমার বউপাখিকেই ভালোবেসেছি। কিন্তু তুমি বললে সে মৃ”ত। কারণ আমি যাকে বউপাখি ভেবেছিলাম সে আদতে অতিথিপাখি। যেভাবে সে আমার জীবনে সবকিছু পরিপূর্ণ করতে এসেছিলো,ঠিক সেভাবেই সবকিছু সাথে করে নিয়ে গিয়েছে সে। আপাতত তোমায় আর আমি নিজের বউপাখি ভেবে বড় কোনো ভুল করতে চাই না।
আর আমার বউ পাখি শুধু আমার ছিলো, আমারই থাকবে। এই জীবনে আর কোনো অতিথি পাখিকে জায়গা দিতে চাই না আমি।”
আনায়া তাচ্ছিল্যের সাথে হেসে বসলো,

“তোমার কথাগুলো অগোছালো রেহান। যাই হোক, যেটা বলতে চাইছো। ঠিক তেমনটাই হয়তো আমার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। আমি অস্বীকার করতে পারবো না, আমি যেমন অন্যকারো অর্ধাঙ্গিনী তেমনি একসময়ের তোমার জীবনে বউপাখি হয়ে আসা বহুরূপী অতিথি পাখি। এটা হয়তো তোমায় ভাষায়।
আমার সহজ ভাষায় যদি বলি,তোমার প্রতি আমার অনুভূতি এখনো হৃদয়ের গভীরে অমলিন হয়ে রয়েছে। তবে সময়ের নিষ্ঠুর বিধান এবং বাস্তবতার প্রাচীর আমাদের মাঝে এমন একটি দূরত্ব তৈরি করেছে, যা পার হওয়া আর সম্ভব নয়।

তুমি আমার জীবনের এমন একটি অধ্যায়, যা কখনোই শেষ হবে না। তবে সেই অধ্যায় নতুন কোনো গল্প যোগ করার আর সুযোগ রাখেনি। হৃদয়ের সেই কোণটি শুধু তোমার স্মৃতির জন্যই রয়ে যাবে।
আর এটাও সত্য যে, তোমার প্রতি আমার অনুভূতি এখনো আগের মতোই তীব্র। তবে পরিস্থিতির পরিক্রমায় আমি বুঝে গেছি, কিছু ভালোবাসা চিরদিনের হলেও, তা শুধুই নীরব থেকে যায়। যথারীতি সেই অনুভূতিটুকু চিরকাল নিঃশব্দে আমার হৃদয়ে বাস করবে।
কারণ আমি জীবনে প্রথমবার মনপ্রাণ দিয়ে কাউকে পাওয়ার জন্য ভালোবেসেছিলাম। সেটা পৃথিবীর আর সবার কাছে ছলনার গল্প হলেও, আমার কাছে তা ভালোবাসাই ছিলো। কিন্তু এসবকিছুর উর্ধ্বে এটাই সত্য যে, আমি কারো অর্ধাঙ্গিনী সাথে একটা মৃ”ত লাশও। আমি কোনোদিনও আর তোমার হতে পারবো না। পারলে মন থেকে এই সত্যটা মেনে নিও।”

সন্ধ্যা রাতের রাস্তার মাঝ দিয়ে সাই-সাই করে এগিয়ে চলছে কালো কুচকুচে মার্সিডিজ। আনায়া নির্বিকারে ড্রাইভিং করছে আর আনায়ার পাশে হুডিতে হাত গুঁজে চুপচাপ গম্ভীর মুখে বসে রইছে কেনীথ। অবশ্য আনায়ার চোখমুখও যথেষ্ট গম্ভীর।
কিছুক্ষণ আগে আনায়াই কেনীথকে বাসা থেকে নিয়ে এসেছে। আর সেই তখন থেকেই দুজনের মধ্যে পিনপতন নীরবতা। এই পর্যায়ে কেনীথ আনায়ার দিকে না তাকিয়েই বলতে লাগলো,
“রেহানের সাথে দেখা করেছিস?”
আনায়া কেনীথের দিকে ফিরে তাকালো না বরং একহাতে স্টিয়ারিং ঘুরাতে ঘুরাতে বললো,
“হুম।”
আনায়াকে হঠাৎ এমন চুপচাপ গম্ভীর দেখে কেনীথ বলতে লাগলো,
“হঠাৎ চেহারার এই হাল কেনো? পুরনো প্রেমিকের সাথে কথা বলতে গিয়েছিলি, মুড তো আরো ভালো থাকার কথা।”

আনায়া এবারও কেনীথ দিয়ে তাকালো না। বরং সামনের দিকে তাকিয়ে থাকা অবস্থাতেই বললো,
“সামনে কোথাও গাড়ি থামাই, কি বলো? আইসক্রিম খাবে? জ্বালাপোড়া কমবে হয়তো।”
এইবার কেনীথ কড়া চোখে আনায়ার দিকে ফিরে তাকালো। আনায়াও গাড়ির স্পিডটা কমিয়ে কেনীথের দিকে তাকিয়ে গম্ভীর্যের সাথে হেসে বললো,

একজোড়া আগুন পাখি পর্ব ৩৭

“আজ একটা বিষয়ে জানতে চাই, উত্তর দেবে?”
কেনীথ আনায়ার দিকে তাক করে রাখা নিজের কড়া চাহনিকে স্বাভাবিক করলো। অন্যদিকে আনায়াও সমানের দিকে পুনোরায় তাকিয়ে বললো,
“সত্যি করে বলো তো, কোনোদিনও কি আমায় তুমি ভালোবেসে ছিলে?”

একজোড়া আগুন পাখি পর্ব ৩৭ (৩)