আযদাহা সিজন ২ পর্ব ৩৩
সাবিলা সাবি
ভোর তখনও ফোটেনি, তবুও আকাশে আজ অদ্ভুত আলো। ভেনাসের পূর্ব দিকের পাহাড়ে দাঁড়িয়ে আছে দেবতা আভ্রাহারের প্রাসাদ—চন্দনের গন্ধ মেশা বাতাস, আকাশ থেকে ঝরে পড়া রূপার ধারা, আর নিঃশব্দ যে পবিত্রতা রয়েছে, তা বিনা বাক্যে বলে দিচ্ছে —আজ এখানে ইতিহাস লেখা হবে।
চাঁদের মতো নরম আলো চারপাশে ছড়িয়ে আছে। আকাশে উজ্জ্বল নক্ষত্রেরা জ্বলছে এই মিলনের সাক্ষী হতে।
প্রসাদের হলঘরে সবার সামনে তৈরি একটি উঁচু বেদী, যার দুইপাশে জ্বলছে “অগ্নিবীথি” আগুনের পথ। বেদীর মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছেন –ভেনাসের পুরোহিত, যার মুখে প্রাচীন ভাষার মন্ত্রপাঠ।
চারপাশে বসে আছেন রাজা জারেন, রাজা ড্রাকোনিস, লিয়ারা, সিলভা, থারিনিয়াস, এথিরিয়ন, আর আলবিরা—প্রত্যেকই জানে, আজ শুধু এক বিয়ে নয়, আজ দুই দুনিয়ার ভাগ্য বাঁধা পড়বে।
ফিওনা এসে দাঁড়ায় প্রথমে।
তার গায়ে গাঢ় লাল আর খয়েরি সমন্বয়ে গড়া সুন্দর রাজকীয় গাউন, গাউনের পেছনে লম্বা ট্রেইল — র*ক্তরঙা নদী বয়ে চলার মতোই। মাথায় ওড়না,ঝরে পড়ছে দু’পাশে, পায়ের আঙুল অব্দি এসে ঠেকেছে আঁচল এক বিশাল সূর্যাস্তের ন্যায়। চোখে আলতো কাজল, ঠোঁটে লাল আভা। তার হাঁটার প্রতিটি ধাপেই চারপাশ থমকে যাচ্ছে। তার চোখে বিস্ময়, কিন্তু ভয় নেই।
ঠিক তারপর আসে জ্যাসপার।
সে হয়ে উঠেছে আগুনের সন্তান—সোনালী লম্বা কোটে ঠিক এল্ড্রের আগুনধরা রাজপুত্রের মতোন। কোটে কাঁধজোড়ায় ড্রাগনের আঁশের মতো প্যাটার্নে ঢাকা। কোমরে বেল্টে সূক্ষ্ম নকশা করা ড্রাগনের প্রতীক, আর গলার কাছে কালো হাই কলার। তার চোখে একরাশ গম্ভীরতা, কিন্তু ফিওনাকে দেখেই মৃদু হাসি এসে যায়। তার চোখে অটলতা আর ঠোঁটে বিনীত প্রশান্তি।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
ফিওনার দিকে তাকিয়ে তার মুখে কেবল একটাই শব্দ ফুটে উঠে —“আমার হামিংবার্ড।”
তাদের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন ভেনাসের পুরোহিত।
তার হাতে রয়েছে এক ক্রিস্টালের পাত্র, যেটার ভেতরে আগুন জ্বলছে, নীল আর সোনালি শিখার মতো।
পুরোহিত বলেন— “আজকের এই দিনে আমি আহ্বান জানাচ্ছি আভ্রাহার দেবতার নামে, এই দুই প্রেমিকযুগল প্রাণ এক হোক র*ক্তে, আগুনে, আর নিয়তির বন্ধনে।”
ফিওনা আর জ্যাসপার ধীরে ধীরে একে অপরের দিকে এগিয়ে আসে।দুজনের মুখেই আলতো হাসির রেখা দেখা যায়। জ্যাসপার আগে চোখ তুলে তাকাল ফিওনার মুখ পানে, মুহূর্তেই তার হৃদয়ের স্পন্দন পাঁজর ভেঙে বাইরে বেরিয়ে আসতে চাইল।
কি অপূর্ব লাগছে ফিওনাকে।ফিওনা চোখ তুলে তাকাতেই জ্যসপারের সাথে তার দৃষ্টির মিলন ঘটলো।
সঙ্গে সঙ্গে ফিওনার গাল জুড়ে ছড়িয়ে পড়লো রক্তিম আভা।
পুরোহিত তখন এক ক্ষুদ্র স্ফটিক ছুরি বাড়িয়ে দেয় তাদের দিকে— তাদের ডানহাতের আঙুল হালকাভাবে কেটে ফোঁটা ফোঁটা র*ক্ত ঝড়ানো হয় আগুনের পাত্রে।
আগুন হঠাৎ করে সোনালি থেকে বেগুনি রঙ ধারণ করে—ঠিক যেনো দেবতার সম্মতির চিহ্ন ভেসে উঠে।
প্রতিটি পদক্ষেপে উচ্চারিত হয় মন্ত্র—
“ভেনাসের আলোতে আজ দুই আত্মা এক হয়ে গেল, জ্যোতিষ্কের রশ্মির মতন মিলবে হৃদয়, সময় তাদের আর আলাদা করতে পারবে না।”
তখনই হাজির হয় প্রাচীন রীতি। আগুনের রেখা টেনে দেয়া হয় চত্বরের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে।জ্যাসপার, কোনো কথা না বলে, ফিওনার দিকে এগিয়ে যায়। তার চোখে একটা জেদ, একটা কোমল অধিকার।
ফিওনার দিকে তাকিয়ে সে বলে—“এই আগুনে আমি তোমার জন্য পুড়তে পারি। কিন্তু তোমাকে আমি পুড়তে দেবো না কখনোই।”
তারপর তাদের সামনে খোলা হয় আগুনের পথ – রিচি। প্রথা অনুযায়ী, বর-কনেকে একসাথে হাঁটতে হবে সেই জ্বলন্ত পথ দিয়ে, যা প্রমান করবে প্রেমের সাহস আর আত্মত্যাগ।
কিন্তু জ্যাসপার হঠাৎ থেমে যায়। তারপর সে ফিওনাকে কোলে তোলে নেয়— আর আগুনের ওপর দিয়ে হাঁটতে শুরু করে জ্যাসপার।
আগুনের শিখা ফিসফিস করে বলে ওঠে—“এ প্রেম শুদ্ধ, এ প্রেম অবিনশ্বর।”
সবার চোখ বিস্ময়ে বড় হয়ে যায়। সেই মুহূর্তে ফিওনার মুখটা গাউনের ওড়নার আড়ালে, কিন্তু চোখ দুটো হাসছে। তারা পেরিয়ে যায় আগুনের পথ। আগুনের মধ্যে দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় সেই পথ এক পলকে ফিকে হয়ে যায়— প্রেম জয় করে নেয় আগুনকেও।
শেষে দাঁড়ায় ‘শুভ দৃষ্টি’র জায়গায়— একটি বড় রাজকীয় আয়না, যেখানে তাদের চোখ প্রতিফলিত হচ্ছে প্রতিবিম্বে । এই নিয়ম বলে দেয়— যদি চোখের মধ্যে সত্য ভালোবাসা দেখা যায়, তবে এই প্রেম কখনো ভাঙবে না।
পুরোহিত মন্ত্র পাঠ করে— “দেবতারা সাক্ষী,
আজ এলড্র রাজ্য আর ফ্লোরাস রাজ্যর প্রেম
একত্রিত হলো আগুন, র*ক্ত, দৃষ্টি, আর নিয়তির বন্ধনে।”
সবাই নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে থাকলো —লিয়ারা চোখ মুছলো, বাকিরা আনন্দে হাসলো, রাজা ড্রাকোনিস নিঃশ্বাস চেপে বসে আছেন।
জ্যাসপার ওড়নার ভেতর দিয়েই ফিওনার কপালে হালকা চুমু দিলো। সে তখন ফিসফিস করে বললো— “তুমি এখন আমার রানী। আমি আগুন ছুঁয়ে এসেছি—কিন্তু যা পুড়েছে, তা আমার একাকিত্ব।”
পুনরায় পুরোহিত বলেন, “ভেনাসের নিয়মে বর কনেকে মালা বদল করতে হবে এটা শুধু মালা বদল নয় দুটো আত্মার বন্ধন। কেবল প্রেম আর আস্থা দিয়েই একে পরানো যায়।আজ থেকে এই মালা রক্ষা করবে একে অপরের হৃদয়কে।”
প্রথমে ফিওনা এগিয়ে আসে। তার হাতে এক দুর্লভ ফুলের তৈরি নীলাভ-রুপালি মালা। ফিওনার হাত কাঁপছে সামান্য, কিন্তু চোখে আত্মবিশ্বাস। সে ধীরে ধীরে জ্যাসপারের দিকে এগিয়ে যায়, জ্যাসপার নিচু হয়ে মাথা এগিয়ে দিলো। সে কখনো কারও সামনে মাথা নত করেনি, কিন্তু ফিওনার সামনে সে চায় নিজের সমস্ত অহংকার ত্যাগ করে দাঁড়াতে। ফিওনা তার গলায় মালা পরিয়ে দিলো।
মালা পরতেই জ্যাসপার ফিসফিস করে বললো,
“তুমি জানো? আমি শত বছর ধরে ঠিক এই মুহূর্তটার জন্য অপেক্ষা করেছিলাম।”
তারপর জ্যাসপার নিজের হাতে তোলে নিলো ফিওনার জন্য তৈরি মালাটি— যেটা বানানো হয়েছে আগ্নিস্নিগ্ধ গোলাপ আর আকাশচুম্বি বেলের পাঁপড়ি দিয়ে। মালাটি হাতে নিতেই ওটা হালকা গরম হয়ে উঠলো।
সে ফিওনার খুব কাছে এসে দাঁড়ালো, তার চোখে চোখ রেখেই বলেলো “এই মালা শুধু ফুল নয়,আমার প্রতিজ্ঞা। যতক্ষণ আমি বেঁচে আছি, কেউ তোমাকে ছুঁতেও পারবে না। এখন তুমি শুধু ফিওনা নও, তুমি আমার হৃদয়ের রানী।”
তারপর জ্যাসপার ফিওনার গলায় মালাটি পরিয়ে দিলো। ফিওনা তখন ধীরে ধীরে চোখ বন্ধ করে ফেললো, সেই মুহূর্তে সমস্ত কষ্ট, সমস্ত ভয় তার বুক থেকে ঝরে গেলো।
চারপাশে তখন নিঃশব্দ। কেবল আভ্রাহারের প্রাসাদের ঘণ্টা বেজে উঠছে, আর দূরে দাঁড়িয়ে থাকা রাজা ড্রাকোনিস, লিয়ারা, সিলভা, এথিরিয়ন সবাই মৃদু হাসিতে মুখ ভরিয়ে নিলো আর ছিটিয়ে দেয় গোলাপ ফুলের পাপড়ি। আকাশে উড়ে যায় কিছু সোনালি পাখি
—আভ্রাহারের প্রতীক হিসেবে। দেবতার পক্ষ থেকে ভালোবাসার আশীর্বাদ হয়ে।
আগুনের রেখার শেষ মাথায় রাখা ছিল সেই পবিত্র শিখা। সেই আগুন যেখানে দাঁড়িয়ে থাকবে প্রেমিক-প্রেমিকা, একে অপরের হাত ধরে, এবং শপথ করবে দেবতা আভ্রাহারের সামনে—”যাই ঘটুক, আমরা একে অপরের ছায়া হয়ে থাকব।”
আহত আলোর মতো আগুন তখন কাঁপছে—পবিত্র, কিন্তু অস্থির, সবাই নিঃশব্দে তাকিয়ে।
রাজা ড্রাকোনিসের চোখে হালকা জল, লিয়ারার ঠোঁট কাঁপছে, এথিরিয়নের বুক ধুকধুক করছে, আলবিরা, থারিনিয়াস হাতজোড় করে দাঁড়িয়ে—তাদের প্রিন্সের আজ চূড়ান্ত পরিণয়।
জ্যাসপার ফিওনার দিকে এক পা করে এগিয়ে গেল।
ওদের হাত দুটো প্রায় মিলেছে—মাত্র এক শ্বাসের দূরত্ব।
ঠিক তখন…
আগুনের শিখার মাঝে শেষ রীতি পালনের প্রস্তুতি চলছিল। জ্যাসপার আর ফিওনার হাতে হাত রাখার কথা,শপথ নেওয়ার কথা — একে অপরের কাছে, দেবতার সামনে। কিন্তু হঠাৎ, ভূমিকম্পের মতো কেঁপে উঠল পুরো প্রাসাদ।মেঝে ফেটে গেল,পিলারগুলো কেঁপে উঠতে লাগল।দেয়ালের কারুকাজ খসে পড়ল ধুলোর ঝড়ে।
চারপাশে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়লো। অভিজাত অতিথিরা, সৈনিকরা,ফ্লোরাস এল্ড্র রাজ্যের প্রতিনিধিরা সবাই দৌঁড়ে বাইরে বের হয়ে যেতে লাগলো।
জ্যাসপার ফিওনার হাত ধরে তাড়াতাড়ি এগিয়ে গেল। কিন্তু হঠাৎ— একটা কানে আসা শব্দ একা জ্যাসপারকেই উদ্দেশ্য করে বলে উঠলো,
“এই ধ্বংস তোমার জন্য।পৃথিবীর নিরীহ রক্তে*র ভার এখনও তোমার শিরায়। তুমি যেভাবে প্রাণ নিয়েছো, ঠিক সেভাবেই এই প্রাসাদ তোমার নিচে চাপা পড়বে আর যদি তুমি এখান থেকে পালানের চেষ্টা করো তবে তোমার সাথে সাথে তোমার পরিবারেরও ধ্বংস হবে।”
জ্যাসপার থেমে গেল। তার চোখে ভয় আর গ্লানির ছায়া। ফিওনা পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখলো, —
“ প্রিন্স?তুমি থেমে গেলে কেন?” জ্যাসপার তাকিয়ে রইলো চারপাশে—ধ্বংস,ধুলো,আর সেই অভিশপ্ত আওয়াজ।
ফিওনা ওর হাত ধরে টেনে বাইরে নিয়ে যেতে চাইল।
— “চলো! দেরি করছো কেন!”
জ্যাসপার মাথা নাড়লো না, “তুমি বের হও, ফিওনা।
এটা আমার নিয়তি। আমাকে এখানেই থাকতে হবে।”
— “না! আমি কোথাও যাব না তোমাকে রেখে!” ফিওনা অস্থির কন্ঠে বললো।
জ্যাসপার এক ধাক্কায় ফিওনাকে বাইরে ঠেলে দিতে গেল, কিন্তু ঠিক সেই মুহূর্তে বিশাল দরজাটা বিকট শব্দে বন্ধ হয়ে গেল।বাইরের দিক থেকে লিয়ারা ড্রাকোনিস ছুটে এসে দরজায় আগুন ছুড়লো,নিজের পিঠ দিয়ে ধাক্কা মারলো— — “দরজা খুলছেনা কেনো ! জ্যাসপার ফিওনা ভেতরে!”
কিন্তু দরজা নড়লো না।আকাশে গর্জন শুরু হলো, মেঘের ফাঁকে ভয়ংকর ছায়াময় রূপ দেখা গেল।দেবতা আভ্রাহার তিনি নিঃশব্দে সব দেখছিলেন দরজা বাইরে দাঁড়িয়ে থেকেও তিনি স্পষ্ট দেখছিলেন ভেতরের দৃশ্য,এটাই যেনো পরীক্ষার শেষ মুহূর্ত।
ভেতরে একে একে ভেঙে পড়তে লাগলো পিলারগুলো। মেঝের ফাঁক গুলো বিস্তৃত হচ্ছিল,বাতাস ভারী হচ্ছিল ধুলা আর জ্বালাময়ী শক্তিতে।
জ্যাসপার ফিওনাকে আবার ঠেলে পাঠাতে চাইল।
“তুমি বাইরে যাও,প্লিজ ফিওনা তোমার জন্য দরজা খুলে যাবে।এই ধ্বংস আমার জন্য আমাকে একা বহন করতে দাও অনুরোধ করছি।”
ফিওনা এক ঝটকায় জড়িয়ে ধরলো জ্যাসপারকে, শক্ত করে।— “তোমার কিছু হলে আমি কি করে বাঁচবো? আমাকে থাকতে দাও প্রিন্স তোমার সাথে, তুমিই তো বলছিলে কখনো বাঁচলে একসাথে বাঁচবো আর নাহয় একসাথে মরবো!”
জ্যাসপার হতবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো ফিওনার চোখে।ওর ভেতরের নিষ্ঠুরতা, দুর্বলতা, রাগ—সব কিছু গলে যেতে লাগলো এই ভালবাসার তাপে।
আগুনের শিখা তখনও মাঝখানে জ্বলছিল। সময় দাঁড়িয়ে গেল—ধ্বংস আর প্রেমের এই চূড়ান্ত পরীক্ষায়।
প্রাসাদের মধ্যভাগে তখনও আগুনের শিখা জ্বলছিল, শেষ রীতির সেই শপথ বাক্যের আগে হঠাৎ ধ্বংস নেমে এল মনে হলো দেবতাদের রুদ্র রূপ। ভূকম্পন থেমে না থেমেই তীব্রতর হলো।এক এক করে পিলারগুলো ফেটে পড়তে লাগলো ইট আর শিলাখণ্ড গড়িয়ে পড়ছিল চারদিক থেকে।
সবাই পালিয়ে গেল।কিন্তু ফিওনা আর জ্যাসপার তখনও প্রাসাদের মধ্যভাগে দাঁড়িয়ে।ৎজ্যাসপারের কানে তখনও বাজছে সেই অদৃশ্য কণ্ঠ— “এই ধ্বংস শুধু তোমার জন্য।তুমি যে র*ক্তের ঋণ রেখে এসেছো পৃথিবীতে,তার প্রতিশোধ এখনও নেওয়া বাকি।”
দরজার ওপার থেকে লিয়ারা,রাজা ড্রাকোনিস, সিলভা, এথিরিয়ন—সবাই চিৎকার করছে। “ফিওনা! দরজা ঠেলে দাও! জ্যাসপার, তোমরা শুনতে পাচ্ছো?!”
ঠিক তখনই ছাদের বিশাল পাথরের এক খণ্ড ছিঁড়ে পড়তে শুরু করলো।জ্যাসপার একটুও না ভেবে ফিওনাকে জড়িয়ে ধরলো—ওর বুকের ভেতরে গুটিয়ে ফেললো ওকে।
“চোখ বন্ধ করো, হামিংবার্ড। তোমার গায়ে কিছুই লাগতে দেব না,” ওর কণ্ঠ ফিসফিসে, কিন্তু তীব্র।
গর্জন, ধুলো, আগুনের আলো—আর তারপর ধ্বস।
একটার পর একটা পাথর এসে জ্যাসপারের পিঠে পড়ছে।
র*ক্ত ছড়িয়ে পড়ছে ওর কাঁধ বেয়ে। কিন্তু ও কাঁপছে না।ফিওনা কিছুই দেখতে পাচ্ছে না,শুধু জ্যাসপারের শরীরের মাঝে ও নিজেকে হারিয়ে ফেলেছে,একটা শক্ত খোলস ওকে বাঁচিয়ে রেখেছে।
— “তুমি…ব্যথা পাচ্ছো তো?” ফিওনার গলা কাঁপছে।
জ্যাসপার কাঁপা কাঁপা গলায় ফিসফিস করে বলে,
— “তুমি ঠিক আছো তো?তোমার একটা আঁচড়ও লাগলে আমি… আমি নিজেকে ক্ষমা করতে পারবো না।”
তারপরও পাথর পড়তে থাকে, জ্যাসপারের পিঠে, মাথায়,হাতে। কিন্তু ও একটুও নড়ে না। ও জানে, এটাই তার শা*স্তি—এবং রাজপুত্রের সবচেয়ে বড় প্রমাণ।
ভেতরে আগুনের আলো আর ধুলোর ধোঁয়ায় দুজনের জড়িয়ে ধরা অবয়ব অস্পষ্ট হয়ে যায়, কিন্তু তাদের ভালোবাসা অটুট থেকে যায় এই ধ্বংসস্তূপের মাঝেও।
পুরো প্রাসাদ নিমেষেই ধসে পড়ল। দূরের পাহাড় থেকে ধুলো আর ধ্বংসের শব্দ একটানা বজ্রধ্বনির মতো আকাশ ফাটিয়ে দিচ্ছে।পাথর, সোনার খণ্ড আর প্রাচীন স্তম্ভ এক এক করে ভেঙে পড়ছে।
জ্যাসপার ফিওনাকে বুকের মাঝে জড়ানো অবস্থায় নিঃশব্দ হয়ে পড়ে আছে।চারদিক নিস্তব্ধ, শুধুই ধ্বংসস্তূপ আর ছিন্ন ইটপাথরের স্তূপ। ওপরে, ছাদ ভেঙে গিয়ে এখন আকাশ দেখা যাচ্ছে—কালচে মেঘের ফাঁকে এক রেখা চন্দ্রলোক এসে পড়েছে ঠিক সেই স্থানে, যেখানে জ্যাসপার আর ফিওনা মাটিতে গুটিয়ে আছে।
সব থেমে গেছে। না আর কোনো শব্দ, না ঝড়, না ধ্বংস। শুধু একটিমাত্র আগুনের শিখা তখনও শান্তভাবে জ্বলছে, সেই মধ্যস্থলের পূর্ণ শিখা, যা কখনও নিভবে না।
ঠিক তখনই, আকাশ ফেটে ভেসে এলো এক অদৃশ্য আওয়াজ— কিন্তু এবার শুধু জ্যাসপার নয়, ফিওনাও শুনতে পেলো সেই কণ্ঠ।
“রাজকুমার জ্যাসপার অরিজিন তোমাকে ক্ষমা করে দেওয়া হলো।তোমার শত বছর আগে থেকেই পাপ বহু, কিন্তু তুমি একমাত্র জায়গায় নিখুঁত ছিলে আর আছো— ভালোবাসায়।তোমার হৃদয়ের শুদ্ধতা,তোমার আত্মত্যাগ, এই প্রেমকে অলঙ্ঘনীয় করল।
তুমি পৃথিবীর যে মানুষদের প্রাণ নিয়েছো,তার শাস্তি তোমায় ভোগ করতেই হবে— কিন্তু আজ, আমি তোমাকে নতুন করে বাঁচার আরেকটি সুযোগ দিচ্ছি।”
এইবার কণ্ঠ স্তব্ধ হয়ে যায়।ঝড় থেমে গেছে,কেবল সেই শিখা টিম টিম করে জ্বলছে আর আলো ফেলছে দুই ভালোবাসার শরীরের ওপর। সেই মুহূর্তে ফিওনা জ্যাসপারকে নিজের বুকের ওপর একটু টেনে আনে।
— “তোমার কাঁধ… সব রক্তে ভেসে গেছে…” ওর গলায় অশ্রু কাঁপছে।
জ্যাসপার চোখ বন্ধ করেও হাসে। — “তোমার গায়ে একটা আঁচড়ও লাগেনি এটাই আমার সবচেয়ে বড় পাওয়া হামিংবার্ড!”
জ্যাসপার বেঁচে আছে।ফিওনা বেঁচে আছে।
আর সেই আগুনের শিখার ঠিক নিচে,ধ্বংসের স্তূপে, ওরা দুজন একে অপরকে জড়িয়ে ধরে বসে থাকে। চারপাশে মৃ*ত্যু হলেও,ওদের মাঝখানে জন্ম নিচ্ছে নতুন এক জীবন।
এটাই প্রেমের শক্তি।এটাই ভেনাসের দেবতার পক্ষ থেকে সর্বশেষ আশীর্বাদ।
চারদিকে ছড়িয়ে থাকা ভাঙা স্তম্ভ,রক্তিম আলোয় ভাসছে।আকাশে কালো মেঘ কেটে গিয়ে পড়ে এক রেখা রুপালি আলো—ঠিক সেই শিখার ওপরে।
ধীরে ধীরে জ্যাসপার উঠে দাঁড়ায়। গায়ের র*ক্ত তখনও জমে আছে, কিন্তু চোখে স্পষ্ট আলো।
ফিওনা ওর হাত ধরতেই ও বলে
— “চলো,শেষ রীতিটা বাকি।তোমার আমার অগ্নি শপথ।” আগুনের শিখার মাঝখানে ঢোকার আগে, ওরা দুজন থামে। জ্যাসপারের শরীর থেকে ফোঁটা রক্ত পড়লো পাথরের ওপর,সেই পাথর ছিল শপথগ্রহণের প্রাচীন চিহ্ন—যার ওপর পবিত্র রক্ত পড়লে সেটি দীপ্তি ছড়ায়।
পাথরটা হঠাৎই আগুনে ঝলসে ওঠে। তারপর, ওরা দুজন হাতে হাত রেখে শিখার মাঝে ঢুকে পড়ে। আগুন স্পর্শ করে না তাদের,শুদ্ধ প্রেমের শরীরেই অগ্নি ঠান্ডা হয়ে যায়।
সেই শিখার কেন্দ্রে দাঁড়িয়ে, একে অপরের চোখে চোখ রেখে ওরা বলে— “আমার আত্মা তোমার,
আমার সময় তোমার, আমার সমস্ত ভবিষ্যৎ, এই মুহূর্ত থেকে তোমার।ৎদেবতা আভ্রাহারের প্রাসাদের সামনে,
আমি প্রতিজ্ঞা করছি— জীবন, মৃত্যু, পুনর্জন্ম, সমস্ত কিছুর ওপরে— তুমি আমার চিরন্তন সঙ্গী।”
ঠিক তখন,শিখা তীব্র আলোয় ফেটে পড়ে, এক মুহূর্তের জন্য চারদিক অন্ধকার আলোকিত হয়ে যায়।
অদৃশ্য দেবতার কণ্ঠ আবার শোনা যায় আকাশে—
“তোমাদের প্রেম এই রাজ্যের সীমা ছাড়িয়ে গেছে।
আজ থেকে তোমাদের বন্ধন হয়ে থাকবে আকাশের তারায়,ৎসমুদ্রের জোয়ারে, এবং চিরন্তন হৃদয়ের অমরতায়।”
দেবতা আভ্রাহার গভীর দৃষ্টিতে আকাশের দিকে তাকিয়ে রইলেন, সৃষ্টির কোনো গুপ্ত সত্য তিনি স্বচক্ষে দেখছেন।তাঁর কণ্ঠে এক অনির্বচনীয় প্রশান্তি, তবুও এক অমোঘ সত্যের ভার ছিল— “নিয়তি ওদের মিলন লিখেনি,কিন্তু ওদের ভালোবাসার জোরে নিয়তিই বদলে গেছে।”
সেই মুহূর্তে আকাশে এক আলোড়ন ওঠে, মহাবিশ্ব নিজেই স্বীকার করে নেয় যে প্রেমের শক্তি সময়ের নিয়মও ভেঙে ফেলতে পারে।
শিখা ধীরে ধীরে নিভে যায়,কিন্তু আলোটা থেকে যায় ওদের গায়ে।চারদিকে তখনও ধ্বংস, কিন্তু তাদের মাঝখানে গড়ে ওঠে এক অদৃশ্য, অক্ষয় রাজত্ব।
এক বিকট শব্দে দরজাটা খুলে গেলো।
ভেঙে পড়া প্রাসাদের ধূলি,ধোঁয়া আর ছাই ছড়িয়ে গেলো চারদিকে।রাজা জারেন,রাজা ড্রাকোনিস, লিয়ারা, এথিরিয়ন, আলবিরা, থারিনিয়াস, আর সিলভা সবাই ছুটে আসে ভেতরে। কেউ ভেবেছিল ওরা বেঁচে নেই… কেউ থমকে গিয়েছিল আশংকায়।
কিন্তু ভেতরে এসে সবাই থেমে যায়। সবকিছু ধ্বংস, সব স্তম্ভ ভাঙা—তবুও মধ্যভাগে আগুনের শিখা এখনো জ্বলছে। আর তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে জ্যাসপার আর ফিওনা। দুজনের হাতে হাত।চোখে চোখ।
ওদের চারপাশে জ্বলছে হালকা স্বর্ণালি আলো,আগুন নিজেই প্রণতি জানাচ্ছে।
ফিওনার মাথার ভারী ওড়না নিচে ছড়িয়ে, গাঢ় লাল গাউনে এক দেবী। আর জ্যাসপার—সোনালি লম্বা কোটে, রক্তে ভেজা, কাটা ছেঁড়া অথচ মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা এক দেবদূত।
লিয়ারা থেমে যায়। চোখে জল এসে যায় ওর, কিন্তু মুখে এক অনির্বচনীয় শান্তি।
রাজা ড্রাকোনিস ধীর কণ্ঠে বলে,
— “আজ দেবতা নিজে এই প্রেমকে আশীর্বাদ দিয়েছেন। এই আগুন, এই ধ্বংস—সব পেছনে পড়ে গেছে।”
সিলভা হেঁটে এসে ফিসফিস করে বলে, — “ভেনাসের ইতিহাসে আজ প্রথম… আগুনের মধ্য থেকে ফিরে এসেছে প্রেমিক যুগল।
আকাশ তখন আলোকিত।কৃত্রিম চন্দ্র উঠেছে ধ্বংসস্তূপের ফাঁক গলে।
এল্ড্র রাজ্যে ফিরে আসার পর,রাজপ্রাসাদের সোনালি গম্বুজে আবার জ্বলে ওঠে আলোর নৃত্য। সবাই—ড্রাকোনিস রাজা জারেন, লিয়ারা, এথিরিয়ন, থারিনিয়াস, আলবিরা, সিলভা—আর রাজ্যের সব ড্রাগনরা আজ গর্বিত,শান্ত, মুক্ত।
বিয়ের দ্বিতীয় পর্ব শুরু হয় আধুনিক নিয়মে—
একটি বিশেষ সফটওয়্যারে ডিজিটাল রেজিস্ট্রেশন।
ডিজিটাল স্ক্রিন জ্বলজ্বল করে— “Jasper Origin & Elison Fiona — Bond Confirmed”
এরপরই রাজা ড্রাকোনিস সামনে এগিয়ে এসে দাঁড়ালেন বিশাল স্বচ্ছ মঞ্চের মাঝখানে।
তার কণ্ঠ ছিল ভারী, রাজ্যজুড়ে প্রতিধ্বনি হয় তার ঘোষণা: “আজ থেকে আর কোনো সফটওয়্যার তোমাদের সঙ্গী নির্বাচন করবে না। আজ থেকে প্রেম নিজেই নিয়ম লিখবে! যে হৃদয় কাউকে ভালবাসবে,সেই হৃদয়ই সিদ্ধান্ত নেবে—কাকে চাইবে পাশে।ভবিষ্যতের ভেনাস ভালোবাসার স্বাধীন রাজ্য হবে।” পুরো প্রাসাদে নীরবতা। তারপর মৃদু হাততালি… ধীরে ধীরে সেই করতালি বিস্ফোরণে রূপ নেয়।
তখন ফিওনা ধীরে ধীরে স্টেজে উঠে দাঁড়ায়।
ওর চোখ দুটো জ্বলছিল।ঠোঁটে নিঃশব্দ তীব্রতা। এক হাতে জ্যাসপারের হাত শক্ত করে ধরেছিল,আরেক হাতে মাইক্রোফোন। তার কণ্ঠ কাঁপছিল না—কিন্তু প্রতিটি শব্দ ছিল বিদ্ধকারী।
“আজ একটিমাত্র নিয়ম বদলানো যথেষ্ট নয়।
আরেকটা নিষ্ঠুর নিয়ম আছে যা বহু বছর ধরে অনেক হৃদয়ের মৃ*ত্যু ঘটিয়েছে।যদি কোনো ড্রাগন কোনো পৃথিবীর মানবকে ভালোবাসে,তাদেরকে আর আলাদা করা যাবে না। আমার মা—লিয়ারা —১৮ বছর বন্দি ছিলেন। শুধু কারণ তিনি একজন মানুষকে, আমার বাবাকে ভালোবেসেছিলেন। আমি… আমার… মায়ের মমতা থেকে দূরে ছিলাম। এখন থেকে আর কেউ সেই কষ্ট পাবে না।আমি অনুরোধ করছি— এমন গবেষণা করুন,এমন রাস্তা খুঁজুন যাতে করে ড্রাগন এবং মানব একসাথে পৃথিবীতে বাঁচতে পারে।এটাই হবে আমাদের নতুন ভবিষ্যৎ।”
রাজ্যজুড়ে তখন শুধু হাততালি নয়—অশ্রু আর আত্মবিশ্বাসের গর্জন।
রাজা ড্রাকোনিস ফিওনার দিকে গর্বিত ভাবে তাকিয়ে বললেন “তুমি শুধু আমার পুত্রবধূ না, তুমি ভেনাসের বিবর্তন। তুমি আমার কন্যা!”
আকাশের তারা আজ আরো উজ্জ্বল হয়ে জ্বলছিল,
কারণ ভেনাসে জন্ম নিচ্ছিল নতুন নিয়ম, এক নতুন সভ্যতা—যেখানে প্রেম আর ভালোবাসা কখনো আর অপরাধ হবেনা।
লিয়ারা ধীরে ধীরে এগিয়ে এসে ফিওনাকে জড়িয়ে ধরলেন।তার চোখে জল, ঠোঁটে অস্ফুট ফিসফিস—
“এতো বছর পরে তোমাকে পেলাম…তবু বেশিদিন কাছে রাখতে পারলাম না মা… তুমি এখন অন্য কারও হয়ে গেলে…”
ফিওনার চোখে কষ্ট, কিন্তু মুখে শান্তি। লিয়ারা কাঁদছেন—কিন্তু আজকের কান্না ততটা দুঃখের না।এ যেন হারানোর নয়,বরং একটা আস্থার কান্না।
কারণ,আজ তিনি বুঝতে পেরেছেন— “এই মেয়েকে যদি কেউ সত্যিই আগলে রাখতে পারে,তাহলে সেটা একমাত্র জ্যাসপার অরিজিন।”
জ্যাসপার একপাশে দাঁড়িয়ে থাকলেও, তার চোখে ছিলো প্রতিজ্ঞার দীপ্তি। সে লিয়ারার চোখে চোখ রাখে, মাথা নিচু করে বলে— “মাদার-ইন-ল! আমি আপনার মেয়েকে পাহাড়,আগুন,মহাকাশ… সবকিছুর থেকে আগলে রাখব।”
রাজা জারেন এসে নিজের মুকুট খুলে জ্যাসপারের মাথায় রাখেন। “ভবিষ্যৎ এখন তোমাদের হাতে। আমাদের রাজ্য এখন ভালোবাসার হাতে।”
বিদায়ের মুহূর্তে, যখন সবাই নিজেদের রাজপ্রাসাদে ফেরার জন্য উঠছে—
এথিরিয়ন হঠাৎ থেমে যায়।তার চোখ শুধু এক জায়গায়—সিলভার দিকে। সিলভা, আজকের দিনের মতো পরিপূর্ণ,সাহসী,কিন্তু ভিতরে কোথাও এক দহন।এথিরিয়নের দৃষ্টি জ্বলছিল—অসহায়, অথচ কিছু বলতেও পারছে না।
সিলভা সেই চোখে তাকিয়ে কিছু বলে না,
কিন্তু সেই নিঃশব্দ চোখের চাহনি অনেক কিছু বলে যা
তারপর ধীরে ধীরে সবাই ফিরে যায়—
শুরু হয় নতুন ইতিহাস, রেখে যায় চোখে জল, আর হৃদয়ে সাহস।
বিয়ের রাত।ভেনাসের প্রাচীন নিয়ম অনুযায়ী—এই রাত বর-কনেকে একে অপর থেকে আলাদা থাকতে হয়।
তাদের একসাথে থাকার পূর্ণ অনুমতি দেওয়া হয় পরদিন রিশিপশনের পর থেকে। এই সময়টা—দুটি আত্মার প্রস্তুতির সময়, মিলনের আগে এক প্রকার নীরব প্রতিজ্ঞা।
প্রাসাদের এক পাশের কক্ষটিতে আজ ফিওনা থাকবে তার সেই একান্ত কাছের সঙ্গী—অ্যাকুয়ারার সাথে।
সেই মাউন্টেন গ্লাস হাউজের দিনের কথা মনে পড়ে—যেখানে এই দুইজন একে অপরের ছায়া হয়ে ছিল।
আজ আবার সেই সময় ফিরে এলো।
ফিওনা ব্রাইডাল গাউন পাল্টে রেশমের মতো পাতলা একটা নাইট ড্রেস পড়ে, চুপচাপ বিছানায় বসে আছে।
অ্যাকুয়ারা ধীরে ধীরে পাশে বসলো।
অ্যাকুয়ারা তখন বললো “তুমি তো এখন এই রাজ্যর রানী,এই চুপচাপ ভাবটা মানাচ্ছে না, বোকা মানবী।”
ফিওনা হেসে উঠলো।তারপর হঠাৎ নিচু গলায় বললো
“অ্যাকুয়ারা… লিউ ঝান খুব ভালো ছেলে। ওকে কেউ কখনো বুঝলো না… আর আমি তো পারলামই না…”
অ্যাকুয়ারার চোখ স্থির। ফিওনার কথা থামার আগেই সে বলে ফেলে— “তুমি ওনাকে বোঝার চেষ্টা করেছিলে। সেটা অনেক।কিন্তু তোমার হৃদয় যেখানে বাঁধা, সেটা তো জোর করে ছিঁড়ে ফেলা যায় না।”
ফিওনা কান্নাভেজা গলায় বললো “অ্যাকুয়ারা, তুমি পারবে তাকে ভালোবাসতে? আমি জানি তুমি একমাত্র তার যোগ্য সঙ্গিনী, তুমি তো ওকে বোঝো… ওকে তুমি আগলে রাখতে পারবে?”
এক মুহূর্ত নীরবতা।অ্যাকুয়ারার চোখে চাঁদের আলো ঝিকমিক করছে। সে ধীরে ফিওনার হাত ধরে।
“আমি জানি,সে ভালোবাসতে জানে। যত্ন করতে জানে।
আর আমি… আমি চেষ্টা করবো তার পাশে দাঁড়াতে। যদি সে চায়—আমি থাকবো। যদি সে দূরে ঠেলে দেয়—তবু আমি তার অপেক্ষায় থাকবো।”
ফিওনা কিছু বলে না। শুধু নিজের বন্ধুকে জড়িয়ে ধরে।
আজকের রাত—একটা বন্ধুত্বের,একটা ভালোবাসার সম্ভাবনার,আর একটা অতীত ভুলে ভবিষ্যতের দিকে তাকানোর রাত।
চাঁদ জানালার ফাঁক দিয়ে হাসছে। লিউ ঝান দূরের কোনো কক্ষে দাঁড়িয়ে আকাশ দেখছে। অ্যাকুয়ারা আর ফিওনা—এক বিছানায়, কিন্তু দুই ভিন্ন ভাবনায়—একজনের প্রেম শেষ হয়েছে,আর একজনের… হয়তো শুরু হতে চলেছে।
রাত গভীর…….
ফিওনার ঘরের সামনে বারান্দায় দাঁড়িয়ে পায়চারি করছে জ্যাসপার।তার মুখে অস্থিরতা, মাঝে মাঝে চোখ চলে যাচ্ছে বন্ধ দরজার দিকে।চাঁদের আলো তার চুলে চকচক করছে।
ঠিক সেই সময় হঠাৎ পেছন থেকে শোনা গেলো দুই পরিচিত কণ্ঠ—
এথিরিয়ন আবেগ মেশানো হাসিতে বললো
“জ্যাসু ভাইয়া,এতো রাতে এখানে কি করছো? ঘুম আসছে না নাকি?”
জ্যাসপার খানিক চমকে ঘুরে দাঁড়াল—
জ্যাসপার হালকা ধমকের স্বরে বললো, “তোরা এতো রাতে এখানে কেন? ঘুমাসনি কেনো?কোনো কাজ নাই তোদের?”
থারিনিয়াস মুখে দুষ্টু হাসি রেখে বললো, “প্রিন্স,আপনি তো এখন বিবাহিত পুরুষ। কাল রিশিপশনের পর তো সবসময় রানিং ফিওনার পাশে থাকবেন। তাই ভাবলাম—আজকের রাতটা একবারে ফুল ব্যাচেলার পার্টি করে ফেললে কেমন হয়?”
এথিরিয়ন কপট হেসে বললো, “একদম সঠিক! এটা তোমার শেষ ব্যাচেলর নাইট, জ্যাসু ভাইয়া! গান, ওয়াইন, স্মৃতি—সব কিছু চাই!”
জ্যাসপার একটু গম্ভীর ভঙ্গিতে তাকালো। তারপর হালকা করে চোখ ঘুরিয়ে বলল— “তোদের দুষ্টামির সীমা নাই… তবে… ঠিক আছে। চল।”
তিনজন মিলে হাঁটতে লাগলো প্রসাদের উপরের দিক
একটা গোপন ছাদঘর যেখানে আগে থেকেই সাজান
ওয়াইন, জ্যোৎস্নায় ভিজে থাকা হালকা সংগীত, আর একটুকরো মুক্তি।
ছাদঘরের এক কোণে বসে জ্যাসপার হাতে নিল এক গ্লাস রুবি রঙের পানীয়। থারিনিয়াস আর এথিরিয়ন নিজেদের মধ্যে হালকা ঠাট্টায় মেতে উঠেছে।
এথিরিয়ন তখন ঠাট্টার ছলে বললো
“জ্যাসু ভাইয়া, কি মনে হয়? ফিওনা কি তোমাকে কালকেই বশ করে ফেলবে?”
জ্যাসপার সামান্য হেসে বললো, “বশ তো অনেক আগেই হয়ে আছি আবার নতুন করে কি বল হবো।”
ভোরের আলো এখনো ফোটেনি।সোনালী আভা ছুঁয়ে ছুঁয়ে ফিরছে পূর্ব আকাশে,আর প্রসাদের ছাদঘরের এক কোণে তিনজন ড্রাগন যুবক মাতাল হয়ে পড়ে আছে। ওয়াইনের বোতল খালি,গানের সুর থেমে গেছে, কিন্তু গলার আওয়াজ থেমে নেই।
থারিনিয়াস হঠাৎ গ্লাস ঝাঁকিয়ে বলল— থারিনিয়াস চোখ আধবোজা,মাতাল ভঙ্গিতে, “আমি… আমি আলবিরাকে বিয়ে করতে চাই! আমি আর অপেক্ষা করতে পারবো না!ওর চোখ… ওর সেই সোনালী চুল… আমি পাগল হই ওর জন্য!”
জ্যাসপার হেসে কাশতে লাগল— “সেনাপতি ড্রাগনের কাণ্ড দেখো… বিয়ে করতে চাই বললেই হলো, বয়স হয়নি তোমার এখনও বিয়ের!”
থারিনিয়াস হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়লো গালিচায়। তার পাশে বসে থাকা এথিরিয়ন তখন হঠাৎ নিচু গলায় স্বীকার করলো—
এথিরিয়ন চোখ লাল, আবেগে ভেজা কণ্ঠে,
“আমি…আমি সিলভাকে ভালোবাসি… অনেক দিন ধরে।ওকে দেখতে ইচ্ছে করছে… খুব বেশি এই মুহূর্তে।”
এক মুহূর্ত নিঃশব্দে কেটে গেলো। তারপর থারিনিয়াস উঠে বসে চিৎকার করে বলল—
“তাহলে যা গিয়ে দেখে আয় রিয়ন! আমিও এখনই যাবো আলবিরার কাছে।
তারপর হঠাৎই উঠে দাঁড়াতে গিয়ে পড়ে গেলো একটা নরম গালিচার উপর।জ্যাসপার হেসে ফেললো আর বললো, “এরা নাকি আবার শক্তিশালী ড্রাগন যোদ্ধা ! মদের বোতলেই ডুবে গেলো… আমি কি তাহলে একমাত্র ঠান্ডা মাথার ড্রাগন এখানে?”
এথিরিয়ন ঘাড় কাত করে বললো “তুমিও ফিওনাকে ভালোবাসো… তবে তোমার ভালোবাসা অন্যরকম। তুমি নিজের জীবন দিয়েও ওকে আগলে রাখবে…”
একটু নিস্তব্ধতা। তারপর তিনজন একসাথে হাসতে লাগলো—আবেগ, বন্ধন আর একটু হালকা পাগলামি নিয়ে।
ভোরের আকাশ এখনও পুরোপুরি রঙ ধরেনি। ভেনাসের আকাশে ধীরে ধীরে আঁধার কাটবে।জ্যাসপার তখন নেশায় ঘুমিয়ে পড়েছে, কিন্তু এথিরিয়নের মনে কিছুতেই শান্তি নেই।
হঠাৎ সে উঠে দাঁড়ালো। মনে হচ্ছিল,বুকের ভেতর আগুন ছুটছে,আর কিছুতেই নিভছে না।
তার গায়ের আকার ধীরে ধীরে বদলাতে লাগলো—
রূপান্তরিত হলো ড্রাগন রূপে।তার ডানা নীরবে প্রসাদের দেয়ালের ওপর ছায়া ফেললো। একটা নিঃশব্দ ডানার ঝাপটায় সে উঠে গেলো আকাশে।
সোজা উড়ে গেলো সিলভার প্রাসাদের ব্যালকনির দিকে। সেখানেই, ল্যাম্পসিডের নরম আলোয় সিলভা ঘুমিয়ে আছে—চোখ বন্ধ, মুখ শান্ত, নিঃশ্বাস গভীর।
তার চারপাশে নীলাভ আলোয় মিশে আছে রাতের শেষটুকু।
এথিরিয়ন চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকলো ব্যালকনির রেলিংয়ের ওপর। কোনো আওয়াজ করলো না, শুধু তাকিয়ে থাকলো। তার চোখের গভীরে ছিল অস্থিরতা…
এক ধরনের হারিয়ে যাওয়া। তারপর সোজা এসে বসলো বিছানায় সিলভার কাছে।
এথিরিয়ন সিলভার দিকে তাকিয়ে মনে মনে বলল— “তোমাকে ছুঁতে পারি না,শুধু এভাবেই দূর থেকে দেখি। যদি জানতেই না পারো, তবুও ভালোবাসি। শুধু একবার… একবার যদি ঘুম থেকে উঠে আমার দিকে তাকাতে…!”
একটা হালকা বাতাস বইলো,সিলভার একপাশে এলিয়ে পড়া চুলগুলো একটু উড়ে গেলো।
এথিরিয়নের শ্বাস থেমে গেলো।তার হৃদয়ের গতি বদলে গেলো মুহূর্তে। সিলভার ঘুম গভীর ছিল,কিন্তু হঠাৎ অনুভব করলো তার পাশে বসেছে। চোখ মেলে দেখলো এক বিশাল ছায়া তার পাশে বসে…
তারপরেই গলার ওপর গরম একটা হাত চাপা।
“শশশ… চিৎকার কোরো না…”
এথিরিয়নের কণ্ঠ নেশায় ভারী, কণ্ঠে এক ধরনের মাদকতা। সিলভা বুঝে গেলো—এথিরিয়ন মাতাল।
“তুমি ড্রিঙ্ক করেছো রিয়ন?” ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করলো সে।
এথিরিয়ন একটু হেসে বলল, “হুম… জ্যাসু ভাইয়ার শেষ ব্যাচেলর নাইট ছিলো তো। আমি, থারিনিয়াস আর আমি… আমরা একটু বেশিই খেয়ে ফেলেছি।”
তার চোখে এখনও সেই রক্তিম ঝিলিক—নেশা, আবেগ আর কিছু অনুচ্চারিত ভালোবাসা। “আমি কি আজকে তোমার ঘরে… ঘুমাতে পারি সিলভা?” তার কণ্ঠে শিশুর মতো একটা সরলতা।
সিলভা থমকে গেলো। এই প্রথম কেউ তাকে এমনভাবে কিছু বললো,আর সেই যে কিনা তার হৃদয়ের অজানা প্রান্তে অনেক আগেই বাসা বেঁধেছে।
সিলভা একটু গম্ভীর হয়ে বললো,
“তুমি কি পাগল?কাল রিসিপশন আছে। তুমি যদি এখন এখানে থাকো, সবাই যদি জেনে ফেলবে…”
এথিরিয়ন তৎক্ষণাৎ উঠে দাঁড়াতে যাবে, কিন্তু হোঁচট খেয়ে আবার পড়লো সিলভার ঠিক কাছাকাছি, সিলভা সাথে সাথে চোখ বন্ধ করে নিলো।
সিলভা চোখ বন্ধ করেই ছিলো, হঠাৎই এথিরিয়নের কণ্ঠ ভেসে এলো—”আচ্ছা… চলে যাবো। কিন্তু এক শর্তে
একটু চুমু দাও।”
সিলভা চোখ মেলে তাকালো তার দিকে,
চোখে একরাশ ক্লান্তি,কিন্তু তাতেই লুকিয়ে ছিলো এক ধরনের ছেলেমানুষী আবদার। “তুমি মদ খেয়ে পাগল হয়ে গেছো, রিয়ন।” বলে মুখ ঘুরিয়ে নিলো সে।
এথিরিয়ন তখন একটা নিঃশ্বাস ফেলে বললো, “জানি তুমি কিছু বলবে না…তবে আমি আজ সত্যিই শুধু এক মুহূর্তের স্পর্শ চেয়েছি…তারপর চলে যাবো।”
সিলভা জানে—এই মুহূর্তে যদি ওর কথা না শোনে, ওর যাওয়ার নাম থাকবে না। সিলভারও আর ইচ্ছা করছেনা ওকে এতোটা ইগনোর করতে।
অবশেষে, সিলভা ধীরে এগিয়ে গিয়ে,আলতো করে এথিরিয়নের গালে একটা চুমু দিলো।
নরম, স্পর্শহীন এক চুমু,তবুও সেখানে হিমবাহ গলে গেলো, আগুনও নেভে গেলো।
এথিরিয়ন চোখ বন্ধ করে ফেললো।
সে কিছু বললো না… শুধু চুপচাপ উঠে দাঁড়ালো।
পিছন ফিরে যাবার আগেই বলে গেলো—
“এই মুহূর্তটা সারাজীবন মনে রাখবো, সিলভা।”
আর সিলভা তাকিয়ে থাকলো… প্রথমবার… কাউকে চাওয়ার অনুভূতিটা সত্যিই এমন?
এথিরিয়ন দরজার দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলো, পা টানাটানি করছে,মাতাল ভাবটা এখনো যায়নি পুরোপুরি। হঠাৎ থেমে গেলো। পিছন ফিরে তাকিয়ে বললো— “কাল… কোন কালারের ড্রেস পরবে তুমি?”
সিলভা জানে না কেন, প্রশ্নটা শুনে একটু কেঁপে উঠলো। এত সাধারণ একটা প্রশ্ন… তবুও, এতটা গভীর কেন লাগলো?
সে কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো। তারপর নিচু গলায় বললো—”সাদা।”
“সাদা?”—এথিরিয়ন হালকা হেসে বললো,
“তাহলে আমি কাল সাদা পড়বো,ম্যাচ করবো তোমার সাথে।”
সিলভা তাকিয়ে থাকলো তার চলে যাওয়া পেছনের দিকে।আস্তে করে কাঁপা গলায় ফিসফিস করলো নিজের সঙ্গে— “তুমি যদি জানতে… আমি কেবল ড্রেসটা নয়, তোমাতেও জড়াতে চাই সাদা আলোয় …”
এথিরিয়নের পায়ে হঠাৎ যেন কিছু আটকে গেলো। সে আবার ফিরে এলো।চোখ দুটো মাদকতায় টলমল করছিল,কিন্তু ভিতরের কথাগুলো ছিল একদম সোজাসাপ্টা। সে সিলভার একদম কাছে এসে একটু ঝুঁকে দাঁড়ালো।তার নিঃশ্বাসে ছিল মৃদু ওয়াইনের গন্ধ, চোখে ছিল একটা নরম বিষণ্নতা।তার গলায় ছিল গভীর একটা আবেগ।
“সিলভা…”আজ শুধু জ্যাসু ভাইয়ার নয়…”
“…আমারও লাস্ট ব্যাচেলার পার্টি ছিলো।”
সিলভার বুক কেঁপে উঠলো।কিছু একটা থমকে গেলো দুজনের মাঝখানে। এথিরিয়ন নরম স্বরে বললো, “তুমি চাইলে কাল থেকে আর কারও দিকে তাকাবোও না আমি… শুধু তোমার সাথে সাথে থাকবো।”
সিলভা কিছু বললো না,শুধু চোখ নামিয়ে রাখলো…
আর চুপিচুপি নিজের হৃদয়ের ভেতর বলে ফেললো—
“কেন তুমি এত দেরি করে এলে আমার জীবনে রিয়ন…”
রাত তখনও গভীর।এল্ড্র প্রাসাদের সব আলো নিভে এসেছে প্রায়। কিন্তু একটিমাত্র জানালায় হালকা আলো—আলবিরার ঘরে।
তার সোনালী চুল এলোমেলো ছড়িয়ে আছে বিছানার ওপরে।মাটির ওপরে একটা পুরোনো পেইন্টিং রাখা, সে সেটা আঁকছিল কিছুক্ষণ আগে, এখন একটু শুয়ে পড়েছে।হঠাৎ দরজার সামান্য একটা শব্দ।
তারপর একটানা ধীর পায়ে এগিয়ে আসা কারও ছায়া।
“কে?” আলবিরা ধীরে উঠে বসে।
দরজা খুলতেই দেখলো থারিনিয়াস।
ওর চোখে একধরনের নরম ক্লান্তি,ঠোঁটে আবছা এক হাসি।তারপর কক্ষে প্রবেশ করেই বললো ” আজকে তোমার কক্ষে থাকতে পারি? অনেক মিস করছিলাম তোমাকে বিরা।
আলবিরা একবার থেমে যায়, বুকের ভেতরটায় ঝড় উঠতে থাকে। সে হেঁটে আসে সামনে, ওর হাতটা ধরে।
“তোমার মুখ থেকে ওয়াইনের গন্ধ আসছে , থারিনিয়াস…তুমি মাতাল হয়ে কি বলে যাচ্ছো?”
থারিনিয়াস মাথা নাড়ে। “হ্যাঁ,আলবিরা আমি আজকে রাতে শুধু তোমাকে নিয়ে ভাবতে চাই।।”
আলবিরা এক ধাক্কায় ওকে নিজের বুকে টেনে আনে।
হঠাৎ বাতাসে হালকা জাদুর গন্ধ ছড়িয়ে পড়ে। জানালার বাইরে চাঁদের আলো পড়ে ওদের মুখে।
“নিয়াস,”আলবিরা ফিসফিস করে বলে,”তুমি কি সত্যিই আমার পাশে থাকবে, আমি হয়তো নিখুঁত নই।”
“তুমি ঠিক যে রকম,আমি সেভাবে তোমাকে ই চাই।”
থারিনিয়াস আলতো করে ওর কপালে একটা চুমু দেয়।
আলবিরার ঘরে হালকা মদিরা আলো জ্বলছে। জানালার পাশে রাখা মোমবাতির আলো ছায়া ফেলেছে দেয়ালে।থারিনিয়াস ধীরে ধীরে কক্ষের দরজা বন্ধ করলো।তার চোখে আজ এক অন্যরকম তৃষ্ণা, মুগ্ধতা।
আলবিরা তখনও জানালার পাশে দাঁড়িয়ে, চাঁদের আলোয় ঝলমল করছে তার সাদা সিল্কের পোশাক। চুল খোলা, হালকা বাতাসে উড়ছে। সে টের পায়, থারিনিয়াস ওর দিকে আসছে।
“তুমি জানো, আমি এক সময় শুধু যুদ্ধ জানতাম। কিন্তু এখন… আমি শুধু তোমাকে ছুঁতে চাই।”
থারিনিয়াস ওর পেছন থেকে এসে দুই হাতে আলবিরার কোমর জড়িয়ে ধরে। আলবিরার নিঃশ্বাস ধরা পড়ে যায়। “নিয়াস…” তার গলা কাঁপে,
“তুমি মাতাল, ঠিক মতো ভাবতে পারছো তো?”
“হয়তো মাতাল,কিন্তু এখন সবচেয়ে সজাগ—তোমার অনুভবে বিরা।” থারিনিয়াস ওর গালে আলতো করে ঠোঁট ছুঁইয়ে দেয়। আলবিরা চোখ বন্ধ করে ফেলে, এক হাতে ওর বুক আঁকড়ে ধরে। তারপর ধীরে ধীরে ওর দিকে ঘুরে দাঁড়ায়।
“তুমি কি সত্যি আমাকে চাও, নিয়াস? শুধু এই রাতের জন্য না, সারাজীবনের জন্য?”
“তোমাকে চাই… বিরা! রোজ সকালে তোমার চোখে চোখ রাখতে চাই,ৎরোজ রাতে তোমার কণ্ঠে ঘুমোতে চাই।”
আলবিরা এবার আর আটকাতে পারে না। ঠোঁট রেখে দেয় থারিনিয়াসের ঠোঁটে—গভীর, কোমল, আর এক অদ্ভুত নিশ্চিততায় পূর্ণ।
দুজনে ধীরে ধীরে নেমে যায় বিছানায়। গোধূলি আলোয় ছায়া ঢেকে ফেলে ওদের দেহ। ওর কাঁধে মুখ লুকিয়ে আলবিরা ফিসফিস করে বলে— “আজ প্রথমবার, আমি নিজেকে কারো হাতে পুরোপুরি তুলে দিলাম…”
“আর আমি আজ বুঝলাম, ভালোবাসা কতো শান্ত, কতো উষ্ণ…” – থারিনিয়াসের কণ্ঠ নরম, নিঃশব্দ।
থারিনিয়াস তখন আলবিরার গলায়, ঘাড়ে, চুম্বনে ভরিয়ে তুলে আর আলবিরা থারিনিয়াসের ঘাড়ে নখ দিয়ে আঁকড়ে ধরে।আলবিরার নিঃশ্বাস ভারী হয়ে আসে। শরীর কাঁপতে থাকে। প্রথমবার কোনো পুরুষের এতো গভীর ছোয়ায় সে মগ্ন হয়েছে আর এই পুরুষ যা তার শৈশবের কৈশোরের ভালোবাসা, একমাত্র ভালোবাসা।
থারিনিয়াস নিজের পোশাক খুলে ফেলে। সাথে আলবিরার পোশাক। কিন্তু হঠাৎ কিছু একটা মনে করে থেমে যায় তারপর ফিসফিস করে বলে ” না থাক আজকে না, আমি তোমাকে মাতাল অবস্থায় না সজাগ অবস্থায় পুরোপুরি নিজের করে নিবো,আর সেটা হবে আমাদের বিয়ের পর” তারপর থারিনিয়াস নিজের বুকের মধ্যে আলবিরাকে জড়িয়ে ধরে আর ঠোঁটজোড়ায় চুম্বন করতে থাকে।
রাতটা জোছনা, শ্বাস,স্পর্শ আর প্রতিজ্ঞার মাঝে গলে যায়।
প্রভাতের সূর্য কিছুটা ম্লান হলেও একে একে তার আলোকরেখা ছড়িয়ে পড়ছিল প্রাসাদের চারপাশে। বাতাস ছিল মৃদু, শান্ত, নতুন দিনের শুরুতে সব কিছু যেন একটু পরিস্কার হতে চাইছে।
ছাদের ঘরটিতে, সেরাতের সমস্ত উদ্দীপনা আর মাতাল ভাব সরে গিয়ে গভীর নীরবতা এসে আছড়ে পড়েছে। জ্যাসপার বিছানায় শুয়ে ছিল, চোখ বন্ধ করে, কল্পনায় ফিওনাকে পাশে পেয়ে আনন্দের অনুভূতি ছিল। তার গভীর নিঃশ্বাসের শব্দ শোনা যাচ্ছিল, শরীরের প্রশান্তি অনুভূত হচ্ছিল। মনের মধ্যে কিছু না বলা কথা ঘুরপাক খাচ্ছিল, তবে তার একমাত্র চিন্তা ছিল ফিওনাকে নিয়ে, তাদের ভবিষ্যত, আর একে অপরের পাশে থাকার অনুভূতি।
এথিরিয়ন তার ঘরে ফিরে এসে, বিশাল জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে রইল। রাতের মাতাল ভাব এখনও পুরোপুরি কাটেনি। সিলভার কক্ষে যা ঘটেছিল তার সবই মধুর স্মৃতি হয়ে ভেসে উঠছিল।গালের চুম্বনটা, তার কন্ঠে সেই মধুরতা,তার শরীরে স্নিগ্ধতা। কিছুক্ষণের জন্য মনে হল আর কিছু চাওয়ার নেই, জীবন তার কাছে পূর্ণ হয়ে এসেছে।
হালকা ভোরের আলো পড়তে শুরু করেছিল, এথিরিয়ন তার বিছানায় ফিরে শুতে গেল, চোখ বন্ধ করল আর মনের মধ্যে মনে পড়ল সিলভার কথা—এখন সেও কোথাও নিজের মতো নির্ভুল ছিল, তার মনে যেন শান্তি ছিল।
অন্যদিকে, আলবিরার ঘর থেকে গাঢ় নিঃশ্বাসের শব্দ ভেসে আসছিল। থারিনিয়াস তার পাশে শুয়ে ছিল, তবে চোখ বন্ধ ছিল। রাতের উত্তেজনা আর আবেগ ধীরে ধীরে শেষ হয়ে গেল, শুধুমাত্র কিছু গরম অনুভূতি, কিছু অনির্দিষ্ট ভবিষ্যত ছিল। আলবিরা অল্প এক দৃষ্টিতে থারিনিয়াসের দিকে তাকাল, কিন্তু কিছু বলেনি। দুজনের মন এক হয়ে গেছিল, আবার কিছু না বলা কথা তাদের মাঝে মেঘের মতো ঘুরছিল।
আযদাহা সিজন ২ পর্ব ৩২
এমন পরিস্থিতিতে, প্রাসাদের সকালের শান্ত পরিবেশের মাঝে সবাই তাদের নিজেদের দুনিয়ায় চলে গেছিল, হয়তো কিছুটা নীরব, কিন্তু একে অপরের প্রতি তাদের ভালোবাসার অনুভূতি গভীর ছিল।