আত্মার আগলে পর্ব ৩৫ (২)
সানজিদা আক্তার মুন্নী
কেটে গেছে ১০ টি দিন “! নির্বাচন! আর মাএ ১০ দিন পরি নির্বাচন “!
এহসান দিনের পর দিন দৌড়ঝাঁপ করেই চলেছে। খাওয়া-দাওয়া ভুলে গেছে, ঘুম নেই চোখে, শুধু রাজনীতি আর ক্ষমতার লড়াই। প্রতিদিনের মিছিল, প্রতিদিনের সংঘর্ষ—তার প্রতিপক্ষ তাকে শেষ করে দেওয়ার জন্য যে কতবার পরিকল্পনা এঁটেছে, তার কোনো ইয়ত্তা নেই। কিন্তু এহসানও কম যায় না। তার লোকজন যেন ছায়ার মতো পাশে থাকে, বিপদ আসার আগেই প্রতিপক্ষকে মাটিতে নামিয়ে দিতে একটুও দ্বিধা করে না।
বিরোধী দল রাকিব, যার তিন ভাই এহসানের হাতে খুন হয়েছে, সে কি এত সহজে হাল ছাড়বে? তার প্রতিশোধের আগুনে পুরো শহর পুড়তে বসেছে। ভোটে জেতা তার লক্ষ্য নয়—তার লক্ষ্য একটাই, এহসানকে শেষ করা। কিন্তু প্রতিবারই ব্যর্থ হচ্ছে। তবু সে লড়ে যাচ্ছে, এক মুহূর্তের জন্যও পিছু হটছে না।
অন্যদিকে, এরিক। সবার আড়ালে থাকা এক রহস্যময় চরিত্র। তার বাবা-চাচা দেশের বাইরে নির্বাসিত, আর সে পণ করেছে তাদের ফিরিয়ে আনবে। কিন্তু তার জন্য এহসানকে মরতেই হবে। কারণ এহসান বেঁচে থাকলে, তার পরিবার এই দেশে আর কখনো পা রাখতে পারবে না।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
এরিক নিখুঁত পরিকল্পনার অধিকারী। কোনো কাঁচা কাজ সে করে না। সে একজন বিজ্ঞানী, যার পুরো মনোযোগ এখন এক বিশেষ ধরনের বোমা বানানোর দিকে। সিলেটের উপশহরের এক নির্জন বাড়িতে সে একাই থাকেছে এখন, রিসার্চ করে চলছে। তার তৈরি করা অস্ত্র একবার ব্যবহার করতে পারলে, এহসানকে শেষ করা কোনো ব্যাপারই হবে না।
নির্বাচন যত এগিয়ে আসছে, ততই শহরের বাতাসে অস্থিরতা বাড়ছে। প্রতিটি গলিতে আতঙ্ক, প্রতিটি মোড়ে ষড়যন্ত্র। এই লড়াই শুধুই ক্ষমতার নয়—এটা টিকে থাকার লড়াই। আর টিকে থাকতে হলে, কেউ না কেউ মরবেই।
মেহনূর এহসানের অপেক্ষায় বসে প্রহর গুনছে। সে জানে, এহসান এখন খুব ব্যস্ত। তাই অনেক দিন হয়তো রাতে বাড়ি নাও ফিরতে পারে। এহসান তাকে খাঁড়া নিষেধ করে দিয়েছে—
—“আমার জন্য অপেক্ষা করবি না, নিজের ঘুম নষ্ট করিস না।”
কিন্তু মেহনূর কি এসব শোনার মানুষ? তার মনে একটিই জিদ—এহসান ছাড়া সে ঘুমাবে না। তাই প্রতিদিন রাত তিনটা-চারটা পর্যন্ত বারান্দায় বসে থাকে, আধো ঘুমে ঢলে পড়ে। গাড়ির শব্দ পেলেই প্রাণ হাতে নিয়ে ছুটে গিয়ে সদর দরজা খুলে দেয়। এটাই তার কাজ।
কিন্তু আজ আর তেমন হলো না। এহসান গাড়ি ছাড়াই বাড়িতে প্রবেশ করেছে। তাই মেহনূরের ঘুমও আর ভাঙেনি। রাত এখন দুটোর কাছাকাছি। আজ একটু তাড়াতাড়িই ফিরেছে এহসান। নির্বাচন নিয়ে সভা, মিছিল, ফ্যাক্টরি, কোম্পানি সামলাতে সামলাতেই দিন কেটে যাচ্ছে তার। তবে হাসিব আর জয়নালের কারণে কিছুটা সুবিধা হয়েছে। তারা আপন ভাইয়ের মতো সব কিছু সামলে নেয়, এহসানের কাজের বোঝা কমানোর জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করে।
এহসান সদর দরজার সামনে এসে দেখে, আজ কেউ দরজা খুলছে না। সে বুঝতে পারে, মেহনূর গাড়ির শব্দ শুনতে পায়নি। তাই ঘুম থেকে ওঠেনি। নয়তো এমন কখনোই হয়নি যে সে জেগে থাকবে, আর এহসান দরজার সামনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করবে।
এহসান আপন মনে হাসল। পকেট থেকে মানিব্যাগ বের করে চাবি দিয়ে দরজা খুলল।
এহসান ভেতরে ঢুকেই দ্রুত নিজের ঘরে চলে এলো। কেন তাড়াহুড়ো করবে না? আপন নারীকে যে দেখতে হবে!
ঘরে ঢুকেই দেখে, বিছানা ফাঁকা। তবে আজ বুক ধক করে ওঠে না। সে জানে, তার “কবুতরের বাচ্চা” কোথায় আছে।
আলতো পায়ে এগিয়ে যায় বারান্দার দিকে। দরজা পেরিয়ে দেখল, তার স্নিগ্ধ ফুলটা সোফায় মাথা এলিয়ে একদিকে কাত হয়ে ঘুমিয়ে আছে। পর্দার ফাঁক দিয়ে চাঁদের আলো তার মুখে পড়েছে, মুখখানা মায়াময় হয়ে উঠেছে। যেন চাঁদের আলো নিজের রশ্মি দিয়ে তার আরেকটি অংশকে ছুঁয়ে রেখেছে।
চাঁদের আলোয় মেহনূরের ঠোঁটের নিচে মাঝবরাবর থাকা ছোট্ট তিলটি স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে।
এহসান এক চিলতে হাসি ঝুলিয়ে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। খুব ক্লান্ত লাগছিলো তার, কিন্তু এখন? প্রশান্তি। এক গভীর প্রশান্তি।
আলতো পায়ে এগিয়ে এসে হাঁটু গেড়ে বসে মেহনূরের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। হাত বাড়িয়ে তার গালে আলতো ছোঁয়া দেয়।
ফিসফিসিয়ে বলে,
—-“তুমি এ কেমন নেশা? তোমায় দেখার তৃষ্ণা কেন আমার শেষ হয় না? প্রহর গুণে থাকি, তবু মন চায়, বারবার তোমার পানে তাকাই।”
এহসানের উপস্থিতি অনুভব করে মেহনূর। ঘুমের ঘোরেই শরীরে শিহরণ জাগে। মনে হয়, আশেপাশে কেউ আছে! আতঙ্কে চোখ খুলে ফেলে। প্রথমে মনে হয়, কোনো জ্বিন-ভূত নয় তো? কিন্তু চোখ খুলেই দেখে, এহসান পাশে বসে আছে।
সে এক লাফে উঠে দাঁড়ায়!
—“আপ… আপনি এখানে কি করছেন?”
এহসান বাঁকা চোখে তাকিয়ে হেসে বলে,
“—আমি থাকব না তো কে থাকবে?”
মেহনূর বুকে হাত দিয়ে শ্বাস নিলো।
—-“না মানে… আমি তো গাড়ির শব্দ শুনিনি!”
এহসান হাসল।
—“গাড়ি নিয়ে আসিনি তো।”
মেহনূরের মন খারাপ হয়ে গেল। সে তো প্রতিদিন দরজা খুলে দেয়, আজ পারল না! ছোট্ট করে বলল,
—“ওহ।”
এহসান বুঝতে পারে তার মন খারাপের কারণ। মেহনূর বেলকনি ছেড়ে চলে যেতে নিলো।
এহসান হেসে বলে,
—“চলে যাচ্ছো যে? জড়িয়ে ধরবে না আজ?”
মেহনূরের পা থেমে গেল। এ ক’দিনে এটা তার অভ্যাস হয়ে গেছে। এহসান এলেই তার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে। আপন পুরুষের ঘামের গন্ধ মাখা বুকে লেপ্টে থাকাটা তার ভালোই লাগে।
সে ধীরে ধীরে ফিরে এল, এহসানের চোখে চোখ রাখল। কিছু মুহূর্ত তাকিয়ে থেকে আর থাকতে পারল না, তার ঠোঁটে হাসি ফুটে উঠল।
মেহনূরের এই হাসি এহসানের কাছে ভয়ংকর সুন্দর। এই হাসির মূল্য পৃথিবীর সমস্ত সম্পদের চেয়েও বেশি।
মেহনূর হেসে জড়িয়ে ধরল এহসানকে।
এহসানও আপন বুকে তাকে শক্ত করে আগলে নিলো। মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,
—“বিশ্বাস করো, আমার প্রাণপ্রিয় নারী, যখন তোমার এই হাসি দেখি, তখন মুহূর্তে গুলিয়ে যাই—তোমাতে আমি।”
মেহনূর বুকে মুখ গুঁজেই বলল,
—“হয়েছে আমার কবি পুরুষ, এখন ছাড়ুন, খাবার নিয়ে আসি।”
এহসান মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,
—“নাহ, আজ বাইরে এক সভায় খেয়ে এসেছি।”
মেহনূর বলল,
—“ওহ, তাহলে গোসল করুন।”
এহসান মুচকি হেসে বলল,
—-“আজ রাতে তোকেও ফরজ গোসল করাব, আমার বাচ্চার মা!”
মেহনূর হেসে বলল,
“—আগে যান, নিজে গিয়ে গোসল করুন, পরে আমায় করাবেন!”
এহসান একখানা লুঙ্গি নিয়ে বাথরুমে প্রবেশ করে, অতঃপর গোসল সেরে বেরিয়ে আসে।
এহসান বেরিয়ে আসতেই মেহনূর বাথরুমে প্রবেশ করে ওজু করে আসে।
মেহনূর বাইরে আসতেই এহসান ওকে বলে—
—-“এ কদিন তুই যদি অসুস্থ না থাকতিস, তাহলে এতদিনে আমি বাচ্চার বাপ হওয়ার সুখবরটা পেয়েই যেতাম রে, কবুতরের বাচ্চা!”
মেহনূর বেশ চটে যায় এ কথায়। এহসানের দিকে তাকিয়ে শান্ত গলায় বলে—
—“শুধু সুখবর পেতেন না, বাচ্চা দুনিয়াতে এসে সে আপনাকে ‘আব্বা’ও ডেকে নিত! অসভ্য লোক, সবসময় শুধু অসভ্য কথা!”
এ বলেই মেহনূর অন্যদিকে চলে যেতে নিলে এহসান মেহনূরকে পিছন থেকে আঁটকে ধরে, আর ওর গালে মুখ বুঁজে বলে—
—“জান, তাহলে আমায় ‘আব্বা’ ডাক শোনার স্বপ্নটা পূরণ করে দাও!”
এ বলে এহসান মেহনূরের কোমর ধীরে হাতে জড়িয়ে ধরে। মেহনূর খিলখিলিয়ে হেসে ওঠে সুরসুরির কারণে!
এহসান আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলে—
—-“জান, কিছু তো বলো!”
মেহনূর কোনো উত্তর দেয় না। কী-ই বা উত্তর দেবে? সে নিজেও তো চায়, এহসানের সঙ্গে একটা সুন্দর সংসার সাজাতে, একজন মুত্তাকি স্ত্রী হয়ে দেখাতে!
এহসান মেহনূরের গালের কাছে মুখ নিয়ে আসে। মেহনূর লজ্জায় মুখ সরিয়ে নেয়।
এহসান হেসে বলে—
—-“ওরে! আবার লজ্জাবতী লতাপাতা! রে, এত লজ্জা তুমি কোথা থেকে পাও?”
মেহনূর এটা শুনে লজ্জায় বলে—
“–ইসস! দেখি, সরুন তো! সবসময় আপনি আমায় লজ্জায় মেরে ফেলেন!”
এহসান এবার মেহনূরকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে, তার গালে আলতো হাতে রেখে বলে—
—“আজ সব লজ্জা চলে যাবে!”
মেহনূর কিছু বলে না। সে শুধু এটা ভাবছে—এই মুহূর্তে তার লজ্জায় মাটির নিচে ঢুকে যাওয়ার অবস্থা! আর এরপরের মুহূর্তগুলোতে তার কী হবে? লজ্জায় কি বেঁচে থাকবে, নাকি লজ্জা পেয়ে পেয়েই মরে যাবে?
এহসান মেহনূরকে আবার প্রশ্ন করে—
—“মিসওয়াক দিয়ে ওজু করেছ তো?”
মেহনূর মাথা নাড়ায়—
—“হ্যাঁ, আপনি?”
এহসান মৃদু হেসে মেহনূরকে কোলে তুলে নেয়—
—“হ্যাঁ, করেছি!”
এ বলে একটু এগিয়ে যায় বিছানার দিকে। মেহনূর এহসানের বুকেই লেপ্টে আছে!
এহসান মেহনূরের দিকে তাকিয়ে বলে—
—“তাহলে তোমার লজ্জাকে ‘ফি আমানিল্লাহ’ বলে দাও!”
এ বলেই আলতো করে শুইয়ে দেয় মেহনূরকে, অতঃপর বাতি নিভিয়ে দেয়।
মেহনূর এতক্ষণ শুধু এহসানের দিকেই তাকিয়ে আছে। ভেতরটা কেমন খচখচ করছে। আজ সে পারবে—নিজের স্বামীর হাতে নিজের ইজ্জত তুলে দিতে। সেই সম্মান, যা সে এতদিন নিজের নফসের সঙ্গে যুদ্ধ করে আগলে রেখেছে, শুধু তার আপন, হালাল পুরুষের জন্য! আজ তার জন্য রাখা সম্মান তার হাতেই তুলে দেবে মেহনূর—সারা জীবনের জন্য!
এহসান এগিয়ে এসে আলতো হাতে মেহনূরের ওড়নাখানা সরিয়ে নেয়।
তারপর মেহনূরের দিকে ঝুঁকে ওর কানে কানে বলে
—- পড়ো!
اللهم جنبنا الشيطان وجنب الشيطان ما رزقتنا
মেহনূর লজ্জা মাখস গলায় পড়ে
—
—اللهم جنبنا الشيطان وجنب الشيطان ما رزقتنا
[“হে আল্লাহ, আমাদেরকে শয়তান থেকে রক্ষা করুন এবং যে সন্তান আপনি আমাদের দান করবেন, তাকে শয়তান থেকে দূরে রাখুন।”]
অতঃপর এহসান মেহনূরের ঠোঁটে আপন ঠোঁট ছুঁইয়ে দেয়।
এতদিন এই অধর শুধু এই মুখশ্রীতে স্থান পেয়েছিল, কিন্তু আজ এই আপন অধরখানা আপন নারীর সমগ্র শরীরে জায়গা করে নিল!
সারা ঘরজুড়ে ছড়িয়ে পড়ল এহসানের বেয়াদব নারীর সেই ভয়ংকর সুন্দর লজ্জামাখা খিলখিল হাসি, সঙ্গে এহসানের মন ভোলানো মুচকি হাসি!
দুজনে পাড়ি জমায় এক সুখে ঘেরা দুনিয়ায়”!
☘️☘️ অনেক মুহূর্ত পর ☘️☘️
এহসান মেহনূরের কানের কাছে মুখ নিয়ে এসে বলে,
— জান, যত নড়াচড়া আর কান্নাকাটি করবে, ততই তোমার কষ্ট হবে, আমার না।
মেহনূর এহসানের কাঁধে খামচে ধরে বলে,
— অনেক হয়েছে, এবার ছাড়ুন আমায়…
মেহনূর আর কিছু বলার আগেই এহসান ওর মুখে এসে পড়া চুলগুলো কানের পাশে গুঁজে দিতে দিতে বলে,
— উমম! ধরেছি তো, যেহেতু সেহেতু কোনো ছাড়াছাড়ি নেই।
মেহনূর জেদ করে বলে,
— না ছাড়লে আমি কিন্তু চিৎকার করব!
এহসান মুচকি হেসে বলে,
— সেটাতো করছই এতক্ষণ ধরে।
মেহনূর চুপ হয়ে যায়। এই পুরুষের সঙ্গে কথা বলাটাই অযথা!
এহসান মেহনূরের গলায় ও বুকে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা চুলগুলো সরিয়ে আবারও ওর গলায় মুখ বুঁজে দেয়। এহসানের দাঁড়ি যতবার ওর ত্বক স্পর্শ করেছে, ততবারই মেহনূর খিলখিলিয়ে হেসে উঠেছে। এবারও তাই হলো!
এহসান মেহনূরের হাসি শুনে মুখ তুলে ওর দিকে তাকিয়ে বলে,
— এ কেমন নমুনা গো, বউ? এই কাঁদো, আবার এই হাসো?
মেহনূর লজ্জায় ঠোঁট কামড়ে হেসে ফেলে! এহসান শব্দ করে হেসে আপন নারীতে আবারও ডুব দেয়।
রাত চারটা বাজতে চলল।
মেহনূর বিছানায় শোয়ে আছে, তবে এহসানের বুকে নয়, বিছানায়, কারণ এহসান গোসল করতে গেছে।
কিন্তু মেহনূর গোসল করতে যায়নি, কারণ গোসল করার জন্য উঠার যে শক্তি প্রয়োজন, তার শরীরে তা আপাতত নেই। মনে হচ্ছে সব হাড় গুড়িয়ে কেউ ভেঙে দিয়েছে। যদিও এহসান কোনো কষ্ট দেয়নি, তাও তার বেশ কষ্ট হচ্ছে। ব্যথায় সারা শরীর গুড়িয়ে যাচ্ছে, মনে হচ্ছে।
মেহনূর উঠতে পারছে না, শোয়ে শোয়ে কিছু সময় আগের ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলোর কথা ভাবছে আর মুচকি মুচকি হাসছে।
এহসান গোসল করে বেরিয়ে আসে বাথরুম থেকে। চুলের পানি মুছতে মুছতে এগিয়ে আসে মেহনূরের কাছে।
এহসানকে দেখে মেহনূরের বেশ লজ্জা লাগছে। মরে যেতে ইচ্ছে করছে লজ্জায়।
এহসানকে দেখে, সাথে সাথে মুখ ঝাপ দিয়ে দেয় মেহনূর। মেহনূরকে এমন করতে দেখে এহসান এগিয়ে এসে হেসে, ওর পাশে এসে বিছানায় বসতে বসতে বলে,
— ওগো, লজ্জাবতী, লতাপাতা আর লজ্জা পেয়ে না। কয়েকদিনের মধ্যে তুমি আমার বাচ্চার মা হয়ে যাবে, তাই এত লজ্জা পেলে চলবে তোমার, শুনি?
মেহনূর আগের মতো থেকে বলে,
— নির্লজ্জ পুরুষ, আর লজ্জা দিবেন না! এমনিতেই আমি মরে যাচ্ছি লজ্জায়।
এহসান একটু এগিয়ে গিয়ে হাত দিয়ে আলতো টান দিয়ে মেহনূরের মুখ থেকে কাঁথা সরিয়ে বলে,
— চলো, তোমার লজ্জা আবারও ভাঙানোর চেষ্টা করি।
মেহনূর চোখ বড় বড় করে তাকায় এহসানের দিকে, তারপর বলে,
— আমি আর আপনার কাছে জীবনেও যাব না।
এহসান অবাক হয়ে বলে,
— কেনো গো বউ, আমার দেওয়া ডোস কি তোমার পছন্দ হয়নি?
মেহনূর এবার একটু রেগে গিয়ে বলে,
— কী করেছেন আপনি আমার সাথে? মনে হচ্ছে, কেউ শরীরের সব হাড় ভেঙে দিয়েছে।
এহসান ঠোঁট কামড়ে হেসে বলে,
— কী করেছি? চলো, আবার করে দেখাই।
এহসান-এর এমন কথায় মেহনূর অন্য দিকে চোখ নিয়ে বলে,
— অসভ্য পুরুষ।
ফিরে চোখ ঘুরিয়ে এহসানের পানে তাকায়। গায়ে গেঞ্জি নেই, একখানা লুঙ্গি পড়েছে! এলোমেলো চুল থেকে এখনো পানির ফোঁটা পড়ছে। মেহনূর আজ মন ভরা দূষিত তাকিয়ে থাকে এহসানের পানে! আজ তার লজ্জা না লাগছে তাকাতে এহসানের পানে, আর না দ্বিধা।
সে ঠায় এক দূষ্টিতে তাকিয়ে থাকে এহসানের পানে! এহসান মেহনূরের এ দূষ্টি লক্ষ্য করে শীতল গলায় বলে,
— কী দেখো?
মেহনূর নিষ্পলক চোখে বলে,
— আপনায়।
এহসান মেহনূরের দিকে এগিয়ে আসে আর তার দিকে ঝুঁকে বলে,
— এবার দেখো, মন ভরে দেখো, মনে রেখে, এই আমি শুধু তোমার।
মেহনূর আলতো হাত তুলে, এহসানের গালে নিজের দুই হাত রাখে আর বলে,
— আমি কল্পনাও করিনি কোনোদিন, আপনার মতো ভয়ংকর সুন্দর পুরুষ, আমার তকদিরের আল্লাহ লিখে রাখবে।
এ বলে মেহনূর হালকা মাথা তুলে, বালিশ থেকে এহসানের কপাল নিজের ঠোঁটে ছুঁয়ে দেয়।
এহসান আবেশে চোখ বুঁজে নেয়। তার জীবনের শ্রেষ্ঠ পাওয়া এটা”! যে তার নারী তাকে ভালোবেসে আলিঙ্গন করছে
মেহনূর আবারও বালিশে মাথা রেখে মুখ ভারী করে বলে,
— আমি তো উঠতেই পারছি না, ভেবেছিলাম তাহাজ্জুদ পড়ব।
এহসান মেহনূরের কথায়, ওর থেকে চোখ সরিয়ে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলে,
— ফজরের আযান পাঁচটা ত্রিশে শুরু হয়, আর এখন চারটা বিশ, তাই পড়তে পারব। চলো, তোমায় নিয়ে যাই।
এ বলেই এহসান মেহনূরের উপরের কাঁথা সরিয়ে নিলে! মেহনূর আঁতকে উঠে তা আঁকড়ে ধরে বলে,
— এই কী করছেন? আমার শরীরের একটা কাপড়ও নেই! ছাড়ুন, আমি উঠে যাব।
এহসান মেহনূরের এমন কথা শুনে হাসতে হাসতে বলে,
— এত কিছুর পরও এত লজ্জা কোথায় থেকে পাও তুমি?
মেহনূর হালকা রাগি গলায় বলে,
— আমার যেখান থেকেই পাই, সেটা আপনার জানার প্রয়োজন নেই! এই কাঁথা সহ যদি পারেন, আমায় বাথরুমে নিয়ে দিতে তো দেন, নয়তো চুপচাপ বসে থাকুন।
এহসান আর কিছু বলে না, মুচকি হেসে উঠে দাঁড়ায়। তারপর কাঁথা সহই মেহনূরকে নিয়ে বাথরুমে বাথটবে শুয়ে দেয় আর বলে,
— আমি কাপড় দিচ্ছি।
এ বলে কক্ষে চলে আসে এবং একটা খয়েরী রঙের থ্রি-পিস বাথরুমে রেখে আসে।
এহসান চলে যাওয়ার পর, মেহনূর নিজের লজ্জা নিজে গিলে, অনেক কষ্টে গোসল সেরে নেয়! তার বেশ কষ্ট হচ্ছিল, সারা শরীরে ব্যথা করছে, এখনও এই ব্যথা তীব্র থেকে তীব্র হচ্ছে!
মেহনূর গোসল করে ওযু করে ধীর পায়ে বেরিয়ে আসে বাথরুম থেকে! এসে দেখতে পায়, এহসান বিছানার বালিশ গুছিয়ে রাখছে। এহসান বিছানার চাদর সহ সব পাল্টে দিয়েছে।
মেহনূর হালকা হেসে উঠে, যে তার পুরুষ তার সব দিক দিয়েই খেয়াল রাখে। মেহনূরকে বেরিয়ে আসতে দেখে এহসান মেহনূরের পানে তাকায়। সেই সবসময়ের মতো তার দুনিয়া থমকে যায়; আপন নারী সামনে দাঁড়িয়ে আছে, ভেজা চুল থেকে টুপটুপ করে পানি গড়াচ্ছে। মুখশ্রীতে পানি লেগে আছে, মনে হচ্ছে মুক্ত ঝরছে।
এহসান মেহনূরের দিকে এগিয়ে যায়। মেহনূরের সামনে এসে হালকা মাথা ঝুঁকিয়ে বলে,
— জান, বেশি কষ্ট হচ্ছে?
মেহনূর মাথা নাড়ে,
— হ্যাঁ, খুব বেশি।
এহসান মেহনূরের গাল আলতো করে ছুঁয়ে বলে,
— চিন্তা করো, সব ঠিক হয়ে যাবে। চলো, নামাজ পড়ি।
মেহনূর এহসানের পানে তাকায়। এবার সে স্পষ্টভাবে দেখতে পায় যে, খাবলিয়ে সে এহসানের শরীর কীভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। ফর্সা শরীরে লাল খামচির দাগ স্পষ্ট।
মেহনূর এহসানের কাঁধের একটা খামচির দাগে হাত বুলিয়ে বলে,
— ইস, কী করেছি আমি আপনার শরীরে?
এহসান মেহনূরের মুখের দিকে তাকিয়ে হেসে বলে,
— তুমি যদি নিজ হাতে আমায় মেরেও ফেলো, তাও আমি খুশি খুশি সেই মরণ মেনে নেব। কোনো অভিযোগ করব না।
মেহনূরের কলিজা খচ করে। এ কথায় সে মনে মনে বলে,
“মাবুদ, এমন পরিস্থিতি যেন আমার স্বপ্নেও না আসে।”
এহসানকে বলে,
— যান, ওযু করে আসুন। নামাজ পড়বেন না?
এহসান মুচকি হেসে বাথরুমের দিকে পা বাড়ায়, উদ্দেশ্য ওযু করা।
মেহনূর ধীর পায়ে এগিয়ে গিয়ে কক্ষে থাকা ওয়ারড্রব থেকে দু’খানা জায়নামাজ হাতে তুলে নেয় এবং নিজে নামাজের হিজাব পড়ে নেয়।
জায়নামাজ বিছিয়ে দেয়; এহসানের জায়গা আগে, আর নিজের জায়গা এহসানের পিছনে। সে চায়, এহসান হোক ইমাম, সে পূর্ণ হয়ে তার সাথেই তাহাজ্জুদ শুরু করুক, আর শুরু হোক এক নতুন জীবন।
এহসান ওযু করে বেরিয়ে আসে, অতঃপর টুপি মাথায় পড়ে আলতো হেসে এসে জায়নামাজে দাঁড়ায় এবং নিজের আপন নারীর সাথে তাহাজ্জুদ শুরু করে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের আশায়।
কিন্তু আট রাকআত পড়ে মোনাজাত করে, মেহনূরের শরীরে আর কুলায় না। সে জায়নামাজেই শুয়ে পড়ে, শরীর অবস হয়ে গেছে, তার মনে হচ্ছে জ্বর আসবে।
এহসান মেহনূরকে শুয়ে যেতে দেখে, মেহনূরের মাথার কাছে এসে বসে, নিজের কোলে মেহনূরের মাথা তুলে, ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলে,
আত্মার আগলে পর্ব ৩৫
— ঔষধ দেবো কি?
মেহনূর চোখ বন্ধ করে উত্তর দেয়,
— না, চা খেয়ে খাব।
এহসান মেহনূরের গালে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলে,
— তেলাওয়াত শুনাবো কি?
মেহনূর চোখ বুঁজেই আলতো হেসে বলে,
— হ্যাঁ।
এহসান অনুমতি পেয়ে, নিজের গলার যত সুর আল্লাহ তাকে দান করেছেন, তা টেনে তাউয পড়ে নেয় এবং সূরা ইয়াসিন তেলাওয়াত করতে শুরু করে।