একজোড়া আগুন পাখি পর্ব ৩৮ (৩)

একজোড়া আগুন পাখি পর্ব ৩৮ (৩)
রনীতা তুশ্মি

—“কোনো উত্তর নেই, তাই না? জানি আমি…কিচ্ছু বলতে পারবেন না আপনি। তবে দয়া করে আর আমার জীবনেও নতুন করে প্রবেশ করার চিন্তাভাবনাও করবেন না। এটা আর সম্ভব নয়, কখনোই সম্ভব নয়। আমি ম’রে গেলেও চাইনা এমন কিছু হোক। আপনি কি করেছেন, না করেছেন তা না-হয় আপনার কাছেই থাকুক। আমি আর নতুন কোনো হিসেব-নিকেশের মাঝে জড়াতে চাইনা। আমাকে আর আমার বোনকে এবার শান্তি মতো… আমাদের মতো করে বাঁচতে দিন। নয়তো… মেরে ফেলুন।”

কেনীথ আনায়ার এতো প্রশ্ন, কথার প্রতিত্তরে কিছুই বলল না।বরং চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। অন্যদিকে আনায়া কিছুক্ষণ কাঁদার পর আর ঠিকঠাক দাঁড়িয়ে থাকার আর শক্তি পেল না। আনায়ার পাশাপাশি কেনীথও অনুভব করল,আনায়ার শরীর অনবরত কাঁপছে। কেনীথ খানিকটা মাথা নিচু করে ওর দিকে তাকাতেই দেখে, সে কেমন যেন তার বুকের মাঝেই নেতিয়ে পড়েছে। কেনীথ কপাল কুঁচকে চিন্তিত স্বরে বলে উঠল,
“তারা! তুই ঠিক আছিস?”
আনায়া আর কিছুই বলে না। যেন সে বলতে পারছে না৷ নূন্যতম বলার জোরটুকু আর অবশিষ্ট নেই। কেনীথ একহাতে ওকে শক্ত করে ধরে নিজের সাথে মিশিয়ে নেয়। অন্যহাতে আনায়ার গাল ছুঁয়ে মুখ উঁচিয়ে ধরতেই আনায়ার বি’ধ্বস্ত চেহেরায় কেনীথ খানিকটা আঁতকে উঠল। হঠাৎ এতো বাজে অবস্থা কি করে হলো কিছুই মাথায় আসছে না। কেনীথ প্রচন্ড উদ্বিগ্ন স্বরে আনায়ার উদ্দেশ্যে বলে উঠল,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“এমন করছিস কেনো?…বেশি খারাপ লাগছে? কথা বলছিস…”
—“দয়া করে আমায় একটু ছাড়ুন…আমি রুমে…”
কেনীথের বাঁধন থেকে আনায়া চাইলেও নিজের শারিরীক অবস্থার কারণে, নড়াচড়াটুকুও করতে পারছিল না৷ হাত পা যে সব অবশ হয়ে আসছে। মাথা প্রচন্ড ভার..চোখ খুলে তাকিয়ে থাকাও যেন কষ্টকর। আনায়া নিজেও বুঝতে পারছেনা, তার এতো কেনো খারাপ লাগছে। আর শেষমেষ কথা বলতে গিয়ে আর তার কথা সম্পূর্ণ হলো না।বরং তার পূর্বেই মাথা ঢুলে কেনীথের বাহুতে অচেতন হয়ে পড়ল।
আনায়া অজ্ঞান হয়েছে তা বুঝতেই কেনীথ তড়িঘড়ি করে ওর গাল চাপ্টে ওকে ডাকতে শুরু করে।
—“তারা! তারা! উঠে যা প্লিজ…”
কেনীথ এ কথা বলতে না বলতেই আনায়াকে পাঁজা কোলে তুলে নেয়। এক মূহুর্তও দেরি না করে আনায়াকে নিয়ে রুমে ছুটে যায়। ওকে বিছানায় শুইয়ে দিয়েই, লোকজন ডেকে ঘর ভরিয়ে ফেলে। ওর উদ্বিগ্নতা, অস্থিরতা সবকিছুই পাগল প্রায়। চারপাশের সার্ভেন্টগুলোও ওর কাজকর্মে ভীতু হয়ে দাঁড়িয়ে। অবশ্য সেই ভয় নিয়েই প্রত্যেকে নিজেদের কাজটা যথাযথ করে চলেছে।

” রাতের শহর জেগে থাকে, নিঃশব্দের দরজায়_____
আমি একা গুনি তোমার অব্যক্ত ব্যবধান
মুখ ফিরিয়ে থাকো তুমি
আমি তবু তোমারই থাকি!
জানো না, জানতেও দাও না—একজোড়া আগুন পাখি
> ভয় নয়, ক্রোধ নয় — এই ভালোবাসা পুড়ে যায়
কষ্ট নয়, শব্দ নয় — শুধু নিরবতায় বাঁচে এই হৃদয়
> আমি আগুন — তুমি বাতাস
ছুঁতে গেলেই মিলায় আশ্বাস________
তবু থেকে যাই তোমার আকাশে
একজোড়া আগুন পাখি — পুড়ে ম’রে নিঃশ্বাসে
> শত প্রশ্ন জমে আছে ঠোঁটের কিনারায়।
বলা হয়নি অনেক কথা ছায়া হয়ে বায়_____
হয়ত তোর ঘৃণা — হয়ত ভুল বোঝা সবই!
তবু হৃদয়ে ভাসে শুধু ____ তুই সেই আমার আগুন পাখি।
জানো না, জানতেও চাও না,
তবু হৃদয় জানে তুমি ছিলে।
আমরা একজোড়া আগুন পাখি—
ভালোবাসারও আগুনে জ্বলেছি নীরবে…
উড়তে পারি না পাশাপাশি,
তবুও পুড়ে যাই সমান তালে—
নিঃশব্দ ভালোবাসায়,
অভিমানী আগুনে।
(Lyrics writer—V.K.)

রাতের নিস্তব্ধ আবহে গাওয়া গান হঠাৎ থেমে যায়।
তার সাথে যেন থেমে যায় সময়ের কাঁটা।
সেই থেমে যাওয়া সুরের ভাঁজে, কেনীথের দীর্ঘশ্বাস একটুকরো ছায়া হয়ে ঢেউ তোলে শূন্যে।
বারান্দার রেলিংয়ে পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সে। মুখটা উপরের দিকে তুলে রাখা, দৃষ্টিটা স্থির—অন্ধকার আকাশের পানে।যেন আকাশের অসীমতার মধ্যে কোথাও লুকিয়ে আছে তার সব প্রশ্নের উত্তর।যা সে কখনো পায়নি… আর পাবে বলেও মনে হয় না।চোখে তার অবাধ শূন্যতা, নিস্তব্ধতা আর হাহাকার…।
আনায়াকে অজ্ঞান অবস্থায় বিছানায় শুইয়ে দেওয়ার পর কিছুক্ষণের মাঝেই ওর জ্ঞান ফেরানো হয়। সেই সাথে বাড়ির পারসোনাল ডক্টর এসে চেক-আপ করে যায়। ডাক্তারের অভিব্যক্তিতে গুরুতর কিছু নয়, অনেকটা সময় না খেয়ে থাকার জন্যই এই অবস্থা। অতঃপর ওকে অর্ধ অচেতনতার মাঝেই কোনো মতে কিছু খাবার খায়ানোর পর, অল্প কিছু সময়ের মাঝেই সে ঘুমিয়ে যায়। এবং তখন হতে এখন পর্যন্ত পুরো সময়টাতেই কেনীথ আনায়ার পাশেই থাকে৷ তবে একটা দীর্ঘ সময় পর অজানা সব চিন্তা ভাবনায় অস্থির হয়ে উঠলে সোজা বারান্দায় চলে আসে।
ভোর হতে আরো অনেকটা দেরি৷ কেনীথের সবকিছুই প্রচন্ড বিরক্ত লাগছে। খানিকটা সময় আনমনে গান গাওয়ার পর এখন প্রচন্ড অস্বস্তিতে হাসফাস করতে লাগল।

কেনীথ চোখদুটো আলগোছে ধীরে ধীরে বুঁজে আনে।হিম হাওয়া গায়ে এসে ঠেকে, কেনীথ খানিকটা কেঁপে ওঠে।তবু নড়ে না, হঠাৎই মৃদু স্বরে, নিজের সঙ্গে নিজের একান্ত কথোপকথনে লিপ্ত হয় সে।
“কত সহজে তুই মিশে যাস সবার মাঝে।
সবাইকে ভালোবাসিস, ছুঁয়ে থাকিস আলগোছে…
আর আমি কে? কে আমি?
আমি তো শুধু তোর পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়া একটা ছায়া মাত্র। যার উপস্থিতি তুই কখনো অনুভব করিসনি।”
কেনীথের স্বরে কষ্ট নেই, কিন্তু রয়েছে আকাশস্পর্শী শূন্যতা।একটা নির্লিপ্ত বেদনাবোধ, যা চিৎকার করে না।,তবুও ভেতরে গভীর ক্ষরণ তোলে। পুনরায় পিনপতন নিরবতায় চারপাশে ছেয়ে যায়। কেনীথ কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর পুনোরায় আওরায়,
“আমি যেন তোরই চেনা শহরে সবচেয়ে অচেনা এক মানুষ।
আমি জানি, তুই ভালোবাসিস না আমাকে। হয়তো কোনোদিনও…।তবুও তো আমি তোকে ভালোবেসেই নিঃশব্দে পুড়ে গিয়েছি।বারবার পুড়ে ছারখার হয়েছি।

তবুও বিন্দুমাত্র অনুভব করতে পারিস না আমায়? কেনো পারিস না? মানছি আমার দোষ রয়েছে। তোর কথা মতো সব দোষ আমার, কিন্তু… এই কিন্তুই তো সরছে না। আর কত কিন্তুর মাঝে ফেঁসে থাকব, আর কত?
কখনো কোনো অভিযোগ করিনি। কখনো বলিনি কেনো ভালোবাসিস না আমায়। কেননা আমাকে ভালোবাসার…”
কেনীথের কথা যেন সম্পূর্ণ হয়না। সে চোখ খুলে অন্ধকারে ডুবে থাকা আকাশের পানে তাকিয়ে থাকে।তার মধ্যে হয়তো সে খোঁজে আনায়ার অবয়ব…কিংবা সেই না-বলা কথাগুলো, যেগুলো কেবলই জমে রয়েছে ঠোঁটের কোণায়।
—“আমি তো সেই আগুন পাখি—
যে উড়তে চায়, তোকে ছুঁতে চায়,
আর ছুঁতেই গিয়ে নিজেই ছাই হয়ে যায়।”
“ভালোবাসা তো আমি চাইনি…
শুধু তোর একফোঁটা নির্ভরতা চেয়েছিলাম।একটুখানি বিশ্বাস,একটুখানি ভরসা।হয়তো কখনো বলবি,‘তুই বুঝিস আমাকে।’
তা-ও পেলাম না। তুই জানিস না,জানতেও চাস না,কখনো আমাকে বোঝার চেষ্টাও করিস না।তবুও আমি জানি, তুই আমারই ছিলি…কোনো একভাবে, কিংবা অনুচ্চারিত কোনো এক ভাষায়।”

পাশের ঘরে আনায়া নিশ্চুপ, গভীর ঘুমে।
অথচ তার ঘুমের নিঃশ্বাসে ধরা পড়ে কেনীথের পুড়ে যাওয়া স্তব্ধ সময়৷ এমন সময় কেনীথের কানে এক শীতল হাওয়ায় ভেসে আসা শীত কন্ঠ ফিসফিস করে বলে উঠল,
“একটা অসমাপ্ত প্রেম,
একটা অপ্রাপ্ত সম্পর্ক—আর একজোড়া আগুন পাখি।যারা কেবল উড়তে চেয়েছিল…
তবে ঝলসে গিয়েছে ফিনিক্স হয়ে উঠার আশায়।”
যদিও এটা কেনীথের কেবলমাত্র ভ্রম ব্যতীত কিছুই নয়। তবে কেনীথ এতে বিন্দুমাত্র বিচলিত হলো না। বরং আকস্মিক মুচকি হেসে ফেলল। আরো কিছুটা সময় এভাবেই একা একা অতিবাহিত হওয়ার পর কেনীথ রুমে ফেরার সিন্ধান্ত নেয়। কিন্তু ভারী দীর্ঘশ্বাস ফেলে রুমে প্রবেশ করতেই সে খানিকটা চমকে যায়। রুমের কোথাও আনায়া নেই। বিছানা ফাঁকা পড়ে রয়েছে। ওয়াশরুমের দিকে খেয়াল করে দেখল, সেখানেও কেউ নেই। তবে এই সময় আনায়া গেলটা কোথায়?

মাঝরাতে আনায়ার যখন ঘুম ভাঙে তখন তার নজর পড়ে বারান্দায়। কেনীথ গ্রিলের সাথে হেলান দিয়ে আকাশের পানে চেয়ে কিছু বিড়বিড় করে বলে যাচ্ছে। কিন্তু আনায়ার তাতে কোনো হেলদোল নেই। সে তার অসুস্থতায় ভাড় হয়ে আসা শরীরটা নিয়েই আলগোছে রুম থেকে বেরিয়ে পড়ে। গন্তব্য তাদের বাবুশকা লুসিয়া…।
সাধারণত এতো রাতে কোনো বৃদ্ধ বয়সী নারীর জেগে থাকার কথা নয়। কিন্তু আনায়া জানে অভ্যসগত কারণে বাবুশকা এতোক্ষণে ঘুম থেকে জেগে উঠেছে নয়তো এখনো ঘুমায়নি। তবে তাকে সজাগ অবস্থায় পাওয়ার জন্য এই সময়টা ভুল নয়।

আনায়া নিজেকে কোনোমতে সামলে নিয়েই বাবুশকা অর্থাৎ লুসিয়ার রুমের কাছে গিয়ে পৌঁছায়। দরজায় একবার শব্দ করে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। মাথাটা ঝিমঝিম করছে। গতকাল সকালে পাভেলের জোরাজুরিতে শেষ একবার ফলের জুশ খেয়েছিল। এরপর আর একটা খাবারও মুখে তোলেনি। এখন মনে হচ্ছে,নিজের সাথে এমন ভুলভাল জেদ দেখানোটা সবচেয়ে বড় ভুল হয়েছে। অন্তত এমন সিচুয়েশনে এসব কাজকর্ম মানায় না। না খাওয়ার ইচ্ছে রইলেও, নিয়ম করে অল্প অল্প খাওয়া উচিত ছিল তার।
আনায়ার চিন্তাভাবনার মাঝেই আচমকা দরজা খুলে যাওয়ায় আনায়া খানিকটা চমকে ওঠে। আজ জায়গাটা খানিক ব্যতীক্রম লাগছে। আশপাশে তেমন কোনো গার্ডও নেই। সাধারণ এদিকটায় গার্ড অনেক বেশি থাকে। আনায়া এই নিয়ে মাথা ঘামাল না। দরজা খুলে যাওয়ায় লুসিয়ার অপ্রস্তুত হাস্যজ্জল মুখের দিকে আনায়া কিঞ্চিৎ হেঁসে ফেলল। কেন যেন আনায়ার মনে হল, লুসিয়া হয়তো জানত সে এসেছে নয়তো আসবে।

আনায়াকে দেখামাত্রই নিমিষেই লুসিয়ার ভাবমূর্তি পরিবর্তন হলো। সে খানিকটা দুশ্চিন্তার সাথে আনায়াকে বলল,
“তোমার শরীর ঠিক আছে? রেস্ট না নিয়ে এতো রাতে…কোনো বিশেষ প্রয়োজন?”
মূহুর্তেই লুসিয়াস দুইরকম ভাবগাম্ভীর্যই যেন আনায়ার খটকাকে সত্যি করে তুলল। তবে নিছকই মুচকি হেসে বাবুশকা উদ্দেশ্যে বলতে লাগল,
“জ্বী! তেমন কিছুই ভাবতে পারেন। আ…বাবুশকা যদি কিছু মনে না করেন তবে কি ভেতরে আসতে পারি?”
লুসিয়া খানিকটা অপ্রস্তুত স্বরে বলে উঠল,
“আ…হ্যাঁ,হ্যাঁ… ভেতরে এসো। বাহিরে কেনো দাঁড়িয়ে আছো? ”
আনায়া খানিকটা মুচকি হেসে রুমের ভেতর প্রবেশ করে। লুসিয়া এতোটা কঠোর ব্যক্তিত্বের হওয়ার পরও তার মৃদু অস্থিরতা, সংকোচ কোনটাই আনায়ার নজরের অগোচর হয়না।
আনায়াকে লুসিয়া বসতে বললে সে গিয়ে সোফায় চুপচাপ বসে পড়ে। সেইসাথে তার মুখোমুখি হয়ে বসে লুসিয়া। অনেকটা সময় পেরিয়ে যায় দুজনের মাঝে কোনো কথাবার্তা হয়না। আনায়া আড় চোখে লুসিয়াকে পর্যবেক্ষণ করতে ব্যস্ত। লুসিয়ার হাভভাব আজ অনেকটাই পরিবর্তন। খুব অদ্ভুত লাগছে বিষয়গুলো। লুসিয়া যেন না চাইতেও বারবার নজর সরিয়ে এদিকে সেদিকে তাকাচ্ছে। আনায়াও তার মতো আশেপাশে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করল, তারা ব্যতীত রুমে আর কেউ রয়েছে কিনা।

এরই মাঝে আনায়া আবহটাকে স্বাভাবিক করতে লুসিয়াস উদ্দেশ্যে বলে উঠল,
“বাবুশকা, রোজ কোথায়? এখানে আসার পর একবারও ওকে দেখিনি আমি।”
আনায়ার এই স্বাভাবিক প্রশ্নটাও যেন বাবুশকার গায়ে কাঁটা দেওয়ার মতো ছিল। আচমকা এই প্রশ্নের জন্য যেন সে মোটেও প্রস্তুত ছিল না। বৃদ্ধ চেহারায় আতংকের ছাপ পড়াতে আনায়া খানিকটা কপাল কুঁচকে ফেলল। অন্যদিকে লুসিয়া নিজেকে যথাসাধ্য চেষ্টা করে ত্বরিত স্বাভাবিক স্বরে জবাব দেয়,
“রোজ তো কনভেন্টে রয়েছে।”
—“রোজ আশ্রমে…আই মিন কনভেন্টে… কবে থেকে?”
—“এই যে তুমি চলে যাওয়ার কিছুদিন পরই, ও ওখানে চলে গিয়েছে। ফিরে আসবে, খুব তাড়াতাড়িই ফিরে আসবে।”
—“ও তো কিছু বছর আগেও গিয়েছিল না ওখানে?”
—“হ্যাঁ,টেম্পোরারি ভাউস হিসেবে…তবে ওই প্রসেসটা দীর্ঘ সময়ের ছিলো। এবার তো অল্প কিছুদিনের জন্য গিয়েছে।”
—“ওহ।”
আনায়া আর এই প্রসঙ্গটাকে বাড়াতে চাইল না। এই খ্রীষ্টধর্ম সম্পর্কে সে পুরোপুরি না হলেও কিছুটা জানে। গত কয়েক বছর আগেও রোজ টেম্পোরারি ভাউস… অর্থাৎ একটা নির্দিষ্ট সময়ের জন্য কনভেন্টে বা খ্রীষ্টধর্মীয় আশ্রমে থেকে ধর্মীয় নিয়ম মানার শপথ নিতে হয়।যেটা মূলত একপ্রকার অস্থায়ী সন্ন্যাসী হওয়ার মতো। কিন্তু সেটা চিরস্থায়ী নয়। আর রোজও প্রায় দুবছরের মতো কনভেন্টে ছিল। যার ফলে পুরো সময়টা তার সাথে কোনো যোগাযোগ ছিল না। কিন্তু সেই ঘটনা আর এবারের ঘটনার মাঝেও একটা ছোট্ট মিল হয়েছে। তখন আনায়া লুসিয়াস কাজের জন্য রাশিয়ার বাহিরে ছিল আর ফিরে এসে শোনে হঠাৎ রোজ কনভেন্টে যাওয়ার সিন্ধান্ত নিয়ে ওখানে চলে গিয়েছে । আর এবারও সে রাশিয়ার বাহিরে যেতে না যেতেই রোজ আবারও কনভেন্টে?

আনায়ার গভীর চিন্তাভাবনার মাঝেই আচমকা লুসিয়া আনায়াকে প্রশ্ন করে,
“শুনলাম, তোমার বোনকে নাকি পেয়েছো? ওর কি অবস্থা এখন?
আনায়া লুসিয়ার এহেন প্রশ্নে খানিকটা অপ্রস্তুত হলো। পরবর্তীতে মূহুর্তেই নিজেকে স্বাভাবিক করে বলল,
” আ…ভালো!ভালোই আছে ও।ডাক্তার বলেছে চিন্তার কোনো কারণ নেই।”
“কেনীথ আর তোমার মাঝে এখন সব ঠিকঠাক তো?
“আপনার তো সবাটাই জানার কথা৷ আশাকরি সব খবরই পেয়েছেন!”
আনায়ার সুক্ষ্ম অভিব্যক্তিতে লুসিয়া খানিকটা কপাল কুঁচকে ফেলল।
—“আমার মনে হয় তুমি আমায় অন্য কিছু বোঝাতে চাইছ।”
আনায়া খানিকটা রুক্ষ হেসে বলে,
“আপনি জ্ঞানী মানুষ, না বললেও সবটাই জানেন, সবটাই বোঝেন। সেই সাথে, আপনার লোকজনও তো যথেষ্ট রয়েছে। সময়মত সব খবরই তো পাবার কথা, আশাকরি তা পেয়েছেন!”
আনায়ার কথা শুনে লুসিয়া নিশ্চুপ হয়ে বসে থাকে। তার এহেন নির্লিপ্ত ভাবভঙ্গিতে আনায়া খানিকটা তাচ্ছিল্যের সাথে বাঁকা হাসে। কিছুক্ষণ সময় অতিবাহিত হবার পর আনায়া নিজেই বলতে লাগল,
“আপনার প্রাণ প্রিয় নাতীর সাথে আমার সম্পর্কটা কখনোই স্বাভাবিক ছিলনা, বাবুশকা। আর আশাকরি ভবিষ্যতেও কখনো স্বাভাবিক হবে না। কারণ এটা সম্ভব নয়, কিংবা আমি চাইনা এমন কিছু হোক।”

—“যদি এমনটাই হয়, তবে তুমি কেনো আমায় মিথ্যা বলে বিডিতে গেলে?”
—“মিথ্যে? কেমন মিথ্যে বাবুশকা?”
—“তুমি….”
লুসিয়ার কথা শেষ হবার পূর্বেই আবায়া তীক্ষ্ণ হেসে বলতে লাগল,
“যে আপনি সাত বছর আমার দেখভাল করলেন। অথচ একবারও আমার বোনের খোঁজ দিতে পারলেন না, এতো বড় মাফিয়া হয়েও…এতোসব পাওয়ার থাকার পরও। আপনি কি ভেবেছিলেন, আমি বুঝিনি যে গেইমটা আপনিও খেলছিলেন!”
—“কি বলতে চাইছো!”
—“এটাই যে, আমাকে বাধ্য হয়েই আপনার সাথেই গেইম খেলতে হয়েছে। আমি জানতাম,আপনি কোনো না কোনোভাবে আমার বোনের সম্পর্কে অনেক কিছুই জানেন।”

—“নাহ,আমি জানতাম না কিছু!”
—“মিথ্যে বলবেন না…”
—“আনায়া…!”
—“সরি বাবুশকা, কিন্তু আজ কিছু কঢ়া কথা না বললেই নয়। আপনি কিভাবে সোজাসাপ্টা মিথ্যে বলতে পারেন? যখন আপনি সবটা জানতেন!”
—“তোমার কাছে কোনো প্রমাণ রয়েছে? নাকি মনগড়া সব বলে যাচ্ছ?”
—“জ্বী অবশ্যই, এতোবছর পর এইসব কথা আমি নিশ্চিয় এমনি এমনি বলতে আসিনি।”
—“………….
—“আমার জীবনে আর যদি কেউ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ থেকে থাকে তবে সে হলো আমার বোন। ওর জন্য আমি সবটা করতে পারি৷”
—“আর কেনীথ?”
আনায়া লুসিয়ার কথায় খানিকটা থমকে যায়। একটু আগেই যে নারীটি এতো কঠোর অভ্যিব্যক্তি প্রদর্শন করছিল, সে কিনা কেনীথের প্রসঙ্গে মূহুর্তেই এতোটা নরম হয়ে পড়ছে! আনায়া এই বিষয়টা ঠিক বুঝে উঠতে পারল না। কারণ সে যা জেনে এসেছে তা তো…। আনায়ার ভাবনার মাঝে লুসিয়া আবারও বলল,
“এখনো চুপ করে রয়েছ কেনো ?কেনীথ তোমার কেউ না?”
—“নাহ, কেউ না। সে আমার জীবনের ধ্বং”স, ব্যতীত কিছু নয়।”
আনায়ার নির্লিপ্ত অভিব্যক্তিত্বে লুসিয়া যেন প্রচন্ড হতাশ হলো। আনায়া যেমন কিছু বলতে চেয়েও বলছে না,তেমনি লুসিয়াও। খানিকটা সময় অদ্ভুত চোখে আনায়ার দিকে তাকিয়ে থাকার পর দীর্ঘ শ্বাস ফেলল। এবং পরক্ষণেই ক্ষিপ্ত স্বরে বলে উঠল,

“তবে কেনো ওর জীবনে ফিরে গেলে?”
—“আমি মোটেও ওনার জীবনে ফিরিনি৷”
—“আনায়া! তুমি কি আমার সাথে মজা করতে এসেছ? আমি কিন্তু তোমার কথাবার্তায় বিরক্ত হচ্ছি।”
—“বিরক্তির জন্য দুঃখীত,কিন্তু আপনার বিরক্তির কারণটাও আমার ঠিক জানা নেই, বাবুশকা!”
দু’জনের তীক্ষ্ণ কথার সুক্ষ্ম লড়াইয়ের পর দুজনেই চুও হয়ে যায়। খানিকটা সময় পর লুসিয়া আনায়ার দিকে কঢ়া চোখে তাকিয়ে থাকার পর বলে উঠল,
“তবে চিরতরে সরে যাচ্ছো না কেনো ওর জীবন থেকে? ওর প্রতি এতো আ”ক্রোশ, এতো রাগ, ক্ষোভ থাকার পরও কেনো ওর মুখোমুখি হতে হলো তোমায়? সাতটা বছর মৃত হিসেবে ওর থেকে দূরে থাকার পর, পুনরায় এমন কি প্রয়োজন হলো যে ওর কাছেই ফিরতে হয়েছে তোমাকে।”
—“এরজন্য হয়তো দায়ী আপনি।”

-লুসিয়া চোখ গরম করে তাকাতেই আনায়া নির্লিপ্ত স্বরে বলতে লাগল,
“সবকিছুই স্বাভাবিকই থাকত, আমাকেও হয়তো তার মুখোমুখি হতে হতো না যদি আপনি আমাকে একটু সাহায্য করতেন৷ কিন্তু আপনি তা করেননি বরং আমার কাজেই বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়েছেন। আমাকে দিয়ে যা নয় তাই কাজ করিয়েছেন, আমিও নির্দ্বিধায় তা করেছি। জেনে হোক, না জেনে হোক, বহু পাপ আমিও করেছি। তাই এই নিয়ে আমার কোনো কথা বলার নেই।
কিন্তু আমি শুধু চেয়েছিলাম আমার বোনকে আপনি খুঁজে দিবেন। নয়তো আমিই খুঁজে নেবো, আপনি একটু সাহায্য করবেন। কিন্তু আপনি তা না করে আড়ালে আমার কাজেই বাঁধা হয়েছেন, সবজায়গায় আমার পেছনে লোক লাগিয়ে রেখেছেন যেন আমি কিছুই করতে না পারি৷ কি ঠিক বললাম তো?”
–;”………..

—“চুপ করে থেকে লাভ নেই বাবুশকা। আপনি আমাকে সাহায্য না করেই সবচেয়ে বড় ভুল করেছেন। আমার বোনকে খুঁজে পেলে আমি চলে যেতাম।সবার থেকে দূরে সরে যেতাম। সারাজীবন মৃ’ত হয়েই থাকতাম, কেউ জানত না আমাদের কথা; কেনীথও না! কিন্তু আপনার সাথে খেলতে গিয়েই যে আমি প্রয়োজনের চেয়ে বেশি রহস্যের সন্ধান পেয়েছি। হয়তো এমন কিছু যা আপনার জন্যই ক্ষ”তিকর।”
লুসিয়া খানিকটা তাচ্ছিল্যের সাথে বলে উঠল,
“তুমি আমার কিছুই করতে পারবে না, কিছুই না!”
—“আগেই বলছেন, আমি কিছু করতে পারব না।তা জানতে চাইবেন না, আমি কি পেয়েছি!”
—“জানিও না, জানতেও চাইনা। পারলে তুমি চলে যাও। যা ইচ্ছে তাই করো, কিন্তু আমাদের থেকে দূরে সরে যাও।”
আনায়া লুসিয়ার অস্থির হাভভাবে কপাল কুঁচকে ফেলল। লুসিয়ার আচরণ নিত্যন্তই অদ্ভুত ঠেকছে তার কাছে।
—“আপনি কি এমন কিছু বলতে চাইছেন যা আপনি বলতে পারছেন না? কেনো জানিনা আমার এমন… ”
আনায়ার কথা শেষ হবার পূর্বেই লুসিয়া ঠোঁট ভিজিয়ে তড়িঘড়ি করে বলে উঠল,
“আমি আর কি বলব? বলার মতো আর কিছু আছে আমার? অন্তত তোমাকে আমি বিশ্বাস করেছিলাম, আনায়া! কিন্তু… তুই সেই বিশ্বাসও রাখোনি।”

—“…………
—-“আমার ভুল হয়েছে যে তোমার মতো একটা ইউজলেসকে আমি কেনীথের জন্য যোগ্য ভেবেছিলাম। খাল কেটে আনা… কুমির পেলেছি এতোদিন।”
লুসিয়ার তিক্ত কথায় আনায়ার চোখমুখ শক্ত হলেও সে স্বাভাবিক রইল। এবং খানিকটা রুক্ষ হেসেই বলতে লাগল,
“তবে আপনি কি ভেবেছিলেন, এতোকিছু হওয়ার পরও আমি আপনার ঐ অমানুষ নাতীর সাথে সংসার করব?তেমন কিছু করার উপায় রেখেছে সে? কতগুলো জীবন ধ্বং’স করেছে…তার জন্য আমাকে সবকিছু হারাতে হয়েছে।”
—“শুধু তুমিই হারিয়েছো? ও কিছু হারায়নি? ওর জীবনটা খুব সুন্দর, তাই না আনায়া?”
—“………….
—“কি হলো, কথা বলছ না কেনো? শুধু নিজেদের কষ্ট, দুঃখ,অভিযোগের হিসেব করে যাচ্ছ, কখনো ওর কথা ভেবেছো? ওই ছেলেটার কি আছে? কিচ্ছু নেই ওর। সবকিছু থেকেও,আজ ওর কিছুই নেই। বর্তমানে ওর সবটা হলে তুমি! আমরা ওর কেউ না। আর ক’দিনই বা থাকব আমরা?”
—“……………
—“বিশ্বাস করো, যদি আমি জানতাম তুমিও ছলনা করছো,তবে আমি কখনই তোমাকে দেশে পাঠাতাম না। তোমাকে ওর ধারেকাছেও যেতে দিলাম না। প্রয়োজনে তোমার মৃ’ত পরিচয়কে সত্যি সত্যি জীবন্ত করে তুলতাম। আমি নিজেই তোমাকে শেষ করতাম৷”

আনায়া চোয়াল শক্ত করে চুপচাপ লুসিয়ার দিকে তাকিয়ে। অন্যদিকে লুসিয়া একের পর এক হিসহিসিয়ে কথা বলে যাচ্ছে। তার রাগ ওঠাটা অস্বাভাবিক নয়, কিন্তু কেনীথের প্রতি লুসিয়ার এতো টান, এতো চিন্তা আনায়াকে ভাবাচ্ছে। যদি লুসিয়া কেনীথের এতোই ভালো চায় তবে কেনো সে এতোদিন ধরে নানান সব চক্রান্ত সাজিয়েছে। নাকি সে যতটুকু জানতে পেরেছে তা শুধুই আংশিক। নাকি এর পেছনে আরো কোনো রহস্য লুকিয়ে আছে!
—“আপনি আমাকে খারাপ ভেবে সব দোষ দিতেই পারেন। আমি কিছুই মনে করব না৷ কিন্তু একটা চরম সত্য হলো, আজ আমার এই খারাপ হওয়ার পেছনে কোনো না কোনভাবে আপনিও দায়ী।

আপনিই আমাকে এতোটা কঠোর হতে শিখিয়েছেন। নয়তো আমি তো কখনোই এমন চিলাম না। আর আমার প্রতি আপনার এতো আ”ক্রোশের অন্যতম কারণ যদি হয়… কেনো আমি আজ কেনীথের পাশে নেই। তবে এটাকে অসম্ভব আপনিই করেছেন। হ্যাঁ, এটা সম্ভব হতো,… আমি হয়তো আর পাঁচটা মেয়ের মতো তার সংসার করে নিতাম। সব ভুলে বাকিটা জীবন তার হাতের পুতুল হয়ে থাকতাম। কিন্তু এমনটা তখনই হতো যদি আমি আগের আনায়া থাকতাম। তাকে আপনারা চাইলেই হাতের পুতুল বানিয়ে রাখতে পারতেন৷ কিন্তু এমনটা না করে, আপনিই আমাকে কঠোর বানিয়েছেন। আমার এই হাত দিয়ে শতশত দোষী কিংবা নির্দোষের জীবন নিয়েছেন। এখন তো চাইলেও আর আপনি আমায় ভাঙতে পারবেন না, বাবুশকা।”

—“বাহ! আসলেই, অসাধারণ কঠোর ব্যক্তিত্ব বানিয়েছো তুমি। সেই সাথে হয়েছ একটা নির্লজ্জ আর স্বার্থপর।”
আনায়া খানিকটা রুক্ষ হেসে বলল,”বাবুশকা!সম্পূর্ণ পৃথিবীটাই তো স্বার্থপর। অবশ্য, আপনিও বা কম কিসে।”
—“খবরদার! নিজের সাথে আমার তুলনা করবে না। ঐ যোগ্যতা তোমার নেই৷”
—“হ্যাঁ,তা তো অবশ্যই। আমি তো অত্যন্ত কাঁচা খেলোয়াড়, নতুন নতুন শিখছি মাত্র। অবশ্য তা আপনার কল্যাণেই। আসল খেলোয়াড় তো আপনিই,তাই না?”
লুসিয়া কঢ়া চাহিনে তাকাতেই আনায়া রুক্ষ হেসে নিরেট স্বরে বলতে লাগল,

“মাফ করবেন, কিন্তু আমার মনে হয় না যে আমি কিছু ভুল বলেছি। আপনি যে শুধু গত সাতবছর আমার উপর নজর রেখেছেন তা নয়, বরং আমি বিডিতে যাওয়ার পরও সর্বত্রে আপনি আমার উপর নজরদারি করেছেন। তাই বাধ্য হয়েই আপনার গুনধর নাতীর সাথে আমার অভিনয় করতে হয়েছে। দেখাতে হয়েছে, আমি তাকে সম্পূর্ণ রূপে মেনে নিতে চেয়েছি। কেননা,আমি যা যা করব, তাই তো আপনি জানবেন।আর আমি এটাও বুঝেছিলাম যে,আপনি আমায় কখনোই বিডিতে যেতে দিবেন না যদি আমি কেনীথের সাথে পুনোরায় সম্পর্কটা স্বাভাবিক না করি। তাই আমাকে এখানেও মিথ্যে বলতে হয়েছে। কারণ সবকিছুর উর্ধ্বে আমার উদ্দেশ্য একটাই ছিল তা হলো আমার বোনকে খুঁজে বের করা।আর আমি খুব ভালো করেই জানতাম, একমাত্র দেশে যেতে পারলেই আমি আমার বোনের খোঁজ পাব। …সবকিছুই সময়মত পাভেল ভাই আপনাকে জানিয়েছে, তাই না?… আরো কেউ রয়েছে, নাকি শুধু উনিই!”

আনায়ার শেষ কথায় লুসিয়ার মুখ ফেকাসে হয়ে যায়। আনায়া তা দেখে মুচকি হেসে বলে,
“নিজেকে এতোটাও চালাক ভাববেন না। সবটাই জানতাম আমি৷ পাভেল ভাই কিন্তু এক আজব মানুষ। সে যে শুধু আপনার পক্ষ নিয়ে কাজ করেছে তা নয়, বরং কেনীথ সহ আমার… প্রত্যেকরই সাহায্য করেছে। আবার এটা ভাবতে যাবেন না,সেও আপনার সাথে বিশ্বা”সঘাতকতা করল। মোটেও না, সে কখনোই আমাকে পরোক্ষভাবে সাহায্য করেনি। করলে হয়তো আমায় এতোকিছু পেঁচিয়ে নিজের কাজ করতে হতো না।
তবে এটুকু শিওর ছিলাম, শুরু থেকেই ঘটতে থাকা ছোট বড় সব কিছুই আপনি জানতেন, তার মাধ্যমে। আর সর্বপ্রথম সন্দেহটা জাগে কিছুমাস পূর্বেই, যখন পাভেল ভাই রাশিয়াতে আসে এবং বিডিতে কি হচ্ছে না হচ্ছে, কেনীথ কি করছে না করছে সবকিছু আপনাকে জানায়৷ ওদিকে পাভেল ভাই আমাকেও এখানে নানান ইনফরমেশন দিয়ে যেত। তখনই বুঝে গিয়েছিলাম , কাহিনি কি ঘটছে।

তবে একটা জিনিস কি জানেন, আমি এখনও বুঝতে পারিনি আপনার মূল উদ্দেশ্য কি। আমার এতোদিনের সন্ধানে যতটুকু জেনেছি তা মোটেও আপনার খেলা বোঝার জন্য যথেষ্ট নয়।”
লুসিয়া খানিকটা সময় আনায়ার দিকে একনাগাড়ে তাকিয়ে থাকার পর স্তব্ধ স্বরে বলে উঠল,
“কি জেনেছো তুমি?”
—“অনেক কিছুই। তবে আগে এটুকু বলুন যে পাভেল ভাইকে আপনি কোথায় পেয়েছিলেন?”
—“………….
—“না, আমি জানি সে কেনীথের ছোটবেলার সঙ্গী। বপনি কেনীথের জন্যই তাকে নিয়ে এসেছিলেন। কিন্তু আমার প্রশ্ন হলো, তার বাবা মা… পরিবার বলতে কেউ নেই?”
—“পাভেলের বাবা আমার বিশস্ত সার্ভেন্ট ছিল। এবং ওর বাবার মৃ”ত্যুর পর, আমি ওকে আমার কাছেই রাখার সিন্ধান্ত নেই।”
—“ওহ আচ্ছা, কিন্তু আমি তো জেনেছি আপনি তার বাবা মা সহ পুরো পরিবারকে শেষ করেছেন। হয়তো সেটা নিজের কর্মের স্বার্থেই কিংবা অন্যকিছু। তা এসব কি পাভেল ভাই জানে?”
—“কি যা তা বলছো, আমি কেনো ওর পরিবারকে…”
—“প্লিজ উত্তেজিত হবেন না, মূল আলোচনা তো কেবল শুরু। আপনার কাছ থেকে, আমার অনেক কিছু জানার রয়েছে। অনেক প্রশ্নের উত্তর চাই আমার।”

আনায়ার স্পষ্ট অভিব্যক্তিতে লুসিয়া ফেকাসে চাহনিতে তার দিকে তাকিয়ে রইল। ঠোঁট গুলো বারবার কেঁপে উঠছে, যে কিছু বলতে চেয়েও বলতে পারছেনা।এরই মাঝে আনায়া শীতল কন্ঠে বলতে শুরু করে,
“কেনীথের নানু কিংবা আপনার স্বামী আর্তেমের মৃ”ত্যুটা কি শুধুই বার্ধক্যজনিত অসুস্থতা ছিল, নাকি এর পেছনেও ভিন্ন কোনো কারণ রয়েছে,বাবুশকা! এছাড়া আমার সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হলো, ‘দ্য গ্রেভ মেকার’ খ্যাত আন্ডারগ্রাউন্ডের সবচেয়ে বড় মাফিয়া আর্তেম দিমিত্রি কিভাবে তার এতোবড় সাম্রাজ্যের সবকিছু তার স্ত্রী…যে কিনা নিজেও একজন বড়সড় মাফিয়া হওয়া সত্বেও… তাকে কিছুই না দিয়ে সম্পূর্ণ সম্পত্তি তার একমাত্র নাতী কেনীথকে দিয়ে যায়?
আমি এই প্রশ্নের উত্তর জানতে চাই বাবুশকা। এমন কি কারণ রয়েছে, যার জন্য তিনি তার পুরো রাজত্বেরের সমস্ত পাওয়ার, প্রোপার্টিস… এভরিথিং কেনীথের নামে দিয়ে গিয়েছেন। সেটাও কিনা পস্টহিউমাস ট্রান্সফার অব ওউনারশিপ এগ্রিমেন্টে।

যা উনি মা”রা যাবার অনেক বছর আগেই করেছেন, যখন কেনীথ নিজেও অনেক ছোট।তবে কেনীথ এখনও সেসবের ওউনার নয়। কেননা তিনি তার এগ্রিমেন্টে নিদিষ্ট করে সময়টাও উল্লেখ করে গিয়েছেন। আর্তেম দিমিত্রির সত্তর বছর অর্থাৎ আজ থেকে ঠিক আরো পাঁচ বছর পর কেনীথের জন্মদিনেই কেনীথ এসবকিছুর মালিক হবে।
আর সবচেয়ে ইন্টারেস্টিং ব্যাপার হলো,কেনীথ এসবের ওউনার হওয়ার পরও, যদি অন্যকাউকে নিজ হাতে এইসবকিছু হস্তান্তর না করে, তবে কারো সাধ্য নেই তার আগে বা পরে এই বিশাল সাম্রাজ্যর অধিকারী হবার। এবং এই পাঁচ বছরের মধ্যে যদি কোনো ভাবে কেনীথের কিছু হয় কিংবা সে যদি মা’রা যায়, তবে তার সাথে সাথে আর্তেম খ্যাত পুরো মাফিয়া সাম্রাজ্য ধ্বং”স হয়ে যাবে।
এখন নিশ্চয় আপনি এটা বলবেন না যে, এসবের কিছুই আপনি জানেন না।”
—“হ্যাঁ,সবটাই জানি আমি। কিন্তু তুমি এসব বলে কি বোঝাতে চাচ্ছো ?”
আনায়া খানিকটা মুচকি হেসে বলল,”অনেক কিছুই তো বললাম, আর কি বলা বা বোঝানো যায়, বলুন তো?”
—“……………

—“বাবুশকা! আমার মনে হয় আমার সন্দেহটা ভুল নয়। কেনীথ কিন্তু এসবের কিছুই জানত না এতোদিন। আর এই পুরো বিষয়টা সিক্রেট থাকার কথা ছিল। অথচ দেখুন আপনি কিংবা আমি দুজনেই এটা জানি । এর মানে এটা আর সিক্রেট নেই। কাহিনিতে কিন্তু অনেক গড়মিল রয়েছে। আমার ছোট্ট মাথায় ঢুকছে না, একটু বুঝিয়ে বলবেন প্লিজ?”
—“আমি তোমার সাথে আপতত আর কোনো কথা বলতে চাচ্ছি না। যাও গিয়ে রুমে রেস্ট করো।”
–“না না, এটা বললে তো হয় না। হাতে যে সময় কম। আমাকে জানতে হবে, ভোর হবার পূর্বেই সবটা জানতে হবে।
আচ্ছা, কেনীথের প্রতি আপনার এতো সচেতনতা, এতো চিন্তা, ভালোবাসা… এসবের একমাত্র কারণ আবার এটা নয়তো…আপনি এইসব প্রোপার্টি, পাওয়ার নিজের করতে চান। এছাড়া তো আর কোনো…”
—“আনায়া….! হাউ ডেয়ার ইউ…কোন সাহসে তুমি এসব…”

লুসিয়াস দাঁত খিঁচে বলা ক্ষি’প্ত কথাগুলো সম্পূর্ণ হবার আগেই আনায়া নির্লিপ্ত স্বরে বলে উঠল,
“সন্দেহ জিনিসটা ভালো না হলেও, বর্তমান পরিস্থিতিতে বিষয়টা মন্দও নয়। যাই হোক, আপনি যে সে মানুষ তো আর নন। হিসেব নিকেশ করেই তো আপনাদের জীবন। এমনও তো হতে পারে, আপনি আমাকে আর কেনীথকে এক করে… দুজনকেই নিজের হাতের পুতুল বানিয়ে ক্ষমতা আত্মসাৎ করতে চান।”
—“আনায়া লিমিট ক্রস করো না! একটু আগে তুমিই না বললে,তুমি তোমার বোনকে পেলে সবকিছু ছেড়ে দূরে চলে যাবে। তবে এখনও এখানে কি করছো? এখন তো তোমার রাস্তা খোলা, চলে যাবার হলে চলে যাও।”
—“জ্বী, অবশ্যই! আমি যাবো, খুব শীঘ্রই সব ছেড়ে চলে যাবো। কিন্তু তার আগে আমার কিছু কাজ না করলেই যে নয়। আমার বোনকে আমি স্বাভাবিক ভাবে পাইনি, ও নিজেই একটা সাইকোপ্যাথ হয়ে গিয়েছে। কিভাবে হয়েছে, কেনো হয়েছে, এর পেছনে আদোও কে কে রয়েছে, এছাড়া নবজাতক বাচ্চাদের নিয়ে অনৈতিক, নৃ”শংস কাজ করা এস.পি.হান্স কোম্পানি মূলত কার হয়ে কাজ করে সবটাই জানতে চাই আমি।”

রাতের এই নির্জন পরিস্থিতি আর বারান্দা থেকে ভেসে আসা শীতল বাতাস যেন এক রুদ্ধশ্বাস আবহ তৈরি করেছে। ঘরের পর্দাগুলো ঢেউ খেলে দুলে উঠছে। আর এমনই পরিস্থিতিতে আচমকা এক শব্দে দু’জনের কথোপকথনের মনযোগে ব্যঘাত ঘটায়। আনায়া কপাল কুঁচকে আশেপাশে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করে আওয়াজটা কোথায় থেকে এলো। সেই সাথে আকস্মিক দাড়িয়ে গিয়ে লুসিয়াস উদ্দেশ্যে বলে উঠল,
“আমরা ব্যতীত এখানে কি আরো কেউ… ”
আনায়ার কথা সম্পূর্ণ হলো না।হঠাৎ দরজার ঠক্ ঠক্ আওয়াজে তাদের নজর সরে যায় দরজার কাছে। কিন্তু আনায়ার মনে হলো আওয়াজ এসেছে বারান্দা থেকে। কিছু একটা নড়াচড়া কিংবা পড়ে যাওয়ার শব্দ ছিল। তবে মনোযোগ দরজার দিকে চলে যাওয়ায়, সে ঘটনা স্বাভাবিক মনে হলো। হয়তো বা বাতাসের কারণেই বারান্দায় কিছু পড়ে গিয়ে শব্দ হয়েছে। তবে কেনো যেন মনের মাঝে একটা খটকা থেকেই যাচ্ছে।
এরই মাঝে বাবুশকা বলে উঠল,

একজোড়া আগুন পাখি পর্ব ৩৮ (২)

“কে?”
বাহির থেকে কোনো প্রতিত্তোরে এলো না। আনায়া যেহেতু দাঁড়িয়েই ছিল তাই সে এগিয়ে দরজার কাছে যায়। কপালের ভাজগুলো এখনো দৃশ্যমান। আনায়া কোনোরকমের দ্বিধা না করে ত্বরিত দরজাটা খুলতেই, তার সামনে দৃশ্যমান হওয়া ব্যক্তিকে দেখে থমকে দাঁড়ায়। নিমিষেই চেহেরাটা ভাবমূর্তি পরিবর্তন হলো। যেন এই সময় মোটেও , এই ব্যক্ত্বিকে প্রত্যশা করেনি সে।

একজোড়া আগুন পাখি পর্ব ৩৮ (৪)