আযদাহা সিজন ২ পর্ব ৩৬
সাবিলা সাবি
ভেনাসের সকালটা আজ যেন অন্যরকম। স্টেলার একাডেমির ক্যাম্পাসজুড়ে হালকা রোদ ছড়িয়ে আছে, বাতাসে রয়েছে স্নিগ্ধতা।ক্যান্টিনের একদম কোনার টেবিলটায় চুপচাপ বসে আছে সিলভা আর তার চারপাশে তার বান্ধুবীরা থাকলেও মনে হচ্ছিল সে যেন একাই বসে আছে। সিলভার চোখের দৃষ্টিতে অন্যমনস্ক, আঙুল দিয়ে কাপে রাখা কফির মুখটা আনমনে ঘুরিয়ে চলেছে। সবার হাসির,কোলাহলের মাঝেও সিলভার মন আজ ভারাক্রান্ত।এথিরিয়নের সেই রাতের আচরণ বারবার ঝড় তুলছিলো তার ভেতরে। কীভাবে একজন এতটা নি*র্মম হতে পারে! নিজেকে প্রশ্ন করে যাচ্ছিল সে নিজেই ।আর শুধু এথিরিয়ন নয়,গতকাল যখন ফ্লোরাস প্রাসাদে ফিরেছিল,তখন অ্যালিসার করুণ অবস্থা দেখে তার মনে আরেকটা ভার জমিয়ে রেখেছে। একদিনের মধ্যেই অ্যালিসাকে এতটা ভেঙে পড়তে দেখবে, কখনও কল্পনাও করেনি। প্রচণ্ড জ্ব*র, মানবদেহের জ্বরের মতোই কাঁপুনি, আর চোখের দৃষ্টিতে ছিলো প্রচন্ড আতঙ্ক। অ্যালিসা কোনো কথাই বলছিলো না কাল থেকে। মনে হচ্ছিল, কোনো ভয়ঙ্কর দৃশ্য দেখে এতটাই শকড হয়ে গেছে যে পুরোপুরি নিস্তেজ হয়ে পড়েছে সে। রাজা জারেন প্রাসাদে ফেরার পর থেকে অ্যালিসার চিকিৎসা চলছে।
কফির কাপে অন্যমনস্কভাবে আঙুল চালাতে চালাতে সিলভা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। স্টেলার একাডেমির সকাল আজ তার জন্য কোনো স্নিগ্ধতা আনেনি —বরং এনেছে শুধু একরাশ অস্থিরতা।ক্যান্টিনের টেবিলে সিলভার বন্ধুরা ধীরে ধীরে একে একে উঠে পড়লো।ক্লাস শেষ, সবার এখন ছুটি।কিন্তু সিলভার জন্য আজ সেই ছুটি এলোনা। দুদিন আগেই রাজপ্রাসাদে বিয়ের অনুষ্ঠানের জন্য ছুটি নিয়েছিলো সে। ফলে আজকে তাকে স্পেশাল ট্রেনিং ক্লাসে অংশ নিতেই হবে, না হলে আসন্ন পরীক্ষায় ফেল করার ঝুঁকি রয়েছে তার জন্য।
সিলভার বন্ধুরা সিলভাকে বিদায় জানিয়ে চলে গেলো।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
সিলভা ক্যান্টিনের জানালা দিয়ে বাইরের আকাশের দিকে একবার তাকিয়ে দেখলো — মনে হচ্ছিল সেই আকাশও আজ তাকে নিঃসঙ্গতার আমন্ত্রণ জানাচ্ছে।নিঃশব্দে ক্যান্টিন ছেড়ে বেরিয়ে এল সে। ব্যাগটা কাঁধে ঝুলিয়ে ধীরে ধীরে স্টেলার একাডেমির ট্রেনিং রুমের দিকে পা বাড়ালো।হলওয়ে পেরিয়ে যখন সে ট্রেনিং রুমে পৌঁছালো, চারদিক যেন আরও নিস্তব্ধ হয়ে গেলো।ফাঁকা রুমের দরজাটা ধাক্কা দিতেই খুলে গেলো আর ভেতরে ঢুকলো সিলভা। দেয়ালের পাশে রাখা কাঠের তলোয়ারগুলো চকচক করছিলো কাঁচের ভেতর। প্রফেসরের কড়া নির্দেশ ছিলো — আজকের ট্রেনিং শেষ করতেই হবে।না হলে পরীক্ষায় নাম লেখানোর সুযোগও পাবে না।সিলভা একটু ইতস্তত করে মনে মনে,তারপর দৃঢ় মনে সে কাঁধের ব্যাগটা নামিয়ে রাখলো টেবিলের ওপর। কোমরে শক্ত করে বাঁধলো বেল্ট। তারপর নিজেই একাকী অনুশীলন করতে শুরু করলো, যেন নিজের কষ্ট, নিজের যন্ত্রণা কাটিয়ে উঠতে চায় এই তলোয়ারবলের ছন্দের ভেতর দিয়ে। কিন্তু সিলভা জানতো না, আজকের এই একাকীত্বের ভেতরেই লুকিয়ে আছে আরও বড় কোনো ঝড়ের পূর্বাভাস…
হঠাৎই সিলভা টের পেলো কেউ যেন তার দিকে তাকিয়ে আছে।পেছন ফিরতেই দেখলো — ট্রেনিং রুমের দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আছেন প্রফেসর। সিলভা একটু চমকে গেলো প্রথমে। এতক্ষণ তিনি চুপচাপ দাঁড়িয়ে তার প্রত্যেকটা মুভমেন্ট দেখছিলেন! সিলভা দ্রুত তলোয়ার নামিয়ে রাখলো, তারপর এক পা এগিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করলো,
“স্যার…বাকিরা কোথায়? সবাই কি আসেনি আজ?”
প্রফেসর ধীর পায়ে ভেতরে এসে বললেন, “বাকিরা তাদের ট্রেনিং আগেই শেষ করেছে। এই দুদিনের ক্লাসে সবাই তাদের প্রয়োজনীয় মাইলস্টোন পূরণ করেছে।” এটা বলেই একটু থামলেন, তার গলা কিছুটা নরম করে বললো, “শুধু তুমি বাকি রয়ে গেছো, সিলভা।”
সিলভা নীরবে মাথা নিচু করলো। বুঝতে পারছিলো, এই স্পেশাল ট্রেনিং এখন তার জন্য কতটা জরুরি। মন যেন আবার অস্থির হয়ে উঠলো — নিজের ব্যর্থতা, এথিরিয়নের জন্য জমে থাকা ক্ষোভ, আর ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তা সব মিলিয়ে হৃদয়টা ভারী হয়ে উঠলো মুহুর্তেই।কিন্তু এই মুহূর্তে কোনো দুর্বলতা দেখানোর সুযোগ ছিলো না। চোখের কোণে জমে থাকা আবেগ চেপে রেখে সিলভা শক্ত গলায় বললো,”আমি প্রস্তুত স্যার। ট্রেনিং শুরু করা যাক।”
প্রফেসর চোখের কোণে একঝলক প্রশংসার হাসি লুকিয়ে নিয়ে বললেন, “তোমার আজকের পরীক্ষা হবে ভিন্নরকম, সিলভা। নিজেকে প্রমাণ করতে হবে তোমাকে।”
কিছুক্ষণ পরেই সিলভাকে সামনে বসিয়ে প্রফেসর একটি ল্যাপটপ এগিয়ে দিলেন সিলভার দিকে। “প্রথমে আজকের ট্রেনিংয়ের মূল নোটগুলো লেখো। প্রতিটি ডিভাইসের ব্যবহার বুঝতে হবে তোমাকে আগে তারপরে পরে হাতে কলমে ট্রেনিং হবে,” গম্ভীর স্বরে বললেন তিনি। সিলভা মাথা নাড়লো। তারপর দ্রুত টাইপ করতে শুরু করলো: “ইলেক্ট্রিক শিল্ড -এটা হচ্ছে রক্ষণাত্মক প্রযুক্তি, আর টাইম স্লো মেকানিজম এটা প্রতিপক্ষের গতি কমানোর জন্য ব্যবহৃত হয়, এনিমি ট্র্যাকার – অদৃশ্য শত্রু সনাক্তকরণ…” টাইপ করতে করতে সিলভা চেষ্টা করছিলো মন থেকে সমস্ত ব্যথা আর অস্বস্তি দূরে সরিয়ে রাখতে।
ল্যাপটপে কাজ শেষ করে সিলভা যখন প্রথম যন্ত্রটির কাছে গেলো —সেটা ছিলো একটি ভারী ইলেক্ট্রিক শিল্ড, প্রফেসর তার পাশে এসে দাঁড়ালেন। তিনি প্রথমে স্বাভাবিক ভঙ্গিতে সিলভাকে বোঝাতে লাগলেন কীভাবে হাত রাখতে হবে, কীভাবে শক্তি নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। কিন্তু অল্প সময়ের মধ্যেই সিলভা খেয়াল করলো — প্রফেসরের হাতটা তার হাতের ওপর অকারণে একটু বেশিক্ষণ রাখছে।আঙুলগুলো অদ্ভুতভাবে তার হাতের পেছনে ঠেকছে। সিলভার শরীরে একটা অনাকাঙ্ক্ষিত স্নায়ুবিক সাড়া উঠলো —যা ছিলো অস্বস্তি!
সে সরতে চাইল, কিন্তু প্রফেসর এমন ভান করলেন যেন এই ছোঁয়া শুধু ট্রেনিংয়ের অংশ। পরের ডিভাইসটা ছিলো টাইম স্লো মেকানিজম। এবারে সিলভা অনুভব করলো প্রফেসর পিছন থেকে দাঁড়িয়ে তার কোমরের কাছেঅপ্রয়োজনীয়ভাবে হাত রাখছে, মেকানিজম বোঝানোর নাম করে। সিলভার ভ্রু কুঁচকে গেলো। মনের মধ্যে গুমগুম করে রাগ জমতে লাগলো। ষএটা আর নিছক প্রশিক্ষণ ছিল না — এখন পরিষ্কার অস্বস্তি হচ্ছিলো তার।
সিলভা এবার পুরোপুরি সচেতন হয়ে গেলো। সে প্রফেসরের দিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে একটু দূরে সরে গেলো, ভেতরে ভেতরে শক্ত হয়ে উঠলো —”স্যার, আমি নিজে নিজেই চেষ্টা করে দেখি,” — গলা শক্ত করে বললো সিলভা। প্রফেসর হালকা হেসে বললেন, “ভয় পাওয়ার কিছু নেই, সিলভা। আমি তো আছি তোমাকে সাহায্য করার জন্য।” কিন্তু সিলভার চোখ দুটো এই মুহূর্তে কঠিন হয়ে উঠলো — সন্দেহ আর ঘৃণায়।
সিলভা এবার মনে প্রাণে ঠিক করলো — আর এক মুহূর্তও সহ্য করবে না এসব। প্রফেসর যখন আবার একবার অকারণে তার বাহু স্পর্শ করলো,এবার সিলভা চেঁচিয়ে উঠতে গেলো — কিন্তু তার আগেই প্রফেসর দ্রুত ফিসফিস করে বললো, “শোনো… তোমার ভালোর জন্যই বলছি। তুমি তো নতুন এই ভার্সিটিতে, সেমিস্টারের মাঝপথে ভর্তি হয়েছো।এখনো অনেক ট্রেনিং, ক্লাস বাকি তোমার।” তার ঠান্ডা গলায় ভয় মিশে ছিলো। “পরীক্ষায় পাস করতে চাইলে আমাকে খুশি করো, সিলভা। আমি চাইলে তোমাকে খুব সহজে পাস করিয়ে দিতে পারবো…”
সিলভার ভেতরটা ছলছল করে উঠলো ঘৃণায় আর রাগে। সে আর এক মুহূর্তও না ভেবে তার হাতে থাকা নোটবুকটা ফেলে দিলো ছুড়ে তারপর প্রফেসরকে থাপ্পড় মারতে হাত উঠালো— কিন্তু ঠিক তখনই প্রফেসর তার কবজি চেপে ধরলো! তারপর সিলভাকে টেনে এনে দেয়ালের সাথে জোরে ঠেলে ধরলো।সিলভা ঘৃণায়, রাগে ছটফট করতে লাগলো।
প্রফেসরের নিঃশ্বাস ভয়ংকরভাবে তার গালের কাছে পড়ছিলো। “ভেবে দেখো, সিলভা,” — প্রফেসর চাপা স্বরে বললেন, “এখান থেকে বেরিয়ে যদি আমি বলি তুমি নিজেই আমাকে অফার করেছো এসব … তখন কে বিশ্বাস করবে তোমাকে?” সিলভার শরীর কাঁপছিলো রাগে আর ভয়ে। কিন্তু তার চোখের জ্বালা বলছিলো — সে হার মানবে না।
প্রফেসর সিলভার মুখের একদম কাছে ঝুঁকে পড়লো, হিং*স্র ভঙ্গিতে।তখনি সিলভা নিজের সমস্ত শক্তি দিয়ে চেঁচিয়ে উঠলো — “ছাড়ুন আমাকে!”
তার চিৎকার গোটা ট্রেনিং হলের নীরবতা চিরে ছড়িয়ে পড়লো দেয়ালে দেয়ালে। একজন স্টুডেন্ট পাশের ক্লাসরুম থেকে শব্দ শুনে ছুটে এল। তখনি প্রফেসর হঠাৎই নিজের ভঙ্গি পাল্টে ফেললো। সরে দাঁড়িয়ে গলা খাঁকারি দিলো, যেন কিছুই হয়নি এমনভাবে।
ঠিক তখন সেই স্টুডেন্টটা ক্লাসরুমে ঢুকতেই, প্রফেসর জোরে চেঁচিয়ে উঠলো, “সিলভা! তোমার এত বড় সাহস হলো কীভাবে? তুমি তোমার প্রফেসরকে এ রকম লজ্জাজনক অফার করলে?”
তার চেঁচানোর আওয়াজে পাশের আরও কয়েকজন স্টুডেন্ট ছুটে এলো। কেউ কেউ ডিভাইসে রেকর্ড করাও শুরু করলো। সবার চোখ বড় বড় হয়ে গেলো তারা হতবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো সিলভার দিকে,আবার সন্দেহের চোখে দেখলো প্রফেসরের নাটকীয় আচরণ।
প্রফেসর রাগে ফেটে পড়লো, “আমি যদি এখনই তোমাকে এখান থেকে বের করে না দেই, তাহলে তো শিক্ষকদের সম্মান বলে কিছু থাকবে না!” সিলভা ভেতরে ভেতরে কাঁপছিলো, কিন্তু তার চোখে জল আসেনি। সে জানতো, এখন চুপ করে থাকলে সত্যিটা কেউ জানবে না। তাকে লড়তেই হবে।
সবাই ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে কানাঘুষো শুরু করে দিলো এক প্রকার। কেউ ফিসফিস করে বললো, “এই মেয়েটাই হয়তো কিছু করেছে।” আবার কেউ বললো, “না না, ওই প্রফেসরের তো আগে থেকেই বদনাম আছে।” কানাঘুষোর শব্দে মাথা আরও ঘুরে উঠলো সিলভার। তার মন এমনিতেই ভেঙে পড়েছিল, আজ সে প্রতিবাদ করার শক্তি খুঁজে পাচ্ছিলো না। কষ্টে কাঁপতে কাঁপতে, দৌড়ে বেরিয়ে গেলো ট্রেনিং হল থেকে। হল ছেড়ে বেরিয়ে প্রায় অনেকটা দূরে চলে এসেছিলো।হঠাৎ সামনে থেকে আসা কারো সাথে সজোরে ধাক্কা খেলো, সিলভা কাঁপতে কাঁপতে মাথা তুললো —
তার চোখের সামনে এথিরিয়নের চওড়া বুক।শরীরটা স্বাভাবিকভাবে এগিয়ে ছিলো তার দিকে।সিলভার চোখে পানি চলে এলো। এতোক্ষণ ধরে আটকে রাখা জল যেনো চোখ ফেটে বেরিয়ে এলো ঝর্নার ধারার মতোই।ফুটফুটে মুখটা ভেঙে পড়লো এথিরিয়নের বুকে।এথিরিয়ন অবাক হয়ে তাকালো তারপর মুহুর্তেই দু’হাতে সিলভার বাহু ধরে নরম গলায় জিজ্ঞেস করলো, “সিলভা, কি হয়েছে? তুমি কাঁদছো কেন?” তার কণ্ঠে ছিলো অদ্ভুত এক উদ্বেগ আর কোমলতা। পেছনে তখনও ছোট ছোট দলে বিভক্ত স্টুডেন্টরা জমে গিয়েছে। কেউ বলছিলো, “শুনেছি সেই প্রফেসর আগেও একটা মেয়ের সাথে বাজে ব্যবহার করেছিলো।” আরেকজন বললো, “আসল দোষ তো ওই প্রফেসরেরই, নতুন স্টুডেন্টরা অনেক কিছু সহ্য করে চুপ থাকে।”
সব কথা এথিরিয়নের কানে আসলো।এথিরিয়ন দাঁড়িয়ে সবাইর কানাঘুষো শুনলো। ড্রাগনের সিক্সথ সেন্স যেন মুহূর্তেই তাকে পুরো পরিস্থিতি বুঝিয়ে দিলো।তার চোখের কোণ এক মুহূর্তে শীতল হয়ে গেলো।সে এক দৃষ্টিতে ভিড়ের দিকে তাকালো, যেন শিকারি তার শিকার চিহ্নিত করছে।
কিন্তু সিলভা তখন শুধুই ফুঁপিয়ে কাঁদছিলো।এথিরিয়ন ওর কাঁধে একটা হাত রাখলো, ফিসফিসিয়ে বললো,
” এখানেই থাকো, আমি আসছি এক্ষুনি ।”
সে সিলভাকে সেখানে রেখেই হনহন করে এগিয়ে গেলো। শক্ত পায়ে পুরো প্রাঙ্গণ পার হয়ে বড় টিচার্স হলরুমের সামনে এসে দাঁড়ালো।হলরুমের ভেতর তখন সেই প্রফেসর দাঁড়িয়ে, অন্য কয়েকজন টিচারের সাথে মিটিং করছিলেন। তিনি হাসতে হাসতে কিছু বলছিলেন, ঠিক তখনই — বিনা কোনো সতর্কতা ছাড়াই, এথিরিয়ন বজ্রগতিতে এগিয়ে গিয়ে এক ঘু*ষি কষিয়ে দিলো প্রফেসরের মুখে। প্রচণ্ড শব্দে প্রফেসর ছিটকে পড়ে গেলেন মাটিতে।
চারদিক স্তব্ধ!সবার চোখ বিস্ফোরিত!কিন্তু এথিরিয়ন থামলো না। সে প্রফেসরের কলার ধরে মাটিতে চেপে ধরে আবারও মারতে থাকলো।— “তুই একটা নোংরা লোক, তোর সাহস কি করে হয় আমার সিলভার গায়ে হাত দেয়ার!” এথিরিয়নের গর্জন যেন হলরুম কাঁপিয়ে দিলো। টিচাররা, গার্ডরা এগিয়ে এসে এথিরিয়নকে টেনে ধরলো।কিন্তু ততক্ষণে যেন ড্রাগনের রাগ তার শরীরে জেগে উঠেছে। কেউই তাকে ধরে রাখতে পারছিলো না।
আর এদিকে ভয় পেয়ে দৌড়ে এসেছিলো ততক্ষনে সিলভা।ভিড় ঠেলে ভিতরে ঢোকার চেষ্টা করছিলো।
কিন্তু ভিড় ছিলো ঘন।চোখের সামনে এথিরিয়নের এমন রূপ দেখে সিলভার চোখে জল চলে এলো। গার্ডরা চিৎকার করছিলো, “থামো! থামো বলছি!” কিন্তু এথিরিয়নের চোখে এখন শুধু প্রতিশোধের আগুন। শেষ ঘুষিটা পড়তেই প্রফেসর মুখ থুবড়ে পড়ে গেলো মেঝেতে। মুখে র*ক্ত, সারা শরীর নিস্তেজ।চারপাশে হাঁ করে তাকিয়ে থাকা লোকগুলোর মধ্যে চাপা গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়লো — “অজ্ঞান হয়ে গেছে…” “ম*রে গেল নাকি…?” অন্য আরো গার্ডরা আর দেরি না করে ছুটে এল। তারা সবাই মিলে এথিরিয়নের হাত চেপে ধরে টানতে লাগলো। কিন্তু এথিরিয়নের শরীর তখনও উত্তপ্ত আগ্নেয়গিরির মতো।দৃঢ় হাতে তাদের ধাক্কা দিতে চাইছিলো, তবে শেষমেশ এতো সংখ্যা লোকের কাছে হার মানলো।
গার্ডরা একজোট হয়ে অনেক কষ্টে এথিরিয়নকে টেনে নিয়ে গেলো দূরের এক করিডোরের দিকে। ষহলরুমের মেঝেতে তখন প্রফেসর নি*থর হয়ে পড়ে আছেন।
সিলভা সেই ভিড় ঠেলে ছুটে এল সামনে।চোখের জল আর থামছিলো না তার।সবকিছু যেন একটা দুঃস্বপ্নের মতো মনে হচ্ছিলো। হঠাৎ কোথা থেকে ভার্সিটির মেডিকেল টিম ছুটে এলো।তারা প্রফেসরকে উঠিয়ে স্ট্রেচারে করে নিয়ে গেলো ইমার্জেন্সি রুমের দিকে।
সিলভা স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলো।
ভিড়ের মধ্যেই একা, হতভম্ব, কাঁপতে থাকা হৃদয় নিয়ে।
আর ভেতরে ভেতরে একটা অনুভুতি —এথিরিয়ন তার জন্যই নিজের সর্বনাশ ডেকে এনেছে।
সকালটা ধীরে ধীরে গাঢ় হয়ে উঠলো। নরম আলোয় সারা ভেনাসের আকাশ যেন কুয়াশার চাদরে ঢেকে আছে।এল্ড্র রাজ্যর অতিথি কক্ষে লিউ ঝান আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে শেষবার নিজের ওভারকোটটা ঠিক করলো। একদম পরিপাটি হয়ে নিয়েছে।তার চোখেমুখে অদ্ভুত এক স্থিরতা। যেন অনেক কিছুর হিসেব সেরে ফেলেছে সে।
ব্রেকফাস্ট শেষ করেই রেডি হচ্ছিলো লিউ ঝান,কিছুক্ষণ বাদেই দরজায় ধীরপায়ে এসে দাঁড়ালো অ্যাকুয়ারা।হালকা নীলচে পোশাকে আজকে ওকে আরও স্নিগ্ধ লাগছিলো।“আপনি… কোথাও যাচ্ছেন নাকি?”অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো অ্যাকুয়ারা।
লিউ ঝান একটু হাসলো। “হ্যাঁ, পৃথিবীতে ফিরছি।”
এক মুহূর্তের জন্য যেন অ্যাকুয়ারার দম বন্ধ হয়ে এলো।
তার কণ্ঠ যেন আটকে গেল কিছুক্ষণের জন্য। “আর কিছুদিন থেকে যেতেন…” আবছা কণ্ঠে বলল সে।
লিউ ঝান চোখ সরিয়ে জানালার দিকে তাকালো।
তার দৃষ্টিতে ফিরে আসার ইচ্ছা নেই, শুধু একরাশ দায়িত্বের টান। “অন্যজনের প্রাসাদে আর কতদিন থাকবো বলো?আর এখন আমি সম্পুর্ন সুস্থ হয়ে গেছি, এখানে আমার আর কোনো কাজ নেই।পৃথিবীতে অনেক কাজ পড়ে আছে, অনেক দায়িত্ব আছে। সেগুলো আমাকে শেষ করতেই হবে।
ওটাই আমার স্থান… আমার কাজ… সবই ওখানে।”
অ্যাকুয়ারা একটু আমতা আমতা করতে লাগলো। ঠোঁট কাঁপলেও কথা বের হচ্ছিল না। তখনি লিউ ঝান হালকা গলায় বললো, “কিছু বলবে? বললে বলতে পারো, সমস্যা নেই। এই মুহূর্তটাই হয়তো শেষ সুযোগ…”
অ্যাকুয়ারা নিচু করে ফেললো মাথা। চোখের পাতা কাঁপছিল।সাহস সঞ্চয় করে আবার মুখ তুললো। “আমি জানি… আপনি এখন হার্ট ব্রোকেন। কিন্তু কারো জন্য কারো স্বপ্ন জীবনের পথ থেমে থাকে না, তাই না?নিজকে ভালোবাসতে হলে নিজেকে সুখী করতে হয়,নিজেকেই আরেকটা সুযোগ দিতে হয়।আপনিও দিন না…নিজেকে আরেকটা সুযোগ দিন…” অ্যাকুয়ারা এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে থেমে গেল। লিউ ঝান কিছুক্ষণ চুপ করে তাকিয়ে রইলো তার চোখে।
তার চোখে ছিল বিস্ময়, খানিকটা অনুধাবন, আবার যেন একরাশ কৌতূহল। লিউ ঝান ধীরে গলা নামিয়ে বললো,”কি বলতে চাইছো তুমি অ্যাকুয়ারা?”
অ্যাকুয়ারার গলাটা একটু কেঁপে উঠলো। এক ফোঁটা জল গাল বেয়ে নেমে এলো।“এই কদিন আপনার পাশে থাকতে থাকতে…কখন যে আপনাকে ভালো লেগে গেছে…আমি নিজেও জানি না। এই প্রথমবার… আমার কারো জন্য এমনটা অনুভব হলো।” লিউ ঝান স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো।তার চোখে ছিল একরাশ বিস্ময়,আর ঠোঁটের কোণায় যেন এক ঝলক দুঃখের ছায়া।
লিউ ঝান তখন বললো, “ভালো লাগা স্বাভাবিক ব্যাপার… আর এটা সাময়িক। আমি চলে যাবার পর, তুমি একসময় আমাকে ভুলে যাবে। এটা ক্ষণিকের ভালো লাগা, অ্যাকুয়ারা।”
অ্যাকুয়ারা তখন গভীরভাবে লিউ ঝানের চোখের দিকে তাকিয়ে বললো,”যদি বলি এটা শুধু ভালো লাগা না… ভালোবাসাও, তখন কি আপনি নিজেকে আর আমাকেও একটা সুযোগ দিবেন?” কিছু মুহূর্ত নিস্তব্ধতায় ডুবে থাকলো দুইজন।
লিউ ঝানের চোখের দৃষ্টি যেন কোথাও হারিয়ে গেছে।বাতাস ভারী হয়ে উঠেছে চারিপাশে,অ্যাকুয়ারা নিঃশ্বাস আটকে অপেক্ষা করছে।এক মুহূর্ত, দুই মুহূর্ত… তারপর লিউ ঝান ধীরে বললো—“ভালোবাসা… শব্দটা খুব শক্তিশালী।তুমি এখন আবেগে আছো অ্যাকুয়ারা,
আর আমি… আমি ঠিক সেই জায়গায় নেই।য়আমি জানি তুমি যা বললে,সেটা তোমার কাছে সত্য।কিন্তু আমি এখনো অন্য কাউকে হৃদয় থেকে ভোলেনি… সেই ক্ষ*ত এখনো শুকায়নি।তাই… যদি আমি এখন তোমাকে একটা সুযোগ দিই, তা হবে তোমার প্রতি অন্যায়।”
তার চোখে কষ্টের রেখা ফুটে উঠলো।“আমি জানি, তুমি অসাধারণ একজন মেয়ে। কিন্তু আমি যদি এখন ‘হ্যাঁ’ বলি, তবে সেটা হবে শুধু তোমার অনুভবের প্রতি সম্মান নয়, আমার ভাঙা হৃদয়কে জোড়ার একটি মরিয়া চেষ্টা মাত্র।”
অ্যাকুয়ারা চোখের জল মুছে ফেলে মাথা নিচু করে বললো— “আমি জানি, আপনি আজ না বলবেন।
কিন্তু আমি এটাও জানি, একটা ভালোবাসা ধীরে ধীরে গড়ে ওঠে।তাই আমি অপেক্ষা করবো… যদি একদিন মনে হয়,আমার কাছে ফিরে আসতে পারেন, তাহলে আমি থাকবো। ঠিক এখানেই আপনার অপেক্ষায়।”
লিউ ঝান কিছু না বলেই তাকিয়ে রইলো অ্যাকুয়ারার দিকে।লিউ পুনরায় ঝান কিছুক্ষণ স্তব্ধ থাকলো। ঘরের বাতাসটা হঠাৎ যেন থেমে গেলো। তার চোখে ভেসে উঠলো ফিওনার মুখ—সেই হাসি, সেই চাহনি, আর সেই বিদায়বেলার মুহুর্ত।
তার কণ্ঠ স্তরিত, কিন্তু স্পষ্ট।”আমি… ফিওনাকে আজও ভুলতে পারছিনা,অ্যাকুয়ারা।আর সত্যি বলতে, হয়তো কোনোদিন ভুলতেও পারবো না।সে আমার হৃদয়ের এমন এক অংশ জুড়ে আছে, যেটা কখনো অন্য কারো জন্য খালি হতে পারবেনা।” সে নিঃশ্বাস টেনে বললো,”তোমাকে সুযোগ দেওয়া মানে হবে, তোমার প্রতি অন্যায় করা…কারণ আমি জানি, আমার হৃদয়ে কেউ আগে থেকেই বসবাস করছে। আমি শুধু একজন সঙ্গী চাই না, আমি চাই একান্ত একজন, যাকে আমি ভালোবাসবো… আর সেই জায়গাটা বর্তমানে ফিওনার জন্যই।”
অ্যাকুয়ারা তখন চোখের কোণে এক ফোঁটা জল নিয়ে বললো, “আমি কোনোদিন চাইও না আপনি ফিওনাকে ভুলে যান। কারণ এটা আজকের নয়,এটা শত বছরের ভালোবাসা…যেটা আমি হলে আমিও ভুলতে পারতাম না। আমি আপনার হৃদয়ে বসবাস করতে চাই না লিউ ঝান,চাই না সেখানে আমার জন্য কোনো জায়গা হোক।
আমি শুধু চাই—আপনার পাশে থাকতে, আপনার হাত ধরে,একসাথে পথ চলার সামান্য একটা সুযোগ। আপনাকে আমি নিজের মতো করে ভালো রাখতে চাই…এটাই শুধু আমার চাওয়া।” লিউ ঝান কিছুক্ষণ চুপ থেকে ধীরে ধীরে বললো, “অ্যাকুয়ারা… তুমি সত্যিই আলাদা সবার থেকে ।তোমার অনুভবটা খুব গভীর… খুব সত্য।তবে আমাকে একটু সময় দাও। আমার মন এখনো সেই পুরোনো আঁধারে আবদ্ধ।যদি কোনোদিন আমার মন নিজে থেকে তোমার দিকে ফিরে আসে,আমি নিজেই তোমার সামনে এসে দাঁড়াবো।
কিন্তু এই মুহূর্তে—আমাকে বিদায় দাও।” লিউ ঝানের চোখে ছিল ম্লান বিষাদের ছায়া,আর অ্যাকুয়ারার চোখে ঝলমল করছিলো নিঃশব্দ ভালোবাসার আলো।
লিউ ঝান তখন চুপচাপ রুম থেকে বেরিয়ে গেলো। পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা অ্যাকুয়ারা শুধু নিঃশব্দে ওর যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকলো।সিরি বেয়ে নিচে নামতেই সে দেখতে পেলো, ড্রাকোনিস প্রাসাদের সামনের চত্বরে সবাই জড়ো হয়ে আছে। ড্রাকোনিসের সামনে এগিয়ে এসে লিউ ঝান বিদায় নিতে চাইলো। আর তখনি ড্রাকোনিস বললেন “আর কিছুদিন থাকলে ভালো হতোনা, লিউ ঝান। এতো তাড়াতাড়ি পৃথিবীর যাওয়ার কি দরকার, আর কিছুদিন থেকে যাও।”
লিউ ঝান হালকা মাথা নেড়ে বললো, “আপনাদের আতিথেয়তার জন্য আমি কৃতজ্ঞ আঙ্কেল।তবে পৃথিবীতে আমার অনেক কাজ জমে আছে।ফিরতেই হবে।”
ঠিক তখনই ফিওনা এগিয়ে এলো। চোখে একরাশ আবেগ আর ঠোঁটে মৃদু হাসি। সে বললো,”সাবধানে যেও আর আবার ও এসো, লিউ ঝান।তোমার জন্য এল্ড্র প্রাসাদের দরজা সবসময় খোলা থাকবে।”
বন্ধুত্বের খাতিরে লিউ ঝান ওর কাঁধে হাত রাখতে চাইল ঠিক তখনই জ্যাসপার হঠাৎ কোথা থেকে এসে ফিওনার কাঁধে হাত রেখে নিজের দিকে টেনে নিলো। ষচোখে আগুন, কণ্ঠে বিদ্রূপ—”এই এই, পাতি সেনাপতি ও সরি… ডক্টর লিউ ঝান, তোর হাতটা একটু সংযত রাখ।”
লিউ ঝান হালকা বিরক্ত নিয়ে বললো, “রিল্যাক্স জ্যাসপার! ইট ওয়াজ জাস্ট আ ফ্রেন্ডলি জেসচার.”
কিন্তু জ্যাসপার থেমে থাকলো না। সে আরেক ধাপ এগিয়ে এসে বললো, “তুই এতো তাড়াতাড়ি চলে যাচ্ছিস কেনো? আমার আর ফিওনার বিয়ে, বাসর এসব কিছু তোর আর সহ্য হচ্ছে না তাইনা?” তখন লিউ ঝান ঠান্ডা গলায় বলে উঠলো, “সাচ আ চাইল্ডিশ বিহেভিয়ার, গ্ৰো আপ ম্যান.”
জ্যাসপার তখন ঠোঁট বাঁকিয়ে বললো, “এটা কে চাইল্ডিশ বলেনা, এটাকে বলে পজেসিভনেস, আমি আমার বউয়ের প্রতি পজেসিভ।” লিউ ঝান হালকা হেসে জবাব দিলো, “পজেসিভ নয়, ওভার-পজেসিভ।তোর লিমিট জানা উচিত।”
তখনই দুজনের চোখে চোখ পড়ে, চারপাশটা যেন হঠাৎ থেমে যায়। উত্তেজনার ছায়া জমে ওঠে দুই ড্রাগনের মধ্যে।
ফিওনা বিরক্ত হয়ে হঠাৎ বললো, “এনাফ! কি শুরু করলে তোমরা!” বলেই সবার সামনে থেকে ঘুরে সোজা চলে যায় ভিতরের দিকে। জ্যাসপার ও চুপ করে থাকতে পারলো না, ওর পেছন পেছন ছুটে গেলো। “হামিংবার্ড!…” ফিওনা কিছু বললো না,কেবল দূরে সরে গেলো। জ্যাসপার ওর নাম ধরে ডেকেই যাচ্ছিলো। পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা ড্রাকোনিস সব কিছু নীরবে দেখলেন। তারপর মনেই মনে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “এই নারী জাতি… ড্রাগনের মতো প্রাণীদেরও মাথা খারাপ করে ফেলতে পারে।”
লিউ ঝান তখন চারপাশটা একবার চোখ বুলিয়ে নিলো। ড্রাকোনিস প্রাসাদের সেই বিশাল চত্বরেই বসে ছিলো রাজদরবারের স্তব্ধতা, আর দূরে পাহাড় ছোঁয়া আকাশটা—সব যেন একসাথে বিদায় জানাতে লাগলো লিউ ঝানকে। সে একবার দীর্ঘশ্বাস ফেললো। তারপর ধীর পায়ে বেরিয়ে গেলো প্রাসাদের বাইরে। ঠিক তখনই থারিনিয়াস সামনে এসে দাঁড়ালো। “চলো তোমাকে পাহাড় পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে আসি।লিউ ঝান! নরম গলায় বললো থারিনিয়াস। “এল্ড্র রাজ্যর অতিথি তুমি তোমাকে তো আর একা যেতে দিতে পারি না,আমি তোমার সঙ্গে যাবো,যতদূর পারি এগিয়ে দেবো।”
লিউ ঝান থারিনিয়াসের দিকে তাকিয়ে হালকা হাসলো।”ধন্যবাদ, থারিনিয়াস।” তারপর দুজনেই একসাথে হাঁটতে শুরু করলো ড্রাকোনিস প্রাসাদ থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পথে। পেছনে পড়ে রইলো রূপকথার মতো এক আনন্দ আর অপর দিকে বিষাদের অধ্যায়।
দুপুরের রোদটা তখন কিছুটা ঝিমিয়ে পড়েছে। প্রাসাদের পেছনের বাগানে হালকা বাতাস বইছে। সেই বাগানের এক কোণায় বহুদিন বন্ধ থাকা একটা স্টোররুম আছে—আজকে গার্ডদের নির্দেশে পরিষ্কার করা হচ্ছিলো সেই রুম।
একজন গার্ড দরজাটা খুলে ভিতরে ঢুকতেই হঠাৎই তীব্র চিৎকার করে উঠলো। “লা*শ! এখানে একটা লা*শ আছে!”
চিৎকার শুনে মুহূর্তেই আশেপাশের গার্ড, কাজের লোকজন, এমনকি প্রসাদের সবাই ছুটে এলো। প্রাসাদজুড়ে মুহূর্তে ছড়িয়ে পড়লো আতঙ্ক। স্টোররুমের ভেতরে পড়ে থাকা শরীরটা এতটাই বিকৃ*ত, মুখটা পুরো চিনে ফেলার উপায় নেই।কারও গলা ছেঁড়া চি*ৎকার, কারও বিস্ময়—সব মিলিয়ে এক অস্থির পরিস্থিতি সৃষ্টি হলো।
ড্রাকোনিস আর জ্যাসপার এসে দৃশ্যটা দেখলো। সঙ্গে সঙ্গে আদেশ দিলেন ড্রাকোনিস ,”লা*শটা ল্যাবে পাঠাও। পরিচয় নিশ্চিত করতে হবে, এল্ড্র রাজ্যর প্রাসাদে এমন মৃ*ত্যু তাও পরিচয়হীন।” তখন দূরে এক কোনে দাঁড়িয়ে ছিলো ফিওনা। তার মুখে আতঙ্ক, চোখে ভয়। সে যেন নিজে দেখতে চাইছে, অথচ পারছেও না। ড্রাকোনিস জ্যাসপারকে ইশারা করলো।”ওকে ভেতরে নিয়ে যাও। ও এসব সহ্য করতে পারবে না।”
জ্যাসপার এগিয়ে গিয়ে ফিওনার কাঁধে হাত রাখলো।
“চলো, হামিংবার্ড। তোমার এখানে থাকা উচিত হবেনা।”
ফিওনা তবুও চোখ সরাতে পারছিলো না লা*শের দিক থেকে। কিন্তু জ্যাসপার ধীরে ধীরে তাকে ভেতরে নিয়ে গেলো।চারপাশে তখনো কানাঘুষা,ভয়,আর একটা অজানা আতঙ্ক—এই লা***শ কার?
স্টেলার একাডেমির প্রধান প্রশাসনিক ভবনে আজ এক অস্বাভাবিক ভিড়। শিক্ষার্থীদের কানে কানে কথা, চোখে অবিশ্বাস—এথিরিয়ন! সেই ড্রাগন কিং ড্রাকোনিস আর ড্রাগন প্রিন্স জ্যাসপারের ভাই, যাকে সবাই শ্রদ্ধা করে আর তার ভাইকেই আজ সাসপেন্ড করা হলো!
প্রিন্সিপাল রুমে বসে আছেন একাডেমির চেয়ারম্যান আর অন্যান্য উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা। এথিরিয়নকে সামনে বসানো হয়েছে—এথিরিয়নের চোখে আগুন, কিন্তু মুখে একফোঁটা অনুশোচনা নেই। প্রধান অধ্যক্ষ কঠোর কণ্ঠে বললেন,”স্টেলার একাডেমি কোনো হিং**স্রতা সহ্য করে না, প্রফেসরের ওপর প্রকাশ্যে আক্রমণ—এটা একাডেমির মর্যাদার বিরুদ্ধে।আমরা বাধ্য হয়েছি তোমাকে সাময়িকভাবে সাসপেন্ড করতে, এথিরিয়ন।”
কেউ কেউ ফিসফিস করছিল—”কিন্তু সে তো সিলভার জন্য করেছে…” “প্রফেসরের তো ইতিহাস ভালো না…”
তবে কেউ কিছু বলার সাহস পেল না।এথিরিয়ন উঠে দাঁড়ালো, সামনের সবার দিকে তাকিয়ে বললো,
“আপনারা চাইলে আজীবনেরজন্য আমাকে বহিষ্কার করতে পারেন, কিন্তু যেখানে কোনো নারীর সম্মান বিপন্ন, সেখানে আমি থামবো না। আমি একজন ড্রাগন, আর ড্রাগনের ন্যায়বিচারের চোখ আগুনে পোড়ে, ভয়ে না।” তারপর সে ফিরে দাঁড়িয়ে বেরিয়ে গেলো।পুরো স্টেলার একাডেমি যেন থমকে গেছে।করিডোর, বারান্দা, ক্লাসরুম—সবখানে শুধু একটা নাম, একটাই মুখ—এথিরিয়ন।
প্রিন্সিপালের রুম থেকে বেরিয়ে এলো সে। মাথা উঁচু করে, চোখে তীক্ষ্ণ আগুন,পায়ে দৃঢ়তা। এমন হাঁটার ভঙ্গি যেন সে কাউকে কিছু প্রমাণ করতে আসেনি—তবে নিজের সম্মান ধরে রাখতে পেরেছে, সেটাই গর্বের মতো বহন করে যাচ্ছে।
একাডেমির প্রতিটি মেয়ের দৃষ্টি আটকে যায় তার চলনে। কেউ বিস্ময়ে তাকিয়ে,কেউ শ্রদ্ধায়, কেউবা নিঃশব্দ আকর্ষণে। এই ভিড়ের মধ্যেই ছিলো সিলভা। নিঃশব্দে, কাঁপা চোখে তাকিয়ে ছিলো এথিরিয়নের দিকে। তখনই এথিরিয়ন তার সামনে এসে দাঁড়ালো। এক মুহূর্ত—দু’জনে একে অপরের চোখে তাকালো।সিলভার চোখে ছিলো অনুশোচনা, অপরাধবোধ আর একরাশ কৃতজ্ঞতা।এথিরিয়নের চোখে কিছুই বলা ছিলো না, কিন্তু অদ্ভুতভাবে সিলভা সব বুঝে গেলো।তারপর, কোনো কথা না বলে, এথিরিয়ন সরে গেলো। ধীরে ধীরে একাডেমির মূল ফটক দিয়ে বেরিয়ে গেলো সে।ছেলে স্টুডেন্টরা থমথমে, শিক্ষকরা নিশ্চুপ। কেউ বাধা দিলো না, কারণ সবাই জানে—এই দিন, এই প্রস্থান, স্টেলার একাডেমির ইতিহাসে লেখা থাকবে।
আযদাহা সিজন ২ পর্ব ৩৫
কিন্তু সিলভার কানে যেন একটাই কথা বারবার ঘুরে ফিরে আসছিলো—”তোর সাহস কী করে হয় আমার সিলভার গায়ে হাত দেওয়ার?”এখন, আজকের এই প্রস্থান মুহূর্তে, সেই কথাটা যেন বো*মার মতো বিস্ফোরিত হচ্ছিল সিলভার মস্তিষ্কে। ওর চোখে পানি চলে এলো— সেদিন এথিরিয়ন ওর সাথে এতোটা জোরজবরদস্তি করলো আর আজকে ওকে অন্য কেউ ছুঁয়েছে বলে তাকে এভাবে মা*রলো আবার সাসপেন্ড হয়ে গেলো।