আযদাহা সিজন ২ পর্ব ৩৭
সাবিলা সাবি
আজকের ভেনাসের বিকেলটা ছিলো শান্ত, নিস্তব্ধ।এক নক্ষত্রের শক্তি ব্যবহার করে গঠিত হয়েছিল ভেনাসের এল্ড্র ল্যাবরেটরিটা। এল্ড্র প্রাসাদের ঠিক নিচতলায় নির্মিত গোপন সেই ল্যাবে নিঃশব্দে কাজ চলছিলো আজকের দিনটায়।স্টেইনলেস কন্টেইনারে থাকা বি’কৃত মৃ’তদেহটিকে ধরে রাখা হয়েছে বায়ো-প্লাজমা টেবিলের উপর। প্যালেস্ট হোলো স্ক্রিনে ভেসে উঠেছে একের পর এক জিনের অনুক্রম “ডিএনএ ম্যাট্রিক্স প্রক্রিয়া শুরু হচ্ছে..” ল্যাবের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা “LYNX-03” স্বয়ংক্রিয়ভাবে তথ্য বলে উঠলো।
একেকটি কোড,একেকটি সিকুয়েন্স খুলে যাচ্ছে ধীরে ধীরে।তথ্য ভেঙে যাচ্ছে ফ্র্যাকশনাল মলিকিউলে। হঠাৎ করেই স্ক্রিনে একটি হোলো ইমেজ ফুটে উঠলো— “সাবজেক্ট আইডেন্টিফায়েড—”আলাইরা”
ড্রাকোনিস স্তব্ধ হয়ে গেলো।থারিনিয়াস, আলবিরা, জ্যাসপার আর এথিরিয়ন সবাই চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে। তাদের মুখে কোনো শব্দ নেই। ‘আলাইরা’ যে গতকাল থেকে নিখোঁজ হয়েছিলো।ফিওনা আর জ্যাসপারের ওয়েডিং এর সমস্ত ডেকোরেশন একাই করেছিলো।আর সেই এতো বছরের পুরনো ওয়ডিং প্ল্যানারের আজ এমন নৃ*শংস মৃ*ত্যু ঘটে গেলো কি করে। হঠাৎ এল্ড্র প্রাসাদের গুদামে তার দেহ কিভাবে এলো? আর কেই বা মারলো তাকে?
“LYNX-03” ডিভাইস পুনরায় বলে উঠলো “ডেথ টাইম ইস্টিমেটেড: ৪৮ ঘণ্টা পূর্বে।” উপস্থিত সবাই একসাথে চমকে ওঠলো। দুদিন আগে মা*রা গেছে সে? তাহলে এতোক্ষণেও কেউ কেনো টের পেলোনা?”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
ড্রাকোনিস গভীরভাবে বললেন, “এই হ”ত্যা দেখে মনে হচ্ছে কেবল ব্যক্তিগত প্রতিহিংসা থেকে নয়, এটা রাজ্যকে টার্গেট করে দেওয়া কোনো আগাম বার্তা মনে হচ্ছে।”হোলো স্ক্রিনের পাশের আলোরররেখাটা খানিকটা কেপে উঠলো, যেন কোনো অদৃশ্য লুকিয়ে থাকা চোখ দেখ যাচ্ছে সবকিছুই। এল্ড্র প্রাসাদে কোনো আসন্ন বিপদের ছায়া যেন নেমে আসছে ধীরে ধীরে…
এথিরিয়নের মনে ভার্সিটির ঘটনাটা ঘূর্ণি তুলছে মস্তিষ্কে ঠিকই, কিন্তু এখন তা বলার সময় নয়। আলাইরার মৃ**ত্যু, রাজ্যের সবার মধ্যে ক্রমশ বেড়ে ওঠা উদ্বেগ,সব মিলিয়ে এল্ড্র প্রাসাদের পরিবেশটায় এখন টানটান উত্তেজনায় ভরা।
এদিকে ফ্লোরাস রাজ্যে—রাজা জারেন হেটে চলেছেন চুপচাপ দরবার হলের করিডোর পেরিয়ে তার পাশেই হাঁটছেন লিয়ারা। দুজনের চোখেই গভীর উদ্বেগ বিদ্যমান। “মেয়েটা একেবারেই চুপ করে গেছে, ভাই…” লিয়ারার কন্ঠ কাঁপছে।
রাজা জারেন খানিকটা থেমে বললেন “আলা*ইরার মৃত্যুর খবরটা শুনলাম কিন্তু অ্যালিসার আচরণ কেমন অদ্ভুত লাগছে না তোমার?” লিয়ারা চুপচাপ মাথা নাড়ালো শুধু।
ঘরের দরজা খুলতেই দেখা গেল অ্যালিসা বিছানায় বসে আছে চুপচাপ, একদৃষ্টিতে জানালার বাইরে তাকিয়ে।
কোনো কথা নেই ঠোটে। চোখে একফোঁটা পানিও নেই।
এক ধরণের নিঃশব্দ আতঙ্ক তার চারপাশে ঘনিয়ে আছে।
রাজা জারেন ফিসফিস করে বললেন “এভাবে থাকলে আমাদের ওকে নিয়ে দেবতা আভ্রাহারের কাছে যেতে হতে পারে।” লিয়ারা বললো “না ভাই, এখন ওকে এখান থেকে সরানো ঠিক হবে না। আমি দেখছি বিষয়টা,ও যেন কিছু মনে করতে চাইছে,কিন্তু পারছে না।” বাহিরে তখনো বয়ে চলেছে অদ্ভুত নিস্তব্ধতা।
সিলভা ভার্সিটি থেকে ফিরে নিজের কক্ষেই বসে আছে।
হাতে ধরা ল্যাপটপ কিন্তু ল্যাপটপের স্ক্রিন অফ। দৃষ্টি স্থির হয়ে আছে একটা বিন্দুর দিকে। “জীবনটা এত জটিল হয়ে গেলো কেনো?” নিজের মনেই বলল সে।
জীবনটা তো সহজ ছিলো। সেদিনগুলোতে, যখন সে শুধু দূর থেকে এথিরিয়নকে দেখতো।একতরফা ভালোবাসা ছিলো বটে, কিন্তু শান্তিও ছিলো। কোনো প্রত্যাশা ছিল না, দুঃখও ছিল না।
এখন…এথিরিয়ন আর সেই আগের মতো নেই।
তার চোখে আগুন। তার চারপাশে উন্মাদনা। আর সিলভার মাঝে জন্ম নিচ্ছে এক অদ্ভুত অপরাধবোধ—“আমি কি ভুল করলাম তবে?”
হঠাৎ করেই মনে পড়ে গেলো আজ ক্যাম্পাসের দৃশ্যটা।
এথিরিয়ন কিভাবে প্রফেসরকে মারলো? আর যার কারনে এথিরিয়নকে বহিস্কার হতে হলো।” তোর সাহস কি করে হয় আমার সিলভার গায়ে হাত দেয়ার?”এই বাক্যটা বারবার তার কানে বাজতে লাগলো। সিলভার ঠোঁট কেঁপে উঠলো।
এক ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়লো গাল বেয়ে। সে জানে না এখন কার জন্য কাঁদছে— নিজের জন্য, নাকি এথিরিয়নের জন্য?
ভেনাসের কৃত্রিম চাঁদের আলো জানালার কাঁচ ছুঁয়ে পড়েছে সাদা মার্বেল মেঝেতে। ফিওনা একাই বেলকনিতে দাঁড়িয়ে আছে, চোখ মেলে তাকিয়ে আছে দূরের আকাশে। স্নিগ্ধ ঠাণ্ডা হাওয়া তার বাদামী চুলগুলোকে বারবার উড়িয়ে নিচ্ছে মুখের সামনে। সে সরায় না। যেন কিছু অনুভব হচ্ছেইনা। হঠাৎ কক্ষের দরজা খুলে যায়। জ্যাসপার নিঃশব্দে ভেতরে প্রবেশ করে।প্রথমে দূর থেকে দেখেলো, ফিওনার ছোট্ট কাঁধগুলো বাতাসে কাঁপছে কিনা বোঝা যাচ্ছে না,কিন্তু ওর নিস্তব্ধতা অসম্ভব ভারী দেখাচ্ছে। জ্যাসপার এগিয়ে যায় বেলকনিতে। ফিওনার একদম পাশে গিয়ে দাঁড়ায়।
ফিওনা কারো উপস্থিতি টের পেয়ে হালকা কেঁপে ওঠে, কিন্তু পেছনে ফিরে তাকায় না।
জ্যাসপার গলা পরিষ্কার করে বলে ওঠে, “ফিওনা… আমি জানতে চাই.. রিসিপশনের রাতে আসলে কী ঘটেছিলো? আমার কেনো কিছু মনে পড়ছে না?”
এক মুহূর্ত নীরবতা নেমে এলো। জ্যাসপার পুনরায় প্রশ্ন করলো “আর আলাইরাকে কে মেরেছে?”
ফিওনা এবার ধীরে ধীরে পেছনে ফিরে তাকায়। চোখে পানি নেই, কণ্ঠে কোনো কম্পন নেই। শুধু এক নিঃশ্বাসে সরাসরি উত্তর দিয়ে দিলো “আমি… আমি মেরেছি ওকে।”
জ্যাসপার পেছনে সরে যায় এক ধাপ। চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে থাকে ফিওনার দিকে। তার ভেতরটা যেন হঠাৎ করে জমে বরফের ন্যায় গেলো। মাথায় তখন ভেসে উঠছে সেই দৃশ্য— সেদিন রাতের র*ক্তমাখা ফিওনা… রহস্যময়ী দৃষ্টি…
আর আজকের আলাইরার নি*থর দেহ… “তুমি… তুমি কী বলছো ফিওনা?” জ্যাসপার ফিসফিস করে বললো।
“তুমি বলছো তুমি…?” জ্যাসপার থেমে গেলো।
ফিওনা চোখ নামিয়ে বললো, “হ্যাঁ, আমিই মেরেছি ওকে । তুমি সেদিন চেতনা হারানোর ঠিক পরেই…”
জ্যাসপার হঠাৎ থেমে গেলো তার চোখ ফাঁকা হয়ে গেলো।
সে বোঝার চেষ্টা করলো, এই মেয়েটা, যে তার হৃদয়ে একমাত্র জায়গা করে নেয়া কোমল নাজুক অথচ সে কী সত্যিই কাউকে খু*ন করতে পারে? “কিন্তু কেনো?” জ্যাসপার শুধায়, গলা খানিকটা রূদ্ধ। “আলাইরা এমন কি করেছিলো সেদিন রাতে?”
ফিওনা তখন সবটা বলতে শুরু করলো জ্যাসপারকে আর নিজেও ডুবে গেলো সেই রাতের বী*ভৎস স্মৃতিতে.
[ফ্ল্যাশব্যাক]………
প্রাসাদের হলঘর আলোয় ঝলমল করছিলো। ফুলের সৌরভ, আতিথেয়তা, আর রয়েছে এক অভিজাত উৎসবমুখর পরিবেশ। ফিওনা তখন ছিলো প্রাসাদের চেঞ্জিং রুমে, গাউন পাল্টাচ্ছিলো রিশিপসনের দ্বিতীয় সেশনের জন্য। অন্যদিকে, আলাইরা নিজের হাতে পরিবেশন করছিলো এক ধরনের বিশেষ ডেজার্টস, যার সঙ্গে মিশিয়ে রেখেছিলো এক অদ্ভুত রঙহীন, গন্ধহীন কেমিক্যাল।
একটার পর একটা অতিথি যেন হালকা নিস্তেজ হতে শুরু করে। জ্যাসপার কেবল একটু জুস খেয়েছিলো
তাই সে পুরোপুরি অচেতন হয়নি, কেবল ভারী অনুভব করছিলো শরীরটা। এই সুযোগটাই নিয়েছিলো আলাইরা।
সে জ্যাসপারকে একা পেয়ে কক্ষে নিয়ে যায়।
ধীরে ধীরে তার মুখের ওপর ঝুঁকে পড়ে,
জ্যাসপারের গাল ছোঁয়, তার ঠোঁটের খুব কাছে মুখ এনে ফিসফিস করে কিছু বলতে যায়…
তারপর হাত বাড়িয়ে পোশাক খুলতে যাবে…
ঠিক তখনই— “প্রিন্স!”
কক্ষের দরজা খোলা হয় সজোরে।ফিওনা ঢুকে পড়ে।
ওর চোখে আগুন জ্বলতে শুরু করে সামনে থাকা দৃশ্যে দেখে। হাতে ওর চেঞ্জিং রুমের পোশাকের টুকরো ঝুলছে।ফিওনা দৃশ্যটা দেখে থমকে যায় এক মুহূর্ত, তারপর চোখে অন্ধকার নেমে আসে। “তুমি… তুমি এটা কী করছো?” ফিওনার কণ্ঠে কাঁপন নেই, শুধু আগুনের দাবানল।
আলাইরা পেছনে ঘুরে তাকায়,কিন্তু ফিওনা কোনো কথা শোনেনি তখন। সে এগিয়ে গিয়ে টেনে সরিয়ে দেয় আলাইরাকে জ্যাসপারের উপর থেকে।
আলাইরির হাত চেপে ধরে জোরে টেনে নিয়ে যাচ্ছে ফিওনা। ফিওনা আলাইরাকে টেনে এল্ড্র প্রাসাদের একটি গোপন স্টোর রুমে পৌঁছায়। রুমে পৌঁছাতেই ফিওনা আলাইরিকে দেয়ালের পাশে ধাক্কা মেরে দাঁড় করিয়ে দেয়।
আলাইরা ছটফট করে উঠে, নিজের হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করে, মুখ কাঁপছে “তুমি যা দেখেছো, ফিওনা, সেটা ভুল! আসলে ব্যাপারটা—”
ফিওনা ঠান্ডা অথচ জ্বলন্ত কন্ঠে বলে “একদম চুপ। ডাইনি একটা।তোর সাহস তো কম না ! আমার প্রিন্সের দিকে চোখ তুলে তাকিয়েছিস? ছুঁতে গিয়েছিলে? সেই ভুলটাই করেছিস যেটার জন্য তোকে চরম মূল্য দিতে হবে।”
আলাইরির চোখ বড় হয়ে যায়—ভয়ে, লজ্জায় আর অপমানে। আলাইরা কাঁপা কাঁপা গলায় বলে “তুমি জানো না আমি কেন এমনটা করতে গিয়েছিলাম… আমি—”
ফিওনা দাঁতে দাঁত চেপে বলে “জানি না, আর জানতেও চাই না। আমার চোখের সামনে কেউ আমার প্রিন্সকে ছোঁয়ার চেষ্টা করলে, সেটা আমি মাফ করবো না।”
পরপরই ফিওনা এক ধাক্কায় আলাইরাকে একটা লোহার চেয়ারে বসিয়ে দেয়।তারপর চোখের পলকে ব্লু-মেটালিকের শক্ত বেল্ট দিয়ে চেয়ারের সাথে বেঁধে ফেলে।মেটালিক শেকল, যা কেবলমাত্র এল্ড্র প্রাসাদের রাজতন্ত্রের অভ্যন্তরীণ টেকনোলজি দ্বারা তৈরি, এমন এক প্রযুক্তি যা সাধারণ ড্রাগন তো দূরের কথা, অভিজাতদের ও ভাঙতে কষ্টসাধ্য হয়ে পড়বে। চারদিক অন্ধকার। শুধু মাঝখানে এক নিঃশব্দ আলো ছড়িয়ে আছে। আর সেই আলোর নিচে দাঁড়িয়ে আছে ফিওনা চোখে দানবীয় আগুন নিয়ে। আলাইরা ছটফট করতে থাকে “তুমি পাগল হয়ে গেছো? আমার সাথে এটা করতে পারো না তুমি!”
ফিওনার গলা বরফের মতো ঠাণ্ডা হয়ে আসে “তুই তো আগুন নিয়ে খেলতে চেয়েছিলি, তাই না আলাইরা? এখন সেই আগুনেই পোড়বি তুই নিজেই।”
আলাইরার চোখ ক্রমশ লালচে হতে শুরু করলো। তার শরীর কাঁপছে অনবরত। সে গর্জে ওঠলো “আমি সম্পুর্ন ড্রাগন! এই শৃঙ্খল ভেঙে ফেলবো আমি, তোমার চোখের সামনেই আমি বাঁধন মুক্ত হয়ে রূপ বদলাব!” আকাশে বাজ পড়ার মতো শব্দ হলো। আলাইরার চোখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠলো ,ডানার মতো কিছু গজাতে শুরু করে তার পিঠ থেকে। কিন্তু… হঠাৎ সব থেমে যায়। একটা ধাতব শব্দ হয়, একটা ধোঁয়া উঠে—আর কিছু না। ফিওনা ঠাণ্ডা গলায় বললো “তোর ভেতরের ড্রাগনকে আমি আটকে ফেলেছি।তোকে জানিয়ে দেই এই শেকলের ভিতরে একটা ব্লাড-সেন্সর আছে এটা তোর র*ক্তে থাকা ড্রাগন-জিন শনাক্ত করেছে,আর যতবার তুই রূপ বদলানোর চেষ্টা করবি, ততবার তোর শরীর ধ্বং*সের এক ধাপ কাছে চলে যাবে।” আলাইরা হঠাৎ প্রচণ্ড কাশি দিতে দিতে দিতে রক্ত থু’কে ফেলে। সে কাঁদতে কাঁদতে বলে— “তুমি তো অর্ধ মানবী পুরোপুরি ড্রাগন নও তাহলে এতো ক্ষমতা এতো জ্ঞান কিভাবে তোমার?”
ফিওনা তার মুখের সামনে ঝুঁকে ফিসফিস করে বলে— “আমি সেই মেয়ে, পৃথিবীতে যার জন্ম, যাকে কেউ কখনো, কোনদিন ভয় পেত না… কিন্তু এখন আমি সেই আগুন, যা পুরো ভেনাস ছারখার করে দিতে পারবে।”
আলাইরা নিঃশব্দে কাঁদতে লাগলো আর শ্বাস কেঁপে কেঁপে ওঠছে বারংবার। তার হাত-পা এখন ও ব্লু-মেটালিক শেকলে বাঁধা, ঠোঁট ফেটে রক্ত পড়ছে, গালে স্পষ্ট দাগ। এইতো কিছুক্ষণ আগেই ফিওনা কয়েকটি কষিয়ে কষিয়ে থাপ্পর মেরেছে। ফিওনা এখন দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে, কাঁধে একটা ধাতব ব্যাগ, সে কিছু ‘বিশেষ জিনিস’ আনতে বাইরে যাচ্ছে, যেন শাস্তি আরো গভীরভাবে দিতে পারে।
ফিওনা বেরিয়ে যাওয়ার পর, স্টোররুমে ছড়িয়ে পড়ে বিষাদ নিস্তব্ধতা। কিন্তু ওইদিকে, প্রাসাদের অন্যপ্রান্তে অ্যালিসা তখন দুশ্চিন্তায় পায়চারি করছে করিডোরে “আলাইরা কি কাজটা ঠিকমতো করতে পারলো?” সে একে একে সবার কক্ষ খুঁজতে থাকলো, শেষে আসে জ্যাসপারের কক্ষে।
ভেতরে গিয়ে দেখলো জ্যাসপার অচেতন হয়ে শুয়ে আছে।চোখ বন্ধ, শরীর নিস্তেজ, ত্বক হালকা ফ্যাকাসে।
“প্রিন্স!” অ্যালিসা ছুটে যায় তার কাছে। জ্যাসপারের সামনে বসে তার কপালে হাত রেখে ছুঁয়ে দেখলো জ্বরের মতো উষ্ণ হয়ে আছে শরীর। অ্যালিসা আর কিছু না ভেবেই ছুটে যায় করিডোর দিয়ে, আলাইরাকে খুঁজতে কিন্তু হঠাৎ করেই এমন সময় অনেকটা কাছ থেকে একটা আর্তনাদ ভেসে আসে—
“বাঁচাও! কেউ আছো? আমাকে বের করো এখান থেকে !” আলাইরার কণ্ঠ! অ্যালিসা আন্দাজ করতে পারলো কোথা থেকে শব্দটা আসছে, সে ছুটে গেলো সেই স্টোররুমের কাছে। দরজার ফাঁক গলিয়ে দেখলো, ভিতরে বাঁধা অবস্থায় আলাইরা। “ও মাই গড! কে করলো আলাইরার এই অবস্থা?”
অ্যালিসা ছুটে যায় আলাইরার কাছে তাকে বাঁধন মুক্ত করতে। ঠিক তখনই… পেছন থেক কে যেন তার হাত মুচড়ে ধরে।সাথে চুলের মুঠি টেনে পিছনে টেনে নিয়ে আসে। ফিওনা। চোখ লাল, মুখে প্রতিহিংসার শীতল আগুন জ্বলছে। “তুইও… ওর সাথেই আছিস তাইনা?” ফিওনার কন্ঠ শীতল ধারালো। অ্যালিসা চিৎকার করতে চাইলো, কিন্তু ফিওনা তার আগেই অ্যালিসার হাতদুটো শক্ত করে পেছনে বেঁধে ফেললো, তারপর ঠেলে দেয় দেয়ালের দিকে। “পার্টনার হিসেবে তাহলে তুইও দেখ! এবার আমি আলাইরার সঙ্গে ঠিক কী কী করি!”
এক ধাক্কায় অ্যালিসা গিয়ে পড়ে মেঝেতে, ফিওনার চোখে তখন আর ম*নুষত্ব নেই— সেখানে আছে কেবল আগুন আর প্রতিশোধের আগুন।
আলাইরা কাঁদছে অনবরত। শরীর কাঁপছে, মুখের পাশে শুকিয়ে যাওয়া র*ক্তের দাগ। কিন্তু ফিওনার মুখে কোনো দয়া নেই। সে এবার ধীরে ধীরে ব্যাগ থেকে বের করে একটি যন্ত্র—হেডফোনের মতো, তবে মাথার দুপাশে তীক্ষ্ণ সূচের মতো অংশ।কালচে ধূসর রঙের। আর মাঝখানে লেখা অদ্ভুত ভিনগ্রহের সিম্বল “NeuralBreaker”
“এই চোখ দিয়ে… তুই আমার প্রিন্সের দিকে তাকিয়েছিলি?”
বলতে বলতে ফিওনা ধীরে ধীরে যন্ত্রটা আলাইরার মাথায় বসিয়ে দেয়। আলাইরার কাঁধে,ঘাড়ে ঘাম জমে আছে। সে হাউমাউ করে কাঁদতে থাকে, মাথা নাড়াতে থাকে। “না! প্লিজ… প্লিজ… আমি ওনার সাথে কিছু করতে চাইনি কখনোই !… তবে সে তো একজন প্রিন্স… তার প্রতি আকর্ষণ কাজ করা তো ভুল নয়” ফিওনার চোখে বিদ্যুৎ জ্বলে ওঠে মুহূর্তেই।
সে যন্ত্রটির রিমোট হাতে নেয়, একবার তাকায় আলাইরার চোখে। “তোর এই চোখেই তো ছিল লোভ, আকাঙ্ক্ষা… এখন দেখ—কীভাবে আমি সে চোখ উপড়ে ফেলি।”
“না—!” একটা চিৎকার দিয়ে উঠে আলাইরা
“শুভ রাত্রি, আলাইরা।” এটা বলেই ফিওনা চিকচিক করে ওঠে রিমোটের বাটন প্রেস করে।
ফট্ একটা বিকট শব্দে শক ছুটে যায় যন্ত্র থেকে আলাইরার মস্তিষ্কে।সে চিৎকার দিয়ে উঠে গলা ফেটে যাওয়ার উপক্রম।
আলাইরার চোখজোড়া কাঁপতে কাঁপতে, হঠাৎ… ছিঁড়ে বেরিয়ে আসে কোটর থেকে । র*ক্তে ভেসে যায় তার মুখ। চোখের কোটর দুটো শূন্য হয়ে যায় মুহূর্তেই গা-শিউরানোর মতোই দেখতে লাগছে এই মুহূর্তে খালি কোটর। রক্তের কিছু ছিটে গিয়ে লাগে ফিওনার মুখে গলায়,ঠোঁটে। সে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে, র*ক্তমাখা মুখেই ঠাণ্ডা হাসি নিয়ে।
পেছন থেকে আরেকটা চিৎকার “না-আ-আ-আ!!!”
অ্যালিসা কেঁপে কেঁপে চিৎকার করে ওঠে। তার গলা কাঁপছে, চোখে ভয়ের ছায়া। সে বুঝতে পারলো মুহূর্তে—ফিওনা আর সেই মিষ্টি মেয়ে নেই।
আলাইরার দুই চোখ উপড়ে বেরিয়ে গেছে। গলা দিয়ে আর শব্দ বেরোয় না, শুধু শ্বাস নিতে চাচ্ছে একটু আর ছটফট করছে।অ্যালিসা এক কোণে পড়ে কাঁপছে অনবরত, তার হাতদুটো বাঁধা, চোখ অর্ধেক বন্ধ, মুখে আতঙ্ক জমে আছে।
ফিওনা এবার ব্যাগ থেকে বের করে এক ছোট্ট কাঁচের শিশি—রঙটা গাঢ় সবুজ, কিন্তু ঢেউ খেলানো। তীব্র গন্ধে ঘরটা ভারী হয়ে যায়। সে শিশিটা হাতে নিয়ে সামনে দাঁড়ায়। আলাইরার ফোঁটা ফোঁটা র*ক্তমাখা মুখের কাছে গিয়ে ফিসফিস করে বলে— “তুই ভাবছিলি এই মুখ দেখিয়ে, এই রূপ দেখিয়ে… আমার প্রিন্সকে আমার থেকে কেড়ে নিবি এতো সহজ?“আজ দেখ, রূপ দিয়ে প্রেমের প্রতিযোগিতা খেলতে গেলে শেষটা কেমন হয়।” এক মুহূর্তে শিশির ঢাকনা খুলে ফিওনা আঙুলের ছোঁয়ায় ক্যামিকেলটা ছুড়ে দেয় আলাইরার মুখের দিকে। এক বিকট সিঁসিঁয়ে শব্দ হয়।
আলাইরার ত্বক গলে যেতে থাকে, ঠোঁট আর গলার মাংস চিবিয়ে ফেলে ক্যামিকেলের আগ্রাসী দাহনে। কুৎসিত পোড়া গন্ধে ভরে ওঠে ঘর। আলাইরা মাথা নাড়তে থাকে, চিৎকার করতে চায়… কিন্তু ফিওনা সঙ্গে সঙ্গে তার মুখে শক্ত করে একটা র*ক্তাভ কসেটেপ লাগিয়ে দেয়। আলাইরা চুপ হয়ে যায় তবে শুধু ভেতরে গুমরে ওঠা, ছটফটানো রয়ে যায়।
অ্যালিসা ভয়ে সিঁটিয়ে পড়ে। তার চোখের সামনে যা হচ্ছে, তাতে তার শরীর জমে গেছে। হাত বাধা, গলা শুকিয়ে এসেছে। চোখে ঝাঁপসা দেখতে পাচ্ছে।
চেতনা হারিয়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে।
ফিওনা এবার তার দিকে ঘুরে তাকায় “তুইও দেখলি তো? এখন তুইও বুঝবি, আমি কেমন হয়ে উঠতে পারি আমার প্রিন্সের জন্য…” অ্যালিসার ঠোঁট থরথর করছে, কিছু বলতে পারছে না,চোখের দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে গেছে ।
অ্যালিসা ধীরে ধীরে পুনরায় চেতনা ফিরে পাচ্ছে। চোখ এখনো ঝাপসা, মাথাটা ভনভন করে ঘুরছে। হাত দুটো শক্ত করে বাঁধা, নড়ার উপায় নেই।
হঠাৎ—ফিওনা এগিয়ে আসে তার কাছে,দম্ভে ভরা হাঁটার মতোই তার চলন। সে এক হাতে অ্যালিসার চুল মুঠো করে ধরে টেনে তোলে মুখটা নিজের মুখের সামনে— “তুই… তুই আমার বোন বলে বেঁচে গেছিস।”
চোখে কুয়াশা জমলেও অ্যালিসা ফিওনার ওই শীতল দৃষ্টিতে ভয় পায়, যেটা আগুনে তৈরি, অথচ বরফের মতো নিস্তব্ধ।
“তুই ভাবিস আমি বুঝিনি? তুই অনেক আগেই থেকে এসব নোংরা প্ল্যান করছিলি।” একটা সপাট চড় ফিওনার হাত থেকে পড়ে অ্যালিসার গালে। “তুই চুপিচুপি আলাইরার সাথে হাত মেলালি, আমার প্রিন্সকে ওর দিকে ঠেলে দিতে চাইলি—ভাবলি আমি আমি ছেড়ে দিবো?”
ফিওনার কণ্ঠস্বর এবার গম্ভীর, কিন্তু তীক্ষ্ণ “এবার চোখের সামনে দেখে নে, অ্যালিসা। তোর ষড়যন্ত্র কেমন পরিণতি পাচ্ছে।ভবিষ্যতে, আমার প্রিন্সকে নিয়ে কোনো চাল দেওয়ার আগে এই দিনটা মনে রাখবি… আগুনে পোড়া মুখ আর ঝলসে যাওয়া চোখের সেই চিৎকার, এই গন্ধ, এই র*ক্ত। তুই ভাবতেও পারবি না,আমি কতদূর যেতে পারি।”
অ্যালিসা চুপ। কথা হারিয়ে গেছে তার। শুধু কাঁপছে… চোখে জল, অথচ কান্নার ও সাহসটুকু পর্যন্ত পাচ্ছেনা।
ফিওনা একটা ধাক্কা দিয়ে তাকে আবার মাটিতে ফেলে দেয়।তার পায়ের নিচে অ্যালিসা আর তার পেছনে, ছটফটানো, ক্ষতবিক্ষত আলাইরা। ফিওনার চোখে এখনো সেই চূড়ান্ত রাগ, গভীর অন্ধকার—যেটা শুধু ভালোবাসার নামে জন্মায়, কিন্তু ধ্বংসের রূপ ধরে।
স্টোর রুমের বাতি নিভে আছে। কেবল জানালার ফাঁক দিয়ে ঢোকা কৃত্রিম চাঁদের আলো ফিওনার মুখে আছড়ে পড়ছে। সে নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে আছে পাথরের মতো স্থির হয়ে। তার চোখে নেই কোনো শোক, নেই কোনো দয়া। কেবল একটা শীতল সিদ্ধান্ত। আলাইরা শুয়ে হলে পড়ে ছিলো লোহার চেয়ারটায়। প্রত্যেকটা আঘাতের চাপে হাঁপাচ্ছে। ফিওনা এখন তার শরীর একবারেই দুর্বল, ঠোঁটে তৃষ্ণা, কিন্তু ভয়টাই সবচেয়ে বড় আতঙ্ক ছড়িয়ে আছে।
“ফিওনা… আমাকে ছেড়ে দাও প্লিজ আমাকে ক্ষমা করে দাও আমি আর কখনো এই রাজ্যেতে আসবোনা…” আলাইরার কণ্ঠে কম্পন। ফিওনা তার ডান হাতে থাকা যন্ত্রটা সামনে তুললো।ধাতব সেই মেশিনটার মুখ জ্বলজ্বল করে ওঠলো লাল আলোয়।এটা সেই মেশিন, যেটা দেয়ালে ফুটো করে, ধাতু গলিয়ে দেয় আর এটা আসলে একটা ‘পিন-পয়েন্ট পার্সিং বোরার’।
“তুই ভুল করেছিস বড় ভুল আলাইরা যার কোনো ক্ষমা নেই,” ফিওনার ঠোঁটে হালকা হাসি খেলে যায়। “আমি যদি রাতে সময় মতো না আসতাম, তুই আমার প্রিন্সকে পুরোপুরি ছুঁয়ে ফেলতি।”
ফিওনা হাঁটু গেড়ে বসলো অ্যালিসার সামনে। ধীরে ধীরে আলাইরার কাঁপা হাত ধরে মেশিনটা রাখে তার তালুর উপরে। চোখের পলকে সুইচ টিপে দেয়।
টটটটট করে এক ভয়ানক শব্দে ধোঁয়া বেরিয়ে আসে হাত থেকে। হাড় গলতে শুরু করে। আলাইরা চিৎকার করে ওঠে, দম বন্ধ হয়ে আসে। “থামো… প্লিজ… আমি মরতে চাই আমি আর যন্ত্রনা চাইনা আমাকে মুক্তি দাও…”
ফিওনা মাথা নেড়ে বলে, “এতো তাড়াতাড়ি না । এখনও বাকি আছে অনেক কিছু” সে মেশিনটা তুলে এবার আলাইরার গালে রাখে। চাপ দেয়। শিশশশ… গালের এক প্রান্ত এ ঢুকে আরেক প্রান্ত দিয়ে বেরিয়ে যায় মেশিন।আলাইরার চিৎকার ঘরের দেয়াল কাঁপিয়ে দেয়, তারপর সেটা থেমে যায় হঠাৎ—জিভ আর নড়তে পারে না আলাইরার। শেষবারের মতো ফিওনা তার কানের পাশে মেশিনটা ধরে, আর কানের ভেতরে সেটি চালু করে দেয়।এক মুহূর্ত, দুই মুহূর্ত… তারপর নিস্তব্ধতা।
আলাইরার নিথর দেহটা মেঝেতে পড়ে যায় চেয়ার সহ।
ফিওনা দাঁড়িয়ে আছে নিস্তব্ধতায়। মেশিনটা বন্ধ করে রাখলো, এবার সে কোমরের পাশ থেকে একটা সরু পাতলা ছু*রি বের করলো, ছুড়িটা ড্রাগন গবেষণাগারের এক পরীক্ষামূলক অস্ত্র ছিলো,যা গরম হলে যেকোনো মাংস ছিঁড়*যে এক বিন্দু সময় লাগেনা।পাতলা, তীক্ষ্ণ খুব ভয়ংকর ছুড়িটা। ইতোমধ্যেই আলাইরার মৃ*ত্যু ঘটে গেছে, ফিওনা তখন শীতল কন্ঠে বললো “তোর দুঃসাহস খুব বেশিই ছিলো আলাইরা,আর আমি দেখতে চাই তোর সেই কলিজাটা যেটাতে এতো বেশি দুঃসাহস জমে ছিলো, আজকে আমি দেখেই ছাড়বো তোর কলিজা কত বড় ছিলো।”
ফিওনা মুহুর্তেই ঝুঁকে পড়ে আলাইরার নিথর দেহের দিকে। ছুরির পাথর-ধরা লেজটা শক্ত করে ধরে আলাইরার বুকের ওপর হালকা চাপ দেয়। প্রথম চাপে চামড়া ছিঁড়ে যায়।তারপর রক্ত ছিটকে পড়ে ফিওনার মুখের ওপর, কিন্তু সে থামে না।আরো বেশি চাপ বাড়ায়। হাড়ের নীচে পৌঁছে যায় গরম ছুরিটা এবার । এরপর ফিওনা ছুড়িটা এক প্রবল ধাক্কায় আরো গভীরে ঢুকিয়ে দেয়,ছুরিটা কলিজার ঠিক পাশ ঘেঁষে ঢুকে পড়ে। এরপর ফিওনা তার ডান হাতটা গলিত রক্তে ঢুকিয়ে দেয়, মাংসের গভীরে পৌঁছে যায় হাত। ঠাণ্ডা, কাঁপা আঙুল হঠাৎ খুঁজে পায় গরম কলিজাটাকে। আর এক টানে কলিজাটা বের করে আনে। আলাইরার চোখ সেই কবেই স্থির হয়ে আছে। দেহ কাঁপা থেমে গেছে আরো অনেক্ষণ আগেই।রক্তে ভেজা সেই অঙ্গটা ফিওনার হাতের মুঠোয় তখন ও ছটফট করতে থাকে। ফিওনা তাকায় সেই লালচে কলিজার দিকে। মুখে একটা তিক্ত বিষাদ ভেসে ওঠে আর তারপর ক্ষণিকেই মিলিয়ে যায় সেই বিষাদ। “তুই সাহস দেখিয়েছিলি অনেক” সে ফিসফিস করে। “এটাই ছিল তোর সাহস দেখানোর চরম মুল্য।”
ফিওনা চোখজোড়া বন্ধ করে একটা গভীর শ্বাস নিলো।
অ্যালিসা নিস্তেজ হয়ে পড়ে আছে চেতনহীন এই মুহূর্তে সে, একপ্রকার আধমরা অবস্থায় পড়ে আছে। তার নিস্তেজ শরীরটাই যেন ফিওনার ক্রোধের সাক্ষী হয়ে গিয়েছে। ফিওনা এক পা এক পা করে এগিয়ে আসে অ্যালিসার দিকে, চূড়ান্ত প্রতিশোধের তৃপ্তি আর খারাপ এক অদ্ভুত শান্তি অনুভব করতে করতে। আলাইরার লা’শটিতে তীব্র যন্ত্রণার ছাপ রয়েছে। ফিওনা স্নিগ্ধভাবে টেনে হিচড়ে প্রাসাদের পেছনের দিকের গুদামঘরের দিকে নিয়ে যায় সেই লা’শ। এমনভাবে টেনে নিয়ে যায় যেন কোনো মৃতদেহ নয়, একপ্রকার অপ্রয়োজনীয় বস্তু নিয়ে যাচ্ছে, যা তাকে এতটুকু টানাপোড়েন ছাড়াই মুছে ফেলা দরকার। গুদাম ঘরের কোণে রেখে সে এক নিঃশব্দ শ্বাস নেয়, তারপর প্রাসাদের সেই ভয়ার্ত কোণে ফিরে আসে যেখানে রক্তের ছিটে ছিঁড়ে পড়েছিল। রক্তের দাগ এক এক করে মুছে ফেলে প্রত্যেকটা জায়গা থেকেই। তবে, নিজের গায়ে লেগে থাকা র*ক্ত সে পরিস্কার করলো না। সেই র*ক্তের ছাপ যেন তার অভিশাপের প্রতীক, যা সে মুছতে চায় না। আর তারপরেই নিঃশব্দে পাহাড়ের ওপর উঠে আসে ফিওনা, যেখানে এক মুহূর্তের জন্য বাতাসের শীতল ঝাপটায় তাকে শান্তি দেওয়ার চেষ্টা করছে। চারপাশে এক অদ্ভুত নীরবতা বিরাজমান, যা তার মনে অন্ধকার থেকে প্রতিধ্বনি শোনাচ্ছে।
ফ্ল্যাশব্যাক ধীরে ধীরে স্লান হয়ে গেলো………..
ফিওনার চোখে তখনো আগুনের রেশ রয়ে গেছে। সে তাকিয়ে আছে জ্যাসপারের চোখে, নিঃশ্বাস টানছে ধীরে ধীরে, যেন ভেতরে জমে থাকা সমস্ত প্রশ্ন এখন একটাই হয়ে দাঁড়িয়েছে। “প্রিন্স,” ফিওনা বলে ওঠে কাঁপা গলায়, “তুমি তো সব শুনলে… সব বুঝলে… এখন কি তুমি আমাকে ঘৃ*ণা করবে?”
এক মুহূর্ত নিস্তব্ধতা নেমে এলো ।তারপর জ্যাসপার কোনো কথা না বলে এগিয়ে আসে। সে ফিওনাকে এক ঝটকায় শক্ত করে বুকে টেনে নেয়, যেন কখনোই ফিওনা হারিয়ে না যায়।
“তুমি যা করেছো,পারফেক্ট করেছো,” জ্যাসপার ফিসফিস করে বলে, “তুমি প্রমাণ করেছো তুমি আমার জন্যই জন্মেছো। আমি যেমন তোমার জন্য পাগল, তেমনই আমিও চেয়েছিলাম তুমিও আমার জন্য পজেসিভ হও। তুমি দেখিয়ে দিলে তুমি আমার যোগ্য অর্ধাঙ্গিনী। ভয় পাওয়া ফিওনা নয়, তুমি এখন সেই আগুন, যে আমার মতোই পোড়াতে জানে।”
ফিওনার চোখে জল জমে। সে জ্যাসপারের বুকের মধ্যে মুখ লুকিয়ে ফেলে।দুজনেই দাঁড়িয়ে আছে দুজনকে আলিঙ্গন করে বেলকনির পাথরের দেয়ালের কিনারে, বাতাসে তাদের চুল উড়ছে।ফিওনার চোখে অন্যমনস্কতা,তবুও ঠোঁটে একরকম প্রশান্তির ছাপ। জ্যাসপার ফিওনাকে নিজের বাহু থেকে সরিয়ে তাকিয়ে থাকে ফিওনার দিকে, তারপর দুই হাত দিয়ে ফিওনার কোমর জড়িয়ে তাকে আবার ও নিজের দিকে টেনে আনে। সে ধীরে ধীরে ফিওনাকে বেলকনির দেয়ালের ওপর বসিয়ে দেয়। তার ঠোঁট ফিওনার কপালে ছুঁয়ে যায়, তারপর চোখের কোণে, তারপর— ফিওনার নিশ্বাস ভারী হয়ে আসে।জ্যাসপার এক হাত দিয়ে তার চিবুক তোলে, অন্য হাত দিয়ে তার পিঠের ওপর আড়াল করে দেয়। “তুমি জানো না, আমি তোমাকে কতোটা চাই সবসময় হামিংবার্ড” সে গম্ভীর গলায় বলে। পরক্ষণেই তার ঠোঁট ফিওনার ঠোঁটে এসে ছুঁয়ে যায় নরম নয়,বরং তীব্র দাবি ছুঁয়ে থাকা এক প্রগাঢ় চুম্বন। যেনো সারা রাত ধরে জমে থাকা আগুন হঠাৎ শিখায় রূপ নিলো। বাতাস থমকে যায়। চাঁদের আলো ছায়া ফেলে তাদের দুজনের মুখে।ফিওনা চোখ বন্ধ করে জ্যাসপারের পিঠ আঁকড়ে ধরে। তাদের মাঝে কোনো শব্দ নেই, শুধু হৃৎস্পন্দনের তীব্রতা আর তপ্ত নিঃশ্বাস।
গভীর রাত। এল্ড্র প্রাসাদের আকাশজুড়ে নীরবতা নেমে এসেছে।চারদিক নিস্তব্ধ,শুধু বাতাসের শো শো শব্দ। সেই নিস্তব্ধতা ভেঙে ধীরে ধীরে নিচে নামে এক ড্রাগন বেগুনি ডানায় জ্যোৎস্নার আলো পড়ে যেনো জ্বলজ্বল করছে সে।
সিলভা। ভেতরটা অস্থির হয়ে উঠেছিলো,এথিরিয়নকে না দেখে আর থাকতে পারছিলোনা। তাই ফ্লোরাস রাজ্যে থাকছে ছুটে আসে এল্ড্র রাজ্যতে আর সেই ড্রাগন রূপে এল্ড্র প্রাসাদের উপরের বারান্দায় নেমে আসে সে,তারপর মানুষের রূপ ধরে সাবধানে এগোয় এথিরিয়নের কক্ষের দিকে।
দরজার ফাঁক দিয়ে উঁকি দেয়। অন্ধকার। নিস্তব্ধ। খালি বিছানা পড়ে আছে কিন্তু এথিরিয়ন নেই। সিলভা এক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে থাকে হতাশ হয়ে পড়ে, তার বুকের ভেতর অজানা হাহাকার বাসা বাঁধে। “কোথায় আছে এই মুহূর্তে রিয়ন…?” মনে মনে বলে সে। পুনরায় ড্রাগন রূপ ধারণ করে চলে যাওয়ার জন্য ডানায় আলো জ্বালাতে যাবে ঠিক তখনই—
হঠাৎ তার হাতে জোরে টান পড়ে একটা । এক ঝটকায় কেউ তাকে নিজের দিকে টেনে নেয়। সিলভার শরীর জমে যায়, চোখের পাতা কাঁপতে থাকে।তখনি চোখের সামনে স্পষ্ট হয়ে ওঠে একজোড়া গভীর,তীক্ষ্ণ নীল চোখ ঠিক আকাশের নীলচে রঙের মতোই যেই চোখে রয়েছে সমুদ্রের অতল গহবর। এথিরিয়ন!! সে সিলভার হাত শক্ত করে ধরে রেখেছে। চোখে ঘুম নেই, বরং একরাশ প্রশ্ন আর তীব্র অনুভূতি।য়”তুমি এখানে?” এথিরিয়নের গলা নরম কিন্তু তীক্ষ্ণ। সিলভা চোখ নামিয়ে ফেলে, ধরা পড়া চোরের মতোই।
এথিরিয়নের চোখে তখন আগুন আর নীল বরফ একসাথে মিশে আছে।সিলভা ফিসফিস করে বললো,
“আম সরি! আমার জন্য তোমাকে সাসপেন্ড হতে হলো…”
এথিরিয়ন একদম চুপ। তারপর ধীরে হাত তোলে,এক আঙুল দিয়ে সিলভার ঠোঁটে রাখে।
“হুশ…”নরম অথচ দৃঢ় কণ্ঠে বলে, “তোমাকে বাজে ভাবে ছুঁয়েছে…আমি জানি না কিভাবে ছুঁয়েছে, শুধু জানি ছুঁয়েছে। আর সেটাই যথেষ্ট ছিলো।”
সিলভার চোখ বড় হয়ে যায়, নিঃশ্বাস বন্ধ করে এথিরিয়নের দিকে তাকিয়ে থাকে।
“ওকে মারার… ওকে মেরে ফেলাই দরকার ছিলো,” — এথিরিয়নের কণ্ঠে অদ্ভুত নিস্তব্ধ এক রাগ, এক ভালবাসার দাবী। “তোমার গায়ে কেউ হাত দেবে? হুঁ… তাকে ছেড়ে দিবো নাকি আমি?”
একটা দীর্ঘ নিরবতা—তারপর সিলভা ফিসফিস করে বললো,
“তুমি কি রাগ আমার ওপর ?” এথিরিয়ন গভীরভাবে সিলভার চোখে তাকিয়ে থাকলো কিছুক্ষণ।তারপর নিচু গলায় বললো—”রাগ.. রাগ কেনো করবো? আগে বলো আমি কি তোমার হৃদয়ে জায়গা পাবো এখন?”
সিলভার ঠোঁটে এক চিলতে হাসি ফুটে উঠলো, গলার স্বর কাঁপা কাঁপা কিন্তু স্পষ্ট “জায়গা পাবে মানে?জায়গা তো কবেই তোমাকে দিয়ে দিয়েছিলাম…”
এক মুহূর্তে চারপাশের নীরবতা যেন জ্যোতির আভায় ভরে যায়। এথিরিয়ন চুপচাপ তার দিকে এগিয়ে যায়, খুব ধীরে, যেন কোনও পবিত্র কিছু ছুঁতে যাচ্ছে। সিলভা চোখ নামিয়ে ফেলে, কিন্তু ঠোঁটে সেই চুপচাপ স্বীকারোক্তির হাসি।
এথিরিয়নের হাত সিলভার গালে এসে থামে। ওর নরম, উষ্ণ ত্বক যেন নীরব ভাষায় বলে দেয়, এই ছোঁয়াতেই সে নিরাপদ, এই ছেলেটাই তার সবচেয়ে বেশি নিজস্ব।
“তুমি জানো না সিলভা, কতদিন ধরে আমি এই দিনটার অপেক্ষায় আছি।” এথিরিয়নের গলা কাঁপছিল আবেগে।
সিলভা কিছু বলার আগেই এথিরিয়ন ওকে বুকের মধ্যে টেনে নেয়। তীব্র আবেগে দুজনেই চোখ বন্ধ করে ফেলে। একে অপরের হৃদস্পন্দন যেন তাদের সত্যি এক করে দেয়।
এথিরিয়ন সিলভার মুখের ঠিক পাশে নেমে আসে। নিঃশ্বাসের কাঁপন ওর ঘাড় ছুঁয়ে যায়।এক ঝলক স্নায়ুতে ছুটে আসে সেই পুরনো দিনের স্মৃতি। “এতো রাতে আমার কক্ষে এসেছো কেনো?” এথিরিয়নের কণ্ঠ ফিসফিসে, নরম কিন্তু গভীর।
“তাও আবার আজকে স্বীকার করলে আমি এখনো তোমার হৃদয়ে আছি।” তারপর চোখে চোখ রেখে আরও এক ধাপ এগিয়ে বলে— “হ্যাঁ, সেদিনের মতো কিছু হয়ে গেলে… এবারও কি তুমি আমাকে ঘৃণা করবে, সিলভা?”
সিলভার চোখ হঠাৎ বড় হয়ে যায়। হৃদয়ে সেই পুরনো রাতের আতঙ্ক ফিরে আসে। সেদিন…এথিরিয়নের চোখেও নেশা ছিলো, রাগ ছিলো, ভাঙা আত্মবিশ্বাস, আর কিছুটা অন্ধতা ছিলো।সে পেছনে সরতে যায়, কিন্তু এথিরিয়নের চোখ এবার শান্ত। “আমি ওরকম আর কিছু করবো না, সিলভা। আমি এখন বুঝতে পেরেছি, ভালোবাসা মানে জোর নয়।”
তার কণ্ঠ এবার কাঁপা, কিন্তু সত্যভরা। “তোমাকে ভয় পাইয়ে দিলে তো আমি নিজেই নিজেকে হারাবো।” সিলভার চোখে পানি জমে—এই স্বীকারোক্তি, এই সততা, তার জন্য অনেক।
এথিরিয়ন খুব ধীরে সিলভার চোখে তাকিয়ে ফিসফিসিয়ে বলে, “ক্যান আই কিস ইউ?” সিলভা কিছু বলে না—চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। নিঃশ্বাস ভারি হয়ে আসে। হৃদয় ধুকপুক করছে, চোখ দুটো নামিয়ে ফেলে, কিন্তু সে সরে না।
তখনই এথিরিয়নের কণ্ঠ আবার শোনা যায়, আরও নিচু স্বরে, একটু মজা মেশানো ভয়ংকর কোমলতায় “নীরবতাই সম্মতির লক্ষণ…”
বারান্দার ধাতব রেলিংয়ে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল সিলভা। চাঁদের আলো তার মুখে পড়ে স্ফটিকের মতো উজ্জ্বল করে তুলছিল। কিন্তু তার চোখে ছিল অস্থিরতা। এক মুহূর্ত…তারপর কোনো পূর্বাভাস ছাড়াই এথিরিয়নের শক্ত হাত সিলভার কবজি জড়িয়ে ধরে। “চলো,” কণ্ঠস্বরটা ছিল গভীর, ধীর কিন্তু প্রকম্পিত যেন তার ভেতর কোনো দাবানল পুড়ছে। সিলভা কিছু বলার আগেই এথিরিয়ন তাকে টেনে নিয়ে আসে ঘরের ভেতর।বারান্দার দরজা বন্ধ হয়, এক নিঃশ্বাসে। পরের মুহূর্তে সে সিলভাকে দেয়ালের সাথে চেপে ধরে, সজোরে। তার চোখ দুটো অন্ধকার রাতে ঝলসে ওঠা বিদ্যুতের মতোই দেখাচ্ছে। তাদের মাঝখানে আর কোনো শব্দ নেই,শুধু নিঃশ্বাস, আর চোখের ভাষা। এথিরিয়নের ঠোঁট সিলভার ঠোঁটে আছড়ে পড়ে।কোনো নরমতা নেই, কোনো অনুমতি নয়। এটা ছিল দাবি… অধিকার… রক্তে*র মতো গাঢ়।
সিলভার ঠোঁটের কোণে কামড় বসিয়ে ফেলে এথিরিয়ন আর দহনময় কন্ঠে বলে ওঠে “তোমার এই নীরবতা আমাকে পুড়িয়ে ফেলছে,সিলভা।আমার তো এখন শুধ চুমু খেতে ইচ্ছে করছেনা, তোমাকে সম্পূর্ণ করে নিতে ইচ্ছে করছে।”
সিলভার শরীরটা কেঁপে ওঠে, কিন্তু সে সরে না।
তাদের মাঝে থেমে থাকে শুধু হৃদস্পন্দনের শব্দ।
আর এক ভয়ানক সত্য—এই ভালোবাসা, এক অগ্নি, যা না পুড়িয়ে থামবে না।
এথিরিয়ন এবার সিলভার গলায় কামড় বসায়, তার ঠোঁটের কামড়টা সিলভার গলায় আরও গভীর হয়ে যায়, যেন তার সব নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে গেছে। সিলভা এক মুহূর্তে স্তব্ধ হয়ে যায়, কিন্তু তার ভেতর অদ্ভুত এক শিরশিরানি অনুভূতি জাগ্রত হয়।এথিরিয়নএর হাত দুটো এখনও সিলভার কোমরের চারপাশে শক্ত করে বাঁধা। তার হৃদস্পন্দন দ্রুত হতে থাকে। ঘরের নীরবতা যেন আরো গভীর হয়ে ওঠে।
এথিরিয়ন তার হাত সিলভারের পিঠে নামিয়ে আনল, ধীরে ধীরে শরীরের নিচের অংশে।চোখে চোখ রেখে, সে আবার সিলভার ঠোঁটের দিকে ধীরে ধীরে এগোল। “এখন তোমার শরীর আমার,” সে বলল, কণ্ঠে এক গভীর ইচ্ছা। “তোমার প্রতিটা নিঃশ্বাস, প্রতিটি ছোঁয়া তোমার প্রতিটা অনুভূতি এখন শুধুই আমার নিয়ন্ত্রণে।” সিলভার শরীর কাঁপতে শুরু করল। কিন্তু সেই কাঁপন কোনো ভয় নয়, বরং এক অজানা আকর্ষণের গভীরে ডুব দেওয়ার আগ্রহ ছিল। তার চোখে এক অদ্ভুত বিপ্লব ছিল সে নিজেই বুঝতে পারছিল না, কিন্তু তার মনের ভেতর যা চলছিল, তা ছিল এক অজেয় আগুনের মতোই। এথিরিয়ন সিলভার হাতে আলতো করে আঙুল দিয়ে স্পর্শ করল, তারপর ধীরে ধীরে তার শরীরের প্রতি অংশে হাত বুলিয়ে দিতে থাকে। “তোমার দেহ থেকে তোমার সব অনুভূতি শোষণ করতে চাই আমি,” সে গম্ভীরভাবে বলল, “আর তারপর… শুধু একটাই প্রতিশ্রুতি থাকবে,আমাদের মধ্যে কখনোই দুরত্ব আসবেনা আর।”
রাত নেমেছিল নিঃশব্দে, চারপাশে শুধু মৃদু বাতাসের সুর। চাঁদের আলো জানালার পর্দা ছুঁয়ে এসে থেমে ছিল তাদের দুজনের গায়ে। সেই নিস্তব্ধ মুহূর্তে, এথিরিয়ন ধীরে, অত্যন্ত সচেতনভাবে, সিলভার মুখের দিকে তাকালো। তার চোখে ছিল নিঃশব্দ পিপাসা, এক আকুল আর্তি—যা শুধু তার হৃদয় জানে।
সিলভা তখনো জানত না কী অপেক্ষা করছে তার জন্য। কিন্তু সে থামেনি। এথিরিয়ন তার কোমরের চারপাশে হাত রেখে তাকে নিজের দিকে টেনে নিল, যেন এই দূরত্বটুকু অসহ্য হয়ে উঠেছে। তার ঠোঁট ছুঁয়ে গেল সিলভার কপাল, তারপর গাল, তারপর আরও নিচে—প্রতিটি চুমু ছিল ধীরে ধীরে জ্বলে ওঠা এক আগুন, যা ঠোঁট দিয়ে শরীরের ভেতরে ছড়িয়ে পড়ছিল।
চেইনের ছোট্ট শব্দে ভেঙে পড়ল মৌনতা।এথিরিয়নের আঙুল গাউনের চেইনের পথ ধরে নামছিলৎ যেন প্রতিটি মুহূর্তে সে সিলভার শরীরের এক একটি গোপন রাগ ছুঁয়ে দিচ্ছে—ধীরে, সাবধানে, কিন্তু গভীর আবেগে ভরপুর। গাউন নামতেই, বাতাস থমকে গেল, যেন সে-ও থেমে দেখছে এই অপরূপ দৃশ্য। সিলভার দেহ তখন এক শিল্পকর্মের মতো সামনে দাঁড়িয়ে,অর্ধোন্মুক্ত,কিন্তু অনাবৃত নয় সে ছিল অলঙ্কারের মতো,সৌন্দর্যের নিঃশব্দ সংজ্ঞা। এথিরিয়ন তাকে দেখছিল—তৃষ্ণার্ত নয়, বরং প্রশংসায় পূর্ণ এক দৃষ্টিতে। তার হাত সিলভার নগ্ন পিঠ বেয়ে নিচে নামছিল, যেন আঙুল দিয়ে আঁকছে অনুভূতির কাব্য।
তার ঠোঁট নামতে লাগলো একে একে, প্রতিটি চুম্বনে ছিল এক দুঃসহ কোমলতা, এক প্রশান্ত বিস্ফোরণ—যা সিলভার ত্বকে কাঁপন তুললঝ, আর হৃদয়ে তুললো ঢেউ। সিলভা ধীরে ধীরে চোখ বন্ধ করল, যেন নিজেকে সঁপে দিচ্ছে সেই আবেগের জোয়ারে। তার আঙুল এথিরিয়নের চুলে জড়িয়ে গেছে, আর বুকের ভেতরে বাজছে এক ছন্দ—প্রেম আর কামনার অসীম সমন্বয়ের।
এথিরিয়নের ঠোঁট সিলভার পিঠে একের পর এক চুমু আঁকছিল ধীরে ধীরে,গভীরভাবে, যেন প্রতিটি স্পর্শে সে তার ভালোবাসা গেঁথে দিচ্ছে তার ত্বকে। সিলভার নিঃশ্বাস ভারী হয়ে উঠছিল, প্রতিটি চুম্বনে যেন সে হারিয়ে যাচ্ছিল এক অজানা আবেশে। তার পিঠ তখন পরিণত হয়েছিল এক ক্যানভাসে, যেখানে এথিরিয়ন ভালবাসার রঙে তুলির ছোঁয়া দিচ্ছিল।
একপর্যায়ে, এথিরিয়নের ঠোঁট উঠে এল সিলভার ঘাড় বরাবর। সেখান থেকে সে আরও এগিয়ে গেল—তার মুখ ঝুঁকে পড়ল সিলভার কানের কাছে। হঠাৎই, সেই কোমল মুহূর্তে, সে কানের লতিতে হালকা এক কামড় বসাল। সিলভার শরীর হালকা শিহরিত হয়ে উঠল, সে এথিরিয়নের বুকের কাছে আরও গা এলিয়ে দিল, যেন তার ভেতরের অনুভবগুলো কোনো শব্দ না করেও বলে দিতে চায়—”আমি তোমার, পুরোপুরি।” এথিরিয়নের ঠোঁট তখন আবার নিচের দিকে নামতে লাগল, পিঠ বেয়ে, কোমরের কাছে—প্রতিটি চুম্বনে একধরনের আকর্ষণ, এক অস্থির শান্তি ছড়িয়ে পড়ছিল। আর সিলভা, চোখ বন্ধ করে, নিজেকে সঁপে দিয়েছিল সেই উষ্ণ পরশের জাদুতে—যেখানে শরীর আর আত্মা একাকার হয়ে যাচ্ছিল।
এক মুহূর্তের জন্য এথিরিয়নের চোখে জমে উঠল তীব্র আকাঙ্ক্ষা কিন্তু তার ভেতরে ছিল না কোনো তাড়াহুড়া, বরং ছিল গভীর ভালোবাসা আর অপার টান। ধীরে ধীরে, কোমরে রাখা হাতে এক নরম টান দিয়ে সে সিলভাকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে নিল। সিলভার চোখে তখন একরাশ লজ্জা আর আত্মসমর্পণের ছায়াকিন্তু সেই চোখে ছিল জ্বলজ্বলে অভিমানহীন ভালোবাসা, যা শুধু এথিরিয়নের জন্যই সংরক্ষিত।
এথিরিয়ন সিলভার মুখের দিকে তাকিয়ে হালকা হাসল—একটা নিরব প্রতিশ্রুতি যেন তার ঠোঁটেই ছিল লেখা। তারপর সে মুখ ঝুঁকিয়ে প্রথমে সিলভার গলায় এক দীর্ঘ, নরম চুমু এঁকে দিল। সেই চুমু ছিল তপ্ত, কিন্তু শান্ত; ছিল দাবিদার, কিন্তু কোমল যেন বলছে, “তুমি শুধু আমার।”
সিলভার চোখ বুঁজে এলো, নিঃশ্বাস খানিক কেঁপে উঠল। গলার নিচে নেমে এথিরিয়নের ঠোঁট এবার খোঁজ নিতে লাগল তার বুকের কাছাকাছি, সেই কোমল স্থানটিতে, যেখানে হৃদয় নিঃশব্দে কাঁপে। সে সেখানে রাখল এক গভীর, আবেগময় চুম্বন—যা শুধু শরীর ছোঁয়ায় সীমাবদ্ধ ছিল না, বরং প্রবেশ করছিল হৃদয়ের গভীরে, আত্মার গভীরতম স্তরে।
সিলভার বুকের কাছে যখন এথিরিয়নের ঠোঁট থেমে থাকল, তখন যেন সময়ও নিঃশব্দে থেমে গেল। সিলভার নিঃশ্বাস কাঁপছিল ,না ভয় থেকে, না লজ্জা থেকে, বরং এক অপরিমেয় আবেগের কারণে, যা তার শরীর জুড়ে ছড়িয়ে পড়ছিল। এথিরিয়নের হাত উঠল ধীরে, বয়ে গেল সিলভার গলার পাশ দিয়ে, তার চুলের রেখা ছুঁয়ে, কাঁধে থেমে। তারপর সেই হাত নামল তার পিঠ বেয়ে, কোমরে এসে জড়িয়ে ধরল দৃঢ়ভাবে,কিন্তু তাতে কোনো চাপ ছিল না, বরং ছিল এক সুরক্ষা, এক নির্ভরতা, যা সিলভাকে আরও বেশি আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য করছিল।
সে আবার ঝুঁকে পড়ল—এবার চুমু রাখল তার বক্ষের মাঝখানে, সেখানে যেখানে হৃদয়ের শব্দ সবচেয়ে জোরে শোনা যায়। সিলভা তখন নিজেকে আর থামাতে পারছিল না। তার আঙুল খুঁজে নিল এথিরিয়নের চুল, নরমভাবে টেনে আনল তাকে আরও কাছে। তার চোখে তখন ছিল জলাভ গ্লানি নয়,ভালোবাসার অতল আবেগ, যেটা গলায় আটকে যায় কিন্তু শব্দ হয় না।
তখনই, কোনো পূর্বঘোষণা ছাড়াই, এথিরিয়ন তাকে দুহাতে কোলে তুলে নিল,যেন তার ওজন ছিল শুধুই হাওয়ার মতোই, আর সেই মুহূর্তে সারা ভেনাস হালকা হয়ে এসেছিল। সিলভার হাত জড়িয়ে গেল তার গলায়, আর মুখের কোণে ফুটে উঠল এক মৃদু, আবেগঘন হাসি।
ধীরে ধীরে, পরম যত্নে, এথিরিয়ন তাকে নিয়ে এল বিছানার দিকে। চাঁদের আলো এসে ঠিক যেন তাদের আশীর্বাদ করছিল,তার আলো সিলভার ত্বকে পড়লে মনে হচ্ছিল কোনো দেবী যেন ধরণীতে নেমে এসেছে। বিছানায় তাকে শুইয়ে, এক মুহূর্ত সিলভার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল এথিরিয়ন—চোখে চোখ রেখে। কোনো শব্দ ছিল না, তবু ভেতরে ছিল এক নিঃশব্দ প্রতিজ্ঞা, “এই রাত, কেবল তোমার আর আমার।”
তারপর, ধীর গতিতে, সে নিজের গায়ের টি-শার্টটা তুলে ফেলল। কাপড় সরে যেতেই তার উন্মুক্ত বুক জেগে উঠল চাঁদের আলোয়—মজবুত, উষ্ণ আর আত্মবিশ্বাসে ভরপুর এক দেহভাষা। সিলভার চোখ তখন ধীরে ধীরে সেই দৃশ্যে আটকে গেল। এথিরিয়ন আবার নিচু হয়ে এল সিলভার ওপর, দুই হাতে বিছানার দুইপাশ ধরে, যেন তাকে ঘিরে ফেলেছে এক উষ্ণ প্রাচীর দিয়ে—যেখান থেকে পালানোর ইচ্ছাও নেই, দরকারও নেই।
এথিরিয়নের চোখে তখন আর কোনো দ্বিধা ছিল না—সেই দৃষ্টিতে জ্বলছিল তীব্র আকাঙ্ক্ষা, কিন্তু তাতে ছিল না কোনো তাড়াহুড়া; ছিল এক অভিজ্ঞান, যেন বহু জন্মের চেনা, বহু রাতের অপেক্ষার প্রতিফলন। সে ধীরে হাত বাড়িয়ে সিলভার পোশাকের কিনারা ধরে। চোখে চোখ রেখে এক মুহূর্ত চুপ থাকল,অনুমতি না চেয়ে, বরং গভীর অনুভবের মাধ্যমে বুঝে নিয়ে।
সিলভা কোনো প্রতিবাদ করল না, বরং চোখ বুজে নিজের শরীর ছেড়ে দিল সেই বিশ্বস্ত হাতের কাছে। তার নিঃশ্বাস ভারী হচ্ছিল, ঠোঁট কেঁপে উঠছিল, কিন্তু মুখে ছিল এক প্রশান্ত আত্মসমর্পণ।
এথিরিয়নের আঙুল ধীরে ধীরে পোশাক সরে নিতে লাগল—প্রতিটি ছোঁয়ায় যেন আগুন ছড়িয়ে পড়ছিল চামড়ার নিচে। তারপর এক তীব্র মুহূর্তে, সেই পোশাকটা সে খুলে নিয়ে এক ঝটকায় ছুড়ে ফেলল।ফ্লোরের কোণায় গিয়ে পড়ল কাপড়টা, যেন তা ছিল শুধুই এক অন্তরায়, যা তাদের মিলনের পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল।
সিলভার নগ্ন শরীর তখন চাঁদের আলোয় ঝলমল করছিল—সে যেন কোনো চিত্রশিল্পীর আঁকা জীবন্ত সৃষ্টি, এক দেবীর মতো। এথিরিয়নের চোখে তৃষ্ণা ছিল, কিন্তু তার স্পর্শে ছিল সম্মান,একজন প্রেমিকের।
নিজেকে একটুখানি দূরে সরিয়ে, সে পাশে রাখা পাতলা চাদরটা টেনে নিল—ধীরে, সযত্নে, যেন কোনো পবিত্রতা ঢেকে দিচ্ছে। চাদরটি দুজনের শরীর ঢেকে দিল, কিন্তু আবেগের উত্তাপ তার নিচে যেন আরো তীব্র হয়ে উঠল।
চাদরটা এখন ছিল এক স্বর্গীয় আচ্ছাদন যেখানে বাইরের জগতের সব আলো,শব্দ, বাস্তবতা ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেছে। শুধু রয়ে গেছে এথিরিয়ন আর সিলভার দেহঘনিষ্ঠ নিঃশ্বাস, উষ্ণতা, আর চিরন্তন এক অনুভব—যেখানে সময় আর শরীর একে অপরকে হারিয়ে ফেলেছে।
চাদরের নিচে এথিরিয়নের ঠোঁট ধীরে ধীরে নামছিল সিলভার ঘাড় থেকে বুকের দিকে,প্রতিটি চুমু ছিল আগের চেয়ে গভীর, ধীর, আর তীব্র ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ। তারপর, সে নামতে লাগল আরো নিচে—তার ঠোঁট ছুঁয়ে গেল সিলভার নাভি।
সেই চুমুতে ছিল অদ্ভুত জাদু—সিলভার শরীর শিহরিত হয়ে উঠল, তার পেট কেঁপে উঠল এক মৃদু শ্বাসে। নাভির চারপাশে এথিরিয়নের ঠোঁটের নরম চাপ যেন ছড়িয়ে দিচ্ছিল অসীম ভালোবাসা, যা শুধু শরীরে নয়—হৃদয়ের গভীরে গেঁথে থাকছে।
তারপর, সেখান থেকে একটু নিচে নামতে নামতে, সে রাখল আরেকটি চুমু,সিলভার তলপেটে, কোমলভাবে। যেন সে নিজের ভালোবাসা ছুঁয়ে দিচ্ছে তার আত্মার কেন্দ্রবিন্দুতে।
সিলভার ঠোঁট তখন হালকা খুলে গেছে, এক নিঃশব্দ শ্বাস বেরিয়ে এসেছে বুকের গহ্বর থেকে। সে তার আঙুল দিয়ে এথিরিয়নের মাথা ছুঁয়ে রাখল—না টেনে ধরার জন্য, বরং শুধু অনুভব করার জন্য—যেন সেই মুহূর্তটা চিরস্থায়ী হয়ে থাকে।
চাদরের নিচে, আলো না থাকলেও, তারা দুজন অনুভব করছিল একে অপরকে—চোখে না, স্পর্শে; কথায় না, নিঃশ্বাসে। চাদরের নিচে শরীর আর নিঃশ্বাস যখন মিশে যাচ্ছিল, সেই মুহূর্তে যেন সময় এক ঝাঁকে উষ্ণ হয়ে উঠেছিল। এথিরিয়নের ঠোঁট ধীরে ধীরে নামছিল আরও গভীরতায়—সিলভার শরীরের প্রতিটি স্পন্দনে যেন জেগে উঠছিল এক জাদুকরী প্রতিক্রিয়া। কিন্তু হঠাৎই—একটা শীতল নিঃশ্বাসের মতো, সিলভার আঙুল এসে এথিরিয়নের ঠোঁটের সামনে থেমে গেল। “থামো,” তার কণ্ঠ ফিসফিসে, কিন্তু দৃঢ়। এথিরিয়নের চোখে ছায়া পড়ে, সে অবাক নয়, শুধু গভীর মনোযোগে তাকায় তার মুখে। সিলভা চোখ নিচু করে আছে, ঠোঁটে কাঁপুনি, কিন্তু কণ্ঠে সেই পরিচিত কোমল দৃঢ়তা।
“… আজকে না,” সে ধীরে বললঝ। এক মুহূর্তের নীরবতা নেমে আসে—কোনো সংকোচ নয়, শুধু এক অপরিহার্য আবেগের সম্মান। এথিরিয়ন কিছু বলে না, শুধু সিলভার চুলে এক মৃদু ছোঁয়া দিয়ে, কপালে আবার চুমু রাখে—এইবার একদম অন্য মানে নিয়ে।
“তুমি যেদিন চাইবে সেদিনই,” সে নিচু স্বরে বলে, আর তাকে আরও ভালো করে জড়িয়ে ধরে চাদরের নিচে।
সিলভা তখন চোখ বন্ধ করে দীর্ঘ নিঃশ্বাস নেয়—একে অপরের উষ্ণতা, ভালোবাসা, আর সম্মানেই যেন সে নতুনভাবে আশ্বস্ত হয়। সেই রাত, যেটা হতে পারত দেহের পূর্ণ মিলন, রয়ে গেল এক আত্মিক বন্ধনের চূড়ান্ত প্রকাশে—যেখানে থেমে যাওয়াটাও হয়ে উঠল প্রেমের গভীরতম ভাষা।
রাত গভীর জ্যাসপার তাঁর গবেষণাগারে বসে গবেষণা করছে,সেলুলার ডিএনএ এবং মস্তিষ্কের নিউরোট্রান্সমিটারস নিয়ে গভীর চিন্তা-ভাবনা করছে।সে জানে, কোনো একভাবে, ফিওনার আচরণের পরিবর্তন ব্যাখ্যা করা দরকার, তার ভালোবাসা তার ফিওনা যে একসময় কোমল,নাজুক আর সরল ছিলো, আজ কেন এই অস্থিরতা, এই ক্রোধ আর অস্বাভাবিক ক্ষমতাধর মানসিক অবস্থা গ্রহণ করেছে? তবে জ্যাসপার জানে, এর উত্তর সহজ নয়।
একজন সাইকো হাজবেন্ড,যে অত্যন্ত পজেসিভ আর নিয়ন্ত্রণকারী আচরণ করে, তার শিকারকে দীর্ঘ সময় ধরে মানসিকভাবে প্রভাবিত করে। এক্ষেত্রে, ফিওনার প্রতি জ্যাসপারের অত্যধিক অধিকারবোধ, তার প্রতি দমনমূলক মনোভাব, আর পজেসিভ সম্পর্কের প্রতি অতিরিক্ত প্রবণতা ফিওনার মস্তিষ্কে গভীর মনস্তাত্ত্বিক পরিবর্তন ঘটাতে সাহায্য করেছে।
একজন সাইকো পার্টনার, যেমন জ্যাসপার, তার সঙ্গীর প্রতি অতিরিক্ত ভালোবাসা আর আবেগপ্রবণ হয়ে উঠে সবসময়। যখন ফিওনার মতো একজন মানুষ,যে আগে স্বাধীন ছিল, তাকে একটানা দমন আর নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রাখা হয়, তখন সেই ভালোবাসা চাপের মাধ্যমে ভীতির সৃষ্টি করে। অতিরিক্ত ভালোবাসার চাহিদা মস্তিষ্কে “শুধু আমি” বা “শুধু তুমি” এমন মনোভাব তৈরি করে, যা দীর্ঘদিনের ব্যবহারে সাইকোটিক আচরণে পরিণত হয়।
এখন জ্যাসপার বুঝতে পারছিল যে, তার অতিরিক্ত ভালোবাসা, অধিকারবোধ এবং নিয়ন্ত্রণের আচরণগুলো ফিওনার মস্তিষ্কে একটা বিপুল পরিবর্তন এনে দিয়েছে।সে গবেষণার মাধ্যমে জানতোযে, একজন সাইকো পার্টনার, যে অতিরিক্ত পজেসিভ এবং নিয়ন্ত্রণকারী আচরণ করে, তার সঙ্গীকে দীর্ঘ সময় ধরে মানসিকভাবে প্রভাবিত করতে পারে। এমনকি সেই সঙ্গী মানসিকভাবে বিধ্বস্ত হয়ে, তার মধ্যে ক্রমশ সাইকোটিক মনোভাব তৈরি হয়ে যেতে পারে।
ফিওনার মস্তিষ্কে শুরু হয় কগনিটিভ ডিসোন্যান্স—এক ধরনের মানসিক দ্বন্দ্ব। একদিকে, সে জানতো যে, তাকে ভালোবাসা হচ্ছে, কিন্তু অন্যদিকে তার অনুভূতি ছিল, “এই ভালোবাসার কারণে আমি কষ্ট পাচ্ছি, আমি ক্রমাগত দমন হয়ে যাচ্ছি।” এই দ্বন্দ্ব তার মধ্যে অস্থিরতা তৈরি করেছিল।
জ্যাসপার তার আরো গবেষণার মাধ্যমে উপলব্ধি করল, যে সাইকো প্যাটার্ন তৈরি হওয়ার জন্য তারও অবদান রয়েছে। তার আচরণ—যে তাকে প্রথমে পজেসিভ করে তুলেছিল, তারপর সাইকোটিকভাবে তার উপর চাপ সৃষ্টি করেছিল—সেগুলোই ছিল ফিওনার এমন আচরণের মূল কারণ।
এখন, জ্যাসপার জানে, ফিওনার পরিবর্তন শুধুমাত্র তার ভালোবাসা থেকে আসেনি—এটি তার ওপর চাপ আর নিয়ন্ত্রণের ফলস্বরূপ ঘটে গেছে।এবার তার কাছে প্রশ্ন ছিল—কিভাবে ফিওনাকে আবার পুরনো রূপে ফিরিয়ে আনা যাব?
ল্যাবের পরিবেশ তখন গাঢ়় অন্ধকারাচ্ছন্ন।মেশিনের নীরব গুঞ্জনে বাতাস ভারী হয়ে আছে।জ্যাসপার সারা রাত ল্যাবে কাটাচ্ছে, যেন কিছুতেই শান্তি পাচ্ছেনা।হঠাৎ করে কেউ একজন ল্যাবে প্রবেশ করল, তার হাতে কিছু গবেষণার কাগজ, কিন্তু তখনই দরজা খোলা থেকে একটি শক্তিশালী উপস্থিতি অনুভব করল।
সেই মুহূর্তে ল্যাবের দরজা ধাক্কা দিয়ে খুলে গেল এবং ভিতরে প্রবেশ করলেন ড্রাকোনিস, এল্ড্র রাজ্যের রাজা।
“আপনি এতো রাতে এখানে?” জ্যাসপার দাঁড়িয়ে গেল, চোখে অস্বাভাবিক চমক। জ্যাসপার সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বলল, “কিছু বলবেন?”
ড্রাকোনিস ধীর পায়ে এগিয়ে এলেন, চোখে প্রশ্ন, কণ্ঠে গর্জনের মতো দৃঢ়তা “আলাইরাকে কে মেরেছে, জ্যাসপার?”
এক মুহূর্ত নিরবতা। ল্যাবের আলো জ্বলে-নিভে উঠল যেন সত্য প্রকাশের সাথে সঙ্গত দিচ্ছে।জ্যাসপার চোখ নামিয়ে চুপ করে রইল কিছুক্ষণ, তারপর শান্ত গলায় বলল —“আমি। আমি ওকে মেরেছি।” ড্রাকোনিস বিস্ময়ে পেছনে সরে গেলেন এক পা, চোখে অদ্ভুত দৃষ্টিতে ছেলেকে দেখলেন।
“কেন?” তাঁর গলায় অশ্রুত হাহাকার।
জ্যাসপার চোখ তুলল, এবার গলায় রাগ, কষ্ট আর অপরাধবোধ “ও সবার খাবারে কেমিক্যাল মিশিয়ে সবাইকে অচেতন করেছিল। ও আমাকে আমার অজান্তে অন্যভাবে ব্যবহার করতে চেয়েছিল। আজ এল্ড্র প্রাসাদের সম্মান, আমার সম্মান, সব ধ্বংস হয়ে যেত…”
ড্রাকোনিস গর্জনের মতো চিৎকার করে উঠলেন —
“মিথ্যে কেনো বলছো, জ্যাসপার? তুমি মারোনি! মেরেছে ফিওনা! আর সেটা প্রমাণিত হয়েছে!” তিনি সামনে এগিয়ে এলেন, কণ্ঠে ক্ষোভ আর চোখে হতাশা “আলাইরার গায়ে থাকা স্পর্শের নমুনা, ডিএনএ, সমস্ত কিছু ফিওনার সাথে মিলে গেছে। ভুলে গেছো? এই ল্যাবে এল্ড্র রাজ্যের প্রতিটি সদস্যের নমুনা রাখা আছে! আমি নিজের হাতে পরীক্ষা করেছি। সত্য কখনো লুকনো যায়না— ও-ই করেছে এটা!”
জ্যাসপারের চোখ লাল হয়ে উঠল, দম বন্ধ হয়ে আসছে তার — “স্টপ ইট!” চেঁচিয়ে উঠল সে, গলা কাঁপছে —
“ফিওনার নাম মুখে নেবেন না, ড্রাকোনিস! কক্ষজুড়ে এক অস্বস্তিকর নীরবতা নেমে আসে। ল্যাবের যন্ত্রগুলো টিকটিক শব্দ করছে। জ্যাসপার এক পা পেছনে সরে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। তার বুকের ভেতর ফিওনার জন্য ব্যথা আর ড্রাকোনিসের জন্য ক্রোধ একসাথে দাউ দাউ করে জ্বলতে থাকে।
ড্রাকোনিস এবার গম্ভীর কণ্ঠে বললেন, “তুমি কি বুঝতে পারছো না, জ্যাসপার? একজন ড্রাগন যদি আরেকজন ড্রাগনকে বিনা যুদ্ধে মেরে ফেলে, সেটা শুধুই অপরাধ নয়, সেটা এক রাজদ্রোহ! এই খবর যদি এল্ড্র প্রাসাদের বাইরের কেউ পায়, তুমি আর প্রিন্স থাকবে না। তোমার সিংহাসন কেড়ে নেওয়া হবে, এমনকি তোমার বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ শাস্তি দেওয়া হতে পারে।” জ্যাসপারের চোখ জ্বলছে, বুক ওঠানামা করছে ক্রোধে। সে সামনে এক পা এগিয়ে বলল, “আই ডোন্ট কেয়ার। আমার প্রিন্সের মুকুট চাই না, ভেনাসের সিংহাসন চাই না, শাস্তি হোক— হোক মৃত্যুদণ্ড, তবু ফিওনার গায়ে কোনো কলঙ্ক আসতে পারবে না। ওর নাম মুখে আনবেন না, ড্রাকোনিস। আমি বলেছি আমি মেরেছি— ব্যস। আমার যা হবার হবে তাতে।”
ড্রাকোনিস গম্ভীর মুখে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন জ্যাসপারের চোখে। তারপর ধীরে ধীরে বললেন, “তোমাকে ভবিষ্যতে এই রাজ্য সামলাতে হবে, জ্যাসপার। একটা খুনে*র দায় স্বীকার করে তুমি রাজ্যের সামনে কি বিবরণ দেবে? হ্যাঁ, আমি জানতাম ভালোবাসা মানুষকে অন্ধ করে দেয়— কিন্তু এখন তো দেখছি ভালোবাসা ড্রাগনকেও অন্ধ করে ফেলে।” জ্যাসপারের চোখে বিদ্যুৎ খেলে গেলো। কণ্ঠস্বর তীব্র, কিন্তু ঠাণ্ডা। “ভুল বলছেন। ভালোবাসা মানুষকে অন্ধ করেনা, ভালোবাসা মানুষকে স্বার্থপর বানায়। আমিও স্বার্থপর। কারণ আমি এখন নিজের অস্তিত্ব, নিজের আত্মা, নিজের জীবন রক্ষা করছি। আর আমার আত্মা, অস্তিত্ব, জীবন— সব কিছুই আমার ফিওনা। তাহলে আমি অবশ্যই স্বার্থপর। কারণ আমি নিজেকে রক্ষা করছি। ব্যাস, এখানেই শেষ কথা। আর একটাও কথা হবেনা ড্রাকোনিস।”
সে এক ধাপ এগিয়ে দাঁড়ায়, চোখে আগুন। “আর যদি আপনি ভুল করেও ফিওনাকে এর মধ্যে টেনে আনেন… আমি পুরো ভেনাস ধ্বংস করে দেব। আমি আর শুধু সেই জ্যাসপার নই— আমি থেরনও। আমায় কেউ আটকাতে পারবে না, আপনি না, রাজসভা না, কেউ না।”
ল্যাবে তখন গা ছমছমে নিস্তব্ধতা। ড্রাকোনিস কাঁপা কণ্ঠে ফিসফিস করে বললেন, “তুমি সত্যিই বদলে গেছো… জ্যাসপার।” ড্রাকোনিস পুনরায় ঠান্ডা গলায় বললেন “আরেকবার ভেবে দেখো তুমি যথাযথ বিবরণ না দিতে পারলে সব হারাবে”। এই কথার সাথে সাথেই জ্যাসপার একটা বিকট শব্দ চিৎকার দিয়ে উঠলো।
ড্রাকোনিস একটু পিছিয়ে গেলেন জ্যাসপারের সেই চিৎকারে।
জ্যাসপার তখন কাঁপতে কাঁপতে ল্যাবের পাশে থাকা কম্পিউটারে এক ঘুষি মারলো। কাঁচ ভেঙে ছিন্নভিন্ন হয়ে গেলো ওর হাত। র*ক্ত গড়িয়ে পড়ছে ল্যাবের ধাতব মেঝেতে।
সে র*ক্তাক্ত হাত তুলে ড্রাকোনিসের চোখে চোখ রেখে চিৎকার করে বলে উঠলো— “আর কতবার, আর কতবার আপনাকে বোঝাতে হবে? আমি সবকিছু হারাতে রাজি! আমার রাজ্য, আমার সিংহাসন, আমার পরিচয়— সব শেষ হয়ে যাক! কিন্তু শুধু একটাই জিনিস চাই আমি— আমার ফিওনা। শুধু ও আমার কাছে থাকলেই আমার সব কিছু পূর্ণ। ওকে হারালে আমি… আমি একেবারে শেষ হয়ে যাবো…।”
জ্যাসপারের চোখে তখন ক্রোধের দহধে ভেসে আসা একফোঁটা অশ্রু,কিন্তু সেই অশ্রু সে লুকোচ্ছে না। ড্রাকোনিস চুপচাপ দাঁড়িয়ে, এত বছরের অভিজ্ঞ রাজা আবার ও তার নিজ ছেলের এমন নিঃস্ব আত্মদহন দেখে বাকরুদ্ধ।
ড্রাকোনিসের চোখে তখন এক অদ্ভুত ঝলক। অনেক কিছু বলতে চেয়েও থেমে গেলেন তিনি। তার ডানপাশে দাঁড়িয়ে র*ক্তাক্ত জ্যাসপার হালকা কাত হয়ে কানে কানে বললো—
“সমস্ত প্রমাণ মুছে ফেলুন। আর সবাইকে জানিয়ে দিন— আমিই মেরেছি আলাইরাকে।”
আযদাহা সিজন ২ পর্ব ৩৬
শব্দগুলো যেন কাঁচের মতো তীক্ষ্ণভাবে ভেদ করে গেলো ল্যাবের নিস্তব্ধতা। জ্যাসপার একবারও পেছনে না তাকিয়ে ল্যাবের দরজার দিকে এগিয়ে গেলো। তার পায়ের ছাপ পড়ছে ল্যাবের মেঝেতে র*ক্তে ভেজা পদচিহ্ন হয়ে— ঠিক যেমনটা সে নিজেই রেখে যাচ্ছে নিজের ভাগ্য রচনা করে।
ড্রাকোনিস অসহায়ভাবে তাকিয়ে রইলেন ছেলের পেছনে।রাজা হিসেবে তাঁর হাতে অনেক ক্ষমতা। কিন্তু একজন পিতা হিসেবে তিনি সেই মুহূর্তে সম্পূর্ণ পরাজিত।