আত্মার আগলে পর্ব ৪১

আত্মার আগলে পর্ব ৪১
সানজিদা আক্তার মুন্নী

এহসানের হাত রক্তে ভেজা। তার আঙুলগুলো খোঁজাখুঁজি করছে এরিকের ছিন্নভিন্ন দেহের গভীরে। পেটের ডান পাশ কেটে ফেলা হয়েছে, আর সেই ক্ষতচিহ্নের মধ্য দিয়ে সে হাত ঢুকিয়েছে—কিন্তু কি খুঁজছে, তা সে নিজেও জানে না।
তার নিঃশ্বাস ভারী হয়ে আসছে, উত্তেজনায় দৃষ্টি ঝাপসা। আঙুলের ডগায় অনুভব করছে উষ্ণ, নরম কিছু—হয়তো কলিজা, নাকি ফুসফুস? প্রথমেই কি টেনে আনবে?
অবশেষে সে হিংস্রতার সঙ্গে আঙুল গেঁথে ধরে এরিকের কলিজা, প্রচণ্ড শক্তিতে ছিঁড়ে আনে সেটি!
চরম যন্ত্রণায় এরিকের গলা ফেটে চিৎকার বেরিয়ে আসে, তার শরীর কেঁপে ওঠে, তারপর ধীরে ধীরে নিথর হয়ে যায়। নিস্তব্ধতা নেমে আসে চারপাশে।
এহসান হাতের মুঠোয় ধরে থাকা রক্তমাখা কলিজার দিকে তাকিয়ে থাকে, চোখে এক অদ্ভুত দৃষ্টি—এটা কি বিজয়ের অনুভূতি, নাকি অনিশ্চয়তা?

রক্তের খেলা
তালুকদার বাড়ির উঠোনজুড়ে রক্তের স্রোত। বৃষ্টি মিশে সেই রক্ত গড়িয়ে যাচ্ছে মাটির গহীনে। এহসানের শরীর রক্তে ভেজা, তার চোখে অদ্ভুত এক উন্মাদনা। চারপাশ নিস্তব্ধ, শুধু দূর থেকে বজ্রপাতের গর্জন শোনা যায়।
তার সামনে দাঁড়িয়ে থরথর করে কাঁপছে মেহনূর। আতঙ্কে তার ঠোঁট কেঁপে যাচ্ছে, চোখ বিস্ময়ে ছানাবড়া। সামনে পড়ে থাকা এরিকের লাশ—কিন্তু সেটা আর লাশ নেই, একটা বিধ্বস্ত দেহ মাত্র। চার টুকরো হয়ে ছড়িয়ে আছে মাটিতে। কলিজা, ফুসফুস, লিভার—সব ছিন্নভিন্ন হয়ে ছড়িয়ে আছে কাদামাটিতে।
এহসান নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে আছে, যেন সে কিছুই করেনি, যেন এরিকের দেহের এই পরিণতি এক স্বাভাবিক ঘটনা। কিন্তু বাস্তবতা আরও নির্মম।
মেহনূর জানে, এরিক আগে গুলি করেছিল এহসানের বুকে। আর সেই বুক? সেই বুক ছিল তার—শুধুই তার। এহসানের কাছে সেই ভালোবাসা ছিল এক পবিত্র আমানত। কিন্তু এরিকের বুলেট সেই আমানতকে কলঙ্কিত করেছে।
এহসান ধীরে ধীরে মুখ তুলল, তার চোখ একবার এরিকের নিথর শরীরের দিকে, তারপর মেহনূরের দিকে। ঠোঁটে এক তিক্ত হাসি টেনে বলল,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

— “দেখো, প্রিয়তমা… যার জন্য তোমার আমানতের খিয়ানত হয়েছে, তার রক্ত দিয়ে আমি গোসল করেছি! বলো, তুমি খুশি তো?”
মেহনূর ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। তার চোখ দিয়ে অঝোর ধারায় কান্না ঝরছে। কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বলে উঠল,
— “নাহ! আমি খুশি নই! আমি চাই না তুমি রক্তের খেলায় মগ্ন থাকো!”
এহসান ধীরে ধীরে মেহনূরের দিকে এগিয়ে গেল। এক হাত বাড়িয়ে তার নরম গালের উপর বয়ে যাওয়া অশ্রু মুছে দিল। চোখে এক ধরনের অদ্ভুত শান্তি, যেন এই রক্তক্ষয়ী খেলা তার কাছে সত্যের প্রকাশ।
— “রক্তের খেলা রক্ত দিয়েই খেলতে হয়, প্রিয়তমা… ফয়সালা দিয়ে নয়।”
বৃষ্টি বেড়ে গেছে। বিদ্যুৎ চমকালো আকাশজুড়ে। রক্তস্নাত এক ভালোবাসা… অন্ধকার এক প্রতিশোধের গল্পের শেষপ্রান্তে দাঁড়িয়ে এহসান আর মেহনূর—একটি অস্থির রাতের সাক্ষী হয়ে…
মেহনূর কাঁপতে কাঁপতে দাঁড়িয়ে আছে, তার দৃষ্টি এহসানের রক্তমাখা হাতে আর মাটিতে পড়ে থাকা এরিকের নিথর দেহের উপর আটকে আছে।
এহসানের হাত তার দিকে বাড়িয়ে এলে মেহনূর এক ঝটকায় সরিয়ে দিয়ে বলে ওঠে—

— “সরুন! কাছে আসবেন না! আপনি আমার! কিভাবে এত নিকৃষ্ট হতে পারেন আপনি?”
এহসান তার কথা শুনে ঠোঁটের কোণে এক অদ্ভুত হাসি ফোটায়। তারপর এক ঝটকায় মেহনূরকে টেনে নেয় নিজের বুকে! একদিকে মাথার ওপর রহমতের বৃষ্টি, অন্যদিকে বুকে আঁকড়ে ধরা তার নিজের রহমত—তার আপন নারী।
এহসান মেহনূরের পিঠে আলতোভাবে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলে—
— “আমি কি তোমার কাছে আসব? আমি তো চলে এসেছি… তোমার আত্মার আগলে অবধি।”
মেহনূর এহসানের বুকে মুখ লুকিয়ে ফেলে, শক্ত করে আঁকড়ে ধরে তার ভেজা পাঞ্জাবি। অঝোরে কাঁদতে কাঁদতে বলে—
— “হ্যাঁ… তাই তো! তাই তো আমি আপনাকে ঘৃণা করতে পারি না! এত নিকৃষ্ট হওয়ার পরও আমি আপনাকে ভালোবাসি… ভীষণ ভালোবাসি!”
একটু থেমে, হঠাৎ দম বন্ধ হয়ে আসা কণ্ঠে ফিসফিস করে বলে—
— “ইস! আমি যদি আজ আপনাকে না ভালোবাসতাম, তাহলে চিৎকার করে বলতাম… কেনো এত নিকৃষ্ট আপনি? কেনো এত নিকৃষ্ট?”
— “কিন্তু আফসোস… আমি তা পারব না! কারণ
— আপনি আমার অস্তিত্ব… আর নিজের অস্তিত্বকে, নিজের আত্মাকে কখনো ঘৃণা করা যায় না!”
এই বলে মেহনূর ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে।
এহসান চোখ বুঁজে থাকে কিছুক্ষণ। এই নারীর প্রতিটি শব্দ যেন তার রক্তে মিশে যাচ্ছে, হৃদয়ে গভীর চিহ্ন এঁকে দিচ্ছে।

বৃষ্টি আরও বেড়ে যায়। এরিকের লাশ থেকে বের হওয়া রক্ত ধীরে ধীরে মাটির সাথে মিশে যাচ্ছে, শরীরের রঙ ফ্যাকাশে হয়ে আসছে। কে জানত, এত ভয়ংকর মৃত্যুর অধিকারি সে হবে!
এহসান মেহনূরের কপালে গভীরভাবে ঠোঁট ছোঁয়ায়, তারপর নিঃশ্বাস ফেলে বলে—
— “তুমি আমায় ঘৃণা করতে পারো, প্রিয়তমা… তোমার ঘৃণারই যোগ্য আমি!”
মেহনূর আরও শক্ত করে তাকে জড়িয়ে ধরে বলে—
— “না! আমি আপনাকে ঘৃণা করতে পারব না… আমি আপনাকে ভালোবাসি!”
গলাটা শুকিয়ে আসে, ঢোক গিলে বলে—
— “ভালোবাসার মানুষকে ঘৃণা করা যায় না… ভালোবাসার মানুষকে শুধুই ভালোবাসা যায়।”
— “তাই আমি আপনাকে ভালোবাসি, আমি ভীষণ ভালোবাসি আপনাকে!”
— “আপনি পাপিষ্ঠ হলেও আমি আপনাকে ভালোবাসি, আপনি নিকৃষ্ট হলেও আমি আপনাকে ভালোবাসি, আপনি হিংস্র হলেও আমি আপনাকে ভালোবাসি… আমি আপনাকে ভীষণ ভালোবাসি!”
এহসান মেহনূরের এই স্বীকারোক্তি শুনে মুচকি হাসে। এই নারী যে তাকে কত ভালোবাসে, তা সে আজ আরও গভীরভাবে বুঝতে পারে।
এক ঝটকায় সে মেহনূরকে কোলে তুলে নেয়।

— “চলো, প্রিয়তমা! আজ পুকুর ঘাটে!”
মেহনূর এহসানের বুকের সাথে লেপ্টে থাকে। সে শুধু এই বুকেই থাকতে চায়… শুধু এই পাপিষ্ঠ বুকেই!
এহসান ধীরে ধীরে পুকুরে নেমে আসে। কোমর পানিতে এসে সে মেহনূরকে নামিয়ে দেয়। বৃষ্টি মিশে যাচ্ছে ঠান্ডা পানিতে, আর তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে তারা দু’জন।
এহসান মেহনূরের ভেজা চুল সরিয়ে কানের পেছনে গুঁজে দেয়, ফিসফিসিয়ে বলে—
— “তুমি এই চাঁদনি রাতের মতোই ভয়ংকর আবেদনময়ী…, প্রিয়তমা!”
— “মন চায়, বারবার তাকিয়ে থাকি তোমার পানে… খুঁটিয়ে দেখি তোমার উপচে পড়া সৌন্দর্যের মায়াবী চেহারা!”
মেহনূর লজ্জায় চোখ নিচু করে নেয়।
এহসান মৃদু হেসে বলে—

— “তোমাকে আমি কলঙ্কে কলঙ্কিত করলাম… অথচ এই কলঙ্ককেই তুমি ভালোবেসে মুড়িয়ে দিলে!”
— “সত্যিই, নারীর মন ভয়ংকর নরম হয়, যার জলজ্যান্ত প্রমাণ তুমি, প্রিয়তমা!”
এই বলে এহসান মেহনূরের কপালে ঠোঁট ছোঁয়ায়… একবার… দুইবার… তিনবার!
মেহনূর এহসানের কোমর শক্ত করে জড়িয়ে ধরে, যেন তার অস্তিত্বের সঙ্গে একাত্ম হয়ে যেতে চায়।
এহসান মেহনূরকে শক্ত করে ধরে নেয় নিজের সাথে অতঃপর তিনবার পানির নিচে ডুবিয়ে দেয়। মেহনূর নাকানি-চুবানি খায়, তার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে।
এহসান মুচকি হেসে তাকে আবার কোলে তুলে নেয়, ধীর পায়ে উঠে আসে পানি থেকে, সোজা ঘরের দিকে হাঁটতে শুরু করে।
পথে যেতে যেতে হাসিমুখে বলে—

— “ইসস! আজ তোমার অনেক কষ্ট হয়ে যাবে… আবার গোসল করতে হবে!”
মেহনূর লজ্জায় বলে—
— “দূর! বজ্জাত পুরুষ, সবসময় এমন কেনো বলেন?”
এহসান মাথা নাড়িয়ে হেসে ওঠে।
তার সামনে তার আপন বেগম—লজ্জায় রাঙা মুখ, ভিজে শরীর, হৃদয়ে বয়ে চলা ভালোবাসার এক সাগর।
এটাই কি ভালোবাসা? নাকি ভালোবাসার নতুন এক সংজ্ঞা?
কেটে গেছে একটি সপ্তাহ, এহসান এখন সুস্থ, সুস্থ হওয়ার পরি এরিক কে এভাবে মৃত্যু দেয় সে”! মেহনূর যে তার পাশে ছায়ার মতো ছিল তাই আরও তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে উঠেছে!

এদিকে মেহরাজ সোফায় বসে ফাইল দেখছিল, হাসপাতালে। তার ফোন এশার কাছে, এশাই চালায় ওর ফোন। এশা কী খুঁজছে ফোনের মধ্যে! মেহরাজ এশাকে এমন শান্ত থাকতে দেখে এক পলক ওর দিকে তাকিয়ে মনে মনে বলে,
“জানি না, আল্লাহর কোন অশেষ দয়া ঢুকেছে এর মধ্যে যে একটু শান্ত আছে।”
বেচারা শুকরিয়া আদায় করে, যেই না চোখ ফিরাবে, তখনি টাশ করে ওর ফোন এসে ওর পাশে পড়ে!
এতে হতভম্ব হয়ে মেহরাজ একবার নিজের অসহায় ফোনের দিকে তাকায়, তো একবার নিজের শ্যামবতির দিকে, যে কী না রাগে ফুসছে।
মেহরাজ সেই অবাকের মধ্যে গৃহে থাকে। এর মধ্যে এশা সাপের মতো ফুসে এসে সেই ফোন হাতে তুলে নেয়। ভালো করে দেখে কিছু হয়েছে কি না! না, কিছু হয়নি। এশা মেহরাজের সামনে এসে ওর ফোন ধরে যেখানে স্পষ্ট মিস রিয়া বলে একজন মেয়ের WhatsApp নাম্বার। সে মেহরাজকে নিজের একটি পিক পাঠিয়ে নিচে লিখেছে,
— “স্যার, আপনি ট্যুরে গেলেন না, আমরা গেলাম!”

মেয়েটার পড়নে এক ঠাইটফিট নীল রঙের টপস, যা শরীরে সাথে বেল্টের মতো লেগে রয়েছে, আর সাদা হাঁটু অব্দি ঠাইট স্কার্ট। সারা শরীর স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। এশার ঘেন্না লাগছে।
এশা রাগে কেঁদে দেয়! মেহরাজ বেশ বুঝতে পারে, তার বেগম বেশ আঘাত পেয়েছে, কিন্তু সে এসবের কিছুই জানে না। একজন জুনিয়র ডাক্তার হিসেবে সেই মেয়েটি তার সাথে এড ছিল, কিন্তু এই মেয়ে এভাবে বাঁশ দিবে, বুঝতে পারেনি সে।
মেহরাজ বসা থেকে উঠে এশাকে কিছু বলতে যাবে, তার আগে এশা মেহরাজের কলার চেপে ধরে, এশার নখ গিয়ে মেহরাজের গলায়ও বিঁধে। মেহরাজ তাও একটি টু শব্দ করে না!
এশা কান্না ঝরিয়ে বলে,
— “যেই না আমি তোকে স্বামী হিসেবে মানতে যাচ্ছি, সেই তুই শুরু করে দিলি পরনারীর সাথে নষ্টামি!”
মেহরাজ হতবাক হয়ে যায়, কী থেকে কী বলছে এ মেয়ে! মেহরাজ ঠান্ডা মাথায় এশার থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বলে,

— “দেখো, আমার কথা বুঝো, জান!”
এশা মেহরাজকে ছেড়ে দিয়ে সোফায় বসতে বসতে কেঁদে উঠে বলে,
—“হ্যাঁ, বুঝছি ভালো করেই তো বুঝছি, দেখতেই তো পারছি, গায়ের চামড়া সুন্দরির প্রতি কত আকৃষ্ট তুমি। এত যদি অন্য নারীকে পছন্দ করো, তাহলে তালাক দাও, তালাক দিয়ে নাটক করো অন্য নারীর সঙ্গে!!”
মেহরাজ এশার সামনে হাঁটু গেড়ে বসে, এশার দুই হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বলে,
—“বিশ্বাস করো জান, ঐ মেয়ের সাথে আমার কিছু নেই, শুধু ও আমার সাথে এড আছে, এটাই।”
এশা নিজের হাত ওর থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে অগ্নিদৃষ্টি দিয়ে ওর পানে তাকিয়ে বলে,
—-“খবরদার মিথ্যা বলবি না, নয়তো গলার রগ ছিঁড়ে নিব। তোর সাথে কিছু না হলে তোকে নিজের ছবি কী করে পাঠায়, হুম? শিখাছ তুই! আমায় উস্টা খাবি, উস্টা!”
মেহরাজ এশার থেকে নিজের ফোন নিয়ে ঐ মেয়ে কে ফোন দিতে দিতে বলে,
—-“দাড়াও, আমি ফোন দিয়ে প্রমাণ করছি ঐ খবিস নারীকে!”
মেহরাজ রিয়া নামের মেয়েটিকে ফোন দেয়, কয়েকবার রিং হওয়ার পর ওপাশ থেকে উত্তর আসে,
—“জ্বি স্যার, বলুন।”

মেহরাজ দাঁত চেপে একবার এশার পানে তাকায়, তারপর শ্বাস নিয়ে বলে,
—-“তোমার সাথে আমার কি কোনো সম্পর্ক যে তুমি আমায় নিজের পিক সেন্ড করলে?”
রিয়া মেয়েটি থতমত খেয়ে বলে,
—“এমন কথা কেন স্যার? আমি তো জাস্ট ফর্মালিটির জন্য দিলাম।”
মেহরাজ এশাকে ইশারা করে, এশা শান্তির শ্বাস ফেলে, তার তো পেশার হাই হয়ে গিয়েছিল এসব দেখে!
মেহরাজ রাগি গলায় রিয়া কে বলে,
—“পরের বার থেকে যেন এমন ফর্মালিটি আমার সাথে করতে না আসো, নয়তো ব্যাপারটা বড় বিষয়ে চলে যাবে।”
রিয়া মেয়েটি থতমত খেয়ে বলে,
—“সরি স্যার, আমি আপনাকে অন্যদের মতোই ভেবেছিলাম, কিন্তু আপনি তো আপনার স্ত্রী সন্তানের প্রতি সত্যি সৎ। আমি শুনেছি, আপনি নাকি তিন সন্তানের বাবা। আমার এটা বিশ্বাস হয়নি, তাই কথা বলার ট্রাই করলাম।”
রিয়া আর কিছু বলতে পারে না, তার আগেই এশা মেহরাজের হাত থেকে ফোন নিয়ে বলে,

—“হ্যা রে কুত্তি, আমার জামাই তিন সন্তানের বাপ, আর তোর লজ্জা করে না? একটা বিবাহিত পুরুষকে নিজের দিকে আকর্ষণ করার চেষ্টা করিস? তুই যে স্টাইলে নিজের ছবি দিলি, আমি বউ হয়েও তো জীবনে আমার জামাইকে এমন ছবি দিইনি। রাস্তার মেয়ে তুই, তাই তো এমন করলি। মনে রাখিস, এই পুরুষ সব পুরুষের মতো নয়। এই পুরুষ শুধু তার স্ত্রী এশা তালুকদারের। তাই এরপর থেকে যদি দেখি আমার জামাইর সাথে লটরচটর করার চেষ্টা করছিস, তো তোকে আমি জিন্দা পুঁতে দিব। জিন্দা বলে দিলাম এই।”
এ বলেই ফোনটি কেটে দেয়। মেহরাজ এশার এমন প্রতিক্রিয়া দেখে, এশার কোলেই মুখ গুঁজে শব্দ করে হাসে! হাসতে হাসতে মুখ তুলে এশার থুতনি ধরে বলে, —“বউ, তুমি এত ভালোবাসো আমায়!”
এশা নিজের থেকে মেহরাজের হাত সরিয়ে বলে, —“ভালোবাসা কি জানি না, কিন্তু মনে রাখিও, তুমি শুধু আমার, আর আমার মৃত্যুর আগ পর্যন্ত আমার হয়েই থাকতে হবে। আমার জিনিসে আমি অন্য কারো নজর পছন্দ করি না।”
মেহরাজ ধীরে ধীরে উঠে বসে, এশার পাশে, এশার গাল টেনে বলে,

— “বউ, তুমি তো দেখি বাংলা সিনেমার রিনা খান থেকেও ভয়ংকর।”
এশা মেহরাজের দিকে ঘুরে বসে তাকিয়ে বলে
—“কথা যদি হয় নিজের জিনিসের, তো আমি ভয়ংকরের চেয়েও ভয়ংকর হতে রাজি।”
এ বলেই এশা মেহরাজের গলা জড়িয়ে ধরে, ভেতরটা ধক ধক করছিল। এতক্ষণ রাগে নিজের চুল নিজে ছিঁড়তে ইচ্ছে হচ্ছিল, কিন্তু এখন শান্তি লাগছে। এটা জেনে, এ পুরুষ শুধু তার।
মেহরাজ এশাকে শক্ত আগলে ধরে, এশার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে ওর কানে কানে বলে,
— “মনে রেখো, আমার জীবনে নারীর আগমন বলতে আমি তোমায় বুঝি, তাই সমাপ্তি অব্দি আমি তোমায় খুঁজি!”
এশা মেহরাজের ঘাড়ে শক্ত করে নিজের হাত পেচিয়ে বলে,
— “আমার জীবনের প্রথম পুরুষ তুমি, তাই আমি যে কোনো মূল্যে তোমার সাথেই থাকব, যেমন তেমন করে হলেও আমি শুধু তোমার থেকে যাব!”
মেহরাজ এশার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলে,
— “চিন্তা করো না, যত দিন বেঁচে থাকবো, ততদিন তোমার হয়ে থাকব।”
এশা নীরবে শুধু জড়িয়ে ধরে থাকে মেহরাজকে! সে এ পুরুষকে ভালোবাসুক আর না ভাসুক, কিন্তু এ পুরুষ শুধু তার, মানে তার।

মেহরুব বসে আছে নূরির পাশে ছাঁদে। নূরি লজ্জায় লাল, নীল, সাদা হয়ে যাচ্ছে, আর মেহরুব তার এই অবস্থা দেখছে।
নূরির এই অবস্থা দেখে মেহরুব হাসতে হাসতে বলে,
— ওরে আমার টুনির মা, তুই অল্পতেই যদি এভাবে লজ্জায় লাল-নীল হয়ে থাকিস, তাহলে আমি আর টুনির বাপ হবো না!
আজ সবার সামনে মেহরুব স্পষ্টভাবে বলে দিয়েছে যে, সে নূরির সাথে বাঁচতে চায়। সবাই সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছে, আগামীকাল তাদের বিয়ে হবে।
আগামীকাল বিয়ে, আর কনে-বর মিলে ছাঁদে বসে গল্প করছেন।
নূরি বেশ লজ্জিত, মনে মনে ভাবছে, মেহরুব কিভাবে এমন সোজাসাপ্টা বলেছিল!
— আমি নূরি ফুলের সাথে বাকি জীবন বাঁচতে চাই, তাই তোমরা তার আয়োজন করো।
এটা কীভাবে বলল মেহরুব এত সহজে! নূরি শুধু এটাই ভাবছে।
নূরি মাথা নিচু করে বসে, নিজের ওড়না হাত দিয়ে পেছাচ্ছে, আর লজ্জায় হাসছে।
মেহরুব তার থেকে কিছুটা দূরে সোফায় হেলান দিয়ে বসে, নূরির এই অবস্থা দেখছে।
মেহরুব হঠাৎ বলে,

— ওরে আমার টুনির মা, তুই এত লজ্জা কোথা থেকে নিয়ে আসিস?
নূরি মেহরুবের দিকে নিচু চোখে তাকিয়ে বলে,
— আপনি আমায় শুধু লজ্জায় ফেলেন, মেহরুব ভাই।
মেহরুব আলতো এগিয়ে এসে নূরির রাঙ্গা গালটি আলতো টেনে হেসে বলে,
— টুনির মা, তোর টুনির বাপ হব আমি, তাই তোকে লজ্জাও দিব আমি।
নূরি মেহরুবের হাত নিজের থেকে সরিয়ে নেয়, তারপর একটু এগিয়ে মেহরুবের দুই পা নিজের উরুর উপর কোলে রাখে। মেহরুব এর পায়ের আঙ্গুল ফুটিয়ে দিতে দিতে বলে,
— মেহরুব ভাই, একটা কথা বলি।
মেহরুব নূরির দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে,
— হুম, বল।
নূরি বলে,
— বিয়ের পর আমার পড়াশোনা নিশ্চয়ই আর করা লাগবে না, আমি পড়াশোনা করব না।
মেহরুব ভ্রু কুচকে বলে,

— পড়াশোনার দিকে তো এমনি আনডাবতী তুমি, এর মধ্যে বলছো পড়াশোনাই করবে না!
নূরি ঘাড় হেলিয়ে মেহরুবের পায়ে হাত বুলাতে বুলাতে বলে,
— না, আমি পড়াশোনা করব না, আমার ভালো লাগে না।
মেহরুব শান্ত গলায় বলে,
— দাওরা টা তো পাশ কর, আলেম নাই হলি।
নূরি মাথা দুলিয়ে বলে,
— আমি আলেম হব, আলেম হওয়ার পর ঐ সব ভার্সিটিতে ভর্তি হতে চাই না, আব্বা বলছে ভর্তি করবে, তাই আমি আগে থেকে আপনায় বলে রাখলাম।
মেহরুব মুচকি হেসে বলে,
— পড়াশোনার যে মর্মান্তিক অবস্থা, তোর আলেম হতে যে কয় জন্ম লাগবে, সেটাই আমি ভেবে কোল পাচ্ছি না।
নূরি মুখ বাঁকিয়ে বলে,
— হুম, নিজে পড়াশোনায় ভালো, তাই এত খুঁটা দিচ্ছেন। কাল থেকে পড়াশোনা ভালো করে শুরু করে দেব, দেখবেন, শুধু পড়ব আর পড়ব।
মেহরুব হেসে বলে,
— কাল তোর বিয়ে।
নূরি থতমত খেয়ে বলে,

— তো কী হয়েছে, কাল রাত থেকে পড়ব, সমস্যা কী?
মেহরুব হেসে উত্তর দেয়,
— কাল রাতে তোর বা…
মেহরুব আর কিছু বলে না, মুখে হাত দিয়ে শব্দ করে হাসে। নূরি মেহরুবের কথাগুলো বুঝতে পেরে, তার পায়ে আলতো চিমটি কাটে,
— বজ্জাত, মেহরুব ভাই!
মেহরুব নূরির কথা শুনে বলে,
— ওরে নূরি ফুল, তুই কবে বুঝবি? আমি তোর ভাই না, আমি তোর জামাই। জামাই!
নূরি মেহরুবের পায়ের পাতার দিকে তাকিয়ে হাত বুলাতে বুলাতে বলে,
— আপনি আমার মেহরুব ভাই, শুধু আমার মেহরুব ভাই।
মেহরুব হেসে বলে,
— হ্যা, আমি নূরি ফুলের মেহরুব ভাই।
মেহরুবের পায়ের টাকনু থেকে লুঙ্গি কিছুটা সরে যায়, এতে নূরির চোখের সামনে স্পষ্ট হয় মেহরুবের শ্যামবর্ণের পা। নূরি চট করে মেহরুবের দিকে তাকায় আর বলে,
— মেহরুব ভাই, আপনার মতো আমার পায়েও লোম আছে।
এ বলেই নিজের পা সোফায় তুলে, আলতো করে পড়নের সেলোয়ারটি পায়ের টাকনুর উপর তুলে দেখায়।
মেহরুব স্পষ্ট দেখতে পায় নূরির ফর্সা ধবধবে পায়ে কালো লোমগুলো এক ভয়ংকর সুন্দর লাগছে।
মেহরুব নূরিকে বলে,

— তোর পা আমার পায়ের সাথে রাখ তো।
নূরি অবাক হয়ে বলে,
— কি বলেছেন? বেয়াদবি হয়ে যাবে তো!
মেহরুব মুখ হালকা বিরক্তি নিয়ে বলে,
— ইস, বেয়াদবি হবে কেন? স্বামীর পায়ের সাথে শত নারীর স্ত্রী পা লাগবে, এটাই স্বাভাবিক। তুই রাখ তো পা।
নূরি মেহরুবের পায়ের কাছে নিজের পা রাখে। মেহরুব তাদের দুজনের পায়ের পানে তাকিয়ে থাকে, এক দৃষ্টিতে। কত বেমানান, নূরির ফর্সা পায়ের কাছে তার শ্যাম রঙের পা কত অতুলনীয় লাগছে।
মেহরুব নূরিকে ইশারা করে দেখিয়ে বলে,
— দেখ, আমাদের রঙের কী পার্থক্য! তুই আমার মতো শ্যাম পুরুষকে ভালোবাসলি কীভাবে?
নূরি সাথে সাথে নিজের পা সরিয়ে নিয়ে মেহরুবের পা আবারও নিজের কোলে নিয়ে বলে,
— ভালোবাসা রঙ দিয়ে হয় না, ভালোবাসা মন থেকে হয়। আমি আপনায় মন দিয়ে ভালোবাসি, ভীষণ ভালোবাসি। এবার আপনি দেখতে কেমন, আপনার চেহারার গঠন, তা নিয়ে আমার আপত্তি নেই। আপনি আমার শ্যাম পুরুষ, শুধু আমার। আমি এটাই জানি।
মেহরুব এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে তার নূরি ফুলের প্রতিটি কথা মন দিয়ে শুনতে থাকে। নূরি মেহরুবের দিকে অসহয় দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে,

— আমি সুন্দর বলে আপনি আমায় পছন্দ করেন না? আমার কি কালো হতে হবে আপনার হতে গেলে?
মেহরুব মুচকি হেসে নিজের পা গুটিয়ে নেয়, অতঃপর নূরির দিকে এগিয়ে এসে নূরির মাথা তার বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে বলে,
— তুই যেমন আছিস, তেমনি আমি তোকে চাই। আমি ভীষণ করে তোকে চাই, তোকে ছাড়া আমার উপায় নেই।
নূরি মেহরুবের বুকে মাথা গুঁজে বলে,
— আমরা কেমন নির্লজ্জ! দেখুন, বিয়ে কাল, আর আজ আমরা একসাথে বসে আছি।
মেহরুব মুচকি হেসে বলে,
— তুই নির্লজ্জ কি জানি না, কিন্তু আমি নির্লজ্জ! পুরুষ মানুষের আবার লজ্জা কিসের রে?
নূরি হেসে উঠে বলে,
— মেহরুব ভাই, শুনাবেন আমায় একখানা সুন্দর আয়াত কোরআন থেকে?
মেহরুব বলে,
— আচ্ছা, শুন।
এ বলে নূরির গায়ে নিজের চাদর জড়িয়ে নেয়, নূরি সোফায় দুই পা তুলে বসে, মেহরুবের কাঁধে মাথা রাখে। মেহরুবও দু পা তুলে সোফায় বসে নূরির পিঠে হাত রাখে।
অতঃপর তাউয তাসিময়া পড়ে শুরু করে…
[২৪:২৬] আন নূর

আত্মার আগলে পর্ব ৪০

الخَبيثاتُ لِلخَبيثينَ وَالخَبيثونَ لِلخَبيثاتِ وَالطَّيِّباتُ لِلطَّيِّبينَ وَالطَّيِّبونَ لِلطَّيِّباتِ أُولئِكَ مُبَرَّءونَ مِمّا يَقولونَ لَهُم مَغفِرَةٌ وَرِزقٌ كَريمٌ
দুশ্চরিত্রা নারীরা দুশ্চরিত্র পুরুষদের জন্য এবং দুশ্চরিত্র পুরুষরা দুশ্চরিত্রা নারীদের জন্য। আর সচ্চরিত্রা নারীরা সচ্চরিত্র পুরুষদের জন্য এবং সচ্চরিত্র পুরুষরা সচ্চরিত্রা নারীদের জন্য; লোকেরা যা বলে, তারা তা থেকে মুক্ত। তাদের জন্য রয়েছে ক্ষমা ও সম্মানজনক রিয্ক।
[২৪:২৭] আন নূর
يا أَيُّهَا الَّذينَ آمَنوا لا تَدخُلوا بُيوتًا غَيرَ بُيوتِكُم حَتّى تَستَأنِسوا وَتُسَلِّموا عَلى أَهلِها ذلِكُم
خَيرٌ لَكُم لَعَلَّكُم تَذَكَّرونَ
হে মুমিনগণ, তোমরা নিজদের গৃহ ছাড়া অন্য কারও গৃহে প্রবেশ করো না, যতক্ষণ না তোমরা অনুমতি নেবে এবং গৃহবাসীদেরকে সালাম দেবে। এটাই তোমাদের জন্য কল্যাণকর, যাতে তোমরা উপদেশ গ্রহণ কর।

আত্মার আগলে পর্ব ৪১ (২)