প্রণয়ের সন্ধিক্ষণে সিজন ২ পর্ব ৪৪
আদ্রিতা নিশি
অরিত্রিকা ক্রোধে ক্ষোভে জর্জরিত হয়ে সিঁড়ি বেয়ে নেমে এসে লিভিং রুমে বসা আজমল সাহেবের সামনাসামনি দাঁড়াল। পিছু পিছু ছুটে এলো সাদাত এবং ইশরা দুজনে সাথী বেগমের পাশে দাঁড়াল। সাথী বেগম দুশ্চিন্তায় পড়ে গেলেন। তিনি বুঝতে পারলেন বড়সর ঝামেলা হতে চলেছে। স্বামীর বোধ বুদ্ধিহীন কাজে বিরক্ত হলেন। এতো বড় ধেড়ে লোক হয়েছে অথচ কোনো বুদ্ধি হয়নি। মনে মনে বকতে লাগলেন। তিনি তো মেয়েকে বলতে চেয়েছিলেন বিয়ে ঠিক করে রাখার কথাটা কিন্তু স্বামীর বদমেজাজি স্বভাবের জন্য বিষয়টা চেপে গেছেন। ননদ যদি হাত ধরে অনুরোধ করে অরিত্রিকাকে পুত্রবধু করার আবদার না করতেন তিনি রাজি হতেন না। তানিয়া বেগম পায়ের ওপর পা তুলে ফুরফুরে মেজাজে বসে থাকেন। তিনি জানতেন অরিত্রিকা বাচ্চা মেয়ে হলেও তেজ, একরোখা মনোভাব, বুদ্ধিবৃত্তিক দুঃসাহস রয়েছে। কোনো অন্যায় হলে তা সহজে মেনে নেয় না। এখন দেখা যাক মেয়েটা তার বাবাকে কি বলে। ইসমা বেগম ছুটে অরিত্রিকার পাশে দাঁড়ালেন। হাত চেপে ধরে শান্ত করার প্রয়াস চালানেন। পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে বললেন ;
“ অরিত্রিকা বাবার সাথে কেউ এভাবে কথা বলে? ”
অরিত্রিকার ধৈর্যের বাঁধ ভাঙল। ম*র্মাহত কন্ঠে চিল্লিয়ে বলল ;
“ আমাকে না জানিয়ে আব্বু কেনো বিয়ে ঠিক করে রেখেছে ফুপি? তোমার ভাইকে উত্তর দিতে বলো? ”
আজমল সাহেব শব্দ করে হাতে থাকা গ্লাসটি টেবিলে রাখলেন। উঠে দাঁড়ালেন সোফা থেকে। মেয়ের এমন আচরণে বিস্মিত হয়েছেন তা মুখাবয়বে স্পষ্ট ফুটে উঠেছে। ইসমা বেগম বোঝানোর চেষ্টা করলেন ;
“ বাবা কখনো চায় না মেয়ের খারাপ হোক। তেমন তোর বাবা ও চায়নি। সে চেয়েছে তোকে সুখী দেখতে। বাড়ির মেয়েকে নিজের কাছে রাখতে। ইরফানকে তোর সুযোগ্য মনে হয়েছে তাই তোর সাথে ইরফানের বিয়ে দিতে চেয়েছে। বাবা হয়ে কী মেয়ের জন্য ভালো ভাবা ভুল? ”
“ আব্বুকে আমি শ্রদ্ধা করি এবং ভালোবাসি। তার কথামতো চলার চেষ্টা করি। তিনি আমাকে অনেক ভালোবাসেন ও স্নেহ করেন তা বুঝতে পারি। কিন্তু আমার জীবনের এতো বড় সিদ্ধান্ত নিলো অথচ আমার সিদ্ধান্ত জানার প্রয়োজনবোধ করলো না। এটা মানতে পারলাম না। ”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
“ তোর বাবা কী ভুল সিদ্ধান্ত নিয়েছে? আমার ছেলে কী খারাপ? ”
“ আব্বু নিজের একান্ত মতামত চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছে। তার সিদ্ধান্ত হয়তো আমার ভালোর জন্য ছিল কিন্তু আমি ইরফান ভাইকে পছন্দ করি কিনা আমার মতে আছে বা নেই এটা জানার দরকার ছিল। ফুপি আমি তোমার ছেলেকে খারাপ বলিনি। ইরফান ভাই ভালো মনের মানুষ। ”
“ তাহলে কেনো বললি বিয়ে করবি না? ”
“ ইরফান ভাইকে আমি ভাইয়ের নজরে দেখি। উনাকে নিজের জীবনসঙ্গী হিসেবে ভাবা আমার পক্ষে অসম্ভব। ”
অরিত্রিকা নিজের মনের গহীনে ক্ষোভ প্রকাশ করে খ্রান্ত হলো। ইসমা বেগম বাকরুদ্ধ হয়ে গেলেন। তিনি ধীর ভঙ্গিতে হাত ছেড়ে দিয়ে কিছুটা দূরে সরে দাঁড়ালেন। আজমল সাহেব মেয়ের উচ্চস্বরে চিৎকার করে কথাগুলো স্বাভাবিক ভাবে নিলেন না। সবার সামনে বেয়াদবের মতো আচরণ বরখাস্ত করলেন না। ভরাট কন্ঠে বললেন ;
“ বেয়াদবের মতো চিল্লাচ্ছো কেনো? আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি তোমার ভালোর জন্য অথচ তুমি আমাদের দিকটা না ভেবে উল্টোপাল্টা বলছো। এসব আচরণ আমি মেনে নিবো না। ”
অরিত্রিকা আরে দফা চমকে গেল। নিজের বাবার এমন আচরণ বিস্মিত করল। তবুও বলল ;
“ আব্বু তুমি তোমার সিদ্ধান্ত আমার ওপর চাপিয়ে দিতে পারো না। আমার দিকটা একটু ভেবে দেখো। ”
“ তোমার এবং আমাদের সকলের কথা চিন্তা করে সিধান্ত নিয়েছি। আমি তোমার বাবা হই। তোমার জীবনের সিদ্ধান্ত আমার নেয়ার অধিকার আছে। আজ থেকে মানসিক ভাবে প্রস্তুত হও বিয়ের জন্য। খুব শীঘ্রই তোমার এবং ইরফানের বিয়ে হবে।”
“ আমি ইরফান ভাইকে বিয়ে করবো না। ”
“ আমার সিদ্ধান্ত শেষ সিদ্ধান্ত। এর কোনো নড়চড় হবে না। ”
“ তুমি আমাকে জোর করে বিয়ে দিতে পারো না। ”
অরিত্রিকা রাগে উচ্চস্বরে চিল্লিয়ে বলল। তার কেমন সবকিছু বিষাক্ত লাগছে। তার বাবা কেন এমন করছে? আজমল সাহেব রেগে গেলেন। হাত উঁচিয়ে থাপ্পড় মারার জন্য উদ্যত হলেন। কিন্তু তখনি সাদাত দৌড়ে এসে অরিত্রিকাকে আগলে নিলো। অরিত্রিকা সাদাতের বাহু ধরে রাগে, অভিমানে কেঁদে উঠল। আজমল সাহেব রাগে রিরি করতে লাগলেন। হাত নামিয়ে গর্জন করে বললেন ;
“ আমার সিদ্ধান্তের নড়চড় হয়না। মাথার মধ্যে গেঁথে নাও তোমার বিয়ে ইরফানের সাথে হবে। ”
সাথী বেগম ফুঁসে উঠলেন। এগিয়ে আসলেন স্বামীর দিকে। তেজ দেখিয়ে বললেন ;
“ আপনি বেশী বাড়াবাড়ি শুরু করেছেন অরিনের বাবা। আমার মেয়ে ভুল কি বলেছে? আপনি অরিত্রিকাকে না জানিয়ে এতো বড় সিদ্ধান্ত নিলেন এটা কী ঠিক হয়েছে। আপনাকে আমি, ভাবি এবং ভাইসাব বুঝিয়েছিলাম। কিন্তু আপনি আমাদের কথা শোনেননি। আজকের পরিস্থিতির জন্য আপনি দায়ী। ”
আজমল সাহেব অগ্নিশর্মা দৃষ্টিতে তাকালেন স্ত্রীর দিকে। ধমকে বললেন ;
“ তুমি চুপ করো সাথী। তোমার আদরে মেয়েটা বেয়াদব হয়েছে। দেখেছো কীভাবে আমার সাথে কথা বলছে। ”
“ আমি আমার মেয়েদের নিজের সিদ্ধান্ত নিজে নিতে শিখিয়েছি। ভুল কী করেছি? ”
“ চুপ করবে তুমি। আমাকে রাগিয়ে দিও না।”
“ সত্যি কথা বললে গায়ে লাগে তাই না। ”
“ আর একটা কথা বললে তোমাকে.. ”
আজমল সাহেব দাঁতে দাঁত চেপে চাপা স্বরে বললেন। সাথী বেগম তাচ্ছিল্য করে বললেন ;
“ কী করবেন? মা*রবেন আমায়? ”
আজমল সাহেব পূর্বের ন্যায় বললেন ;
“ দরকার হলে তাই করবো। ”
স্ত্রী হয়ে স্বামীর এমন কথা শুনে থমকে গেলেন। অবিশ্বাস্য চাহনিতে তাকালেন। অশ্রুকণা ভীড় করল চক্ষু পটে। তানিয়া বেগম সোফা থেকে উঠে এগিয়ে আসলেন। সাথী বেগমকে হাত ধরে নিয়ে এসে বসালেন সোফায়। অতঃপর বিরক্তির সহিত বললেন ;
“ এসব কী ধরনের আচরণ তোমার? স্ত্রীকে সবার সামনে কেউ মা*রতে চায়? ”
আজমল সাহেব গমগমে কন্ঠে প্রতিত্তোর করলেন ;
“ ভাবী সাথীকে চুপ করে থাকতে বলুন। ”
তানিয়া বেগম কিছু বলবেন তার আগে সাদাত দৃঢ় কন্ঠে বলল ;
“ চাচী কেনো চুপ করে থাকবে? আমরা সকলে জানি আপনার এই পদক্ষেপ নেওয়া ভুল হয়েছে। বাবা হয়েছেন তাই নিজের সিদ্ধান্ত মেয়ের ওপর চাপিয়ে দিচ্ছেন এটা সম্পূর্ণ ভুল একটা কাজ। ”
আজমল সাহেব তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালেন সাদাতের দিকে। গম্ভীর কন্ঠে বললেন ;
“ ছোট হয়ে বড়দের মাঝে কথা বলতে এসো না। ”
“ বড়রা যখন ভুল করে তখন ছোটরা শুধরে দেওয়ার চেষ্টা করে। ”
“ আমি ভুল করিনি। অরিত্রিকা তোমায় বলছি, তুমি যেহেতু জেনে গিয়েছো ইরফানের সাথে তোমার বিয়ে ঠিক করেছি সেহেতু বিয়েটা খুব শীঘ্রই হবে। একটা কথা মনে রেখো, তোমার আব্বু কাউকে ওয়াদা করে তা কখনো ভাঙে না। ”
অরিত্রিকার মনে অভিমান এবং অভিযোগ জন্মালো। বাবার হৃদয়হীন নিষ্ঠুরতায় গুড়িয়ে গেল তার নরম মন। রাগ, ঘৃণায় বিষিয়ে উঠল তার ভেতরটা। কেমন যেন অসহায় মনে হলো তার। ভেতর থেকে কান্না দলা পাকিয়ে উগ্রে বাহিরে আসতে চাইল। ডুকরে কেঁদে উঠল সে। অভিমানে জর্জরিত কন্দনরত কন্ঠে চিল্লিয়ে বলল ;
“ তুমি নিষ্ঠুর কেনো আব্বু? তুমি খুব খারাপ। তুমি কেন আমায় বোঝার চেষ্টা করলেনা? কেন আমার সিদ্ধান্ত জানতে চাইলে না? কেন নিজেকে কঠিন সত্তায় আবদ্ধ করলে?
আজমল সাহেবের চোয়াল শক্ত হয়ে আসে। শক্ত কন্ঠে বলে ;
“ এতেই তোমার ভালো হবে তাই কঠিন হতে বাধ্য হয়েছি। ”
আজমল সাহেব লিভিং রুমে একমুহূর্ত দাঁড়ালেন না। গজগজ করে সেখান থেকে প্রস্থান করলেন। ইশরা দৌড়ে এসে অরিত্রিকার পাশে দাঁড়াল। সাদাত এবং ইশরা মিলে অরিত্রিকাকে বসালো সোফায়। ইসমা বেগম মন খারাপ করে সেখান থেকে প্রস্থান করলেন। সাথী বেগম থম মে*রে বসে রইলেন। নিস্পৃহ চাহনিতে তাকালেন মেয়ের কন্দনরত চেহারার দিকে। বুক ভার হয়ে এলো। দুই বছর ধরে আজমল সাহেবকে বুঝিয়েছেন তিনি। কিন্তু কোনো লাভ হয়নি। তানিয়া বেগম দীর্ঘ শ্বাস ফেললেন। এটা তো আজ বাদে কাল হওয়ার ছিলো। তিনি এগিয়ে গিয়ে অরিত্রিকার পাশে গিয়ে বসলেন। অরিত্রিকা বড়মাকে পাশে বসতে দেখে হামলে পড়ল মাতৃসমতুল্য মানুষটার বুকে শব্দ করে কেঁদে উঠে। তানিয়া বেগম দুহাতে আগলে নেয় বাচ্চা মেয়েটাকে। আদুরে ভঙ্গিতে হাত বুলিয়ে মাথায়। ইশরা অরিত্রিকার পাশে বসে। তার চক্ষুদ্বয় ছলছল করছে। এসব কেন যেন মেনে নিতে পারছে না। কান্নার শব্দ সহ্য হয় না। অরিত্রিকার মনের অবস্থা বুঝতে পারে। চক্ষুদ্বয় বেয়ে অশ্রু কণা গড়িয়ে পড়ে।
“ অরিত্রিকা কান্না করিস না মা। আমি তোর মা, বড়বাবা আছি আমাদের ওপর বিশ্বাস রাখ। আমরা তোর মতের বিরুদ্ধে বিয়ে হতে দেবো না। ”
তানিয়া বেগম শান্ত কন্ঠে বললেন। অরিত্রিকা তখনও নিঃশব্দে অশ্রু বিসর্জন দিচ্ছে। কষ্টগুলো তীব্র যন্ত্রনার সৃষ্টি করছে। অসহায় মন সারহানের অনুপস্থিতি উপলব্ধি করছে। তার কল্প পুরুষ যদি থাকতো তাহলে হয়তো কোনো সুরাহা করতে পারতো। সেই শূন্য স্থান যেন ভেতরে ভেতরে পোড়াতে লাগল। সারহান ভাই কী জানে তার অগোচরে রয়ে যাওয়া তিক্ত কথাটা? হয়তো জানে। কারণ সে এই মুহুর্তে বুঝতে পারছে সারহানের বলা হেঁয়ালিপূর্ণ কথার মানে। জেনেও মানুষটা কীভাবে শান্ত আছে? তার কথা কি সেসময়ে একবারও মনে পড়েনি? হৃদয় পোড়েনি? দাম বন্ধ হয়ে আসেনি? সেসব ভাবনা মনের মাঝে চাপা রয়। অরিত্রিকা নিরব চিত্তে পড়ে রয় তানিয়া বেগমের বক্ষে। কান্না থেমে এসেছে প্রায়। ভেজা কন্ঠে অস্ফুট স্বরে শুধায় ;
“ বড় মা তোমার বড় ছেলে কখন আসবে? ”
তানিয়া বেগমের কপাল কুঁচকে যায়। আগ্রহী হয়ে বলে ;
“ কেনো? ”
“ এমনি। একটা কথা জিজ্ঞেস করবো? ”
“ কর। ”
“ সারহান ভাই কী জানতো আব্বু ইরফান ভাইয়ের সাথে আমার বিয়ে ঠিক করে রেখেছে? ”
কথাটা বলতে অরিত্রিকার কন্ঠনালী কেঁপে উঠল। তানিয়া বেগম স্বাভাবিক ভাবে বললেন;
“ হ্যা জানতো। দুইবছর আগে যখন তোর বাবা এবং ফুপি তোদের বিয়ে ঠিক করল। তখন আমি, তোর বড়বাবা আর সারহান সেখানে উপস্থিত ছিলাম। ”
অরিত্রিকার মন ভার হয়ে এলো। চক্ষুদ্বয় বন্ধ করে নিলো তৎক্ষনাৎ। পুনরায় কাঁদতে ইচ্ছে করল। অভিমানের বুদ হয়ে গেল সে। অভিমান মিশ্রিত কন্ঠে বিরবির করে আওড়ালো ;
“ বড় মা তোমার বড় ছেলে হার্টলেস। উনি কীভাবে পারলেন এমনটা হতে দিতে? আমার কথা কেন একবারও ভাবলেন না। তোমার ছেলে ভালো না বড় মা… ”
অরিত্রিকার বন্ধ চক্ষুদ্বয় হতে অশ্রু কণা গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়তে লাগল। তানিয়া বেগম কি শুনলেন মেয়েটার অভিমানের স্বরে বলা অভিযোগ?অরিন কিছুক্ষণ আগে লিভিং রুমে এসেছে। এতোক্ষণ ঘটে যাওয়া ঘটনা বুঝতে সক্ষম হয়েছে। বাবার এমন নির্বোধ কর্মে সে বিরক্ত হয়েছে। বাবা হয়ে মেয়ের মতের বিরুদ্ধে বিয়ে দেওয়ার লজিক খুঁজে পেলো না সে। সে এগিয়ে এলো অরিত্রিকার দিকে। মনটা বেশ ভারাক্রান্ত।
“কল্লোল ফাউন্ডেশনের বিরুদ্ধে অর্থ লোপাট ও একাধিক ব্যক্তির নিখোঁজ হওয়ার মতো গুরুতর অভিযোগের প্রমাণ পাওয়া গেছে। প্রতিনিয়ত বেড়ে চলেছে দুর্নীতির পরিমাণ। অথচ এই প্রতিষ্ঠানটির কার্যক্রম সরাসরি সরকারের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হতো। তাহলে প্রশ্ন ওঠে বিগত দুই বছরে এসব অনৈতিক কর্মকাণ্ড প্রশাসনের নজরে এলো না কেন? নাকি ইচ্ছাকৃতভাবে তা উপেক্ষা করা হয়েছে? প্রতিষ্ঠানটির মালিক ও একাংশ কর্মকর্তা-কর্মচারী যখন লাপাত্তা তখন সরকারের নীরবতা কি এই সন্দেহকে আরও জোরালো করছে না যে উচ্চপদস্থ কিছু নেতা ও মন্ত্রী হয়তো এর সঙ্গে জড়িত? আর তাই কি এখনো পুলিশ কোনো কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করছে না?”
রাজশাহী শহরের দলীয় পার্টি অফিসের একটি কক্ষে আজ অনুষ্ঠিত হচ্ছে জরুরি প্রেস ব্রিফিং। ঘরজুড়ে টানটান উত্তেজনা বিভিন্ন জাতীয় ও স্থানীয় সংবাদমাধ্যমের প্রতিনিধি ও সাংবাদিকবৃন্দ ইতোমধ্যেই নির্ধারিত চেয়ারে বসে পড়েছেন। সামনে একটি অস্থায়ী স্টেজ সাজানো হয়েছে।যার ঠিক মাঝখানে রাখা রয়েছে একটি টেবিল, টেবিলের ওপরে সংবাদমাধ্যমের মাইক্রোফোন ও মাউথপিস সারিবদ্ধভাবে স্থাপিত।
স্টেজের কেন্দ্রে গাম্ভীর্যপূর্ণ ভঙ্গিতে বসে আছেন সদ্য নির্বাচিত রাজশাহী ১ আসনের সংসদ সদস্য সারহান ইদায়াত চৌধুরী। তার ডান পাশে বসে রয়েছেন এই আসনের প্রাক্তন সংসদ সদস্য আজাদ রহমানসহ আরও কয়েকজন অভিজ্ঞ ও উচ্চপদস্থ দলীয় নেতা। সারহানের মুখে দায়িত্ববোধের ছাপ স্পষ্ট। কল্লোল ফাউন্ডেশন ট্রাজেডি ও সাম্প্রতিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে তিনি সরাসরি মুখোমুখি হচ্ছেন সাংবাদিকদের জিজ্ঞাসার।স্টেজের নিচে চোখ-কান খোলা রেখে দাঁড়িয়ে আছে দুজন আবির ও ইনান। আবিরের দৃষ্টি ছুটে চলেছে সারাক্ষণ চারপাশে আর ইনান নিঃশব্দে কিন্তু কড়া নজরে গোটা পার্টি অফিস চত্বরের নিরাপত্তা নিশ্চিত করছে।
সারহান মনোযোগ দিয়ে সংবাদকর্মীর প্রশ্ন শুনলো। অতঃপর কন্ঠে দায়িত্বশীল এবং সংযম নিয়ে বলল ;
“কল্লোল ফাউন্ডেশন নিয়ে উত্থাপিত অভিযোগগুলো অত্যন্ত গুরুতর এবং উদ্বেগজনক। একজন সংসদ সদস্য হিসেবে আমি জনগণের প্রশ্নকে সম্মান করি এবং আপনাদের দৃষ্টান্তমূলক সচেতনতার প্রশংসা করি। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি আইনের ঊর্ধ্বে কেউ নয়, সে যত বড় প্রতিষ্ঠানের মালিকই হোক না কেন।
সরকারি পর্যবেক্ষণে থেকেও যদি এই ধরনের অনিয়ম ঘটে থাকে তবে সেটি নিঃসন্দেহে আমাদের ব্যর্থতা এবং এর জন্য দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে অবশ্যই কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। আমি নিজে ব্যক্তিগতভাবে বিষয়টি নিয়ে সংসদে আলোচনা তুলব এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে দ্রুত তদন্ত ও জবাবদিহিতার আওতায় আনার দাবি জানাব।আমরা চাই না কোনো নিরীহ মানুষ নি/খোঁজ থাকুক, কোনো টাকার অপচয় হোক কিংবা জনগণের বিশ্বাসকে কেউ পুঁজি করে বেআইনি কার্যকলাপ চালাক। সত্য উন্মোচিত হবেই এটাই আমার বিশ্বাস। আপনারা পাশে থাকুন, প্রশ্ন তুলুন, আমরা জবাবদিহি নিশ্চিত করবো।”
সংবাদকর্মী সন্তুষ্ট হলেন। তিনি বসে পড়লেন নিজ চেয়ারে। আরেকজন সংবাদকর্মী দাঁড়ালেন এবং প্রশ্ন করলেন ;
“ তাহলে কবে কল্লোল ফাউন্ডেশনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে? ”
সারহান দৃঢ় কন্ঠে প্রশ্নের জবাব দিলো ;
“আপনার উদ্বেগ একদম যৌক্তিক। আমি আপনাকে আশ্বস্ত করতে চাই বিষয়টি ইতিমধ্যে সংশ্লিষ্ট তদন্ত সংস্থার নজরে এসেছে। তবে একটি পূর্ণাঙ্গ তদন্ত ছাড়া সরাসরি ব্যবস্থা গ্রহণ করলে সত্য আড়াল হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। আমরা চাই যেন নিরপেক্ষ স্বচ্ছ ও প্রমাণভিত্তিক তদন্তের মাধ্যমে প্রকৃত দোষীদের চিহ্নিত করা যায় এবং তাদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হয়।তদন্তের অগ্রগতি আমি নিজে পর্যবেক্ষণ করবো এবং সংসদে নিয়মিতভাবে বিষয়টি উত্থাপন করব। জনগণের স্বার্থে কোনো ধরনের গড়িমসি বরদাশত করা হবে না। আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন, সত্য গোপন থাকবে না প্রয়োজনে আমরা প্রশাসনিক চাপও সৃষ্টি করব যাতে ব্যবস্থা গ্রহণ বিলম্বিত না হয়।”
সংবাদকর্মী উত্তর পেয়ে বসে পড়লেন। আরেকজন সংবাদকর্মী দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করলেন;
“ সুষ্ঠ বিচারের অপেক্ষায় আছি আমরা। কিছুদিন পূর্বে ভোট হয়েছে এবং ভোটে আপনি জয়ী হয়েছেন। রাজশাহী শহর নিয়ে আপনার পরিকল্পনা কী? ”
সারহান বিচক্ষণতার সহিত উত্তর দিলো;
“আপনাদের আস্থা ও ভালোবাসায় আমি নির্বাচিত হয়েছি। এজন্য কৃতজ্ঞতা জানাই। রাজশাহী শহর শুধু একটি প্রশাসনিক কেন্দ্র নয়। এটি আমাদের ইতিহাস, সংস্কৃতি, এবং শিক্ষার প্রাণকেন্দ্র। এই শহরের উন্নয়ন মানে গোটা উত্তরবঙ্গের উন্নয়ন।আমার পরিকল্পনার প্রথম ধাপ সুশাসন প্রতিষ্ঠা ও দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসন নিশ্চিত করা। পাশাপাশি রাজশাহীর অবকাঠামো উন্নয়ন, স্বাস্থ্যসেবা ও শিক্ষাব্যবস্থার মানোন্নয়ন আমার অগ্রাধিকার। আমরা টেকসই নগরায়ণের ওপর জোর দেব, যাতে নাগরিকদের মৌলিক সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত হয়।তরুণদের কর্মসংস্থানের জন্য নতুন প্রকল্প হাতে নেওয়া হবে এবং রাজশাহীকে একটি ‘উদ্ভাবনী শহর’ হিসেবে গড়ে তোলার উদ্যোগ গ্রহণ করব। আপনারা পাশে থাকুন, সহযোগিতা করুন রাজশাহীকে আমরা গড়ব আধুনিক, সুশৃঙ্খল ও মানবিক নগরী হিসেবে।‘সুষ্ঠু বিচারের অপেক্ষায় আছি’এই বাক্যটির প্রতি আমি পূর্ণ সম্মান রেখেই বলছি এবং আমি কথা দিচ্ছি, ন্যায়বিচার যেন কোনোদিন অপেক্ষার নাম না হয়।সেটিই হবে আমার কাজের মূল অঙ্গীকার। আপনাদের আর কোনো প্রশ্ন থাকলে করতে পারেন।”
সংবাদকর্মীরা আর কোনো প্রশ্ন করলো না। সবাই চুপচাপ বসে রইল। সারহান তা দেখে সৌজন্য বজায় রেখে বলল ;
“ আপনাদের আর কোনো প্রশ্ন নেই তাই প্রেস ব্রিফিং এখানে সমাপ্তি ঘোষণা করছি। সবাই ভালো থাকবেন। আসসালামু আলাইকুম। ”
সারহান স্টেজ থেকে নেমে গেল। কক্ষ থেকে বেড়িয়ে নিজে নিজের নির্ধারিত রুমে গেল। আবির তাদের দলের নেতাকর্মীদের আরেকটা রুমে নিয়ে গিয়ে বসার ব্যবস্থা করলেন। ইনান এবং তার কয়েকজন সহযোগী সংবাদ কর্মীদের নাস্তার ব্যবস্থা করল।
“সারহান আজাদ সাহেব তোর সাথে একান্তে কথা বলতে চান। ”
সারহান পার্টি অফিসের নিজের নির্ধারিত রুমে এসে বসেছিল মাত্র। এর মাঝে আবির এসে কথাটি বলাতে দীর্ঘ শ্বাস ফেলল। সে সরাসরি তাকালো আবিরের দিকে। গম্ভীর কন্ঠে বলল ;
“ উনাকে বসতে বল আমি আসছি। তোর কাছে আমার ফোন ছিলো দে। ”
আবির নিজের প্যান্টের পকেট থেকে সারহানের ফোন বের করে টেবিলে রাখল। সারহান ফোনটা হাতে নিয়ে অন করতেই দেখল “MY SECRET AMBROSIA ” নামটা জ্বলজ্বল করছে। পাঁচটা পাঁচ মিনিট থেকে পাঁচটা দশ পর্যন্ত তেরোটা মিসড কল উঠে আছে। হঠাৎ কেন অরিত্রিকা তাকে কল করল বোধগম্য হলো না। সে দৃষ্টি উঁচিয়ে আবিরের দিকে তাকাল। স্বাভাবিক ভাবে জিজ্ঞেস করল ;
“ অরিত্রিকা কল দিয়েছিল খেয়াল করিসনি? ”
আবির মৃদু হেসে বলল ;
“ খেয়াল করেছি। কিন্তু তুই বিজি ছিলি তাই ফোন তোকে দিইনি আর নিজেও রিসিভ করিনি। অরিত্রিকা তোকে ভেবে আমায় যদি উল্টা পাল্টা কিছু বলে দিতো তখন আমার কি হতো? ”
“ নাটক কম কর। ”
“ সত্যি কথা বললে নাটক হয়ে যায়। আমার বউটা যেমন ঠিক তুইও তেমন। ”
সারহান কিছু বলল না। সে অরিত্রিকাকে কল দিবে এমন সময় দেখল সেই নাম্বার থেকে কল এসেছে। সে দ্রুত রিসিভ করল কল। অতঃপর কানে গুঁজে শান্ত কন্ঠে বলল ;
“ সারহান স্পিকিং। ”
ফোনের ওপর পাশ হতে কোনো কথা শোনা গেল না। শুধু ফুপিয়ে কেঁদে উঠার শব্দ পেল। সারহান থমকে গেল। বিচলিত কন্ঠে বলল ;
“ হোয়াট হেপেন্ড বিবিজান? কাঁদছো কেনো? ”
কান্নার গতি বাড়ল যেন। সারহান উদ্বিগ্ন হয়ে গেল। চেয়ার ছেড়ে দাঁড়িয়ে গেল। পুনরায় একই ভঙ্গিতে বলল ;
“ এই মেয়ে কথা বলো। কি হয়েছে? ”
ফোনের ওপর পাশ হতে ভেসে এলো মেয়েলী করুণস্বর।অরিত্রিকা কন্দনরত কন্ঠে থেমে থেমে বলল ;
“সারহান ভাই, আপনি কোথায়? প্লিজ দ্রুত বাড়িতে ফিরে আসুন। আমার খুব কষ্ট হচ্ছে। দমবন্ধ হয়ে আসছে। শুনতে পাচ্ছেন না? আপনার সেই ‘না হওয়া’ বিবিজান এই মুহূর্তে অসহ্য যন্ত্রণা সহ্য করতে পারছে না।আমি সত্যিই আপনাকে হারাতে পারবো না একটুও না। দ্রুত বাড়ি আসুন নেতা সাহেব ।”
উদভ্রান্তের ন্যায় এতটুকু বলে অরিত্রিকা কেটে দিল। সারহান স্তম্ভিত হয়ে গেল। সে ফোন কান থেকে নামিয়ে পকেটে রাখল। উদ্বিগ্ন এবং উত্তেজিত হয়ে উঠল তার মন। মস্তিষ্ক সচল হয়ে গেল। বুঝতে সময় লাগল না বাড়িতে কী ঘটেছে। সে বিচলিত হয়ে আবিরকে বলল ;
প্রণয়ের সন্ধিক্ষণে সিজন ২ পর্ব ৪৩
“ এদিকটা সামলে নিস আর আজাদ সাহেবকে বলিস আগামীকাল কথা বলবো উনার সাথে। আমাকে আর্জেন্ট বাড়ি যেতে হবে। ”
কথাটা শেষ করে চিন্তাগ্রস্ত বদনে শাণিত পায়ে বেড়িয়ে গেল রুম থেকে। আবিরও ছুটে গেল পিছু পিছু।