প্রণয়ের সন্ধিক্ষণে সিজন ২ পর্ব ৪৭

প্রণয়ের সন্ধিক্ষণে সিজন ২ পর্ব ৪৭
আদ্রিতা নিশি

“ সামান্য বিষয় নিয়ে ঝগড়া করো না তো! ”
“ দুই চারটা মন খুলে কথা বলেছি তাতেই ঝগড়া হয়ে গেল? ”
“ তুমি আপাতত থামো। তোমার ছেলে কেন এসেছে শুনি তারপর আবার ঝগড়া করব রাতভর। ”
“ আপনি আবার বলছেন ঝগড়া করছি! ”
তানিয়া বেগম কটমট করে তাকিয়ে ক্ষুব্ধ হয়ে বললেন। আরশাদ সাহেব হতাশ হলেন। প্রাণ প্রিয় অর্ধাঙ্গিনীর রাগাশ্রয়ী মুখশ্রী দেখে দমে গেলেন। ইচ্ছে না হলো এ মুহুর্তে কথা বাড়াতে। বুড়ো বয়সে এসে স্ত্রী অবুঝের ন্যায় আচরণ করলে কেমন যেন অদ্ভুত লাগে। তিনি হতাশামূলক শ্বাস ফেললেন। স্ত্রীর দিকে শান্ত চাহনিতে তাকিয়ে স্বাভাবিক ভাবে বললেন ;

“ আচ্ছা স্যরি। ”
তানিয়া বেগম বিস্মিত হলেন। রাগান্বিত ভঙ্গিমা পরিবর্তন হলো। পরক্ষণে হেসে বললেন ;
“ অবশেষে স্বীকার করলেন ঝগড়া করে ভুল করেছেন। আমি নরম মনের মানুষ তাই এবারের মতো ক্ষমা করে দিলাম চৌধুরী সাহেব। ”
আরশাদ সাহেব মুখ ভার করে বিরবির করে বললেন ;
“ বড্ড উপকার করলেন বিবি সাহেবা। ”
“ তোমাদের ঝগড়া শেষ হলে আমি একটা কথা বলতে চাই। ”
সারহান দীর্ঘ সময় ধরে মা – বাবার মিষ্টি ঝগড়া উপভোগ করছিল। সরাসরি উপভোগ্য ঝগড়া শুনতে মন্দ লাগেনি । বরঞ্চ অন্যরকম ভালোলাগা কাজ করেছে অন্তঃস্থলে। ছোট থেকে বাবা মায়ের এমন ঠুকঠাক লেগে যাওয়া বাকবিতন্ডায় বরাবরই নিরব দর্শক সে। চুপচাপ ভদ্র ছেলের ন্যায় দেখতো আর সকলের অগোচরে হাসত। কারণ ঝগড়া তেমন গুরুতর ছিল না। তবুও দুজনে ঝগড়া করতেন এবং তার বাবা সবসময় মায়ের রাগ ভাঙানোর জন্য ভুল স্বীকার করতেন। কিন্তু যখন সে বড় হলো প্রাণোচ্ছল ভাবটা কোথাও মিলিয়ে গেল। ভেতরটা কেমন গম্ভীর হয়ে উঠল। ধীরে ধীরে মানুষদের সাথে মেলামেশা করতে লাগল। দুরত্ব বাড়ল পরিবারের থেকে। তাই বাড়িতে কি হচ্ছে সেসব খবর তেমন রাখতো না।
তানিয়া বেগম ছেলের কথা শুনলেন। আদুরে ভঙ্গিতে বললেন ;

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“ বল আব্বা। ”
আরশাদ সাহেব পা মেলে আধশোয়া হয়ে বসে ছিলেন। এবার দু’পা গুটিয়ে বিছানায় সোজা হয়ে বসলেন। চশমা ঠেলে বললেন ;
“ নিশ্চয়ই রাজনৈতিক বিষয় নিয়ে বলবে। চুপ করে না থেকে বলে ফেলো। ”
সারহান আয়েশ করে বসল। তির্যক দৃষ্টিতে তাকিয়ে গম্ভীর উত্তর দিল ;
“ আমি কোনো রাজনৈতিক বিষয় নিয়ে কথা বলতে আসিনি, ইমপোর্টেন্ট বিষয় নিয়ে কথা বলতে এসেছি। ”
“ ইমপোর্টেন্ট বিষয়!”
“ জ্বী। ”
“ ইমপোর্টেন্ট বিষয় বলতে কী বোঝাতে চাইছো?”

আরশাদ সাহেব ভ্রুযুগল কুঞ্চন করে অধীর আগ্রহে জানতে চাইলেন। তিনি যে আশ্চর্যিত হয়েছেন তা ধরা দিলেন না বরং সাবধানে চেপে গেলেন। ভাবতে লাগলেন বড় ছেলে হঠাৎ ব্যক্তিগত কথা কেন বলতে চাইছে? কখনো ব্যক্তিগত বিষয়ে নিজ মর্জি ছাড়া একধাপ দেয় না যে ছেলে! আজ সেই ছেলে নিজ থেকে এসেছে ব্যক্তিগত বিষয় শেয়ার করতে! তানিয়া বেগম সারহানের চাল চলন লক্ষ্য করছেন। ছেলেটার ভাবভঙ্গি এবং মুখাবয়ব অস্বাভাবিক গম্ভীর। তিনি বুঝতে পারলেন হয়তো সিরিয়াস কিছু ঘটেছে। তবে কী ছেলের পছন্দ করা মেয়েটার বিয়ে হয়ে যাচ্ছে? তাই ছুটে এসেছে বাবাকে বলতে? কিন্তু ছেলে তো ওমন ধাঁচের নয়। নিজের ব্যক্তিগত সকল সমস্যার সমাধান করতে জানে। তাহলে কী এমন বিষয় যা তাদের বলতে এসেছে? তিনি চিন্তিতগ্রস্থ হলেন। ছেলেকে উদ্দেশ্য করে উদ্বিগ্ন হয়ে বললেন ;

“ আব্বা, কী হয়েছে বল। মেয়েটার কী বিয়ে হয়ে গেছে? তাই আমাদের বলতে এসেছিস। তোকে সেদিন বললাম মেয়েটাকে তুলে নিয়ে তারপর সবকিছু আমি দেখে নেবো। সেসব কথা তো শুনলি না। বল আমার হবু বউমার কি বিয়ে হয়ে গেছে?”
সারহান মায়ের উদ্বিগ্ন ভাব দেখে এবং কথার ধরণ দেখে বিব্রতবোধ করল না। বরং স্বাভাবিক রইল। পুরূ কন্ঠে বলল ;
“ বিয়ে হয়নি এখনো। ”
“ তাহলে চুপ করে বসে আছিস কেনো? বিয়ে হয়ে যাওয়ার অপেক্ষা করছিস? যদি তুলে নিয়ে না আসতে পারিস আমাদের মেয়ের বাড়ির ঠিকানা বল আমি আর তোর বাবা বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে যাব। শোন আব্বা, যদি তোর হবু শশুড় আমাদের প্রস্তাব না মানেন তাহলে অন্য পন্থা অবলম্বন করব। বেয়াইকে অচেতন করে আমি এবং চৌধুরী সাহেব বউ মা কে তুলে নিয়ে আসব। ”

সারহান স্তম্ভিত হলো এহেন কথা শ্রবণ হতে। নিষ্পলক হতবুদ্ধির ন্যায় তাকিয়ে রইল মায়ের বুদ্ধির ধরণ দেখে। কেন যেন মনে হলো তানিয়া বেগমের মাঝে মাফিয়াদের মতো সাহস আছে । সে থমকিত দৃষ্টি স্থির করল বাবার পাণে। আরশাদ সাহেব নিষ্পাপ ভঙ্গিতে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছেন। স্ত্রীর কথাগুলো শুনে একদফা চমকে গেছেন তা স্পষ্ট এবং প্রমাণিত। ঠাওর করতে পারছেন না মেয়ে ঘটিত জটিলতার উৎপত্তি কোথায়? স্ত্রী এবং সন্তান কোন মেয়েকে নিয়ে কথা বলছে? কে সেই মেয়ে যাকে সকলের অগোচরে তুলে আনার প্লান করছে স্বয়ং এমপির মা। অতিব আশ্চর্যের বিষয়। লোকজন যদি জানতে পারে এসব কথা তাহলে তো হয়েছে। তিনি এমুহূর্তে স্ত্রীর গুন্ডী রুপে থমকেছেন। তিনি মোটেও এমন রুপের সাথে পরিচিত নন। আবার অচেনা মেয়েকে তুলে আনার জন্য তার মতো ভোলাভালা, নির্ভেজাল মানুষকে টানছে? এই বুড়ো বয়সে বউয়ের খপ্পড়ে পড়ে কী তবে মেয়ে উঠিয়ে আনতে হবে? ভেবেই মাথাটা চক্কর দিয়ে উঠল। তটস্থ ভঙ্গিতে শব্দ করে নড়েচড়ে উঠলেন। মিনিট দুয়েক স্থির থেকে গমগমে জিজ্ঞেস করলেন ;

“ কোন মেয়েকে তুলে আনার কথা বলছো তোমরা? কে সে, কীসের বিয়ে? ”
তানিয়া বেগম ভ্রু বাঁকিয়ে সূঁচালো দৃষ্টি নিবদ্ধ করলেন স্বামীর পানে। দৃঢ় কন্ঠে বললেন ;
“ তোমার বড় ছেলের হবু বউয়ের আর আমাদের হবু পুত্রবধূর কথা বলছি। ”
“ পুত্রবধূ মানে? ”
“ তোমার ছেলে একটা মেয়েকে ভালোবাসে। বিয়ে করতে চায় কিন্তু মেয়েটার আরেক জায়গায় বিয়ে ঠিক হয়েছে। তাই আমি আপনার ছেলেকে বুদ্ধি দিয়েছি মেয়েটিকে তুলে আনার জন্য। ”
“ বাহ বাহ, কী বুদ্ধিমতী স্ত্রী আমার। ছেলে পছন্দ করে তাই তুলে আনার বুদ্ধি দিচ্ছে। এমন মা তো ঘরে ঘরে দরকার। ”
আরশাদ সাহেব স্ত্রীর ওপর ক্ষিপ্ত হলেন। ছেলের দিকে তাকিয়ে সরাসরি জিজ্ঞেস করলেন ;
“ তোমার মা যা বলছে সব সত্যি? ”
সারহান দু’দিকে মাথা নাড়িয়ে নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে বলল ;
“ জ্বী। ”

“ তোমার মতো অনুভূতিহীন, গম্ভীর মানুষের দ্বারা কোনো মেয়েকে কীভাবে ভালোবাসা সম্ভব? আশ্চর্যের বিষয়। যাই হোক, একটা মেয়েকে ভালোবাসো, তুলে আনতো চাও। এসব প্ল্যানিং প্লটিং করছো অথচ বাপ হয়ে কিছু জানি না আমি। সেসব চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলো। মেয়ের বাবার সাথে কথা না বলে চুপচাপ বসে থাকার থাকার ছেলে তুমি নও এটা আমরা জানি। তাহলে চুপ করে থাকার কারণ কী? ”
“ আমার মতো অনুভূতিহীন, গম্ভীর মানুষের কী মন বলতে কিছু নেই? বাবা হয়ে সন্দেহ করছেন। অদ্ভুত! শুনুন বাবা, হবু শশুড় আপনার মতো ঘাড়ত্যাড়া। তাই ভাবলাম আপনার মতো ঘাড়ত্যাড়া মানুষকে দিয়ে আরেক ঘাড়ত্যাড়াকে প্রস্তাবখানা পাঠানোর ব্যবস্থা করি। যদি তিনি না মানেন তখন অন্য পন্থা অবলম্বন করব। ”
“ আমাকে অপমান করছো বেয়াদব ছেলে। ”
আরশাদ সাহেব চোখ মুখ খিঁচে তিরিক্ষি মেজাজে বললেন। সারহান বাবার এহেন আচরণে অভ্যস্ত। মানুষটা যে সুযোগ বুঝে কথা শুনাচ্ছেন তা বুঝতে বিলম্ব হলো না। সে বাঁকা হাসল। হাসি বজায় রেখে বলল ;

“ আপনি আমার কথা মানবেন কিনা বলুন। ”
আরশাদ সাহেব রুষ্টিত চাপা স্বরে বললেন ;
“ মেয়েটার বিয়ে ঠিক হয়েছে জেনে আমার ইচ্ছা নেই বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে যাওয়ার। ”
তানিয়া বেগম স্বামীর আচরণে বিরক্ত হলেন। ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন হলো তৎক্ষনাৎ। তেঁতে উঠে বললেন;
“ যেহেতু পারবেন না প্রস্তাব নিয়ে যেতে তাহলে চলুন মেয়েকে আজ রাতে তুলে নিয়ে আসবো। ”
“ বুড়ো বয়সে ছেলের পছন্দ করা মেয়েকে তুলে আনতে গিয়ে মা’র খেয়ে সম্মান হারাতে চাই না আমি। তুমি একা যেতে চাইলে যেতে পারো আমি বাঁধা দেব না। ”
“ আপনি ভীতুর ডিম চৌধুরী সাহেব। ”
“ আর তুমি বুদ্ধির ঢেঁকি। ”

তানিয়া বেগম রাগান্বিত দৃষ্টিতে তাকালেন। আরশাদ সাহেব চুপ হয়ে গেলেন। স্ত্রীর রণমুর্তি চাহনিতে খানিকটা ভয় পেলেন কিন্তু প্রকাশ করলেন না। তিনি ঘাড় বাঁকিয়ে সারহানের দিকে তাকালেন। গমগমে কন্ঠে বললেন ;
“ শোনো , তোমার কথা মানতে রাজি নই আমি। ”
সারহান ক্রূর হাসল। আরশাদ সাহেব ছেলের হাসি দেখে ভড়কে গেলেন। তা স্পষ্ট ধরা দিল তীক্ষ্ণ চোখ জোড়ায়।কন্ঠে ক্রূরতা বজায় বলল ;
“ আপনি সহজে কথা মানার মানুষ নন আমি জানি। তবুও ভালোভাবে বললাম। কিন্তু আপনি মানলেন না। কোনো ব্যাপার না! আমি নিজের রাস্তা ক্লিয়ার করে নেব। তখন আফসোস করবেন না।”
“ তাহলে আমার কাছে কেন এসেছো? নিজের রাস্তা নিজেই ক্লিয়ার করে নাও। ”
“ বাবার দায়িত্ব পালন করার সুযোগ দিতে এসেছিলাম। কিন্তু আপনি তো পালন করলেন না। উমম আরো সিক্রেট কিছু কথা বলার ছিল?”

“ সিক্রেট! কী বলবে বলো। ”
“ মেয়ে এবং মেয়ের বাবা কিন্তু আপনার পরিচিত। ”
আরশাদ সাহেব বিস্মিত হলেন। কপালের মধ্যাংশ বরাবর কয়েকটা ভাজ পড়ল। কৌতুহল বশত জিজ্ঞেস করলেন ;
“ মেয়ের এবং মেয়ের বাবার নাম কী?”
সারহানের ওষ্ঠ প্রসারিত হয়। ওষ্ঠ জুড়ে চমৎকার হাসি। সচরাচর প্রাণখোলা হাস্যরত মুখাবয়বের দেখা মিলে না। ক্ষীণ সময়ের অভিব্যক্তি খানিকটা দৃঢ় এবং গাঢ়। সময় অপচয় করে না সে। কন্ঠে স্বভাবসিদ্ধ রুক্ষতা ঢেলে বলল ;
“ মেয়ের নাম অরিত্রিকা ফাইরুজ চৌধুরী এবং মেয়ের বাবার নাম আজমল চৌধুরী। ”

নিস্তব্ধতায় মোড়া চার দেয়ালের বেষ্টিত রুম। পিনপিনে নিরবতা বিরাজ করছে। রুমের ভেতর তিনটি প্রাণের অস্তিত্ব। প্রতিধ্বনিত হচ্ছে ঘন ঘন নিঃশ্বাসের ধ্বনি। কারো কন্ঠনালী হতে কথা বের হচ্ছে না যেন কন্ঠনালী নিমেষে রোধ হয়ে গেছে। তানিয়া বেগম ছেলের মুখে উক্ত বোমার ন্যায় কথাটি শুনে স্তব্ধ হয়ে গেছে। ভঙ্গিমা নির্বাক। নিগূঢ় অন্ধকারে যেন ঢেকে গেছে মুখ।চক্ষুদ্বয়ে বিস্ফোরিত দৃষ্টি স্থির ছেলের পানে। ঘন্টা খানেক পূর্বে স্বাভাবিক থাকলেও এই মুহুর্তে স্বাভাবিকতা লেজ গুটিয়ে পলায়ন করল। ছেলেটা কীভাবে বলতে পারল অরিত্রিকাকে বিয়ে করবে? এটা তো সম্ভব নয়। আরশাদ সাহেব বাকরুদ্ধ হয়ে গেছেন। আচমকা জোড়ালো ধাক্কা খেয়েছেন তিনি। তীক্ষ্ণ গভীর চক্ষুদ্বয়ে গহীনে ক্ষুদ্ধতার প্রতিচ্ছবি ফুটে উঠেছে । মন মেজাজ বিগড়ে গেছে। বিক্ষিপ্ত হয়ে উঠছে ভেতরটা। মাথার র*ক্ত ছলকে উঠছে।সারহান অতি বিচক্ষণ এবং বুদ্ধিমান ছেলে হয়ে এমনটা করবে তা যেন কল্পনাতীত ছিলো।
“ তুমি আমার সাথে মশকরা করছো? মাথা ঠিক আছে তোমার? ”

আরশাদ সাহেব বিছানা থেকে নেমে দাঁড়ালেন। দৃষ্টি স্থির করলেন ছেলের পানে। অতঃপর নিস্তব্ধতা ভেঙে রেগে হুংকার ছাড়লেন। তানিয়া বেগম চমকে গেলে ভীতগ্রস্থ নয়নে তাকালেন ছেলের দিকে। সারহানের অনড় ভঙ্গিমা। তেমন নড়চড় পরিলক্ষিত হলো না। দাম্ভিকতার আবরণে সুপ্ত চিড় ধরল। তবে তা কাঠিন্যতার আড়ালে লুকিয়ে রইল। কন্ঠে কাঠিন্যতা ঢেলে বলল ;
“ আমি এবং আমার মাথা দুটোই ঠিক আছে বাবা। ”
আরশাদ হুলুস্থুল পায়ে এগিয়ে গেলেন ছেলের দিকে। তর্জনী আঙুল উঁচিয়ে কঠোর ভাবে বললেন ;
“ তুমি জানো এটা কখনো সম্ভব নয়। অরিত্রিকার ইরফানের সাথে বিয়ে ঠিক হয়েছে। ”
“ কার সাথে কার বিয়ে ঠিক হয়েছে সেসব আমার দেখার বিষয় নয়। আমি অরিত্রিকাকে বিয়ে করতে চাই। ”
“ সারহান! ”
“ আপনাকে দুইদিন সময় দিলাম চাচার সাথে কথা বলুন এবং আমাদের বিয়ের ব্যবস্থা করুন। ”
“ আমি আজমল কে কিছু বলতে পারব না। ”

আরশাদ সাহেব বিক্ষুব্ধ হয়ে বললেন। সারহান ভ্রুযুগল গুটালো। সোফা থেকে উঠে দাঁড়াল। শক্ত গলায় বলল ;
“ আমাকে রাগাবেন না বাবা। আমি ফাইরুজকে না পেলে তুলকালাম বাঁধিয়ে দেব। আপনার ভাইকে বোঝান এবং রাজি করান। এতে আপনাদের মঙ্গল। ”
আরশাদ সাহেব গমগমে কন্ঠে বললেন ;
“ বাবাকে হুমকি দিচ্ছো? কী করবে তুমি? ”
“ কী করব আপনার ধারণার বাইরে। ”
“ ধারণার বাইরে! তুমি হঠাৎ অরিত্রিকার মতো সাধাসিধা মেয়েকে বিয়ে করতে চাইছো! কারণ কী?”
“ ভালোবাসি তাই। ”
সারহান স্পষ্ট করে বলল। আরশাদ সাহেব হতবিহ্বল হয়ে গেলেন। কন্ঠ রোধ হয়ে আসল। কথার পরিপ্রেক্ষিতে কি বলবেন তালগোল পাকিয়ে গেল। অদ্ভুত চোখে তাকিয়ে ধমকে বললেন ;

“ তুমি অরিত্রিকাকে ভালোবাসো? বললেই বিশ্বাস করে নিবো? কখনো না। তোমাদের দুজনের মধ্যে নিঃশব্দ দ্বন্দ্ব সম্পর্কে আমরা অবগত আর অরিত্রিকাকে তুমি ভালোবাসো কথাটা তোমার সাথে যায় না। ”
শেষাক্তো কথাটি ছিল তাচ্ছিল্য মিশেল।সারহানের চোয়াল শক্ত হয়ে গেল। কাঠিন্যতা এঁটে চাপা স্বরে বলল ;
“ আমার অনুভূতি এবং ভালোবাসার দিকে আঙুল তোলার অধিকার কাউকে দেইনি। আমার ভালোবাসা কোনো সস্তা রসিকতা জিনিস নয় যে আপনি উপহাস করবেন। ”
“ আমার আর তোমার চাচার সম্পর্ক নষ্ট করো না সারহান। দুবছর পর ওদের এ বাড়িতে ফিরিয়ে আনতে পেরেছি পুনরায় তোমার কারণে যেন তারা একই না কাজ করে তা মাথায় রেখো। ”
“ আপনি ফিরিয়ে আনেনি আমি ফিরিয়ে এনেছি। ”

সারহান দম্ভ চুর্ণ করে বলল।আরশাদ সাহেব দমে গেলেন। ক্ষীণ অপমানে মুখখানা চুপসে গেল। ছেলেকে কীভাবে বুঝাবেন বিয়েটা সম্ভব নয়। যদি তিনি ভাইয়ের কাছে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে যায় এতে হিতে বিপরীত হতে পারে। একদিকে ভাই ও বোন, অন্যদিকে ছেলের জেদ কীভাবে সামলাবেন তিনি? পূর্বে কখনো ঘোলাটে পরিস্থিতিতে পড়েন নি। তিনি তপ্ত শ্বাস ফেললেন। ললাট জুড়ে বিন্দু বিন্দু ঘামের আবির্ভাব ঘটেছে। দুশ্চিন্তায় ভেতরটা অস্থির হয়ে উঠেছে। তিনি তাকালেন ছেলের দিকে। গম্ভীর কণ্ঠে বললেন ;
“ তুমি তো দুবছর আগে থেকে জানতে অরিত্রিকা এবং ইরফানের ভালোবাসার কথা। তাহলে মেয়েটাকে ভালোবাসার মতো ভুল কীভাবে করলে? ”
সারহান অদ্ভুত হাসল ;

“ ফাইরুজকে আমি দুবছর এগারো মাস দশ দিন আগে থেকে ভালোবাসি। কথাটি অবিশ্বাস্য মনে হলেও সত্য। সময়টা দীর্ঘ হয়েছে,অনুভূতি,শূন্যতা, অতীত আমায় প্রতিনিয়ত দগ্ধ করেছে। অতঃপর সুন্দর অনুভূতির সঙ্গে পরিচয় করিয়েছে। আমার কাছে ভালোবাসা ভুল নয়, একগুচ্ছ অনুভূতির সংমিশ্রণে জন্ম নেওয়া স্নিগ্ধ প্রণয় নামক সুখ। যা আমায় ক্ষণে ক্ষণে বাধ্য করিয়েছে ভালোবাসতে।”
“ তাহলে চুপ করে কেনো ছিলে? ”
“ কারণ অরিত্রিকা আমাকে ঘৃণা করত। কেন ঘৃণা করতো তা সকলের অজানা নয়।”
“ মেয়েটা তোমাকে এখনো তার বাবার মৃ*ত্যুসম অবস্থার জন্য এখনো ঘৃণা করে। ”
“ সবার অগোচরে ঘৃণা ভালোবাসার রুপ নিয়েছে, বাবা । ফাইরুজ আমাকে ভালোবাসে।”

সারহান দৃঢ় এবং শক্ত কন্ঠে বলল। আরশাদ সাহেব এবং তানিয়া বেগম আরেক দফা চমকালেন, থমকালেন। কি বলবেন!কি করবেন ভুলে বসলেন! ছেলেকে কখনো কোনো কিছু পাওয়ার জন্য মরিয়া হতে দেখেননি। এই প্রথম কাউকে ভালোবেসে ও নিজের করে পাওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে। সারহান পুনরায় বলল ;
“ আমি পারিবারিক সম্পর্ক বজায় রাখতে এবং আত্মীয়তা রক্ষার্থে নিজের অনুভূতিকে চেপে রেখেছিলাম। কিন্তু দিন শেষে সবাই নিজেদের স্বার্থ হাসিল করে ভালো ছিল আর আমি ছিলাম শূন্য। ”
আরশাদ সাহেব থমথমে গলায় জিজ্ঞেস করলেন ;
“ কার কথা বলছো তুমি? ”
“ আস্তে ধীরে জেনে যাবেন। ”
“ এখনি বলো। ”
“ সেসব অতীত নিয়ে কথা বলে লাভ নেই। আপনি শুধু আগামীকাল চাচার সাথে কথা বলুন। বাকীটা আমি সামলে নেব। ”

আরশাদ সাহেব চুপ করে রইলেন। মুখাবয়ব অতিশয় গম্ভীর এবং কঠিন। কিছুক্ষণ পর বললেন ;
“ তোমার জন্য নিজেদের মধ্যে ঝামেলা সৃষ্টি করতে চাই না। ”
সারহানের ভ্রুযুগল দ্বিগুণ কুঁচকে যায়। রাগ নিয়ন্ত্রণ করার জন্য দুহাত মুষ্টিবদ্ধ করে। হাতের পেশীর শিরা উপশিরা ফুলে উঠে। ক্রুদ্ধ কন্ঠে বলে উঠে ;
“ আপনাকে কিছু বলতে হবে না। আমি যা করার নিজে করব। আপনি আমায় বাঁধা দিতে আসবেন না। ”
“ সারহান উল্টোপাল্টা কোনো কাজ করো না। ”
“ আপনার কথা শুনতে বাধ্য নই আমি। শুধু শুনে রাখুন, ফাইরুজ শুধু সারহান ইদায়াত চৌধুরীর। আমি ব্যতিত ফাইরুজ অন্যকারো হবে না, আমি কখনো হতে দেবো না। ”
সারহান একটু থেমে পূর্বের ন্যায় বলল;

“ পরিবারের স্বার্থে যেমন ভালোবাসার মানুষকে ত্যাগ করতে পারি। তেমন নিজ স্বার্থে ভালোবাসার মানুষকে সারাজীবনের আঁটকে রাখতে পারি। আমাদের দুজনের মাঝে তৃতীয় ব্যক্তি হিসেবে কেউ আসলে তাকে সরিয়ে দিতে পারি — আমাদের জীবন কিংবা দুনিয়া থেকে। ”
শেষোক্ত কথাটি সারহান থেমে থেমে বজ্রকন্ঠে হুংকার ছেড়ে বলল। অতঃপর শাণিত পায়ে গজগজিয়ে রুম থেকে বেড়িয়ে গেল। আরশাদ সাহেব ধপ করে বসে পড়লেন বিছানায়। টি টেবিলে রাখা পানির গ্লাস হাতে নিয়ে ঢকঢক করে পানি পান করলেন। গ্লাসটা শব্দ করে টি টেবিলে রেখে গাম্ভীর্য ভাব নিয়ে বললেন ;
“ তানিয়া তোমার ছেলেকে থামাও। ”

প্রণয়ের সন্ধিক্ষণে সিজন ২ পর্ব ৪৬ (২)

তানিয়া বেগমের সম্বিৎ ফিরে। তিনি দ্রুত পায়ে এগিয়ে এসে স্বামীর পাশে দাড়ান। এ মুহুর্তে কী বলবেন বুঝতে পারলেন না। ছেলের উগ্র আচরণে তিনি অবাক হয়েছেন। তবে সবচেয়ে বিস্ময়কর বিষয় ছেলে তার ভালোবাসা এবং অনুভূতি গোপন করেছে। কাউকে ভালোবেসে গোপন করে রাখা যে যন্ত্রণা সমতুল্য। কীভাবে স্বাভাবিক থেকেছে,কীভাবে অরিত্রিকার বিয়ের কথা শুনে চুপ করে থেকেছে। এসব ভাবনা মায়ের মনকে অশান্ত করে তুলছে।
“ আপনার ছেলে থামবে না সারহানের বাবা আর আমিও থামাবো না। ”
তানিয়া বেগম শঙ্কিত হয়ে বিরবির করে বললেন।

প্রণয়ের সন্ধিক্ষণে সিজন ২ পর্ব ৪৮