যতনে রাখিলাম যাতনা পর্ব ২৩
মম সাহা
মাথার উপর চলা ফ্যানের যান্ত্রিকতার বাতাস এসে রোজা সওদাগরের অস্থিরতা কমাতে পারলো না। শ্বাস নিচ্ছেন তিনি অনবরত। মেয়ের উপর হওয়া তার রাগ, অভিমান, অভিযোগ সব মিলেমিশে একাকার। তিনি ফোনটা হাতের মুঠোয় চেপে রেখেই এক গ্লাস পানি খেলেন ঢকঢক করে।
চাঁদনী নিরবেই মায়ের এই অস্থিরতা দেখছিলো। ভেবেছিল মা হয়তো ঠিক সামলে নিতে পারবে। কিন্তু রোজা সওদাগরের ঘামের উপর ঘাম, হাঁসফাঁস করা দেখে এবার চাঁদনীরই খারাপ লাগছে।
আফজাল সওদাগর ওয়াশরুম থেকে বের হয়েই স্ত্রীর এমন অস্থিরতা লক্ষ্য করে কিছুটা এগিয়ে এলেন। পুরুষালী ভারি কণ্ঠে প্রশ্ন ছুঁড়লেন, “কী হয়েছে, রোজা? ঘামছো কেন?”
স্বামীর এক টুকরো যত্ন মাখা চিন্তায় হাউমাউ করে কেঁদে উঠলেন রোজা সওদাগর। মোবাইলটা এগিয়ে দিয়ে ক্রন্দনরত স্বরে বললেন,
“দেখো না ও কী বলছে। তোমার মেয়েটা কী বলে তুমিই শুনো।”
আফজাল সওদাগর এবার মোবাইলের স্ক্রিনে তাকালেন। মেয়ের ফ্যাকাশে মুখটি ভেসে উঠল সেখানটায়। উনি মোবাইলটা ধরলেন। চিন্তিত ভঙ্গিতে শুধালেন,
“কী হয়েছে, আম্মু? তোমার কিছু হয়েছে? তোমার মা এমন করছে কেন?”
চাঁদনী সংশয়ে চুপ করে রইলো। রোজা সওদাগরই বললেন,
“আপনার মাইয়া দেশে আসবো না বলে। ও পাহাড় ঘুরবো। ওর বাপ মা’র প্রতি কোনো টান নাই। ও নাকি পাহাড় ঘুরে ঘুরে জীবন কাটিয়ে দিবে।”
স্ত্রীর কথায় ভীষণ অবাক হলেন আফজাল সওদাগর। উনি তো এমন কিছু শুনেননি! চাঁদনী তো কোনো সিদ্ধান্ত নিলেই আগে তাকে জানায়। স্ত্রীর কথা পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পারলেন না তিনি। তার স্ত্রীর স্বভাব আছে তিলকে তাল বানানোর। তাই তিনি মেয়েকেই জিজ্ঞেস করলেন,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
“কী শুনি, আম্মা? তুমি এসব বলেছো?”
চাঁদনী জবাব দেয় না।
তার মুখটাও শুকিয়ে এলো এবার। যতটুকু সাহস সে সঞ্চয় করেছিলো, মায়ের অঙ্গভঙ্গি দেখে ততটুকু হাওয়ায় মিলিয়ে গিয়েছে এতক্ষণে।
মেয়ের নীরবতায় যেন নিজের উত্তর খুঁজে পেলেন বাবা। কিছুটা বিস্ময় নিয়েই বললেন,
“তাহলে সত্যি তুমি এটা ভেবেছো তাই তো?”
চাঁদনী কেবল মাথা নাড়িয়ে বুঝালো, হ্যাঁ।
আফজাল সওদাগর কতক্ষণ মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে রাশভারী স্বরে বললেন,
“অনেক হয়েছে বিদেশ পড়ে থাকা। এবার দেশে ফিরে আসো। তোমার একটু একা থাকার প্রয়োজন ছিলো আমি সেটা রেখেছি। কিন্তু এখন তুমি যে-ই আবদার করছো তা সম্ভবই নয় রাখা।”
“আব্বু, একবার ভেবে দেখো…”
চাঁদনীর কথা শেষ করতে দেন না আফজাল সওদাগর। তার আগেই বলেন, “আমি ইমার্জেন্সি ভিসার বন্দোবস্ত করছি। তুমি দ্রুতই চলে আসবে আশা করি। ঠিক আছে?”
চাঁদনী হতাশ শ্বাস ফেললো। জবাবটুকু দিতে পারলো না তার আগেই তার বাবা কলটি বিচ্ছিন্ন করলেন।
চাঁদনীর চোখের ঘুমের লেশ কেটে গেলো। সে উঠে গিয়ে নিজের বারান্দায় দাঁড়ালো। বরফ পড়ছে আকাশ থেকে। চারপাশটাও ঢেকে গেছে বরফে। এই ঠান্ডা পরিবেশে মিশে গেলো চাঁদনীর এক বুক দীর্ঘশ্বাস। বাবা কখনো তার উপর কিছু চাপিয়ে দেননি, আজ কেন এতটা কঠোর হলেন। তবে কি সে বড়ো ভুল আবদার করে বসেছে?
কিন্তু কী করবে সে? তার যে আর ফিরে যেতে ইচ্ছে করে না। মনে হয় হারিয়ে যেতে দূর থেকে দূরে। কীভাবে সে এটা বুঝাবে? পৃথিবীতে এমন অনেকেই আছে যাদের সাথে সবচেয়ে খারাপ থেকে খারাপতম ঘটনা ঘটে। কত যন্ত্রণায় কাটাতে হয় দিন। ভালোবাসা, বিশ্বাস যাদের ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যায়। কই তারা তো ঠিক আবার দ্বিতীয় বার ভালোবাসে, দ্বিতীয় বার বিশ্বাস করে, আবারও সঙ্গীসহ বাঁচার কথা ভাবে। তবে সে কেন পারে না? আর তাছাড়া জীবনে চলতে হলে কি সঙ্গীর খুব দরকার? একাও তো জীবনটা কাটিয়ে দেওয়া যায়। উড়ে-ঘুরে, ছুটে, শখ পূরণ করে এই জীবনটাকে তো সর্বোচ্চ সুখ দেওয়াই যায়। তবে বাবা-মা কেন এতটুকু বুঝতে পারেন না! সন্তানের মায়া কাটানো সহজ নয় বলেই হয়তো তারা বেঁধে রাখতে চান সন্তানকে।
নিরিবিলি ঘরটাতে শো শো শব্দই শোনা যাচ্ছে কেবল। ফুল স্প্রিডে চলছে ফ্যানটা।
অবনী বেগম বিছানাটা ঝেরে একদম টান টান করে দিয়েছেন। বারান্দা থেকে সিগারেটের বিদঘুটে একটি গন্ধ ভেসে আসছে। আমজাদ সওদাগর সিগারেট ফুঁকছেন হয়তো।
বিছানা ঝেরেই তিনি বেরিয়ে যাওয়ার জন্য উদ্যোত হতেই আমজাদ সওদাগর বারান্দা থেকে ডেকে বললেন,
“অবনী, একটু বারান্দায় আসো।”
স্বামীর আদেশ অবনী বেগম কখনো অমর্যাদা করেননি। আজও করবেন না সেটাই স্বাভাবিক। তাই তিনি গুটব গুটি পায়ে এগিয়ে গেলেন। বারান্দায় দরজায় দাঁড়িয়ে বেশ স্বাভাবিক এবং শান্ত স্বরে বললেন,
“বলো।”
আমজাদ সওদাগরের দৃষ্টি তখনও বারান্দার গ্রিল জুড়ে। সিগারেট টানতেই ব্যস্ত তার ঠোঁট।
মিনিট দুই পেরিয়ে গেলো এহেন নীরবতায়। অবনী বেগম আবার তাড়া দিলেন,
“কী বলবে, বলো। আমার যেতে হবে।”
আমজাদ সওদাগর সিগারেটটা দূরে ছুঁড়ে মারলেন আগুন নিভিয়ে। এরপর অবনী বেগমের দিকে না তাকিয়েই বললেন,
“তুমি জানোই নিশ্চয় অহির মায়ের প্রতি আমার ভালোবাসা কতটা।”
যদিও অবনী বেগম বুঝলেন না এসময় এই কথা বলার মানে কী। তবুও জবাবে বললেন, “জানি। তারপর?”
“হুট করে অহি ওর মা’কে নিয়ে এমন বাজে মন্তব্য করাতে আমি রেগে গিয়ে ছিলাম। তার উপর তুমি এসে আটকাতে চাওয়ায় সবটুকু রাগ তোমার উপর এসে পড়ে। সেজন্য চড়টা দিয়ে দিয়েছি।”
“বুঝলাম। আর কিছু?”
চোখ বন্ধ করলেন আমজাদ সওদাগর। অবনী বেগমের গম্ভীর কণ্ঠে তার দিকে তাকালেন,
“আমি জানি তোমার খারাপ লেগেছে তাই….”
“তাই তুমি এখন সরি ফিল করছো। এটাই বলবে তো?”
আমজাদ সওদাগর বললেন, “হ্যাঁ।”
“বলার প্রয়োজন নেই।”
“প্রয়োজন নেই!” আমজাদ সওদাগরের কণ্ঠে কিছুটা অবাক ভাব।
অবনী বেগম তাচ্ছিল্য করে বললেন,
“একদমই নেই। এ জীবনে আমি যা পেয়েছি, যতটুকু পেয়েছি ততটুকু অন্যের পাওনা ছিলো। এই সংসার ছিলো অন্যের আমি সেটা পেয়েছি। তুমি অন্যের সেটা পেয়েছি। তোমার রাগও অন্য জনের জন্য সেটাও আমি পেয়েছি। আর তোমার যেই কাছে আসা কিংবা ঘনিষ্ঠতা সেটাও অন্যের জন্যই ছিলো, তা-ও আমি পেয়েছি। তুমি কখনো আমার জন্য কিছু দাওনি। কিছু রাখোনি। নেশা করে কিংবা শারীরিক চাহিদায় যখন আমার সাথে ঘনিষ্ঠ হতে তখনও তুমি তোমার প্রথম স্ত্রীর কথা ভাবতে, নাম জপতে। কী ঘৃণা লাগতো তখন আমার! অন্যের শরীর ভেবে কেউ আমার শরীরে ডুব দিচ্ছে এটা ভাবলেই মরে যেতে ইচ্ছে হতো। কিন্তু এই চার দেয়ালের কথা আমি কখনো কাউকে বলিনি। কখনো মুখ ফুটে তোমাকেও বলিনি যে, আমজাদ, এমন করে তুমি আমার মনে ঘৃণার জন্ম দিও না।
বলে কী লাভ হতো? কিছুই না। আজ সেসব অতীতের কথা না উঠাই থাক। কেবল এতটুকু বলবো, এ জীবনে আমাকে যা দিয়েছো তা সবই অন্যের পাওয়ার কথা ছিলো। তাই আমাকে তুমি নতুন করে আর কিছু দিও না। হোক সেটা তোমার করুণা কিংবা রাগ। আমি অবনী, পরগাছা হয়ে এ সংসারে দিব্যি কাটিয়ে দিয়েছি। নতুন করে আর কিছু চাওয়ার নেই।”
কথা শেষ করেই গটগট করে বেরিয়ে গেলেন অবনী। আমজাদ সওদাগর তাকিয়ে রইলেন সেই যাওয়ার পানে। সে কি নিজের জীবনটা এবং তার আশেপাশের সবকিছু বেশি কঠিন করে ফেলেছেন? নয়তো নিজের মেয়েটা অব্দি তাকে এতটা অপছন্দ কেন করে?
সওদাগর বাড়ির প্রাচীর গুলো ছোটো ছোটো আলোয় সেজে উঠেছে। সেজে উঠেছে বাড়ির গেট হতে বাগান সবটুকু জায়গা। আনন্দের ছোঁয়ায় যেন খিলখিল করে হাসছে বাড়িটি। আবার কতদিন পর সেই আনন্দ ফিরে এসেছে।
ড্রয়িং রুম জুড়ে বসে আছে আত্মীয় স্বজন। চিত্রার দাদীও এসেছেন। ভদ্রমহিলার নাক উঁচু করার স্বভাব এখনো যাননি। এসেই বাড়ির প্রত্যেককে কয়েক দফা ঝেড়েছেন। এই বাড়ির কারো চালচলনই যেন তার মনের মতন নয়। শহর জীবনটাকেই তিনি বড়ো অপছন্দ করেন।
পিঠে বানাচ্ছে রান্নাঘরে। হৈচৈ আমেজে আনন্দমুখর ড্রয়িং রুম। কাল থেকে সব অনুষ্ঠান শুরু হবে। খুব শীগ্রই বিয়েটা ধরে ফেলেছেন উনারা। চিত্রা তখন ডেকোরেশন করা লোকদের দেখিয়ে দিচ্ছে মেহেদীর স্টেজটা কোথায় হবে।
চিত্রার দাদী চিত্রাকে দেখে প্রায় খেঁকিয়েই উঠলেন,
“এই, এই মাইয়া, তোর চুলডি না কত বড়ো আছিলো? অহন এট্টুক ক্যান? কাইট্টা লাইছত?”
আচমকা দাদীর এই খেঁকিয়ে উঠা গলার স্বর পেয়ে চিত্রা ভড়কে গেলো। থতমত খেয়ে মাথা থেকে পড়ে যাওয়া ওড়নাটা আবার মাথায় জড়িয়ে নিলো।
অহি ব্যাপারটা সামলে নেওয়ার জন্য বলল, “দাদী, এখন তো এটাই স্টাইল।”
“ইসটাইল আবার কী? চুল কাইট্টা কীয়ের ইসটাইল?”
“আহা, দাদী, এটাই বর্তমান যুগে চলছে।”
“তুই চুপ থাক ছেমড়ি। এই মাইয়াডার চদরভদর সব। এতদিন তো গেরামেও যায় নাই দেখতেও পারি নাই। কত সুন্দর চুল আছিলো। কাইট্টা ফেললো!”
মুনিয়া বেগম রান্নাঘর থেকেই শাশুড়ির হাঁক-ডাক শুনে বেরিয়ে এলেন। মেয়েকে এখান থেকে সরানোর জন্য ফন্দি আঁটলেন। মেয়ের হাতে এক বাটি পিঠে ধরিয়ে দিয়ে বললেন,
“যা তো চিত্রা, ও বাড়িতে গিয়ে পিঠা দিয়া আয়। ভাবি, বনফুল কেউ তো নাই। ছেলেটা ভালো মন্দ কী খায়, না খায়। যা।”
ভদ্রমহিলা কিছু বলতেন আরও তার আগে চিত্রা মায়ের হাত থেকে পিঠার বাটিটা নিয়ে দৌড়ে চলে গেলো।
পেছন থেকে বৃদ্ধার কত আকুলিবিকুলি কথা শোনা যাচ্ছে তখনও।
বাহার ভাইদের বাড়িটা অন্ধকার। বেশিরভাগ সময় অন্ধকারই থাকে। লোকটার যে কী আনন্দ লাগে এমন বাড়িটা অন্ধকার করে রাখতে!
চিত্রা দরজায় টোকা দিতে গিয়ে খেয়াল করলো দরজাটা খোলা। আশ্চর্য! লোকটা দরজাটাও খুলে রেখেছেন!
চিত্রা ধীরে ধীরে বাড়িটায় ঢুকলো। বার কয়েক মানুষটার নাম ধরে ডাকলেও সাড়া পেলো না মোটেও। ছাঁদ থেকে খুটখাট শব্দ ভেসে আসছিলো কেবল।
যতনে রাখিলাম যাতনা পর্ব ২২
চিত্রা ধুপধাপ পায়ে ছাঁদের উঠল। ছাঁদের চিলেকোঠা থেকে ভেসে এলো এক চিমটি আলো।
মেয়েটা আনন্দিত মনে চিলেকোঠার জানালা দিয়ে উঁকি দিতেই দেখলো বাহার ভাইয়ের হাতে একটি বন্দুক। চকচক করছে বন্দুকটা। থমকে গেলো চিত্রার পা জোড়া। ভুল নাকি ভ্রম ভেবে কূল পেলো না!