আযদাহা সিজন ২ পর্ব ৪১

আযদাহা সিজন ২ পর্ব ৪১
সাবিলা সাবি

জ্যাসপার আপাতত ফিওনাকে তার সম্পদের অর্ধেক অংশ দেখিয়েছে মাত্র—কেবলমাত্র হালকা এক ঝলক। তারপর দুজনেই বিলাসবহুল এক রেস্টুরেন্টে খাওয়াদাওয়া সেরে উঠে পড়ে গাড়িতে।
পরবর্তী গন্তব্য তাদের একটি চাইনিজ শপিং মল, যেখানে ফিওনা কিনবে নিজের জন্য কিছু কমফোর্টেবল পোশাক।
বেইজিং শহরের রাস্তাগুলো তখন স্নিগ্ধ বিকেলের আলোয় ভরে উঠছে। আকাশে হালকা আভা, বাতাসে বসন্তের পরশ।পৃথিবীর সবচেয়ে দামি গাড়িটা ছুটে চলেছে শহরের ব্যস্ত রাস্তায়।য়গাড়িতে বসে বাইরের দৃশ্য দেখতে দেখতে হঠাৎ ফিওনার কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ে। সে ধীরে ধীরে বলে ওঠে
“আচ্ছা প্রিন্স, আমি সবগুলো অফিস ঘুরলাম।

কিন্তু একটা জিনিস খুব নজরে পড়লো—তোমার অফিসে কোনো মেয়ে কর্মী নেই, সব ছেলে কর্মী। একটাও মেয়ে নেই! কেনো এমনটা?”
জ্যাসপার কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে।য়তারপর হঠাৎ গাড়ির ব্রেকে হালকা চাপ দেয়।গাড়ি থেমে যায় তারপর চুপচাপ ফিওনার দিকে ঘুরে তাকায় সে—চোখে তীব্র এক স্মৃতি জেগে ওঠে।
জ্যাসপার শান্ত কণ্ঠে বলে “আমি তোমাকে বলেছিলাম আমি পৃথিবীতে দু’বার এসেছিলাম। কিন্তু না… সত্যিটা হলো, আমি এসেছিলাম বহুবার—বিজনেস এক্সপানশনের জন্য, ইনভেস্টমেন্টের জন্য। তখন আমার সব অফিসেই ছেলে-মেয়ে কর্মী ছিলো সমান সংখ্যায়। আমি মেয়ে ক্লায়েন্টদের সঙ্গেও ডিল করেছি বহুবার, বিজনেস ট্রিপে গেছি সব অফিসের কর্মীদের সাথে—সব কিছু ঠিকঠাকই চলছিলো। কিন্তু তারপর… আমার জীবনে এমন কিছু ঘটলো যা আমি কখনও ভাবিনি।আমার হিসেব অনুযায়ী, অন্তত ৫০ জন মেয়ে সুইসাইড করেছিলো… এই কয়েক বছরে শুধুমাত্র আমার জন্য।”
ফিওনা অবাক হয় না।সে শুধু শান্ত গলায় বলে— “তারা আ*ত্মহত্যা করেছিলো মানে? পুরো ঘটনা খুলে বলো প্রিন্স।”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

জ্যাসপার একদৃষ্টিতে বাইরের দিকে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ।তারপর এক গভীর নিঃশ্বাস ফেলে জ্যাসপার তাকায় ফিওনার চোখে। সেই চোখে একধরনের বিস্ময়কর সৌন্দর্য মিশে আছে—যেন তার ভেতরে পুরো মহাকাশ ঘুরপাক খাচ্ছে। তারপর গভীর এক শ্বাস নিয়ে বলতে শুরু করে—
“তুমি জানো হামিংবার্ড,” জ্যাসপার শুরু করলো নরম কণ্ঠে, “আমি যখনই পৃথিবীতে এসেছি, কখনো সরাসরি কারো চোখে চোখ রাখিনি। সবসময় মাস্ক, সানগ্লাস পড়ে থাকতাম, একমাত্র তোমার সামনেই আমি আমার মুখ প্রদর্শন করেছিলাম আর দ্বিতীয় দিন তোমার ফ্রেন্ডের সামনে কারন আমার তখন উদ্দেশ্য ছিলো তোমাকে আমার প্রতি আকৃষ্ট করে আমার কাজ হাসিল করা আমার ভাইকে উদ্ধার করা তাই তোমার সামনেই আমি এমন খোলামেলাভাবে ভাবে দিয়েছিলাম।. তবে আমি এমন জায়গাগুলোই বেছে নিতাম যেখানে মানুষের ভিড় কম থাকতো। কিন্তু কিছু ব্যবসায়িক সফরে ক্লায়েন্টরা আমার মুখ দেখেছে। অনেকেই অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকতো… কেউ কেউ সরাসরি প্রপোজ করেছিলো। এমনকি বিশ্বের অন্যতম ধনী ব্যক্তির মেয়ে… সেও। তারা আমাকে ভালোবাসতে চেয়েছে, ছুঁতে চেয়েছে।”

এক মুহূর্ত থেমে জ্যাসপার চোখ নামায়।তারপর পুনরায় বলতে লাগলো। “কিন্তু তখন আমার ভেতরে ‘লাভ ফাংশন’ ছিল না। হৃদয় ছিল, অনুভূতি ছিল না। আমি তাদের সঙ্গে রূঢ় আচরণ করতাম, যেন কোনো দেয়াল তুলে দিতাম। কেউ কেউ এক ওয়ান নাইটের অফার করতো তার বলছো শুধু এক রাতের জন্য হলেও তারা আমাকে চায়।—আমি আরো গা জ্বালানো আচরণ করতাম।আরো বেশি তাদের অপমান করতাম। আর… এরপর শুনতাম কেউ কেউ মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছে,এমনকি কেউ কেউ আত্ম*হত্যাও করেছে।”
গাড়িতে হালকা নীরবতা নেমে আসে। বাতাসটা হঠাৎ কেমন যেন ভারী হয়ে ওঠে। “একদিন অফিসে রাত করে কাজ করছিলাম, সেদিন কয়েকজন সহকর্মী আমার মুখ দেখে ফেলে। তারাও স্বাভাবিক থাকেনি। আমার মতো কেউ হয়তো এই পৃথিবীতে এক ধরণের অভিশাপ— ড্রাগনদের থেকে মানবী নারীরা অনেক বেশি আকর্ষিত হয় রূপের প্রতি।

আর আমি— এই পৃথিবীর জন্য ছিলাম এক অভি*শপ্ত রূপকথা।”?
ফিওনা তখন ধীরে হাত বাড়িয়ে জ্যাসপারের মুখটা নিজের হাতে তুলে ধরে। তার চোখ জলের মতো স্বচ্ছ, কিন্তু তাতে ঝরে পড়া ভালোবাসার গম্ভীরতা।
“তুমি তো ঐশ্বরিক। তুমি শুধুই পৃথিবীর সবচেয়ে সুদর্শন নও, আমি বলবো পুরো মহাবিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে মোহময়, সবচেয়ে অপার্থিব প্রাণ। তোমাকে দেখলে মনে হয় দেবতার চেয়ে বেশি কিছু তুমি। আর আমি… আমি পৃথিবীর সবচেয়ে লাকি গার্ল, যে কিনা তোমাকে ভালোবাসতে পেরেছে, ছুঁতে পেরেছে।”
জ্যাসপার পুনরায় ফিওনার দিকে তাকিয়ে ধীরে ধীরে বলে “এইসব ঘটনার পর…আমি সিদ্ধান্ত নেই— আর কখনো কোনো নারী কর্মী থাকবে না আমার কোনো অফিসে।আর মেয়ে ক্লায়েন্ট?তাদের সঙ্গে আর কোনো ডিল নয়।
ফিওনা একটু চুপ করে, তারপর ঠোঁটে হালকা বাঁকা হাসি নিয়ে বলে “তোমার জন্য অর্ধ শত নারী আত্মহত্যা করেছিলো, তাই তো?” একটু থেমে ঠাণ্ডা কণ্ঠে

“ভালোই করেছে মরেছে— না হলে আমি নিজেই খুঁজে বের করে মেরে ফেলতাম।”
গাড়ি ছুটে চলেছে পুনরায়। ফিওনা আজও বিশ্বাস করতে পারছে না—তার পাশে বসে আছে সেই পুরুষ, যে মানুষ হয়েও মানুষ নয়। এক অপার্থিব প্রাণ—জ্যাসপার অরিজিন।
সে চালাচ্ছে গাড়ি, কিন্তু মনে হয় যেন কোনো রাজ্যপাটের মহারাজ তার সিংহাসনে বসে—ধীর, নিয়ন্ত্রিত, অথচ এমন এক জ্যোতি নিয়ে, যা মানুষকে চোখ ফেরাতে দেয় না।
জ্যাসপারের ত্বক যেন বিশুদ্ধ চাঁদের আলোতে তৈরি—কোনো দাগ নেই, অদ্ভুত মসৃণ। তার গালের হাড়ের গঠন যেন কোনো দেবশিল্পীর খোদাই করা মূর্তি—নির্ভুল, নিখুঁত, অভিজাত। নাকটা সুনির্মিত, চোখদুটি—সেই স্বর্ণাভ ছায়াময় চোখ,যা গভীর অরন্যর মতোই।যেগুলোতে যেন আকাশের তারা হেসে ওঠে। তার চোখের গভীরে তাকালে ফিওনার মনে হয়—তারা দেখা মহাবিশ্বের মতো এক অসীম রহস্যের দিকে তাকিয়ে আছে সে।

চুলগুলো লম্বাটে, ঢেউ খেলানো, হালকা নীলাভ কালো—যা একেক সময় সূর্যের আলোয় রুপালি ঝিলিক দেয়। ঠোঁটজোড়া তার ধারালো,কিন্তু কোমল।আর হালকা রক্তিম বেগুনি।এমন ঠোঁট তো আসলেই পৃথিবীর কারো হয়না। আর সেই গলার স্বর… যেন কোনও সিম্ফনির লীলা—শুধু শোনা যায় না, হৃদয়ে বাজে। ফিওনার মনে হলো—”জ্যাসপার পৃথিবীর কোনো সৌন্দর্যের মাপকাঠিতে পড়ে না।”
তার সৌন্দর্যকে তুলনা করা চলে না কোনো অভিনেতার সঙ্গে, না কোনো রাজপুত্রের সঙ্গে।সে যেন গ্রিক দেবতাদের মতো অলৌকিক, আবার জাপানি রাজপুত্রের মতো রুচিশীল। যেন কেউ মহাবিশ্বের সমস্ত সৌন্দর্য একত্র করে এক অবয়ব গড়ে তুলেছে—আর সেটিই এখন তার পাশে বসে আছে।
ফিওনা মনে মনে বলে ফেললো— “তুমি তো… শুধু পৃথিবীর নয়, পুরো মহাবিশ্বের সবচেয়ে সুদর্শন পুরুষ… যার জন্য অর্ধশত নারী সুইসাইড করেছে আর আমি পৃথিবীর সেই লাকি গার্ল, যে এই অপরূপকে এত কাছ থেকে দেখতে পায় প্রতিদিন।”

জ্যাসপার গাড়ি চালাতে চালাতে হালকা হাসছে—একটা ধীর, গভীর হাসি। তার হাসিতে ফিওনার বুক কেঁপে ওঠলো হঠাৎ করেই । সে জানে, এই হাসি বহু হৃদয় পুড়িয়ে দিতে পারে, কিন্তু আজ সেই হাসির অধিকারী একমাত্র সে।
গাড়ি মোড় নিলো, সামনে ঝলমলে আলোয় ভরা একটি শপিং মল।অবশেষে তারা শহরের সবচেয়ে বিলাসবহুল শপিং মলে পৌঁছে যায়।লেডিস শপিং ফ্লোরের সামনে এসে জ্যাসপার দাঁড়িয়ে পড়ে।
“তুমি যাও, আমি বাইরে অপেক্ষা করছি,”
জ্যাসপার শান্তভাবে বলে।ফিওনা মাথা নেড়ে ভেতরে ঢুকে যায় একা।মলের ঝকঝকে আলোয় চারপাশ ঝলমল করছে।ফিওনা একে একে কয়েকটা ড্রেস বেছে নেয়।রঙিন, আরামদায়ক—চীনের হালকা শীতে পরার উপযোগী।একটা ড্রেস পরে দেখতে চায়, ট্রায়াল রুমে ঢোকে।

কিছুক্ষণ পর—সে বেরিয়ে আসে।য়শপিং মলের দোতলায় নারীদের সাজঘরের গেট খুলে ফিওনা যখন বেরিয়ে এলো, তখন ঠিক সেই মুহূর্তে জ্যাসপার পিছন ফিরে দাঁড়িয়েই ছিল।ফিওনার উপস্থিতে তার দিকে ঘুরে তাকালো।তার চোখে কালো সানগ্লাস, মুখে পাতলা কালো মাস্ক, তবু—দেখা না গেলেও সেই দৃষ্টির গাঢ়তা যেন হাওয়ায় দোলা দিলো।স
ফিওনা ট্রায়াল রুম থেকে মেরুন রঙের একটি ফিগার হাগিং বডিকন পরে এসেছে —চিকন ফিতের হাতা, আর পিঠটা পুরোপুরি খোলা। কোমরের ভাঁজ ধরে যেন পোশাকটা শরীরের গঠনকে আরও স্বচ্ছন্দে প্রকাশ করেছে।তার হিলের টোকায় মেঝেতে অনুনাদ উঠছে—আর প্রতিটি পা ফেলাতে যেন বাতাস থমকে যাচ্ছে।
জ্যাসপারের ভেতরে কিছু একটা থেমে যায় সেই মুহূর্তে। সে তাকিয়ে থাকে—স্তব্ধ, নীরব, আর মুগ্ধ নয়নে।জ্যাসপারের নিঃশ্বাস আটকে আসে কিছুক্ষণের জন্য।তবে ফিওনা সেটা বুঝতে পারে না। কারণ জ্যাসপারের মাস্কের আড়ালে চাপা পড়ে থাকে মুখের অভিব্যক্তি আর চোখের পেছনে সানগ্লাস।

ফিওনা সামনে এসে দাঁড়ায়, একটু ঘাড় কাত করে জিজ্ঞেস করে, “কেমন লাগছে আমাকে?”
জ্যাসপার গলার স্বর নিচু করে বলল, “একটু বেশিই হট… কিন্তু এই হটনেস আমি ছাড়া কেউ দেখতে পারবে না।”
বলেই জ্যাসপার নিজের কালো ওভারকোটটি খুলে নিঃশব্দে ফিওনার কাঁধে জড়িয়ে দেয়—যেন পুরো পৃথিবী থেকে তাকে আড়াল করে রাখলো। তারপর সে ফিওনার হাত থেকে শপিং ব্যাগ নিয়ে নেয়, ফিওনার নরম হাতটা নিজের শক্ত হাতে ধরে স্কেলেটর দিয়ে নিচে নামতে শুরু করে।নিচতলায় পৌঁছে ঠিক মলের এক্সিট গেটে পৌঁছেই হঠাৎ থেমে যায়।

জ্যাসপার এক ঝলকে কিছু দেখে ফেলে।
সে ফিওনাকে থামায়। তারপর চোখ নামিয়ে ফিওনার হিল জুতোয় তাকিয়ে থেকে এক পলকে বলে ফেলে, “তুমি এই অবস্থায় হিল পড়েছো?” ফিওনা একটু অবাক হয়, “কি হয়েছে?” জ্যাসপার কোনো উত্তর না দিয়ে এক হাঁটু ভেঙে বসে পড়ে। তারপর আলতো করে ফিওনার পা থেকে হিল খুলে নেয়। ফিওনা বিস্ময়ে ফিসফিসিয়ে বলে, “প্রিন্স, তুমি কী করছো!?”
জ্যাসপার নিচু গলায়, কিন্তু দৃঢ় ভঙ্গিতে বলে,
“ফিওনা, তুমি জানো না, এই মুহূর্তে হিল পড়া কতটা বিপজ্জনক। যদি পড়ে যাও… আমি আমার বেবিকে নিয়ে একটুও রিস্ক নিতে পারি না।”
ফিওনা মুচকি হেসে বলে, “আমার অভ্যাস আছে, প্রিন্স। আমি হিল সামলাতে পারি।”

জ্যাসপার চোখে সানগ্লাস থাকলেও চোখদুটো যেন আগুন হয়ে ওঠে। “আমি অভ্যাসে নয়, নিরাপত্তায় বিশ্বাস করি।”
ফিওনা তখন একটু ক্ষীণ কণ্ঠে বলে, “তাহলে আমি খালি পায়ে যাবো?”
জ্যাসপার কিছু না বলে সোজা দাঁড়িয়ে পড়ে। এক হাতে শপিং ব্যাগ, আরেক হাতে ফিওনার হিল ধরা।হঠাৎ—সে নিঃশব্দে ফিওনার কোমরে হাত রেখে তাকে কোলে তুলে নেয়।
“প্রিন্স!” ফিওনার মুখে চমকের ধ্বনি।ফিওনা লজ্জায় মুখ গুঁজে ফেলে তার বুকে।আর জ্যাসপার—যার মুখ ঢেকে রেখেছে মাস্ক, চোখ আড়াল করা সানগ্লাসে—তবু সেই মুখের কোণে এক অপার হাসি খেলে যায়। সেই হাসি—কেবল একজন ফিওনার জন্যই।

জ্যাসপারের কোলে মাথা গুঁজে থাকা ফিওনা হঠাৎ চোখ মেলে চারপাশে তাকায়।শপিং মলের গ্লাসদেয়াল, গেটের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা কিছু মানুষ, সিকিউরিটি গার্ড—সবাই তাকিয়ে আছে তাদের দিকে। সে একটু লজ্জা পেয়ে ফিসফিসিয়ে বলে ওঠে,“প্রিন্স… নামাও আমাকে। সবাই দেখছে!”কিন্তু ফিওনার কণ্ঠস্বরের সেই সংকোচ যেন জ্যাসপারের হৃদয়ে কোনো রেখাপাতই করে না।
তার বদলে সে হঠাৎ থেমে দাঁড়ায়। মুখের মাস্কটা সরিয়ে—অসীম দৃঢ়তায় ফিওনার ঠোঁটের উপর তার ঠোঁট বসিয়ে দেয়।
আচমকা চুম্বনে ফিওনার নিঃশ্বাস কেঁপে ওঠে।
সে দু’হাতে জ্যাসপারের গলা জড়িয়ে ধরে, যেন এক মুহূর্তের জন্য সময় থেমে যায়। জ্যাসপার গভীরভাবে ফিসফিস করে,

“ এমন ড্রেস পড়ে সামনে এসেছিলে কেনো?…” এটা বলেই পুনরায় কিস করতে করতেই সে গেট পেরিয়ে রস রয়্যাল বোয়াট টেইল গাড়ির দিকে এগিয়ে চলে।লোকজনের চোখের সামনে, অথচ তাদের দু’জনের মাঝে যেন এক নির্জন মহাবিশ্ব তৈরি হয়।
একসময় ফিওনা ঠোঁট সরিয়ে নিতে নিতে একটু ধাক্কা দিয়ে বলে,“প্রিন্স! তুমি কি করছো? এটা কিস করার জায়গা নয়!”
তখন জ্যাসপার থেমে দাঁড়ায় না, একটুও না।তার ঠোঁটে এক চঞ্চল, সাহসী হাসি। “কিস করতে প্লেস লাগে না, হামিংবার্ড,”সে বলে ওঠে,শুধু লাগে—দুইজন প্রাণীর নিউরন সিগন্যালিং, হালকা অ্যাড্রেনালিন রাশ, আর সবচেয়ে জরুরি—অক্সিটোসিন।বাকি সবকিছু… আমার শরীরে এখন ঠিকঠাক চলছে।”
অবশেষে জ্যাসপার কোনো কথা না বলেই ফিওনাকে আগলে ধরে, তার কাঁধে মাথা রাখা ফিওনার কেশরাশি বাতাসে উড়ে উঠে।নিঃশব্দে, কিন্তু এক গভীর অভিমানে সে ফিওনাকে কোলে নিয়ে গাড়ির দিকে এগিয়ে যায়।
সামনের লোকেরা একটু কৌতূহলী হয়ে তাকালেও জ্যাসপারের চোখে সেই চিরচেনা ঠান্ডা আগুন—যা কাউকে ভয় পাইয়ে দিতে যথেষ্ট। ফিওনা বুঝতে পারে, এই পুরুষকে কেউ থামাতে পারবে না। যে একবার ভালোবাসে, সে গোটা পৃথিবীকে পাশ কাটিয়ে শুধু তাকে রক্ষা করে।

গাড়ির দরজা খুলে, জ্যাসপার আদরের স্পর্শে ফিওনাকে গাড়ির ভেতরে বসিয়ে দেয়।তারপর নিজে ড্রাইভিং সিটে বসে স্টিয়ারিং ধরতেই, রস রয়্যাল বোয়াট টেইল যেন বুলেটের গতিতে ছুটে চলে।
গাড়ির ভেতরে তখন এক গভীর নিস্তব্ধতা।
ফিওনা জানালার পাশে বসে থাকে,তার গলায় থাকা হালকা সাদা পর্দার মতো তার স্কার্ফ ওড়ছে। জ্যাসপার মাঝে মাঝে ফিওনার দিকে আড়চোখে তাকায়—তার চোখের পেছনে মৃদু আলো, যেন বলে উঠছে “তুমি আমার, হামিংবার্ড। শুধু আমার।”
প্রায় আধাঘণ্টার মধ্যে তারা পৌঁছে যায় মিস্টার চেন শিং-এর বাড়ির সামনে। সন্ধার আলোয় চেন শিংয়ের বাড়ি যেন জ্বলজ্বল করছে কোনো মহাজাগতিক গবেষণাগারের মতো।
গাড়ি থামতেই জ্যাসপার নেমে এসে গাড়ির দরজা খুলে দাঁড়ায়। তার চোখে সানগ্লাস, মুখে সেই মাস্ক, তবুও ফিওনা জানে—এই মুখটা পৃথিবীর নয়। এটা মহাবিশ্বের সবথেকে রহস্যময়, সবথেকে আকর্ষণীয় সৌন্দর্যের নাম জ্যাসপার।
“চলো,” সে বলে।তার কণ্ঠে অদ্ভুত কোমলতা।
ফিওনা নিঃশব্দে হাত বাড়িয়ে দেয়।জ্যাসপার আবারও তাকে নিজের পাশে টেনে নেয়—এবার আর কোলে নয়, তবে এমনভাবে জড়িয়ে ধরে, যেন এই পৃথিবীর সবচেয়ে মূল্যবান রত্ন তার পাশে হাঁটছে।

এল্ড্র প্রাসাদের এক কোণে রাত্রির নীলাভ আলো ছড়িয়ে পড়েছে। ছাদের ওপরে ভেনাসের রূপালি জ্যোৎস্না ঠিকরে পড়ছে গম্বুজের কাঁচে। সেই অপার্থিব সৌন্দর্যের মাঝখানে বসে আছে লিউ ঝান—চোখে এক অস্থিরতা।
প্রাসাদের একটি ঝুলন্ত ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে অ্যাকুয়ারা—তার নীল রঙা চুল বাতাসে উড়ছে,আকাশী রঙা চোখে অন্যমনস্ক দৃষ্টি। লিউ ঝান ধীরে ধীরে তার পাশে এসে দাঁড়ায়। “তুমি এখনও ভেবেই চলেছো, অ্যাকু?” তার গলায় উদ্বেগ।
অ্যাকুয়ারা শান্ত গলায় উত্তর দেয়,“ঝান, আমি পৃথিবীতে ফিরতে চাই না এমন নয়… কিন্তু প্রিন্সের অনুমতি ছাড়া আমি এক কদমও এগোতে পারবো না।”
লিউ ঝান একটু অসহায় ভঙ্গিতে বলে,“তুমি তো জানো, জ্যাসপার এখন পৃথিবীতে আছে। কে জানে কবে ফিরবে… আমরা কি ততদিন অপেক্ষা করবো?”
অ্যাকুয়ারা ধীরে মুখ ঘুরিয়ে বলে,“হ্যাঁ। কারণ এটা শুধু অনুমতির ব্যাপার নয়—এটা আনুগত্যের প্রশ্ন। আমি প্রিন্সের সৈন্য, তার অধীনে থেকেছি চিরকাল। তিনি এখন পৃথিবীতে তার গুরুত্বপূর্ণ মিশনে রয়েছেন। তার অনুপস্থিতিতে আমি নিজের সিদ্ধান্ত নিজে নিতে পারবোনা।”

লিউ ঝান কিছুক্ষণ নীরব থাকে, তারপর মাথা নিচু করে বলে, “ঠিক আছে। আমি ততদিন এখানেই থাকবো, যতদিন না তুমি আমার সঙ্গে পৃথিবীতে ফিরে যেতে রাজি হও।”
অ্যাকুয়ারা বিস্মিত চোখে তাকিয়ে থাকে।তার ঠোঁটে এক ফোঁটা মৃদু হাসি খেলে যায়, যদিও সেটা লিউ ঝান দেখতে পায় না। ভেনাসের আকাশে তখন দুটো নক্ষত্র পাশাপাশি জ্বলে উঠেছে‌
অ্যাকুয়ারা ব্যালকনির কিনারায় দাঁড়িয়ে নিচের বাগানের দিকে তাকিয়ে ছিল। এল্ড্র প্রাসাদের স্নিগ্ধ বাতাসে তার নীল চুল উড়ছিল ধীরে ধীরে, আর ভেনাসের আলোয় তার ত্বক যেন জ্বলজ্বল করছিল রুপোর মতো।হঠাৎই পেছন থেকে দুই হাত এসে জড়িয়ে ধরলো তাকে।লিউ ঝান—নিঃশব্দে কাছে এসে তাকে আগলে রেখেছে।
অ্যাকুয়ারা প্রথমে একটু চমকে উঠলো ছোঁয়ার তারপর স্বাভাবিক হয়ে গেলো।লিউ ঝানের নাক তার চুলে ডুবে যায়, সে ধীরে শ্বাস নেয়।এক অদ্ভুত মিষ্টি ঘ্রাণ—না, এটা পৃথিবীর কোনও সুগন্ধী নয়। এমনকি ভেনাসের বাগানেও এমন কিছু জন্মায় না। ষএটা যেন কারও আত্মার গন্ধ। পরিচ্ছন্ন, কোমল… অথচ নেশাগ্রস্ত করে ফেলে এক নিমেষেই।
“তোমার চুলে কি দ্যুতি মাখানো থাকে?”—লিউ ঝানের কণ্ঠ রুদ্ধস্বরে ফিসফিস করে ওঠে।“এই ঘ্রাণ… আমি আগে কখনও পাইনি কোথাও। যেন আমার হৃদয়ের ভিতর পর্যন্ত ঢুকে যাচ্ছে।” অ্যাকুয়ারা তার চোখ বন্ধ করে একটুখানি নিঃশ্বাস ফেলে। সে কিছু বলে না।

তার চোখেমুখে কোনও বিস্ময় নেই, লিউ ঝানের এমন আচরণ সে আগে কখনো দেখেনি। কিন্তু এবার তার মনে হয়, লিউ ঝান যেন সত্যিই বদলে যাচ্ছে।
আর লিউ ঝান?সে জানে না, এই সৌরভ তাকে কোথায় টেনে নিয়ে যাচ্ছে—ভালোবাসার দিকে, নাকি এক এমন আকর্ষণের গভীরে, যেখান থেকে আর ফিরে আসা যাবে না।
লিউ ঝানের বুকের মাঝে ঢেউ খেলে যাচ্ছিল। অনেকটা সময় চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকার পর, সে ধীরে ধীরে অ্যাকুয়ারার কাঁধে হাত রাখে।অ্যাকুয়ারার পরনে সিলভার-নীল রঙা একটি পাতলা গাউন, যা বাতাসে দুলে উঠছে, ঠিক যেন জলজ ফুল। লিউ ঝান তাকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে নেয়।

অ্যাকুয়ারা ধীরে চোখ তুলে তাকায়—স্বচ্ছ আকাশী চোখের গভীরে ছিল প্রশান্তি, কিন্তু তাতেই যেন ডুবে যাচ্ছিল লিউ ঝান।সে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে।তার দৃষ্টিতে আজ আর কোনও অবহেলা নেই, নেই নির্লিপ্ততা। আজ সেখানে ছিল বিস্ময়… আর মুগ্ধতা। “আগে কখনো খেয়াল করিনি তোমাকে…” — তার কণ্ঠ ছিল একটু থমথমে, ধীরে ফিসফিস করে বলে উঠে, “কিন্তু এখন মনে হচ্ছে, তোমার রূপেই তুমি আমাকে মেরে ফেলবে।”
অ্যাকুয়ারার ঠোঁটে এক মৃদু হাসি খেলে যায়।
সে কিছু বলে না।সে জানে, এই কথার উত্তর ভাষায় হয় না।
তার সৌন্দর্য এমনই—নিরব, অথচ ধ্বংসাত্মক।
ঠিক যেনো এক মহাজাগতিক ছায়াপথ, যা নিজের ভিতরেই টেনে নেয় সব আলো, সব আকর্ষণ।
আর লিউ ঝান?সে হয়তো বুঝে গেছে…
এই রমণীর পাশে দাঁড়ানো মানেই ধীরে ধীরে নিজের সমস্ত যুক্তি হারিয়ে ফেলা। নিজেকে হারানো।

ড্রাকোনিস শিখরের পশ্চিম দিকের আকাশটা আজ অদ্ভুত রকমের স্তব্ধ। মেঘেরা যেন থেমে আছে, বাতাসও নিঃশব্দ।
রাজা ড্রাকোনিস দাঁড়িয়ে আছেন রাজপ্রাসাদের উচ্চতম ব্যালকনিতে। তার চোখ দূরের মহাশূন্যে নিবদ্ধ, যেন কিছু খুঁজে চলেছেন গভীর মনোযোগে। হ্যাঁ, তিনি জানেন—এথিরিয়ন কোথাও গেছে। কিন্তু কোথায়?
প্রাসাদজুড়ে জাদুকরী সিগনাল পাঠানো হয়েছে, এলড্র প্রযুক্তির মাধ্যমে তার অবস্থান খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা চলছে। তবুও এথিরিয়নের অস্তিত্ব কিছুতেই ধরা পড়ছে না।
প্রবীণ ড্রাগন সৈন্যরা উদ্বিগ্ন, দাস-দাসীরা গুঞ্জন করতে শুরু করেছে। তবুও ড্রাকোনিস স্থির।
তিনি শুধু একবার ধীরে বলেন, “সে এথিরিয়ন… আমার ছেলে… অকারণে নিজেকে হারিয়ে ফেলবে না বিশ্বাস আমার।” কিন্তু সবার মতো স্থির থাকতে পারছেন না সিলভা।
এথিরিয়নের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার পর থেকে যেন প্রতিটি মুহূর্ত তার কাছে বিষাক্ত হয়ে উঠছে। আকাশের দিকে তাকালেই বুক ধড়ফড় করে ওঠে। কোথায় গেলো সে? কেনো কিছু না বলেই চলে গেলো?
প্রতিটি ঘন্টা যেন এক একটি যুগ। সিলভা কয়েকবার এথিরিয়নের বন্ধুদের কাছে গিয়ে তার অবস্থান জানতে চেয়েছে। কিন্তু কোনো সদুত্তর না পেয়ে সে যেন নিজের ভিতরেই পুড়ছে।সিলভা জানে না কেন, তবে তার মন বলছে—এথিরিয়ন গেছে এমন কোনো স্থানে, যেখানে গেলে ফেরাটা সহজ নয়…

ফ্লোরাস রাজপ্রাসাদের পূর্ব শাখায় আজ অদ্ভুত এক নীরবতা। প্রিন্সেস অ্যালিসার কক্ষজুড়ে হালকা নীল আলো ছড়িয়ে আছে। জানালার পাশে বসে আছে সে, নিষ্পলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বাইরে। মনে হচ্ছে—তার চোখের পলকও যেন ভুলে গেছে ঝাপটা দিতে।
রাজা জারেনের আদেশে অবশেষে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়—অ্যালিসার মানসিক অবস্থার উন্নতির জন্য একজন বিশেষজ্ঞ ডাকা হবে। এবং সেই দায়িত্ব পড়ে ডক্টর আগ্নিসের হাতে।
ডক্টর আগ্নিসস—একজন সাইকো-নিউরাল থেরাপিস্ট, একইসাথে মহাজাগতিক মেমোরি মডিউলস বিশ্লেষক। তবে তিনি শুধু একজন চিকিৎসক নন, বরং অতীত, স্মৃতি আর অন্তর্জগৎের গভীরে পৌঁছে যাওয়া এক শক্তিমান নিরীক্ষক।
যখন তিনি ফ্লোরাস প্রাসাদে প্রবেশ করেন, তার পরনে ছিল সাদা-রূপালি ব্লেজার, চোখে হালকা নীল কন্ট্যাক্ট লেন্স, এবং হাতে একটি স্মৃতি-পঠন যন্ত্র।
রাজা জারেন নিজে এসে ডক্টর আগ্নিসকে অ্যালিসার ঘরে নিয়ে যান। অ্যালিসা তাকিয়ে থাকে এক দৃষ্টিতে। কিন্তু ডক্টর আগ্নিস কোনো কথা বলেন না। শুধু এক ঝলক অ্যালিসার চোখের দিকে তাকিয়ে হালকা হাসেন।

বেইজিং শহরের এক মনোরম সন্ধ্যা। জানালার বাইরে শহরের আলো জ্বলজ্বল করছে, দূরে হালকা কুয়াশার পর্দার মতো ঠান্ডা বাতাস বইছে। শহরের হৃৎপিণ্ডে অবস্থিত মিস্টার চেন শিং-এর অভিজাত বাংলোতে সেই সন্ধ্যাটা ছিল অন্যরকম। রোদ ফুরিয়ে যাওয়ার পর নরম আলো আর চায়ের সুগন্ধে ভরে উঠেছিলো ড্রয়িং রুমটি।
জ্যাসপার, ফিওনা, মিস্টার চেন শিং, আলবিরা ও থারিনিয়াস—পাঁচজন একসাথে নরম সোফায় বসে হালকা হাসি আর গল্পে ডুবে ছিল। ফিওনার হাতে ধরা ছিল এক কাপ গরম কফি, চোখে তার প্রশান্তির ছোঁয়া। মাঝে মাঝে সে জানালার বাইরে তাকিয়ে বেইজিংয়ের আলোকোজ্জ্বল আকাশ দেখছিল।
আড্ডার মাঝেই হঠাৎ করেই ডোরবেল বেজে ওঠে। শঙ্খধ্বনির মতো সেই আওয়াজে ঘরের নীরবতা খানিকটা কেঁপে ওঠে। আলবিরা উঠে গিয়ে দরজা খোলে। বাইরে দাঁড়িয়ে এক ডেলিভারি ম্যান—কাঁধে তার কালো ব্যাগ, হাতে একটি বড় পার্সেল। চোখে তার ক্লান্তির রেখা, কিন্তু মুখে অদ্ভুত এক গম্ভীরতা।
“মিস্টার জ্যাসপার অরিজিন?” মৃদু স্বরে প্রশ্ন করে সে।
জ্যাসপার চোখ মেলে এক মুহূর্ত তাকিয়ে থাকে। তারপর নিঃশব্দে এগিয়ে এসে সাইন করে পার্সেলটি গ্রহণ করে। পার্সেলটা ফিওনার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললো “এটা তোমার জন্য, হামিংবার্ড,” — তার ঠোঁটে এক রহস্যময় হাসি নিয়ে।

ফিওনা কৌতূহলভরে পার্সেল খুলে ফেলে। প্রথমে একটু ভেবেই ছিল কোনো বই বা পোশাক হবে। কিন্তু প্যাকেট খোলায় পর ট্রান্সপারেন্ট বাক্সটি সাথে সাথেই পুরো ঘর যেন আলোয় ঝলমল করে ওঠলঝ।
বাক্সের ভেতরে রাখা ছিল একটি অভূতপূর্ব গোলাপ—
একটি রেড ডায়মন্ড গোলাপ।
গোলাপটি ছিল সম্পূর্ণ রত্নখচিত। তার পাপড়িগুলো তৈরি হয়েছে ভিন্ন ভিন্ন শেডের রেড ডায়মন্ড দিয়ে—হালকা গোলাপি থেকে শুরু করে গাঢ় রক্তবর্ণ। প্রতিটি পাপড়ির প্রান্ত সোনার সুতোয় বাঁধা, যেন সূর্যের আলোতে লাল আগুনের মতো জ্বলছে। পাতাগুলো ছিল টুকটুকে সবুজ প্লাটিনামের তৈরি, আর ডাঁটাটি ছিল বিশুদ্ধ খাঁটি সোনার। ফুলের বুকে, ঠিক মাঝখানে একটি ছোট্ট হৃদয় আকৃতির হীরা বসানো, যা প্রতিটা আলোয় আলাদা আলাদা রঙে ঝিলমিল করছিল।

সাথে থাকা কার্ডটিতে লেখা ছিল—”For the one who bloomed in my dark galaxy – Jasper.”
সবার চোখ তখন স্থির। মিস্টার চেন শিং চোখের চশমা খুলে আবার পরলেন। থারিনিয়াস একটু কাশলেন যেন নিজের বিস্ময় ঢাকতে চান। আর ফিওনা… সে স্তব্ধ।
“প্রিন্স… এটা কতোটা দামী?” জ্যাসপার ধীরে এগিয়ে এসে ফিওনার পাশে বসে বললো, “এই গোলাপটা আমি বিশেষভাবে তৈরি করেছি—রেড ডায়মন্ডকে কেটে, সাজিয়ে, জীবন্ত গোলাপের মতো করে গড়েছি। এর মূল্য মাত্র ২৮০ কোটি টাকা… এবং প্লাস, কারণ এর আসল মূল্য টাকার মাপে হয় না।”
ফিওনা নিঃশ্বাস বন্ধ করে তাকিয়ে থাকলো সেই গোলাপের দিকে। জীবনে অনেক উপহার পেয়েছে সে—কিন্তু এমন ভালোবাসার, এমন নীরব উচ্চারণের… এমন শিল্পসৃষ্ট উপহার, যা শব্দেরও ঊর্ধ্বে।
জ্যাসপার হালকা হেসে বলে, “তুমি আমার নক্ষত্র, হামিংবার্ড। আমি চেয়েছিলাম এমন একটা গোলাপ বানাতে, যা একদিনও বিবর্ণ হবে না যেটা কোনোদিন ও শুকিয়ে যাবেনা সব চিকচিক করবে। ঠিক যেমন তুমি আমার হৃদয়ে সারাজীবন আলোকিত হয়ে থাকবে।”

সে মুহূর্তে, ফিওনার চোখে এক ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ে। কিন্তু সে হেসে ফেলে। “এই গোলাপটা আমি কোথায় রাখবো, প্রিন্স?” জ্যাসপার উত্তর দিলো, “আমার হৃদয়ের মতোই—সবচেয়ে নিরাপদ জায়গায়।”
সবার চোখে বিস্ময়। চেন শিং নিচু গলায় বলে উঠলো,
“এটা তো একটা সম্পূর্ণ রাজকীয় উপহার…!”
আলবিরা অবাক হয়ে বললো,“এই রকম রত্নে গড়া ফুল পৃথিবীর কোথাও আছে বলে তো শুনিনি।”
আর ফিওনা তখনো তাকিয়ে ছিলো সেই গোলাপটার দিকে—যেটা এখন থেকে তার জীবনের সবচেয়ে দামি, সবচেয়ে আবেগভরা উপহার হয়ে থাকল।

রাত নেমে এসেছে শহরের গায়ে। চেন শিং এর কাঁচঘেরা বাড়িটা এখন নিঃস্তব্ধ। শুধু দূরে কোথাও হালকা ঝিঁঝিঁ পোকার আওয়াজ, আর মাঝে মাঝে পাহাড়ি বাতাসের ধাক্কায় কাঁচের দরজায় ক্ষীণ ঠকঠক শব্দ।চাঁদের আলোয় ঘরের ভেতরটাও স্নিগ্ধ হয়ে উঠেছে। বাথরুমের দিকের দরজাটা একটু খুলে যায়।
ফিওনা শাওয়ার শেষ করে ভেজা চুলে, শরীরটা টাওয়ালে জড়ানো অবস্থায় বেরিয়ে আসে। টাওয়ালের সাদা কাপড়টা কোমরের নিচে পর্যন্ত ঝুলে আছে। তার ত্বকে এখনো জলের ফোঁটা ঝিকিমিকি করছে। জ্যাসপার তখনও আগের শপিংমলের স্মৃতিতে আটক—সেই বডিকন ড্রেসে ফিওনা যেন ঠিক তার সীমাহীন ধৈর্যের পরীক্ষা নিচ্ছিল।
এই মুহূর্তে ফিওনা-কে এভাবে সামনে দেখে জ্যাসপার-এর দৃষ্টি স্থির হয়ে যায়। সে আর নিজেকে সামলে রাখতে পারে না। ধীরে ধীরে সে ফিওনার কাছে এসে দাঁড়ায়।ফিওনা চোখ মেলে জ্যাসপারকে দেখে—তার চোখে একরকম আগুন জ্বলছে, অথচ মুখটা শান্ত।

জ্যাসপার হঠাৎ ফিওনাকে আয়নার সামনে থেকে জড়িয়ে ধরে,তার গলা বরাবর নরম করে ঠোঁট ছোঁয়ায়। ফিওনা একটু কেঁপে ওঠে, কিন্তু পিছিয়ে আসে না। জ্যাসপার এর ঠোঁট ধীরে ধীরে গাল ছুঁয়ে চলে যায় ঘাড়ের দিকে।পুরো মুহূর্তটা নিঃশব্দ, শুধু ওদের নিঃশ্বাসের শব্দ যেন ঘরটাকে ভরিয়ে তোলে।
জ্যাসপার ধীরে ধীরে ফিওনাকে কোলে তুলে বিছানার দিকে এগোয়। ফিওনা ওর কাঁধে মাথা রেখে চোখ বন্ধ করে ফেলে, যেন তার নিঃশ্বাসেও জ্যাসপারের স্পর্শ মিশে আছে।
বিছানায় পৌঁছে জ্যাসপার ফিওনাকে আলতো করে নামিয়ে দেয়। তারপর সে ওর পাশে শুয়ে পড়ে। নিঃশব্দে ফিওনার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ, যেন এক জীবনের গল্প জমা হয়েছে ঐ চোখজোড়ায়।
জ্যাসপার মাথা নিচু করে ফিওনার ঠোঁটে এক কোমল চুমু এঁকে দেয়।ফিওনা চোখ খুলে তাকায় ওর দিকে, কোনো প্রতিবাদ নেই, শুধু এক গভীর অনুভব।জ্যাসপার তখন তার ঠোঁট নামিয়ে আনে ফিওনার গলায়, সেখান থেকে ধীরে ধীরে বুকের কাছে—তার প্রতিটি স্পর্শে ফিওনার দেহ যেন কেঁপে ওঠে।
জ্যাসপার চোখে তখন একরকম উন্মাদনা। সে আর নিজেকে ধরে রাখতে পারে না। ফিওনার শরীর থেকে টাওয়ালটা খুলে ছুঁড়ে ফেলে দেয়। মুহূর্তেই তার নিঃশ্বাস গাঢ় হয়ে ওঠে, চোখদুটো যেন আগুনের মতো জ্বলছে।
কিন্তু ঠিক তখনই ফিওনা নিজের হাত ক্যাসপারের বুকে রেখে হালকা করে ঠেলে দেয়। “প্রিন্স, তুমি ভুলে গেছো?” — তার কণ্ঠে কোমলতা, কিন্তু দৃঢ়তাও স্পষ্ট।

জ্যাসপার হঠাৎ থমকে যায়। ফিওনার কথাগুলো যেন বজ্রের মতো তার মাথায় বাজে। মনে পড়ে যায়—ফিওনা গর্ভবতী। তার শরীরে এখন আরেকটি প্রাণ বহন করছে। তার চোখে অস্বস্তি আর অপরাধবোধের ছায়া নেমে আসে।
সে এক ঝটকায় উঠে পড়ে। বিছানার পাশ থেকে চাদর তুলে ফিওনার শরীরে জড়িয়ে দেয়—নিজের হাতগুলো কাঁপছে একটু। কোনো কথা না বলে, সে মেঝেতে পড়ে থাকা ফিওনার টাওয়ালটা হাতে নিয়ে বাথরুমের দিকে চলে যায়, দরজাটা ভেতর থেকে বন্ধ করে দেয়।
ঘরের মধ্যে তখন শুধু নীরবতা।ফিওনা চুপচাপ চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকে, জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিচ্ছে।
বাথরুমে ঢুকে জ্যাসপার দরজাটা বন্ধ করে দেয়। কিন্তু ভেতরের ঝড় থেমে নেই।ফিওনার ঘ্রাণ যেন এখনো ওর নাকে লেগে আছে। একটু আগে তার গায়ে ছোঁয়া, সেই ঠোঁটের স্বাদ, আর সবচেয়ে বেশি মাথায় বাজছে ফিওনার সেই বডিকন ড্রেসের দৃশ্য। প্রতিটা অনুভব যেন আগুন জ্বেলে দিচ্ছে ওর রক্তে।

হঠাৎ করে জ্যাসপার ফিওনার টাওয়ালটা চোখের সামনে ধরে। সেই টাওয়ালটা এখনও ফিওনার শরীরের ঘ্রাণে ভরপুর। সে নাকের কাছে এনে ধরে—আর ঠিক তখনই যেন তার মাথা আর শরীর দুই-ই বিদ্রোহ করে বসে।
“Bloody hell…” — নিজের ভেতরের গর্জনটা চাপা দিতে পারে না সে। সে হঠাৎই বাথটাবে গিয়ে বসে পড়ে। ঠান্ডা পানি ছেড়ে দেয় নিজের উপর, যেন শরীরের উত্তাপটা কমাতে পারে। কিন্তু পানি গায়ে পড়লেও, উত্তেজনার জ্বালা থামে না। সে দুই হাতে মুখ ঢেকে রাখে, নিঃশ্বাস ক্রমেই ভারী হয়ে ওঠে।
তার চোখে এখন অপরাধবোধের ছাপ। সে ফিওনাকে ভালোবাসে—কিন্তু তার শরীর, তার আকর্ষণ যেন বারবার নিজের সীমা ভাঙতে চাইছে।

ঠান্ডা পানির ধারা জ্যাসপারের শরীর জুড়ে বয়ে চলেছে, কিন্তু ভিতরের আগুন নিভছে না। ফিওনার সেই ঘ্রাণ—যেটা এখনো টাওয়ালের ভাঁজে লেগে আছে—তার নাকের ঠিক সামনে। সে একবার চোখ বন্ধ করে, এক মুহূর্তের জন্য ফিওনাকে যেন পুরোপুরি অনুভব করতে চায়।
তার এক হাত তখনও শক্ত করে ধরে রাখা ফিওনার টাওয়াল, অন্য হাতটা নিজের অজান্তেই সরে যাচ্ছে শরীরের সবচেয়ে সংবেদনশীল জায়গার দিকে। নিঃশ্বাস ধীরে ধীরে ঘন হয়ে ওঠে। জ্যাসপার আর কিছু ভাবতে পারে না—এই মুহূর্তে কেবল ফিওনার শরীর, তার কোমলতা, তার মুখের সেই অসহায় চাহনি ভাসছে চোখের সামনে।
সে নিজের শরীরের উপর একরকম অধিকার ফলাতে শুরু করে—নিঃশব্দে, নিভৃতে। ঠান্ডা পানির ধারা তার পিঠ বেয়ে পড়ছে, আর সামনে ফিওনার টাওয়ালটা যেন আগুন জ্বালিয়ে দিচ্ছে ওর রক্তে।
এই মুহূর্তে জ্যাসপার জানে, সে যা করছে, তা শুধু শারীরিক মুক্তি নয়—এই ভালোবাসা, এই আকাঙ্ক্ষা, এই যন্ত্রণা—সব একসঙ্গে তার মন আর শরীরকে গ্রাস করছে।

জ্যাসপার আর সহ্য করতে পারছে না।ফিওনার ঘ্রাণ, তার শরীরের ভেজা আভা, সেই নিষ্পাপ চাহনি—সব মিলে তার ভিতরটা ঝাঁপিয়ে পড়তে চাচ্ছে। কিন্তু সে জানে,ফিওনা এখন একা নয়। তার শরীরের ভেতরে আরেকটা প্রাণ বাড়ছে। আর জ্যাসপার সেই প্রাণেরও দায়িত্বে।
সে দাঁত চেপে নিজেকে সামলাতে চায়, কিন্তু শরীর বিদ্রোহ করে বসে। তীব্র আকর্ষণ আর আবেগের ধাক্কায় সে কাঁপতে থাকে। বাথটাবের এক কোণে রাখা ছোট একটা ব্লেড-জাতীয় ধাতব বস্তু হাতে তুলে নেয় সে। চোখ দুটো লালচে, ঠোঁট কামড়ে ধরে। আর এক মুহূর্ত অপেক্ষা না করে সে নিজের বাম হাতের তালুর ভেতর দিয়ে গভীর এক দাগ কাটে।

আযদাহা সিজন ২ পর্ব ৪০

এক ঝলক রক্ত বেরিয়ে আসে, ব্যথায় তার শরীর শিউরে ওঠে, কিন্তু মনটা শান্ত হতে থাকে।
রক্ত মিশে যায় ঠান্ডা পানির স্রোতে—সবুজ হয়ে ছড়িয়ে পড়ে বাথটাবের স্বচ্ছ জলে। সে নিঃশব্দে হু হু করে শ্বাস নেয়। ব্যথা যেন একমাত্র উপায় নিজেকে বাস্তবে ফেরানোর।চোখ খুলে দেখে ফিওনা এখনো জানে না সে কী ঝড় থামিয়ে দিল।

আযদাহা সিজন ২ পর্ব ৪২