প্রণয়ের সন্ধিক্ষণে সিজন ২ পর্ব ৪৯
আদ্রিতা নিশি
অরিত্রিকার বক্ষপিঞ্জরে অকস্মাৎ যেন তান্ডব বইয়ে যায়। হৃদপিন্ড তড়িৎ বেগে লাফাতে থাকে। আতংকে হাত – পা ঠান্ডা হয়ে আসে। সে মাথা নিচু করে মেঝেতে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে। চক্ষুদ্বয় ছলছল করে উঠে। টুপটাপ অশ্রু বিন্দু গড়িয়ে পড়ল গাল পেয়ে। সাহস সঞ্চার করে অশ্রুসজল চক্ষুদ্বয় উঁচিয়ে তাকায় সামনে দন্ডায়মান মানুষটার দিকে। দুজনের চোখাচোখি হয়। অদৃশ্য অনুভূতিরা জেঁকে ধরে। ভীতি, দ্বিধা, প্রণয়ানুভূতি যেন জর্জরিত করল তাকে। পরিস্থিতির চাপে ভীত তটস্থা ছোট্ট দেহখানা দোদুল্যমান হলো। নিজেকে সামলে নেয়। ভীতিগ্রস্ত হৃদয়কে সাহসী করে তোলে। মন ও মস্তিষ্কের নিরব দ্বন্দ্বের অবসান ঘটানোর চেষ্টায় মত্ত হয়। ওষ্ঠ কামড়ে কান্না নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করে। উপস্থিত সবাইকে অবাক করে সাহসীকতার সহিত সকলের সামনে — মাথা ধীর ভঙ্গিমায় উপর নিচ নাড়িয়ে “ হ্যা বোধক সমর্থন করে। সে সারহান ভাইকে ভালোবাসে, খুব ভালোবাসে। নেতা সাহেবের না হওয়া বিবিজান নেতা সাহেবকে নিজের থেকে বেশী ভালোবাসে। এসব মিথ্যা নয় সত্যি, চরম সত্যি। ”হৃদস্পন্দন যেন অস্বাভাবিক ভাবে বাড়তে থাকে। ঘন ঘন শ্বাস ফেলতে থাকে। তৎক্ষনাৎ দৃষ্টি আড়ষ্টতায় নত করে ফেলে।
তানিয়া বেগম বিস্মিত হলেন। ছোট্ট মেয়েটা তার ছেলেকে কবে থেকে ভালোবাসে! তিনি বুঝতে কেন পারেননি? সাথী বেগম শুকনো ঢোক গিলেন। কিঞ্চিৎ উত্তেজনা, ভয়ে জমে যান। ভয়ার্ত দৃষ্টিতে তাকান স্বামীর দিকে। ইসমা বেগম ধপ করে মেঝেতে বসে পড়লেন। মুখে কাপড় চেপে নিঃশব্দে কাঁদতে লাগলেন। কি থেকে কি হয়ে গেল? তিনি ছেলেকে কী জবাব দেবেন!
“ তোমরা কি শুরু করেছো? মশকরা করছো আমার সাথে? ”
আজমল সাহেব রেগেমেগে চিৎকার করে বললেন। আরশাদ সাহেবের স্তম্ভিত ভাব কেটে যায়। মনে মনে ভাবেন, ছেলে তার সব ধরনের প্রস্তুতি নিয়ে মাঠে নেমেছে। একের পর এক ছক্কা মার*ছে। সারহান হাত উঁচিয়ে ইশারা করে থেমে যাওয়ার জন্য। আজমল সাহেব চুপ হয়ে গেলেন।
সারহান শক্ত কন্ঠে বলে;
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
“ আপনার সাথে মশকরা করার সময় আমার নেই। ”
সে থামে, পুনরায় অতি শান্ত চাহনিতে তাকায় অরিত্রিকার মুখপানে। দৃঢ় কন্ঠে শুধায় ;
“ বিয়ে করব তোকে। বউ হবি আমার? ”
অরিত্রিকা কেঁপে উঠে। ভেজা নেত্রপল্লব ঝাপটে তাকায় সারহানের দিকে। অন্তঃকোণ শীতল হয়ে যায়। সকলের বিস্মায়াবিষ্ট চাহনি উপেক্ষা করে ভেজা কম্পনরত কন্ঠে বলল ;
“ বউ.. হতে চাই আপনার।”
আজমল সাহেব হতবিহ্বল। সারহানে বজ্রস কন্ঠ;
“ ফাইরুজের উত্তর পেয়েছেন নিশ্চয়ই। এখন বুঝতে পারছেন কেন আপনার মেয়ে ইরফানকে বিয়ে করবে না। ”
আজমল সাহেব ফুঁসে উঠলেন। দ্রুত পায়ে এগিয়ে গেলেন মেয়ের দিকে। সরাসরি হাত উঁচিয়ে থাপ্পড় মা*রলেন মেয়ের গালে। অরিত্রিকা অকস্মাৎ থাপ্পড়ে কিছুটা পিছিয়ে গেল। তীব্র জ্বলুনি অনুভব হতে ফুপিয়ে কেঁদে উঠল। এক হাতে গাল চেপে ধরল। অবিশ্বাস্য লাগল বাবা তাকে থা*প্পড় মেরেছে!তানিয়া বেগম এবং সাথী বেগম সবেগে আগলে নিলেন মেয়ে। আরশাদ সাহেব হতভম্ব হয়ে গেলেন। সাদাত রেগে গেল। তার ইচ্ছে করল কয়েক কথা শুনিয়ে দিতে কিন্তু আপাতত চুপ থাকল।
আজমল সাহেব বিক্ষিপ্ত, বিক্ষুব্ধ। রাগ যেন ঠিকরে পড়ছে। তিনি রাগান্বিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে উচ্চস্বরে বললেন;
“ তোমার সাহস কী করে হলো আমার মতের বিরুদ্ধে কথা বলার? আমার কথার অবাধ্য হওয়ার সাহস কোথায় পেলে?বেয়াদব অসভ্য মেয়ে লজ্জা সরম ভুলে সবার সামনে কীভাবে বললে বিয়ের কথা? আমার অগোচরে এসব করে বেড়াচ্ছো?”
আরশাদ সাহেব এগিয়ে আসলেন।ধমকে বললেন ;
“ আজমল বাবা হয়ে মেয়েকে মা*রছো—এটা কী ধরনের ব্যবহার?”
“ভাইসাব মেয়েটা আমার সম্মান ধূলিসাৎ করে দিল। আমি সহ্য করতে পারছি না। আমার অগোচরে এতো বড় ভুল কীভাবে করল?”
“ মাথা ঠান্ডা করো।সব ঠিক হয়ে যাবে।”
“অসভ্য মেয়ে আমার মান সম্মান শেষ করে দিয়েছে।”
বাবার ক্রোধান্বিত কন্ঠ, বাচনভঙ্গি এবং জ্বলন্ত চাহনি যেন অরিত্রিকার ভয়ের মাত্রা বাড়িয়ে দিল। নিঃশব্দে অশ্রু বিসর্জন দিতে লাগল। আজমল সাহেব ক্রুদ্ধ হয়ে বললেন;
“ তুমি সত্যি সারহানকে ভালোবাসো? নাকি মিথ্যা বলছো?”
অরিত্রিকা শিউরে উঠল ভয়ে। কান্নার গতি বাড়ল! জড়োসড়ো হয়ে তানিয়া বেগমের কাছে চেপে গেল।শুষ্ক ঢোক গিলে হেঁচকি তুলে কন্দনরত কন্ঠে জবাব দিল ;
“ আব্বু,আমি সত্যি সারহান ভাইকে.. ভালোবাসি।”
আজমল সাহেব পুনরায় বিক্ষিপ্ত বিক্ষুব্ধ হয়ে তেড়ে এলেন। হাত উঁচিয়ে থাপ্পড় মারতে উদ্যত হলেন কিন্ত মারতে পারলেন না। সারহান বিলম্ব না করে সামনে এসে দাঁড়ায় এবং হাত ধরে ফেলে। বজ্র কন্ঠে বলে ;
“ আপনি ফাইরুজকে থাপ্পর মে*রে ভুল করেছেন। আপনার জায়গায় অন্য কেউ কাজটা করলে হাত হাতের জায়গায় থাকতো না। আজকের মতো ভুল আবার করার চেষ্টা করবেন না। মেয়ের মুখে সত্যিটা জানার পরেও কেন নির্বোধের মতো আচরণ করার কারণ কী?”
“ তুমি আমার মেয়েকে ফাঁসিয়েছ। ভাইসাব আপনার ছেলে আমার মেয়েকে ফাঁসিয়েছে।”
“আপনার মেয়ে অবুঝ নয়। ভালোবাসা এবং ছলনার মধ্যে তফাত করতে শিখেছে। দয়া করে লজিকলেস কথাবার্তা বলা বন্ধ করুন।”
“আমি তোমার সাথে আমার মেয়ের বিয়ে দেবো না।”
“ আপনার কষ্ট করার কোনো দরকার নেই। বিয়ের কাজটা না হয় আমি একাই সামলে নেব। ”
সাদাত এগিয়ে আসল এবার। মেকি হেসে বলল ;
“আরে ব্রো তুমি একা কেন? আমিও আছি বিয়ের কাজ সামলে নেওয়ার জন্য।”
সারহান আজমল সাহেবে হাত ছেড়ে দিল। বক্ষপটে হাত গুঁজে দাঁড়াল। অভিব্যক্তি কঠোরতা দাম্ভিকতার আড়ালে রহস্যময় সত্তা। তানিয়া বেগম সহসা বললেন ;
“সারহান এবং অরিত্রিকা একে অপরকে ভালোবাসে । দুজন দুজনকে বিয়ে করতে চায়। আমার মনে হয় তাদের সিদ্ধান্ত আমাদের মেনে নেওয়া উচিত। নয়তো হিতে বিপরীত হতে পারে। ”
আজমল সাহেব ক্ষিপ্ত হলেন;
“ইরফানের কথা কেন ভাবছেন না ভাবী?”
“ইরফানের জন্য খারাপ লাগছে বটে। ছেলেটা আপনি এবং আপনার বোনের জন্য দুরাবস্থায় পড়ল। আমরা সকলে স্পষ্ট বুঝতে পারছি আপনারা ইচ্ছাকৃত সারহানকে দূরে সরিয়ে অরিত্রিকার বিয়ে ইরফানের সাথে ঠিক করেছিলেন। যাই হোক,ইরফান আসলে ভালোভাবে বোঝান। ”
“আপনার ছেলের সাথে আমার মেয়ের বিয়ে দেব না ভাবী। ”
আজমল সাহেবের ক্রুদ্ধ কন্ঠস্বর। তানিয়া বেগম বিরক্ত হলেন। সারহানের ওষ্ঠকোণে বাঁকা হাসি ;
“ আমার ক্ষমতা সম্পর্কে অবগত নন আপনি। ভদ্রতার খাতিরে আপনার সম্মতি নিয়ে আপনার মেয়েকে বিয়ে করতে চাইছি অথচ আপনার ভালোলাগছে না। ব্যাপার না!ফাইরুজের যেহেতু আমাকে বিয়ে করতে আপত্তি নেই তাহলে আপনার অনুমতি ব্যতিত বিয়েটা করে ফেলা যায় । কী বলেন চাচা?”
আজমল সাহেব কাঠিন্যতা এটে বললেন;
“ আমাকে ভয় দেখাচ্ছো? ”
“ ভয় নয় আগত পরিস্থিতি সম্পর্কে অবগত করছি। আমার মাঝে কী এমন কমতি আছে তাই মেয়েকে বিয়ে দিতে চাইছেন না? বলুন।”
“তুমি রাজনীতি করো।”
সারহানের কপাল কুঁচকে যায়। ভরাট কন্ঠে বলে ;
“ ছাত্র জীবনে রাজনীতি আপনিও করেছেন অথচ দোহাই দিচ্ছেন রাজনীতির! হাস্যকর! আসল কারণ রাজনীতি নয় অন্যকিছু। দুবছর আগে রাজনৈতিক সমাবেশে বু*লেটটা আপনার বুকে না লেগে আমার বুকে লাগত তাহলে হয়তো পরিস্থিতি অন্যরকম হতো। এখনো পুরনো তিক্ত ঘটনার জন্য আমায় অপ*রাধী বানিয়ে দিচ্ছেন সবার সামনে! এতে যদি আপনি ভালো থাকেন তাই হোক। তবে শুনে রাখুন, সেদিনের ঘটনা জাস্ট একটা এক্সিডেন্টে ছিলো! নাথিং অ্যাট অল। আপনাকে পরিষ্কার করে জানিয়ে দিতে চাই, আপনি এবং আপনার বোন আমার কাছে ঘৃন্য মনোভাবাপন্ন ব্যক্তি। যারা নিজেরা নিজেদের স্বার্থে আমায় ব্যবহার করেছেন এবং স্বার্থ হাসিল করেছেন। স্বার্থান্বেষীর মতো স্বার্থ হাসিল করতে গিয়ে ইরফানকে গুটি হিসেবে ব্যবহার করেছেন। আপনাদের আমি ছাড় দেবো না।”
সারহান থেমে ইসমা বেগমের তাকিয়ে তাচ্ছিল্য করে বলে;
“আমার থেকে অরিত্রিকাকে কেড়ে নিয়ে নিজের স্বার্থ হাসিল করতে চেয়েছিলেন ফুপি! কিন্তু আফসোস দীর্ঘ অপেক্ষার পরে আপনাকে শূন্য হাতে ফিরতে হবে। যে কারণে প্লান করে এতো দূর এলেন তা নিমেষে মাটিতে মিশে গেল। আফসোস আপনি এবং আপনার মনোবাসনার সমাপ্তি খুব শীঘ্রই ঘটবে। কিছুটা সময় দিলাম নিজেকে বাঁচিয়ে নিন। অল দ্য বেস্ট।”
ইসমা বেগম কেঁদে উঠলেন। আজমল সাহেব দমে গেলেন। দীর্ঘ দিনের পরিকল্পনায় এভাবে পানি ঢেলে দিবে বুঝতে পারেননি। বাকি সবার মতো তিনি বুঝলেন না কথাটির মানে। সাদাতের রাগ তরতর করে বাড়ছে। কী হচ্ছে!কী বলছে কিছু বুঝতে পারছে না। তবে ভাইয়ের থেকে পয়েন্টে পয়েন্টে কথা গুলো মগজে সেট করে রাখছে। কারণ যখন তখন কাজে লাগতে পারে। অরিন হাতে থাকা ফোনটির লক খুলে আবিরকে কিছু একটা লিখে মেসেজ পাঠালো। অতঃপর সকলের দিকে নজর বুলিয়ে নিলো। সারহান অরিত্রিকার দিকে তাকিয়ে ইশারা করল এগিয়ে আসার জন্য। মেয়েটা অশ্রুসজল চক্ষুদ্বয় নিয়ে টলটলে পায়ে এগিয়ে এসে কল্পপুরুষের পাশে দাঁড়াল। হঠাৎ পুরুষালি অমসৃণ হাত যেন তার বাহুকে আগলে ধরল। শক্ত প্রশস্ত বুক্ষে টেনে নিল সযতনে। ছোট্ট দেহখানা কাঁপল!থমকাল!শিহরিত হলো। লজ্জায়, আড়ষ্টতায় নেতিয়ে গেল। থমকিত সত্তায় কান্নার বেগ কমে এলো। অথচ সারহান নির্ভীক এবং নির্লিপ্ত। কঠিন খোলসে আবৃত এক গুরুগম্ভীর ব্যক্তিত্ব। যার কার্যে কোনো দ্বিধার ছোঁয়া নেই। এহেন দৃশ্যে সকলের চক্ষু চড়কগাছ।সবাই স্তম্ভিত ভাব নিয়ে একে ওপরের দিকে তাকাল। নিস্তব্ধতা ভেঙে তীক্ষ্ণ, ধা*রালো তীরের ন্যায় উদ্দাম বেগে ছুটে এলো একটি স্বর ;
“আগামী শুক্রবার আমার এবং ফাইরুজের আকদের ব্যবস্থা করুন বাবা।”
আরশাদ সাহেব বিপাকে পড়েছেন। ছেলের একরোখা জেগে যেন ক্লান্ত হয়ে পড়ছেন তিনি। আজমল সাহেব চিল্লিয়ে বললেন ;
“ ভাইসাব আপনার ছেলের স্পর্ধা দেখে আমি অবাক হয়ে যাচ্ছি। আপনি কিছু বলুন।”
আরশাদ সাহেব মুখ খুললেন।গলা খাঁকড়ি দিয়ে বললেন ;
“ ইয়ে মানে এমপি হয়ে সাদামাটা বিয়ে করলে কেমন একটা দেখায় না? তুমি বরং ডেটটা একটু পিছিয়ে দাও।”
“ভাইসাব এসব আপনি কী বলছেন?”
“ কেনো ভুল কি বলেছি?”
“ আপনরা রাজনীতি করা ছেলের সাথে মেয়ে বিয়ে দিবো না। আগে মা*রামা*রি,কা*টাকা*টি করতো। এখন সেসব কিছু ছেলেপুলেদের দিয়ে পরিচালনা করায়। আরেকটা ভয় তো আছে— সেটা হলো কখন বিরোধী পক্ষ হা*মলা করে মে*রে গুম করে দেবে আমরা টেরও পাবো না। আমার মেয়ের জীবন নষ্ট করতে আমি রাজি নই।”
“বিরোধী পক্ষ তোমায় কতোদিন হা*মলা করেছে আজমল?”
আরশাদ সাহেবের কন্ঠস্বর দৃঢ়। সারহান তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল;
“আমি রাজনীতি করি,মা*রামারি, কা*টাকা*টি কিংবা সন্ত্রা*সী কারবার করি তবুও আপনার মেয়ে আমাকে চায়। আমার কারণে আপনার মেয়ে সহিসালামতে চলাফেরা করছে নয়তো কেঁদে কুল পেতেন না। বেশী কথা না বাড়িয়ে যা বলছি তাই করুন।”
অরিন এগিয়ে এলো। বাবাকে উদ্দেশ্য করে বলল ;
“ আব্বু, সারহান ভাই এবং অরিত্রিকা দুজন দুজনকে ভালোবাসে, বিয়ে করতে চায়। তুমি বাঁধা দিও না।”
আজমল সাহেব ধমকে উঠলেন;
“বেয়াদব মেয়ে চুপ করো।”
“ আব্বু, তুমি তোমার জেদের কারণে অরিত্রিকার জীবন শেষ করতে পারো না। আমার সাথে তুমি ঠিক একই ভুল করতে চেয়েছিলে। রাহাতের মতো ফ্রডের সাথে বিয়ে দিতে চেয়েছিলে। সারহান ভাইয়ের জন্য আমার বিয়ে রাহাতের সাথে হয়নি। সারহান ভাইয়ের জন্য আজ আমি সহিসালামতে বেঁচে আছি।”
“রাহাত আর ইরফান এক নয়।”
“ জানি আমি। তবুও বলবো ভেবে দেখো একবার।”
আজমল সাহেব মুখ গম্ভীর করলেন।সাদাত শব্দ করে হেসে বলল ;
“ বড় ভাই এতো তাড়াতাড়ি ছক্কা মা*রবে জানা ছিলো না। ভালোবাসলে বাঘের মতো লড়াই করতে হয়। বিড়ালের মতো ঢুস দিয়ে ছুটে পালালে হয় না। আমিও তোমার মতো বাঘ হয়ে শিকারকে ধরে নিয়ে আসব থুক্কু ভালোবাসার মানুষকে ধরে নিয়ে আসব। হিহিহি।”
সারহান তির্যক দৃষ্টিতে তাকিয়ে গম্ভীর কন্ঠে বলল;
“বাহিরে শিকার না করে ঘরে শিকার করার চেষ্টা করছিস? চেষ্টা করতে থাক। অল দ্য বেস্ট ডুড্। ”
সাদাত খুকখুক করে কেশে উঠল। কি সাংঘাতিক! ভাই তার মনের খবর কীভাবে বুঝল? কবে থেকে জানে!কীভাবে জানলো? সবকিছু মাথায় ঘুরপাক খেতে লাগল। আরশাদ সাহেব সন্দিহান দৃষ্টিতে তাকালেন ছোট ছেলের দিকে। ছেলেটার ভাবমূর্তি সুবিধার নয়।ইশরা চক্ষুদ্বয় সংকুচিত করে তাকাল প্লে বয়টার দিকে। সবার সামনে জবান চালাচ্ছে বাহ বাহ!
সারহান অরিত্রিকার দিকে তাকায়। তীক্ষ্ণ দৃষ্টি স্থির হয় চোখের কোণে অশ্রুকণার দিকে। সে হাত উঁচিয়ে বৃদ্ধা আঙুলের সাহায্য অশ্রুকণা মুছে দেয়। দৃঢ় এবং শক্ত ভাবে বাহুবন্ধনে মিশিয়ে নেয় সযতনে। ভেজা আঁখিদ্বয়ে দৃষ্টি স্থির রেখে স্পষ্টতার সহিত গম্ভীর অথচ দৃঢ় কন্ঠে অধিকারবোধ ঢেলে বলল ;
“ তুই শুধু আমার ফাইরুজ। আমি ছাড়া তোর জীবনে দ্বিতীয় কোনো পুরুষের অস্তিত্ব থাকবে না। আমার থেকে তোকে যে কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা করবে তার নামনিশানা দুনিয়া থেকে মুছে দেব। অরিত্রিকা ফাইরুজ চৌধুরী শুধুমাত্র সারহান ইদায়াত চৌধুরীর। এটাই ভবিতব্য এবং চিরন্তন সত্য।”
অরিত্রিকা কান্না থেমে গেল। দমকা হাওয়ায় শীতল স্পর্শ যেন বক্ষপিঞ্জর দীপ্তিমান করল। বিষাদগ্রস্ত মন,আতংকিত সত্তা, অভিমান যেন কর্পূরের ন্যায় মিলিয়ে গেল। ছোট্ট বাহুবন্দী দেহখানা কাঁপল। অতীত, বর্তমানের তিক্ত অনুভূতি এবং ঘটনাগুলো মানসপট থেকে হারিয়ে গেল। স্তব্ধতা মিলিয়ে ওষ্ঠকোণে ধরা দিল হাসির ঝিলিক। ফর্সা র’ক্তাভ মুখখানা উজ্জীবিত, প্রাণবন্ত হয়ে উঠল। অন্তঃকোণে ভালোলাগার অনুভূতি ছড়িয়ে পড়ল। প্রথম প্রেম নিবেদন এক হৃদয়স্পর্শী ঘটনার সাক্ষী করল। যন্ত্রমানব, নিরামিষ ,কাঠখোট্টা, বদমেজাজি, গোমড়ামুখো মানুষটা তাকে ভালোবাসে! পুরো শরীর শিরশির করে উঠল। চঞ্চলা মন নতুন অনুভূতির চাদরে সিক্ত হলো। বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে দৃষ্টি স্থির করে তাকিয়ে রইল শ্যামানবের কঠিন মুখাবয়বে।
“সারহান,তোমার চাচার মত ব্যতিত বিয়ে করবে?”
আরশাদ সাহেব কৌতুহল বশত জিজ্ঞেস করলেন৷ সারহান বাবার দিকে তাকায়। দৃঢ়জ গলায় বলে;
“যদি অমত করেন তবে সেটাই করা ছাড়া উপায় দেখছিনা। আপনি সেসব চিন্তা ভাবনা বাদ দিয়ে আগামী শুক্রবার আকদের ব্যবস্থা করুন। আগে আকদ তারপর আপনারা বড় করে রিসেপশন করুন বা না করুন আমার যায় আসে না। ”
আজমল সাহেব উত্তর দিলেন না বরং একমুহুর্ত দেরী করলেন না গজগজ করে সিঁড়ি বেয়ে নিজের রুমে চলে গেলেন। আরশাদ সাহেব ধম করে সোফায় বসে পড়লেন। চিন্তিত ভঙ্গিতে গালে হাত দিয়ে গম্ভীর মুখে বসে রইলেন। তানিয়া বেগম এসে স্বামীর পাশে বসলেন। খোঁচা দিয়ে বললেন;
“চৌধুরী সাহেব ছেলের থেকে একটু সাহস ধার নিন। বড় ভাই হয়ে ছোট ভাইকে সামান্য কথাটুকু বলতে পারলেন না!”
আরশাদ সাহেব গমগমে কন্ঠে বললেন;
“ সাহস আমার কম নেই। মনে করে দেখো, তোমার বাপের সামনে ঠিক এমন ভাবেই বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিলাম।”
তানিয়া বেগম হাসলেন;
“ আমার শশুর আব্বার ধমকের ভয়ে বলেছিলেন। ”
আরশাদ সাহেব চাপা স্বরে বললেন ;
“ তানিয়া আস্তে কথা বলো। কেউ শুনবে।”
তানিয়া বেগম ঠোঁট টিপে হাসলেন। ইশরা পদযুগল ফেলে এগিয়ে গেল ইসমা বেগমের সামনে। মাকে দুই হাত টেনে উঠালো। নরম কন্ঠে শুধাল ;
“ মা সারহান ভাই তোমার নামে কী বলছে? তুমি কি করেছো? ”
ইসমা বেগম নিষ্প্রাণ হয়ে কন্দনরত কন্ঠে বললেন;
“ ভুল করে ফেলেছি ইশু। মস্ত বড় ভুল। ”
“কী ভুল করেছো তুমি?”
“ বলার মুখ নেই।”
সাথী বেগমের বিস্ময় ভাব কেটে গেল। তিনি খানিকটা এগিয়ে গিয়ে বসলেন। দুশ্চিন্তা যেন মস্তিষ্কে ঝড় তুলেছে। সারহান এবং ইরফান দুজনে বাড়ির ছেলে। স্বভাব, চরিত্র ভালো। বলা যায় সবদিক দিয়ে পারফেক্ট। কিন্তু পরিস্থিতি বিবেচনা করলে অবস্থা ভয়াবহ।
সদর দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে ইরফান। স্তব্ধ, নির্বিকার এবং বিস্ময়াভিভূত। কেমন যেন অনুভূতি শূন্য। চোখ মুখ ফ্যাকাসে বর্ণ ধারণ করেছে। স্তম্ভিত চক্ষুদ্বয় স্থির লিভিংরুমের দিকে। এতোক্ষণের সম্পূর্ণ ঘটনা শুনেছে, দেখেছে। প্রতিটি কথা যেন অকস্মাৎ বজ্রের ন্যায় মনে হয়েছে। কিছু তিক্ত সত্য,ধোঁয়াশাময় উত্তর মন এবং মস্তিষ্ক জটিল করে তুলছে। সারহান অরিত্রিকাকে ভালোবাসে এবং অরিত্রিকাকে সারহানকে ভালোবাসে কী তিক্ত সত্যি! আর বিয়ে.. ভাবতে পারে না মাথা কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে। সে নিঃশব্দে এলোমেলো ভঙ্গিমায় এগিয়ে যায় লিভিং রুমের দিকে। সামনে দৃষ্টি স্থির করে না। সারহান এবং অরিত্রিকারকে একসাথে দেখতে পারবে না সে। ভালোবাসার মানুষকে অন্য কারো সঙ্গে সহ্য হয় না।
ইসমা বেগম ছেলেকে আসতে দেখে দৌড়ে এসে ছেলের হাত ধরলেন। হাউমাউ করে কেঁদে বলেন;
“ বাপ তুই এসেছিস? কোথায় ছিলি রাতে? ”
ইরফান অনুভূতি শূন্য। নিষ্প্রান চাহনিতে তাকায় মায়ের মুখের দিকে। অপলক চেয়ে রয় কিছুক্ষণ। বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠে মন। এক ঝটকায় হাত ছাড়িয়ে নেয়। উদভ্রান্তের ন্যায় চিল্লিয়ে বলে;
“তোমরা আমায় গুটি হিসেবে ব্যবহার করেছো? কেন আমাদের বিয়ে ঠিক করেছিলে?কেন আমায় প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলে অরিত্রিকা আমার হবে? তেমন কিছু হয়নি। তুমি আমার ভালো চাওনি মা.. তুমি ভালো চাওনি। আমি শেষ হয়ে গেছি। আমার সাজানো গুছানো স্বপ্নগুলো ভেঙে গেছে নিমেষে। অরিত্রিকাকে ভালোবেসেছি কিন্তু নিজের করে না পাওয়ার আশঙ্কায় ডুবে ম*রছি। আমি কি তাকে পাবো… আমার সাথে কেনো এমন হলো?”
প্রণয়ের সন্ধিক্ষণে সিজন ২ পর্ব ৪৮
ইরফানের চক্ষুদ্বয় রক্তা’ভ বর্ণ ধারণ করে। রাগ,ক্ষোভ, কষ্ট মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। সেসব সহ্য করার ক্ষমতাটুকু হারিয়েছে। অসহনীয় বক্ষ যন্ত্রণায় চোখ হতে এক ফোঁটা নোনাজল গড়িয়ে পরে। অতি কষ্টে ছেলেদের কাঁদতে নেই—কথাটি মনে পড়ে। সে বিষন্ন মনে হাসে। বিমর্ষ, ভগ্নচিত্ত হৃদয়, অশান্ত এবং এক বিক্ষ*ত সত্তা নিয়ে রুমের দিকে পা বাড়ায়। সকলে হতবাক হয়ে সেই দৃশ্য দেখে। কথার পরিপ্রেক্ষিতে কথা বলে শান্তনা দেওয়ার ভাষা নেই। অরিত্রিকা আদুরে বিড়াল ছানার ন্যায় মিশে যায় শ্যামমানবের বক্ষে। দুহাতে শক্ত করে আঁকড়ে ধরে শার্ট যেন কেউ তাকে সারহান ভাইয়ের থেকে আলাদা না করতে পারে। সারহান দীর্ঘ শ্বাস ফেলে তাকায় অরিত্রিকা ফর্সা ধবধবে শঙ্কিত মুখপানে।