প্রণয়ের সন্ধিক্ষণে সিজন ২ পর্ব ৫১
আদ্রিতা নিশি
দিনের শেষ আলো ধীরে ধীরে নিভে আসছে পশ্চিম অম্বরের কোণে। সূর্য ক্লান্ত কোনো পথিকের মতো রক্তিম আভা মেখে ঢলে পড়ছে দিগন্তের কিনারায়। চারদিকে যেন এক আশ্চর্য নীরবতা নেমে এসেছে। পাখিরা শেষবারের মতো ডেকে জানিয়ে দিচ্ছে নিজেদের নীড়ে ফেরার কথা।গোধূলির কোমল আলোয় চারদিক স্নান করে উঠল নরম সোনালি ও বেগুনি রঙের মিশেলে তৈরি মায়াময় আবরণে ঢেকে গেছে গাছপালা, শহর এবং প্রকৃতি। পদ্মা নদীতে পড়ছে টুকরো টুকরো আলো-ছায়ার খেলা। দূরে কোনো বংশী বাজনার ক্ষীণ ধ্বনি যেন হারিয়ে যেতে যেতে আবার ফিরে আসছে হালকা বাতাসে ভেসে।
“ ভাই! নয়ন তালুদারের ছেলে-পুলেদের দেখতে যাওয়া কি ঠিক হচ্ছে? মানে আপনি তো কয়েকটাকে মে*রে আধম*রা বানিয়েছেন। এখন যদি ফুলের বুকে নিয়ে দেখতে যান তাহলে পরিস্থিতি অন্যরকম হতে পারে। যদি হাম*লা করে?”
ইনানের কন্ঠস্বর অশান্ত। ভীতিগ্রস্ত ভঙ্গিমার আভাস। দু হাতে আগলে রেখেছে লাল টকটকে গোলাপের বুকে। সারহান ইনানের কথা শুনে থেমে যায়। ঘাড় বাঁকিয়ে সরাসরি দৃষ্টি ফেলে ইনানের দিকে। দৃষ্টি তীক্ষ্ণ এবং প্রখর। মুখাবয়ব অতিশয় গম্ভীর হলেও মুখ মাস্ক দ্বারা আবৃত থাকায় বোঝা দায়! উদ্ভট কথার পরিপ্রেক্ষিতে ভ্রুযুগল গুটিয়ে ভরাট কন্ঠে বলল ;
“ তুমি ভয় পাচ্ছো ইনান? ”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
ইনান আশেপাশে তাকায়। তারা এখন রাজশাহী মেডিকেলে অবস্থান করছে। আশেপাশে রোগী, নার্স এবং ডাক্তারদের আনাগোনা। হসপিটালের পরিবেশ নোংরা। কেমন যেন অস্বস্তিকর পরিবেশ। পরিষ্কার পরিচ্ছন্নের বালাইটুকু নেই। তার মুখেও মাস্ক। তবুও তীব্র উটকো দুর্গন্ধ নাকে প্রবেশ করছে। তাদের সাথে আরো দুজন দেহরক্ষী রয়েছে।তবুও নয়ন তালুকদারের মতো টাকলা ব্যাটাকে ভয় পাচ্ছে। কিন্তু প্রকাশ করা যাবে না। সে দৃষ্টি ফিরিয়ে সারহানের দিকে তাকায়। আমতা আমতা করে বলে ;
“ নাহ ভাই। ”
“ তাহলে দাঁড়িয়ে না থেকে চলো। ”
সারহান দৃঢ় কন্ঠে বলে ওয়ার্ডের দিকে হাটতে লাগল। ইনান কিছু না বলে পিছু পিছু ছুটলো। দেহরক্ষীরা এমপির নির্দেশনা মোতাবেক পিছুপিছু এগিয়ে গেল। রাজশাহী মেডিকেলের দশ নাম্বার ওয়ার্ডের আশেপাশে থমথমে এবং নিস্তব্ধতা বিরাজ করছে। ওয়ার্ডের এদিক ওদিক মানুষজনের আনাগোনা নেই বললেই চলে। ওয়ার্ডের ভেতরে বারোটা বেডে শুয়ে থাকা বারোজন ছেলে আহত অবস্থায় শুয়ে আছে। তাদের চেহারায় ফুটে উঠেছে যন্ত্রণা এবং ব্য*থার বিভৎস দৃশ্য। সবার শরীরজুড়ে গভীর আ*ঘাতের চিহ্ন। হাতে-পায়ে গভীর কালসিটে দাগ, ক্ষ*তের চিহ্ন স্পষ্ট। কারো হাতে গভীর ক্ষ*ত, কারো পায়ে ব্যান্ডেজে মোড়ানো অংশ থেকে লালচে র*ক্ত বেরিয়ে আসছে। চারপাশে ভেসে বেড়াচ্ছে ওষুধ আর র*ক্তের মিশ্র গন্ধ। ফিনাইলের তীব্র গন্ধে গা গুলিয়ে আসার জোগাড়। ব্য*থিত শরীর নিয়ে শুয়ে থাকলেও তাদের শরীর প্রতিনিয়ত কাঁপছে যেন প্রতিটি শ্বাসে মৃ*ত্যু আরও কাছে টেনে নিচ্ছে।মাঝে মাঝে তাদের গলা দিয়ে বেরিয়ে আসা মৃদু চিৎকার ও আর্তনাদ চারপাশের নীরবতাকে ভেঙে দিয়ে আতঙ্ক ছড়িয়ে দিচ্ছে। নার্স আর কর্মীর দেখা নেই ভেতরে। ওয়ার্ডের এক কোণে চেয়ারে বসে আছে নয়ন তালুকদার। মুখ ভার করে পান চিবাচ্ছেন। পাশে বসে আছে ইলহাম এবং কয়েকজন দলীয় সহযোগী।
দশ নম্বর ওয়ার্ডের দরজা ঠেলে প্রবেশ করল সারহান। পিছু পিছু ফুলের বুকে হাতে প্রবেশ করল ইনান। আচমকা কারো পায়ের পদধ্বনিততে নয়ন তালুকদার সহ উপস্থিত সকলের মনোযোগ বিঘ্নিত হলো। বিরক্তির সহিত দৃষ্টি স্থির করে দরজার দিকে। অনাকাঙ্ক্ষিত ব্যক্তিকে দেখে হচকচিয়ে উঠে দাঁড়াল তারা। সারহান বাঁকা হাসল। ওয়ার্ডের প্রতিটি বেডে পড়ল তার তীক্ষ্ণ এবং প্রখর চোখের সেই শীতল দৃষ্টি। পরখ করল পুরো স্থান। ওষ্ঠকোণে বাঁকা হাসি বজায় রেখে অপ্রতিরোধ্য ভঙ্গিতে এগিয়ে যায় সামনের দিকে।পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা ইনানও ছুটে যায়। তাদের সঙ্গে থাকা দুই দেহরক্ষী দরজার সামনে অবস্থান করে এবং নিঃশব্দে চারপাশে নজর বুলাতে থাকে।
সারহান শাণিত পায়ে এগিয়ে গেল নয়ন তালুকদারের সামনে। সম্মুখে দাঁড়িয়ে ভ্রুযুগল কুঁচকে তাকালো নয়ন তালুকদারের দিকে। স্বাস্থ্যবান গোলগাল চেহারা ,মেদওয়ালা, মাথায় গুটিকয়েক চুলের আস্তরণ, উচ্চতা পাঁচ ফুটের আশেপাশে, শরীরের গড়ন পাকাপোক্ত। বয়সে পঞ্চাশ পেরিয়েছে আগেই।
“ আমার ছেলেপুলেদের মে*রে দেখতে এসেছো সারহান? কতো সৌভাগ্য আমার। ”
নয়ন তালুকদার বিদ্রুপাত্মক হেসে বলে উঠলেন। ইলহাম রাগান্বিত ভঙ্গিমায় দাঁড়িয়ে আছে। অগ্নিশর্মা চাহনির লেলিহানে যেন ভস্ম করে দিবে। সারহানের চোয়াল শক্ত হয়ে আসে। কাঠিন্যতা এঁটে শক্ত কন্ঠে জবাব দেয় ;
“ আপনার ছেলেদের কয়টার হাত পা অকেজো হয়েছে — সেটা দেখতে এসেছি। ”
নয়ন তালুকদার হিসহিসিয়ে তেড়ে এলেন ;
“ এমপি হয়ে দাপট বেড়েছে তোমার? জনগনের উপকার না করে মে*রে আধম*রা করছো? ”
সারহান ভ্রুযুগল গুটিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে চাপা স্বরে বলল ;
“ আপনার ছেলেপুলে মানুষ হলে উপকার করতাম। কিন্তু ওরা মানুষ নয়। আমার ভাষ্যমতে, ওরা আপনার পালিত কুকুর। যারা মনিবের অপকর্মে জড়িত থাকে। ”
“ কি বললে ওরা কুকুর?”
“ কুকুর নয় পালিত কুকুর বলেছি আর আপনি ওদের মনিব।”
“বুঝে শুনে কথা বলো সারহান! ”
“ আপনার ছেলেরা আমাদের ছেলেদের ওপর হা*মলা কেন করল? নিশ্চয়ই আপনি অর্ডার দিয়েছিলেন? কুকুরদের মনিব বলে কথা — এর থেকে বেশী কি বা আশা করা যায়!”
ব্যঙ্গাত্নক ভারিক্কি কন্ঠে বলল সারহান। নয়ন তালুকদার রেগে গেলেন। গর্জে উঠে বললেন ;
তোমাকে কেন কৈফিয়ত দেবো আমি? এমপি হয়েছো তাই সম্মান দিচ্ছি নয়তো দেখিয়ে দিতাম আমি কি জিনিস। ”
সারহান ফিচেল হাসে ;
“ আপনি কে এটা আমাকে দেখিয়ে লাভ নেই। আপনি বরং জেলে গিয়ে নিজের আসল রুপ পুলিশদের দেখিয়ে দিবেন তাহলে ওদের আর লাঠির প্রয়োগ করতে হবে না। ”
“ এসব কি বলছো তুমি?”
“এমপি সারহান ইদায়াত চৌধুরীর দলের কর্মীদের ওপর অতর্কিত হা*মলা চালিয়েছে বিরোধী দলীয় নেতার সাঙ্গপাঙ্গরা। বর্তমানে প্রতিটি নিউজ চ্যানেলের শিরোনাম এটা। আপনিসহ আপনার দলের কয়েকজন নেতা এবং ছেলেপুলেদের নামে থানায় অলরেডি মা*মলা করা হয়েছে। এরেস্ট ওয়ারেন্ট বের হলে আপনাদের গন্তব্য জেল। বয়ঃজ্যোষ্ঠ রাজনৈতিক নেতা হয়ে কাঁচা কাজ করলেন আপনি! ”
“ আমাকে পুলিশের ভয় দেখাচ্ছো? ওই দুইটাকার পুলিশকে টাকা দিয়ে কিনে নিতে পারি আমি।”
“ কিনে দেখান নয়ন তালুকদার সাহেব। আমরাও দেখি আপনার কালো টাকার ক্ষমতা। ”
সারহান দৃঢ়,শক্ত কন্ঠে বলল। নয়ন তালুকদার ভড়কে গেলেন। পাশে দাঁড়ানো বিরোধী পক্ষের সহযোগীরা এমপির ঠান্ডা গলার হুমকিতে ভয় পেয়ে যায়। পরিবেশ উত্তপ্ত দেখে ওয়ার্ড থেকে নিরবে সটকে পড়ার পায়তারা করে। কিন্তু দেহরক্ষীরা দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকায় সাহস করে না বাহিরে যাওয়ার। ইলহাম তপ্ত শ্বাস ফেলল। এগিয়ে আসল সারহানের দিকে। স্বাভাবিক ভাবে বলল ;
“ তোর দলের ছেলেরা আগে হা*মলা করেছিল সারহান। ”
সারহানের কপালের মধ্যাংশে কয়েকটা ভাজ পড়ল। রুদ্ধ স্বরে বলল ;
“ কারা কাদের হাম*লা করেছিল সেসব তোকে না ভাবলেও চলবে। ”
“ আমার বাবাকে মিথ্যা অপবাদ দিচ্ছিস আর আমি চুপ থাকব?”
“ তোর জন্য এমুহূর্তে চুপ থাকা শ্রেয় ইলহাম। আমাদের কথোপকথনের মধ্যে কথা বলিস না। ”
সারহান স্বভাবসিদ্ধ রুক্ষতা নিয়ে বলল। সে হাত বাড়িয়ে ইলহামের প্রশস্ত কাঁধ চাপড়ে দিল। অতঃপর খানিকটা ঝুকে চাপা স্বরে বলল ;
“ তোর বাবা একজন খু*নী ইলহাম। হি ইজ অ্যা ক্রি*মিনাল। তোর বোনকে খু*ন করেছে।”
ইলহাম চকিত নয়নে তাকাল। বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে খানিকটা পিছিয়ে গেল। উচ্চস্বরে বলে উঠল ;
“ তুই মি*থ্যা বলছিস! আমার বাবা কাউকে খু*ন করতে পারে না। ”
“ সত্যিটা জেনেও অন্ধের মতো বিশ্বাস করা মুর্খতার পরিচয়। ”
“ তাজকে কেউ খু*ন করেনি সারহান। আমার বোন আত্নহ*ত্যা করেছিল। ”
সারহান অদ্ভুত হেসে বলল ;
“ তোর থেকে আমি তাজিয়াকে ভালো করে চিনতাম। মেয়েটা আত্মহ*ত্যা করার মতো মেয়ে ছিল না। ”
ইলহামের চক্ষুদ্বয় অস্বাভাবিক লাল হয়ে গেল। চিৎকার করে বলল ;
“ তুই আমাকে বোকা বানাচ্ছিস সারহান। তোর কথা বিশ্বাস করব না আমি। ”
“ বিশ্বাস করা না করা তোর ব্যাপার। ”
নয়ন তালুকদার হাস ফাঁস করে উঠল। আচানক ঘামতে শুরু করল। কপাল বেয়ে গড়িয়ে পড়তে লাগল ঘর্ম বিন্দুগুলো। অতিরিত চিন্তায় প্রেশার বেড়ে গেল। তিনি ধপ করে বসে পড়লেন চেয়ারে। সারহান দৃশ্যটা ঈগল চোখে দেখে। প্রতিটা আচরণ সুক্ষ্ম দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করে। ইনানের হাত থেকে ফুলের বুকেটা নিয়ে নয়ন তালুকদারের কোলের ওপরে রাখে। অতঃপর দম্ভক ভঙ্গিমায় বলল ;
“ অতীত এবং বর্তমানের লুকোচুরি খেলায় আপনি ধরা পড়ে গেছেন নয়ন তালুকদার। কথায় আছে, পাপ বাপকে ছাড়ে না। ঠিক আপনারও সেসময় ঘনিয়ে আসছে। শুধু প্রহর গুনতে থাকুন নিজের ধ্বংসের। ”
নয়ন তালুকদার স্তম্ভিত হয়ে তাকিয়ে রইল শুধু। সারহান পুরো ওয়ার্ডে চোখ বুলিয়ে আধম*রা ছেলেপুলেদের দেখে নিল। দৃষ্টি ফিরিয়ে ইলহামের দিকে নিবদ্ধ করল। ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন হলো। ক্রুর হেসে বলল ;
“ রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলের সামনে র*ক্তের সম্পর্ক ফিকে হয়ে যায়। তেমনি তাজের ক্ষেত্রে হয়েছে। শত্রু হয়েও খু*নী কে তা বলে দিলাম। অন্তত কৃতজ্ঞতা জানাতে পারতিস! ”
ইলহামের চোখের কোণায় অশ্রু জমা হয়। বক্ষস্থল বিষিয়ে ওঠে। মস্তিকে করাঘাত করে সারহানের বলা কথাগুলো। সত্যি কি তার বোনকে খু*ন করা হয়েছে? তার বাবা কি কাজটা করেছে? সবকিছু তালগোল পাকিয়ে আসে। সারহান একমুহুর্ত দাঁড়ায় না ওয়ার্ড থেকে বেড়িয়ে যাওয়ার জন্য পা বাড়ায়। দরজার কাছে যেতেই দেখা হয় নিশাদ এবং মিহির সাথে। তৎক্ষনাৎ দাঁড়িয়ে যায় সে। নিশাদ এবং মিহিও হচকচিয়ে দাঁড়িয়ে যায়। দীর্ঘ তিনবছর পর দেখা!সময়টা অনেক দীর্ঘ। সময় পাল্টেছে, মানুষ বদলেছে। শুধু মনে রয়ে গেছে পুরনো স্মৃতি। সারহান সাইড হয়ে বেড়িয়ে যায়। পিছু পিছু ইনান এবং দেহরক্ষীরা প্রস্থান করে।
মিহি ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে রয় সারহানের চলে যাওয়ার দিকে। আচমকা প্রফুল্লচিত্তে ডেকে ওঠে ;
“ এই যে ইয়াং এমপি সাহেব! আপনাকে আমার খুব ভালোলাগে। একটা সেলফি তুলবো দাঁড়ান। ”
কথাটা বলে দৌড়ে বাহিরে যাবে এমন সময় নিশাদ মিহির হাত ধরে ফেলল। ধমকে বলল ;
“ হসপিটালে এসে কিসের সেলফি। চুপচাপ চলো ভেতরে। ”
“ আমার ক্রাশ এমপি সাহেব…”
“ চুপ করবে তুমি নাকি থাপ্পড় দিয়ে গাল লাল করে দেবো। ”
মিহির মুখ গোমড়া হয়ে গেল। নিশাদ বেজায় বিরক্ত হয়ে মিহিকে টেনে ভেতরে নিয়ে আসল।
লিভিং রুমে বসে আছে তিশা এবং রাহা। কিছুক্ষণ আগে বান্ধবীর জরুরী তলবে ছুটে এসেছে। হঠাৎ কেন জরুরী হাক ডাক সেসব কিছু সম্পর্কে অবগত করেনি অরিত্রিকা। প্রায় বিশ মিনিট ধরে বসে আছে দুজনে। তিশা সোফায় আরাম করে বসে ফোন টিপতে ব্যস্ত। রাহার ইচ্ছে করছে না বসে থাকতে। উড়নচণ্ডী বান্ধবীটা তাদের বসিয়ে কোথায় চলে গেল? এখনো আসছে না কেন? ভাবতে ভাবতে সে মহা বিরক্ত হয়ে উঠে দাঁড়াল সোফা থেকে। আশেপাশে তাকিয়ে পরখ করল। দৃষ্টি আঁটকে গেল সিঁড়ির সামনে। সেথায় লেভি বসে আছে থ’ম মে’রে। রাহা হাসল। চঞ্চল পায়ে এগিয়ে যেতে লাগল লেভিকে কোলে নিতে। কিছু দূর যেতেই তাকে হতাশ করে দিয়ে দৌড়ে পালাল লেভি। রাহার মন ভার হয়ে আসে। সে তপ্ত শ্বাস ফেলে আনমনে গুনগুন করে গান গাইতে গাইতে বাহিরের দিকে হাটা ধরল। বাড়িতে প্রবেশ করার পূর্বে খেয়াল করেছিল ফুলের বাগান। নানান রকমের ফুলে মুগ্ধ হয়েছে সে। সদর দরজা পেরিয়ে আনমনা ভাব নিয়ে এগিয়ে যেতে লাগল বাগানের দিকে।
সন্ধ্যা ছয়টা পেরিয়ে গিয়েছে পাঁচ মিনিটের চুপচাপ পলায়নে। রাতের আবরণ নামছে নিঃশব্দে অথচ আশপাশের সাদাটে আলোর ভেতর রাতের গাঢ়তা যেন বিলীন হয়ে গেছে দিন আর রাতের সীমারেখা কোথায় বোঝার উপায় নেই।রাহার মন তখন হালকা অকারণ আনন্দে ভরপুর। পায়ে পায়ে এগিয়ে যাচ্ছিল বাগানের দিকে। আচমকাই বাতাস কাঁপিয়ে উঠল এক বাইকের গম্ভীর শব্দে। রাহা থমকে দাঁড়ায়। শিউরে ওঠে কৌতূহলের ছায়ায়। ধীরে ধীরে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায় পেছনের পার্কিং প্লেসের দিকে।একজন দাঁড়িয়ে আছে বাইকের পাশে। পরিচিত আলোর ভেতরও তার ছায়ামূর্তি অচেনা ঠেকে যায়। রাহার ভ্রু সঙ্কুচিত হয় অজান্তেই।সাদাত তো এখনো বাড়ির ভেতরেই থাকার কথা, তবে বাইক নিয়ে আসা এই আগন্তুক কে? কে এলো সন্ধ্যার গোধূলিতে এমন নিঃশব্দ পায়ে?
ইরফান বাইকটা পার্কিং প্লেসে রেখে শার্টের হাতা গুটাতে গুটাতে সামনে এগিয়ে আসতে থাকে। সদর দরজার দিকে যাবে এমন সময় পাশেই কিছুটা দূরে হালকা গোলাপী থ্রি পিস পরিহিত মেয়েকে দেখতে পায়। মেয়েটা তার পরিচিত। অরিত্রিকার বান্ধবী। এরাতের বেলা বাড়ির সামনে একা একা ঘুরঘুর করছে কেন? সে বাড়িতে না ঢুকে এগিয়ে যায় রাহার দিকে। দুরত্ব বজায় রেখে দাঁড়িয়ে ভরাট কন্ঠে জিজ্ঞেস করে;
“ তুমি এখানে কী করছো?”
রাহা থমতম খেয়ে যায়। তড়িঘড়ি করে বলে ;
“ ইয়ারফোন ভাইয়া থুক্কু ইরফান ভাইয়া ভালো আছেন?”
ইরফানের মুখাবয়ব গম্ভীর হয়ে যায়। তার সুন্দর নামটার এভাবে হালুয়া বানিয়ে দিলো? গর্দভ মেয়ে একটা। গাম্ভীর্য ভাব নিয়ে বলল ;
“ ভালো আছি। তুমি এখানে কী করছো?”
রাহা হাঁপ ছেড়ে বাঁচল। হাসার ভাণ করে বলল ;
“ বাগানে যাচ্ছিলাম।”
“ রাতে কেউ বাগানে যায়? ভেতরে যাও। ”
“ টুপ করে যাব টুপ করে চলে আসব। আপনি এখানে দাঁড়িয়ে পাহারা দিন যেন ভুত প্রেতাত্মা আমার ঘাড়ে চাপতে না পারে। ”
রাহা কথাটুকু শেষ করে দৌড়ে চলে গেল বাগানের দিকে। ইরফান হতভম্ব হয়ে যায় মেয়েটার আচরণে। ছোট্ট পুঁচকে এক মেয়ে তাকে পাহারা দেওয়ার জন্য বলছে? কতো বড় সাহস মেয়েটার ভেবে অবাক হয়ে গেল। সে চমকিত নয়নে তাকিয়ে রইল বাগানের দিকে। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে এগিয়ে গেল বাগানের দিকে। বাগানের সামনে দাড়িয়ে গমগমে কন্ঠে বলে ;
“ বাগানের ভেতরে বিষাক্ত পোকামাকড় আছে গর্দভ মেয়ে! দ্রুত বেড়িয়ে এসো। ”
রাহা চমকে তাকাল। তড়িঘড়ি করে বাগান থেকে বেড়িয়ে এসে ইরফানের সামনে দাঁড়াল। পরক্ষণে মনে পড়ে গেল মানুষটা তাকে গর্দভ বলেছে। মুহুর্তে ভাবভঙ্গি পরিবর্তন হলো৷ কোমড়ে দু’হাত গুঁজে কটমট করে তাকিয়ে তেজি কন্ঠে বলল;
“ আপনি আমাকে গর্দভ বললেন?”
“ তোমার নাম মনে নেই আমার তাই গর্দভ বলে ফেলেছি। উমম তোমার নামটা কি যেন? ”
“ আমার নাম আপনার মাথা এবং মুন্ডু। এত্তো সুন্দর নাম আমার অথচ আমায় গর্দভ বলে ডেকেছেন? বলে রাখলাম আপনার প্রেম হবে না কোনোদিন। ”
“ অভিশাপ দিচ্ছো? ”
“ হ্যা। ”
“ শকুনের দোয়ায় কখনো গরু ম’রে না।”
ইরফান বিরক্তি প্রকাশ করে বলল। রাহা মুখ বাঁকিয়ে বলল ;
“ গরু ম*রবে। অপেক্ষা করুন। ”
ইরফান ধমকে বলল ;
“ এই মেয়ে তুমি এতো বাচাল কেন? ”
“ কী বললেন আমি বাচাল? ”
“ এখানে দাঁড়িয়ে একা একা বকবক করো। আমি গেলাম। ”
ইরফান তিরিক্ষি মেজাজে বাক্যটুকু ব্যয় করে পা বাড়াল বাড়ির দিকে। রাহা চোখ মুখ কুঁচকে সেথায় দাঁড়িয়ে রইল। বাগানের ভেতর থেকে অদ্ভুত আওয়াজ ভেসে আসতেই তার কান খাড়া হয়ে গেল। খানিকটা ভয় পেল। বাগানে কী সাপ আছে নাকি? যদি হঠাৎ এসে কামড়ে দেয়! সে দাঁড়াল না ভয়ার্ত ভঙ্গিতে দৌড়ে ভেতরে চলে গেল।
অরিত্রিকা লিভিং রুমে এসে খেয়াল করল তিশা একা বসে আছে। রাহা কোথাও নেই। সে এগিয়ে আসল তিশার দিকে। জিজ্ঞেস করল ;
“ তিশা! রাহা কোথায়? ”
তিশা ফোন থেকে দৃষ্টি সরিয়ে বলল ;
“ বাহিরে গেছে। ”
“ একা একা বাহিরে কি করছে? ”
“ জানিনা তুই ডেকে নিয়ে আয়। ”
“ আচ্ছা। ”
অরিত্রিকা বাহিরে যাবে এমন সময় সদর দরজা দিয়ে দৌড়ে প্রবেশ করল রাহা। এসে ঠাস করে বসে পড়ল সোফায়। হাঁপাতে হাঁপাতে বলল ;
“ তোদের বাগানে সাপ পালন করিস নাকি অরিত্রি? ”
তিশা কিছু পড়ার শব্দে হচকচিয়ে গেল। দ্রুত ঘাড় বাঁকিয়ে পাশে তাকাল। দেখল ভেটকি মাছের মতো পড়ে আছে রাহা। অরিত্রিকা চমকে গেল। তড়িঘড়ি করে জিজ্ঞেস করল ;
“ এসব কী বলছিস! বাগানে সাপ কোথা থেকে আসবে?”
রাহা একটু শান্ত হলো যেন। স্বাভাবিকভাবে বসল সোফায়। চোখ মুখ কুঁচকে রাগান্বিত কন্ঠে বলল ;
“ তোর ওই ভাইটা খারাপ কেন? জানিস, একটু আগে আমায় ধমক দিয়েছে। ”
অরিত্রিকা বুঝতে পারল না কার কথা বলছে। সারহান ভাই তো বাড়িতে নেই। সাদাত নিজের রুমে আছে। তাহলে কার কথা বলছে রাহা? কৌতুহল বশত জিজ্ঞেস করল ;
“ কার কথা বলছিস তুই? ”
রাহা মুখ গোমড়া করে বলল ;
“ ইয়ারফোন ভাইয়ের কথা বলেছি। ব্যাটা বজ্জাত একটা। ”
“ ইরফান ভাই? ”
“ হ্যা। ”
“ আমার ভাইকে তুমি বজ্জাত বলেছো রাহা? ”
আচানক ইশরার কন্ঠ কর্ণকুহরে প্রবেশ করতেই রাহা হচকচিয়ে যায়। হতচকিত দৃষ্টিতে তাকায় সামনে। ইশরাকে ভ্রু উঁচিয়ে তার দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে শুকনো ঢোক গিলে। হাসার ভাণ করে আমতা আমতা করে বলে ;
“ তুমি ভুল শুনেছো। আমি আসলে ইয়ারফোন থুক্কু ইরফান ভাইয়ার নামে প্রশংসা করছিলাম। তোমার ভাই অনেক ভালো। কাউকে ধমক দেয় না। একদম শান্ত শিষ্ট লেজ বিশিষ্ট। মন চায় গাল দুটো কুচুপু করে দিতে। ”
“ তাই নাকি মিস রাহা! ”
প্রণয়ের সন্ধিক্ষণে সিজন ২ পর্ব ৫০
গুরুগম্ভীর পুরুষালী কন্ঠস্বর প্রবেশ করতেই ভড়কে যায় রাহা। দৃষ্টি ঘুরিয়ে সামনে তাকাতেই দেখতে পায় ইরফান চোয়াল শক্ত করে দাঁড়িয়ে আছে। সে ভয়ে সিঁটিয়ে যায়। অরিত্রিকার হাত আঁকড়ে বলে ;
“ আমায় বাঁচা বনু ইয়ারফোন ভাইয়ার থেকে।”