হ্যালো 2441139 পর্ব ২০

হ্যালো 2441139 পর্ব ২০
রাজিয়া রহমান

পারভীন পুকুর ঘাটে বসে পায়ে আলতা দিচ্ছে।পুকুরের স্বচ্ছ জলে পারভীনের নিজের প্রতিবিম্ব ফুটে উঠলো।জলের দিকে তাকিয়ে পারভীনের দুই চোখ ভিজে উঠে। শাহেদ দেশের বাহিরে গেছে এই ১২ বছর। ১ যুগ হয়ে গেলো এখনো স্বামীকে কাছে পাচ্ছে না। শাহেদের কি একটু মনে হচ্ছে না স্ত্রীর কথা? একটা জীবনে কি শুধু ধৈর্য ধরেই কাটিয়ে দিতে হবে? বিয়ের ১৮ দিন পর শাহেদ সেই যে গেলো, আর এলো না এখন পর্যন্ত। এরমধ্যে শাহেদকে কাছে পেয়েছে ১ সপ্তাহ। বাকি দিনগুলোতে শাহেদের সময় কেটেছে জুয়ার আসরে।
পারভীন সেসব ভাবতে ভাবতে কেঁদে উঠে। বুকের ভেতর পাহাড় সমান যন্ত্রণা তার।অথচ মেনে নেওয়া ছাড়া উপায় নেই।

সাদেকের মনটা আজকে কেমন অবাধ্য হয়ে উঠেছে। বারবার ইচ্ছে করছে পারভীনকে দেখতে।
নিজের মনের এই নির্লজ্জ ইচ্ছে দেখে সাদেক নিজেই অপ্রস্তুত হয়।ভাগ্যিস মনের ভেতর কি হচ্ছে কেউ দেখতে পায় না। নয়তো দেখতো সাদেরকের মনের ভেতর কেমন তোলপাড় হচ্ছে!
অনেক ক্ষণ ধরে মনের সাথে যুদ্ধ করে ও সাদেক জিততে পারে নি। শেষ পর্যন্ত পুকুর ঘাটের দিকের জানালার পর্দা ফাঁক করে তাকায় সাদেক।
পারভীন কেমন অসহায় ভঙ্গিতে তাকিয়ে আছে পুকুরের দিকে।
সম্পূর্ণ বেখেয়ালি হয়ে বসে আছে পারভীন। কি এতো ভাবছে!
এতো কষ্ট কিসের ওর!
এদিক ওদিক তাকিয়ে কাদের এলো পুকুর ঘাটে। পারভীনের পায়ের দিকে লোভাতুর দৃষ্টিতে তাকিয়ে এগিয়ে গেলো পারভীনের দিকে।
একটা মানুষ এতো বেশি সুন্দর হয় কিভাবে?
যেনো মোমের পুতুল।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

পারভীন অন্যমনস্ক হয়ে বসে ভাবছে নিজের জীবনের প্রাপ্তি, অপ্রাপ্তি নিয়ে।
কাদের গিয়ে পারভীনের কোমরে হাত দিয়ে বললো, “কি ব্যাপার ভাবী,কি ভাবেন?”
অতর্কিত স্পর্শে পারভীন চমকে উঠে ছিটকে উঠে দাঁড়ায়। কাদেরের থেকে দূরে গিয়ে বললো, “কি করছেন আপনি?টাচ করে কথা বলছেন কেনো?”
কাদের গলা নিচু করে বললো, “একটা ফুলগাছ দিন দিন শুকাইয়া যাইতেছে,আমার তো দায়িত্ব তার গোড়ায় জল ঢালা।”
পারভীন তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো, “মালিহা পাইছেন আমারে?যেভাবে মাঝরাতে মালিহার ঘরে ঢুকে যান,ভাবছেন তেমন সব?সবাইরে এক পাল্লায় মাপতে যাবেন না।জেনে ও সব চুপ করে আছি,নিজেরা পাপ করতেছেন নিজেরা হিসাব দিবেন।আমার সাথে বেচাল করতে আসবেন তো পুরো গ্রাম জানবে আপনাদের কুকীর্তি। ”
কাদেরের চোয়াল শক্ত হলো।এ তাহলে সব বুঝে গেছে। কাদের এদিক ওদিক তাকায়। সন্ধ্যা হয়ে আসছে।কাদের বেপরোয়া হয়ে উঠে। এ যখন সব জানেই,তাহলে আর ভালো মানুষের মুখোশটা কষ্ট করে পরে থাকার কোনো দরকার নেই এর সামনে।

এক হাত দিয়ে পারভীনের কোমরে শক্ত করে খামচি দিয়ে ধরে আরেক হাতে পারভীনের মুখ চাপা দিয়ে কাদের বললো, “সব যখন জাইনাই গেছেন তাইলে আর লুকাচুরি কিসের?সবাইরে জানানোর ভয় দেখান আমারে?কি জানাইবেন সবাইরে?আমি আপনারে…..”
কাদেরের লোলুপ স্পর্শে পারভীনের পেটের নাড়িভুড়ি উল্টে এলো। কাদের কথা শেষ করতে পারে না তার আগেই শুনতে পেলো ঘরের দরজা খোলার শব্দ হচ্ছে। বাড়ির মাস্টার সাদেক আলী মালিহাকে ডাকতে ডাকতে এদিকে আসছে সম্ভবত।
লাফিয়ে সিড়ি বেয়ে কাদের উঠে যায়।
পারভীন বিধ্বস্ত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। একটু আগে যা হলো তা কখনো পারভীনের কল্পনাতেও ছিলো না। সাদেক স্যার যদি মালিহাকে না ডাকতে বের হতো তাহলে আজ পারভীনের কি যে হতো!
সাদেক এদিক ওদিক তাকিয়ে মালিহাকে ডেকে ঘরে চলে গেলো।
নিজের রুমে ঢুকে সাদেকের ভীষণ রাগ হতে লাগলো। কাদেরকে খু ন করে ফেলতে ইচ্ছে করছে তার।
সে কিছুই করতে পারলো না এরকম একটা ঘটনা ঘটতে দেখে ও!
সাদেকের মনটা বলছিল, ‘এটা ঠিক হচ্ছে না,কিছু করা উচিত। ‘
কিন্তু তবুও সে পারে নি। কেমন একটা অদ্ভুত অসহায়ত্ব অনুভব হচ্ছিলো সাদেকের।কারণ তার কাছে কোনো প্রমাণ নেই।

গ্রামের মানুষজন যে তিল কে তাল করে ফেলতে পারে সাদেক জানে।সে হয়তো পারভীনকে বাঁচাতে যেতো,কাদের হয়তো রটিয়ে দিতো সে আর পারভীনকে নিয়ে কোনো কুৎসা।
সাদেক কিছু করলেই পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারতো।
কাদের চলে গেল, কিন্তু সাদেকের মাথার ভেতর তখনো ঝড় চলছে। বারবার নিজের বিবেক তাকে বলছে সে কিছু করতে পারলে হয়তো মানুষটার কষ্টটা একটু কমাতে পারতো। কিন্তু কিছুই করে নি তখন!
সাদেকের এখন মনে হচ্ছে, শুধু ওর সঙ্গেই না, নিজের সঙ্গেও অন্যায় করেছে। এই অপরাধবোধ বোধহয় তাকে ছাড়বে না।
পারভীন চুপচাপ ঘরে চলে এলো।ঘরে এসে শাহেদকে ইমুতে কল দিলো।
একবার, দুই বার,তিনবার।

রিং হচ্ছে কিন্তু কল রিসিভ হচ্ছে না। পারভীনের বুক ফেটে কান্না আসছে।এতো অসহায় কেনো সে!
প্রতি নিয়ত ভেতর থেকে ভেঙে যাচ্ছে পারভীন।এখানে কোন আজাব সহ্য করছে সে তা শুধু তার অন্তর্যামী জানেন।একজন স্বামী শুধু একজন মানুষ -ই নন,বরং একজন রক্ষা কবচ।পারভীনের যন্ত্রণা আরো দ্বিগুণ হয়ে যায় শাহেদের সাথে যোগাযোগ করতে না পেরে।
শাহেদ শেষ কথা বলেছে আরো দুই সপ্তাহ আগে।
কল করা কখনো পারভীনের সাথে দুটো সুখদুঃখের গল্প করা নয়।শাহেদ কল করে পারভীনকে অশ্রাব্য গালাগাল করার জন্য।
পারভীন মনে করে তার জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল ছিলো মাভক্ত,মায়ের একমাত্র ছেলেকে বিয়ে করা।শাহেদের কাছে ধ্রুব সত্য হচ্ছে জমিরন।
সেখানে পারভীন হচ্ছে তাদের বাড়ির বিনা বেতনের কাজের মেয়ে।

পারভীনের কষ্টের কথা বলার কোনো জায়গা নেই।কোনো বোন থাকলে বোনের সাথে বলতো।কিন্তু কোনো বোন নেই তার।মা নিযে তো ভাইদের সংসারে গলগ্রহ হয়ে আছে।পারভীন একটা কথা বলতে গেলেই মা আগেই বলে, সংসার এমনই মা।মেনে নে।তবুও তো দুটো ভাত খেতে পাস।ওখান থেকে বের হয়ে গেলে এই ভাত ও পাইবি না।পেটের আগুনের চাইতে যন্ত্রণার এই দুনিয়ায় কিচ্ছু নাই।মাইনসে কয়,পেটে দিয়ে পিঠে দিলে ও সয়।”
পারভীন কার কাছে বলবে তার যন্ত্রণার কথা?
সবচেয়ে কষ্ট হয়, যখন নিজেকে বোঝাতে থাকে সে যে এটা যতদিন বেঁচে আছে ততদিন সহ্য করতেই হবে। একটা সময় পারভীনের মনে হতে থাকে,তার কষ্ট বা অনুভূতিগুলো আজীবনের জন্য নির্ধারিত হয়ে গেছে।পারভীনের ভেতরে এক ধরনের একাকিত্ব গড়ে ওঠেছে দিন দিন যা বাইরে থেকে কেউ বুঝতে পারে না।
পিয়াসা এসেছে বাহিরে থেকে খেলে।পারভীন অসহায় দৃষ্টিতে মেয়ের দিকে তাকায়।১২ বছর ধরে তো এই যন্ত্রণার আগুনে পুড়ে দগ্ধ হচ্ছে।

পিয়াসা মা’কে বললো ক্ষুধা লেগেছে তার।
পারভীন চোখ মুছে উঠে দাঁড়ায়।
রুমের বাহিরে বের হতেই জমিরনের মুখোমুখি হয়।
পারভীনের চুলের মুঠি ধরে জমিরন বললো, “বুড়ি মা*,কি বলছস তুই আমার মাইয়ার জামাইরে?তোর এতো বড় কলিজা হইছে?তোর সাহস এতো বাড়ছে?”
পারভীন রুমের দরজা বাহির থেকে ছিটকিনি দিয়ে দেয়।পিয়াসা যাতে কখনো এসবের কিছু না বুঝতে পারে।এমনিতেই মেয়ে কষ্টে থাকে কখনোই তার বাবা তার সাথে কথা বলে না বলে। সেখানে মায়ের এসব যন্ত্রণা ছোট মেয়েটাকে আরো যন্ত্রণা দিবে।

জমিরনের হাত থেকে নিজের চুল ছাড়াতে ছাড়াতে পারভীন বললো, “বড় দুলাভাই আমার লগে অসভ্যতা করছে।আমি ওনাকে কোনো অসম্মান করি নি।বরং উনি আমার সাথে খারাপ ব্যবহার করেছেন।”
“কি করছে তোরে?মিথ্যা কথার জায়গা পাস না তুই?তুই কি কইছস?আমার মালিহা আর ওর কাদেরের নামে কি কইবি তুই সবাইরে?কি কইবি?তুই কি মনে করছস তোরে আমি এম্নেই ছাইড়া দিমু?তুই মনে রাখিস তোর হাল কি করি আমি। ”
বাহিরে হুটোপুটি শুনে সাদেক বুঝতে পারলো পারভীনকে ওর শাশুড়ী মারধর করছে সম্ভবত। প্রায়ই এরকম হুটোপুটি শোনা যায়।কিন্তু কখনোই সাদেক সেসবে পাত্তা দেয় নি।সে এখানে মালিহাকে পড়ায় নিজের রুমেই।রুমের বাহিরে এদের যা-ই হোক সেসবে তার ইন্টারফেরের কিছু নেই।
কিন্তু আজকে মনে হচ্ছে বাহিরে বের হওয়া উচিত। কিছু না বললেও সে বের হতে দেখলে জমিরন চাচী নিজের নোংরা রূপ লুকিয়ে ফেলবে।
যা ভেবেছে তাই,দরজার খুট করে শব্দ হতেই জমিরন পারভীনকে ছেড়ে দেয়।পারভীন এলোমেলোভাবে ফ্লোরে বসে আছে।

হ্যালো 2441139 পর্ব ১৯

সেদিকে এক নজর তাকিয়ে সাদেকের ভীষণ মায়া হয়।
আহারে বেচারা!
এতো অসহায় কেনো!
এর তো স্বামীর সংসারে রানী হওয়ার কথা ছিলো অথচ ভাগ্য তাকে রানী করেছে ঠিকই তবে দুঃখীরানী।
সাদেক বের হয়ে বললো, “মালিহা,পড়তে আসো।”
জমিরন বিগলিত হেসে বললো, “স্যার,নাশতায় কি খাইবেন?”
সাদেক বললো, “আমি কিছু খাবো মা চাচী।ক্ষিধে নেই।”
সাদেক ভেতরে চলে যেতেই জমিরন বললো, “একটা কাকপক্ষী কোনো কিছু যদি বুঝতে পারে তাইলে মনে রাখিস,তোর আর পিয়াসার অবস্থা আমি কি করি।”
পারভীন কিছু বলার সাহস পায় না আর।

হ্যালো 2441139 পর্ব ২১