যতনে রাখিলাম যাতনা পর্ব ২৫

যতনে রাখিলাম যাতনা পর্ব ২৫
মম সাহা

রাতটি ঠিক ফুরিয়ে এসেছে ভোর নামের ঘ্রাণে। ছাদের এক কোণাতে ঘাপটি মেরে বসে থাকা কাকপক্ষী ছাড়া এ সময়টায় আর বিচরণ নেই কারো। কাকটিও ঝিমুচ্ছে। আলতো চোখ গুলো খানিকটা সময় পর পর বন্ধ হয়ে আসছে। ছোটো ছোটো হরেক রঙের বাতিগুলো জ্বলছে বিরতিহীন। হালকা আকাশের আলোটির সাথে রঙটা বড়োই সুন্দর পরিবেশ সৃষ্টি করেছে চারপাশে।
শাহাদাৎ তাদের বাড়ির ছাদটাতে দাঁড়িয়ে আছে। চোখ দু’টো লাল হয়ে লোকটির। সারা রাত ঘুমোয়নি এক ফোঁটা। বুকের ভেতর কেমন একটা ছটফট করছে তার। এর আগে কখনো বুকের ভেতরটা এত অশান্ত হয়নি। গত কিছুদিন যাবত হচ্ছে। তাই প্রায়ই, ভোর না হতেই চলে আসে সে ছাদে। যদি এই সকালের শুদ্ধ পবনে একটু বেঁচে থাকার অক্সিজেন জোগাড় করা যায় সেই আশায়।

ছাদে উঠতেই বুকের হাঁসফাঁসটা যেন বাড়ল আরও খানিকটা। চাঁদনীদের বাড়ির দিকে তাকালেই এমনটা হয়। বিশেষ করে ঐ ছাদটা! শূন্য করা সেই ছাদে যেন কত অতীতের গল্প মিশে আছে। ছাত্রজীবনে যখন তাদের সবে সবে প্রেম শুরু হলো… প্রায় বিকেলে ছাদে এসেই তারা দু’জন দু’জনকে চোখের দেখা দেখে নিতো। কত বিকেল গড়াতো, সন্ধ্যা হতো! একটু দেখতে পাওয়ার আশায় কত পাগলামিই না করেছিলো? আজ সেসব ধ্বংসাত্মক অতীত প্রায়। ঘুরে ঘুরে অনুশোচনা জাগায় বুকে। এত বছর যদিও এই অনুশোচনার দেখা মেলেনি। কিন্তু যেদিন থেকে চাঁদনী সকল অভিযোগ করল, জানালো কত কত লুকিয়ে থাকা অভিমানের কথা সেদিন থেকেই বুকটাতে আর শান্তি পায়নি সে। থেকে থেকে বুকের জমিন খুবলে খায় অনুশোচনারা।
শাহাদাৎ পকেট থেকে ফোনটা বের করে। নতুন সিম নিয়েছে সে দিন তিনেক হলো। সিমটি কিনেছিলো চাঁদনীর সাথে যোগাযোগের উদ্দেশ্যেই। কিন্তু যোগাযোগ আর হলো কই?
বেইমানী করা চোখের, বুকের কিংবা শরীরটার কি এমন দুঃসাহস করা সাজে? সাজে না। তাই তো আর কল করা হয়ে উঠে না।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

শাহাদাৎ-এর এই নয়ছয় ভাবনার মাঝেই কারো পায়ের শব্দ শুনতে পেলো। এবং ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে তাকাতেই দেখলো উসকোখুসকো চুল নিয়ে উপস্থিত হলো মৃন্ময়। তার আদরের, একমাত্র ছোটো ভাইটি। মৃন্ময়ের চোখের নিচেও কালির প্রলেপ। যাযাবরের মতন দেখতে লাগছে তাকে। কত কাল যেন নিন্দ্রা যায়নি মৃন্ময়ের চোখজোড়া।
ছাঁদে উঠেই ভাইকে দেখতে পেয়ে মৃন্ময়ের পা থেমে গেলো। কিছুটা অবাক হলো। বলল,
“এখানে তুই, ভাইয়া? কোনো সমস্যা?”
শাহাদাৎ এগিয়ে গেলো মৃন্ময়ের দিকে। খানিক আমতা-আমতা করে বলল, “ঘুম ভেঙে গেলো তাই এলাম। তোরও কি তাই?”

মৃন্ময় চারপাশে চোখ ঘোরাতে থাকে। চারপাশের শুদ্ধ বাতাসটা টেনে নিতে থাকে বুকে। তারও দেশে আসার পর আর ভালো ঘুম হয়নি। কেবল থেকে-থেকে একটি মেয়ের মুখই বুকের জমিনে ভেসে উঠে। ভাইকে কি আর এমন কথা বলা যায়? ভাই বুঝবে বুকের ভেতর কেমন হচ্ছে ভাঙচুর?
“বললি না তো, ঘুম ভেঙে গেলো নাকি ঘুমোসইনি?”
মৃন্ময় বুক ভরা শ্বাস নিয়ে সত্যি কথাটিই বলল, “ঘুমোয়নি।”
শাহাদাৎ ছোটো ভাইয়ের অকপটে বলা এই সত্যি কথায় হাসল। ভাইয়ের বাঁ বাহুতে ছোটো চড় দিয়ে প্রশ্ন ছুঁড়ল,
“কোনো সমস্যা?”
বড়ো ভাইয়ের জানতে চাওয়ার আগ্রহী চোখ দু’টো ঘুরে বেড়াল মৃন্ময়ের মুখ জুড়ে। মৃন্ময়ের মনে হলো একটু মন খুলে মনের কথা বলতে। কথার ভারে তার প্রাণ যায় যে! কিন্তু বলতে পারলে না। সংকেচ, দ্বিধায় আটকে গেলো মুখের বুলি মুখেতেই। সে কথা ঘুরিয়ে বলল,

“না ভাই, কী আর সমস্যা হবে। গেম খেলেছি সারা রাত।”
“এখন তাহলে ঘুমুতে যা। ঘুমিয়ে নে। ভোর হয়ে গেলো বলে।”
ভাইয়ের কথা মাথা পেতে নিলো মৃন্ময়। যেমন করে এসেছিলো তেমন করেই প্রস্থান নেওয়ার জন্য পা বাড়াতেই শাহাদাৎ পিছু ডাকল। আপন মনে বলল,
“যদি প্রেম ঘটিত সমস্যা হয় জানাবি। আমরা যেকোনো মেয়েকে বউ হিসেবে আনতে রাজি তোর পছন্দের। আর বাবার অফিসে কবে থেকে বসবি সেটাও জানাস।”
মৃন্ময় যেতে নিয়েও ফিরে তাকায়। তপ্ত শ্বাস ফেলে বলে, “এ মাসটা কাটুক। আগামী মাসে বসবো। এ মাসে একটু নাহয় তাকে ভেবেই কাটিয়ে দিলাম।” শেষের বাক্যটা খুব ধীরে বলল। এতটাই ধীরে যে তার ভাই বুঝলো না।
মৃন্ময় চলে যেতেই আবারও ছাদে একাকী দাঁড়িয়ে রইল শাহাদাৎ। খুব মন টানল চাঁদনীকে কল দেওয়ার জন্য। কিন্তু নিজের মনকে সংযত করল। কী দরকার মানুষের ব্যথা বাড়ানোর!

সওদাগর বাড়ি ব্যস্ত বাড়ির মেয়ের বিয়ে সম্পর্কিত অনুষ্ঠান নিয়ে। আজ গায়ের হলুদ অহির। সকাল থেকে তাই দৌড়াদৌড়ি, ছোটাছুটি পড়ে গেছে। এই নাকি ফুল নেই, এই নাকি সাদা গোলাপ কম এনেছে, এই নাকি রান্নার আয়োজন শুরু করতে দেরি হচ্ছে… আরও কত কী!
অহির ঘরে ফ্যান চলছে। পর্দা গুলো এখনো টাঙানো। জানালার সামনে থেকে সরানো হয়নি পর্দা গুলো। বাহিরের হৈচৈ রুমটি অব্দি পৌঁছাতে দিচ্ছে না বন্ধ দরজাটি। সকলেই অহির একটি সুষ্ঠ নিন্দ্রার ব্যবস্থা করে দিয়েছে যেন। মেয়েটা ভোরে নাস্তা করে, স্নান সেরেই ঘুমিয়েছে।
অহির সুন্দর ঘুমটিকে বড়ো জ্বালাতন করে ভাঙিয়ে দিলো তার ফোনের রিংটোন। অনবরত তার কম্পনরত শব্দে অহির ঘুম ভাঙলো। তবে চোখে তখনও এক সমুদ্র ঘুম বাসা বেঁধে আছে। অহি ঘোলা চোখে ফোনটি রিসিভ করল। ভারী কণ্ঠে বলল,

“হ্যালো…”
অপর পাশ থেকে পুরুষালি, চনমনে কণ্ঠ ভেসে এলো, “ঘুমাচ্ছেন নাকি?”
কণ্ঠটি নওশাদের তা বুঝতে এক সেকেন্ডও সময় ব্যয় হলো না অহির। সে ঘুমন্ত স্বরে, ঠোঁটে কিঞ্চিৎ হাসি নিয়েই বলল, “হ্যাঁ।”
“তাহলে ঘুমিয়ে নিন, পরে কল দিচ্ছি।”
“আরে না, না। বলুন।”
“আসলে মা জিজ্ঞেস করছিলো আপনার আঙুলের সাইজ কত।”
“কেন?”
“সেটা তো আম্মুই জানে। আমাকে কেবল জিজ্ঞেস করতে বলল।”

অহি হাসলো। আংটির সাইজ যে ওর শাশুড়ি নয় নওশাদেরই প্রয়োজন তা সে বুঝতে পেরেছে বেশ। তবে, সে বুঝতে পারেনি ভাব করেই সাইজ বলল।
নওশাদ বলল, “তাহলে আপনি ঘুমিয়ে নিন। পরে কথা হবে।”
“না, সমস্যা নেই। হুমু কোথায়?”
“আরে ঘুমিয়ে নিন। পরে আবার কবে না কবে ঘুমুতে পারেন রাতে। আর হ্যাঁ, হুমু খেলছে।”
অহি হয়তো বুঝলো না নওশাদের কথার ইঙ্গিত। তাই শুধাল, “ঘুমুতে পারব না কেন রাতে?”
“কারণ রাতে কাজ আছে তাই পারবেন না।”
“কী কাজ?”
“কেন, ভালোবাসা-বাসির কাজ।” কথাটি বলেই নওশাদ হো হো করে হেসে উঠল। এবার পরিপূর্ণ ভাবে অহির মস্তিষ্কে সেই কথাটি অর্থবহ হলো। লজ্জা ঘিরে ধরলো তাকে আষ্টেপৃষ্টে। অহি মাথা নামিয়ে ফেলল। “নির্লজ্জ” বলেই খট করে কেটে দিলো ফোনটা।
নব্য হবু বধূর সবটুকু লজ্জা তাকে জড়িয়ে ধরলো ভালোবেসে। তার দেহে লাজ এলো আবেশে।

অহির হলুদ শুরু হবে আরও প্রায় ঘন্টাখানেক পর। আকাশে তখন ভর সন্ধ্যে। ল্যাম্পপোস্টের আলোয় ঝলমল করছে রাস্তা। চিত্রা তৈরি হয়ে নিয়েছে অনেকটা সময় আগেই। সে এখন একটা জায়গায় যাবে তাই আগেই তৈরি হওয়া।
নিজের ঘরে বসেই অপেক্ষা করছিলো সে ভাইজানের। তার অপেক্ষার অবসার ঘটিয়ে তুহিন উপস্থিত হলো। নীল পাঞ্জাবি পরনে তার। আজ গায়ের হলুদ উপলক্ষে সকলে নীল রঙের পোশাক পরেছে।
নীল পাঞ্জাবিতে তুহিন ভাইজানকে নির্দ্বিধায় অসম্ভব সুন্দর সুপুরষটি লাগছে। তবে মানুষটার চোখে এক গুপ্ত অবসন্নতা চোখ এড়ায় না চিত্রার।

তুহিন ঘরে ঢুকেই চিত্রাকে তাড়া দিল, “কিরে, চল। কোথায় না যাবি?”
চিত্রা বিছানা থেকে উঠে দাঁড়াল। এক গাল হেসে বলল, “হ্যাঁ, এক জায়গায় যাবো। দরকার আছে।”
তুহিন একটু কপাল কুঁচকালো। তাড়া দিয়ে বলল, “আজই যেতে হবে? সব কাজই তোর দরকারের সময় পড়ে।”
চিত্রা এক গাল হেসে মাথা নাড়াল। ভাইজানের কথা তেমন না ধরেই ভাইজানকে টেনে নিয়ে গেলো বাহিরে। তুহিন গাড়ি বের করতে চাইলেও চিত্রা গাড়ি বের করতে দিলো না। বায়না ধরল রিকশা করে যাওয়ার। তুহিন বোনের বায়না পূরণ করল। রিকশা ডেকে উঠে পড়ল রিকশায়।
চিত্রা রিকশায় উঠেই হাসিমুখে বলল, “তুমি আমার সব ইচ্ছেই পূরণ করলে, ভাইজান। তুমি অনেক ভালো।”
তুহিন বোনের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো আলগোছে। শান্ত কণ্ঠে বলল, “তুই তো আমার চেয়েও ভালো।”

“তাই তো তোমার থেকে সুখ কেড়ে নিলাম।” কথাটি বলেই ছোটো দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করল চিত্রা।
তুহিন কপাল কুঁচকালো, ছোটো ধমক দিয়ে বলল,
“মানুষের কি সাধ্য আছে সুখ কেড়ে নেওয়ার? যার অদৃষ্টে যা লিখা তা-ই হবে দিনশেষে। সে আমি, তুই যা করি আর না করি।”
চিত্রা ভাইয়ের হাতটা জড়িয়ে ধরলো। বিষণ্ণ কণ্ঠে বলল, “তুমি সুখেরা ফিরে আসুক ভাইজান। ফিরে আসুক।”
নিস্তব্ধ রাস্তায় তিন পায়া যানটা চলতে চলতে ওরা দু’জন এসে পৌঁছালো কাঙ্ক্ষিত জায়গাটিতে।
তুহিনের কাছে অপরিচিত জায়গাটি। সে রিকশা থেকে নামতে নামতে প্রশ্ন করল, “এখানে কেন এসেছিস, চিতা বাঘ?”

চিত্রা জবাব দিলো না। ভাইয়ের হাত টেনে নিয়ে গেলো ভেতরে। তুহিনের গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল। যেতে যেতে তারা গিয়ে দাঁড়াল একটি রুমের সামনে। চিত্রা রুমের দরজাটি অল্প একটু খুলল। তুহিন বাহির থেকে দেখল বাহার ভাই বসে আছেন ভেতরে। তুহিন কপাল কুঁচকে কিছু বলার আগেই ভেতরে থাকা মেয়েটাকে দেখে চমকে উঠল।
তুহিন মূর্তির মতন ভেতরে ঢুকল প্রাণহীন পায়ে। ধীর কণ্ঠে ডাক দিল, “বনফুল?”
এলোমেলো, তেলে জবজবে হয়ে থাকা চুলগুলো কাসের পিঠে গুঁজে নিচ্ছিল বনফুল। তুহিনের ডাকে মেয়েটা তুহিনের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকাল।

যতনে রাখিলাম যাতনা পর্ব ২৪

বাহার ভাই ও চিত্রার মনে হলো এই বুঝি মেয়েটা রেগে যাবে। এই বুঝি মেয়েটা উত্তেজিত হবে।
অথচ তাদের অবাক করে দিয়ে বনফুল হেসে দিলো। চোখ টলমলে জল নিয়ে কেবল বোকা বোকা কণ্ঠে বলল,
“তুমি এসেছো? আমার কাছে সত্যি এসেছো? তোমাকে কি ছুঁতে নিলে আবার চলে যাবে? না আজ ছোঁয়া যাবে?”
কী আকুতি সেই কণ্ঠে! তুহিন ছুটে গেলো। তুহিনের চোখে ততক্ষণে জল এসে পড়েছে। সে বিনা দ্বিধায় বনফুলের হাত ধরল। অস্ফুটস্বরে বলল, “এই যে ছুঁয়ে দেখো। আমি আর চলে যাচ্ছি না।”

যতনে রাখিলাম যাতনা পর্ব ২৬