হ্যালো 2441139 পর্ব ২৪

হ্যালো 2441139 পর্ব ২৪
রাজিয়া রহমান

বৃষ্টি থেমেছে অনেকক্ষণ হলো।আকাশে এখনো ঘন কালো মেঘ জমে আছে।থেমে থেমে মেঘের গর্জন ভেসে আসছে।
পিয়াসা মায়ের কোলে মাথা রেখে শুয়ে আছে। আকাশের মতোই জমাট মেঘ জমে আছে পিয়াসার মনে।
তার মনটা ভীষণ অস্থির হয়ে আছে।
মা কেনো এসব কথা বলছে?
সে এসব শুনতে চায় না।ওই নামগুলো পিয়াসা আজীবনের জন্য তার জীবনে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে দিয়েছে।
এসব কথায় তার বুকের ভেতরটা যন্ত্রণায় আরো ভারী হয়ে উঠে।
যে-সব স্মৃতি সে বুকের ভেতর এক অন্ধকার কফিনে ঢুকিয়ে পেরেক ঠুকে বন্ধ করে দিয়েছে আজীবনের মতো সে-সব কিছুই সে শুনতে চায় না।
আল্লাহ তাকে নতুন একটা জীবন দিয়েছেন নতুন বাবা মা’য়ের কাছে। তাদের ছাড়া আর কাউকেই পিয়াসা জানতে চায় না,চিনতে চায় না।

শারমিন মেয়েকে পারভীনের সব কথা জানালো।
তারপর বললো, “পারভীন তোকে নিজের কাছেই নিয়ে যেতো যদি না তোকে আমরা লিগ্যালি দত্তক নিয়ে আসতাম।সে তোর জন্মদাত্রী। অবশ্যই তোর প্রতি তার ভালোবাসা অসীম।
ও যখন জানতে পেরেছিলো তুই আমার কাছে আছিস,তারপর ও গোপনে তোর খোঁজ খবর নিয়েছে পারভীন। লজ্জায়,ভয়ে তোর সামনে আসে নি আজ পর্যন্ত।
সন্তানের চোখে উপেক্ষিত, অবহেলিত, ঘৃণিত হওয়ার মতো যন্ত্রণাদায়ক আর কিছুই নেই।সে তো একটা আস্ত জাহান্নামে ছিলো রে মা।মা হওয়ার আগে সে একজন মানুষ। আগে তো তার বাঁচতে হবে। নিজে সুস্থভাবে না বাঁচলে তোকে কিভাবে বাঁচাতো?”
শুনে পিয়াসা হিহিহি করে হেসে উঠে। শারমিন অবাক হয়। মেয়ে হাসছে কেনো?
শারমিন তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকায় মেয়ের দিকে।পিয়াসা কেমন অপ্রকৃতস্থ মানুষের মতো হাসছে।সারা শরীর দুলিয়ে এরকম অট্টহাসি তো তার মেয়ে হাসে না।
শারমিন বুঝতে পারে মেয়েটা আঘাতের তীব্রতায় এমন করছে।মা’কে বুঝতে দিতে চাইছে না তার ভেতর কতটা গভীর ক্ষত।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

মানুষ হয়ে জন্মানোর অনেক যন্ত্রণা।
বুকে যন্ত্রণা লুকিয়ে নিজেকে সুখী প্রমাণ দিতে হয়।
মায়ের মন অনেক কিছুই বুঝতে পারে। সন্তান যখন বুকের জমা ক্ষত বাবা মা’য়ের থেকে লুকাতে ভান করে, মা’য়ের ভালোবাসার চোখে সেই হাসির পেছনে দুমড়ে মুচড়ে যাওয়া অন্তরটা ঠিকই ভেসে উঠে।
শারমিন মেয়ের মুখে হাত চাপা দিয়ে বললো, “না মা,তুই এভাবে হাসিস না।আমার চাঁদের হাসি আমি চিনি মা।এই হাসি যে বড় দুঃখের হাসি,বড় ক্ষোভের হাসি।”
পিয়াসা হাসি বন্ধ করে মা’য়ের দিকে তাকিয়ে বললো,”জেনে ও কেনো এসব বলছো মা?ওই মানুষগুলোর প্রতি আমার মনোভাব এই জন্মে হোক আর পরকালে হোক,কখনোই বদলাবে না।আমি তাদের কখনোই ক্ষমা করবো না যারা নিজেদের স্বার্থসিদ্ধি র জন্য আমাকে ত্যাগ করতে এক মুহূর্ত ভাবে নি সে হোক পারভীন অথবা শাহেদ।”
শারমিনের কেমন দম বন্ধ লাগে।তার মেয়েটার বুকে কি অনেক বড় ক্ষত জমে আছে!
মা হয়ে কেনো মেয়ের আঘাত দূর করতে পারছে না?

কি করলে মেয়েটা সব ভুলে যেতে পারবে?
পিয়াসা মা’য়ের হাত নিজের গালে চেপে ধরে বললো, “মা,জীবনে সব ক্ষত মুছে ফেলা যায় না।সব আঘাতের নীল রঙ বিবর্ণ হয়ে যায় না।
কিছু যন্ত্রণা বুকের কোনো এক কোণে বন্দী করেই বাঁচতে হয়।সেই যন্ত্রণাগুলো থাকে বলেই মানুষ জীবনে সুখের মর্ম বুঝতে পারে।
এই যে আমি, ভীষণভাবে বুঝতে পারছি এখন সন্তানের জন্য গুড প্যারেন্ট কেমন ব্লেসিং!
বুঝতে পারছি বলেই আমি চাই জীবনের সব ঘাত,প্রতিঘাতে তুমি আর বাবা যাতে আমার পাশে থাকো।
তোমাদের ছাড়া আমি ভীষণ অসহায় মা।”
শারমিনের বুকের ঝড় শান্ত হয়।
বৈশাখীর বিয়ে হয়েছে প্রায় চার মাস আগে।এর মধ্যে পিয়াসার এইচএসসি ও শুরু হয়ে গেছে।গতকাল পরীক্ষা শেষ হয়েছে। এতোগুলো সময় কেটে গেছে শারমিন মেয়ের কাছে পারভীনের ব্যাপারটা বলবে বলবে করেও বলে উঠতে পারে নি।

সিদ্ধান্ত নিয়েছিলো মেয়ের এইচএসসি শেষ হলে মেয়ে যখন চাপমুক্ত থাকবে তখনই মেয়েকে জানাবে।
সেই সময়টা এখন এলো।গতকাল পরীক্ষা শেষ হওয়ার পর শারমিন আজকে মেয়ের সাথে সব কথা শেয়ার করলো।সেদিন পিয়াসা আর কিছুতেই বিয়ে বাড়িতে থাকে নি।বিয়ের দিনেই আনোয়ার চৌধুরী মেয়ের অস্থিরতা দেখে বাড়িতে চলে এসেছেন।
পিয়াসা উঠে বসে। মা’য়ের গলা জড়িয়ে ধরে বললো, “মা,আমি কোচিং এ ভর্তি হবো কোথায়? এডমিশন টেস্টের জন্য তো কোচিং করতে হবে।”
শারমিনের মাথায় ও এই ব্যাপারটা ছিলো। মেয়েদের জীবন কতো অদ্ভত।এই যে মেয়েটা এখন এডমিশন টেস্টের জন্য ঘর ছাড়বে এরপর আর কি আগের মতো ফিরতে পারবে সব পিছুটান ছেড়ে!
এতো দিন যেমন নিশ্চিন্তে,নির্বিঘ্নে ছুটে এসে বাবার গলা জড়িয়ে ধরতো।এরপর কি আর সেই সময় আসবে?
পড়ালেখা, ক্যারিয়ার এরপর একদিন টুক করে বিদায় দিয়ে দিতে হবে মেয়েকে।মেয়েটা অতিথি হয়ে যাওয়ার সময় যেনো ঘনিয়ে আসছে।

তিনি নিজেও তো এভাবেই বের হয়েছিলেন বাড়ি থেকে পড়ার জন্য, তারপর আর তার ঘরে ফেরা হলো না।
যেই ঘর আলোকিত করে একটা মেয়ে জন্ম নেয় সেই ঘরটার সাথে যোজন যোজন দূরত্ব তৈরি হয়ে যায় কবে যেনো।
নতুন ঠিকানা হয়,নতুন ঘর হয়,,নতুন মানুষ আসে জীবনে।
জন্ম থেকে চেনা সেই ঘরটার সাথে পর হয়ে যেতে থাকে জন্ম থেকে চেনা মানুষেরা।
পিয়াসা মা’য়ের চিবুকে হাত রেখে বললো, “কি ভাবছো মা?”
“আমাদের এখানে তো ভালো কোনো কোচিং সেন্টার নেই।তুই ঢাকায় কোচিং করবি?”
পিয়াসা এক মুহূর্ত ভাবে।তার ক্লাসমেটরা সবাই-ই ঢাকাতেই কোচিং করবে।
“বাবা আসলে রাতে বাবার সাথে ডিসকাস করো তুমি। বাবা যেখানে বলবে সেখানেই। ”
শারমিন চলে যেতেই পিয়াসা অতীত মুড়িয়ে রাখা স্মৃতির কফিনের ঢাকনা খোলে।
মানসপটে মা বলে যেই মানুষটার ছবি ভেসে উঠে তাকে মন কিছুতেই মা বলে স্বীকৃতি দিতে চায় না।
পিয়াসা কিভাবে এই মানুষটাকে ক্ষমা করবে!

সেই দুঃসহ রাতটা পিয়াসা যেভাবে কাটিয়েছে সে কথা মনে পড়লেই পিয়াসার আত্মা কেঁপে উঠে।
পিয়াসা চোখ বন্ধ করে বলে, “যাদের দেওয়া আঘাতে আমার রূহ পর্যন্ত যে-ই কেঁপে উঠেছিলো তারা যতোই পরিস্থিতির স্বীকার হোক, আমি কখনোই তাদের ক্ষমা করবো না।”
কতো মানুষ -ই তো সন্তানকে আগলে ধরে সব ঝড় মোকাবিলা করে। এভাবে যে ফেলে যেতে পারে সে কখনোই আপন ছিলো না।
সেই রাতে পিয়াসা প্রতি মুহূর্তে কেঁপে উঠেছিলো।মা’য়ের চিন্তা, সাপের ভয়,ভুলুর ভয়।
সে-সব পিয়াসা কি করে ভুলবে!
ক্ষমা করার মতো মহৎ পিয়াসা কখনো হতে চায় না।শেষ বিচারের দিন ও পিয়াসা আল্লাহকে বলবে,”আল্লাহ, এই মানুষগুলোর দেওয়া যন্ত্রণা আমার রূহ পর্যন্ত পৌঁছে গিয়েছিলো।সেই সময় আমি সহ্য করেছি আল্লাহ, আজকে যাতে তোমার এই হাশরের ময়দান সহ্য না করে। ”

যারা এতো নির্মম ভাবে তাকে ক্ষত বিক্ষত করেছে তাদের জন্য পিয়াসা এক ফোঁটা সহানুভূতি অনুভব করে না।নিজেকে পাথর করতে অনেক কষ্ট হয়েছে পিয়াসা।আর ভাঙবে না সে।কিছুতেই না।
হতে পারে তিনি ভীষণ বাজে পরিস্থিতিতে ছিলো,কিন্তু পিয়াসা নিজে কি ভালো পরিস্থিতিতে ছিলো তা কি ভেবেছে!
সেই ঝড়ের রাতে ভুলুর আক্রমণ থেকে পিয়াসা যখন পালিয়ে এসেছিলো, সেই দুঃস্মৃতি এখনো পিয়াসাকে তাড়া করে।
সব কি এতো সহজে ভুলে যাওয়া যায়?
তিনি যেমন নিজের পরিস্থিতির স্বীকার, পিয়াসা ও তেমন।
তার পরিস্থিতি যদি তাকে পিয়াসার থেকে দূরে যেতে বাধ্য করেছে,তাহলে পিয়াসার পরিস্থিতি ও তাকে ক্ষমা না করতে শিখিয়েছে।
তাদের দুজনের জীবনে ল্র সবচেয়ে বড় ভিলেন তাদের ভাগ্য।
তাছাড়া এখন তিনি ও নিজের জীবনে ভালো আছেন,পিয়াসা ও বাবা মা’কে নিয়ে ভালো আছে।কারো জীবনের ছায়া কারো উপর নেই।

সেখানে পিয়াসা তাকে ক্ষমা করুক আর না করুক,তাতে তার কোনো অসুবিধা হওয়ার কথা না।পিয়াসা তার জীবনের হারিয়ে যাওয়া সেই অধ্যায়, যে অধ্যায় তার জীবনের পরীক্ষার সিলেবাসের বাহিরে।
জীবনের চলার পথ যখন আলাদাই হয়ে গেছে আজীবনের জন্য সেখানে ক্ষমা করুক আর না করুক কার কি!
রাতে খাওয়ার টেবিলে বাবা মেয়ে একত্রিত হয়।পিয়াসা বাবার দিকে তাকায়। বাবাকে ভীষণ ক্লান্ত লাগছে।
বাবার হাতের উপর হাত রেখে বললো, “কি হয়েছে বাবা?এমন লাগছে কেনো তোমাকে?”
আনোয়ার চৌধুরী মেয়ের মাথায় হাত রেখে বললো, “তুই কোচিং এর জন্য দূরে চলে গেলে আমি কিভাবে বাঁচবো বাবা?তুই ছাড়া যে আমার এই ঘর অন্ধকার হয়ে যাবে।”
পিয়াসা হেসে বললো, “পড়তে যাচ্ছি বাবা,আজীবনের জন্য যাচ্ছি না।”
“তোর সিরাজ আংকেলের সাথে কথা বলেছি বুঝলি।তোর মা আমাকে বিকেলে জানিয়েছে।তখনই তোর আংকেল কল করে। কথায় কথায় আমি জানাই তোর কোচিং এর কথা।

তুই ঢাকাতেই কোচিং করবি।ওদের বাসায় থেকেই কোচিং করবি।তোকে হোস্টেলে দিলে আমি অস্থিরতায় নিশ্বাস নিতে পারবো না।তোর দেখা শোনা করার কেউ থাকবে না।”
শারমিন গ্লাসে পানি ঢালতে ঢালতে বললো, “এটা তো সবচেয়ে ভালো সিদ্ধান্ত। আমি ও নিশ্চিন্ত থাকতে পারবো তোকে নিয়ে। কি খাচ্ছিস,না খাচ্ছিস,কেমন আছিস সব দেখার জন্য রজনী আছে।তা না হলে অন্য কোথাও থাকলে কে তোর যত্ন নিবে।”
পিয়াসার মাথায় আসমান ভেঙে পড়ে। আবারও ওই বাড়িতে যেতে হবে?
পিয়াসার চোখের সামনে সেই দিনটার স্মৃতি ভেসে উঠে।
হলুদ একটা লেহেঙ্গা পরে পিয়াসা বাবা মা’য়ের সাথে প্রথম আষাঢ়দের বাড়িতে বেড়াতে যায়।
পিংকির সাথে পিয়াসার ভীষণ ভাব হয়ে যাওয়ায় পিংকি পিয়াসাকে নিয়ে ছুটে যায় ছাদে তাকে কবুতর দেখানোর জন্য।

এতো কবুতর দেখে পিয়াসার ভীষণ আনন্দ হয়।
পিংকি পিয়াসাকে ছাদে রেখেই নিচে আসে।
পিয়াসা যখন নিচে হয়ে বসে কবুতরকে আদর করছিলো, মিরা এসে এক ফাঁকে উপুড় হয়ে বসে থাকা পিয়াসার লেহেঙ্গার টপসের ফিতা কেটে দেয়।
পিয়াসাকে যে ওরা তিন বোন ভীষণ অপছন্দ করে পিয়াসার তা বুঝতে বাকি ছিলো না।
আষাঢ় পিয়াসার সামনে বসেই কবুতরকে খাবার দিচ্ছিলো।সেই মুহূর্তেই দুর্ঘটনা ঘটে।
টপস অনেকটা নেমে আসে গলা দিয়ে পেছনের বাঁধন ছিঁড়ে যাওয়ায়।
আষাঢ় তাৎক্ষণিক উঠে সরে যায়, পিয়াসার খেয়াল হয় কিছুক্ষণ পরেই।
ভয়ে,আতংকে পিয়াসা ছুটে নেমে আসে ছাদ থেকে।
কেউ জানে না কি ভীষণ লজ্জা,অপমানের মুখোমুখি হয়েছে পিয়াসা সেদিন।
লজ্জায় মাটির সাথে মিশে যেতে ইচ্ছে করছিলো তার।
তারপর থেকে আষাঢ়কে পিয়াসা ভীষণ ভয় পায়।
ইথচ এখন কি-না তাদের বাসায় গিয়েই থাকতে হবে?
পিয়াসার বুকের ভেতর দ্রিমদ্রিম করে। কি করবে?

সকাল বেলায় আষাঢ়ের সাথে পিয়াসার দেখা হয়ে গেলো। আনোয়ার আংকেল পিয়াসাকে নিয়ে এসেছেন।
মা’য়ের কাছে আষাঢ় গত রাতেই শুনেছিলো পিয়াসা আসবে, এখানে থেকেই কোচিং করবে।
আষাঢ় পিয়াসাকে দেখে ভাবলো এখন থেকে তার বাড়িতে থাকা কমিয়ে দিতে হবে।এমনিতে ও আষাঢ় বাড়িতে কম থাকে রাজনৈতিক কারণে। প্রায় তাকে বাড়িতে ফিরতে হয় ১ টার দিকে।
সকালে বের হয়ে রাতে বাড়ি ফেরে আষাঢ়।
পিয়াসা নিশ্চিন্তে থাকতে পারবে।তার জন্য মেয়েটা অস্বস্তিতে পড়ুক এটা আষাঢ় কখনোই চায় না।এজ এ জেন্টেলম্যান,সে চায় এই মেয়েটা নিশ্চিন্তে তার পোষা কইতরের মতো ঘুরে বেড়াক এই বিশাল বাড়িটির আনাচে কানাচে।

হ্যালো 2441139 পর্ব ২৩

নিজের ভাবনায় নিজেই হেসে ফেলে আষাঢ়।
কইতর!
কি কিউট বিশেষণ!
এই মেয়েটাকে কইতর বলেই ডাকবে কোনো এক দিন।দেখা যাবে কেমন রিয়েক্ট করে সে তখন।
নিশ্চয় আষাঢ়ের মাথা ফা টি য়ে দিবে।

হ্যালো 2441139 পর্ব ২৫