অশ্রুজলে বোনা বিয়ে সিজন ৩ পর্ব ৪৩
ইয়াসমিন খন্দকার
আরুশি বাসায় এসে জাঈদকে নিয়ে ঘরে দরজা বন্ধ করে বসে আছে। রাজীব এটা দেখে দীর্ঘ শ্বাস ফেলে। দরজার বাইরে থেকেই বলে,”নিজের অতীত থেকে কি এভাবে পালিয়ে বেড়ানো যায় আরু? তুমি এভাবে বেশিক্ষণ থাকতে পারবে না। তোমায় এবার সত্যের সম্মুখীন হতেই হবে। আর সত্য টা হলো এই যে, জাঈদ যে আরহামের সন্তান এটা হয়তো এবার ওর জানার সময় এসে গেছে।”
আরুশি বলে ওঠে,”কিন্তু সত্য টা জেনে যদি ও আমার ছেলেকে আমার থেকে দূরে পাঠায়। এটা যে আমি মানতে পারব না।”
“পরে কি হবে এটা আমি জানি না আরু। তবে আরহাম আমাদের ফলো করেছে আমি খেয়াল করেছি। ও হয়তো কিছু সময়ের মধ্যে আমাদের বাসাতেও চলে আসবে। এভাবে বেশি সময় তুমি আর পালিয়ে বেড়াতে পারবে না।”
আরুশি জাঈদকে বুকের সাথে আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলে,”হতে পারে আরহাম ওর বাবা। কিন্তু আমি ওর মা। আমি ওকে জন্ম দিয়েছি। জাঈদ আমার নাড়িছেঁড়া ধন। জন্মের পর থেকে ওকে আমি একা মানুষ করেছি৷ তাই ওর দায়িত্ব আমি আর কাউকে দেব না। এভাবে কাউকে আমি ওকে আমার থেকে বিছিন্ন করতে দেব না। রাজীব ভাই, তুমি প্লিজ আমাকে আইনিভাবে সাহায্য করার ব্যবস্থা করে দিও। আমি চাই, আমার ছেলে যেন আমার সাথে থাকে। এজন্য যা যা করতে হয় আমি করব। আমার শুধু আমার ছেলেকে চাই, ব্যস।”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
এমন সময় হঠাৎ করে তাদের বাসার মেইন দরজায় কলিং বেল বেজে ওঠে। রাজীব দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বলে,”৫ বছর পর, নিজের অতীতের মুখোমুখি হবার জন্য প্রস্তুত হও তুমি আরু। এখন আর পালানোর কোন পথ নেই।”
বলেই রাজীব গিয়ে দরজাটা খুলে দেয়। দরজা খোলামাত্রই আরহাম তাড়াহুড়ো করে বাসায় ঢুকে আসে। রাজীবকে দেখেই বলে,”রাজীব ভাই..আপনি আমার থেকে সত্যটা কেন লুকালেন? আরুশি আপনার কাছে এসে এটা কেন বললেন না আমায়? কেন করলেন আপনি এমনটা?”
“আরহাম, শান্ত হও। আমাকে এক্সপ্লেইন করতে দাও।”
“আমি আপনার কোন এক্সপ্লেনেশন শুনতে রাজি নই। আমি এখানে আরুশির সাথে কথা বলতে এসেছি। আপনি ওনাকে ডেকে দিন।”
“ডেকে দিচ্ছি বাট তুমি একটু শান্ত হও। এভাবে রেগে থাকলে আরুশি তোমার সাথে কথা বলতে ভয় পাবে!”
“এটা আমার আর আরুশির ব্যাপার। আপনি এই নিয়ে কথা না বললেই খুশি হবো। প্লিজ, আরুশিকে ডেকে দিন।”
রাজীব এবার আরুশির রুমের সামনে গিয়ে বলে,”আরু..বি ব্রেভ। এভাবে আর লুকিয়ে থাকলে হবে না। বাইরে বেরিয়ে এসো। এত দিন অনেক লুকোচুরি হয়েছে বাট আজ একটু বাস্তবতা টাকে ফেইস করো। বাস্তবতা থেকে আজ আর পালানোর কোন পথ নেই।”
আরুশি জাঈদকে বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে তার কপালে চুমু খেয়ে বলে,”তোমাকে আমি হারাতে পারবো না! প্লিজ, আমাকে কথা দাও নিজের মাম্মাকে ছেড়ে কোথাও যাবে না।”
জাঈদ বলে ওঠে,”আমি তোমায় ছেড়ে কোথাও যাব না মাম্মা!”
আরুশি এবার সাহস করে জাঈদকে নিয়ে উঠে দাঁড়ায়। অতঃপর ধীর পায়ে এগিয়ে গিয়ে দরজাটা খুলে বাইরে আসে। আরুশিকে দেখামাত্রই তার সামনে এসে দাঁড়ায় আরহাম। আরুশির কোলে থাকা জাঈদের দিকে তাকায়। ছেলেটাকে প্রথম দেখাতেই তার অনেক আপন মনে হয়েছিল। এখন তো তার চেহারার মাঝেও যেন নিজের মিল খুঁজে পাচ্ছে।
আরুশি জাঈদের দিকে আরহামকে তাকাতে দেখে ভয়ে জাঈদকে আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। আরহাম বলে ওঠে,”কেন তুমি এত দিন ধরে এভাবে আমাদের থেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছিলে আরুশি?”
আরুশি চুপ থাকে। আরহাম অধৈর্য হয়ে বলে,”চুপ করে আছ, সব সত্যটা বলো।”
“তুমি সব জেনেও এসব কিভাবে বলছ?”
“সব জেনে মানে? কি জানতাম আমি। তোমার অবস্থান সম্পর্কে আমি কিছুই জানতাম না। এই ৫ বছরে আমি তোমায় কত খুঁজেছি। সেটা কি তুমি জানো?”
আরহাম এর কথায় আরুশি একটু আবেগঘন হয়ে যায়। তারপর নির্ঝর খানের বলা কথা ও আরহামের কোলে থাকা মেয়েটির কথা ভেবে সে বলে,”ওহ, রিয়্যালি? তুমি আমায় খুঁজে বেরিয়েছ, মানে সত্যিই? কিন্তু কেন? তোমাকে তো নিজের নতুন জীবনে অনেক হ্যাপিই মনে হচ্ছে। কেন তাহলে আবার আমার খোঁজ করছ?”
“সুখ? হাহ, আমার জীবন বিগত ৫ বছরে কেমন ছিল সেটা শুধুমাত্র আমিই জানি। যাক গে, বাদ দাও সেসব কথা। এখন আমি তোমায় যেই প্রশ্ন করব, কোন ভনিতা না করে সেই প্রশ্নের জবাব দাও।”
“কি প্রশ্ন?”
“তোমার ছেলে..”
“জাঈদ..ওর নাম জাঈদ।”
“আচ্ছা, জাঈদ কি আমার সন্তান? ওর বাবা কি আমি?”
আরুশি চুপ থাকে। আরহাম মেজাজ হারিয়ে বলে,”অনেক চুপ থেকেছ তুমি আরুশি আজ এটলিস্ট আর চুপ থেকো না। বিগত ৫ টা বছর আমার জীবন কতোটা কষ্টে ছিল তা আমি বল বুঝাতে পারব না। তুমি আমাকে বা বাড়ির কাউকে কিছু না বলে হঠাৎ এভাবে হারিয়ে গেলে। তারপর তোমার আর কোন খোঁজ খবরই পাওয়া গেল না আর আজ হঠাৎ এত গুলো বছর পর আমি খুলনায় এসে তোমার দেখা পেলাম। শুধু তাই নয়,জানতে পারলাম তোমার একটা ছেলেও আছে। কিন্তু আমার সাথে তো তোমার এখনো ডিভোর্স হয় নি। লিগ্যালি আমরা এখনো হাসবেন্ড ওয়াইফ..তাহলে তুমি নিশ্চয়ই আর অন্য কাউকে বিয়ে করো নি। তাহলে এই বাচ্চা..”
আরুশি বলে,”জাঈদ আমার ছেলে। এই পরিচয়ই ওর জন্য যথেষ্ট। এর থেকে বেশি কোন পরিচয়ের ওর দরকার নেই।”
“তোমার দরকার না থাকতে পারে কিন্তু আমার জানার দরকার আছে। ওকে আমায় দাও, ওকে আমি হাসপাতালে নিয়ে যাব ওর ডিএনএ টেস্ট করাবো। সব সত্যটা আমি জেনেই ছাড়ব।”
“আরহাম! আমার সন্তানের থেকে দূরে থাকো। তুমি তো নিজের নতুন জীবন শুরু করেছ। তাহলে সেই জীবন নিয়েই সুখে থাকো না। কেন আমার আর আমার ছেলের জীবনের সুখ কেড়ে নিতে চাইছ?”
“আমি কারো জীবনের সুখ কেড়ে নিতে চাইছি না। আমি শুধু সত্যটা জানতে চাইছি।”
“বেশ, তুমি সত্যটা জানতে চাও তো তাহলে শোনো, আরহাম তোমারই ছেলে। তুমি ওর বায়োলজিকাল পিতা। আমার কথা বিশ্বাস না হলে ডিএনএ টেস্টও করিয়ে দেখতে পারো। শুনেছ সত্যটা? এবার শান্তি হয়েছে?”
আরহাম একদম আবেগপ্রবণ হয়ে যায়। জাঈদের দিকে অশ্রুসিক্ত চোখে তাকিয়ে চরম ক্রোধ নিয়ে বলে,
“শান্তি? কিসের শান্তির কথা বলছ তুমি আরুশি? দীর্ঘ ৫ টা বছর ধরে তুমি আমার সন্তানের থেকে আমায় দূরে রেখেছ। আমি জানতেও পারি নি আমার এতো ফুটফুটে একটা সন্তান আছে৷ আমাকে তুমি আমার পিতৃত্ব থেকে বঞ্চিত করেছ আর এখন আমায় দোষ দিচ্ছ যে আমি তোমার সুখ কেড়ে নেব?”
“কেন,আপনি তো অন্য একটা মেয়েকে বিয়ে করে নিয়েছেন। তার সাথে আপনার একটা সন্তানও আছে। তাহলে কিসের দুঃখ আপনার? আপনি নিজের দ্বিতীয় স্ত্রী আর সন্তান নিয়েই সুখী থাকুন না। আমার আর আমার ছেলেকে একা থাকতে দিন।”
“এসব কি যা তা বলছ?”
“যা তা বলছি না। যা সত্য তাই বলছি।”
“আমার দ্বিতীয় স্ত্রী আর সন্তান আসবে কোথা থেকে? আমি তো আর বিয়েই করি নি।”
অশ্রুজলে বোনা বিয়ে সিজন ৩ পর্ব ৪২
আরুশি বড় একটা ঝটকা খায়। রাজীব বলে ওঠে,”তাহলে তোমার কোলে যে মেয়েটা ছিল সে কে?”
এমন সময় সেখানে আমান আমিনাকে কোলে নিয়ে উপস্থিত হয়ে বলে,”ও হলো আমিনা। আমার আর সায়রার মেয়ে! আরহাম ভাইয়া এই ৫ বছর আরু আপাইয়ের শোকেই কাটিয়ে দিয়েছে। সে আর বিয়ে করে নি।”
সত্যের মুখোমুখি হয়ে আরুশি নিজেকে সামলাতে পারে না। জাঈদকে কোলে নেয়ে অবস্থাতেই ঢলে পড়ে যেতে নেয়। আরহাম তাকে সামলে নেয়।