প্রণয়ের সন্ধিক্ষণে সিজন ২ পর্ব ৫৯

প্রণয়ের সন্ধিক্ষণে সিজন ২ পর্ব ৫৯
আদ্রিতা নিশি

“বিরোধী দলীয় বয়ঃজ্যোষ্ঠ নেতা নয়ন তালুকদার কে.ফাউন্ডেশন ট্রাজেডি মামলায় গ্রেফতার হয়েছেন।”
সকাল দশটা। প্রতিটি টেলিভিশন চ্যানেল, সংবাদপত্র ও অনলাইন মিডিয়া ঝড় বইয়ে দিয়েছে একটিমাত্র খবর ঘিরে।নিউজ রুম থেকে রিপোর্টারদের উত্তেজনাপূর্ণ গলায় বারবার ভেসে আসছে “নয়ন তালুকদার গ্রেফতার”।সোশাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মগুলোতেও মুহূর্তেই ছড়িয়ে পড়ে খবরটি।গতরাত তিনটায় নিজ বাড়ি থেকে গ্রেফতার করা হয়েছে দেশের প্রভাবশালী বিরোধী দলীয় রাজনৈতিক নেতা নয়ন তালুকদারকে।নীরব রাত্রির নিস্তব্ধতা ভেঙে রাতের আঁধারে হঠাৎ ছুটে আসা পুলিশের গাড়ি।সেই সঙ্গে সাংবাদিকদের ক্যামেরার ও জনমানসের কারণে ছিন্নভিন্ন হয় শূন্য রাতের ঘুম।সকাল হতে না হতেই একে একে বেরিয়ে আসছে চাঞ্চল্যকর সব তথ্য।প্রাথমিক তদন্তে দেখা গেছে, বহু আলোচিত “কে.ফাউন্ডেশন ট্র্যাজেডি”-তে সরাসরি জড়িত নয়ন তালুকদার।পুলিশ এখন পর্যন্ত তার সঙ্গে জড়িত আরও দশজনকে গ্রেফতার করেছে।তন্মধ্যে পাঁচজন নয়নের রাজনৈতিক দলের শীর্ষস্থানীয় নেতা।এ খবর যেন কেঁচো খুঁড়তে সাপ বেরিয়ে আসার বাস্তব উদাহরণ।তদন্তের গতি প্রতিনিয়তই নাটকীয় মোড় নিচ্ছে।পুলিশ বলছে, আরও অনেক তথ্য এখনো অজানা।তদন্ত চলছে পুরোদমে।সেইসাথে জনমানসে উঠছে একটাই প্রশ্ন,ক্ষমতার আড়ালে আর কী কী অন্ধকার গোপন আছে?

রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগার।গা ছমছমে পরিবেশ ও কংক্রিটের দেয়ালে বেষ্টিত কারাগারের সেল। চারদিকে ধূসরতা, স্যাঁতসেঁতে ঘ্রাণ আর অদ্ভুত শ্রান্তি মিশে আছে কারাগারের বাতাসে। এই নিঃশ্বাস-রুদ্ধ পরিবেশে পঞ্চম সেলের এক কোণে চুপচাপ বসে আছে এক সময়ের দাপুটে নেতা নয়ন তালুকদার।হাঁটুতে মুখ গুঁজে রাখা তার দেহভঙ্গি। ভাবমূর্তি ও মনোভাব তেমন বোঝার উপায় নেই। ষাটোর্ধ বয়সী গৌরবর্ণের সেই স্বাস্থ্যবান শরীর এখন কৃশ, কুঁচকে যাওয়া চামড়া তার দুর্দশার দলিল।পরনের সাদা পাঞ্জাবিটা কুঁচকে আছে। ধুলো ময়লায় জড়িয়ে গেছে পরনের কাপড়টি।চোখে মুখে বয়স ও ক্লান্তির ছাপ। চক্ষুদ্বয় লাল টকটকে বর্ণ ধারণ করেছে নির্ঘুম রাত কাটানোর কারনে।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

রাতের আঁধারে আকস্মিক পুলিশ হানায় যখন ঘুম ভেঙেছিল তার তখন পালানোর মরিয়া চেষ্টায় গোপন দরজার পথ ধরেছিলেন তিনি।তবু মোটা দেহ আর বয়সের ভার সহায় হয়নি।দৌঁড়াতে গিয়ে পায়ের সাথে পা বেঁধে প্রান্তে হোঁচট খেয়ে পড়ে যান।কোমরে তীব্র ব্যথা পেয়েছিলেন। এখনো সে যন্ত্রণা বয়ে বেড়াচ্ছেন। মূলত সেই কারণে পুলিশের হাতে অপমানজনকভাবে ধরা পড়েন তিনি।তারপর জনসম্মুখে টেনে-হিঁচড়ে আনা হয় রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারে।তার নাম, তার ক্ষমতা, তার দম্ভ সব আজ এখানে নিরর্থক হয়েছে।এককালের গর্জন এখন নিঃশব্দ দীর্ঘশ্বাসে পরিণত।কঠোর গারদের লোহার সেলে বন্দী হয়ে একান্তে বসে তিনি হয়তো ভাবছেন, ক্ষমতার চূড়ায় বসেও অন্ধকার গর্তে পড়ে যেতে সময় লাগে না।
ভাবনার মাঝে এক পুলিশ কর্মকর্তা নিষ্ঠুর নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে খাবারের প্লেটটা সেলের ফাঁক দিয়ে ঠেলে দিয়ে কটু স্বরে বলে উঠলেন,

“খাবার দিয়ে গেলাম, খেয়ে নিস।”
কথাটা বলে পুলিশ কর্মকর্তা সেখান থেকে প্রস্থান করলেন।নয়ন তালুকদারের কর্ণকুহরে প্রবেশ করে কটু স্বর। তিনি মাথা উঁচিয়ে তাকায়। লোহা ঘেরা ওই সঙ্কুচিত জায়গার মধ্যেই তার দৃষ্টি স্থির হয় খাবারের প্লেটটায়। স্টিলের প্লেটে সকালে নাস্তা স্বরুপ দুটি শুকনো রুটি আর এক টুকরো গুড় দেখতে পায়। তার মনে ডেকে বলে,ক্ষমতার সেই রাজসিক প্রভু এখন বন্দী আর তার আহার যেন দয়ার দান।তার চক্ষুদ্বয় ক্রোধে জ্বলে ওঠে। মুহুর্তেই রক্তাভ বর্ণ ধারণ করে।রাগ, অপমান আর অপার হিংসায় পশু সত্তা দগ্ধ হয়। মুহুর্তে গর্জে উঠে চিৎকার করে;
“আমারে তোরা ফকির ভেবেছিস? এইটা খাবার? এই রুটি গুড় দিয়া দয়া করছিস তোরা? তোদের খাবারে থুথু মা*রি।”

সেলের অন্ধকারে, জীর্ণ দেয়ালে ধাক্কা খেয়ে ফিরে আসে নয়নের রাগত চিৎকার। ঠিক তখনই পাশের কোণ থেকে ভেসে এলো কড়া হাসির প্রতিধ্বনি। আরেকজন কয়েদি বসে আছে সেই সেলে। সেই কয়েদি ওষ্ঠকোণে বাঁকা হাসি টেনে বলল,
“ওই বেশী গলাবাজি করিস না রে। গলাবাজি করলে খেতে পাবি না, বুঝলি? ভদ্র মানুষের মতো খেয়ে নে।”
নয়ন তালুকদার ফুঁসে উঠল। জলন্ত চাহনিতে তাকাল লোকটির দিকে তাকিয়ে তর্জনী আঙ্গুল উঁচিয়ে হিসহিসিয়ে বলল ;
“চুপ কর তুই। মেজাজ বিগড়ে দিস না।”
লোকটি অদ্ভুত হেসে বলল;
“আমিও তোর মতো জমিদার ছিলাম। প্রথম জেলে এসে তোর মতো ভাব নিতাম। তারপর পুলিশের সাথে বেয়াদবি করেছিলাম। ব্যস, তিনদিন খাবার দেয়নি আমায়।”

সেলের কাঁচা মেঝেতে বসে নয়ন তালুকদার একটানা শ্বাস নিলেন। বক্ষের ভেতর জমে থাকা ক্রোধ দহন হয়ে উঠছে। কিন্তু মুখে কোনো শব্দ অপচয় করা বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই।তিনি জানেন এই পতনের শুরুটা সারহানের হাতে।সে-ই কৌশলে তাকে ফাঁসিয়েছে, ঠেলে দিয়েছে গারদের ভেতর।”কে. ফাউন্ডেশন” ট্রাজেডির ফাঁদ নয়ন নিজেই পেতেছিলেন সারহানের জন্য, কিন্তু তা নিজের গলায় দড়ি হয়ে ফিরেছে।এখনো তদন্ত চলছে কিন্তু তাজিয়া আত্মহত্যা কেসটা যদি খুলে যায় তবে আরও কিছু কালো অধ্যায় সকলের সামনে উন্মোচিত হয়ে আসবে।তবুও নয়ন তালুকদার হেরে যাবার মানুষ নন।রাজনীতির এ অন্ধকার খেলা তিনি রক্ত দিয়ে শিখেছেন,শক্তি দিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন,এমন হঠাৎ পতনে চুপচাপ মেনে নেওয়া তার ধাতে নেই।তিনি জানেন, আপাতত বন্দী, কিন্তু এই গারদই শেষ না।তিনি বের হবেন,এ গারদের দেওয়াল চিরদিন তাকে আটকে রাখতে পারবে না।তার ঘৃণা, তার প্রতিশোধ, তার শাসন সবকিছু সে ফিরিয়ে আনবে দ্বিগুণ মাত্রায়।ভেতরে ভেতরে সেই অগ্নিস্নান উপভোগ করতে করতে নয়ন তালুকদার ওষ্ঠ কোণে টেনে আনলেন ভয়াবহ পৈশাচিক হাসির রেখা।সারহান ইদায়াত চৌধুরীর রাজপথে এখনো অনেক কাঁটা বাকি আছে।আর সেসব কাঁটার ধার নতুন করে শান দিচ্ছেন নয়ন তালুকদার। তার মুখাবয়বে স্পষ্ট হিংস্রতার ছাপ ফুটে উঠেছে। হঠাৎ অশ্রাব্য গালিগালাজ করে বলে উঠে;

“আমাকে জেলে পাঠিয়ে মোটেও ঠিক করিসনি সারহান! তুই কি ভেবেছিস, আমাকে বন্দী করে রেখে পরিবারের সাথে সুখে শান্তিতে থাকবি। আমি বেঁচে থাকতে তা কখনো হতে দেবো না।”
নয়ন তালুকদার থেমে উদভ্রান্তের ন্যায় হাসলেন। চুলহীন টাকলা মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়ালে হেলান দিয়ে বসলেন। চক্ষুদ্বয় বন্ধ করে তেজ নিয়ে আওড়ালেন;
“আগামীকাল শুক্রবার। তোর জীবনের নতুন অধ্যায়ের সূচনা হবে। সেই সাথে সূচনা হবে তোর জীবনের সবচেয়ে দীর্ঘ কালো অধ্যায়ের।”
নয়ন তালুকদার চক্ষুদ্বয় খুলে ফেলে। দাঁত বের করে বিদঘুটে হাসে। হাসি বজায় রেখে পুনরায় আওড়ায়;
“দুই বছর দশ মাস।তোর জীবনটাকে যে পিশাচের মতো চিবিয়ে গিলে ফেলেছিল।সে আবার আসছে, সারহান!পুনর্জন্ম নিচ্ছে সেই বিষ, সেই আগুন।যা তোর শিরায় শিরায় জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ফেলবে।শুক্রবার তোর জীবনের সূচনা নয়,শুক্রবার আসছে তোর ধ্বংসের দিন হয়ে। এবার কীভাবে বাঁচবি তুই আর কিভাবে বাঁচাবি তোর ফাইরুজকে? টিক টক টিক টক, সে আসছে।”
কথাটি বলে উচ্চস্বরে হাসতে লাগল। সেলে থাকা মানুষটি অবাক হয়ে শুনলো শুধু।

সকাল দশটা বিশ মিনিট। অরিত্রিকা নিঃশব্দে ধীর পায়ে নামছে সিঁড়ি বেয়ে। চনমনে ভঙ্গিমায় আশেপাশেসহ লিভিংরুমে নজর বুলাতে লাগল। দেখতে পেল কয়েকজন সার্জেন্ট ছাড়া আর কেউ নেই। সে হাঁপ ছেড়ে বাঁচল। চোরের ন্যায় চুপিচুপি না নেমে স্বাভাবিক ভাবে নেমে এলো। অতঃপর আয়েশ করে ঠাস করে বসল সোফায়। বসার সাথে সাথে কোথা থেকে দৌড়ে এলো লেভি। সরাসরি লাফিয়ে উঠে বসল অরিত্রিকার কোলে। অরিত্রিকা প্রথমে ভয় পেলেও লেভিকে দেখে ভয় পালিয়ে যায়। সে একহাতে লেভিকে আগলে নিয়ে হাতে থাকা ফোন দ্বারা টপাটপ কয়েকটা অদ্ভুত ভঙ্গিমায় সেলফি তুলে দুজনের। অতঃপর ফেসবুকে ঢুকে পছন্দসই দুইটা ছবি স্টোরি দেয়।
“সাদাত আজকে তুই আমার সাথে পার্টি অফিসে যাবি।”
“ভাই আমি না গেলে হয় না? আসলে শপিংয়ে যেতে হবে মায়ের সাথে।”

অরিত্রিকার চোখ আড়চোখে সিঁড়ির দিকে তাকাল।সে দেখতে পেলো সারহান আর সাদাত হিরোর মতো সাজসজ্জায় নেমে আসছে। শ্যামমানবের সেই চমকানো ভঙ্গিমা দেখে তার হৃদয়ে এক মিশ্র অনুভূতি জেগে উঠল। লজ্জা, অভিমান আর খানিকটা দ্বিধার জন্ম নিলো ততক্ষণে সে দৃষ্টি দ্রুত ফিরিয়ে নিল যে দেখেও দেখলো না এমন ভাব।তার চক্ষুপটে ভেসে উঠল গতকাল রাতের দৃশ্যটি।সারহান ভাই কীভাবে সবাইকে ছাপিয়ে নিঃশব্দে তার হাত ধরে চু*মু দিয়েছিল। সেই মুহূর্তের কথা ভাবতেই গাল দুটো গরম হয়ে গেল। এখনো তার বক্ষস্থল অদ্ভুতভাবে ভারী হয়ে উঠল। লজ্জায় নেতিয়ে পড়ল সে। মানুষটা কিভাবে পাড়লো নির্লজ্জের মতো সবার সামনে ওমন কান্ড ঘটাতে? একটুও লজ্জা করেনি? গত রাতের সেই কান্ড নিয়ে সাদাত, ইশরা, অরিন, আর আবির ভাইয়া তো তাকে ছুড়ে ছুড়ে খুঁচিয়ে বসেছিল। হাসি-মজা আর খোঁচায় যেন তার লজ্জার আড়ালে থাকা অনুভূতিগুলো আরও গভীর হচ্ছিল। অবশেষে সে না পেরে ছাদ থেকে দৌড়ে এসে নিজের রুমের দরজা বন্ধ করে নিয়েছিল। নিজের হৃদয়ের শব্দগুলো লুকিয়ে রেখেছিলো সবার থেকে।আর আজ? সারহান ভাই নির্বিকারভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছে যেন কিছুই হয়নি। অথচ অরিত্রিকা তার লজ্জার ভার নিয়ে নিঃশব্দে চুপচাপ বাড়ির সবার থেকে নিজেকে লুকিয়ে রাখছে। তার মন তো লজ্জা আর দ্বিধার গহীন নীরবতায় অন্তর ভাসমান অবস্থায় আছে।

“ভাবী কি করছেন?”
অরিত্রিকার ভাবনার ছেদ ঘটে আচমকা ডাকায়। ভাবী সম্বোধন শুনে হতবাক হয়ে সামনে তাকায়। সাদাত সোফায় বসে মিটিমিটি হাসছে। তার পাশেই বসে আছে সারহান। সে দৃষ্টিনত করে। বুঝতে পারে সাদাত তাকে লজ্জায় ফেলার জন্য পায়তারা করছে। সে মনে মনে পণ করে এ মুহুর্তে একটা কথাও বলবে না। কথা বললেই সর্বনাশ। সাদাত সারহানের দিকে তাকাল৷ ভাইয়ের ভাবভঙ্গি ওষ্ঠ প্রসারিত করে হাসল। অতঃপর লেভির দিকে তাকিয়ে শয়তানি করে বলল;
“আরে ভাবী ভাতিজিকে আমার কোলে দিন। কতোদিন কোলে নেই না?”
সারহান হতভম্ব চাহনিতে তাকাল ছোট ভাইয়ের দিকে। বিস্মিত কন্ঠে বলল;
“ভাতিজি?”
সাদাত শব্দ করে হেসে লেভিকে দেখিয়ে বলল;
“ওই যে আমার ভাতিজি আর তোমার মেয়ে।”
সারহান রুদ্ধ স্বরে বলল;

“একদম বাজে কথা বলবি না। আমি বিড়ালের বাবা কেন হতে যাব?”
“তাহলে কি সারাজীবন লেভির মামু হয়ে থাকতে চাও।”
“বাবা,মামু এসব বলা বন্ধ কর নয়তো গতকাল আমাদের কাউকে না বলে ইশরাকে নিয়ে ঘুরতে গিয়েছিলি সেই পানিশমেন্ট হিসেবে একমাস বাইক ছাড়া কলেজে যাওয়ার ব্যবস্থা করবো।”
“ভাই তুমি আমায় ব্ল্যাকমেইল করছো?”
“তুই এটারই যোগ্য।”
সারহান ফিচেল হেসে বলল। সাদাত মুখ গোমড়া করল। কোথাও গিয়ে শান্তি নেই। ভাই নামক সিসি ক্যামেরা সব জায়গায় নজর রাখে। যদি সুযোগ পেতো তাহলে বোধ হয় ওয়াশরুমে ও নজর রাখা বাদ যেত না। সারহান ঘাড় ঘুরিয়ে সরাসরি দৃষ্টি স্থির করল সামনে বসা মানবীর দিকে। পরনে বাহিরে যাওয়ার ড্রেস দেখে কপাল কুঁচকালো। ভরাট কন্ঠে জিজ্ঞেস করল;
“কোথায় যাবি?”
অরিত্রিকা এতোক্ষণ চুপচাপ দুই ভাইয়ের কথোপকথন শুনছিল। আচামকা প্রশ্নের তীর তার দিকে ঘুরতেই চমকে গেল। ভয়ার্ত নেত্রপল্লব ঝাপটে তাকাল সামনে বসে থাকা গম্ভীর মানুষটার দিকে। ক্ষীণ কন্ঠে জবাব দিলো;

“আম্মুর সাথে শপিং করতে যাব।”
সারহান পুনরায় জিজ্ঞেস করল;
“আর কে যাবে?”
অরিত্রিকা স্বাভাবিক ভাবে জবাব দিলো;
“অরিন আপু, ইশরা, বড় মা আর সাদাত।”
সাদাত কথার মাঝে বাঁধ সাধলো। মুখ ভার করে বলল;
“আমি তোদের সাথে যেতে পারব না। ভাইয়ের সাথে পার্টি অফিসে যেতে হবে।”
অরিত্রিকার মন খারাপ হলো। মুখ বেজার করে বলল;
“তাহলে আমাদের সাথে কে যাবে? ইরফান ভাইকে নিয়ে যাব?”
সারহান কিছুক্ষণ মৌন থেকে গম্ভীর কন্ঠে বলল;
“ইরফান অফিসে গেছে। সাদাত তোর পার্টি অফিসে যাওয়ার দরকার নেই। তুই ফাইরুজের সাথে যা আর তোদের সেফটির জন্য দুজন গার্ডকে নিয়ে যাস।”
সাদাত মনে মনে খুশী হলো। পার্টি অফিসে যাওয়া মানে জীবন তেজপাতা হয়ে যাওয়া। ওখানে যাওয়ার থেকে শপিংমলে যাওয়া ঢের ভালো। সে মনের গহীনে চলমান ভাব খানা বুঝতে দিলো না। সিরিয়াস ভঙ্গিমায় বলল;
“ঠিক আছে ভাই।”

সারহানের ফোনে কল আসলো। সে পকেট থেকে ফোন বের করে দেখল ইনান কল দিয়েছে। সে সময় ব্যয় না করে কল রিসিভ করে কথা বলতে লাগল। অরিত্রিকা এই ফাঁকে পূর্ণ চাহনিতে তাকাল সারহানের দিকে। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগল মানবটিকে। পরণে শুভ্র রঙা শার্ট দেখে যেন পুনরায় প্রেমে পড়ল। বলা বাহুল্য, শুভ্র শার্ট তার অধিক পছন্দের। শুভ্র শার্ট কেন পছন্দ এটার পেছনেও কারণ আছে। যখন সে ইন্টার সেকেন্ড ইয়ারের ছাত্রী তখন থেকে উপন্যাসের বই টুকটাক পড়া হয়। উপন্যাসের চরিত্রগুলো তার ভীষণ প্রিয়। সেই সাথে পুরুষ প্রধান চরিত্রগুলোর যখন শুভ্র শার্ট পড়ার বর্ণনা থাকতো তখন যেন নিজের কল্পনায় ডুবে যেত। শুভ্র শার্ট ও শুভ্র নাম ভীষণ পছন্দ তার। উপন্যাস পড়তে গিয়ে শ্যামমানবের প্রতি এক প্রকার আসক্তি এসে গিয়েছিল। কল্পনা করতো কোনো এক অস্তিত্বহীন শ্যামমানবের। তবে বাস্তবেও যে শ্যামমানব তার জীবনে জড়িয়ে যাবে তা কে জানতো? অরিত্রিকা হাসল। লেভিকে দুহাতে উঁচিয়ে পরপর তিন চারটা চু*মু খেল। তারপর ছেড়ে দিলো।

লেভি ছাড়া পেয়ে দৌড়ে গেল সাদাতের পায়ের কাছে। ম্যাও ম্যাও করতেই সাদাত সোফা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে লেভিকে কোলে নিলো। অতঃপর সাদা লোমশ তুলতুলে প্রাণীটির শরীরে আদুরে হাত বুলিয়ে বলল;
“লেভি আজকের দিনটাই সারহান ভাইকে মামু বলে ডেকে নে। কারণ আগামীকাল তোর বড় মামু তোর বাবা হয়ে যাবে।”
সারহান ইনানের সাথে কথা বলে কল কাটতেই সাদাতের কথা শুনতে পেলো। সে সূচালো দৃষ্টিতে তাকাল ছোট ভাইয়ের দিকে। চাপা স্বরে ধমকে উঠল;
“সাদাত।”
সাদাত ছিটকে সরে গেল সেখান থেকে। আমতা আমতা করে বলল;
“ভাই, আমি তো মজা করছি। তুমি রেগে যাচ্ছো কেন? জানোনা, বিয়ের বরকে মেজাজ গরম করতে নেই।”
সারহান ক্রোধমিশ্রিত কন্ঠে বলল;

“আমার চোখের সামনে থেকে এখুনি সর।”
“আচ্ছা চলে যাচ্ছি। তুমি আর অরিত্রিকা বসে বসে প্রেম করো। বাই।”
কথাটা বলেই সাদাত হেলেদুলে লেভিকে নিয়ে চলে গেল। সারহান বিরক্ত হলো। সে সিঁড়ির দিক থেকে দৃষ্টি সরিয়ে অরিত্রিকার দিকে তাকাতেই দেখল মেয়েটা লুকিয়ে তার ছবি তুলছে। তার বিরক্তিমাখা মুখ স্বাভাবিক হয়ে এলো। ওষ্ঠকোণে খেলে গেল মৃদু হাসি। অতঃপর হাস্যজ্জ্বল মুখে পোজ দিলো। অরিত্রিকা মনোযোগ সহকারে ছবি তুলতে ব্যস্ত থাকায় তেমন একটা খেয়াল না করে পরপর অনেকগুলো ছবি তুলে ক্ষ্রান্ত হলো। ছবি তোলা শেষ করে সামনে তাকাতেই হচকচিয়ে গেল। হাতে থাকা ফোনটা ঠাস করে পড়ল সোফায়। সারহান ভ্রু নাচিয়ে জিজ্ঞেস করল;

“ছবি কেমন হয়েছে?”
অরিত্রিকা হাসার ভাণ করে তুতলিয়ে বলল;
“কার ছবি?”
“তোর নেতাসাহেবের?”
“নেতাসাহেবটা আবার কে?”
অরিত্রিকা না বোঝার ভাণ করল। সারহান উঠে দাঁড়াল। শাণিত পায়ে এগিয়ে গিয়ে অরিত্রিকার পাশে বসল। খানিকটা ঝুঁকে গিয়ে ফিসফিসিয়ে বলল ;
“নেতাসাহেব কে চিনতে পেরেছিস নাকি আরও গভীর ভাবে চিনিয়ে দেবো?”
অরিত্রিকা ধরফরিয়ে উঠল। সারহানের কাছ থেকে ছিটকে সরে যেতে চাইল। কিন্তু সারহান বাঁধ সাধলো। অরিত্রিকার এক হাত ধরে নিজের সন্নিকটে আনল। পুরুষালী উত্তপ্ত শ্বাস ছুঁয়ে যেতে লাগল মেয়েলী মুখাবয়ব। অরিত্রিকা কাঁপতে লাগল। অজানা অনুভূতিতে বক্ষস্থল অশান্ত হয়ে উঠল। সারহানের প্রগাঢ় চাহনি নিবদ্ধ মেয়েলী মুখশ্রীতে। কিছুটা দিগবিদিকশূন্য তার মস্তিষ্ক। সে নিজেকে সামলে নেয়। মেয়েলী তিরতির করে গোলাপী ওষ্ঠযুগল বৃদ্ধা আঙুল দ্বারা ছুঁইয়ে দেয়। মাদকতা মিশ্রিত কন্ঠে বলে;

“ সিক্রেট অ্যামব্রোজিয়া!ক্ষণে ক্ষণে লজ্জা পেয়ে পালাতে চাস কেন?”
অরিত্রিকা লজ্জা পেল। খানিকটা অপ্রস্তুত হলো। কম্পনরত কন্ঠে বলল;
“এমনি।”
সারহান স্নিগ্ধ হাসল;
“জানিস,তুই লজ্জাবতী লতার মতো। সামান্য ছুঁইয়ে দিলে নুয়ে পড়িস।”
অরিত্রিকা বিস্মিত চাহনিতে তাকাল। সারহান সেই চাহনি পরখ করে কেমন যেন উদাসীন ভঙ্গিতে বলল;
“লাজুকলতা তুই আমার হলেও ছুঁয়ে দেওয়ার সাধ্য নেই।জানিনা কবে তুই পরিপূর্ণ রুপে আমার হবি।”
অরিত্রিকা এহেন কথায় অবাক হলো। অবাকতার রেষ নিয়ে বলল ;
“এসব কথা বলছেন কেন?”
সারহান অরিত্রিকার হাত ছেড়ে দিয়ে একটু দূরে গিয়ে বসল। স্বভাবসুলভ বলল;

প্রণয়ের সন্ধিক্ষণে সিজন ২ পর্ব ৫৮

“তোর বাপের কারণে?”
“আব্বু? আব্বু কি করেছে?”
“তোর বাপ বলেছে আকদ হলেও তুই আর আমি আলাদা থাকব। মানে বিবাহিত সিঙ্গেল হয়ে থাকতে হবে। যতদিন রিসেপশন না হয় ততদিন তোর কাছে যাওয়া যাবে না আমার।”
“এসব কে বলেছে?”
“তোর বাপ।”

প্রণয়ের সন্ধিক্ষণে সিজন ২ পর্ব ৬০