আপনাতেই আমি সিজন ২ পর্ব ৪২

আপনাতেই আমি সিজন ২ পর্ব ৪২
ইশিকা ইসলাম ইশা

আজ দিয়ে প্রায় সপ্তাহ খানেক হলো এই টরেন্টো শহরে আসা।১সপ্তাহের এই ৭ দিনে কারো সাথেই তেমন কোন কথা বলেনি তীব্র।মুখ গম্ভীর করেই রেখেছে সবসময়। আর মেজাজ সে তো বলার বাইরে।
আজ ছুটির দিন হওয়াই সবাই আজ বাড়িতে।সবাই বলতে তীর,লাবিব আর তীব্র। তীব্র সকাল থেকেই রুমে বসে ল্যাপটপে কাজে ব্যাস্ত।লাবিব হলরুমে বসে ল্যাপটপে মুভি দেখছে।তীরের সকাল থেকেই কোন খোঁজ নেই।সে লাপাত্তা। যদিও তীরকে নিয়ে তেমন কোন ভাবাবেগ নেই কারোই।কারন তীর ফ্লার্টিং মাস্টার নিশ্চিত কারো না কারো সাথে ঘুরে বেড়াচ্ছে।সময় হলে ঠিকিই চলে আসবে।

লাবিব রাতের জন্য রান্না করছে।টুকটাক রান্না সে পারে যদিও তীব্রর মতো পারে না। তবে নিজের জন্য আরকি যতটুকু দরকার। তীব্র সে তো নিজের জন্য নিজের মতোই বানিয়ে খাই। তাছাড়া তীব্রর গম্ভীরতা আর রাগ এখানে এসে যেন শতাধিক বেড়েছে।তাই আপাতত বসকে রাগানোর মতো একটা শব্দ ও উচ্চারণ করতে ভয় পায় সে।ইভেন উপর তলায় যাওয়ার খুব প্রয়োজন না হলে যাওয়া হয় না আজকাল।
লাবিবের রান্নার মাঝেই কলিং বেল বেজে ওঠে।লাবির তখন স্যালাড কাটছিল।তীর এসেছে ভেবে দীর্ঘশ্বাস ফেলে দরজা খুলতে খুলতে বলল,
তীর ভাই কোথায় হাওয়া হয়ে গেছিলেন সেই সকাল থেকে কোন খোঁজ নেই আপনার।বস সকাল থেকে এখনও নিচে নামেনি। শুধু এককাপ কফি খেয়েছে আর……………..
আআআআআপপনি!!!
তীর লাবিব কে এইভাবে শকড্ রুপে দেখে একরাশ বিরক্তি নিয়ে বললো,
সাইড দে ভাই।ভেতরে আইতে দে……
লাবিব হচকচিয়ে ঝটপট সরে দাঁড়াল।তার বিষ্ময় এখনো কাটেনি।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

চারবার।গুনে গুনে চারবার ডাকার পরেও তীর বা লাবিবের আসার নামগন্ধ না পেয়ে তীব্রর বিগরানো মেজাজ আরো বিগরালো।মাথা দপদপ করছে ব্যাথায়।টানা কয়েকদিন নির্ঘুম থাকায় মাথা দপদপ করছে। তীব্র রাগে গজগজ করতে করতে আবারো বলল,
এই লাবিব!!কোথায় মরছিস তোরা?সালা আমি যদি রুম থেকে বের হয় আজ তোদের কে এখানেই পুতবো!
পঞ্চম বার ডাকার পর তীব্র ক্ষিপ্ত হয়ে রুম থেকে বের হয়ে নিচে এসে দেখে চারদিকে অন্ধকার।রাগে গজগজ করতে করতে কিছু বলতে গিয়েও থেমে যায়। অন্ধকারে একটা ছায়ামূর্তি এগিয়ে আসতে দেখে তীব্র থম মেরে দাড়াই। অন্ধকারও সে ছায়ামূর্তি চিনতে একটস। আচমকাই হলুদ রঙের আলো জ্বলে উঠে।সেই ক্ষীণ আলোয় ভেসে উঠল স্বর্ণালী মায়াবী মুখখানা।যেই মায়াবী মুখানায় তীব্রর দুনিয়া থমকে যায়।তীব্রর সমস্ত সত্তা হারিয়ে যায়।সেই তীব্র হারিয়ে গিয়ে নতুন তীব্র হয়ে ধরা পড়ে।তার মায়াবতী,মায়াবীনি,বৌ,জানবৌ ঠিক তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে।হাতে তার ছোট্ট সাইজের একটা কেক।মুখে লেগে আছে মিষ্টি হাসি।
“শুভ জন্মদিন অপ্রিয় রাক্ষস মশাই”
হ্যাপি বার্থডে দোস্ত…………….

মূহুর্তের মধ্যেই চারদিকে আলো জ্বলে উঠতেই।তীর, লাবিব,মির একসাথে চেঁচিয়ে উঠলো।
তীব্রর সেদিকে কোন ধ্যান নেই।সে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে রিদির দিকে।রিদির পড়নে কালো একটা সালোয়ার কামিজ। লম্বা চুল গুলো একপাশে বেনী করা।মুখে কোন প্রসাধনী নেই শুধু ঐ মিষ্টি হাসি ছাড়া।তাতেই কি অপরুপ লাগছে !ঐ মিষ্টি হাসিই কি যথেষ্ট নয় তীব্রর হাট ব্লক করার জন্য।
রিদি হাতের কেকটা কাটার জন্য তীব্র দিকে বাড়ালো। তীব্র একবার কেক তো একবার রিদিকে দেখে চাকুটা নিজের হাতে নিতেই সবাই হো হো করে উঠল।
তীব্র চাকু নিয়ে কেক কাটার বদলে কেকটাকে উল্টে নিচে ফেলে দিল।সবাই আশ্চর্য হয়ে তাকালো তীব্রর দিকে।তীর সাথে সাথেই বলল,

এটা কি করলি তীব্র!!রিদিতা কতো কষ্ট করে তোর জন্য বানালো আর তুই…..
তীরের কথা শেষ হওয়ার আগেই তীব্র রিদিতার দিকে তাকিয়ে বলল,
গেট আউট!!
রিদি তীব্রর কথায় ছলছল চোখে তাকিয়ে বলল,
সরি ত……..
আই সেইড গেট আউট…….
তীব্রর হুংকারে রিদি কেঁপে উঠলো। কাঁপা কাঁপা গলায় বলল,
আমাকে মাফ………….
আই সেইড গেট আউট ওফ মাই হাউস…….
দেখ তীব্র রিদি ছোট মানুষ ভুল করেছে মাফ…..
মিরের কথায় তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করে বলল,

ছোট!ছোট মাই ফুট!ওর স্বামীর থেকে বেশি বাপ ইম্পর্ট্যান্ট তো যা বাপের কাছে যা।বের হ আমার বাড়ি থেকে……
তীব্রর হুংকারে রিদি আবারো কেঁপে উঠলেও এবার সাহস করে ঝট করেই জরিয়ে ধরলো তীব্র কে। তীব্র মূহুর্তের মধ্যেই থ হয়ে দাঁড়ালো।রিদি তীব্রর বুকে মুখ গুজে ফুঁপিয়ে উঠল। বিরবির করে কিছু বলাই রিদির ঠোট তীব্রর বুকে বার বার ছোঁয়া লাগাই তীব্র ফুস করে একটা নিঃশ্বাস ছাড়লো।রিদিকে ছাড়াতে চাইলে রিদি আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলল,
প্লিজ প্লিজ এবার আমাকে মাফ করে দেন প্লিজ!!আর হবে না এমন!আর কখনো আমি আপনার অবাধ্য হব না।সরি তো! এত্তগুলা সরি!!
তীব্র জোড় করে রিদিকে নিজের থেকে ছাড়িয়ে মিরের উদ্দেশ্য বলল,
একে বাংলাদেশে দিয়ে আয়।নয়তো সেখানে ইচ্ছে সেখানে যাক।এটাকে যেন আমার বাড়িতে না দেখি নয়তো তোদের জন্য ভালো হবে না….
কথাটা বলেই তীব্র হনহন করে রুমে চলে গেল। তীব্র যেতেই মির ক্ষিপ্ত মেজাজে বলল,
দেখলি!দেখলি!সালা বেদদপ…..

তীর নিজেও কিছুটা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বলল,
এটা কি হলো!!কোই ভাবলাম তীব্র সালা খুশি হয়ে দুচারটে গাড়ি গিফট করবে!ধুর……
ভাবি আপনি একদম চিন্তা করেন না।বিদেশে দুচারটা বাড়ি আছে তাই বলে নিজের মাথা কিনে নিয়েছে।সেই ওর ঐ মাথা তো আল্লাহই দিয়েছে!হু……
এই চল এখানে থাকবো না।এরপর এই শালা ডাকলেও আর আসবো না।
মির বিরক্ত হয়ে বলল,
রিদি কে কোথায় রাখব??এখান থেকে শহর অনেক দূর!তাছাড়া……..
রিদি মলিন মুখে মিরের কথার বিপরীতে বলল,
সরি ভাইয়া!আপনাদের আমার জন্য অনেক ঝামেলা পোহাতে হচ্ছে।আমি…..
তীর সাথে সাথেই বলে,
কি যে বলেন না পিচ্চি ভাবি!এই সালাকে তো সকালে দেখব!আর আপনি একদম চিন্তা নট থাকেন।আমরা এই বাসায় না কিন্তু পাশের বাসায় থাকবো। চলুন চলুন….
মির কিছুটা বিরক্ত হয়ে বলল,
মানে?
মানে গিয়েই বুঝাব আয়। আসুন পিচ্চি ভাবি।
রিদি দীর্ঘশ্বাস ফেলে উপরের দিকে একবার তাকিয়ে তীরের পিছু পিছু গেল।এদিকে লাবিব হতাশ হয়ে ওদের যাওয়া দেখল।বসের যা মেজাজ আজকাল আবার রিদি এখানে থাকলে কি কান্ড বাধাবে বলা মুশকিল।

তীব্রর পাশের বাসায় থাকা একজন মহিলা।বয়স ৩০ হলেও বোঝা মুশকিল গুনে গুনে দশ বছর কমানো যাবে এমন সুন্দর। তীর কানাডিয়ান ভাষায় মেয়েটার সাথে কথা বলছে।মেয়েটা একবার রিদি কে দেখছে তো আবার বেশ উৎসুক হয়ে কথা বলছে তিরের সাথে। তীর আলুথালু কি বলল জানা নেই।তবে মেয়েটি মিষ্টি হেসে এগিয়ে এলো রিদির দিকে।রিদির হাত ধরে মিহি কন্ঠে বলল,
কাম!কাম ডিয়ার…ইউ আর ভেরি প্রিটি গাল।এন্ড ইউর হেয়ার মাই গড সো লং!আই লাইক ইট!
রিদি হচকচিয়ে মেয়েটির ইংরেজি কথার বিপরিতে মুচকি হাসল। মেয়েটি যথেষ্ট আন্তরিক।
রিদিকে নিয়ে মেয়েটি ভেতরে যেতেই মির ক্ষিপ্ত সুরে বলল,
বাল বললি এসব!রিদি বুঝতে পারলে কি হতো!!
তীর দাঁত কেলিয়ে বলল,

রিদি বোঝে না কানাডিয়ান ভাষা।তাছাড়া মিথ্যা কি বলেছি!!আমি বলেছি রিদি তীব্রর বোন।রিদি ওর বোনকে খুব ভালোবাসে। তীব্র আজ বাসায় নাই তাই আজকের রাতটা তার কাছে রিদিকে থাকতে দিতে।
তো! মিথ্যা নয় এটা!
দেখ আমি যদি এখন বলতাম মেয়েটাকে রিদিতা তীব্রর বৌ হয় তবে আজ আর এতো আদর করে ওকে নিয়ে যেত না।
কেন?
মিস ওলিভিয়া তীব্র কে পছন্দ করে।তাইতো এখানে শহর থেকে দূরে এইখানে বাড়ি বানিয়েছে। কিন্তু আজ পর্যন্ত তীব্রর পাত্তা পায় নি। বরং ওলিভিয়া কে দেখলে তীব্র বিরক্ত হয়। তীব্র তো গাডদের বলে দিয়েছে ওলিভিয়া যেন সে থাকাকালিন এই বাড়িতে না আসে।মেয়েটা একটু গায়ে পড়া টাইপ।আর তুই তো জানিস ই তীব্রর মেয়েদের স্পর্শে এলার্জি আছে।
মির তপ্ত একটা নিঃশ্বাস ফেলে বললো,
তুই সিউর!রিদি এখানে সেভ থাকবে?
১০০%….
মিস ওলিভিয়া কিন্তু তীব্র আর তীব্রর জিনিস গুলার বেশ যত্ন করে!যেমন ধর তীব্রর গাছপালা ইত্যাদি ইত্যাদি।

কানাডিয়ান সময়ে রাত প্রায় ২ টা।এখানে আসাঘন্টা পার হয়েছে।রিদি বিছানায় শুয়ে এপাশ ওপাশ করছে।ঘুম আসছে না।মূলত নতুন জায়গায় ঘুম আসে না।তারপর আবার অপরিচিত দেশ।রিদি উঠে বেলকনিতে গেল। এখানে থেকে তীব্রর বাসা দেখা গেলেও চারদিকে সবটা নিস্তব্ধ হয়ে আছে।মিস ওলিভিয়ার বাড়ির আগে কয়েকটা বাড়ি আছে।তবে বেশ ছোট। সবচেয়ে বড় তীব্রর বাসা। বিশাল বড় এরিয়া জুড়ে দোতলা বাসা।রিদি এতোক্ষণ পর খেয়াল করল তীব্রর বাসাটা প্রায় কাচের ই তৈরি। চৌধুরী বাড়িতে তীব্র নিবাস ও কাচের তৈরি।লোকটার কাচের তৈরি এমন বাড়ি বেশ পছন্দ হয়তো।রিদি হতাশ হয়ে শুরু থেকে সবটা ভাবল। তীব্র কে বোঝা তার কাছে ভীষণ কঠিন লাগছে। তীব্র নামক এই অধ্যায় টাও বেশ কঠিন তার কাছে। তার কাছে “তার অপ্রিয় রাক্ষস মশাই” মানেই আস্ত একটা রহস্য মানব।একটা নিষ্ঠুর মানব!তবে এই নিষ্ঠুর মানুষটাকেই সে ভীষণ ভাবে ভালোবাসে।
রিদির ভাবনার মাঝেই তীব্র আওয়াজে গেট খুলে যায়।রিদি আওয়াজ শুনে বেলকনি থেকে রুমে আসতেই থমকে যায়। তীব্র রিদিকে এইভাবে দাড়িয়ে থাকতে দেখে কোন কথা ছাড়াই রিদির হাত ধরে টেনে নিয়ে যেতে থাকে।মিস অলিভিয়া বারবার কানাডিয়ান ভাষায় কিছু তো বলছে কিন্তু তীব্র এদিক ওদিক কোনদিক না তাকিয়ে রিদিকে টেনে নিয়ে বাইরে এলো।মিস ওলিভিয়া তীব্র কে আটকাতে তীব্রর হাত ধরতেই সে এক ঝাটকা মেরে হাত সরিয়ে রেগে বলল,

ডোন্ট ইউ ডেয়ার টু টাচ মি!!!
মিস ওলিভিয়া ছিটকে দূরে পড়তেই রিদি চেঁচিয়ে উঠলো,
কি করছেন আপনি? ছাড়ুন আপুর লেগেছে মনে…
তীব্র হুংকার দিয়ে বলল,
চুপ!!
রিদি তীব্রর হুংকার শুনে ভয়ে কেঁপে উঠে বুকে থু থুতু ছিটিয়ে বলল,
এভাবে বাঘের মতো হুংকার দেন কেন?ভ ভয় পায় না!!আমি ছোট মানুষ একটু ধীরে ধীরে কথা বলবেন।বাপরে!! একদিন আমি ধমক শুনেই না এট্যাক ফ্যটাক ক…….

আপনাতেই আমি সিজন ২ পর্ব ৪১

রিদি আরো কিছু বলার আগেই তীব্র রিদিকে কোলে তুলে নিয়ে হাটা দিল নিজের বাড়ির উদ্দেশ্যে।রিদি প্রথমে ভয় পেলেও নিজ থেকেই কিশক্ত করে ধরল তীব্র কে। মুখ উঁচিয়ে একবার ওলিভিয়া কে দেখতে চাইল কিন্তু ততক্ষণে তীব্র বেরিয়ে এসেছে বাড়ি থেকে।রিদি ক্লান্ত ভঙ্গিতে মাথা এলিয়ে দিল তীব্রর বুকে। তীব্র মূহুর্তে মধ্যেই হাটা থামিয়ে কয়েকপলক রিদিকে দেখে আবারও হাটতে শুরু করল।

আপনাতেই আমি সিজন ২ পর্ব ৪৩