হ্যালো 2441139 পর্ব ২৬
রাজিয়া রহমান
বাবা মা’কে ছাড়া পিয়াসার সবকিছু কেমন শূন্য মনে হয়। ঢাকায় এসেছে সপ্তাহ হয়ে গেছে, পিয়াসা এখনো মানিয়ে নিতে পারে নি নিজেকে। রাত হলেই পিয়াসার ভীষণ কান্না পায়।
মা’য়ের আদর,বাবার ভালোবাসা সবকিছুই পিয়াসাকে কষ্ট দেয়।ইচ্ছে করে ছুটে গিয়ে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বাবার গলা।
কিংবা খাওয়ার সময় খুব করে মা’য়ের বকা শুনে।
পিয়াসার এখানে দমবন্ধ লাগে।রজনী আন্টি, সিরাজ আংকেল পিয়াসাকে ভীষণ স্নেহ করেন তবুও বাবা মা’য়ের মতো কি কেউ হৃদয় ছুঁতে পারে?
সন্ধ্যা নামছে চারদিকে। গোধূলির লালচে কমলা আভায় চারদিক কেমন মায়াবী স্বপ্নপূরী মনে হচ্ছে পিয়াসার কাছে।
কোচিং শুরু হয়েছে আজকে দুদিন হলো। পিয়াসা কোচিং এর বই নিয়ে পড়তে বসেছে।পিংকি এলো কিছুক্ষণ বাদে।পিয়াসাকে মন দিয়ে পড়তে দেখে বললো, “এখনই পড়তে বসে গেছিস!চল আমার রুমে,সবাই মিলে লুডু খেলবো।”
পিয়াসার মনোযোগ বইতে নিবদ্ধ। মাথা না তুলেই বললো, “না রে,আমি খেলবো না।আমাকে পড়তে হবে।”
পিংকি বিরক্ত হয়। পিয়াসা যে এতো বইপোকা পিংকি বুঝতে পারে নি। সারাক্ষণ রুমে বন্দী থাকে।বই ছাড়া কখনোই একা থাকতে দেখে নি পিংকি তাকে।হয় একাডেমিক বই না হয় উপন্যাস, যা-ই হোক বই থাকবেই।
পিংকি বের হয়ে গেলো মিনির কাছে।সে,রিংকি,বর্ষা,আর মিনি মিলে খেলবে।
মিনি নখে নেইল পালিশ দিচ্ছে। পিংকি গিয়ে বললো, “লুডু খেলবি মিনি?চল খেললে।”
মিনি নখে নেইল পালিশ লাগাতে লাগাতে বললো, “তোর বান্ধবী কোথায়?সে খেলছে? ”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
“না ও পড়ছে।ও খেলবে না।”
মিনি হেসে বললো, “ও না খেলায় আমাকে ডাকছিস না?এখন আর তো আমাকে তুই পাত্তাই দেস না।”
পিংকি বিরক্ত হয়ে বললো, “দেখ খেললে আয়,নয়তো আমরা তিন জনেই খেলবো।”
মিনি উঠে গেলো লুডু খেলতে।
এক কাপ চা নিয়ে রজনী পিয়াসার কাছে এলো।পিয়াসাকে চা দিয়ে মহুয়া বেগমের জন্য নাশতা বানাতে গেলো।
পিয়াসা চায়ের কাপ সামনে রেখে পড়ছে নির্জন এদিক ওদিক তাকিয়ে পিয়াসার রুমে ঢুকে গেলো।
পিয়াসা নির্জনকে দেখে চমকে এদিক ওদিক তাকায়। এখানে আসার পর থেকে পিয়াসা বুঝে গেছে এই বাড়িতে নার্গিস আন্টি,শিরিন আন্টি আর দাদু কেউ-ই তাকে পছন্দ করে না।
কেউ তাকে মুখ ফুটে কিছু বলে নি যদিও কিন্তু ব্যবহারে, দৃষ্টিভঙ্গিতে অনেক কিছুই প্রকাশ পায়।
এজন্যই পিয়াসা ঠিক করলো পিংকির সাথে ও কম মিশবে এখন থেকে।পিংকি তার সাথে কথা বলতে এলে নার্গিস আন্টি কেমন বাঁকা দৃষ্টিতে তাকায়। এই ছোট্ট ব্যাপারটায় পিয়াসা ভীষণ কষ্ট পায়।
নির্জন ভেতরে এসে চেয়ার টেনে বসলো।তারপর মুচকি হেসে বললো, “কেমন আছো পিয়াসা?”
“জি ভালো। আপনি এখানে এই সময়? ”
নির্জন অস্বস্তিতে পড়ে। পিয়াসা কি সে আসায় বিরক্ত হচ্ছে!
“কোনো সমস্যা পিয়াসা?”
“না সমস্যা না,এখন তো আমার পড়ার সময়। আর আপনি আমার রুমে এলেন এই সময়ে, আপনি তো ব্যস্ত থাকেন। ”
“না না,আমি ব্যস্ত থাকি না।আমি তো আজাইরা মানুষ। ব্যস্ত থাকে আমাদের আষাঢ়। আমি শুধু খাই,দাই,ঘুরি।”
পিয়াসা আর কিছু বললো না। নির্জন উঠে দাঁড়িয়ে বললো, “আচ্ছা কোনো কিছু লাগলে, কোনো প্রব্লেম হলে আমাকে বলিও।”
“জি আচ্ছা। ”
নির্জন চলে গেলো।পিয়াসা হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো যেনো।ওনার মা দেখে ফেললে ভ্রু কুঁচকে তাকাবে পিয়াসার দিকে। পিয়াসার এসব কিছুতেই ভালো লাগে না।
রাতের খাবার ঝুনি খালা নিয়ে এলো।এই একটা মানুষকে দেখলে পিয়াসার মন ভালো হয়ে যায়। ভীষণ মজার একজন মানুষ।
পিয়াসাকে খেতে দিয়ে সবসময় পাশে দাঁড়িয়ে থাকে।পিয়াসা খেতে খেতে বললো, “আপনি কখন খাবেন খালা?”
“আমার খাওনের সময় রাইতের দশটা।সিরিয়াল ছাইড়া আরাম কইরা বইসা খামু।”
পিয়াসার খাওয়ার পর ঝুনি খালা চলে গেলো।
পিয়াসা অনেকক্ষণ ধরে পড়লো রাতে।পড়ার মধ্যে শুনতে পেলো কলিং বেল বাজছে। একবার, দুইবার, তিনবার…
অনেক বার বাজতে লাগলো কলিং বেল।
পিয়াসা অস্বস্তিতে পড়ে। এই সময় আষাঢ় বাসায় ফিরে।প্রতি রাতে রজনী আন্টি জেগে বসে থাকে শুধু মাত্র দরজা খোলার জন্য।
কিন্তু আজকে কেনো জানি আন্টি নেই।অনেকক্ষণ ধরে বেল বাজার পরেও যখন কেউ আসে নি পিয়াসা উঠে যায় দরজা খোলার জন্য।
নিজেকে নিজে সাহস দেয় যে কোনো অসুবিধা হবে না,সে দরজা খুলবে তারপর ফোর জি স্পীডে ছুটে রুমে ঢুকে যাবে।আষাঢ় তার দিকে ভালো করে তাকানোর সুযোগ ও পাবে না তাতে।
যেই ভাবা সেই কাজ।পিয়াসা দুরুদুরু পায়ে এগিয়ে যায়। তারপর দরজা খুলতেই তার কোলে এসে পড়ে একটা ফুলের তোড়া।
ছুটে পালানোর আগে চমকে উঠে পিয়াসা।
আষাঢ় পিয়াসাকে দেখে অবাক হয়।
পিয়াসা দরজা খুলেছে?
পিয়াসাকে উদ্দেশ্য করে বললো, “আজকে কি সূর্য পশ্চিমে উঠেছে না-কি? দরজা তুমি খুললে যে?”
পিয়াসা জবাব না দিয়ে ফুলের তোড়াটা সোফার উপর রেখে ছুটে পালাতে যায়।পিয়াসা পালানোর আগেই আষাঢ় বললো, “আমাকে এক গ্লাস বরফ শীতল পানি খাওয়াও তো পিয়াসা।”
পিয়াসা হতবাক হয়। এই লোকটা কি পাগল না-কি!
কি বলছে তাকে?
পানি চাইছে তার কাছে?
সে এই লোকটার থেকে পালাতে চাইছে।
আষাঢ় সোফায় হেলান দিয়ে বসে বললো, “দাঁড়িয়ে আছো যে?এক গ্লাস পানি চেয়েছি তো আমি।”
পিয়াসা টলমল পায়ে ফ্রিজের দিকে এগিয়ে যায়।পুরো বাড়ির সবাই নিশ্চয় এখন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। অথচ এই মানুষটা এখন ফিরলো ঘরে।
কে জানে কি করে সারাদিন!
নিশ্চয় টোটো কোম্পানির ম্যানেজার এর চাইতে নির্জন ভাই ভালো। অন্তত রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়ায় না।
সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে পিয়াসা পানি এনে দেয়।আষাঢ় ভীষণ সহজ ব্যবহার করছে তার সাথে। হুট করে পিয়াসার মনে হলো, এমন ও তো হতে পারে হয়তো ওনার ওই ব্যাপারটা মনে নেই।অনেক বছর আগের ব্যাপার। পিয়াসার জন্য লজ্জাজনক ছিলো বলে তার মনে আছে,ওনার জন্য তো না।হয়তো উনি সেসব ভুলে গেছেন।
তা না হলে এরকম স্বাভাবিক ভাবে কথা বলতো না তো।
নিজের এলোমেলো ভাবনার মধ্যেই আষাঢ় বললো, “মা বোধহয় ঘুমিয়ে পড়েছে।মায়ের শরীরটা ভালো যাচ্ছে না কয়েকদিন ধরে। তুমি কি আমার খাবারটা গরম করে দিতে পারবে?”
পিয়াসার ভীষণ রাগ হলো।এই লোক কি ভেবেছে? তাকে একটার পর একটা ফরমায়েশ দিয়ে যাচ্ছে।
স্পষ্ট গলায় পিয়াসা বললো, “না পারবো না।আমার পড়া আছে।”
আষাঢ় দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে সোফায় শুয়ে বললো, “ঠিক আছে যাও।আমি না হয় না খেয়ে থাকলাম।তাতে কার কি এসে যায়।
আজকাল মানুষের মন থেকে মায়া,দয়া,মমতা সব উঠে যাচ্ছে।”
পিয়াসা চলে যেতে নিলো। আষাঢ়ের কথা শুনে তার গা জ্বলে গেলো যেনো।একবার ভাবলো খাবারটা গরম করে দিবে।পরক্ষণে মত বদলালো।তাকে এতো কথা বলেছে যখন সে ও খাবার গরম করে দিবে না।তার কিসের এতো দায়!
পিয়াসা নিজের রুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলো।
দুটো বেজে আসতেই পিয়াসা উঠে পড়ে। ঘুমানোর জন্য। দরজার নিচ দিয়ে বসার ঘরের আলো আসছে পিয়াসার রুমে।
পিয়াসা বিরক্ত হলো।এই লোকটা লাইট অফ না করেই চলে গেছে!
অদ্ভুত লোক।
দরজা খুলে পিয়াসা বের হলো লাইট অফ করতে।বের হয়ে দেখে আষাঢ় সোফায় ওভাবেই শুয়ে আছে।
পিয়াসা ভালো করে তাকায় আষাঢ়ের দিকে। এই লোকটার চেহারা কেমন বন্য প্রাণীর মতো। মুখ ভর্তি চাপদাড়ি,সিগারেটে পোড়া ঠোঁট, শ্যামলা চেহারায় কেমন রুক্ষতার স্পষ্ট ছাপ।
এর তুলনায় নির্জন ভাইয়ের চেহারা ভীষণ শান্ত, কোমল। দেখলেই মনে হয় ভীষণ শান্ত, ভদ্র মানুষ। আর ওনাকে দেখলে মনে হয় এখনই বুঝি পকেট থেকে ছু রি বের করে বলবে,”কি আছে পকেটে বের কর।”
পিয়াসা ভেবে পায় না ওনার বাবা মা এতো ভালো অথচ তাদের ছেলে হয়ে এই লোক এমন বন্য হলো কিভাবে?
দেখতে ও যেমন লম্বা তালগাছের মতো, কথাবার্তা ও বন্য।
নয়তো একটা মেয়েকে কিভাবে কেউ এভাবে কথা বলতে পারে!
পিয়াসা লাইট অফ করে দিয়ে চলে যাচ্ছিলো, আষাঢ় ডেকে বললো, “দিলে না তো খাবার। ঠিক আছে দিও না।না খেয়েই থাকবো।সকাল হলেই মা’কে বলবো মা যার প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে বলে একেবারে পরীর মতো একটা মেয়ে,এতো মিষ্টি, এতো সুইট।তার সেই মিষ্টি মেয়ের ভেতরটা একেবারে করলার মতো মিষ্টি। ”
পিয়াসা লাইট অন করে বললো, “আমি করলার মতো মিষ্টি! আপনি নিজে কি?একটা বন্য।”
আষাঢ় হেসে ফেলে পিয়াসার কথা শুনে। এই মেয়েটা তার ভয়ে এই রুমের ভেতর নিজেকে আটকে রেখেছে। সে যদি নিজ থেকে ব্যাপারটা সহজ না করে তাহলে পিয়াসা এখানে স্বাভাবিকভাবে থাকতে পারবে না।
এজন্য আষাঢ় সিদ্ধান্ত নিলো পিয়াসার সাথে সে অনেক কথা বলবে,ভীষণ বিরক্ত করবে।তাতে মেয়েটার মনের ভেতর থেকে ভয় দূর হবে।
বাবা মাকে ছেড়ে এখানে এসে সবার সাথে যদি মিশতে না পারে,একা দিন কাটায় তাহলে ওর মন খারাপ থাকবে।
তাছাড়া আগামীকাল থেকে আষাঢ়কে দেখলে ও আরো ভড়কে যাবে।আজকেই কিছুটা স্বভাবিক করতে হবে।
এই ভাবনা থেকেই আষাঢ় মা’কে বলেছিলো আজ আর তার জন্য অপেক্ষা না করতে।
পিয়াসার নাকের ডগা রাগে লাল হয়ে আছে।যেনো পাকা টমেটো।
আষাঢ় মনে মনে বললো, “ইশশ,কইতর রে আমার। কি মিষ্টি লাগছে তোমাকে!”
পিয়াসা গজগজ করে রান্নাঘরে গেলো।এতো বিরক্ত লাগছে তার এখন।সে এদের বাড়ির সবকিছু থেকে দূরে থাকতে চায়। অথচ এখন তাকে রান্নাঘরে গিয়ে খাবার গরম করতে হচ্ছে।
মাছ রান্না করা হয়েছে, সাথে শুটকি ভর্তা আর পাতলা ডাল।
পিয়াসা সব রেডি করে টেবিলে দিয়ে আষাঢ়কে বললো, “যান খাবার রেখে এসেছি।আমি যাচ্ছি এবার। ”
“তুমি কোথায় যাচ্ছো?ম্যানার জানো না?কাউকে একা খেতে দিতে নেই।সাথে বসে থাকতে হয়।এটা ওটা এগিয়ে দিতে হয়।”
পিয়াসা চোখ বড় করে তাকায়।আষাঢ় পাত্তা না দিয়ে বললো, “পিয়াসা,চট করে পিঁয়াজ, মরিচ দিয়ে একটা ডিম ভেজে ফেলো তো।তরকারি এসব খেতে ইচ্ছে করছে না আমার। ”
পিয়াসার মাথা গরম হয়ে গেলো। রাগান্বিত হয়ে বললো, “আপনার সমস্যা কি?এরকম করছেন কেনো?”
আষাঢ় মুচকি হেসে বললো, “রাগ করছো?বুঝতে পেরেছি তুমি ডিম ভাজতে জানো না তাই না?দেখেই বুঝা যায় তুমি তেমন একটা কিছু পারো না।”
পিয়াসা বিরক্তি নিয়ে ডিম ভাজি করতে যায়।
পিয়াসা ডিম ভেজে প্লেটে দিলো।তারপর একটা চেয়ার টেনে পাশে বসে বললো, “আর কিছু?”
“একটু মাছের ঝোল দাও তো,ওই পেটির মাছটা দিও।”
পিয়াসা হতভম্ব হয়ে বললো, “আপনি না বললেন মাছ খাবেন না,তরকারি ভালো লাগছে না।এখন আবার বলছেন মাছ দিতে।”
হ্যালো 2441139 পর্ব ২৫
“তখন ভালো লাগে নি,এখন ভালো লাগবে মনে হচ্ছে।”
পিয়াসা কথা বাড়ালো না।চুপচাপ যা করতে বলছে তাই করে গেলো।
খাওয়ার পর পিয়াসা আর এক সেকেন্ড ও দাঁড়ালো না।সোজা রুমে ঢুকে গেলো।
আষাঢ় মুচকি হেসে নিজের রুমের দিকে গেলো।কালকে পিয়াসার রিয়েকশন কি হবে তা ভেবেই আষাঢ়ের হাসি পাচ্ছে। গুনগুন করে গান গাইতে গাইতে আষাঢ় রুমে ঢুকে শুয়ে পড়ে।