প্রণয়ের অমল কাব্য পর্ব ৮১

প্রণয়ের অমল কাব্য পর্ব ৮১
Drm Shohag

ইরফানকে জোর করে মাইরা হসপিটাল নিয়ে যায়। এরপর ডক্টরের ট্রিটমেন্টে ইরফানের হাত ধীরে ধীরে রিকোভার করতে শুরু করে।
দেখতে দেখতে প্রায় তিন মাস পেরিয়ে যায়। এতোদিন ইরফান না কখনো ড্রাইভ করতে পেরেছে আর না তো কখনো কোনো কাজ ঠিকমতো করতে পেরেছে। হাত পুড়ে যাওয়ার পর-ও হাতের উপর অনেক প্রেশার খাঁটিয়ে কিছু কাজ করায় ইরফানের হাতে আরও বেশি প্রবলেম হয়েছিল।
ভার্সিটি থেকে একটা লম্বা সময়ের জন্য অবসর নেয় সাথে অফিসের কাজেও ঠিকঠাক অ্যাটেন্ড করতে পারেনি। দু’হাত দিয়ে তেমন কাজ করতে পারেনি। এজন্য তারেক নেওয়াজ এর উপর কাজের প্রেশার বেশি পড়েছে।
ইরফানের হাত এখনো পুরোপুরি রিকোভার হয়নি। নিজের হাতে খেতে পারেনি। মাঝে মাঝে চামুচ দিয়ে খায়,, বেশিরভাগ সময় মাইরা খাইয়ে দেয়।

ঘড়ির কাটা দুপুর ২ টার ঘর ছাড়িয়েছে। ইরফানের মতো কাজে ব্যস্ত থাকা মানুষ হঠাৎ এতোটা অবসয় সময় কাটানোয় প্রচুর বিরক্ত সে। বাচ্চা বউ বিয়ে করার জ্বালা বুঝতে পারছে। মাইরার সামনে সে ফোন ধরলেও মাইরা চেঁচিয়ে ওঠে। ইরফান না পেরে ধমক দেয়, আবার নিজেকে দমিয়েও নেয় মাইরার অসহায় মুখখানি দেখে।
মাইরা হাতে প্লেট নিয়ে ঘরে প্রবেশ করে। ইরফানকে পা মেলে বেডের এক কোণায় বসে থাকতে দেখে এগিয়ে আসে। হাতের প্লেট বেডের উপর রেখে তার পরনের ওড়না মাথা থেকে নামিয়ে গলার সাথে দু’বার পেঁচিয়ে নেয়। এরপর ইরফানের সামনে পা ভাঁজ করে বসলে ইরফান চোখ মেলে তাকায়। মাইরা ভাত মাখিয়ে ইরফানের মুখের সামনে ধরলে ইরফান গম্ভীর গলায় বলে,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

– তুমি খেয়েছ?
মাইরা মলিন মুখে ইরফানের দিকে তাকিয়ে থাকে। মাইরা ইরফানকে শুধু ভালোবেসে খাইয়ে দিতে চেয়েছিল। কিন্তু ইরফানের এসব উল্টাপাল্টা কাজে মাইরার দায়িত্ব পালন করতে খাইয়ে দিতে হয়। এখানেও ভালোবাসা আছে, কিন্তু মাইরার ভীষণ খারাপ লাগে। ইরফানকে খাইয়ে দিতে আসলে মাইরার সবার আগে ইরফানের দু’হাতের দিকে চোখ পড়ে। দৃষ্টি নামিয়ে মাইরা ইরফানের হাত দু’টোর দিকে তাকালো। হাতের তালু দু’টো কেমন কালচে হয়ে গিয়েছে। মাইরার চোখ ঝাপসা হয়।
ইরফান ভ্রু কুঁচকে বলে,
– হোয়াট হ্যাপেন্ড? কথা বলছো না কেন?
মাইরা বেশ কয়েকবার পলক ঝাপ্টে নিজেকে স্বাভাবিক করে নিল। এরপর ইরফানের দিকে চেয়ে মৃদু হেসে বলে,
– একসাথে খাবো।
ইরফান বেশ কিছুক্ষণ তীক্ষ্ণ চোখে মাইরার চোখের দিকে তাকিয়ে থাকে। মাইরাকে টেনে তার কোলে বসিয়ে বলে,
– খাওয়াও, ফাস্ট।

মাইরা কিছু বলল না। ইরফানের হুটহাট এমন কাজে মাইরা বেশ অনেকটা অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছে। মাইরা ইরফানকে খাওয়ায় সাথে নিজেও খায়। মাইরা তার মুখে খাবার নেয়ার সময় ইরফানের দিকে তাকালে দেখল ইরফান তার দিকেই চেয়ে আছে। মাইরা মুখে খাবার নিয়ে সবটুকু চিবিয়ে গিলে নেয়। এরপর ইরফানের উদ্দেশ্যে বলে,
– আপনি কি অন্যদিকে তাকাতে পারেন না? মুখের সামনে এভাবে তাকিয়ে থাকলে কোনো কাজ করা যায়?
ইরফান চোখ ছোট ছোট করে বলে,
– মাই উইস। ডিস্টার্ব কর না। ফাস্ট খাওয়াও।
মাইরা মুখ ভেঙায়। বিড়বিড় করে,
– শা’লা ইংরেজ সাদা বিলাই!
ইরফান গম্ভীর গলায় বলে,
– অ্যা’ম ইওর হাসবেন্ড নট শা’লা।
মাইরা থতমত খেয়ে তাকায়। মেকি হেসে বলে,
– হ্যাঁ হ্যাঁ জানি।

কথাটা বলে ইরফানের দিকে তাকায়। ইরফান আজ একটু বেশিই চুপচাপ। যদিও ইরফান তো এমনই, কথা কম বলে। কিন্তু আজ কেন যেন একটু বেশিই কেমন যেন লাগছে। কেমন খিটখিটে মে’জা’জে কথা বলছে। মাইরা শেষ খাবার টুকু ইরফানের মুখে দিয়ে ইরফানের কোল থেকে নেমে যায়। ইরফান কিছু বললো না। মাইরা এবার সত্যিই অবাক হয়। এই ইরফান তো তাকে শুধু জ্বালায়, আজ হলো টা কি? মাইরা ডান হাতে এঁটো প্লেট ধরে রেখে বা হাত কোমরে রেখে ইরফানের সামনে এসে দাঁড়ায়। চোখ ছোট ছোট করে বলে,
– আপনার কি হয়েছে বলুন তো?
ইরফান বিরক্তি কণ্ঠে বলে,

– নাথিং
মাইরার ও বিরক্ত লাগে। এই অ’স’হ্য লোকটার আবার কি হয়েছে? উফ! আর নেয়া যায় না। মাইরা কিছু একটা ভেবে মনে মনে হেসে নরম কণ্ঠে ডাকে,
– শিসরাজ?
মাইরার ডাকে ইরফান শীতল দৃষ্টিতে তাকায় মাইরার দিকে। মাইরা মনে মনে হাসে। উপরে উপরে মুখটা ছোট করে বলে,
– জানেন? শ্যামবর্ণের ছেলেরা ভীষণ সুন্দর হয়। আর যে ছেলেদের চোখের মণি কালো তারা তো মারাত্মক সুদর্শন হয়। কিন্তু আমার কপালে এক বিলাই চোখ ওয়ালা সাথে গায়ের রঙ সাদা ফকফকা স্বামী জুটেছে। যার মধ্যে সুদর্শন এর স-ও নেই। আমার কপাল টা কি পোড়া একবার ভাবুন!
ইরফান শক্ত চোখে মাইরার দিকে চেয়ে আছে। এমনিতেই তার একগাদা কাজ স্তূপ হয়ে আছে তিন মাসের গ্যাপে। তার বাবা অফিস গেলেও সবকিছু সামলে নিতে পারেননি তিনি। মাথা হ্যাং হয়ে আছে তার। এর মধ্যে এই স্টুপিট তার সাথে বাঁদরামি করছে। রে’গে দাঁতে দাঁত চেপে বলে,

– স্টুপিট গার্ল, থা’প্প’ড় দিয়ে সব দাঁত ফেলব তোমার।
মাইরা মিটিমিটি হেসে ডান গাল পেতে দিয়ে বলে,
– ফেলুন তো দেখি কেমন পারেন।
ইরফান বসা থেকে উঠে দাঁড়ালে মাইরা দ্রুত এক পিছিয়ে যায়। ইরফান মাইরার দিকে এগিয়ে আসতে নিলে মাইরা দু’হাতে প্লেট শক্ত করে ধরে দৌড় দেয়। ইরফান ধরতে গিয়েও পারল না। বিড়বিড় করল,
– স্টুপিট বাঁদর।
মাইরা ঘর থেকে বেরিয়ে নিচে যেতে গিয়েও আবার উল্টো ঘুরে এসেছে। না না বাবা এসব নিয়ে মজা করা যাবে না। ইরফান যা মানুষ। তার কথা অনুযায়ী যদি আবার কোনো পা’গ’লা’মি করে? মাইরা আবারও উল্টো ঘুরে ঘরে এসে দেখল ইরফান ওয়াশরুমের দিকে যাচ্ছে। মাইরা দ্রুত বলে ওঠে,

– শিরসাজ শুনুন?
ইরফান পিছু ফিরে তাকায়। মাইরা মৃদু হেসে বলে,
– আপনি দেখতে একটু আনকমন মানুষ। কিন্তু শ্যামবর্ণের ছেলেরা শুধু সুদর্শন হয়, আর আপনি ট্রিপল সুদর্শন পুরুষ।
ইরফান মাইরার দিকে এগিয়ে আসতে আসতে ঠোঁট বাঁকিয়ে বলে,
– আচ্ছা?
মাইরা ল’জ্জা পায়। আমতা আমতা করে বলে,
– আপনার চোখ দেখলে আমার লিওর চোখ ভেসে ওঠে। আপনি না থাকলে আমি লিওর চোখ দেখে দিন চালিয়ে নিতে পারবো।
ইরফান চোখমুখ কুঁচকে বলে,

– হোয়াট?
মাইরা মাথা নিচু করে মিটিমিটি হাসে। ইরফান ঘরের এক কোণায় ঘুমিয়ে থাকা লিওর দিকে তাকায়। চরম বিরক্ত সে। এটা মাইরাকে এনে দেয়াই তার সবচেয়ে বড় ভুল ছিল। মাইরা ইরফানের দৃষ্টি লিওর দিকে দেখে দ্রুত লিওর দিকে যেতে নেয়, তার আগেই ইরফান লিওকে দু’আঙুলের সাহায্যে উপরে টেনে তোলে। লিও ঘুমাচ্ছিল। হঠাৎ এভাবে ধরায় বেচারা মিআউ করে ডেকে ওঠে। ইরফানের ইচ্ছে করছে এর চোখ দু’টো তুলে নিয়ে মার্বেল খেলতে। স্টুপিট বউয়ের স্টুপিট বিড়াল। দু’টোই জ্বালিয়ে খায়।
মাইরা দ্রুত ইরফানের হাত থেকে লিওকে ছিনিয়ে কোলে নিয়ে বলে,
– ওর এভাবে ধরেন কেন আপনি? একটা বাচ্চা ঘুমাচ্ছে। তবুও আপনার একটু দয়ামায়া নেই।
ইরফান বিরক্তি কণ্ঠে বলে,
– ওকে ফেলে দিয়ে এসো। গো।
মাইরা চোখ বড় বড় করে তাকায়৷ কত বড় খারাপ লোক ভাবা যায়। তার বিড়াল ছানাটার সাথে কেমন করে।
ইরফান মাইরার দিকে এগিয়ে আসতে নিলে মাইরা দৌড় দেয় বাইরের দিকে। পিছু ফিরে বলে,
– এমন করেন কেন? আপনার চোখ-ই বেশি সুন্দর তো! একদম আমার লিওর দিকে নজর দিবেন না। পা’ষা’ণ লোক একটা।

ইরফান বিরক্ত চোখে চেয়ে থাকলো মাইরার দিকে। এই বাঁদর জীবনেও ঠিক হবে না। ফোনের শব্দ পেয়ে এগিয়ে গিয়ে কল রিসিভ করে। ছোট করে আসছি বলে কল কেটে দেয়।
এরপর দ্রুত রেডি হয়ে নেয়। হাতঘড়ি পরতে পরতে একবার একবার তার দু’হাতের দিকে তাকালো। হাত দু’টো ভালোই কালচে হয়েছে, সাথে এখনো কিছু কিছু জায়গায় বেশ ক্ষ’ত। ইরফান মৃদু হাসলো। আবার মাইরার কান্নামাখা মুখ চোখের সামনে ভাসলে ইরফানের মুখ মলিন হয়। সে নিজেকে শাস্তি দিয়ে নিজে তো শাস্তি পেয়েছে অনেক, কিন্তু সাথে তার বার্ডফ্লাওয়ারকেও ক’ষ্ট দিয়ে দিয়েছে। ক’ষ্ট পাবে না-ই বা কেন? এই যে ইরফানের মতো এমন শক্তপোক্ত মানুষ কেমন নেতিয়ে গিয়েছিল। উপর থেকে যদিও ভীষণ শক্ত থাকতো, কিন্তু মাঝে মাঝে জ্বরে আশেপাশের কোনো হুশ থাকতো না। একটু একটু চোখ মেলে কান্নারত মাইরাকে দেখে তার কী যে খারাপ লাগতো! দীর্ঘশ্বাস ফেলে ঘর থেকে বেরিয়ে যায় অফিসের উদ্দেশ্যে।

সময় তার গতিতে অতিবাহিত হতে থাকে। ঠিক যেমন মাইরার এইচএসসি এক্সাম চলে এসেছে। বেশ অনেকগুলো এক্সাম শেষ। আর দু’টো এক্সাম বাকি আছে,, এরপর প্রাকটিক্যাল।
ইরফান বিজনেসের কাজে রাশিয়া এসেছে। ইম্পর্ট্যান্ট কাজ হওয়ায় আসতে হয়েছে। নয়তো মাইরাকে রেখে সে আসতো না। এরকম একটা টাইমে কাজ পড়েছে, মাইরাকে নিয়ে আসতে পারেনি। আবার কাজ ফেলেও রাখতে পারেনি। মাঝে বিজনেসে সময় দিতে না পারায় অনেক কাজ জমা হয়ে গিয়েছে।
ইরফানের সাথে শুদ্ধ ফাইজ-ও এসেছে। এর কারণ আছে। ইরফানের কাজ রাশিয়ায় হওয়ায় এসেছে নাছিমের সাথে দেখা করতে। সকলের একসাথে দেখাও হয়ে গেল, সাথে ইরফানের কাজ-ও কমপ্লিট হলো।
ফাইজ তার ছেলে প্রিন্স এর সঙ্গে ভিডিও কলে কথা বলছে। ইরফান তাকিয়ে রইল সেদিকে। মাইরার কথা ভাবতেই মাথায় মাহিরা নামটি বাজলো। ইরফান ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসলো। ফাইজ ইরফানের পাশে বসে ইরফানের দিকে তার ফোন করে। ওপাশ থেকে ইনায়ার কোলে বসা ১ বছরের প্রিন্স দু’হাত মেলে দেয়।
ইরফান মৃদু হাসে প্রিন্স এর দিকে তাকিয়ে। ইনায়া ইরফানের সাথে টুকটাক কথা বললো প্রিন্সকে খাওয়াতে খাওয়াতে। হঠাৎ-ই বাচ্চা ছেলেটি কাশতে থাকে। ইরফান সামনে টেবিল থেকে দ্রুত পানির গ্লাস নিয়ে সামনে ধরে বলে,

– প্রিন্স, টেক ইট।
পাশ থেকে ফাইজ শব্দ করে হেসে ওঠে। ইনায়া প্রিন্সকে পানি খাইয়েছে। ইরফানের কান্ডে সে-ও না হেসে পারলো না। ফাইজ হাসতে হাসতে বলে,
– তোর একটা বাচ্চা দরকার ভাই, আমি বুঝেছি।
ইরফান ব্যাপারটা বুঝতে পেরে তব্দা খেয়ে চেয়ে আছে। প্রিন্সকে হঠাৎ এভাবে কাশতে দেখে এটা খেয়াল-ই ছিল না, যে প্রিন্স ফোনের ওপাশে। ফাইজ আবারও হেসে বলে,
– মনে হয় খুব তাড়াতাড়ি আমার প্রিন্স বাবার একটা ভাই-বোন পাবো। বুঝলে লিটল কুইন তোমার ভাই তো আমার প্রিন্সকে কনফিউজভ করে দিবে, ওর বাবা আমি নাকি ও।
ইনায়া হাসতে হাসতে বলে,
– আমার ভাইয়ের মতো আদর করতে পারেন না আপনি। ভাইয়ার থেকে একটু শিখুন।
ফাইজ ইনোসেন্ট ফেস বানিয়ে তাকায় প্রিন্সের দিকে। তার ছেলেকে নাকি সে আদর করে না? ইরফানের জন্য তাকে অ’প’বা’দ নিতে হচ্ছে। ফাইজ প্রিন্স এর সাথে আরেকটু দুষ্টুমি করে কল কেটে দেয়। এরপর ইরফানের দিকে চেয়ে বলে,

– আর কয়দিন পর মাইরা ভার্সিটি উঠবে। তুই এবার আমার প্রিন্সের ভাই-বোন আনার ব্যবস্থা কর।
ইরফান বিরক্তি কণ্ঠে বলে,
– আর ইউ ম্যাড? আমার বউ বাচ্চা।
শুদ্ধ সোফায় বসতে বসতে হেসে বলে,
– মাইরা তোর কাছে সারাজীবন-ই বাচ্চা থাকবে সোনা। সে আমরা জানি। তুই চাইলেই ওই বাচ্চার পেট থেকে ডজন ডজন ছাও বের হবে। বুঝলি?
ফাইজ হাসছে। ইরফান বিরক্ত হয়। তার বাচ্চা বউকে নিয়ে কিসব আলোচনা। বিরক্তি নিয়ে বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে নাছিমের ঘরের দিকে যায়। শুদ্ধ আর ফাইজ হাসলো।

নাছিম বেলকনিতে দাঁড়িয়ে। অনেক তারার ভীরে গোল থালার মতো চাঁদটি জ্বলজ্বল করছে। নাছিমের দৃষ্টি সেই জ্বলজ্বল করা চাঁদে। আজ সকালে ইরফান, ফাইজ, শুদ্ধ এসেছে। সারাদিন চার বন্ধু বেশ ভালো সময় কাটিয়েছে। যদিও ইরফান চুপচাপ থাকে, তবে এভাবেই তারা ইরফানের সঙ্গ মেনে নেয়। ইরফানকে যেন এভাবেই ভালো লাগে। কিন্তু তার মন খারাপ। ভীষণ মন খারাপ। ইরফানকে দেখে তার চোখে ইরফানের মুখে মাইরার প্রতিচ্ছবি ভাসে। তার কল্পনায় থাকা বার্বিডল ইরফানের জন্য হাসে, ইরফানের জন্য কাঁদে, ইরফানের জন্য বাঁচে। সবকিছুই ইরফানের জন্য। নাছিমের মুখে মলিন হাসি ফুটে ওঠে। সে বার্বিডলকে ভুলতে পারে না। মুভ অন আর বিয়ে এই শব্দ দু’টোর প্রতি নাছিমের বিষাদ কাজ করে। সবার মুখে তার জন্য এই শব্দ দু’টো থাকে। কেন সবাই তাকে ক’ষ্ট দেয়? সে তো এভাবেই বেশ আছে। বার্বিডল নামে এক আস্ত অনুভূতিকে হারিয়ে ফেলার অনুভূতি লালন করার মাঝেও তো এক তিক্ত স্বাদ আছে। অন্তরার বলা কথাটা মনে পড়ল, ভালোবেসে ভালো হতে না পারলেও খারাপ হওয়ার মাঝেও এক ভালো লাগা লুকিয়ে থাকে। নাছিম বিড়বিড় করল,

– ভালোবেসে সবাই ভালোবাসা জিতিয়ে নিয়ে পূর্ণতার হাসি হাসে। আমি নাহয় ভালোবেসে ভালোবাসা হারিয়ে অপূর্ণতায় ঘেরা মলিন হাসি হাসলাম।
কথাটা বলে দীর্ঘশ্বাস ফেলল।
এরপর থালার মতো চাঁদটির দিকে গভীর দৃষ্টি রেখে কিছুটা আওয়াজ করে মলিন হেসে বলে,
– তুমি চাঁদের চেয়েও দামী বার্বিডল। চাঁদকে ছুঁতে না পারলেও দেখা যায়। কিন্তু আমি তোমাকে ছোঁয়া তো দূর, দেখার অধিকার টুকুও হারিয়ে ফেলেছি।
একটু থেমে আবারও বলে,
– তোমাকে কখনো ভুলতে পারবো না বার্বিডল।

ইরফান নাছিমের ঘরে এসেছিল। বেলকনি থেকে এক পা বাড়াতে গিয়েও নাছিমের কথা শুনে তার পা থেমে যায়, সাথে চোয়াল শক্ত হয়ে যায়। দু’হাত মুষ্টিবদ্ধ করে নেয়। ইরফানের পাশে শুদ্ধ-ও এসে দাঁড়িয়েছিল। বেচারা নাছিমের কথাটা শুনে ঘাড় বাঁকিয়ে ইরফানের দিকে তাকায়। যা বোঝার বুঝল। ইরফান রে’গে নাছিমের দিকে এগিয়ে যেতে নিলে শুদ্ধ ইরফানকে টেনে ধরে। ইরফান শুদ্ধকে ধাক্কা দিতে চায়। রে’গে বলে,
– শুদ্ধ আমাকে ছাড়।
ইরফানের গলা পেয়ে নাছিম পিছু ফিরে তাকায়। শুদ্ধ আর ইরফানকে এভাবে দেখে অবাক হয়। এগিয়ে এসে বলে,
– আরে তোদের কি হয়েছে?
ইরফান ভস্ম করে দেয়া চোখে তাকায় নাছিমের দিকে। নাছিম বুঝলো না ইরফানের দৃষ্টির মানে। ইরফান রে’গে কিছু বলার আগেই শুদ্ধ বলে ওঠে,

– মাইরার ১০৫° জ্বর।
শুদ্ধর কথা শুনে ইরফান বিস্ময় চোখে তাকায় শুদ্ধর দিকে। নাছিম নিজেও শুদ্ধর দিকে অবাক হয়ে তাকায়। শুদ্ধ ঢোক গিলল। ইরফান দ্রুত শুদ্ধর থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নেয়। পকেট থেকে ফোন বের করে মাইরার নাম্বারে কল করে। সে বেশ কিছুক্ষণ আগে কয়েকবার কল করেছিল, মাইরা কল রিসিভ করেনি,, সে ভেবেছে মাইরা ঘুমিয়েছে,, কিন্তু শুদ্ধর কথা শুনে তার আর কিছু মাথায় আসেনি। চিন্তায় মাথা ফেটে যাচ্ছে। ইরফান মাইরাকে ফোনে না পেয়ে শুদ্ধর দিকে চেয়ে অসহায় কণ্ঠে বলে,
– আমার বার্ডফ্লাওয়ারের কি হয়েছে? ও কোথায়? আমার কল রিসিভ করছে না কেন?
শুদ্ধ ঢোক গিলল। নাছিম নিজেও চিন্তিত। তবে ইরফানকে দেখে অবাক হচ্ছে। আসলে এরকম ইরফানকে সে সামনে দেখে দোখেনি। শুদ্ধর মুখে গল্প শুনেছে, কিন্তু সামনে থেকে এমন অসহায়ত্বে ঘেরা ইরফানকে সে দেখেনি বললেই চলে।
শুদ্ধ মৃদুস্বরে বলে,

– মামা মামি কে কল দিয়ে দেখ। আমাকে কেন বলছিস?
ইরফান দ্রুত তার বাবার নাম্বারে কল করে। রিং হয়। ইরফান চিন্তিত বদনে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলে শুদ্ধ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। ইরফান বেরিয়ে যেতেই নাছিম এগিয়ে এসে বলে,
– বার্বিডলের এখন কেমন আছে?
শুদ্ধ বিরক্ত হয়ে বলে,
– বা’লের বার্বিডল। তোর বার্বিডলের পেটে ইরফানের চারজোড়া বাচ্চা আছে। এবার ওকে ভুলে যা। একটু স্বাভাবিক হ, প্লিজ!
নাছিম অসহায় দৃষ্টিতে তাকায় শুদ্ধর দিকে। কিছু বললো না। মেয়েটি ইরফানের বউ। তার চিন্তা করা টা শোভা পায় না। ছোট করে বলে,
– আচ্ছা।

শুদ্ধর খারাপ লাগলো। সে কাদের মাঝখানে এসে পড়লো। কাকেই বা দোষ দিবে? নাছিম শুদ্ধকে পাশ কাটিয়ে ঘরে চলে আসে। শুদ্ধ ডান হাতের দু’আঙুলের সাহায্যে কপাল ঘষে।
নাছিম তার ঘরে এসে টেবিলের কোণায় দাঁড়ায়। চোখজোড়া ঝাপসা। সে তো অস্বাভাবিক নয়। সে বার্বিডলের জায়গা টা কাউকে দিতে পারে না। এটা কি তবে তার ব্যর্থতা? দু’একটা ব্যর্থতা জীবনে থাকলে খুব কি ক্ষতি হয়? এইতো থেকে থেকে ক’ষ্ট হয়, দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে। এতে খুব বেশি ক্ষতি হয় না তো!
ভাবনায় আসে, একজীবনে সবার কি সব পাওয়া হয়? এই যে সামিয়া, সে যে কিছুই পায়নি। নাছিমের খারাপ লাগার পরিমাণ আরও তীব্র হলো।

সামিয়ার সাথে তার হঠাৎ দেখা। একদিনের পরিচয়, অথচ মেয়েটিকে সে আজও ভুলতে পারেনি। সামিয়ার ভেজা চোখ, মিষ্টি একটা মুখ, শান্ত স্বরে কথার বলার ভঙ্গি নাছিমের চোখে ভাসে। নাছিমের ইচ্ছে করে আল্লাহর কাছে সামিয়ার জন্য অভিযোগের খাতা খুলে বসতে, মেয়েটি কেন কিছু পেল না? আর নিজের জন্য আফসোস হয়, সে কেন সামিয়াকে তার পাশে পেল না? সামিয়া তার বন্ধু হওয়ার জন্য কেন থেকে গেল না? তার যে ভীষণ আফসোস হয়, বার্বিডল কে না পাওয়ার আক্ষেপ প্রথম থেকেই মেনে নিয়েছে। কিন্তু সামিয়াকে বন্ধু হিসেবে পাওয়ার আক্ষেপটা বেশ অনেক বেশি। আল্লাহ কেন যেন, তার জীবনে কিছু আসার আগেই সবকিছু কেড়ে নেয়। আর তাকে দিয়ে যায় একরাশ হতাশা, সাথে কিছু দীর্ঘশ্বাস,, কখনো কখনো চোখের কোণে জমা পানি।

নাছিম টেবিলের ড্রয়ার খুলে একটি কাগজ বের করে। কাগজটির তিনটে ভাঁজ খোলে। প্রায় ছয় মাস আগের সামিয়ার চিঠি। নাছিম পুরো চিঠিতে চোখ বুলায়। চিঠিটি পড়লে নাছিমের মনে হয় সামিয়া সত্যিই তার এক ভীষণ আপন বন্ধু, তাদের ভীষণ মিল! কিন্তু এটা আর রাখতে চাইলো না নিজের কাছে। দীর্ঘশ্বাস ফেলল। টেবিলের উপর থেকে লাইটার নিয়ে কাগজটির কোণায় আগুন জ্বালায়। দু’সেকেন্ড যেতে না যেতেই শুদ্ধ নাছিমের হাত থেকে কাগজটি কেড়ে নেয়।
নাছিম পিছু ফিরে শুদ্ধকে কিছু বলতে গিয়েও বললো না। শুদ্ধ কোনোরকমে আগুন নিভিয়ে বিরক্তি কণ্ঠে বলে,
– কি রে ভাই তোরা! কোন ইম্পর্ট্যান্ট কাগজটা পোড়ানোর ভূত চাপালি মাথায়?
কথাটা বলে কাগজটিতে দৃষ্টি দিয়ে মাথা উঁচু করতে গিয়েও করল না। চোখে পড়ে একটি লেখা~
~ প্রিয় শুদ্ধ সাহেব,
শুদ্ধ চোখ সরালো না। ধীরে ধীরে নিচের দিকে দৃষ্টি দেয়।
চিঠিটি পড়ার পর নাছিমের কথা শুনে শুদ্ধ বেশ অনেকক্ষণ চুপ করে থাকলো। তার প্রতিক্রিয়া বোঝা যায় না। হঠাৎ-ই দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে ওঠে,
– মেয়েটি বেঁচে থাকলে আমি নিজ দায়িত্বে ওর জীবন সাজিয়ে দিতাম।
নাছিম কৌতুক স্বরে বলে,
– দ্বিতীয় বিয়ে করে সাজাতি না-কি!
শুদ্ধ চোখ ছোট ছোট করে তাকায় নাছিমের দিকে। রে’গে বলে,

– তোর মতো দে’ব’দা’স হয়ে ঘুরতো না এট লিস্ট। ওকে আমার চেয়েও হাজারগুণ সুদর্শন পুরুষের সাথে বিয়ে দিতাম। মানুষ চাইলে সব পারে। সেটা তোকে দেখাতাম।
নাছিম কিছু বললো না। মানুষ মুখে অনেক কিছুই বলে, সব এতো সহজ? ফারাহ’র কিছু হলে শুদ্ধ কি করত? যখন ভার্সিটিতে পড়ত, তখন তো ফারাহ’কে পাবে না ভেবে শুদ্ধ চিরকুমার থাকার কথা-ই ভাবতো। এই ব্যাপারে প্রশ্ন করতে চেয়েও করল না। কথায় কথা বাড়ে। তার ভালো লাগছে না।
শুদ্ধ-ও আর কিছু বললো না। লাইটার দিয়ে তার হাতে থাকা সামিয়ার চিঠির কোণায় আগুন ধরিয়ে বলে ওঠে,
– স্যরি সামিয়া! আমার প্রতি তোমার অনুভূতিকে ছোট করছি না। কিন্তু তুমি বেঁচে থাকলে এতোদিনে তুমি অন্যের বউ থাকতে! কি জানি, তুমি যার ভাগ্যে ছিলে, সে বেচারার কপালে বউ জুটেছে না-কি তোমার অভাবে শুকিয়ে কঙ্কাল হয়ে যাচ্ছে!
নাছিম হতাশ কণ্ঠে বলে,

– তুই এটা নিয়েও মজা করবি?
শুদ্ধ মৃদু হেসে বলে,
– করিনি। বললাম তো, ও বেঁচে থাকলে বিয়ে হয়ে যেত ওর। যে মেয়ের ঘটক আমি হতাম, সে মেয়ের জীবনে দুঃখ থাকতো না! কিন্তু আমি তো সুযোগ পেলাম না।
নাছিম ভ্রু কুঁচকে বলে,
– এটা পুড়িয়ে ফেললি কেন?
শুদ্ধ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,
– কারণ ওর অনুভূতি আমাকে ঘিরে, আর আমার অনুভূতি ফারাহকে ঘিরে। আমি মেয়েটির অনুভূতির মূল্য কখনো দিতে পারতাম না, যার ফলস্বরূপ আমাকে ঘিরে মেয়েটির মাঝে যা-ই ছিল সবকিছু মূল্যহীন। আর মূল্যহীন সবকিছুকে পুড়িয়ে ফেলতে হয়, সেটা হোক যেকোনো জিনিস বা অনুভূতি।
নাছিম বুঝলো শুদ্ধ কথাটা তাকে ইন্ডিকেট করে বলেছে। সে মৃদু হেসে বলে,
– আমি হয়তো ব্যর্থ। তবে কিছু ব্যর্থতায় প্রশান্তি থাকে, যা তুই বুঝবি না। কারণ তুই তো পূর্ণতার পথিক।
শুদ্ধ অসহায় চোখে চেয়ে রইলো। বলার মতো কিছু খুঁজে পায় না। নাছিমকে কিছু বলে লাভ নেই। খুব ভালো করেই বুঝলো।

ইরফান নাছিমের বাসা থেকে বেরিয়ে তারেক নেওয়াজ এর সাথে কথা বলে। মাইরা আসলেই ঘুমিয়ে গিয়েছে, জ্বর আসেনি। ইরফান বুঝেছে শুদ্ধ আর তার সাথে নাছিমের ঝামেলা আটকানোর জন্য শুদধ মিথ্যা বলেছে। ইরফান আর নাছিমদের বাড়িতে যায়নি। সে তার কাজে ব্যস্ত হয়ে গিয়েছে। মোটামুটি তার কিছু কাজ গুছিয়ে নেয়। আপাতত তার মন এখানে টিকছে না। এরপর মাইরাকে সাথে করে আনবে। এভাবে একা একা থাকা ইম্পসিবল।
এরপর ইরফান শপিংমলে যায়। নাছিমের কথাগুলো ভাবতেই হাজারো বিরক্তি, রা’গ এসে জমা হয় তার মাঝে।
ইরফানের ইচ্ছে করল, সে এই পুরো শপিংমলের সব বোরখা নিকাব কিনে মাইরাকে তার মধ্যে ডুবিয়ে রাখবে, তাহলে নাছিম আর কখনো ভুল করেও তার বার্ডফ্লাওয়ারকে দেখতে পাবে না। বা নাছিমের মতো কেউ যেন তার বার্ডফ্লাওয়ারকে দেখে এসব অনুভূতি ক্রিয়েট হয়। আগে বুঝলে সে তার বার্ডফ্লাওয়ারকে জন্ম থেকেই নিকাবের মধ্যে ঢুকিয়ে রাখতো।

অনেক বড়সড় দু’টো লাগেজ ভরে মাইরার জন্য অনেকগুলো নিকাব কিনে নেয় ইরফান। বিভিন্ন কালারের নিকাব কিনেছে, তবে প্রায় অর্ধেকের বেশি কালো কালারের। প্রতিটি নিকাব এর সাথে ম্যাচিং করে সেইম কালারের বোরখা কিনেছে। নিকাবের সংখ্যা গুণে গুণে একশো টা,, সাথে ম্যাচিং করে বোরখা। দু’টো লাগেজ ভরে গিয়েছে।
ইরফান বাংলাদেশের ফ্লাইটের জন্য সব ব্যবস্থা করে মাইরার জন্য শপিং করেছে।
এয়ারপোর্টে যাওয়ার আগে অনেক চিন্তাভাবনা করে ইরফান নাছিমের নাম্বারে কল করে। সে চলে যাচ্ছে এটা জানিয়ে ডিরেক্ট বলে,

– নাছিম তোকে বিয়ে করতে হবে।
নাছিম চুপ থাকে। ইরফানের মাথাটা আবারও ধীরে ধীরে গরম হতে থাকে। নিজেকে সামলে শক্ত গলায় বলে,
– তুই বিয়ে না করলে আমাদের আর কখনো দেখা হবে না।
নাছিম নির্জীব চোখে চেয়ে রইল। নাছিমকে চুপ দেখে ইরফান রে’গে কল কেটে দেয়। প্লেনে ওঠার পর নিজের উশখুশ কমাতে নাছিমের নাম্বারে একটা মেসেজ করে,
– বলেছিলাম, মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ফাঁসির দড়ি গলায় ঝুলবে,, অ্যন্ড ইট’স ট্রু। খুশি হওয়ার প্রয়োজন নেই।
ইরফানের মেসেজটি দেখে নাছিম এতো খারাপ লাগার মাঝেও শব্দ করে হেসে দেয়। যে হাসিতে হাজারো তৃপ্তি মিশে আছে। মানুষ যেমন অনেককিছু পায়না তেমনি আবার অনেক কিছুই পেয়ে যায়। এই যে সে ইরফানের মতো একজন বন্ধু পেয়েছে। এই পাওয়া টা কি কম? কখনো না।

মাইরা সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে পড়তে বসেছে। আজ তার বায়োলজি এক্সাম। এই এক্সাম শেষ হলে আর একটা এক্সাম বাকি আছে। সকাল সকাল ফ্রেশ মাইন্ডে বেশ অনেকক্ষণ বই পড়লো। এরপর কলেজ ড্রেস এর বোরখা বের করে বোরখা পরে নেয়। এরপর হিজাব মাথায় বেঁধে নেয়। হঠাৎ-ই খেয়াল করল কাভার্ড এর এক কোণা থেকে কিসের যেন কাগজ পড়লো মেঝেতে। মাইরা নিচু হয়ে কাগজটি হাতে তুললে দেখল এটা একটি ছোটোখাটো খামের মতো। মাইরা ভেতর থেকে দু’টো কাগজ বের করে তাতে চোখ বুলায়। দৃষ্টিতে বিস্ময় ভর করে। খুব ভালো করে না বুঝলেও বুঝল এটা ইরফানের কানাডায় পিএইচডি করতে যাওয়ার কাগজ, সাথে পাসপোর্ট। মাইরার কি যে খারাপ লাগছে। ইরফান তাকে রেখে পিএইচডি করতে চলে যাবে? ভাবনার মাঝেই মনে হলো ঘরে কেউ প্রবেশ করেছে। মাইরা মাথা তুলে তাকালে ইরফানকে দেখে বিস্ময় চোখে তাকায়।
ইরফান গতকাল রাশিয়া গিয়েছে, আরও দু’দিন পর আসার কথা। আজকেই হঠাৎ সামনে দেখে মাইরার মনে হচ্ছে সে বোধয় অধিক শোকে চোখে বেশি দেখছে। ইরফান গটগট পায়ে এগিয়ে এসে মাইরার সামনে দাঁড়ায়। মৃদুস্বরে বলে,

– বার্ডফ্লাওয়ার? আমার কল রিসিভ কর না কেন তুমি? হোয়াই? থা’প্প’ড় খেতে চাও?
মাইরা জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে কিছু বলতে চায়, তার আগেই ইরফান মাইরার কোমরে বা হাত রেখে মাইরাকে টেনে আনে তার দিকে। ডান হাত মাইরার গালে রেখে মাইরার ঠোঁটজোড়া আঁকড়ে ধরে। মাইরা ইরফানের দিকে হেলে যায়। ইরফান মাইরাকে তার সাথে শক্ত করে জড়িয়ে নেয়। চোখ বুজে রেখে ডান হাতে ধীরে ধীরে মাইরা বাঁধা হিজাব খুলে ফেলে দেয়। এরপর ডান হাতে মাইরার বোরখার চেইন খুলে দেয়। মাইরা ইরফানকে ঠেলে। কিন্তু ইরফান পাত্তা দেয় না। সে তার কাজে ব্যস্ত।
মাইরার বোরখার নিচে জামার চেইন-ও একটানে খুলে দেয়। মাইরা ছটফটায়। আর একটু পর তার এক্সাম, আর এই লোক কি শুরু করেছে? ইশ!

হঠাৎ-ই তারেক নেওয়াজ এর গলা পায়। মাইরাকে ডাকতে ডাকতে এদিকে আসছে। মাইরার চোখ বড় বড় হয়ে যায়। দু’হাতে ইরফানকে এতো ঠেলা ঠেলে, বেচারি কিছুই করতে পারলো না। বরং ইরফান আরও শক্ত করে ধরে মাইরাকে। মাইরার কান্না পায়। ইরফান যেন শুনতে পাচ্ছে না কিছুই। তারেক নেওয়াজের কণ্ঠ আরও কাছ থেকে শুনতে পেয়ে মাইরার ছটফটানি বাড়ে। ইরফান চরম বিরক্ত হয়ে মাইরাকে ছেড়ে রে’গে বলে,

– স্টুপিট গার্ল, আদর করছি না আমি? অলটাইম ডিস্টার্ব কর কেন? বড় হবে না তুমি?
মাইরা ইরফানের কথা শুনলো কি-না। মেঝে থেকে হিজাবটা কুড়িয়ে নিয়ে ওয়াশরুমের দিকে দৌড় লাগায়। ইরফান বিরক্তি চোখে মাইরার কান্ড দেখল। পিছন থেকে তারেক নেওয়াজ ছেলের কথাটা শুনে একটু কেশে উঠল। ইরফান তার বাবার কণ্ঠ পেয়ে পিছু ফিরে তাকায়।
তারেক নেওয়াজ গলা ঝাড়লো। ইরফানের অভিব্যক্ত স্বাভাবিক। তার বাবা যে তার কথা শুনেছে, এর জন্য একটু ল’জ্জা পাওয়া উচিৎ, কিন্তু তার ছেলে ল’জ্জা পাচ্ছে না। তারেক নেওয়াজ ইরফানের বাবা হিসেবে চরম হতাশ।
ইরফান ভ্রু কুঁচকে বলে,

– কিছু বলবে?
তারেক নেওয়াজ আশেপাশে তাকিয়ে বলে,
– মাইরাকে ডেকে দাও। ওর এক্সাম আছে। ওকে কলেজে নিয়ে যাবো।
ইরফান মৃদুস্বরে বলে,
– তেমাকে যেতে হবে না। আমি ওকে রাখতে যাবো।
তারেক নেওয়াজ সাথে সাথে বলেন,
– কেন?
ইরফান ভ্রু কুঁচকে বলে,
– কজ, ও আমার বউ। তুমি তোমার বউ….
তারেক নেওয়াজ ইরফানকে থামিয়ে দিয়ে বলে,
– হ্যাঁ হ্যাঁ তোমার আম্মু মানে আমার বউ আমাকে ডাকছে। হয়তো অনেক ইম্পর্ট্যান্ট কাজ। তুমি তাহলে তোমার বউকে রেখে এসো।
ইরফান ছোট করে বলে,

– ওকে।
তারেক নেওয়াজ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। ইরফানের দিকে চেয়ে ভাবলো, তাকে কত মেপে মেপে কথা বলতে হয় এই ছেলেটার জন্য। একটুও মিল নেই তার সাথে। একদম উল্টো। সে কি সুন্দর সভ্য। আর তার ছেলে অ’স’ভ্য-ই বলা যায়।
ইরফান তার বাবাকে তার দিকে চেয়ে বলে,
– আর কিছু বলবে?
তারেক নেওয়াজ মাথা নেড়ে বলে,
– তুমি চাইলে রেস্ট কর। মাত্র তো ফিরলে। আমি মাইরা আম্মুকে ড্রপ করে দিচ্ছি।
ইরফান ডান হাত পকেটে গুঁজে রেখে বলে,

– ওকে কলেজে ড্রপ করে এসে আমি রেস্ট করব। নো প্রবলেম।
তারেক নেওয়াজ আর কিছু বলল না। সত্যি বলতে তার ভালো লাগে মাইরার প্রতি ইরফানের এতো কেয়ার দেখে।
মাইরা ওয়াশরুম থেকে তারেক নেওয়াজ এর গলা না পেয়ে বুঝলো তিনি চলে গিয়েছেন। গলার সাথে হিজাব জড়িয়ে ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে কোনোদিকে না তাকিয়ে দৌড়ে গিয়ে ইরফানকে জড়িয়ে ধরে। ইরফান বুঝতে পারেনি, শরীর হালকা ঝাঁকি দিয়ে ওঠে। মাইরার কান্ডে কিছুটা অবাক হয়। দু’হাতে জড়িয়ে নিয়ে মৃদুস্বরে বলে,
– হোয়াট হ্যাপেন্ড?
মাইরা ইরফানের বুকে নাক ঘষল। এরপর মাথা তুলে অসহায় কণ্ঠে বলে,
– আপনি আমাকে রেখে কানাডা চলে যাবেন শিসরাজ? আপনি আবার আমাকে ভুলে যেতে চাইছেন?
ইরফান ঠোঁট বাঁকিয়ে বলে,

– ইন্টেলিজেন্ট গার্ল।
মাইরা ইরফানের বুকে থা’প্প’ড় দিতে দিতে রে’গে বলে,
– আমি আপনাকে যেতে দিব না। পা’ষা’ণ লোক আপনি। শুধু আমাকে ভুলে যেতে চায়।
ইরফান ডান হাতে মাইরার দু’হাত ধরে বা হাতে মাইরাকে তার সাথে চেপে মৃদুস্বরে বলে,
– লিটল গার্ল তোমার জন্য কতকিছু স্যাক্রিফাইস করেছি, কোনো আইডিয়া আছে?
মাইরা ভ্রু কুঁচকে তাকায়। ইরফান মাইরাকে ছেড়ে ওয়াশরুমে যেতে যেতে বলে,
– ইউ নো বার্ডফ্লাওয়ার? পিএইচডি করার জন্য যা যা অ্যারেঞ্জ করেছিলাম, সবকিছু ক্যান্সেল করেছি, যাস্ট ফর ইউ।
আই ফিল লাইক অ্যা’ম আনএডুকেটেড নাউ।
মাইরা বোকাচোখে চেয়ে দেখল ইরফানকে। খারাপ-ই লাগলো। ইরফান তার জন্য একটু শান্তি করে পড়তেও পারেনি। কিন্তু সে তো বারণ করেনি। আবার ভাবলো একটু আগেই তো বারণ করল। এখন একটু ল’জ্জা-ও লাগছে। নিজের মাথায় নিজেই একটা থা’প্প’ড় দিয়ে হিজাব বাঁধতে শুরু করে।
কিছু একটা ভেবে ইরফানের উদ্দেশ্যে বলে,
– আপনার তো আরও দু’দিন পর আসার কথা। আজ আসলেন কেন?
ইরফান পিছু ফিরে থেকেই একটু ঠোঁট বাঁকিয়ে বলে,
– বাংলাদেশি গার্লফ্রেন্ড কল করেছিল।
মাইরা রে’গে তাকায় ইরফানের দিকে। অ’স’ভ্য লোক একটা। শুধু উল্টাপাল্টা কথা বলবে।

মাইরা এক্সাম শেষে বাড়ি ফ্রেশ হয়ে খেয়ে নামাজ পড়ে ইরফানের সাথে ঘুমিয়েছিল। এক্সামের জন্য তার ভালোভাবে ঘুম না হওয়ায় এক ঘুমে পুরো সন্ধ্যার পর ঘুম ভেঙেছে।
ইরফান বাম কাত হয়ে শুয়ে ঘুমে বিভোর। মাইরা ইরফানের দিকে খানিকটা ঝুঁকে ইরফানের বালিশের কোণায় মাথা রাখে। ইরফানের ঘুমন্ত মুখপানে চেয়ে মৃদু হাসে মাইরা।
কলেজ থেকে ফেরার সময়ের কথা মনে পড়লো।

মাইরা এক্সাম শেষে কলেজ গেইট থেকে বেরিয়ে ইরফানকে দেখে অবাক হয়। এগিয়ে এসে বলে,
– আপনি এখানে কেন? বাড়িতে যাননি?
ইরফানের চোখদুটো লাল। গতকাল সারারাত ঘুমায়নি, আবার মাইরার এক্সামের পুরো সময়ে এখানে এভাবেই দাঁড়িয়ে ছিল। ইরফান মাইরাকে বা হাতে আগলে নিয়ে মৃদুস্বরে বলেছিল,
– একসাথে ঘুমাবো বউ। একা একা ঘুম আসে না।
মাইরা কথাগুলো ভেবে হেসে ফেলল। ইরফানকে নিয়ে কি বলবে মেয়েটা বুঝে পায় না। ইরফানের হাত দু’টোর দিকে চোখ পড়লে মুখখানা মলিন হয়। হাত দু’টোর অনেকটা-ই কালচে হয়ে গিয়েছে।
মুখ এগিয়ে নিয়ে ইরফানের দু’হাতে দু’টো চুমু খায়। এরপর বেড থেকে নেমে নামাজ পড়ে নেয়। ঘরের এক কোণায় দু’টো লাগেজ দেখে মাইরা এগিয়ে গিয়ে লাগেজের চেইন খুললে অবাক হয়। দু’টো লাগেজ ভর্তি নিকাব আর বোরখা। একটা লাগেজে শুধু কালো কালারের বোরখা আর নিকাব। আর অপর লাগেজে কালো সহ আরও বিভিন্ন কালারের বোরখা, নিকাব। মাইরা অবাক না হয়ে পারে না।
কালো কালার ইরফানের ভীষণ পছন্দের, এটা মাইরা এতোদিনে বুঝে গিয়েছে। এই যে ঘরের সব জিনিস-ও তো কালো।

ইরফানের কাভার্ডে ৬০০ টা (শার্ট, প্যান্ট) এর মধ্যে ৫০০ টা-ই কালো।
যদিও ইরফানের শার্ট, প্যান্ট হয়তো আরও বেশি-ই হবে। ইরফান যে ভীষণ বিলাসী জীবনযাপন করতে পছন্দ করে এটা-ও মাইরা বুঝেছে। পিছন থেকে ইরফান বলে,
– কি করছ বার্ডফ্লাওয়ার?
মাইরা উঠে দাঁড়ায়। ইরফানের সামনে দাঁড়িয়ে অবাক হয়ে বলে,
– এতোগুলো বোরখা, নিকাব কার জন্য এনেছেন?
ইরফান মৃদুস্বরে বলে,
– তোমার।
মাইরা বলতে নেয়,
– তাই বলে এতো……
বলতে গিয়েও থেমে যায়। সেই জুতো গুলোর কথা মনে পড়ে যায়। থা’প্প’ড়ের কথা মনে পড়ে। ইরফান ভ্রু কুঁচকে বলে,

– হোয়াট?
মাইরা মিনমিন করে বলে,
– আমি তো নিকাব পরি না।
ইরফান মৃদুস্বরে বলে,
– এখন থেকে পরবে।
মাইরা মাথা নিচু করে বলে,
– আমি তো মুখ ঢেকে থাকতে পারিনা। অভ্যাস নেই।
ইরফান দু’হাতের আঁজলায় মাইরার মুখটা নেয়। মাইরার পিটপিট করে ইরফানের দিকে তাকায়। ইরফান কণ্ঠে আবেগ ঢেলে বলে,
– তোমার মূল্য আকাশে ভেসে থাকা চাঁদের চেয়েও হাজারগুণ বেশি বার্ডফ্লাওয়ার। চাঁদকে সবাই দেখতে পেলেও আমার বার্ডফ্লাওয়ারকে দেখার অধিকার শুধুমাত্র আমার। আমার মাইরা পরীর সৌন্দর্য অনুভব করার অধিকার তোমার শিসরাজ ছাড়া আর কারো নেই।
মাইরা অবাক হয়ে ইরফানের দিকে চেয়ে রইল। ইরফান মাইরার গালে হাত দিয়ে আবারও বলে,
– আমার মাইরা পরীকে যাস্ট আমি দেখতে চাই। নো ওয়ান এলস্। আন্ডারস্ট্যান্ড?
মাইরা কি প্রতিক্রিয়া দিবে বুঝতে পারে না।
দু’হাতে ইরফানকে জড়িয়ে ধরে ছোট করে বলে,

– আচ্ছা শিসরাজ।
ইরফান মৃদু হাসলো। দু’হাতে মাইরাকে আগলে নেয়। একটু পর মাইরা মাথা উঁচু করে বলে,
– আপনি আজকে কয়টা সিগারেট খেয়েছেন?
আজ মাইরা যখন পরীক্ষার হলে ছিল, তখন পুরো তিন ঘণ্টা ইরফান বাইরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করেছে সাথে একটা একটা করে সিগারেট শেষ করেছে। এজন্যই মূলত আজ অনেক খেয়ে ফেলেছে। ইরফান খুব স্বাভাবিক ভাবে উত্তর করে,
– এবাউট ফিফটিন।
মাইরা বিস্ময় দৃষ্টিতে তাকায়। রে’গে ইরফানকে কথা শোনাতে ইচ্ছে করল। তবে নিজেকে দমিয়ে আবদার করে,
– আমি সিগারেট পছন্দ করিনা। আপনি আমার এই অপছন্দের সিগারেট ছাড়েন না কেন শিসরাজ?
ইরফানের মুখটা ছোট হয়ে যায়। এটা কিভাবে সম্ভব? এটা তো আজকের অভ্যাস নয়। এটা ইম্পসিবল। মাইরার দিকে তাকিয়ে মৃদুস্বরে বলে,
– আমি আমার সাথে সবসময় অনেক চুইনগাম রাখি। তুমি অন্যকিছু বলো বার্ডফ্লাওয়ার। আই প্রমিস, আমি সব শুনব।

মাইরার ভীষণ খারাপ লাগে। সে বুঝে একটা হ্যাবিট ছেড়ে দেয়া এতো সহজ কাজ নয়। মাইরা অসহায় কণ্ঠে বলে,
– আপনি জানেন না শিসরাজ? সিগারেট খেলে ফুসফুস নষ্ট হয়ে যায়। আপনি কি আমার আগে ওপারে যেতে চান? আমার তো আপনি ছাড়া আপন কেউ নেই শিসওয়ালা। তবুও আপনি কেন আমায় একা রেখে চলে যেতে চান?
কথাগুলো বলতে বলতে মাইরার চোখের কোণে পানি জমে। ইরফানের নিজেকে ভীষণ অপরাধী লাগলো। মাইরার কথাটা একেবারে মিথ্যে নয়,, কিন্তু মাইরার ইচ্ছেটাই তার কাছে সবচেয়ে বড়। মাইরার এই অপছন্দের জিনিস টা তার আরও আগেই তার লাইফ থেকে মুছে ফেলা উচিৎ ছিল। নিজের উপর বিরক্ত হলো।
মাইরাকে শক্ত করে জড়িয়ে নিয়ে মৃদুস্বরে বলে,

– অ্যা’ম স্যরি বার্ডফ্লাওয়ার।
এরপর ডান হাতে মাইরার চিবুকে হাত রেখে মাইরার মাথা কিছুটা উঁচু করে মৃদুস্বরে বলে,
– তোমার জন্য সবকিছু করতে পারি বার্ডফ্লাওয়ার। সিগারেট ইজ মাই ফার্স্ট গার্লফ্রেন্ড। এন্ড ইউ আর মাই হার্ট, মাই এভরিথিং।
সো, মাইরা পরীর জন্য ফার্স্ট গার্লফ্রেন্ড কে ভুলে যাওয়া, ইট’স নরমাল। অবশ্যই তোমার ইচ্ছে পূরণ হবে এন্ড আমি আমার ফার্স্ট গার্লফ্রেন্ড কে ভুলে যাব। আর ইউ হ্যাপি বার্ডফ্লাওয়ার?
মাইরা কি বলবে বুঝতে পারে না। তবে ইরফান সিগারেটকে গার্লফ্রেন্ড বলায় শব্দ করে হেসে দেয়। হাসতে হাসতে ইরফানের বুকে কপাল ঠেকায়। ইরফান মাইরা চুলের ভাঁজে ঠোঁট ছুঁইয়ে মৃদু হাসে।

পরদিন শুদ্ধ আর ফাইজ বাংলাদেশে ব্যাক করে। শুদ্ধ ফারাহ’কে তার মায়ের কাছে গ্রামে রেখে গিয়েছিল। তৃণা বেগম দরজা খুলে দিলে শুদ্ধ হেসে বলে,
– তোমার ছেলের বউ কোথায় মা? কি একটা অবস্থা! নিশ্চয়ই দা’জ্জা’ল বউটা এতো ভালো ভোলাভালা শ্বাশুড়িকে দিয়ে সব কাজ করিয়ে নিচ্ছে তাইনা? আহারে আমার বউয়ের শ্বাশুড়ি ক’ষ্ট পেও না। আমি ওকে….
তৃণা বেগম শুদ্ধর কান টেনে বলে,
– এসেই বাঁদরামি শুরু করেছিস? ও রান্না করছে তোর জন্য।
শুদ্ধ মাথায় হাত দিয়ে বলে,
– হায় আল্লাহ! তুমি আমার বউটাকে দিয়ে সব কাজ করিয়ে নিচ্ছ?
তৃণা বেগম হতাশ কণ্ঠে বলেন,
– যা গোসল করে নে। বাঁদরামি ছাড় যা।
শুদ্ধ হাসলো। তৃণা বেগম শুদ্ধর সাথে টুকটাক কথা বলে তার ঘরের দিকে গেলে শুদ্ধ রান্নাঘরের দিকে যায়। পিছন থেকে দেখল ফারাহ ওড়না পাশে খুলে রেখে চুলার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। শুদ্ধ এগিয়ে গিয়ে পিছন থেকে ফারাহ’কে জড়িয়ে ধরে। ফারাহ ভ’য় পেয়ে চিৎকার দিতে গিয়েও শুদ্ধর কথা শুনে থেমে যায়। শুদ্ধ মৃদু হেসে বলে,

– ভালোবাসি ফারাহ পাখি।
ফারাহ উল্টো ঘুরে দাঁড়িয়ে বলে,
– এখান থেকে যাও। গোসল করে নাও। আমি আসছি।
শুদ্ধ দু’হাতে ফারাহ’র মুখে লেগে থাকা ঘাম মুছে দেয়। ফারাহ’কে দেখে তার সামিয়ার কথা মনে পড়ল। সত্যি বলতে তার খারাপ লেগেছে মেয়েটার জন্য। কিন্তু তার সবটা জুড়ে যে তার ফারাহ পাখি। ফারাহ শুদ্ধ কে চুপ দেখে বলে,
– কি হয়েছে তোমার?
শুদ্ধ ফারাহ’র দু’হাত ধরে হাতের উল্টোপিঠে চুমু আঁকে। ফারাহ অবাক হয়ে বলে,
– কি করছ? আমি রান্না করছি। হাত এঁটো।
শুদ্ধ হাসলো। ফারাহ’কে জড়িয়ে ধরে বলে,
– অনেক ভালোবাসি ফারাহ পাখি।
ফারাহ কিছু বলতে গিয়ে পিছনে শ্বাশুড়ি মা কে দেখে বিড়বিড়িয়ে বলে,
– ছাড়ো আমায়। মা এসেছে।
শুদ্ধ ফারাহ’কে ধরে রেখেই গলা চড়িয়ে বলে,
– মা জানো, বউকে ছাড়া একদম থাকা যায় না। মারাত্মক মিস করেছি। এখন আমার বউকে কি ছাড়া উচিৎ তুমি-ই বলো?
তৃণা বেগম তার ঘরের দিকে যেতে যেতে মৃদু হাসলো। এই ছেলেকে নিয়ে আর পারে না।

ইরফান লাস্ট ছয় মাস আগে নাছিমের সাথে দেখা করে গিয়েছেল। আবারও ছয় মাস পর গত তিনদিন আগে তার সাথে দেখা করতে এসেছিল।
নাছিম অফিস থেকে ফিরে ফ্রেশ হয়ে আসে। ডায়নিং রুমে এসে খাবার খুঁজলে সব পাত্র একদম ফাঁকা দেখে নাছিম অসহায় মুখ করে থাকে। তার মা কয়েকদিন হলো আবার জেদ ধরেছে তাকে বিয়ে করাবে। তার বিজনেস পার্টনার এর এক মেয়ে, বয়স ২২-২৩ হবে,, মেয়েটি তার মায়ের কান ভাঙিয়েছে কিভাবে যেন। নাছিম বিরক্ত। মেয়েটির সঙ্গে তার প্রায় দেখা হতো, টুকটাক কথা হতো! এখন সে সেই মেয়েটাকে বিয়ে করে নিবে? ব্যাপারটা এতো হাস্যকর লাগে তার কাছে।
তার মা এসব নিয়ে তার উপর রে’গে রান্না করেনি। নাছিম আর কি করবে? সে নিজেই রান্নাঘরে গিয়ে নুডুলস্ রান্না করে নেয়। এরপর তার মা আর তার জন্য দু’টো বাটিতে নিয়ে তার মায়ের ঘরের দিকে যায়। এগিয়ে গিয়ে মায়ের পাশে বসে মৃদুস্বরে ডাকে,

– মা?
ভদ্রমহিলা চোখ বুজে রেখেই বলে,
– ঘরে বউ না আনলে এখন থেকে এভাবেই না খেয়ে থাকতে হবে।
মায়ের কথায় নাছিম মৃদু হেসে বলে,
– হবে না। তোমার ছেলে রাঁধতে জানে একটু-আধটু। তোমাকে সহ রান্না করিয়ে খাওয়াবো।
নাছিমের মা কথাটা শুনেই তড়িঘড়ি করে উঠে বসে। নাছিমের হাতে রান্না করা নুডুলস্ দেখে তিনি অবাক হয়। তিনি ভেবেছিলেন নাছিমকে এভাবে বললে হয়তো মানাতে পারবে। কিন্তু তিনি ব্যর্থ। উল্টে তার ছেলে তার জন্য সহ রেঁধে এনেছে। নাছিম মায়ের দিকে চেয়ে মলিন হাসলো। হাতের বাটি রেখে মায়ের হাত তার দু’হাতের মাঝে রেখে একটা চুমু খেয়ে বলে,

– আমি এভাবে ভালো আছি মা। তুমি আমাকে বিয়ের কথা বললে আমি ভীষণ ক’ষ্ট পাই। তুমি আমাকে কেন ক’ষ্ট দাও মা? বার্বিডল কে ভাবিনা আমি,, কিন্তু আমি তো ওকে ভুলি-ও না মা। থাকি না এভাবে?
ভদ্রমহিলার চোখজোড়া ঝাপসা হয়। তার ছেলের জীবনটা গুছিয়ে দিতে পারলেন না তিনি। নিজেকে সামলে বলে,
– জানি মেয়েটির বিয়ে হয়ে গিয়েছে। কিন্তু মেয়েটি কে রে? খুব দেখতে ইচ্ছে হয়, কার জন্য আমার ছেলের জীবনের একটি অংশ থেমে গেল?
নাছিম দীর্ঘশ্বাস ফেলল। মৃদু হেসে বলে,
– কখনো পূর্ণতা সুন্দর, কখনো অপূর্ণতা আবার কখনো আক্ষেপ। তুমি আমার না হওয়া বার্বিডলকে না দেখার আক্ষেপ রাখো, আমি সামিয়াকে বন্ধু হিসেবে না পাওয়ার আক্ষেপ রাখি। এটাই সুন্দর।
কথাগুলো বলে নাছিম খাওয়ায় মনোযোগ দিল। ভদ্রমহিলা ছেলের পানে চেয়ে রইল।
নাছিমের ভেতর থেকে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে,, যার সাথে হয়তো মিশে আছে বার্বিডল আর সামিয়া এই দু’টি নাম। যাদের কখনো ভুলে যাওয়া যায় না।

মাইরার এইচএসসি এক্সাম শেষে অ্যাডমিশন হয়। ভাগ্য সাথে থাকায় মাইরার ইরফানের ভার্সিটিতে চান্স পেয়ে যায়। এটা নিয়ে মাইরা কি ভীষণ খুশি হয়েছিল।
রাত তখন ১০ টা। ইরফান অফিস থেকে ফেরেনি। মাইরা ছাদের কোণায় এসে দাঁড়িয়েছে। তখন-ই ইরফানকে গাড়ি নিয়ে গেইট দিয়ে ঢুকতে দেখে মাইরার ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে ওঠে। ইরফান গাড়ি গ্যারেজে রেখে বাড়ির ভেতর চলে যায়। মাইরার মনে কিছু চলছে। বেশ কিছুক্ষণ সময় অতিবাহিত হয়। সিঁড়িতে কারো পায়ের শব্দ পেয়ে বুঝতে পারে ইরফান তাকে খুঁজে না পেয়ে ছাদে আসছে। ইরফানদের এই বাড়ি তিন তলা। রেলিঙটা বেশ মোটা। মাইরা ভ’য়ে ভ’য়ে ছাদের প্রাচীর উপর উঠে দাঁড়ায়। তখন-ই ইরফান ছাদে এসে দাঁড়ায়। সামনে তাকিয়ে মাইরাকে ছাদের রেলিঙের উপর দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে হতভম্ব হয়ে যায়। ভীত কণ্ঠে ডাকে,

– বার্ডফ্লাওয়ার?
মাইরা যদিও ভ’য় পাচ্ছে তবে ইরফানকে দেখে হাসলো। ইরফান এগিয়ে আসতে নিলে মাইরা দ্রুত বলে ওঠে,
– শিসরাজ দাঁড়ান দাঁড়ান।
ইরফান ধমকে বলে,
– থা’প্প’ড় দিয়ে সব দাঁত ফেলব তোমার। ওখানে কেন উঠেছ?
মাইরা অসহায় কণ্ঠে বলে,
– শিসরাজ আমাকে একদম বকবেন না। আমি কিন্তু লাফ দিব এখান থেকে।
ইরফান ফোঁস করে শ্বাস ফেলে। একটু এগিয়ে এসে বলে,
– বার্ডফ্লাওয়ার নেমে এসো।
মাইরা মাথা নেড়ে বলে,

– তাহলে বলুন, আপনি আমাকে পছন্দ করেন আর ভালোবাসেন।
ইরফান চোখ ছোট ছোট করে তাকায়। এই স্টুপিট এর বাঁদরামি দেখতেই তার দিন যায়। মাইরা আবারও বলে,
– বলুন আপনি আমাকে পছন্দ করেন, আর অনেক ভালোবাসেন। মুখে উচ্চারণ করে বলবেন কিন্তু।
ইরফান তীক্ষ্ণ চোখে চেয়ে মাইরার দিকে এগিয়ে আসতে আসতে বলে,
– আই ডোন্ট লাইক ইউ।
মাইরা মুখ ফুলায়৷ ইরফানকে অনেকটা কাছে দেখে মাইরা হঠাৎ-ই পিছন দিকে শরীর ছেড়ে দেয়। ইরফান একপ্রকার দৌড়ে গিয়ে শরীর ছেড়ে দেয়া মাইরাকে জড়িয়ে নেয় নিজের সাথে। ভীত কণ্ঠে আওড়ায়,
– আই লাইক ইউ বার্ডফ্লাওয়ার, লাভ ইউ আ লট মাই হার্ট।
মাইরা দু’হাতে ইরফানকে জড়িয়ে ধরে শব্দ করে হেসে ফেলে। ইরফানের বুক ধুকধুক করছে। এই মেয়েটার বাঁদরামির লেভেল কোথায় গিয়েছে! তার হার্ট অ্যাটাক করাবে স্টুপিট। ইরফান মাইরার মাথা উঁচু করে রে’গে বলে,
– ভালো হবে না তুমি? পড়ে গেলে কি হতো?
মাইরা ইনোসেন্ট ফেস বানিয়ে বলে,
– পড়ব না তো। শিসওয়ালা থাকতে তার বার্ডফ্লাওয়ার পড়ে যায় না-কি!
ইরফান শীতল দৃষ্টিতে তাকায় মাইরার দিকে। মাইরা ইরফানের বুকে মাথা রেখে মৃদু হাসে।

ফারাহ, নুসরাত, শাহেদ, সাজিদ ভার্সিটির মাঠে বসে আছে। নুসরাত সবাইকে না জানিয়ে বিয়ে করায় সাথে কন্টাক্ট অফ রাখায় সবার রা’গ, অভিমান বেশ কসরত করে ভাঙিয়েছে নুসরাত। তার আপুর যে কি হয়েছিল, হঠাৎ-ই অনেক রুড হয়ে গিয়েছিল। একারণেই মূলত সে সবার থেকে দূরে ছিল। নুসরাত সাজিদের বাহুতে থা’প্প’ড় মেরে বলে,
– এই বিদ্যাসাগর আর ভালো হলো না। একটু কম করে পড় রে। আশেপাশেও একটু নজর দে। তোর বউ তো কেঁদে ম’র’বে।
নুসরাতের কথায় সবাই হাসলেও সাজিদ নুসরাতের থেকে কিছুটা দূরে সরে বলে,

– গা ঘেঁষবি না।
সাজিদের কথায় নুসরাত অবাক হয়। সাজিদ তার থেকে কেমন যেন আর কথাই বলে না। শাহেদ হাসলেও ফারাহ হাসলো না। বরং সাজিদের দিকে চেয়ে রইল। সকলে আরও বেশ কিছুক্ষণ কথা বলার পর নুসরাত বাইরে বেরিয়ে যায়। শাহেদও চলে যায়। সাজিদ বসে থাকে। কিছুক্ষণ পর সাজিদ উঠে দাঁড়ালে ফারাহ এগিয়ে এসে দাঁড়ায় াজিদের সামনে। এরপর মৃদুস্বরে বলে,
– তুই কি ডিস্টার্ব সাজিদ?
সাজিদ মৃদুস্বরে বলে,
– না।
ফারাহ সাজিদের দিকে তাকিয়ে বলে,
– তুই নুসরাতকে ভালোবাসিস, তাইনা সাজিদ?
ফারাহ’র কথায় সাজিদ বিস্ময় দৃষ্টিতে তাকায়। ফারাহ আফসোসের সুরে বলে,
– ওর থেকে লুকিয়ে রাখলি কেন? আমরা যখন একসাথে ছিলাম, তখন জানিয়ে দিলে এট লিস্ট ও হয়তো এখন বিবাহিত থাকতো না।
সাজিদ বেশ কিছুকক্ষণ চুপ থাকলো। এরপর মৃদু হেসে বলে,

– আমি মধ্যবিত্ত ঘরের ছেলে ফারাহ। টিউশন করে পেট চালাই। আমারা মধ্যবিত্তরা ভালোবাসতে পারলেও, সেই ভালোবাসা চাওয়ার দুঃসাহস আমাদের নেই।
কথাটা বলে সাজিদ দীর্ঘশ্বাস ফেলে। এরপর উল্টো ঘুরে যেতে যেতে বলে,
– ওকে বলিস না ফারাহ। ও বিদেশী বরের সাথে খুব সুখেই আছে।
ফারাহ অসহায় চোখে চেয়ে রইল। তার মনে পড়ল সামিয়ার কথা, মমে পড়ল নাছিমের কথা, এরপর মনে পড়ল জাহারার কথা। ইরফানের খালাতো বোন জাহারা, যে মেয়েটি ইরফানের জন্য এই ভার্সিটি বাদ দিয়ে দিয়েছিল। বিয়ে করবে না বলে কত অশান্তি করেছে শুনেছে। কিন্তু সবশেষে অনেক ক’ষ্টে বিয়ে দিয়েছিল জাহারাকে খুব সাদামাটাভাবে। এখন হয়তো ভালোই আছে সে।
কিন্তু বাকিদের জীবন কেমন ছন্নছাড়া হয়ে গেল! সাজিদ এর পরিণতি কি হবে? কথাগুলো ভেবে ফারাহ’র মন খারাপ হলো।
শুদ্ধ অন্তরাকে দেখে বলে,

– কি রে কি অবস্থা?
অন্তরা ভার্সিটির গেইট দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করে বলে,
– এইতো চলছে।
– বিয়ের দাওয়াত দিলি না যে!
অন্তরা হেসে বলে,
– আমাদের মতো মানুষদের জন্য বিয়ে করা তো দূর, বিয়ে শব্দটাতেই ঘৃণা জন্মে গিয়েছে।
শুদ্ধ দীর্ঘশ্বাস ফেলল। অন্তরা ফারাহ’র সাথে টুকটাক কথা বলে বেরিয়ে যায়। নুসরাত নাকি বেরিয়ে গিয়েছে। শুদ্ধ ফারাহ’র হাত ধরে হাঁটতে হাঁটতে বলে,
– মন খারাপ কেন পাখি?
ফারাহ মলিন মুখে বলে,
– কিছু মানুষের জীবনে ভালোবাসা শুধু ক’ষ্ট দেয় কেন?
শুদ্ধ একটু ভেবে বলে,
– কারণ সেই কিছু মানুষের ভালোবাসা একতরফা হয়। দু’তরফা ভালোবাসা হলে সেই ভালোবাসার ৯৯% মানুষ জিতে যায়, যেখানে এক আকাশ সমান প্রশান্তি থাকে। এই যেমন আমি আমার ফারাহ পাখিকে পেয়েছি।
ফারাহ মৃদু হাসলো। শুদ্ধ হেসে বলে,
– ভালোবাসি পাখি।

সন্ধ্যার পর পর,
ইরফান মাইরাকে নিয়ে গ্রামের বাড়ি এসেছে। মাইরা লাবিবকে কোলে নিয়ে বসে আছে। লাবিব মাইরার উদ্দেশ্যে বলে,
– আপুই আমাকে তুমু কাচ্চ না কিনু?
ইরফান চোখ ছোট ছোট করে বলে,
– কজ, হাসবেন্ড দের কিস করতে হয়।
লাবিব ইরফানের দিকে চেয়ে বলে,
– টুমি সিটআপ। টুমি পুচা। আপুকে টুমু খিতে দাউ না। খুচিব ডুলাবাই।
মাইরা মিটমিটিয়ে হাসছে লাবিবের কান্ড দেখে। ইরফান চোখমুখ কুঁচকে তাকায়। মাইরা হেসে বলে,
– আপনার অনুভূতি বলুন।
ইরফান মৃদুস্বরে বলে,
– তোমার ভাইকে বিয়ে দিয়ে দিব। আমার বউয়ের ভাগ আর কত দিব?
মাইরা ইরফানের কথা শুনে হেসে ফেলল৷ লাবিব ভাবুক ভঙ্গিতে বলে,
– বিয়ি দিলে কি য়বে?
ইরফান সাথে সাথে বলে,
– তোমার বউ হবে।
লাবিব তার ডান হাত বাড়িয়ে আঙুলগুলো নাড়াতে নাড়াতে বলে,
– আমাল বুউ কুতায়? আমাল বুউ ইনে দাউ।
লাবিবের কথা শুনে মাইরা জোরে জোরে হাসতে থাকে। ইরফান নিজেও একটু ঠোঁট বাঁকালো।

মাইরা লাবিবকে ইরফানের কাছে রেখে ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছে।
তার মা রান্নাঘরে রান্না বসিয়েছে। মাইরা এগিয়ে যায়। তার এখন এই বাসায় এসে ভীষণ ভালো লাগে। লাবিবের বাবা তাকে আর কিছু বলে না। মাইরা রান্নাঘরে গিয়ে তার মাকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে। মাইরার মা মৃদু হেসে বলে,
– এখানে আসলি কেন? ইরফানের কিছু লাগলে বলিস মা!
মাইরা মুখ ফুলিয়ে বলে,
– হ্যাঁ হ্যাঁ সারাদিন শুধু জামাই জামাই কর। আমাকে তো ভুলেই যাচ্ছো দিন দিন।
মাইরার মা হাসলো মাইরার কথায়। রান্না ঢেকে দিয়ে মাইরার দিকে ফিরে মৃদু হেসে বলে,
– তুই তো আমার মা। আমার মা কে কি করে ভুলি বল তো?
মাইরা তার মাকে জড়িয়ে ধরে বলে,
– তুমি এতো ভালো কেন মা?
ভদ্রমহিলা মাইরাকে বা হাতে জড়িয়ে রেখে ডান হাতে খাবার নাড়তে নাড়তে বলে,
– আমার মেয়ের মন ভালো তাই তার মা-ও তার কাছে ভালো।
মাইরা হাসলো। মায়ের সাথে হেলান দিয়ে রান্না দেখতে লাগলো। সত্যিই তার মা সেরা।

পরদিন ইরফান মাইরা ফজর নামাজ পরে ঘুমায়নি। মূলত ইরফান মাইরাকে ঘুমাতে দেয়নি। সে মাইরাকে শাড়ি পড়িয়ে দিচ্ছে। খুব মনোযোগ সহকারে অল্প সময়ের সময়ের মাঝেই মাইরাকে কালো শাড়ি পরিয়ে দেয়। সবশেষ হাঁটুমুড়ে বসে একটা একটা করে শাড়ির কুচি ঠিক করে দেয়। মাইরা মৃদু হেসে তাকিয়ে আছে ইরফানের দিকে। ইরফান তার কাজ শেষ করে বসা থেকে উঠে দাঁড়ায়। একে তো মাইরাদের এখানে এসি নেই। ইরফান ঘেমে নেয়ে একাকার হয়ে গিয়েছে। মাইরা অসহায় কণ্ঠে বলে,
– আপনি কি গোসল করবেন?
ইরফান মাইরার দিকে তাকায়। মাইরার খোপা করা চুলগুলো ছেড়ে দিল। এরপর মাইরার দু’গালে হাত রেখে মৃদুস্বরে বলে,

প্রণয়ের অমল কাব্য পর্ব ৮০

– আগে তোমাকে রেডি করিয়ে নিই বউ।
কথাটা বলে ইরফান নিজে নিজে যা পারলো, তাই সাজিয়ে দিল। মাইরার দু’হাত ভর্তি করে কাঁচের চুড়ি পরিয়ে দেয়।
মাইরা হাসলো। তার মনে আছে, ইরফান প্রায় ৩০ টি অ্যালবাম কিনেছিল, যার মধ্যে ইরফানের আঁকানো তাদের কতশত পিক বন্দী করে রাখা আছে। এরপর ইরফান তাদের দু’জনের জন্য কাপল ঘড়ি কিনেছিল, সাথে অনেক বড় বক্সের চুড়ি, যেখানে ৬০ ডজন চুড়ি ছিল। এই চুড়িগুলো ইরফানের দেয়া সেই চুড়িগুলোর মধ্যের কয়েক ডজন। মজার ব্যাপার হলো এগুলো মাইরা নেয়নি। গ্রামে আসার আগে ইরফান নিজে নিজেই কখন যে এগুলো তাদের ট্রলিতে তুলে নিয়েছে মাইরা জানেই না। ইরফান শাড়ির আঁচল টেনে মাইরার মাথায় দিয়ে দিল। সবকিছু খুব সুন্দর করে পিনআপ করে দিয়ে ইরফান স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। এরপর মাইরাকে নিঁখুতভাবে অবলোকন করে।

প্রণয়ের অমল কাব্য শেষ পর্ব