নে আদরে জড়িয়ে মন পর্ব ৪২
সিনথিয়া
নিউইয়র্কের সবচেয়ে বড় প্রাইভেট রিসার্চ ইউনিভার্সিটির করিডোর দিয়ে হাঁটছে জারা এবং আরশি। দু’জনের হাতই একগাদা নোটস, আর বইপত্ররে ঠাসা৷ বারোটায় ক্লাস শুরু হয়েছে আর শেষ হতে হতে বিকেল চারটে।
জারা হাতঘড়িতে সময় দেখলো। তারপর ফিরে চাইলো আরশির দিকে। প্রসঙ্গ টেনে বললো,
‘ভাগ্যিস তখন মেহমেদ আঙ্কেল গাড়ি করে পৌঁছে দিয়ে গেলেন! নয়তো আজ আর কুইজে টুইজে পার্টিসিপেট করা হতো না আমাদের। আন্টি আবার ব্যাগে করে লাঞ্চও প্যাক করে দিয়েছেন৷ ভাবা যায়? তোর শাশুড়ি মা কত্ত ভালো না রে? ওনাকে বলিস তো আমাকে মেয়ে হিসেবে দত্তক নিয়ে নিতে। তাহলে তোর সাথে থাকবো আর রোজ রোজ ফ্রিতে আদর খাবো!’
আরশি মেদুর মুখখানায় তখন আষাঢ়ে মেঘের আনাগোনা। মন খারাপের চূড়ান্তে পৌঁছে দূরন্ত মেয়েটাও আজ যেনো হয়েছে শান্ত নদী। তার সমস্তদিন কেটেছে চুপচাপ বয়ে চলার মধ্যদিয়ে। জারার নিরন্তর বকবকে শূন্য মনোযোগী হয়ে হেঁটে চলেছে পাশাপাশি।
জারা একা একাই কলকল করে চললো টিয়াপাখিটির মতো। বিরামহীন তার মুখ। আরশি কোনো প্রতিত্তোর করছে না দেখে, হুট করেই কথায় লাগাম টানলো
সে। তারপর বলে উঠলো,
‘এই আরশি? শুনলি আমি কী বললাম? ডাইনিং হলে বসবি?’
এবারেও রমনী উদাস। নিশ্চুপ তার কৌতূহল বাতিক।
পাল্টা প্রশ্ন তো দূর, হু-হা টুক করলো না। জারা প্রলম্বিত এক শ্বাস ফেললো। তারপর আরশির কাঁধে কনুই তুলে ভারী কৌতুক করে বললো,
‘মাথা নিচু করে পা চলছে ঠিকই কিন্তু মনটা বোধহয় নেই এখানে? তাহলে সে গেলো কোথায় বল তো? প্রফেসর সোয়ামীর কাছে?’
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
হুট করেই পদচারণা থেমে গেলো আরশির। টলমল করে উঠলো নেত্র সরোবর। পদ্মকোমল ঠোঁটগুলো ভেঙেচুরে এলো দুঃখে। অনুযোগের স্বরে বলে উঠলো,
‘কে সোয়ামী? উনি হলেন একটা আস্ত পাঁজি পঁচা জাম্বুবান। নচ্ছার লোক। তিন তিনটা বছর আমাকে নাকে দঁড়ি দিয়ে ঘোরানোর পর ভালোবাসি বললি! একটু তো সময় দে আমাকে ব্যাপারটা হজম করার? কিন্তু নাহ! মহাশয় হুটহাট চুমু খেয়ে নিচ্ছে? কথা নেই বার্তা নেই, রেগে যাচ্ছে! আবার ঠান্ডা হচ্ছে! আবার রেগে যাচ্ছে! বল! কারোর সহ্য হয় এসব?’
জারার জোর হাসি পেলেও সে হাসলো না। খুব কষ্টে দম ফাটা হাসিটা আঁটকে গলা পরিষ্কার করলো। তারপর গুরুগম্ভীর মুখে শুধালো,
‘হুটহাট চুমু টা কি শুধু সে-ই খাচ্ছে? নাকি লুকিয়ে চুরিয়ে তুইও একটু আধটু খাচ্ছিস?’
দৈবাৎ চমকালো আরশি। থমকে গেলো ওর একনাগাড়ে বলে চলা অভিযোগের থলি। পান্ডুর গালে গোধূলির রঙ নামলো। অপ্রস্তুত দৃষ্টি ফেললো এদিক-ওদিক। ইতস্তত হয়ে আওড়ালো,
‘একদমই না! তোর আমাকে দেখে মনে হয় আমি ওরকম? যে লুকিয়ে চুমু খাবো ঐ লোককে?’
জারা হাসি চেপে বিজ্ঞের মতো মাথা নাড়লো। বুড়ো আঙুল দিয়ে থুতনির পাশে স্লাইড করতে করতে বেশ ভাবুক হলো সে।
তারপর চিন্তিত স্বরে বলে উঠলো,
‘সবই তো বুঝলাম! কিন্তু শুধু শুধু মন খারাপ করে থাকলে তো আর তোর এই জাম্বুবানঘটিত সমস্যার সমাধান বের হবে না জান।’
আরশি নাটকীয় ভঙ্গিতে দুহাত জোর করলো। জারার দিকে চেয়ে মেকি বিষন্ন স্বরে উঠলো,
‘তাহলে কী করলে সমাধান বের হবে? রাজকুমারের মান ভাঙানোর জন্য এখন সাত সমুদ্দুর তেরো নদী পাড়ি দিতে হবে আমাকে?’
জারা উপায় বাতলালো তৎক্ষনাৎ। প্রথমে চোখ বড় বড় করে আওড়ালো,
‘অসম্ভব! আমার জান কেনো এসব করবে?’
‘এক্সাক্টলি!’
আরশির মেকি চোটপাটে ঠোঁট টিপলো জারা। তারপর বলে উঠলো,
‘উল্টে আমার মতে তোর উচিত এক্ষুনি প্রফেসরের রুমে গিয়ে তাকে বলা, দেখুন আমার কিন্তু এসব সহ্য হচ্ছে না! আপনি রাগ কমালে কমান নয়তো আমি সন্ন্যাস নিয়ে গৃহত্যাগী হবো।’
আরশি অবাক হয়ে হাঁটা থামালো। বিস্ময় ভর করলো তার দৃষ্টিতে। তারপর অসহায় স্বরে বললো,
‘ফট করে তো বলে দিলি গৃহত্যাগী হবো? কিন্তু গৃহত্যাগী যে হবো, হয়ে উঠবো টা কোথায়?’
জারার নিরুদ্বেগ উত্তর এলো সাথে সাথে,
‘কেনো? ডর্মে গিয়ে উঠবি!’
ডর্মের কথা শুনেই চোখমুখ চকচক করে উঠলো আরশির। প্রফেসরের বউ হিসেবে ডিসকাউন্ট না পেলেও ফ্রেশার হিসেবে ডিসকাউন্ট তো পেয়েই যাবে ডর্মে ওঠার। তাহলে আর চিন্তা কিসের? কিন্তু পরক্ষনেই ভ্রুকুঞ্চিত করে বললো,
‘এক সেকেন্ড! এক সেকেন্ড! তোদের বাসা থাকতে রাগ করে আমি ডর্মে উঠতে যাবো কেন’
‘তুই একা উঠবি নাকি? আমিও তো উঠবো তোর সাথে। বেস্ট ফ্রেন্ডের মন খারাপ মানে আমারও মন খারাপ! গট ইট জান?’
দুই বান্ধবী থেমে রইলো না। সাজিয়ে গেলো শেহজাদকে বলার জন্য একের পর এক লাইন। জারাও থাকবে শুনে আরশি যেনো একটু বল পেলো। জোর দিয়ে বললো,
‘হ্যাঁ! ডর্মে গিয়েই উঠবো!’
‘গুড! তারপর বলবি, আপনার মুখও দেখবো না!’
‘সাথে স্নোবলকে দিয়ে আপনার সবগুলো চার্জারের ক্যাবল কেটে ফেলবো।’
‘ঠুসঠাস চুমু টুমু তো একদম খেতে দেবো না!’
এপর্যায়ে আরেকদফা থতমত খেলো আরশি।
পা জোড়া থেমে রইলো পোরসেলিন টাইলসের মেঝেতে। তারপর দাঁড়িয়ে থেকেই ফিরে চাইলো জারার দিকে। ওভারকোটের উপর দিয়ে কোমরে হাত রেখে বললো,
‘তুই কিন্তু মেইন টপিক থেকে সরে যাচ্ছিস জারা! আমরা কী নিয়ে আলোচনা করছিলাম? ঐ নচ্ছার, পাঁজি, পঁচা জাম্বুবানকে নিয়ে! সেখানে চুমুর মতো এতো মিষ্টি, আদর-আদর জিনিস নিয়ে আসলে তো চুমুরও অপমান! ঐ খিটখিটে বুড়োর সাথে যায় নাকি এসব?’
জারা প্রতিত্তোরে কিছু বলতে গিয়েও সামনে তাকিয়ে থামলো। চোখের ইশারায় চুপ করতে বললো আরশিকেও। কিন্তু সে পাবলিক চুপ করার নয়। অভিযোগ আর অনুযোগের স্তবক আওড়ে গেলো শেহজাদের নামে,
‘এই যে, আজ ওনার ক্লাস ছিল না? তারপরও কি পারতেন না আমার সাথে একবার এসে একটু কথা বলতে? বা কাউকে দিয়ে আমাকে ডেকে পাঠাতে? কিন্তু না! তা তো উনি করলেনই না, উল্টে আমি যখন তার রুমে যেতে চাইলাম তখন স্টাফকে দিয়ে সাফ বলে পাঠালেন অনুমতি নেই? সে ব্যস্ত?’
ঠোঁট কামড়ে হাসি চাপলো জারা। আনত মুখে অপেক্ষা করলো আরশির বড়সড় চমকটা পাওয়ার। হলোও তাই! কথাগুলো বলে মাথা ঘোরানোর সঙ্গে সঙ্গে আরশির নাকটা গিয়ে প্রবল ধাক্কা খেলো শক্ত কিছুর সঙ্গে। ছিটকে পড়ার আগেই বাহু আগলে ধরলো মজবুত একটা হাত। পরপর হ্যাঁচকা টানে বুকের সাথে মিশিয়ে শুধোলো,
‘খিটখিটে বুড়োর ব্যস্ততার জন্য আ’ম সরি! তাই বলে যখন ডেকে পাঠালাম তখন দেখা না করে চলে যাওয়ার মানে টা কী মিসেস শেহজাদ?’
প্রবল বিস্ময়ে কৃষ্ণকালো অক্ষিকোটর ছানাবড়া হলো আরশির। শেহজাদের পৌরুষস্বরে বেমালুম ভুলে বসলো খানিক আগের অভিমানী রমনীকে। বিস্ময় কমতেই কল্পলোক মনে হলো সবটা। তবে কি কল্পনায় এলো শেহজাদ? তন্দ্রালু স্বরে জানালো,
‘কেনো দেখা করবো আপনার সাথে? আর মুখের ওপর পাষাণ পুরুষের মতো সামনে আসতে বারণ করে এখন প্রেমিক সাজার কারণ?’
‘অভিমান করেছো?’
আরশি চোখ নামালো। গাল ফুলিয়ে বললো,
‘অভিমান নয়! অভিমান করলে কথা বলা উচিত না! কিন্তু আমি যেহেতু কথা বলছি। তারমানে আপনার বুঝে নিতে হবে..!’
বাকি কথাটুকু কেড়ে নিলো শেহজাদ। বৃদ্ধা আর তর্জনী আঙুলের মাঝে রমনীর চিবুক তুলে ফেরালো নিজের দিকে। তারপর বেশ প্রশ্রয়ের স্বরে বললো,
‘বুঝে নিতে হবে, অভিমান আর নেই এখন! উফফ! ফাইনালি আমাদের প্রেমটা তারমানে হচ্ছে? অ্যাম আই রাইট ম্যাডাম?’
মূহুর্তেই আরক্তিম হলো ঝরা বেলীর মতো স্নিগ্ধ মুখখানা। ঐ সমুদ্রসম নীল চোখে চোখ রাখতে পর্যুদস্ত আরশি হাঁসফাঁস করে বলে উঠলো,
‘মোটেই না! আপনার উপর হওয়া প্রচুর রাগটা এখনো আছে। একটুও কমেনি! কেনো তখন ওভাবে বেরিয়ে গেলেন বাড়ি থেকে? বাবা কত কষ্ট পেয়েছেন আপনি জানেন? আজ কিন্তু আমার সাথে আপনিও সমান দোষী। ভুলে গেলেন সে কথা?’
শেহজাদের স্বভাবসুলভ ভারীস্বর উদ্বেগী হলো। কাতর প্রেমিকের মতো প্রশ্ন করলো,
‘বেশ! তাহলে তুমিই বলে দাও, এই দোষী, পঁচা, পাঁজি জাম্বুবানের তার বউয়ের রাগ ভাঙানোর জন্য কী কী করা উচিত?’
শেহজাদের কাতর কন্ঠে রমনীর মনে কড়া নাড়লো সদ্য বয়ঃসন্ধির প্রেম। লাজুক লাজুক চাওনি ঘাড় ফেরাতেই কানের পাশে সেই পরিচিত মুখটা ফিসফিস করে আওড়ালো,
‘আপতত হাজারখানেক চুমু? আর বাকি আদর বাসায় গিয়ে! চলবে?’
হৃদ প্রকোষ্ঠে হার্টবিট মিস হলো আরশির। ভীষণ লজ্জায় কাবু হলো অন্তঃপট। অলিন্দের গতি দীর্ঘশ্বাস আর বিষন্নতা হারিয়ে ছুটতে লাগলো চঞ্চলা কিশোরীর মতো। তক্ষুনি বহুদূর থেকে যেনো ভেসে এলো এক বিরাগী নারীকন্ঠ। ইংরেজিতেই বললো,
‘মিস আরশি! আপনি ঠিক আছেন? কি সব বলছেন তখন থেকে নিজের মতো করে?’
আরশির হুঁশ ফিরলো যেনো। সামনে তাকিয়ে সম্মুখীন হলো প্রবল অসন্তুষ্ট মুখে দাঁড়িয়ে থাকা মিসেস বেলার। গোলগাল হৃষ্টপুষ্ট মুখখানা হতাশ হয়ে আওড়ালো,
‘মিস আরশি! আমার মনে হয় আপনি ডিপ্রেসড। কতক্ষণ ধরে ডাকছি শুনছেনই না। কাইন্ডলি ভালো একজন ডক্টর দেখান। আপনি ক্লাসেও আজকে বেশ অমনোযোগী ছিলেন। একজন ইন্টারন্যাশনাল স্টুডেন্ট হিসেবে আপনাদের থেকে অনেক বেশি এক্সপেক্টেশন রাখি আমরা। সেখানে আপনি..’
মিসেস বেলার বাকি কথাগুলো আর কর্ণধার অবধি পৌঁছোলো না আরশির। কেমন ধোঁয়াশার মতে লাগলো সেসব। ধীরে ধীরে অক্ষিপটে ভাসলো খানিকক্ষণ আগের ঘটনা। সবটাই অলীক ভেবে নিজেকে বুঝ দিতে পারলো না সে। এতো বাস্তবও কি কখনো হতে পারে কল্পলোক?
মিসেস বেলা অনেকটা সময় নিয়ে আরশিকে তাদের এক্সপেক্টেশন, রুলস এন্ড রেগুলেশন বুঝিয়ে বিদেয় নিতেই শব্দ করে হেসে ফেললো জারা। হাসির দমকে চোখের কোটরে পানি জমলো। পেটে খিল ধরলো। তারপর আরশির কাঁধে ভর দিয়ে বললো,
‘বাপ রে কি প্রেম তোর আর মিসেস বেলার। উনি ইংরেজিতে তোকে ঝাড়ছিলেন আর তুই বাংলার জীবনানন্দ তাকে বনলতা ভেবে বসলি। কী কী সব বলছিলি ভাই! আচ্ছা কাকে ভেবে বলছিলি সেসব বলতো? সত্যি করে বলবি! আমি একটুও হাসবো না!’
আরশির মুখভার। জারার দুষ্টুমিতে কিঞ্চিৎ বিরক্ত হলেও ফের গুটিয়ে গেলো ভেতর ভেতর। যাকে ভেবেছিল সে কি আদৌও মনে রেখেছে ওকে? ভেবেছে ওর কথা একবারও আজ? কেনো বলবে তার নাম সে?
আর বললেই যে জারা হাসবে না,
তার গ্যারান্টি কী?
তাও ভালো, ভাগ্য সুপ্রসন্ন থাকায় মিসেস বেলাকে চুমু টুমু খেয়ে বসেনি সে! এটুকুই যা স্বস্তি। নইলে প্রান প্রিয় বান্ধবীর হাসাহাসির তোপে এতক্ষণ আর দাঁড়িয়ে থাকতে হতো না এখানে!
নিউইয়র্কের মতো ব্যস্ত শহরে সন্ধ্যে নামলো। হাজারখানেক ডিজিটাল বিল বোর্ড আর আর্কিটেকচারাল লাইটিংয়ে উদাসীনতা হারালো পথিকদের ক্লান্তচোখ। রাস্তার দুপাশে সোডিয়াম আলোয় চিকচিক করে উঠলো পেঁজা তুলোর মতো বরফের স্তুপ।
নিয়ন সাইনগুলো দিনের আলোর মতো আলো ঝলমলে করে রাখলো টাইমস স্কয়ার। ব্রুকলিন ব্রিজে বাড়লো জনসমাগম। যেখানে কপটকপোতীর উন্মাদ প্রেমে সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়লো কোনো এক হৃদয়ভাঙা তরুণ।
হাসান ভিলায়ও রোজকার মতোই আলো জ্বললো। মেহমেদ হাসান প্রিয়তমার জন্য কফি মগ হাতে রুমে এসে সাউন্ড বক্সের বাটন টিপলেন। সাউন্ড বক্সে তেষট্টি বছর বয়সী ফ্র্যাঙ্ক সিনাত্রা তার সুকোমল কন্ঠস্বরের উষ্ণতা ছড়িয়ে মৃদু লয়ে গেয়ে উঠলেন,
—‘I wanna wake up in that city, that doesn’t sleep
And find your king of the hill, top of the heap
Your small town blues, they’re melting away
I’m gonna make a brand-new start of it, in old New York’
মরিয়ম বেগমের হাতে ছোট্ট রুশার ফ্রেমে বাঁধানো ছবি। একটা ফুটন্ত গোলাপের মতো মুখে কি অনাবিল আনন্দে চেয়ে। ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে খিলখিল করে হেঁসে উঠতেই মূহুর্তটা ক্যামেরা বন্দী করেছিলেন মেহমেদ।
কিন্তু সেই রুশা আজ নেই, শুধু রয়ে গেছে তার স্থিরচিত্র।
মরিয়ম বেগমের বুক ভার হয়ে এলো। ফুঁপিয়ে উঠলেন মেয়ের ছবি বক্ষভাগে চেপে।
ঈষদুষ্ণ অশ্রুকণা গাল গড়িয়ে পড়ার আগেই হাতের আঁজলা পাতলেন মেহমেদ।
স্ত্রীর দুঃখটুকু মুঠোয় ভরে নরম স্বরে বললেন,
‘আর কত কাঁদবে মরিয়ম! আজ আঠারো টা বছর তো কেঁদেই গেলে। তুমি কাঁদলে যদি আমাদের রুশাকে উপরওয়ালা ফিরিয়ে দিতেনই, তাহলে এতোদিনে কী রুশা আমাদের কাছে ফিরে আসতো না বলো?’
মরিয়ম ভেজা চোখে মুখ তুললেন। শান্ত দৃষ্টিতে স্বামীর দিকে তাকিয়ে বলে উঠলেন,
‘রুশা আর ফিরবে না! ও মারা গেছে! এই সত্যিটা আমার থেকে লুকিয়ে কী শান্তি পেলে বলো তো?’
মেহমেদ হাসান স্তব্ধ। মূর্তির ন্যায় শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন খানিকক্ষণ। তারপর শুকনো ঢোক গিলে বললেন,
‘যে সত্যিটা কষ্ট দেয় তা জানার চাইতে একটা মিথ্যেকে খড়কুটোর মতো আঁকড়ে ধরে বাঁচার মধ্যে এক আলাদা আত্মিক প্রশান্তি অনুভব করা যায়! আমি বোধ হয় সেরকম কোনো প্রশান্তিই দিতে চাইছিলাম তোমাকে! আ’ম সরি মরিয়ম।’
বিবাহিত জীবনে এই প্রথম বোধ হয় মরিয়ম বেগম রাগলেন। বীতস্পৃহায় মুখ ফিরিয়ে নিলেন একপাশে। দাঁতে দাঁত চেপে বলে উঠলেন,
‘এটাকে ঠকানো বলে মেহমেদ। তুমি আমায় ঠকিয়েছো! ভাগ্যিস আজ ড্রয়ার খুলে তোমার ফাইল বের করতে গেছিলাম! নয়তো দেখে যেতো মেয়েটার ডেথ সার্টিফিকেটটাও তুমি সরিয়ে ফেলেছো আমার চোখের আড়ালে।’
মেহমেদ হাসান পোড়া শ্বাস ফেললেন। অনুতাপে রুদ্ধ হওয়া অক্ষিপটে ঝাপসা দেখলেন হঠাৎ। অপরাধবোধে মাথা নোয়ালেন। তবে কী কাঁদছেন তিনি?
ফ্রাঙ্ক সিনাত্রারার গানের মতোই হয়তো নিউইয়র্ক শহর কখনো ঘুমায় না। এ শহরে নীরবতা নগন্য। সর্বদায় নিয়ন সাইনে জ্বলজ্বলে এর অলিগলি। হর্ণ আর ট্রাফিকে তটস্থ চলাচলের রাস্তা। সাবওয়ে ট্রেন ছাড়া হেঁটে বাড়ি ফিরলে চোখে পড়বে নানা স্ট্রিট পারফর্মেন্স। কেউ গান গাইছে, তো কেউ সুর তুলছে গিটার অথবা স্যাক্সোফোনে।
জারা বিকেলে মিসেস লরেন্স এর সাথে দেখা করতে গিয়েছিল। চাকরির প্রথম দিনে থাকতে না পারার সীমাহীন লজ্জায় যখন পর্যুদস্ত সে, তখন মিসেস লরেন্স হেসে বলছিলেন,
‘ইটস ওকে ডিয়ার। আয়ান ফোন করে আমাকে জানিয়েছিল যে তুমি আজ হয়তো আসতে পারবে না। আমি সেভাবেই অন্য টিচারদের শিডিউল করে দিয়েছি। কিন্তু আগামীকাল ঠিক টাইমে চলে এসো! কেমন? তোমার স্টুডেন্টরা নতুন টিচারকে দেখবে বলে মুখিয়ে আছে। তুমি আসলে ওদের সত্যিই খুব ভালো লাগবে!’
দাঁড়িয়ে গান শুনতে শুনতে মনে মনেই স্মিত হাসলো মেয়েটা। একহারা মুখটা ম্যাগনোলিয়া ফুলের মতোই স্নিগ্ধ লাগলো আলো-আঁধারির মধ্যে। ঝিরিঝিরে তুষারকণারা ঢেকে দিতে চাইলো লাজবন্তীর মেদুর আদল। অন্তঃস্থলে বইলো বসন্তের হাওয়া। তখনই কানে এলো এক রিনরিনে মেয়েলী কন্ঠ। হাতে গিটার। ইংরেজিতেই আবদার করে বললো,
‘ম্যাম! আপনি গাইবেন আমার সাথে?’
জারা হকচকানো দৃষ্টিতে চাইলো মেয়েটির দিকে। সবাই হাততালি দিতেই ভারী লজ্জায় পড়ে গেলো বেচারি। কতবার বলতে চাইলো গান গাইতে সে পারে না। তবে সে কথা কেউ শুনলে তো?
অগত্যা মাইক্রোফোন হাতে নিয়ে মধ্যমণি হলো পঞ্চাশোর্ধ মানুষের। চোখ বন্ধ করতেই নীলাম্বরীর মানসপটে ভাসলো সেই হাসিখুশী মুখখানা। প্রাঞ্জল মুখশ্রীর এক দাপুটে তরুণ। যার প্রেমে পড়ে গানটাও রপ্ত করে ফেললো রমনী। গেয়ে উঠলো
লতা মঙ্গেশকরের বহু পুরোনো একটি গান,
‘isliye tujhse main pyaar karoon
ki too ik badal aawara
janam janam se hoon saath tere
hai naam mera jal ki dhara..’
হিন্দি গানের অর্থোদ্ধার না করতে পারলেও পাশে দাঁড়ানো মেয়েটা গিটারে চমৎকার সুর তুলতে ভুললো না। তবে এমন মনোহর সংগীতাবোহ তৈরি হতেই সবাইকে চমকে দিয়ে ভিরের মধ্যে থেকে ভেসে এলো এক পৌরুষ কন্ঠ। তালাত মাহমুদের অংশটুকু গাইলো সে,
‘itna na mujhse tu pyaar badha
ki main ik badal aawara
kaise kisi ka sahara banoon
ki main khud beghar bechara..’
পরিচিত কন্ঠ শুনেই চোখ মেললো জারা। তৎক্ষনাৎ দৃষ্টি গিয়ে ভিড়লো একজোড়া হেম চোখে। চোখাচোখি হতেই হৃদপিণ্ড থমকালো জারার। ভালোবাসায় বুদ হলো মস্তিষ্ক। যার সুরের মূর্ছনায় শহর হারালো, তার হেমচোখে অপলক চেয়ে রইলো জারা।
প্রেমিকার মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে নিঃশব্দে হাসলো আয়ান। গান থামাতেই যেনো করতালিতে ফেটে পড়লো সবাই।
ভির ঠেলে জারার মুখোমুখি এসে দাঁড়ালো কালো জ্যাকেট আর এলোমেলো চুলের মানুষটা। পরপর সবাইকে অবাক করে দিয়ে হাঁটু গেড়ে বসে পড়লো জারার পায়ের কাছে।
উল্লাসে ফেটে পড়লো পথচারীরা। কয়েকজন তো মোবাইলবন্দী করতে লাগলো আয়ানের পাগলামী। গিটার হাতের মেয়েটা আয়ানের হাতে মাইক্রোফোন এগিয়ে দিতেই বান্দা লুফে নিলো সেটা।
জারা তখনও ফ্যালফ্যালে চোখে তাকিয়ে। দৃষ্টিতে বিভ্রম। যেনো আশেপাশের সবটাই কাল্পনিক। তরুণীর কল্পলোকের সেই রাজকুমার তার দিকে চেয়ে ঠোঁট কামড়ে হাসলো। তারপর পকেট থেকে বের করলো একটা ছোট্ট চারকোনা বক্স আর একটা লাল গোলাপ। নিজেই বক্সটা খুললো জারার সামনে। যেখান থেকে আলো ছড়িয়ে মাথা তুললো ছোট্ট পাথরের একটা আংটি।
জারাকে তৃতীদফায় বাকশূন্য করে মাইক্রোফোন হাতে আয়ান বলে উঠলো,
‘উইল ইউ মেরি মি বাটারফ্লাই?’
আশপাশের মানুষের আনন্দচিৎকারের কমতি নেই। সবাই সমস্বরে বলতে লাগলো,
‘সে ইয়েস..সে ইয়েস!’
বিস্ময়াভূতের মতো কতক্ষণ চেয়ে থেকে ঝরঝর করে কেঁদে ফেললো শক্তপোক্ত মেয়েটা। সে কি এক অদ্ভুত অনুভূতি! মুখে হাত চেপে কোনো এক অজানা তাগিদেই ক্রমাগত মাথা নাড়লো জারা।
দুটো ভালোবাসার মানুষের এমন মূহুর্ত উদযাপনে কার্পণ্য করলো না নিউইয়র্ক শহর। ভীষণ করতালিতে আরেকদফা কানে তালা লাগলো সবার।
তুষারের শহর আর জারার ভেজা চোখ সাক্ষী হলো আয়ানের আংটি পরানোর দৃশ্যের।
জারার বা হাতের অনামিকা আঙুলে জ্বলজ্বল করলো আয়ানের দেয়া সেই আংটিখানি। ভালোবাসার মানুষের শ’খানেক চুমুতে সিক্ত হলো জারার মসৃণ কপাল। শীর্ণ গতরখানা শক্তপোক্ত বুকটায় মিশিয়ে নিয়ে আয়ান বললো,
‘ভালোবাসি বাটারফ্লাই! খুব খুব বেশি ভালোবাসি!’
জারা ফোপাঁতে ফোঁপাতে ক্লান্ত হয়ে ছেড়ে দিয়েছে শরীরের সমস্ত ভর। নিস্তেজ হওয়া গলায় বললো,
‘আপনি খুব পঁচা গান বানরমশাই! এতো পঁচা গলার গান আমি কোত্থাও শুনিনি!’
আয়ান হাসলো। বড্ড স্বতঃস্ফূর্ত দেখালো সেই হাস্যোজ্জ্বল সৌম্য মুখ। যেনো নিজের প্রশংসা শুনেছে এমন কন্ঠে বললো,
‘তাহলে তো রোজ শোনাতে হয় এই পঁচা গলার গান!’
জারা মুখ তুললো আয়ানের বুক থেকে। পেলব হাতজোড়া আরো শক্ত করে আয়ানকে জড়িয়ে ধরে ভেজা চোখে শুধালো,
নে আদরে জড়িয়ে মন পর্ব ৪১
‘আর রোজ রোজ এই পঁচা গলার গান শুনে হজম করলে আমি কী পাবো?’
আয়ান ভাবুক স্বরে বললো,
‘নির্ঘুম রাত আর পাগলের মতো আদর? চলবে ম্যাডাম?’
জারার চোখ বড় বড় হয়ে গেলো মূহুর্তেই। আকাশসম লজ্জায় মুষড়ে পড়লো আয়ানের বুকে। মুখ লুকালো চওড়া সিনায়। আকুন্ঠ লজ্জায় প্রাণনাশ হলে কাল খবরের হেডলাইনে জারার নামটা উঠে যেতো নির্ঘাত।
আয়ান প্রেয়সীর এমন লজ্জা দেখে ঠোঁট টিপলো। তারপর কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে আওড়ালো,
‘আবারো বলছি! ভালোবাসি বাটারফ্লাই! ভীষণ ভালোবাসা। যতটা ভালোবাসলে মরে যাওয়া যায়, তার থেকেও বেশি ভালোবাসি তোমাকে!’