অশ্রুজলে বোনা বিয়ে সিজন ৩ পর্ব ৪৪

অশ্রুজলে বোনা বিয়ে সিজন ৩ পর্ব ৪৪
ইয়াসমিন খন্দকার

আরুশি হতবাক চোখে আমানের দিকে তাকায়। আমানের কোলে থাকা মেয়েটির পিতা সে। আরহাম এখনো বিয়ে করে নি! তাহলে নির্ঝর খান কি এত দিন তাকে এক মিথ্যার মধ্যে রেখেছিল? আরুশি বুঝতে পারে না কিভাবে নিজেকে সামলাবে। এমন সময় আরহাম বল ওঠে,”কে বলেছিল তোমাকে যে আমি বিবাহিত? আর কেন তুমি ভেবেছিলে এই বাচ্চাটা আমার?”
আরুশি এতটাই হতবাক হয় যে কিছু বলে উঠতে পারে না। তার মুখ দিয়ে যেন আজ কোন শব্দই নিঃসৃত হতে চায় না। আরহাম ব্যাপারটা বুঝে আলতো করে আরুশির কাধ স্পর্শ করে বলে,”একদম ভয় পেও না আরুশি। আমি আছি তো তোমার পাশে৷ নির্ভয়এ সমস্ত সত্যটা আমায় খুলে বলো। কেন তুমি এত গুলো দিন আমার থেকে দূরে ছিলে? কেন আমার সন্তানের পরিচয় আমার থেকে লুকিয়ে রাখলে?”

আরুশি হঠাৎ করে ফুপিয়ে কেঁদে ওঠে। রাজীব আরহামের উদ্দ্যেশ্যে বলে,”তার মানে এত দিন ধরে তোমাদের মধ্যে একটা ভুল বোঝাবুঝি জিইয়ে রেখে তোমাদের সম্পর্কটা নষ্ট করা হয়েছে। এর জন্য তুমি বা আরু কেউই দায়ী নও। তোমরা দুজনেই পরিস্থিতির স্বীকার।”
“কি হয়েছে সেটা আমার সম্পূর্ণ খুলে বলুন। আমি কিছু বুঝে উঠতে পারছি না।”
আরুশি এবার বলে ওঠে,”আমি স্বেচ্ছায় তোমার থেকে দূরে সরে আসি নি আরহাম। সেদিন আমি হাসপাতালে তোমাকে খাবার দিতে চাই, তখনই আমি টেস্টের মাধ্যমে জানতে পারি যে আমি প্রেগন্যান্ট। আমি এই খুশির খবরটা তোমাকে জানাতে যাই কিন্তু সেই সময় শুনি তুমি তোমার বাবাকে কথা দিচ্ছ আমায় ডিভোর্স দেবে। এই কথাটা শুনে আমি সম্পূর্ণ ভেঙে পড়ি। আমার মনে হয়, তুমি আমাকে নিজের থেকে দূরে করে দেবে নিজের বাবার জন্য। আর আমাদের সন্তানের কথা জানলে তাকেও আমার থেকে কেড়ে নেবে। এজন্য আমি তোমায় কিছু..কিছু না জানিয়ে আমাদের সন্তানকে নিয়ে একা রাজীব ভাইয়ের সাথে খুলনায় চলে আছি।”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

আরহাম ক্রন্দনরত স্বরে বলে,”আমি তো শুধু ড্যাডের ঐ অবস্থায় সান্ত্বনা দেয়ার জন্যই এই কথাটা বলেছিলাম। এর পেছনে আমার অন্য কোন উদ্দ্যেশ্য ছিল না। আমি কখনোই তোমাকে ছাড়া অন্য কাউকে বিয়ে করার কথা কল্পনা করতে পারি না আরুশি৷ তুমি কেন একটিবার এই বিষয় নিয়ে আমার সাথে মুখোমুখি হয়ে কথা বললে না? তাহলে হয়তো আজ পরিস্থিতি ভিন্ন হতো৷ আর এত গুলো দিন আমার সাথে যোগাযোগই বা কেন বিছিন্ন করে রাখলে? আমার সন্তানের ব্যাপারে জানার কোন অধিকার নি আমার ছিল না?”

“আমি তোমাদের সাথে যোগাযোগ করতে চেয়েছি আরহাম। আর এজন্য বাড়ির ল্যান্ডলাইন নাম্বারে কল করেছিলাম। কিন্তু সেই সময় ফোনটা রিসিভ করেছিল তোমার বাবা। আর তিনি ফোন রিসিভ করে জানান যে…তুমি…তুমি নাকি অন্য কাউকে বিয়ে করে নতুন জীবন শুরু করেছ। আর সেজন্য..সেজন্য আমি নিজেকে আরো বেশি করে গুটিয়ে নেই। এরপর আর কখনো তোমাদের সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টাও করি না। ”
কথাটা শুনে সম্পূর্ণ বাকরুদ্ধ হয়ে যায় আরহাম৷ পাশে থাকা একটি চেয়ারে বসে পরে চুপচাপ। আমান রাগী স্বরে বলে,”ছি! ড্যাড এত নিচে নামল কিভাবে? এভাবে এত মিথ্যা বলে তোমাদের সম্পর্ক শেষ করে দিল। এর জন্য ড্যাডকে আমি কখনো ক্ষমা করব না।”
আরহাম ভাঙা গলায় বলে,”আমার ছেলেকে একটু আমার কোলে দেবে আরুশি? ওকে আমি একটু আদর করতে চাই।”

আরুশি জাঈদকে আরহামের দিকে ঠেলে দেয়। আবেগাপ্লুত হয়ে জাঈদকে জড়িয়ে ধরে আরহাম। জাঈদ কিছু বুঝে উঠতে না পেরে হতবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে। রাজীব বলে ওঠে,”উনি তোমার পাপা জাঈদ..যাকে তুমি এত দিন ধরে খুঁজে বেরিয়েছ!”
জাঈদও আবেগাপ্লুত হয়ে বলে,”পাপা!”
নিজের ছেলের মুখে পাপা ডাক শুনে নিজেকে আর ধরে রাখতে পারে না আরহাম। একদম ছোট বাচ্চাদের মতো করে সে কাঁদতে শুরু করে। আমানও নিজের বড় ভাইকে এই পরিস্থিতিতে দেখে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়ে।
তার চোখের কোনেও জল দেখা যায়। এদিকে আমিনা কিছু বুঝে উঠতে না পেরে বলে,”কি হয়েচে আব্বু? চবাই এবাবে কাঁদচে কেন? আর ঐ চেলেটা কি বড় আব্বুর চেলে হয়?”
“হ্যাঁ, সোনা। ও হলো জাঈদ, তোমার বড় আব্বুর ছেলে। তোমার কাজিন। আর উনি হলেন আরু আপাই..তোমার বড় আম্মু।”

আমিনা খুশি মনে বলে,”তার মানে বড় আব্বু আবার তার হারানো পরিবারকে পিরে পেয়েচে। আমার কুব ভালো লাগচে। একন আমরা চবাই একচাতে তাকব তাই না?”
“হ্যাঁ, সোনা এখন আমরা সবাই একসাথে থাকব।”
আরহাম হঠাৎ করে ক্রোধিত কন্ঠে বলে,”একসাথে থাকব তো নিশ্চয়ই কিন্তু তার আগে ড্যাডের সাথে আমার কিছু বোঝাপড়া করা বাকি আছে।”
“কিসের বোঝাপড়া?”
“ড্যাডের কারণে আমি এত দিন নিজের স্ত্রী সন্তান থেকে দূরে ছিলাম। আমি নিজের সন্তানের পিতৃত্ব থেকে বঞ্চিত হয়েছি। এসব কিছুর জবাব ড্যাডকে দিতেই হবে।”
বলেই রক্তিম চোখে তাকায় আরহাম। তার পুরো মুখবিবর শক্ত ও রাগান্বিত।

আফিফা খান সব কিছু জানতে পারলেন আমানের কাছে। এতদিন পর আরুশির সন্ধান পেয়ে তিনি যতোটা না আনন্দিত হয়েছেন তার থেকে অনেক বেশি কষ্ট পেয়েছেন নিজের নাতির ব্যাপারে জেনে এবং নিজের স্বামীর অপকর্মে। তিনি আমানকে বলে ওঠেন,”তোমাদের ড্যাড এত জঘন্য কাজ কিভাবে করল? তার জন্য আমাদের বাড়ির ছেলে..আমার নাতি এতগুলো দিন পরিবার ছাড়া বড় হলো..এর ফল তোমাদের ড্যাডকে পেতেই হবে।”
বলেই রক্তিম চেহারা নিয়ে আফিফা খান ছুটে যান নির্ঝর খানের রুমের দিকে। আফিফা খান কে দেখেই নির্ঝর খান বলেন,”তুমি হঠাৎ আজ এত দিন পর আমার রুমে?”

“হুম, শেষবারের মতো এলাম।”
“মানে?”
“তুমি এতোটা নীচ কিভাবে হতে পারলে? তুমি তো সেই নির্ঝর নও যাকে আমি ভালোবেসেছি।”
“যা বলার স্পষ্ট করে বলো।”
“কি বলবো আর? কিছু বলার মুখ রেখেছ কি তুমি? শুধুমাত্র নিজের ভুল ধারণা, জেদ, আধিপত্য বজায় রাখতে গিয়ে তুমি নিজের ছেলের জীবন পুরো নষ্ট করে দিয়েছ। নিজের সন্তানের জীবন অন্ধকারে ডুবিয়ে দিয়েছ। আরুকে কি বলেছিলে তুমি? কিসের জন্য আরু এত গুলো বছর আমাদের থেকে দূরে রইল।”
নির্ঝর খান কিছু বলেন না। আফিফা খান রেগে বলেন,”চুপ করে আছ কেন? তোমার সত্যটা এবার সামনে এসে গেছে। আর চুপ থেকেও কোন লাভ নেই। এবার সত্যটা স্বীকার তোমায় করতেই হবে। নিজের অন্যায়ের ফল পেতে হবে।”

“কোন অন্যায়ের কথা বলছ তুমি? আমি যা করেছি তা একদম ঠিক করেছি।”
“এখনো তোমার অহংকার ভাঙেনি? তুমি জান, তোমার এই কাজের জন্য আমাদের বাড়ির সন্তান এত দিন আমাদের ছাড়া মানুষ হয়েছে।”
“কি?”
“হ্যাঁ, আরু ও আরহামের ছেলে।।আমাদের নাতি..,,,শুধুমাত্র তোমার একটা মিথ্যার জন্য ওর কথা আমরা জানতে পারি নি। আমার ছেলেটা তার পিতৃত্ব থেকে বঞ্চিত হলো।”
“আরুশি তো আমায় এই ব্যাপারে আমায় কিছু বলে নি।”
“কিভাবে বলবে? ঐ বেচারিকে তুমি ওর প্রেগ্যান্সির সময় যা কষ্ট দিয়েছ তারপর ও কোন মুখে সব বলতো? না জানি এত গুলো বছর মেয়েটাকে কত কষ্ট সহ্য করতে হয়েছে। কিন্তু আর না,এবার আমরা সবাই দাড়াবো আরুর পাশে। আর তুমি তোমার এই অহংকার নিয়ে এখানে একাই পড়ে থাকো।”

অশ্রুজলে বোনা বিয়ে সিজন ৩ পর্ব ৪৩

বলেই আফিফা খান বেরিয়ে যায়। আর এদিকে নির্ঝর খান ভীষণ অস্বস্তি বোধ করেন। এই প্রথম তিনি অনুশোচনা বোধ করতে থাকেন। এমন সময় নিঝুম খান লাঠিতে ভড় দিয়ে সেখানে উপস্থিত হয়ে বলেন,”আমি সব শুনেছি..”
“আমি কি সত্যিই কোন দোষ করেছি মম?”
“হুম, করেছ। তোমার দোষের জন্য আজ একটা বাচ্চাকে, তোমার নাতিকে ঠিক সেই শৈশব কাটাতে হয়েছে যা তুমি কাটিয়েছ, আরহাম আর আরুশিকে সেই কষ্ট ভোগ করতে হয়েছে যা আমি আর তোমার বাবা করেছি। তোমার এই ভুলের কোন ক্ষমা হয় না”

অশ্রুজলে বোনা বিয়ে সিজন ৩ পর্ব ৪৫