প্রেমের সমর সিজন ২ পর্ব ১৬
অলকানন্দা ঐন্দ্রি
সুহার হাতে ব্যান্ডেজ। চোখজোড়া বুঝে শুয়ে আছে। স্বচ্ছ দীর্ঘশ্বাস ফেলে এবারে। একহাতে সুহার চুলে হাত বুলাতে বুলাতে স্বচ্ছ নিরব চেয়ে থাকে ওর মুখপানে। তারপর অনেকটা সময় পর সে মাথা নুইয়ে চুমু বসাল সুহার কপালে। পরপরই সুহার গালে চুমু বসাল। স্বচ্ছ একজন পুরুষ মানুষ। লোকসম্মুখে কান্না বারণ তার। তবে স্বচ্ছ সে নিয়ম মনে না করে সুহাকে চুমু দিতে দিতেই চোখ লাল টকটকে হয়ে উঠে। যেন চোখের পানি পড়বে এক্ষুনিই। স্বচ্ছ কিছুট্ সময় স্থির তাকিয়ে থেকে আক্ষেপ নিয়ে ভেজা স্বরে বলে,
“ আমি জানি না বিধাতা আমায় কিসের শাস্তি দিচ্ছে সুহাসিনী। কেন বিধাতা কাউকে আমার শত্রু তৈরি করে পাঠালেন। আমি চাইনি কেউ আমাকে শত্রু হিসেবে দেখুক সুহাসিনী, কেউ আমার ভালোব্সার জিনিসগুলোর প্রতি নজর দিক আমি চাইনি। তবুও নজর দিয়েছে। বারংবার আমার ক্ষতি করার চেষ্টা করেছে সুহাসিনী। প্রথমে তোমার আর আমার এক্সিডেন্ট করানোর চেষ্টা চালাল। ভাবল আমরা মরে যাব সেই এক্সিডেন্ট। অথচ আমরা বেঁচে ফিরলাম। তারপরও আসল কাল্প্রিটকে খুুজে বের করতে আমার কম সময় যায় নি। আমি যখন খুঁজে বের করলাম, আমার সাথে সাথে তোমাকে হ’ত্যা করার চেষ্টা কিংবা আমার প্রিয় মানুষটার লাইফও রিস্কে ফেলার কারণে তাকে দিনের পর দিন আমি শারিরীক যন্ত্রনা দিয়েছি সুহাসিনী। জানে মারতে পারিনি, কারণ যতই হোক সে আমার চাচা। রক্তের সম্পর্ক! তিহানকে যে খুব ভালোবাসতাম সুহাসিনী। ওর আব্বুকে নিজ হাতে কিভাবেই বা মেরে দিই বলো? কিন্তু ওটাই পাপ হলো। ঐ খু’নী পালিয়ে গেল একদিন। আমি তখন ভয় পেয়ে গেলাম। ভাবলাম যদি তোমার উপর আক্রমন হয়?তার উপর তখন তুমি দুয়েকমাসের প্রেগন্যান্ট সুহাসিনী!”
আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন
এটুকু বলেই স্বচ্ছ ঢোক গিলে। সুহার সুস্থ হাতটা এবার হাতের মধ্যে আগলে নিয়ে বলল,
“ সিদ্ধান্ত নিলাম এদেশেই থাকব। ফিরব না আর। এর জন্য যা যা কিছু করতে হতো তার জন্য একবার দেশের বাইরে যেতে হয়েছিল আমার। এবং তার ফল কি হলো জানো সুহাসিনী? ঐ জা’নোয়ারটা এবার আবারও ওখানে আমার উপর হামলা চালানোর চেষ্টা করল। আবির আর আমি একটা গাড়িতেই ছিলাম সেবার। মাঝপথে আমি কি একটা কারণে নেমে পড়াতে গাড়িতে কেবল আবিরই ছিল। এবং ফলাফল কি হয়েছিল জানো সুহাসিনী? ঐ পাষন্ড লোকটা আমায় হ’ত্যার উদ্দেশ্যে নিজেই গাড়ি চালিয়ে আক্রমন চালাল। আর তারপরই শোনা গেল ঐ এক্সিডেন্ট দুই গাড়ির এক চালক মারা যায় এবং অপরজন হসপিটালে ভর্তি। সেবার আবিরের জন্য কলিজা লাফিয়ে বের হয়ে যাচ্ছিল যেন। বহু খোঁজ করে যখন আবিরকে পেলাম তখন শুনলাম আবির কোমায়। এবং যে লোকটা মারা গিয়েছিল সে আমারই আপন চাচা। এরপর আমি ভেবেছিলাম যে আর কোন শত্রু বোধহয় আমার সত্যিই নেই। আমি তার লা’শ নিয়ে দেশে ফিরলাম , আবিরের খোজ নিতে মাঝেমাঝে যেতাম। কিন্তু আমার একবারও মনে হয় নি সে শত্রুর শত্রুতার রেশ আমার সন্তানকেও দিতে হবে সুহাসিনী। আমি জানি, আমি জানি তুমি আমায় কেন ঘৃণা করো সুহাসিনী। কেন আমাদের মেয়ের মৃত্যুর জন্য আমাকেয় দায়ী মনে করো। ”
স্বচ্ছ ফের ফ্যাঁসফ্যাঁস করে বলে,
“ আমি একজনকে হারিয়েছি সুহাসিনী। একজনকে আমি না চাইতেও হারিয়ে ফেলেছি। কিন্তু তোমাকে হারাতে চাই না। তোমাকে কিছুতেই হারাতে পারব না সুহাসিনী। এত ভয় আমি আর সামলাতে পারি না। কেন এমন করো সুহাসিনী? কেন? আমি তো এমন চাইনি। সত্যিই চাইনি এমনটা। ”
এইটুকু বলতে বলতেই স্বচ্ছ কান্না পেল। ঢোক গিলে সে। সুহা ততক্ষনে ক্লান্ত চাহনিতে তাকায় স্বচ্ছর দিকে। এতক্ষন সব শুনেছে কিনা স্বচ্ছ বুঝে উঠে না। তবে স্বচ্ছকে অমন করে রক্তিম চোখে তাকিয়ে থাকতে দেখে হালকা হেসে বলে সে,
“ চিন্তা করছিলেন নাকি? কিন্তু বেঁচে গেলাম তো এবারও স্বচ্ছ। ”
কথাটায় কি ছিল যেন জানা নেই তবে স্বচ্ছ একমুহুর্তও দেরি করল না সুহাকে জড়িয়ে নিতে। বলে উঠল অস্থিরভাবে,
“ বাঁচতেই হবে তোমাকে সুহাসিনী। তুমি ছাড়া আমি শূণ্য। ”
সুহা নিশ্চুপ থাকে। আত্মহত্যা মহাপাপ। সুহার এটা অজানা নয়। কিন্তু তবুও সুহা আজকাল বাঁচতে পারে না। নিঃশ্বাস ফেলতে পারে না। যখন থেকে জানতে পারল সেদিন ছাদে তিহান ছিল। তিহানই তাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলল এবং কারণটা হলো স্বচ্ছর সাথে শত্রুতা। কারণ স্বচ্ছ তার বাবাকে অনেকদিন আটক রেখেছিল এর কারণে সে তার বাবার মৃত্যুর জন্য স্বচ্ছকেই দায়ী করে। সুহা মাঝেমাঝে একদম স্বাভাবিক আচরণই করে যেন পুরোপুরি সুস্থ সে আবার মাঝেমাঝেই তার মাথা ঠিক থাকে না। পাগলামো শুরু হয়। সুহা স্বচ্ছর পিঠে হাত রাখে আলতো করে। বলে,
“ আমাদের মেয়েটাকে ছাড়া ও কি আপনি পূর্ণ আছেন স্বচ্ছ? ”
স্বচ্ছ ফুঁফিয়ে কেঁদে উঠে এবারে। বলে,
“ আমি চেয়েছিলাম তাকেও। বিধাতা রাখেননি। বোধহয় আমার কারণেই রাখেননি”
সুহা নিরব চেয়ে থাকে। গড়িয়ে পড়ে চোখ বেয়ে পানি। বলে,
“ বিধাতা রাখেননি? নাকি তাকে রাখতে দেওয়া হয়নি স্বচ্ছ? বলুন.. ”
স্বচ্ছ মুখ তুলে তাকায়। সুহার দিকে চেয়ে নির্বাক তাকিয়ে থাকে। তারপর বহু কষ্টে বলার চেষ্টা করে,
“ সুহাসিনী.. ”
সুহা এবারে অস্বাভাবিক ভাবে চিৎকার করে কেঁদে উঠে। নিজের চুলগুলো নিজেই টেনে ধরে পাগলের ন্যায়। দাঁতে দাোত চেপে চিবিয়ে চিবিয়ে বলে,
“ ওকে মেরে ফেলা হয়েছে স্বচ্ছ। ওকে সত্যিই মেরে ফেলা হয়েছে। আমি মা হয়ে মেনে নিব এটা? আর আপনি? আপনি তো সবটা জেনেও শুরু থেকে চুপ আছেন স্বচ্ছ। আপনাকে ঘৃণা করব না? করাটা কি অনুচিত বলুন? আপনি এখনও আমার মেয়েটার খুনীর কোন শাস্তি নিশ্চিত করেননি। করেননি। ”
ফের আবার বলতে লাগে,
“ আমি তো জানতাম না আমার বাচ্চাটার এত শত্রু আছে। তাও তার বাবার কারণেই সে পৃথিবীতে জম্মানোর আগেই অনেকে তাকে শত্রু হিসেবে ভেবে এসেছে।তার বাবা তো জানত তার গুঁটিকয়েক শত্রু থাকতে পারে তাই না?তবুও কেন আমার বাচ্চাটাকে আগাম সতর্কতা নিয়ে রক্ষা করল না? কেন বাঁচিয়ে রাখল না? ”
সুহা কাঁদে। কাঁদতে কাঁদতে হেচকি উঠে মেয়েটার। সবশেষে ক্লান্ত স্বরে স্বচ্ছর কাছে কাঁদতে কাঁদতেই আকুতি নিয়ে বলে,
“ আমাকে একটা বাচ্চা এনে দিন স্বচ্ছ। আমি তাকে নিয়ে থাকব। নয়তো আমাকে আমার মেয়ের কাছে যেতে দিন। বিশ্বাস করুন, আমি ঘুমাতে পারি না আমার মেয়েটার কান্নায়।”
এভাবে বলতে বলতেই সুহা জ্ঞান হারাল। চোখ বুঝে পড়ে রইল। স্বচ্ছ ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। দীর্ঘশ্বাস টেনে ভারী আওয়াজে বলে,
“ আমি একবার বেবি নিয়ে তোমাকে হারানোর ভয়ে ক্ষতবিক্ষত হয়েছি সুহাসিনী।ডক্টর যখন থেকে বলেছিল ঝুুকি ছিল তখন থেকেই। আর এখনও রোজ ভয় পাই তুমি কি না কি করে ফেলবে এই ভেবে। আমি তোমাকে হারাতে চাই না সুহাসিনী। ”
স্বচ্ছ ডক্টরের সামনে বসা৷ কপালে চিন্তার রেখা তার। ডক্টর এবারে ছোটশ্বাস টেনে স্বচ্ছকে শুধালেন,
“সম্ভবত একটা বেবিই পারে ওর ভেতরের এই যন্ত্রনাটা মুঁছে দিতে স্বচ্ছ। আর, সুহা কিন্তু তোমার প্রতি রাগ জেদ যায় দেখাক তোমাকে এখনো ভালোবাসে স্বচ্ছ। তার মাঝে এখনও তোমার জন্য একটা সফট কর্নার আছেে।তুমি কৌশলে তা কাজে লাগিয়ে তাকে সুস্থ করতে পারো। ”
স্বচ্ছ স্থির তাকায়। বলে,
“ ও বোধহয় আমায় সত্যি সত্যিই ঘৃণা করে ডক্টর। কারণ আমার মেয়েটা আমার অসতর্কতার কারণেই মারা গিয়েছিল ডক্টর।”
ডক্টর শান্তস্বরে বোঝালেন,
“ আমি সবটা জানি স্বচ্ছ। কিন্তু তুমি তো ইচ্ছে করে করোনি। নিজেকে দোষ দিও না স্বচ্ছ। তোমার শত্রু থাকতেই পারে। এর জন্য তোমার সন্তান মারা গেলে এটা তোমার দোষ নয়। ”
“ আমার আরেকটু সতর্ক হওয়া উচিত ছিল ডক্টর। ছাদ থেকে ধাক্কা দেওয়াটা যে তিহান করতে পারে এটা আমার মাথাতে কাজই করেনি। পরবর্তীতে যখন জানলাম তখন থেকে তিহান নিরুদ্দেশ।আমি এখনও আমার বাচ্চাটার জন্য কিছুই করতে পারিনি ডক্টর। ”
ডক্টর স্বচ্ছর হাতের উপর হাত রাখলেন। বললেন,
“ আপনার তো করার কিছু নেইও স্বচ্ছ। সে অপরাধ করেছে, এর শাস্তি আইন তাকে দিবে। আপনি যদি আগের বারেও আপনার চাচাকে আইনের আওতায় অন্তর্ভুক্ত করতেন তাহলে বোধহয় সমস্যাটা এতটুকু বাড়ত না স্বচ্ছ।”
আবির ছাদে বসা।পাশে বসে আছে ছোটন। প্রতিদিনের মতো সিগারেট ফুঁকছে না সে। বরং নিরব চেয়ে আছে আকাশের পানে। আবির পাশে বসা ছোটনের দিকে চেয়ে হালকা হাসে। বলে,
“ তোর বোন এখন কি করছে বলতো?একটু কথা বলিয়ে দিবি তোর বোনের সাথে? ”
আবার ফের ছোটনের দিকে চেয়ে ভ্রু নাচিয়ে বলে,
“ আমার সাথে যে রাতদুপুরে এসে বসে আছিস তোর বোন কিছু বলবে না? ”
ছোটন তাকায়। হালকা হেসে বলে,
“ তুমি আপুকে অনেক ভালোবাসো তাই না আবির ভাই? ”
আবির উত্তর দেয়,
“ একটুআধটু।
ফের প্রশ্ন আসে,
“ ভালোবাসা ঠিক কেমন তোমার কাছে?”
“ আমার কাছে ভালোবাসা মানে তোর বোন।তোর বোনের পাগলামো। আমি ভালোবাসা বুঝতে পেরেছি সর্বপ্রথম তোর বোনকে দিয়েই। ”
ছোটন উৎসুক দৃষ্টিতে চেয়ে এবারে বলে,
“ আপু তোমার প্রথম প্রেম? ”
আবির উত্তর করে,
“ ঠিক প্রেম নয়। তবে প্রথম অনুভূতি ওই।গোপন অনুভূতি, যে অনুভূতির কথা তোর বোনকে অব্দি জানতে দিইনি। ”
ছোটন হেসে উঠে। ফোন নিয়ে ছুটিকে ভিডিও কল দিতে দিতে হেসে বলে,
“ আপুর সাথে কথা বলবে না? ”
আবির মুহুর্তেই উত্তর দিল,
“বলি একটু। বোকাপাখির কন্ঠ শোনার বড্ড ইচ্ছে হচ্ছে। ”
ছোটন কল দিয়েই ফোনটা আবিরের হাতে দিল। আবির অপেক্ষায় থাকল কবে কল রিসিভড হবে । বুক ঢিপঢিপ করে তার কেমন। ঠিক তখনই কর তোলা হলো। ওপাশ থেকে ভেসে এল ছুটির স্নিগ্ধ চাহনি। আবির মুখটার দিকে তাকিয়েই বুকের বা পাশে হাত রাখে। বলে,
“ বহু তো লুকোচুরি হলো। লাভ কি হলো শুনি? ধরা তো পড়লিই বোকাপাখি। ”
ছুটি মনোযোগ নিয়ে তাকায়। আবিরকে ফোনের স্ক্রিনে দেখে ভ্রু কুঁচকায় সে। বলে,
“ আপনি? আপনি কেন ছোটনের ফোনে? ”
আবির হেসে বলে,
“ মনে হলো তোকে বহুদিন জ্বালাই না। ”
ছুটি বিরক্ত যেন। উত্তরে বলে,
“ এরপরও যে সবসময় জ্বালাবেন এমন তো নয়৷ দুদিন জ্বালিয়ে আবারও হয়তো নিরুদ্দেশ হয়ে যাবেন। তখন তো আমার মানাতে কষ্ট হবে। এর চাইতে ভালো যোগাযোগ না হোক।”
আবির খোচা দিয়ে বলল,
প্রেমের সমর সিজন ২ পর্ব ১৫
“ তোর তো বয়ফ্রেন্ড আছে। কষ্ট কেন হবে? আমাকে তো আর এখন ভালোবাসিস না। ”
ছুটি জ্বলন্ত চাহনিতে তাকায়। উত্তরে বলে,
“ একদম। আমার ভুল হয়েছে জীবনে আপনার মতো কাউকে ভালোবাসা। আমার সত্যিই নিজের উপর রাগ হয় এই ভেবে যে আমি আপনাকে কেন ভালোবাসলাম।কোন দুঃখে!আমার আর জীবনে কিচ্ছু বাকি থাকল না। ”
আবির হেসে উঠে। ঠোঁট বাকিয়ে বলে উঠে,
“ কি করবি এখন আর? ভালোবেসে সব তো দিয়েই দিয়েছিস বল? এখন নতুন করে ভেবে আর লাভ নেই।”