যতনে রাখিলাম যাতনা পর্ব ২৯
মম সাহা
এমন করে দোর খুলতেই সুখের আবহাওয়া তৈরি হওয়ার ঘটনা সওদাগর ভিলাতে নতুনই। দরজার ওপাশে একেবারেই অপ্রত্যাশিত ভাবে চাঁদনীকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সকলের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ যেন মিনিট কয়েকের জন্য স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল।
অবনী বেগম তো ড্রয়িং রুম থেকেই চিৎকার শুরু করে এমন ভাবে রোজা সওদাগরকে ডাকতে শুরু করলেন যেন বাড়িতে দিনে-দুপুরে ডা কা ত পড়েছে।
“বড়ো আপা, আপা, তাড়াতাড়ি আসেন। দেখেন না কে আসছে। আপাগো তাড়াতাড়ি আসেন।”
সেই ডাক শুনেই রোজা সওদাগর নিজের রুম থেকে বেরিয়ে এসেছেন। মাথার চুল ভেজা। হয়তো গোসল সেরে তৈরি হচ্ছিলেন। বাহিরে রান্নাবান্না তদারকি করছিলেন আফজাল সওদাগর। ছোটো ভাইয়ের স্ত্রীর এমন হাঁকডাক শুনে তিনিও হুড়মুড়িয়ে দরজার কাছটায় এসে নিজের মেয়েকে দেখে অবাক, হতবিহ্বল হয়ে গিয়েছেন প্রায়।
এমন সুন্দর, শৌখিন, স্বপ্নের মতন দৃশ্য বোধহয় সিনেমাতেই দেখানো হয়। বাস্তব জীবনে এমন আনন্দ অকল্পনীয়। চোখে জলে জমিয়ে দেয়। আবেগের দুর্যোগ বুকের ভেতর ঝড় তুলে দেয়।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
রোজা সওদাগর, আমজাদ সওদাগরসহ সকলেই হুড়মুড়িয়ে এগিয়ে আসে। এতদিন পর সামনা-সামনি নিজের জীবনের সবচেয়ে কাছের মানুষটাদেরকে দেখে চাঁদনী নিজের পা-দুটো আটকে রাখতে পারল না। ঘুরেই জড়িয়ে ধরল বাবাকে। কতটা দিন পর এই সাক্ষাৎ? এই স্পর্শ! বাবার গায়ের ঘ্রাণ, বাবার জামার পুরোনো সেই নেপথানির পরিচিত গন্ধ কতদিন পর এসে লাগল নাকে! এই স্মৃতিই তো তাকে কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছিলো। তার বুকে জমে ছিলো ক্ষতের মতন। আজ কতটা শীতল লাগছে। বুকটা ঠান্ডা লাগছে। প্রাণ ফিরে এসেছে অনুভব হচ্ছে।
“আম্মারে, আম্মা, তুই এলি মা আমার? তুই অবশেষে বাবার বুকে এলিরে, মা। মা গো, কী যন্ত্রণায় পুড়ছিলাম এতগুলো বছর! অবশেষে এলি মা। বাপের পরাণ ঠান্ডা করলি, মা। বাপের পরাণ ঠান্ডা করলি।” বাবাটা বাচ্চাদের মতন বুলি আউড়িয়ে কাঁদছেন কেমন করে।
চাঁদনীও কি আটকাতে পারে চোখের জল? থামাতে পারে দূরত্ব মিটে যাওয়ার এই আনন্দের অশ্রুকে?
বাবাকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে রইল চুপ করে। রোজা সওদাগর এসে মেয়ের পিঠের উপর মাথা রাখলেন। মহিলাও কাঁদছেন হাউমাউ করে।
চাঁদনী মা আর বাবাকে জাপ্টে ধরে আছে। পাহাড় সে কীভাবে দেখতে যেতো এই স্বর্গগুলোকে না দেখে? মরে গেলে আফসোস থাকতো না? তাই তো শেষ মুহূর্তে ছুটে এলো দুনিয়ার সর্ব উঁচু বাবা নামক হিমালয়ের বুকে। মা নামক বৃক্ষের ছায়ায়। এরচেয়ে বড়ো পাহাড় আর হয় না-কি!
অন্ধকার, স্যাঁতস্যাঁতে রুমটিতে ভাপসা একটি গন্ধ। আবছায়া ভাব। মনে হয় দুঃখের অশরীরীরা নৃত্য করছে হাত তুলে। সেই আবছায়ার সাথে হু হু করে মিশে যাচ্ছে দীর্ঘশ্বাসেরা।
বনফুল ভাইয়ের কাছে আবদার করে বসল। মাথা হেলিয়ে দুলিয়ে বলল,
“আমারে বাড়ি নিয়ে চলো, ভাইয়া। এখানে যে মন টিকে না।”
বাহার ভাই বোনের হাত ধরে চুপ করে থাকেন। বোনকে এখান থেকে নেওয়ার জন্য এখানের দুই মাসের টাকা পরিশোধ করতে হবে। মোট সাঁইত্রিশ হাজার টাকার প্রয়োজন। অথচ তার কাছে সবে আছে আঠারো হাজার। তমসার টিউশনিটা না ছাড়লে হয়তো টাকাগুলো ম্যানেজ করা যেত। কিন্তু সেটাও ছেড়ে দিয়েছে। সরকারি চাকরিতে আবেদনই করা যাচ্ছে কেবল। চাকরি আর হচ্ছে না। জেল ফেরত আসামীকে চাকরি দিতে চায় কেই-বা? সে যতই নির্দোষ প্রমাণিত হোক।
“ও ভাইয়া, কবে নিয়ে যাবে আমাকে।”
আবুঝ বাচ্চাটির মতন প্রশ্ন। বাহার ভাই উত্তর দিতে গিয়ে গুটিয়ে যান। কী বলবেন? বোনের কি আর বোঝার মতন বোধ আছে? বুঝবে কি এই অর্থ সংকটের কথা?
বাহার ভাইয়ের এই চিন্তায় মগ্ন হওয়ার মুহূর্তে উপস্থিত হলো তুহিন। হাসিখুশি তার মুখটি। বনফুলের জন্য একগুচ্ছ গোলাপ ফুলের তোড়া এনেছে। উজ্জ্বল, চনমনে কণ্ঠে বলল, “এত সুন্দর রুমটি অন্ধকার কেন শুনি?”
তুহিনকে দেখেই বনফুল আনন্দে আত্মহারা হয়ে গেল। বাহার ভাইও খানিকটা অবাক হয়ে বললেন,
“তুমি এখানে?”
তুহিন এগিয়ে এলো। ফুলের তোড়াটি এগিয়ে দিলো বনফুলের দিকে। বেশ স্বাভাবিক কণ্ঠে বলল,
“হ্যাঁ। আজ না বনফুলের ছুটি?”
তুহিনের কথায় চমকে উঠলেন বাহার ভাই। ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বললেন, “ছুটি? কীসের ছুটি? কে বলেছে?”
তুহিনের এবার খটকা লাগলে। সামান্য ভ্রু কুঞ্চিত করে বলল, “কেন? এখান থেকেই তো আমার ফোনে কল গেলো। বলল, আজ বনফুলের ছুটি।”
বাহার ভাই অতি আশ্চর্য হলেন। ছুটে গেলেন ম্যানেজমেন্টের কাছে এবং জানলেন তার টাকা পরিশোধ করা হয়েছে। বনফুলকেও এখন বাড়ি নিয়ে যেতে পারবে।
ম্যানেজমেন্টের লোক বাহার ভাইয়ের হাতে একটি চিরকুটও ধরিয়ে দিলেন। যে টাকা পরিশোধ করেছেন সে নাকি এই চিরকুটটি দিয়ে দিয়েছে।
বাহার ভাই চিরকুট মেলে দেখলেন। ছোটো একটি লাইন। লাল কালিতে লিখা আছে— এতটুকু ঋণ থাকুক।
বাহার ভাই অবাক হয়ে লিখাটার দিকে তাকিয়ে রইলেন। এই লিখাটি তার পরিচিত বড়ো। চেনা চেনা লিখা। কে ন ঋণী করে দিয়ে গেলো তাকে? কী এত দায় সেই অপরিচিত মানুষটির?
বিয়ে বাড়িতে আনন্দে জড়িয়ে আছে কোণায় কোণায়। চাঁদনীর আগমন আনন্দকে দ্বিগুণ করে দিয়েছে যেন। চিত্রা কেবল ঘুরে-ফিরে চাঁদনী আপার কাছে যাচ্ছে। আপার গাল ধরে কেবল বলছে,
“আমার বিশ্বাস হয়না, তোমায় ধরতে পারছি আবার।”
চাঁদনী যেহেতু অহির রুমেই, অহির সাজগোছ করাচ্ছে নিজের হাতে সেহেতু চিত্রার কথা অহির কান অব্দিও পৌঁছাচ্ছে। আর অহি ততবারই মুচকি হাসছে। মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিয়ে বলছে,
“ঠিক। আমারও বিশ্বাস হচ্ছে না।”
অহি আপার সম্মতি পেতেই চিত্রা যেন আরেকটু উৎসাহী হয়ে উঠে। এরপর আরেকটু কৌতূহল নিয়ে বলে,
“তুমি সুন্দরও হয়ে গিয়েছো, আপা।”
অহি এবারেও সম্মতি জানায়। দুই বোনের পাগলামো দেখে চাঁদনী হেসে কুটিকুটি হয়।
বাড়িতে খুশি তখন গমগমে। সকলের আঙিনা বেয়েই যেন সদ্য খুশি ধরা দিচ্ছে। কেবল খুশিতে ভাঁটা পড়েছে একটি ঘরে। সেই ঘরটি অহির বাবা-মায়ের। ঘরটির ভেতরে গুমোট নীরবতা। বাহিরের হৈচৈ কেমন ঝনঝনিয়ে বাজে কেবল।
অহির মা- অবনী বেগম স্বামীর পাঞ্জাবি, পায়জামা আলমারি থেকে নামিয়ে নামিয়ে রাখছেন।
সবশেষে স্বামীকে বললেন, “তৈরি হও। ছেলের বাড়ির সকলে এলো বলে।”
আমজাদ সওদাগরের মুখ চোখ শুকনো। স্ত্রীর কথাকে তেমন গা না করে বললেন, “তুমি যাও রুম থেকে। আমি একা থাকতে চাই।”
“আমি তো তোমার কোলে উঠে বসে থাকিনি। না তোমার আগেপিছে ছুটছি। একাই আছো তুমি।”
স্ত্রীর বলার ভঙ্গিতে পরিবর্তন দেখে আমজাদ সওদাগরের কপালে তিন ভাঁজ পড়ল। কিন্তু তিনি আর রুক্ষ জবাব দিলেন না। বললেন, “আতরটা বের করে রেখো।”
“নিজে নিয়ে নিতে পারবে না? হাতে কি ন্যাবা হয়েছে?”
এবারের উত্তরটা যেন বদহজম হয়ে গেলো আমজাদ সওদাগরের জন্য। হতবিহ্বল হয়ে বললেন, “এ কেমন কথাবার্তা তোমার?”
“তোমার সাথে যেমন মানায়, তেমন।”
অবনী বেগমের এই কর্কশ আচরণ আমজাদ সওদাগরের জন্য বড্ড নতুন। তিনি বুঝার চেষ্টা করলেন হলোটা কী।
বাহির থেকে তখনই অবনী বেগমের ডাক আসতেই তিনি বেরিয়ে গেলেন। আমজাদ সওদাগরের এই থতমত মুখটিকে তাকে কিঞ্চিৎ আনন্দও দিলো বটে।
বাড়ি ভর্তি হয়ে গিয়েছে আত্মীয় স্বজনে। বাড়ির সামনে বাগনটায় বিয়ের আয়োজন করা হয়েছে। মানুষে রীতিমতো গিজগিজ করছে সেখানটায়।
চাঁদনী বসে আছে একটি সাইডে। সেখানেই সওদাগর বাড়ির বেশ অনেকে উপস্থিত।
চিত্রা কোনো একটি কথায় অট্টহাসিতে ব্যস্ত ছিলো। আজ মেয়েটা কারণে-অকারণে হাসছে। সাথে চাঁদনীও হাসছে৷
তখনই উপস্থিত একজন ঠেস মেরে বললেন,
“কতদিন পর চাঁদনী এলো বাড়িতে। তা ওর বিয়ে কবে ধরবেন, ভাইসাহেব? বয়স তো কম হলো না ওর।”
ভদ্রমহিলার প্রশ্নে সকলেই ফিরে তাকাল। মহিলাটি আর কেউই নয়, শাহাদাতের মা।
চাঁদনীর মুখটা শক্ত হয়ে গেলো নিমিষেই। আফজাল সওদাগর জবাব দেওয়ার আগেই একটি পুরুষালি কণ্ঠ বলে উঠল,
“বিয়ে করে আপনি কী করতে পেরেছেন জীবনে? সেই তো অন্যের বাড়ির মেয়ের বিয়ে নিয়েই পড়ে আছেন।”
মহিলা তাকালেন। সাথে তাকালো সকলেই। বাহার ভাইকে দেখে মহিলা রীতিমতো রেগে গেলেন। ধমকে বললেন,
“তুমি কী বলছো? আমি তো ওর ভালোর জন্যই বলছি। তাছাড়া বিয়ের কাজ ফরজ কাজ। ভাইজানেরা ওরে অবিবাহিত রেখে মরলে জান্নাতে যেতে পারবেন না-কি!”
যতনে রাখিলাম যাতনা পর্ব ২৮
বাহার ভাই এগিয়ে এলেন। হেসে দিলেন ফিক করে। নিজের চুলগুলোতে হাত বুলিয়ে বললেন,
“এই সমাজের মানুষের কেবল একটাই চিন্তা— অন্যদের কীভাবে জান্নাতে পাঠাবেন। অথচ নিজেরা যে এক পা জাহান্নামে দিয়ে রাখছে, তা নিয়ে মাথা ব্যথা নেই। তাই না,মৃন্ময়?”
মৃন্ময় হতাশ চোখে তাকিয়ে রইল কেবল। এমনিই সব ঘেঁটে ঘ হয়ে আছে। তার উপর তার আম্মু আলাদা মশালা মাখাচ্ছেন যেন।