আযদাহা সিজন ২ পর্ব ৪৭
সাবিলা সাবি
কক্ষটা একবারেই নিঃশব্দ। জানালার পাশে বসে আছে ফিওনা একবারে চুপচাপ, একা হয়ে।চোখের নিচে গাঢ় কালি পড়েছে, চুলগুলো এলোমেলো হয়ে আছে, ঠোঁটে কোনো শব্দ নেই। বাইরে হালকা বৃষ্টি শুরু হয়েছে। অল্প বাতাসে জানালার পর্দা মাঝে মাঝে সরে গিয়ে আবার পড়ে যাচ্ছে।
বিছানার পাশে রাখা পানির গ্লাসও কেউ ছুঁয়নি বহুক্ষণ।
কক্ষজুড়ে জমে থাকা বোবা এক বিষণ্নতা।
তখনই হঠাৎ দরজায় ধীরে ধীরে শব্দ হয়।
জ্যাসপার।
হাতের মধ্যে সাদা ছোট্ট একটা বাক্স। কিছু না বলে অনেকটা সময় দাঁড়িয়ে থাকে দরজার কাছটায়। তারপর ধীরে ধীরে এগিয়ে আসে, ফিওনার খুব কাছে।
“হামিংবার্ড…”
নরম কণ্ঠস্বর। যেন ভেঙে যাওয়ার আগের কাচের শব্দ।
ফিওনা কোনো উত্তর দেয় না।শুধু জানালার দিকে মুখ ঘুরিয়ে রাখে। তাকে দেখে বোঝা যাচ্ছছ—ভাঙা কিছু জিনিস জোড়া লাগতে সময় লাগবে।
জ্যাসপার ফিওনার সামনে বসে পড়, মেঝেতেই, একদম চুপচাপ।
“তুমি চাইলে আমাকে আর কখনো দেখো না…
চাইলে ঘৃণা করো, আঘাত করো আমাকে…কিন্তু আমি যা করেছিলাম, সেটা শুধুই তোমার জন্য। আমি সেই নিষ্ঠুর বাবা হতে চাইনি… আমি শুধু তোমাকে বাঁচাতে চাই।”
তার গলায় না বলা কষ্ট। তার চোখে ভয়, যেন ভালোবাসা হারানোর ভয়টা বেঁচে থাকার চেয়েও বড় হয়ে উঠেছে।
ফিওনার চোখে জল এসে পড়ে, তবুও কিছু বলে না। ঠোঁট কাঁপছে, কিন্তু শব্দ বেরোয় না।
জ্যাসপার ধীরে ধীরে সেই ছোট্ট সাদা বাক্সটা খুলে।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
ভিতরে একটা ছোট্ট কাঠের ফ্রেম ছিলো। ফ্রেমের মধ্যে জ্যাসপার নিজে তৈরি করেছে একটি নিখুঁত হ্যান্ডক্রাফট আর্টওয়ার্ক—একটা ঝকঝকে সবুজ ড্রাগনের ছবি, তার পাশে একটা ছোট্ট, স্নিগ্ধ হামিংবার্ড আর আরেকটি ডিম।
আর্টের নিচে জ্যাসপারের নিজ হাতের খোদাই করা ছোঁয়া স্পষ্ট— তাতে লেখা “My Family”।
আমি জানি, তুমি এখনই আমায় ক্ষমা করবে না। কিন্তু আমি তোমার সঙ্গে… আমাদের বেবির সঙ্গে… থাকতে চাই। শেষ একটা সুযোগ চাই, ফিওনা।”
একটানা বলা এসব কথার ভেতর জ্যাসপারের গলা ভিজে উঠেছে।
তখন ফিওনা আস্তে বলল— “তুমি… আমাকে আমার জীবনের সবচেয়ে বড় আঘাত দিয়েচো… তুমি বিশ্বাস ভেঙেছো আমার, প্রিন্স…”
জ্যাসপার দু’চোখ ভিজে ফিওনার চোখের দিকে তাকায়।
“তুমি আমার হৃদয়, ফিওনা। তোমার কিছু হলে… আমার বেঁচে থাকার মানে থাকবে না।আমি নিজেকে উৎসর্গ করে দিবো দরকার পড়লে। তবুও তুমি বেঁচে থাকো… আমাদের সন্তান বাঁচুক… আমি আর কিছু চাই না।”
এক মুহূর্তের নীরবতা।
তারপর ফিওনা ধীরে ধীরে জ্যাসপারের দিকে ফিরে তাকায়। সেই পুরনো চোখজোড়া যেন আবার কথা বলে।
“তুমি কি… সত্যিই চাও আমাদের সন্তান বেঁচে থাকুক?”
জ্যাসপারের গলা জড়িয়ে আসে, কণ্ঠস্বর নিচু হয়ে আসে “হাজার বার চাই।কোন বাবা চাইবেনা তার রক্ত তার অস্তিত্ব মহাবিশ্বের আলো দেখুক।
সেই মুহূর্তে ফিওনা ভেঙে পড়ে। জ্যাসপারের বুকের মধ্যে মুখ লুকিয়ে ধরে ফেলে ওর হাত।
বৃষ্টির পর সকালটা হালকা ধোঁয়ায় ঢাকা।
ফিওনা চোখ মেলে জেগে ওঠে—রাতের গভীর ঘুমের পর। জ্যাসপার হাত ধরে তাকে তুলে বসায়। সে আর কিছু বলেনি, শুধু বলেছে— “চলো…তোমাকে এক জায়গায় নিয়ে যাবো।”
ফিওনা কিছু না বুঝেই রাজি হয়।
গায়ে ওভারকোট জড়িয়ে, ধীরে ধীরে হাঁটে জ্যাসপারের সঙ্গে। তার অভ্যন্তরে একরাশ প্রশ্ন, কিন্তু এখন জিজ্ঞাসা করার মতো শক্তি নেই।
অবশেষে জ্যাসপার ফিওনাকে নিয়ে ল্যাবে প্রবেশ করে।
জমাটবাঁধা ঠান্ডা ধাতুর ঘ্রাণ। দেয়ালে প্রজেক্টর, স্ক্রিনে ডিএনএ-এর ছবি ভাসছে। একটা সাদা কোট পরা পুরুষ এগিয়ে আসে। ডক্টর আগ্নিস।এই ল্যাবের প্রধান গবেষক।
ফিওনার চোখ বিস্ময়ে বড় হয়ে যায়। জ্যাসপার চুপচাপ পাশে দাঁড়িয়ে থাকে। ডক্টর আগ্নিস একটা ট্যাবলেটে কিছু ছবি দেখাতে শুরু করেন।
“ফিওনা…তোমার গর্ভে যে প্রাণ বেড়ে উঠছে, সে পুরোপুরি শুদ্ধ ড্রাগন ।এটা একটা নতুন সত্তা—যার অস্তিত্ব এখনো কোথাও নেই। তার বেড়ে ওঠা কোনো সাধারণ প্রক্রিয়া না।”
ফিওনা তখনই প্রশ্ন ছোঁড়ে— “তাহলে প্রিন্স আমার সন্তানের জীবন নিয়ে খেলেছিলো কেনো?”
জ্যাসপার চুপ করে তাকিয়ে থাকে, কিছু বলে না।
তখনই ডক্টর আগ্নিস গম্ভীর গলায় বলে— “না, বরং সে তোমাকে বাঁচাতে চেয়েছে। তুমি পুরোপুরি ড্রাগন নও, তুমি অর্ধেক মানবী তার ফলে এই সন্তান জন্ম দিতে গেলে তোমার মৃত্যু নিশ্চিত কারন আর কিছুদিন পরেই তুমি দাঁড়াতেও পারবেনা। এমন ও হতে পারে জন্ম দেবার আগেও তোমার জীবন চলতে যেতে পারে। তাই আমিই প্রিন্সকে বলেছিলাম এই সন্তানের ভ্রুন এখানেই নিঃশব্দ করে দিতে।”
ফিওনার চোখে জল চলে আসে, কিন্তু এবার আর সেই জল কেবল দুঃখে নয়। তার কণ্ঠ দৃঢ় হয়— “যা-ই হোক, আমি আমার সন্তানকে হারাতে দেবো না। আমি লড়াই করব… যদি দরকার হয়, সমস্ত আকাশ, পৃথিবী,ভেনাস গ্রহ আমার বিরুদ্ধে গেলেও… আমি এই প্রাণটাকে আঁকড়ে ধরে রাখব!”
ডক্টর আগ্নিস মাথা নোয়ান সম্মানে। “তাহলে আমাদের একটা রিসার্চ শুরু করতে হবে। এতে ঝুঁকি আছে… কিন্তু যদি সফল হই, তাহলে তুমি আর তোমার সন্তান—দু’জনেই নিরাপদে বাঁচতে পারবে।”
জ্যাসপার কিছু না বলে ফিওনার দিকে তাকায়।
তার চোখে তখন একরাশ সংকল্প “তোমাকে আগামী ছয় মাসের জন্য পুরোপুরি ড্রাগনে রুপান্তরিত করা হবে তবেই আমাদের বেবি আর তুমি দুজনেই সুস্থ থাকবে।”
ডক্টর আগ্নিস আরেকটা কিছু বলার আগেই জ্যাসপার চোখ ইশারায় তাকে থামিয়ে দেয়। ফিওনা তখনো জানে না—জ্যাসপার ঠিক কী হারাতে যাচ্ছে।
ড্রাকোনিস শিখরের গবেষণা ল্যাবের গোপন দরজা অটোমেটিকভাবে খুলে গেল। ভেতরে বিস্ময়কর জিনবিজ্ঞান আর জৈব প্রযুক্তির সমন্বয়ে এক নতুন যুগের সূচনা হতে চলেছে।
ফিওনা ধীরে ধীরে ল্যাবের চেম্বারে প্রবেশ করে।তাঁর চারপাশে ভাসছে ড্রাগনের নিউরোন কোড, তিন মাত্রিক প্রজেকশন—ডিএনএ সিকোয়েন্সের উজ্জ্বল রেখা।
ডক্টর আগ্নিস গম্ভীর গলায় ঘোষণা করলেন—“ফিওনা, তোমাকে বাঁচাতে হলে আমাদের তোমার শরীরের জিনগত কাঠামো বদলাতে হবে। পুরো ৬ মাসের জন্য তুমি হয়ে উঠবে একজন পূর্ণ ড্রাগন।একমাত্র এভাবেই তোমার গর্ভে থাকা শিশু—নিরাপদে বেড়ে উঠতে পারবে।”
ফিওনার চোখ বিস্ময়ে জ্বলজ্বল করে ওঠে। “আমি কি… তখন আর মানুষ থাকব না?”
ডক্টর আগ্নিস মাথা নেড়ে বলেন “তুমি তখন হবে এমন এক সত্তা, যা কখনো দেখা যায়নি— পূর্ণ ড্রাগন শরীর, কিন্তু মানব হৃদয়।সন্তান জন্মের পরেই তুমি আবার তোমার আগের রুপে ফিরে আসবে হাইব্রিড ড্রাগন রুপে।
ফিওনা চোখ বন্ধ করে বলে— “আমি রাজি। যদি আমার সন্তান বাঁচে, তাহলে আমি ড্রাগনের আগুনও সহ্য করতে পারবো।”
ফিওনাকে রাখা হয় একটি জৈব ক্যাপসুলে। চারদিক থেকে লাল জ্যোতিতে মোড়ানো ডিএনএ রি-কোডিং শুরু হয়।
ল্যাবের ভেতরে আলো কমে এসেছে। কেবল মাঝখানে এক গোল সিলিন্ডার, যার চারপাশে ঘুরছে হাজারো ন্যানো-ক্রিস্টাল।
ডক্টর আগ্নিস সিস্টেম চালু করলেন।
হলোস্ক্রিনে জ্বলছে নির্দেশনা— “Initiate: Dragon-Womb Adaptation | Code: FIONA”
ফিওনাকে ঘিরে আভা ছড়াচ্ছে, তার দেহ ধীরে ধীরে প্রস্তুত হচ্ছে রূপান্তরের জন্য।ফিওনা এই মুহূর্তে চেতনা হীন হয়ে আছে।কিন্তু একটি ধাপ এখনো অসম্পূর্ণ—প্রধান উপাদান অনুপস্থিত।
ডক্টর আগ্নিস জ্যাসপারের দিকে এগিয়ে গিয়ে বললো
“আমাদের এখন দরকার একটি বিশেষ শক্তি—ড্রাগনের ‘জেনেটিক ফায়ারকোর’। এটা সাধারণ কোনো শক্তি নয়,” ডক্টর আগ্নিস বললেন, “এটা রাজপরিবারের উত্তরাধিকারী ড্রাগনের হৃদয়ের কেন্দ্র থেকে উৎসারিত ‘সোল-কোড ফ্লেম’।
এই শক্তি একবার দেওয়া যায়—দিলে আর ফেরানো যায় না।”
জ্যাসপার এক পা এগিয়ে আসে। জ্যাসপার নরম গলায় বললো “আমি জানি, এতে আমার পরিবর্তন হবে।তবুও আমি দিচ্ছি… কারণ এতে আমার ফিওনা রিস্ক ছাড়াই ড্রাগনে রুপান্তরিত হবে আমি ওকে নিয়ে আর একবিন্দু রিস্ক নিতে চাইনা।”
ডক্টর আগ্নিস থেমে গিয়ে বলেন—“তুমি যদি এটা দাও, প্রিন্স, তাহলে তুমি আর আগুনের রূপে ফিরতে পারবে না। তুমি হয়ে পড়বে… আগুনবিহীন ড্রাগন—রক্তে আগুন থাকবে, কিন্তু শরীরে ডানা, আঁশ, এমনকি মুখ দিয়ে আগুন ছোড়ার ক্ষমতাও থাকবে না আর ড্রাগনের প্রধান অস্ত্র আর শক্তি হচ্ছে আগুন ছোড়া।”
ড্রাগনের ‘সোল-কোড ফ্লেম’ একটি জেনেটিক-হার্ট ফায়ার, যা কেবল উত্তরাধিকারী ড্রাগনের হৃদয় থেকে পাওয়া যায়।
একবার দিলেই তা চিরতরে চলে যায়। ফেরত আনার কোনো উপায় নেই।তার ডানা ও মুখ দিয়ে আগুন ছোড়ার ক্ষমতা চলে যাবে।সময়ের সঙ্গে বা বিশেষ পরিস্থিতিতে এই শক্তি হয়তো কোনোভাবে জেগে উঠতে পারে, কিন্তু তার নিশ্চয়তা নেই।
ল্যাবের ভেতর নিস্তব্ধতা নেমে আসে।জ্যাসপার ধীরে পেছনে তাকায় ফিওনার দিকে, তার চোখে অস্থিরতা কিন্তু কিছু বলে না।
জ্যাসপার চোখ বন্ধ করে তার বুকে হাত রাখে। এক মুহূর্তের মধ্যে, তার বুকের মাঝখান থেকে বেরিয়ে আসে এক জ্বলন্ত শিখা— কিন্তু সেটা কোনো সাধারণ আগুন নয়, একটা সোনালি-বেগুনি আলোয় গড়া “সোল-কোড ফ্লেম”, যেটা শুধু হৃদয়ের গভীরতম বাঁধনে উৎসর্গ করা যায়।
শিখাটি ধীরে ধীরে ভাসতে ভাসতে চলে যায় রূপান্তর চেম্বারের দিকে… ফিওনার ভেতরে প্রবেশ করে… এবং পরিবর্তন শুরু হয়।
রূপান্তরের পরে, জ্যাসপার দাঁড়িয়ে ফিওনার দিকে তাকিয়ে থাকে। তার চোখে ক্লান্তি, কিন্তু শান্তির ছায়া ভেসে উঠে।
হঠাৎ ড্রাগন রুপ ধরে সে একবার মুখ খোলে— আগুন ছুড়তে চায়… কিন্তু কিছুই আসে না। আবার চেষ্টা করে… না। পুনরায় সে মানব রুপে পরিবর্তন হয়।
সে নিজের মুখে হাসি টেনে ফিসফিস করে—
“আমি এখন তোমায় আমায় হ্নদয়ের আগুন দিয়েছি, হামিংবার্ড… আমার আগুনের অস্তিত্ব আর নেই আর নেই,কিন্তু তাতে কিছু যায় আসে না, কারণ তুমি আগুন জ্বালাবে আমার হয়ে।”
রূপান্তরের শেষ ধাপে যখন “সোল-কোড ফ্লেম” ফিওনার শরীরে প্রবেশ করে, তখন তার সমস্ত স্নায়ুতন্ত্র যেন একসাথে ঝাঁকুনি খায়। প্রথমে ফিওনা একটা চিৎকার করে কিছুক্ষণ বাদেই চিৎকার বন্ধ হয়ে যায়। চোখ দুটি বন্ধ হয়ে আসে ধীরে ধীরে। ফিওনা অচেতন হয়ে পুনরায়।
তিনদিন সময় পেরিয়ে গেছে।
কক্ষের প্রতিটি দেয়ালে তখন নিস্তব্ধতা ঝুলে আছে। সময় যেন জমে আছে একটানা। ফিওনা ধীরে ধীরে নিঃশ্বাস নিচ্ছে, চোখ বন্ধ, ঠোঁট নিস্পন্দ। তার দেহে এখন প্রবাহিত হচ্ছে শুধুই স্যালাইন আর সেই রহস্যময় শক্তি—যা এসেছে জ্যাসপারের হৃদয়ের কেন্দ্র থেকে।
তিন দিন।
তিন রাত।
একটানা নিঃশব্দে সে লড়ছে রূপান্তরের এক অজানা যন্ত্রণার সঙ্গে। এই তিনদিনে জ্যাসপার একটু ও ঘুমায়নি।
তার আগুনের ক্ষমতা নেই আর। মুখে নেই আগুন ছোঁড়ার সেই শক্তি— কিন্তু তার চোখে এখনও জ্বলছে এক অদম্য প্রতিজ্ঞা। সে কেবল বসে থাকে ফিওনার পাশে।
কখনো জলপট্টি চেপে দেয় কপালে, কখনো নীরবে হাত রাখে হাতে। তার ভেতরের একটা অংশ যেন ধীরে ধীরে ফিওনার শরীরের মধ্যেই স্থান করে নিচ্ছে।
তৃতীয় দিনের দুপুরে এলড্র কেঁপে উঠে। একটা দামি গাড়ি এসে থামে ড্রাকোনিসের প্রাসাদের সামনে।
ফিওনার মা, লিয়ারা। আর সাথে তার ভাই রাজা জারেন—কঠোর মুখ, রাজকীয় ভঙ্গিমায়। তারা নেমে পড়ে গাড়ি থেকে।
দুজনেই তড়িঘড়ি করে প্রবেশ করেন ফিওনার কক্ষের দিকে।
আর প্রথম দৃষ্টিতেই লিয়ারা ছুটে গিয়ে ফিওনার শরীরে হাত রাখেন।
“ফিওনা! ফিও…না!” — গলায় ঝরে পড়ে শোক আর ভয়।
তার কণ্ঠ কেঁপে ওঠে, চোখ ছলছল করে। “আমি আর এক মুহূর্তও এখানে রাখছি না আমার মেয়েকে। আমি ওকে আমার নিজের কাছে, ফ্লোরাস প্রাসাদে নিয়ে যাচ্ছি!”
জ্যাসপার তখন ধীরে উঠে দাঁড়ায়।চোখে ক্লান্তির ছায়া, কিন্তু গলায় এক অদম্য স্থিরতা। “মাদার ইন ল। কাম ডাউন! আর ফিওনা শুধুমাত্র আপনার মেয়ে নয় এটা ভুলে যাবেন ও আমার ওয়াইফ আর এখন আমার সন্তানের মা হতে যাচ্ছে। আর এখন জন্য অবস্থা কিছুটা খারাপ তাই এই অবস্থায় ওকে কোথাও সরানো যাবে না।”
লিয়ারা মুখ তুলে তাকান। তার চোখে রাগ আর অভিমান।তুমি কী করেছো ওর সঙ্গে, বলো!”
জ্যাসপার ফিওনার দিকে তাকিয়ে বলে— “ওর হাইব্রিড ড্রাগন তাই ওর দেহ একজন শুদ্ধ ড্রাগনের সন্তান ধারন করার মতো পর্যাপ্ত ক্ষমতা ছিলোনা। তাই ওকে ছয় মাসের জন্য পুরোপুরি ড্রাগনে রুপান্তরিত করা হয়েছে রিসার্চের মাধ্যমে।”
লিয়ারা অবাক হয়ে যায় তবে সেও শিক্ষিত একজন নারী তাই তিনি বুঝতে পেরেছেন সবটা।
সবাই নিস্তব্ধ হয়ে যায়। জ্যাসপার পুনরায় বলে “আপনি এখানে থাকুন কিছুদিন… ওর পাশে। তবে তাকে আমার চোখের এক সেকেন্ডের আড়ালও করার চেষ্টা করবেন না।”
লিয়ারা চুপ করে যান। তিনি ফিওনার পাশে বসেন।
তার হাতটা ধরেন।জ্যাসপার আর কিছু বলে না। সে ধীরে ফিওনার অন্য পাশে বসে। তাদের মাঝখানে তখন ফিওনা—নিঃসাড়, কিন্তু তার চারপাশে জ্বলছে এক অভাবনীয় ভালোবাসার দীপ্তি।
পৃথিবীর সূর্য তখন ঢলে পড়েছে গোধূলির আকাশে। আলোর রেখাগুলো ছুঁয়ে যাচ্ছে বিলাসবহুল চীনা ভিলা ‘লিউ ম্যানর’ এর ছাদ। লিউ ঝানের বাবা মা লন্ডন থেকে নিজ বাড়িতে ফিরেছেন গত কয়েকদিন হলো।
লিউ ঝান প্রথমবারের মতো কাউকে এনেছে এই বাড়িতে, মা-বাবার সামনে। তার পাশে আজ দাঁড়িয়ে আছে অ্যাকুয়ারা—রূপে দীপ্তিমান, চাহনিতে ধীর অথচ গভীর কিছু।
গেট খুলে গাড়ি ঢুকলো। গাড়ি থেকে নেমে বাড়ির অভ্যন্তরে প্রবেশ করতেই। দেখলো তার বাবা মা ইতোমধ্যে সোফায় বসে আছেন। লিউ ঝানের মা দাঁড়িয়ে পড়েন। কিছুটা অবাক হলেও কিছুটা খুশি ও হন আর তিনি প্রশ্ন ছুড়ে দেন।
“তুমি তো কখনো কোনো মেয়েকে বাড়িতে আনোনি, আজকে হঠাৎ…কে ও?”
লিউ ঝান মৃদু হেসে বলে, “মম, ড্যাড… এ হলো অ্যাকুয়ারা। আমরা দুজন দুজনকে ভালোবাসি। আমি তাকে বিয়ে করতে চাই।”
ঘরে নেমে আসে মুহূর্তের নিস্তব্ধতা। তারপর লিউ ঝানের বাবা, একজন সংরক্ষিত, রুচিশীল ভদ্রলোক, সোফা থেকে উঠে দাঁড়ান।
“বিয়ে?” “তুমি তো এসব নিয়ে কখনো কথা বলনি!আমার এতো চেষ্টা করলাম তুমি তো বিয়ে যে রাজি হলেনা। ব্লাইন্ড ডেট না করেই মেয়েটাকে ফেলে চলে গেলে। কিন্তু যেহেতু ওকে এনেছো, নিশ্চয়ই ভাবনা-চিন্তা করেই এনেছো।”
তার মা ইতিমধ্যেই অ্যাকুয়ারার দিকে তাকিয়ে প্রশংসায় মুগ্ধ।
“অভিজাত, শান্ত, সুন্দর। অ্যাকুয়ারা দেখতে খুবই সুন্দরী। কোনো এক রুপকথা পরীর চেয়ে কম না।তবে তোমরা কোথা থেকে পরিচিত হলে?”
লিউ ঝান মুহূর্তকাল চুপ থেকে বলে— “ও লন্ডনের একজন বিখ্যাত বিজনেস্ ম্যানের ভাতিজি। খুব প্রাইভেট লাইফ রাখে ও। সম্প্রতি এক আন্তর্জাতিক কনফারেন্সে দেখা হয়েছিল, সেখান থেকেই… আমাদের সম্পর্কটা শুরু।”
অ্যাকুয়ারা মাথা নিচু করে এক চিমটি কাটে লিউ ঝানের হাতে।
লিউ ঝানের বাবা চশমা নামিয়ে চোখ মেলে তাকান— “তাহলে তো ভালো রক্তের মেয়ে… অভিজাত পরিবার।
তবে তার পুরো নামটা কী? আর তোমার সেই চাচা, মানে লন্ডনের লোকটা কে?”
লিউ ঝান ঠোঁটে নিঃসঙ্গ হাসি ফুটিয়ে বলে— “এখনই সব কিছু বলা যাচ্ছে না, ড্যাড। ওর পরিবার কিছুটা গোপন প্রোফাইল মেনে চলে। তবে চিন্তার কিছু নেই। আমি ভালো করেই জানি আমি কী করছি।”
তার মা হয়তো কিছুর ইঙ্গিত টের পান।কিন্তু তারা আর প্রশ্ন করেন না।অ্যাকুয়ারার প্রতি এক ধরনের সৌন্দর্য-ভিত্তিক আকর্ষণ তৈরি হয়ে গেছে তাদের মনে।ভদ্র, শালীন এবং অভিজাত ব্যবহার—সবটাই নিখুঁত।
তারা যখন খাবার টেবিলে বসে, লিউ ঝানের মা শুধু একবার মুখ টিপে হেসে বলেন “এই মেয়েটা যেনো ঠিক পৃথিবীর কেউ না… যেন অনেক গভীর কিছু লুকিয়ে আছে ওর নীল চোখে।”
অ্যাকুয়ারা হালকা হেসে চোখ সরিয়ে নেয়।তার ভেতরে থাকা হাজার বছরের ড্রাগন আত্মা যেন নিঃশব্দে হাহাকার করে—মনে মনে সে বলে “আপনি ঠিকই বলেছেন, মা… আমি এই পৃথিবীর কেউ নই। কিন্তু আপনার ছেলেকে ভালোবেসে ফেলেছি। মানুষরূপে, ড্রাগন হৃদয়ে।”
কক্ষটা নিস্তব্ধ। সামান্য হাওয়ার শব্দে সিল্ক পর্দা কাঁপছে ধীরে ধীরে। চন্দনের ধোঁয়া আর মৃদু জ্যোৎস্না মিলে ঘরের বাতাসে তৈরি করেছে এক অদ্ভুত মায়া।
রূপান্তরের পর তিনদিন কেটে গেছে।ফিওনা ছিল নিস্পন্দ—শুধু বুকের ধীরে ওঠানামায় বোঝা যেত,সাদা স্যালাইনের টিউব তার হাতে। চোখের নিচে হালকা গর্ত, ঠোঁট শুকিয়ে গেছে…তবুও তার ত্বকের উষ্ণতায় এখনো লুকিয়ে এক নতুন প্রাণের চিহ্ন—এক অর্ধ-মানবী ড্রাগনের নিঃশ্বাস।
তার মাথার পাশে বসে আছে জ্যাসপার।
চোখে লাল আভা, এক বিন্দু ঘুম নেই তিনদিন। তার কুঁচকে যাওয়া কোটের হাতায় চেপে আছে একটি মোচড়ানো মুঠো—অভ্যন্তরের ব্যথা ও দ্বিধার নিঃশব্দ চিহ্ন।
ডক্টর আগ্নিস বারবার বলছিলেন, “জ্ঞান ফিরবে… ধৈর্য ধরো প্রিন্স।” কিন্তু সে ধৈর্য কেমন যেন প্রতিবার ভেঙে গিয়েছিল ফিওনার নিস্তব্ধ মুখ দেখে।
অথচ ঠিক তখন…
একটি শব্দ—মৃদু, নিঃশব্দের মধ্যে ভেসে এলো
“… প্রিন্স?”
ফিওনার চোখের পাতায় হালকা কাঁপুনি। তার কণ্ঠ যেন অনেক দূরের গুহা থেকে ভেসে আসা বাতাস।
জ্যাসপার এক লাফে উঠে এলো, তার কপাল ফিওনার কপালের সঙ্গে ছুঁইয়ে বলল— “হামিংবার্ড… ফিওনা… তুমি… তুমি জেগে উঠেছ?”
ফিওনার চোখের কোণে জমে থাকা জল গড়িয়ে পড়ে।
তার ঠোঁট নড়ে, “তুমি… এখানেই ছিলে? সব সময়?”
জ্যাসপার মাথা নেড়ে, তার আঙুল ছুঁয়ে বলে— “তিনদিন, তিন রাত। তোমার নিঃশ্বাস গুনেছি আমি।”
ফিওনার ঠোঁটে একটুকু হাসি।তবে হঠাৎ মুখে একটা ব্যথার রেখা, সে কপাল ছুঁয়ে বলে— “আমার মাথায়… অদ্ভুত একটা অনুভূতি… কেমন যেন গরম, আবার ঠান্ডা। আমি কি… এখনো মানুষ?”
জ্যাসপার চুপ করে যায়। এক মুহূর্তের নীরবতার পর সে ফিসফিস করে “তুমি এখন আমার ভেনাস… আর আমি তোমার জন্য… আমার আগুন হারিয়েছি, ফিওনা।”
ফিওনার চোখ বড় হয়ে ওঠে। সে কিছুটা আন্দাজ করে এই রূপান্তরের পেছনে ছিল এমন এক ত্যাগ, যা কোনো স্বাভাবিক ভালোবাসার ভাষায় বলা যায় না।
তার ঠোঁট কাঁপে, কিন্তু কিছু বলে না। শুধু জ্যাসপারের হাত আঁকড়ে ধরে, চোখ বুজে ফেলে।
আর জ্যাসপার?সে জানে—এই চোখ দুটো যখন খুলবে পরেরবার, ফিওনা হবে সম্পূর্ণ ভিন্ন কেউ। এক মানবী নয়, এক নবজন্মপ্রাপ্ত ড্রাগন-রানী।
অবশেষে একজন সার্ভেন্ট গিয়ে সবাইকে খবরটা দিলো। ফিওনার জ্ঞান ফিরেছে।
আহত পাখির মতো সবাই ছুটে এল ফিওনার কক্ষে।
প্রথমেই ঢুকলেন লিয়ারা—ফিওনার মা। তার চোখে রাতভর না ঘুমানোর চিহ্ন, মুখে উদ্বেগ আর বুকের মধ্যে সঞ্চিত অশ্রুর স্রোত।
ফিওনার চোখ খুলতেই মা’কে দেখে প্রথমেই কাঁপা গলায় বলল— “মা…”
এক মুহূর্ত থেমে গিয়ে লিয়ারা ছুটে এসে মেয়েকে জড়িয়ে ধরলেন।মেয়ের গাল, কপাল, চোখ—প্রতিটি স্পর্শে যেন তিনি যাচাই করছেন, সত্যিই কি ফিওনা ঠিক আছে?
“…আমার বাচ্চা… আমার ফিওনা… মা তুমি ফিরে এসেছো… তোমাকে হারানোর ভয়টা…” কথাগুলো গলা ভেজা কণ্ঠে ভেঙে পড়ে।
ফিওনার চোখও ছলছল করে ওঠে।তিনদিন অচেতন থাকার পর এই স্পর্শ, এই কণ্ঠস্বর তাকে যেন প্রশান্তী দিলো।
ফিওনার মামা—লিয়ারার ভাই রাজা জারেন—পাশে এসে দাঁড়ান, চোখে গর্ব আর বিস্ময়। তিনিও হেসে ফিওনার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন।
জ্যাসপার একপাশে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকলেও, চোখ ছিল শুধু ফিওনার দিকে।
লিয়ারা হঠাৎ ফিওনার স্যালাইন আর ক্ষীণ শরীর দেখে অস্থির হয়ে বলেন— “আমি ওকে এখনই ফ্লোরাস প্রাসাদে নিয়ে যাবো। রাজ-চিকিৎসকেরা ওকে দেখবে। ও আমার একমাত্র সন্তান…”
ফিওনা, যার দৃষ্টিশক্তি এখনো সম্পূর্ণ ফেরেনি, শুধু হাত বাড়িয়ে বলে— “মা, আমি ঠিক আছি… আর প্রিন্স… ও আমাকে এক মুহূর্তের জন্যও ছেড়ে যায়নি… আমার যত্ন নিয়েছে” মা কাঁদতে কাঁদতে ফিওনার মাথায় চুমু খান।
ফিওনার জ্ঞান ফিরে আসার পর, চারপাশে একটু একটু করে জীবন ফিরছে। প্রাসাদের করিডোরে ধীরে ধীরে আলো জ্বলে উঠছে, নিঃশব্দ পায়ে কাজের লোকেরা হাঁটছে, কিন্তু লিয়ারার পায়ের নিচে যেন স্থির হয়ে আছে সবকিছু।
হঠাৎ, করিডোরের মোড় ঘুরতেই তার মুখোমুখি এসে দাঁড়ায় সিলভা— বর্তমানে প্রাসাদের অভিজাত ড্রাগনের স্ত্রী আর এক সময় ছিলো লিয়ারার সবচেয়ে আদরের ভাতিজী কিন্তু আজ সবচেয়ে দূরের।
দুজনের চোখ এক মুহূর্তে আটকে যায়।
সিলভা কিছু বলতে যাচ্ছিলো, কিন্তু লিয়ারা কথা না বলে চোখ সরিয়ে একপাশে সরে যান। শব্দহীন সেই অগ্রাহ্যের ভেতরে ছিল অভিমান, বেদনা, আর কোনো এক ভাঙা আস্থার ভার।
সিলভা দাঁড়িয়ে থাকলো… একা, অথর্ব, এবং চুপচাপ।
লিয়ারা নীরবে অতিথিকক্ষে গিয়ে দরজাটা টেনে দেন।
কক্ষটি রাজকীয় হলেও আজ যেন ছায়ায় ঢাকা।
এক কোণে বসে পড়েন রানী লিয়ারা।
প্রাচীর ঘেঁষে রাখা আয়নার দিকে তাকিয়ে তার মনে পড়ে যায় সেই দিন…
– ১৮ বছর পূর্বে।
এল্ড্র রাজ্যের ফুলে ঢাকা রাজউদ্যান। ফ্লোরাস রাজ্যর রাজকুমারী তখন ছিলেন যুবতী লিয়ারা। তিনি পৃথিবী ভ্রমনে যান আর তখনি প্রেমে পড়েছিলেন এক পৃথিবীর মানবের… যিনি কোনো রাজা নন, কোনো সৈনিকও নন, বরং ছিলেন এক সাধারণ লেখক। তবে তার লেখা অনেক লোভেল সেই সময়ে ব্যাপক নাম করেছিলেন।
তাদের প্রেম ছিল অমরত্বের প্রতিশ্রুতি ছাড়া, কিন্তু পূর্ণ আবেগে পূর্ণ। কিন্তু এই ভালোবাসার খেসারত দিয়েই তাকে হারাতে হয়েছিলো তার ভালোবাসার মানুষটা কে আর তাকে ১৮ বছর বন্দি থাকতে হয়েছিলো কারাগারে। স্বজাতি তাকে বিশ্বাস করেনি তাকে ক্ষমা করেনি, এবং প্রাসাদ থেকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিল তাকে।
তখনই, তিনি জানতেই পারেননি—তার শরীরে বেড়ে উঠছিল এক নতুন প্রাণ যেটা তিনি জন্ম দিয়েছিলেন পৃথিবীর এক চার্চে, কিন্তু যার কোনো পরিচয় তিনি জানতে পারেননি।
ছেলেই ছিলো না কি মেয়ে? জীবিত ছিল, না কি জন্মের পরেই মারা গিয়েছিলো?
এ প্রশ্নগুলোই তাকে ছিঁড়ে খেয়েছে দিনের পর দিন।
এবং সেই দিন…
যেদিন সিলভা ফ্লোরাস প্রাসাদ ত্যাগ করে এথিরিয়নের হাত ধরে চলে গেলো, কারও অনুমতি ছাড়াই, কারও চোখের সামনে দাঁড়িয়ে— ঠিক সেদিন লিয়ারা আবার একবার ভেঙে পড়েছিলেন।
“আমি কাঁদতে কাঁদতে রাত পার করেছিলাম।তুমি জানো না সিলভা… কেউ যখন ভালোবাসে, আর সেই ভালোবাসা তার স্বাধীনতা কেড়ে নেয়… তখন সে আর কারো উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ দেখতে সাহস পায় না। আমি শুধু চাইনি, কেউ আমার মতো একা হয়ে যাক… আমি চাইনি কি আরো জীবনটা আমার মতো হোক। যে সম হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে যাবে। নিজের মুল্যবান ১৮ বছর সময় অপচয় হয়েছে নিজের সন্তানের ছায়াটাও দেখতে পাইনি, আমি চেয়েছিলাম আমার মেয়েরা এমন একটা লাইফে থাকুক যে লাইফ থেকে কখনোই তারা কষ্ট পাবেনা,”
লিয়ারা সেই কথাগুলো উচ্চারণ করলেন না, কিন্তু তার চোখের মধ্যে সব ছিল। তিনি জানেন না সিলভা তাকে এখনো বোঝে কি না।তিনি শুধু জানেন, ফিওনা যেন তার মতো করে জীবন হারিয়ে না ফেলে, ভালোবাসা যেন ফিওনার জন্য বেদনার শেকল না হয়।
তিনি চুপচাপ আয়নার সামনে বসে থাকেন…তবে তার চোখে একটাই সিদ্ধান্ত— “এবার আমি কোনো সন্তানকে দূরে যেতে দেবো না। ফিওনা আমার আলো, আমি তাকে আঁকড়ে রাখবো। এই বার আমি ব্যর্থ হবো না।”
সিলভা ধীরে ধীরে পেছন ফিরলো। লিয়ারা কিছু না বলেই চলে গেলেন, কিন্তু তাতে যে কথা নেই, তা নয়। ওই নিরবতা যেন শত আঘাতের থেকেও গভীর ছিল।চোখ নামিয়ে কাঁপা কাঁপা পায়ে হাঁটতে হাঁটতে সে চলে এলো প্রাসাদের পূর্ব দিকের একটি খালি কক্ষে— যেখানে কেউ আসেনা, কেউ থাকে না।
ভেতরে ঢুকেই দরজাটা বন্ধ করে দিলো সজোরে। হঠাৎ সব যেন নীরব হয়ে গেলো।সিলভা সেই নিস্তব্ধতার মাঝে এক কোণে বসে পড়লো, দেওয়ালের গায়ে হেলান দিয়ে।
তার চোখে জল জমছে, ঠোঁট কাঁপছে।
“আমি তো শুধু ভালোবেসেছিলাম…আমি কি ভুল করেছিলাম…?” সে ফিসফিস করলো।
হঠাৎ কান্না আর আটকাতে পারলো না।ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকলো—কোনো শব্দ নেই, শুধু নিঃশ্বাসের ধাক্কায় কাঁপছে তাঁর বুক।
সেই মুহূর্তে দরজার ধারে দাঁড়ানো এক ছায়ামূর্তি এগিয়ে এলো।
এথিরিয়ন।
ধীরে ধীরে এসে সিলভার পাশে বসে পড়লো।
কোনো কথা বললো না। শুধু হাত বাড়িয়ে সিলভাকে নিজের দিকে টেনে নিলেন।
সিলভা মুখ গুঁজে দিলেন এথিরিয়নের বুকে।
“আমি কখনো চাইনি ফুপি আমাকে ঘৃণা করুক…আমি তো শুধু তোমাকে ভালোবেসেছি…” — তার কণ্ঠ কেঁপে ওঠে।
এথিরিয়ন তার চুলে হাত বুলিয়ে বললো নিচু স্বরে—
“আমি জানি সিলভা…আমি জানি তুমি কী হারিয়েছো…
কিন্তু বিশ্বাস করো, তুমি একা নও।আমি যতদিন আছি, কষ্ট তোমাকে ছুঁতে পারবেনা।আমি তোমাকে ভালো রাখবো কথা দিচ্ছি আর একদিন তোমার ফুপি সেটা বুঝতে পারবেন।”
সিলভা কিছু বললো না।কেবল চোখ বুজে, এথিরিয়নের বাহুতে লুকিয়ে রাখলো নিজের ভাঙা হৃদয়ের সব কান্না।
ঘরের বাতাস ভারী হয়ে রইলো।কিন্তু সেই নীরবতার মাঝেই গড়ে উঠলো এক অদৃশ্য দেয়ালভালোবাসা আর অনুতাপের মাঝে বিভক্ত, কিন্তু একে অপরের জন্য নিঃশর্ত।
এলড্র রাজ্যের বাইরে স্নিগ্ধ হাওয়া বইছে। পাহাড়ি গাছপালা হালকা দুলছে, আর দূরের জলপ্রপাতের শব্দে যেন একটা বিষণ্ন সংগীত বাজছে।
কক্ষের ভিতরে নরম আলো জ্বলছে। ফিওনা চুপ করে শুয়ে আছে, মাথা পাশ ফিরিয়ে রেখেছে—দেয়ালের দিকে।
জ্যাসপার নীরবে ভেতরে প্রবেশ করলো হাতে একটি ছোট ট্রে। সেটিতে ছিলো হালকা খাবার—সুপ, আর কিছু ফল।
“তুমি অনেকক্ষণ কিছু খাওনি,” — সে নিচু গলায় বলল।
ফিওনা কোনো উত্তর দিল না। জ্যাসপার ধীরে বিছানার পাশে বসল। “এই… একটু খেয়ে নাও, প্লিজ…”
ফিওনা চোখ বন্ধ করে বলল— “তোমার আনা খাবারের প্রতি আমার আর বিশ্বাস হচ্ছেনা।”
জ্যাসপার থমকে গেলো।ফিওনা এবার তার দিকে ফিরলো, চোখদুটো লাল হয়ে আছে, ঠোঁট কেঁপে উঠছে।
“যদি আমি ওই জুসটা সেদিন খেয়ে নিতাম… তাহলে আজ আমার… আমার সন্তানটা…” — কণ্ঠ ভেঙে আসে।
এক অদৃশ্য দেয়াল যেন দাঁড়িয়ে গেলো তাদের মাঝে।
জ্যাসপার নিঃশব্দে ট্রেটা নামিয়ে রাখে।তার মুখ থমথমে। সে ধীরে ধীরে ফিওনার হাত ধরতে যায়।ফিওনা প্রথমে সরিয়ে নেয়, কিন্তু জ্যাসপার এবার তার হাতে আঙুল জড়িয়ে রাখে।
“আমি ভুল করেছি। আমি সেটা স্বীকার করছি, ফিওনা। “কিন্তু আমি কখনো, কখনো আমাদের সন্তান কিংবা তোমার ক্ষতি চাইনি। তুমি খাবে না, তবু আমি বসে থাকবো তোমার পাশে।তুমি কথা বলবে না, তবু আমি শুনবো তোমার নিরবতা। তুমি রাগ করো, অভিমান করো—আমি থাকবো, এখানেই বসে।”
সে ফিওনার হাতটা বুকের ওপর রেখে বলল—“আর কখনো… কখনো এমন করবো না। আমি কথা দিচ্ছি… প্রমিজ করছি।”
ফিওনার চোখে পানি চলে আসে, তবু সে মুখ ঘুরিয়ে রাখে। কিন্তু তার হাতটা জ্যাসপারের মুঠোয় থাকেই।এটাই এখন সবচেয়ে বড় নিঃশব্দ মীমাংসা— রাগ আর ভালোবাসার মাঝখানে এক সূক্ষ্ম সন্ধি।
জ্যাসপার এখনো ফিওনার পাশে বসে আছে। তার চোখদুটি স্থির, নরম আলোয় যেন আরও ক্লান্ত দেখায়।
একটু পরেই সে ফিসফিস করে বলে— “তুমি না খেলে তোমার শরীর আরও দুর্বল হয়ে যাবে… আমি কি… আমি কি একবার খাওয়াতে পারি?”
ফিওনা চোখ বন্ধ করে কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে।
তার হৃদয়ের গভীরেই যেন অভিমানের দেওয়াল একটু একটু করে গলে যাচ্ছে। জ্যাসপারের কণ্ঠে এমন এক মায়া, এমন এক সত্যতা, যেটা আর অস্বীকার করা যায় না।
হঠাৎ সে হাতটা টেনে নেয় না আর। বরং ধীরে ধীরে নিজের চোখের কোণ মুছে নেয়, চোখ মেলে তাকায় জ্যাসপারের দিকে।“ খাইয়ে দাও।”
জ্যাসপারের চোখ বিস্ময়ে ভরে ওঠে, তারপর একটু হাসে—হালকা, প্রশান্তির মতো এক নিঃশ্বাসে।সে ট্রে থেকে চামচ তুলে কিছু সুপ নিয়ে ফিওনার ঠোঁটের কাছে এগিয়ে দেয়।
ফিওনা একটু দ্বিধা করে, তারপর ধীরে ধীরে মুখ খোলে।
সুপের কণাটা ঠোঁট ছুঁতেই জ্যাসপার বলে— “ধন্যবাদ, হামিংবার্ড…” ফিওনা একটুখানি চোখ ছোট করে তাকায়—
খাবার ধীরে ধীরে শেষ হয়।প্রতিটি চামচের সঙ্গে যেন ফিওনার অভিমান, কষ্ট, আর রাগ একটু একটু করে গলে যায়।
সুপ খাওয়ার পর ক্লান্তিতে ফিওনার চোখ ভারী হয়ে আসে। জ্যাসপার চুপ করে পাশে বসে থাকে, তার আঙুলে এখনও ফিওনার স্পর্শের উষ্ণতা লেগে আছে।
ফিওনা মাথা হেলিয়ে দেয় বালিশে।চোখ দুটো আধভাঙা ঘুমে ঝাপসা হয়ে আসে, কিন্তু জ্যাসপারকে দেখে একটা নরম হাসি খেলে যায় মুখে। “তুমি… এখন আর কোথাও যাবা না, এখানেই থাকবে তো?” — ফিসফিস করে বলে সে।
জ্যাসপার তার কপালের কাছেমুখ নিয়ে যায়, চোখ বুঁজে মৃদুস্বরে বলে— “তোমার পাশে থাকাটাই আমার শ্বাস নেওয়ার একমাত্র কারণ হয়ে গেছে…”
ফিওনার ঠোঁটে যেন তৃপ্তির ছায়া খেলে যায়।সে নিঃশব্দে ঘুমিয়ে পড়ে।জ্যাসপার ধীরে ধীরে তার মুখের দিকে তাকায়।
তীব্র যুদ্ধ, অভিমান আর ভুল বোঝাবুঝির পরে—এই একটুখানি প্রশান্তি যেন পুরো ব্রহ্মাণ্ডের কাছে চাওয়ার মতো কিছু।
সে নরম হাতে ফিওনার একগাছা চুল সরিয়ে নেয় কপাল থেকে।একটু নিচু হয়ে যায়… নিঃশ্বাস থেমে যায় যেন ফিওনার কপালে এক নিঃশব্দ চুম্বন রেখে দেয় জ্যাসপার।
কক্ষের জানালা দিয়ে পাহাড়ি বাতাস আসছে।
জ্যাসপার চোখ বন্ধ করে— নিজের সমস্ত শক্তি দিয়ে প্রার্থনা করে, যেন ফিওনার জীবনে আর কোনো ছায়া না নামে।
সূর্যের প্রথম আলো পাহাড় ঘেঁষে জেগে উঠেছে। এল্ড্র প্রাসাদের হলঘরে, এক নিঃশব্দ অথচ গম্ভীর পরিবেশে দাঁড়িয়ে ডক্টর আগ্নিস আর ড্রাকোনিস।
ডক্টর আগ্নিস নিচু কণ্ঠে বলেন “রিসার্চ শেষ হয়েছে… তবে ।”
ড্রাকোনিস অবাক হয়ে থাকলো তারপর প্রশ্ন করলো ” তবে কি ???
ডক্টর আগ্নিস বললেন জেনেটিক ফায়ারকোর দরকার ছিলো আর যেটা একবার দেওয়া যায়।আর জ্যাসপার… নিজের সোল-কোড ফ্লেম দিয়েই রিসার্চ কমপ্লিট করেছে।”
ডক্টর আগ্নিস গম্ভীর গলায় বলেন— “আর সেই ফ্লেম দিয়েই রূপান্তর। ৬ মাসের জন্য ফিওনা এখন সম্পূর্ণ ড্রাগন।
কিন্তু তার শরীরে সেই মানব সন্তানটির উপস্থিতি সহ্য করার ক্ষমতা ছিল না। তবে সেদিন জ্যাসপার আমার কথায় ফিওনাকে বাঁচাতে নিজের সন্তানকে শেষ করে দিচ্ছিলো।”
ড্রাকোনিস এবার আর কোনো অবাক হলেন না কারন তিনি এখন জ্যাসপারকে বুঝে গেছেন। তার এই ছেলে ফিওনার জন্য নিজেকেই শেষ করে দিতে প্রস্তুত।আবার পুরো গ্রহ ভেনাস ধ্বংস করতেও দ্বিধা করবেনা।
এই কথোপকথনের আড়ালেই দাঁড়িয়ে ছিলেন লিয়ারা।
দরজার ফাঁক দিয়ে সবটা শুনে ফেলেন তিনি।
তাঁর চোখ ধীরে ধীরে বিস্ময়ে বড় হয়ে যায়…সেদিনের অভিমান, সেদিনের রাগ—সব মিলিয়ে জমে থাকা প্রশ্নগুলোর উত্তর যেন আচমকা পেয়ে যান তিনি।
তিনি ধীরে ধীরে পেছনে সরে যান, যেন কেউ দেখে না ফেলে।
চোখ দুটো জলে ভরে ওঠে। “সে… নিজের সন্তানের জীবন শেষ করে দিতে চেয়েছে শুধু আমার মেয়েকে বাঁচাতে…” — ফিসফিস করে বলেন লিয়ারা। নিজের এতো বড় অস্ত্র আর ক্ষমতা পর্যন্ত আত্মত্যাগ করেছে।
তার ঠোঁটে এক অদ্ভুত নরম হাসি খেলে যায়। “এমনটা তো… কেবল কেউ তখনই করে, যখন সে ভালোবাসে নিজের থেকেও বেশি কাউকে।”
তিনি আজকে বুঝলেন তারা থেকেও বেশি তার মেয়েকে জ্যাসপার ভালোবাসে আর এটা আজকের ভালোবাসা না এটা তো শত বছর আগের ভালোবাসা। তিনি জানালার দিকে তাকান।সূর্যের আলো পড়েছে পাহাড়চূড়ায়।সেই আলোতেই জ্বলজ্বল করছে জ্যাসপারের ত্যাগ আর নিঃশব্দ ভালোবাসার সত্য।
সূর্য মাথার ওপরে উঠে এসেছে। ফিওনার ঘুম ভাঙার পর সবার মুখে একরকম প্রশান্তি, আর সেই দুপুরে আচমকা থারিনিয়াস হন্তদন্ত হয়ে এল ড্রয়িংরুমে।
“কিং ড্রাকোনিস! রয়্যাল নিউজ এসেছে—এথিরিয়নের ব্যাপারে,”
জ্যাসপার, ফিওনা, আলবিরা,লিয়ারা, আর সিলভা সকলেই তাকিয়ে থাকলো থারিনিয়াসের দিকে। ড্রাকোনিস তখন জানতে চাইলো।
” এথিরিয়ন এরমধ্যে নিখোঁজ হয়েছিলো। ও তখন ওর এক বন্ধুর সাথে পৃথিবীতে গিয়েছিলো। ও পৃথিবীতে থাকার সময় একটা ডিজাইন তৈরি করেছিলো… একটা গাড়ির ডিজাইন। লন্ডনের ওর বন্ধুর ভাইয়ের কোম্পানি সেই ডিজাইন দেখে অবাক হয়ে যায়।”
জ্যাসপার কপাল কুঁচকে জিজ্ঞেস করে “পৃথিবীতে গিয়েছিলো আবার কারের ডিজাইন আর্ট করেছে, ?”
থারিনিয়াস মাথা নাড়ে। “হ্যাঁ। তারা তখনই সেই ডিজাইন নিয়ে রিসার্চ শুরু করে। আজ সকালে খবর এসেছে—গাড়িটি তৈরি হয়ে গেছে। এবং এটিই হতে যাচ্ছে পৃথিবীর প্রথম “স্মার্ট-এথিকাল ডিজাইনড রাইড”। বিশেষভাবে তৈরি—গ্লোবাল ইলেকট্রিক শো তে প্রথম স্থান পাওয়ার সম্ভাবনা ৯০%।”
সিলভা চুপচাপ দাঁড়িয়ে, চোখে গর্বের ঝিলিক। জ্যাসপারের মুখে হাসি ফূটে উঠে আর মনে মনে বলে—‘ড্রাগনের রক্ত শুধু আগুন ছোড়ার জন্য না, কিছু গড়ার জন্যও।’”
উপস্থিত সবাই এই নিউজে খুশি হন তবে লিয়ারাকে দেখে বোঝা গেলো না তার প্রতিক্রিয়া।
এথিরিয়ন তার নিজস্ব কক্ষে একটা ই-মেইলের স্ক্রিনের সামনে থমকে আছে। চোখে বিস্ময় আর হালকা উত্তেজনা।
এথিরিয়নের করা ডিজাইনে তৈরি সেই গাড়ি—
‘SkyNova-EV’ আগামী সপ্তাহে লঞ্চ হচ্ছে।
আর… তাকে অফিসিয়ালি ডিজাইনার হিসেবে ইনভাইট করেছে অনুষ্ঠানে।”
রাত সাড়ে আটটা
বাইরে ঝুম বৃষ্টি শুরু হয়েছে। কাঁচের দেয়ালে কাঁপা কাঁপা ফোঁটাগুলো পড়ছে একেকটা মৃদু সুরের মতো। ফিওনা জানালার পাশে দাঁড়িয়ে বাইরে তাকিয়ে ছিলো। একসময় ঘুরে দাঁড়িয়ে বলল—
“আমি একটু বাইরে যেতে চাই, বৃষ্টিতে ভিজতে। অনেকদিন হলো, বৃষ্টির স্পর্শ পাইনি।”
জ্যাসপার তার দিকে তাকাল— চোখে এক ধরণের উদ্বেগ।
“তুমি জানো না এখন তোমার শরীর কেমন নাজুক… আর এখন তুমি একা না আমায় বেবি আছে তোমার অস্তিত্বে…”
ফিওনা ঠোঁট ফুলিয়ে বলল— “আমি ড্রাগন হয়েছি, এখন আর আমার ঠান্ডা লেগে যাওয়ার ভয় নেই। এই মুহূর্তে একটু বৃষ্টি যদি না ছুঁতেই না পারি, তাহলে এই জীবনই বা কিসের!”
জ্যাসপার বিরক্ত চোখে তাকিয়ে কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে।
তারপর হালকা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে— “আচ্ছা। কিন্তু… শুধু পাঁচ মিনিট। আর আমি থাকবো তোমার সঙ্গে। একা কিছুতেই না।”
জ্যাসপার একটা ভারি কোট ফিওনার গায়ে জড়িয়ে দেয়। তারপর দু’জন ধীরে ধীরে কক্ষ থেকে বেরিয়ে পড়ে আর চলে যায় প্রাসাদের বিশাল রাজকীয় ছাদে।
বৃষ্টির ফোঁটাগুলো যখন ফিওনার গায়ে পড়লো, সে যেন চোখ বন্ধ করে আবার ছেলেবেলার পৃথিবীতে ফিরে গেলো। তার পায়ের নিচে ডায়মন্ডের মতো পাথরের পথ, মাথার ওপর মুক্ত বৃষ্টি… আর পাশে সেই প্রিন্স চার্মিং ড্রাগন প্রিন্স।
হঠাৎ ফিওনা ঘুরে দাঁড়িয়ে বলে—
” প্রিন্স…”
সে কিছু বলার আগেই তার ঠোঁট জ্যাসপারের ঠোঁট ছুঁয়ে যায়।এক মুহূর্তের জন্য সময় থেমে থাকে।
জ্যাসপার প্রথমে স্তব্ধ হয়ে যায়। তারপর ধীরে ধীরে তার বাহু দিয়ে ফিওনাকে আঁকড়ে ধরে।
বৃষ্টি ততক্ষণে গাঢ় হয়ে এসেছে। চুল ভিজে গেছে দু’জনের, কিন্তু ঠোঁটের উষ্ণতা যেন সমস্ত শীতলতা গলিয়ে দিচ্ছে।
“তোমাকে… আমি কিছুতেই হারাতে চাই না,” জ্যাসপার ফিসফিস করে বলে।
ফিওনা কাঁধে মাথা রেখে বলে— “তুমি যতক্ষণ আমার পাশে থাকো, আমি পুরো জীবনের সব ঝড় সামলে নিতে পারি।”
বৃষ্টির গান বাজছে, বাতাসে ভেজা ঘ্রাণ মিশে আছে। ফিওনার চোখ মেলে তাকিয়ে থাকে জ্যাসপারের দিকে, ঠোঁট কাঁপছে উত্তেজনায়।
জ্যাসপার তার গা ছুঁয়ে দেয়, আঙুলগুলো স্পর্শ করে ফিওনার কোমর, ধীরে ধীরে উপরের দিকে উঠে যায়। ফিওনার নিঃশ্বাস বাধা পড়ে যায়, শরীর হয়ে ওঠে আগুনে ভরা।
“তোমার বায়না মানতে বাধ্য হচ্ছি,” জ্যাসপার গলা জমে উঠা সুরে বলে, তার ঠোঁট ধীরে ধীরে ফিওনার গালের রেখায় লেগে যায়, স্পর্শে আগুন জ্বলে ওঠে।
বৃষ্টি ঝরছে হালকা, যেন আকাশের প্রতিটি ফোটা ফিওনার শরীরে অবিরত নেমে পড়ছে। বৃষ্টিগুলো মুক্তোর মতো লম্বা চুলের কাছে আটকে আছে, ভারি ওভারকোট খুলে ফেললো সে। আর বৃষ্টির পানিতে তার সিল্কের সেই পোশাকটায় শরীরের প্রতিটি বাঁক সরসভাবে ফুটে উঠলো। ঠান্ডা হাওয়ায় গা শিহরছে, কিন্তু ফিওনার চোখে এক অদ্ভুত আগুন জ্বলে উঠেছে।
জ্যাসপার তার হাত স্পর্শ করে ফিওনার কোমর, যেন সে ছুঁয়ে দিতে চায় সব দহন। ভেজা কাপড়ের নিচে তার স্পর্শ অতি স্পর্শকাতর হয়ে উঠেছে—শরীরের প্রতিটি নার্ভ যেন জাগ্রত।
“তুমি জানো?” জ্যাসপার ফিসফিস করে, “তোমার এই ভেজা শরীর আমাকে পাগল করে দিচ্ছে…”
ফিওনার হৃদয় বেধে ওঠে, সে আর নিজেকে সামলাতে পারে না। তার চোখে অতি স্পষ্ট কামনার জ্বলন, আর সে জ্যাসপারের দিকে ঝুঁকে পড়ে।
জ্যাসপার আর দাঁড়িয়ে থাকে না। হাত বেয়ে তার গলা, বুকে, আর কোমরে আগুনের মতো ছুটে যায়। তার ঠোঁট ফিওনার গলা ও গালের নরম ত্বকে ঠেকে, স্পর্শে তার দেহ কাঁপতে থাকে।
বৃষ্টির তীব্র ঝরনার মধ্যেও জ্যাসপারের চোখে এক অদ্ভুত দীপ্তি জ্বলছিলো। সে ধীরে ধীরে ফিওনার কোমর জড়িয়ে ধরে, অবশেষে কোমলতার সঙ্গে তাকে কোলে তুলে নিলো। ফিওনার নড়াচড়া কমে গেলো, সে শুধু জ্যাসপারের দিকে তাকিয়ে ছিলো।
জ্যাসপার তাকে নিয়ে গেলো,ছাদের এক কক্ষে যেখানে একটি ছোট ও গোপনীয় কক্ষ ছিলো — প্রাসাদের অন্তরালে রাখা, একান্তের জন্য তৈরি। দরজাটি বন্ধ হতেই বৃষ্টির শব্দ বাইরে থেকে যেনো দূরে সরে গেলো, শুধু তাদের নিঃশ্বাস আর হৃদয়ের স্পন্দন কক্ষে ভরে গেলো।
জ্যাসপার ফিওনাকে ধীরে ধীরে বসালো সেই কক্ষের কাউচে, তার হাত আবার কোমর ঘিরে ধরলো।
ফিওনা একটু লজ্জায় মিশে গেলো, তারপর ধীরে ধীরে তার হাত জ্যাসপারের বুকের ওপর বয়ে গেলো, অনুভব করলো সেই দমবন্ধ করা স্পর্শ। একরাশ উত্তেজনা আর স্নেহ মিশে তাদের মাঝে যেনো নতুন এক দুনিয়ার জন্ম হচ্ছিলো।
জ্যাসপার ধীরে ধীরে নিজের শার্টের বাটন খুলতে লাগল। তার শক্তিশালী বুক যেন এক মন্ত্রমুগ্ধ করার মতো, বৃষ্টির ফোঁটা গা ছুঁয়ে ঝলমল করছিল। ফিওনার চোখ তার প্রতি আকৃষ্ট হয়ে রইল।
সে আর অপেক্ষা করল না, ধীরে ধীরে নিজের পোশাক খুলতে শুরু করল, ভেজা কাপড় ধীরে ধীরে নিচে নামতে লাগল। ফিওনার গলা, কাঁধ, বুক—সবকিছু ঝলমল করে ফুটে উঠল বৃষ্টির ফোঁটার মতো।
জ্যাসপার একে একে ফিওনার গলা, কাঁধ আর বুকে কোমল চুম্বন করতে লাগল। তার ঠোঁট স্পর্শ করল গলার নরম ত্বকে, তার হাত নরম বুকে ফিকে ফিকে স্পর্শ ছড়িয়ে দিল। স্পর্শটা ছিল গভীর, আগ্রহী, প্রেমময় আর এক সঙ্গে ভরপুর কামনায়।
ফিওনার নিঃশ্বাস জমে গেল, শরীর অচেতন হয়ে উত্তেজনায় কাঁপতে লাগল। জ্যাসপারের হাত তার সমস্ত শরীরে বিচরণ করছে আর ঠোঁটের স্পর্শ যেন তার রক্তের প্রতিটি স্রোতকে আগুনে ঝলসাতে লাগল।
জ্যাসপার হঠাৎ থেমে গেল, তার হাতগুলো ফিওনার কোমর থেকে ধীরে ধীরে নামতে লাগল। সে তার নিঃশ্বাস জোরে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করছিল।
ফিওনা, নিজের অদম্য কামনার অজান্তেই, ধীরে ধীরে জ্যাসপারের হাত ধরে তুলে ধরে তার দিকে তাকাল, চোখে আগুন জ্বলে উঠল। তার ঠোঁটে লেগে ছিল এক অদ্ভুত উদ্দীপনা।
“ইউ ওয়ান্ট দিজ, রাইট?” জ্যাসপার কণ্ঠে ছিল গভীর একটা কাঁপন। “ওকেই, ফাইন। আই উইল ডু এভরিথিং… উইদাউট ফা****।”
সে ধীরে ধীরে ফিওনার গলার দিকে ঝুঁকে পড়ল, সারা শরীরে কোমল চুমুতে ভরিয়ে দিল—নাভি থেকে শুরু করে বুকের মাঝখানে অবধি, তার ভালোবাসার প্রতিটি স্পর্শ ফিওনার হৃদয়ে গেঁথে যাচ্ছে।
ফিওনা শান্ত অথচ উত্তেজনায় চোখ বন্ধ করে ছিল।জ্যাসপার তার নাভির ওপর ঠোঁট বেয়ে হালকা চুমু দিলো, একেকটা স্পর্শ যেন আগুনের মতো জ্বলছে, শরীর জুড়ে এক অজানা অনুভূতির ঢেউ বয়ে চলল।
ফিওনা হাত বাড়িয়ে জ্যাসপারের ঘাড়ের চুলআঁকড়ে ধরল, তাদের মাঝের আবেগ, ভালোবাসা আর আকর্ষণ সেই মুহূর্তে গা ছমছমে করে তুলল।
ফিওনা ধীরে ধীরে উঠে জ্যাসপারকে দেখতে লাগল, চোখে একটা খেলা মিশে ছিল। জ্যাসপার তখন কাউচের বসে ছিলো আর ফিওনা তখন উঠে এসে জ্যাসপারের সামনে ফ্লোরে বসে পড়ে হাঁটু ভেঙ্গে। দম নেয়া মিশ্রিত একউত্তেজনায় হাতটা অবশ্যম্ভাবী হয়ে গেল জ্যাসপারের প্যান্টের জিপারের দিকে।
নরম স্পর্শে সে ধীরে ধীরে জিপার নামাতে শুরু করল, প্রতিটি মুহূর্ত যেন ভারী নিঃশ্বাসের মতো জমছিল তাদের মাঝখানে। চোখ মেলে জ্যাসপারের দিকে তাকিয়ে ফিওনা বলল, “আই উইল হেল্প ইউ।”
কিছুক্ষণ বাদেই জ্যাসপার হঠাৎ ফিওনার কোমল চুলগুলো আঁকড়ে ধরল।
আযদাহা সিজন ২ পর্ব ৪৬
সে নিজের মাথাটা ধীরে ধীরে কাউচের পেছনে হেলিয়ে দিয়ে, নিজের ঠোটকে একটু শক্ত করে কামড়ে ধরল — যেন এই স্পর্শে সবকিছু ব্যক্ত হতে চায়। দুজনের নিঃশ্বাস একত্রিত হয়ে বাতাসে মিলেমিশে গেলো, আর মুহূর্তটা হয়ে উঠল একদম প্রগাঢ়, এক অমলিন আবেগের বাঁধন।