হ্যালো 2441139 পর্ব ৪৮
রাজিয়া রহমান
সুবহে সাদিকের সময় খোলা জানালা দিয়ে রুমের ভেতর একরাশ ঠান্ডা বাতাস প্রবেশ করে। পিয়াসার চোখ খুলে যায়। বিছানার অপর পাশে থাকা মানুষটা নেই।
থাকবে না এটা যদিও জানা কথা পিয়াসার।
প্রতিদিন জামাতে নামাজ পড়ে আষাঢ়।
পিয়াসা উঠে বসে।চারদিকে সবেমাত্র আলো ফুটে উঠছে।
পিয়াসা অযু করে আসে।
নামাজ পড়ে কুরআন শরীফ নিয়ে বারান্দায় বসে।কিছুক্ষণ কুরআন তিলাওয়াত করে।
এই বারান্দাটা ভীষণ সুন্দর মের আগে পিয়াসা আসে নি।
বারান্দায় বসার দুটো চেয়ার আছে।বারান্দা জুড়ে বিভিন্ন প্রজাতির অর্কিড।
সবচেয়ে বেশি ভালো লাগে খাঁচায় থাকা টিয়াপাখিটি।
এক মুহূর্তের জন্য পিয়াসার মনে হয় এই লোকটাকে সে যেমন ভেবেছিলো লোকটা সম্ভবত তেমন নয়।
টিয়া পাখির টুকটুকে লাল ঠোঁটদুটো কেমন স্বপ্নের মতো লাগছে।
পিয়াসা ভেসে যায় অতীতে, সেই কালো অতীতে।
পুকুর পাড়ে থাকা কামরাঙা গাছটায় প্রায়শই দেখা যায় টিয়া পাখি এসে বসেছে।
পিয়াসা মাঝেমধ্যেই মা’য়ের কাছে বায়না করতো একটা টিয়া পাখি এনে দিতে,সে পুষবে।
একটা পাখির জন্য পিয়াসা গোপনে কতো চোখের জল ফেলেছে তা পিয়াসার চাইতে ভালো কে জানে!
পিয়াসা হাসে অতীতের কথা ভেবে।একটা সময় এতো বেশি কেঁদেছে বলেই হয়তো এখন চাইলেও কাঁদতে পারে না।
পিয়াসা এগিয়ে গিয়ে খাঁচার সামনে দাঁড়ায়। আপনমনে বিড়বিড় করে বলে, “তোর নাম কি রে রঙিলা টিয়ে?”
“পিঁয়াঁসাঁ”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
পিয়াসা চমকায় ভীষণভাবে।
সে স্বপ্ন দেখছে না তো!
ইতস্তত করে এদিক ওদিক তাকায় আবারও। কেউ নেই।
তারপর আবারও জিজ্ঞেস করে একই প্রশ্ন।
পাখি আবারও তার নাঁকি সুরে জবাব দেয়, “পিঁয়াঁসাঁ”
হুট করেই পিয়াসার মন খারাপ হয়ে যায়। কে জানে কেনো পিয়াসার বুকের ভেতর জ্বালাপোড়া অনুভূতি হতে থাকে।
পিয়াসা আর রুমে থাকলো না। আষাঢ়ের ফেরার সময় হয়ে এসেছে। পিয়াসা রুম থেকে বের হয়ে গেলো।
পুরো বাড়ি কেমন নিরব,নিস্তব্ধ হয়ে আছে।রান্নাঘর থেকে মৃদু টুংটাং শব্দ আসছে শুধু।
পিয়াসা এই প্রথম এই বাড়ির সকাল বেলার বাহিরের রূপ দেখতে পেলো।
এতো দিন তো তার দিন রাত একটা রুমেই কাটতো।
রান্নাঘরে রজনী আর নার্গিস মিলে নেমে গেছে প্রতিদিনের কাজকর্মে।
রজনী পিয়াসাকে দেখে মিষ্টি হেসে বললো, “এতো সকালে উঠলে কেনো মা?আরেকটু ঘুমিয়ে নাও।”
পিয়াসার হাসে।
এতো যত্ন করে, আদর করে কেউ তার সাথে কথা বললে তার বুক কাঁপে শঙ্কায়। বারবার একটা মানুষের কথা মনে পড়ে যায়। সারা পৃথিবীর মানুষের আদর পেয়ে ও কেনো একটা মানুষের জন্য মনের খচখচানি দূর হয় না পিয়াসা জানে না।
মনের এক কোণে কেনো আজও সে রয়ে গেছে!
নার্গিস আড়চোখে মেয়েটার দিকে তাকায়। এই মেয়েটাকে সে ও পছন্দ করতো না।অথচ আজকে কেনো জানি ভালো লাগছে মেয়েটাকে খুব।
নার্গিস এগিয়ে গিয়ে পিয়াসার চিবুক ধরে বললো, “এই বাড়ির বড় বউ তুমি,এই বাড়ির যতো বস্তাপঁচা নিয়ম আছে সবকিছু তোমাকেই দূর করতে হবে।
তোমার শাশুড়ীকে তো আমি আমার বিয়ে হয়ে আসার পর থেকেই দেখছি।তোমাকে বউ করতে পারার পর তোমার শাশুড়ীর চোখেমুখে আমি যেই উপচে পড়া আনন্দ দেখেছি,তা আর কখনো দেখি নি।
তোমার শাশুড়ীর জীবনে অনেক না পাওয়া আছে,তুমি তো সবই জানো।তবুও তোমাকে পেয়ে যেই সুখ তিনি পেয়েছেন তা যেনো আজীবন এমনই থাকে।”
পিয়াসা একটা মোড়া টেনে নিয়ে বসলো। বাবা মা ছাড়া কখনো কারো আদর পায় নি পিয়াসা।তাই হঠাৎ করে আজ এমন আদর পেয়ে এখান থেকে সরতে ইচ্ছে করছে না তার।একটু আগে বলা নার্গিস আন্টির কথাগুলো শুনে পিয়াসা কিছু বলতে পারলো না।
রজনী আন্টি তাকে অনেক বেশি পছন্দ করেন।কিন্তু সে কি এতো ভালোবাসা, আদর পাওয়ার যোগ্য!
যেখানে তার ছেলেকে সে এক ফোঁটা ও পছন্দ করে না!
মহুয়া বেগম সিড়ি বেয়ে নেমে এলেন।সাথে এলো তার সাথে শিরিন।
সোফায় বসে মহুয়া বেগম পিয়াসাকে ডাকলেন।রজনীর মুখ গম্ভীর হয়ে গেলো। পিয়াসাকে নিশ্চয় এখন এমন কিছু বলবে যা ভীষণ অপ্রীতিকর।
পিয়াসা কিচেন থেকে বের হয়ে গেলো মহুয়া বেগমের কাছে।
মহুয়া বেগমের মুখ থমথমে। আদেশের সুরে বললো, “আমার জন্য আজকে জাউভাত তুমি রান্না করবে।যাও।”
পিয়াসা ফুরফুরে মেজাজে রান্নাঘরে ঢুকে গেলো।
রজনী বললো, “তুমি বসো,আমি রান্না করে দিচ্ছি।তুমি বলো যে তুমি রান্না করেছো তাহলেই হবে।”
পিয়াসা ব্যস্ত হয়ে বললো, “না আন্টি,আমি নিজেই রান্না করবো।আমার কোনো সমস্যা হবে না।আপনারা থাকলে বরং আমি রান্না করতে পারবো না। আপনারা বাহিরে গিয়ে বসুন।”
নার্গিস পিয়াসার চোখের দিকে তাকিয়ে দ্বিধান্বিত হয়ে গেলো। এই মেয়ের চোখ হাসছে।কিছু একটা করবে নিশ্চয়।
রজনীর দিকে তাকিয়ে নার্গিস বললো, “ভাবী চলুন,আমরা বাহিরে গিয়ে বসি।ও যখন চাইছে ওকে একটু সুযোগ দিন।”
রজনী অনিচ্ছা সত্ত্বেও বাহিরে বের হয়ে গেলো।
পিয়াসার ভীষণ হাসি পেলো।মহুয়া বেগম মানুষ চেনে না।পিয়াসাকে এতটা ছোট করে দেখা ওনার উচিত হয় নি।
পিয়াসা মনমতো লবণ,মরিচ দিয়ে রান্না চাপালো।
এতো আনন্দ কেনো হচ্ছে তার বুঝতে পারছে না।
আষাঢ় নামাজ পড়ে রুমে এসে দেখে পিয়াসা নেইমথচ পিয়াসার ঘ্রাণ রুমের সবখানে।পিয়াসার বালিশটা নিয়ে আষাঢ় একটা চুমু খায়।
তারপর ছাদে চলে যায় কবুতরের কাছে।
শিরিনের ভীষণ উসখুস লাগছে। এই মেয়েটা কি করছে কে জানে!
কৌতূহল মেটাতে না পেরে শিরিন রান্নাঘরে ঢুকে গেলো। পিয়াসা খুন্তি হাতে নিয়ে গুনগুন করছে। শিরিন বললো, “রান্না কতোদূর?”
“এখনো দুই মাইল দূর।”
শিরিন ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বললো, “মশকরা করছো তুমি?”
“আপনি আমার এতটা ও কাছের কেউ নন যে ঠাট্টা মশকরা করবো।আমার মশকরা ও ভীষণ দামী, যার তার সাথে হয় না।”
শিরিনের পায়ের তালু জ্বলে গেলো এমন অহংকারী কথা শুনে।
পাতিলের দিকে উঁকি দিয়ে বললো, “কি করছো এসব?এক সাগর পানি দিয়ে রেখেছো কেনো?”
“পানি বেশি হয়ে গেছে না-কি! ঠিক আছে তাহলে আপনি না হয় রান্না করে আমাকে দেখিয়ে দিন।”
“আমি কেনো রান্না করবো?”
“তাহলে জ্ঞান দিতে আসবেন না প্লিজ,আমার জ্ঞান খুব একটা কম নেই।”
শিরিন অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো। এই মেয়ে রীতিমতো তাকে অপমান করছে যেনো।
রাগে বের হয়ে এলো কিচেন থেকে।
পিয়াসা রান্না শেষ করে প্লেটে করে এনে ডাইনিং টেবিলে রাখলো।
রজনী আর নার্গিস ঢুকলো সবার জন্য রান্না করতে।
শিরিন সিদ্ধান্ত নিয়েই রেখেছে খাওয়ার সময় কয়েকটা কথা শুনিয়ে দিবে।
রজনীর বুক ঢিপঢিপ করছে। মহুয়া বেগম যে একটা ঝামেলা করার জন্য পিয়াসাকে রান্না করতে বলেছেন তা তিনি বুঝতে পারছেন।
জা’য়ের শুকনো মুখের দিকে তাকিয়ে নার্গিস বললো, “ভাবী,এতো চিন্তা করবেন না।পিয়াসা বুদ্ধিমতী মেয়ে,আমার আপনার মতো বোকা না।ওকে ওর মতো করে ব্যাপারটা বুঝতে দেন।”
রজনীর শঙ্কা দূর হয় না।
অতটুকু মেয়ে কতটুকই বা কথার আঘাত সহ্য করতে পারবে!
নাশতা তৈরি করে ঝুনি সবাইকে ডেকে আনলো। পিয়াসা ইচ্ছে করে আষাঢ়ের বাম পাশে বসলো।
শিরিনের গা জ্বলে উঠে দেখে।
মহুয়া বেগম সিরাজুল ইসলাম কে বললেন, “আজকে তোর পুত্রবধূ আমার জন্য রান্না করেছে।”
কথাটা শুনে আষাঢ়ের চোয়াল শক্ত হয়ে উঠে। কঠোর গলায় বললো, “তোমাকে রান্না ঘরে ঢুকতে বলেছে কে?”
পিয়াসা গলায় মধু ঢেলে বললো, “এতো রাগছেন কেনো?আপনার বউ হয়েছি যখন, আপনার পরিবার তো এখন আমার ও পরিবার।এখন তো আমি ফ্রি আছি,একটু চেষ্টা করছি।ক্লাস শুরু হলে তো আর পারবো না।প্লিজ।”
এমন ভোল পাল্টে ফেলতে দেখে আষাঢ় বিষম খেলো।পিয়াসা পানির গ্লাস এগিয়ে দিয়ে মিষ্টি করে হাসলো।
মহুয়া বেগম খাবার মুখে দিতেই তার মনে হলো তার নাক কান দিয়ে ধোঁয়া বের হচ্ছে যেনো।
পিয়াসা মিটিমিটি হাসছে।সে রান্নায় নাগা মরিচ দিয়েছে।
মহুয়া বেগম অর্তনাদ করে উঠে।
প্রচন্ড ঝাল আর লবণে মহুয়া বেগমের গলা জ্বলে যাচ্ছে যেনো।
পিয়াসা অবুঝের মতো বললো, “কি হয়েছে দাদী?”
শিরিন কটমট করে তাকায়।
ঝুনি গিয়ে চিনির ডিব্বা নিয়ে আসে।পরপর চার চামচ চিনি মুখে দেয় মহুয়া বেগম। তারপর বরফ এনে মুখে দেয়।
শিরিন কটমট করে বললো, “বুড়ি দামড়ি মেয়ে,এটুকু রান্না ও জানো না তুমি? বিয়ে বসার জন্য পাগল হয়ে গেছো।তোমার মা সারাদিন চাকরি বাকরি নিয়ে থাকছে,মেয়ের দিকে খেয়াল দেয় নি।”
সিরাজুল ইসলাম, মিরাজুল ইসলাম দুই ভাই বোনের দিকে তাকিয়ে আছেন।
আষাঢ় কিছু বলার আগে পিয়াসা আষাঢ়ের হাত চেপে ধরে। চোখের ইশারায় শান্ত হতে বলে।
পিয়াসা আরো শান্ত সুরে বললো, “দেখলেন ফুফু,আপনি বুঝছেন ব্যাপারটা। চাকরিজীবী মায়ের সন্তান এমনই হয় ফুফু।মা’য়ের সান্নিধ্য পায় না যে তাই।
হ্যালো 2441139 পর্ব ৪৭
প্লিজ ফুফু,আমার রিকুয়েষ্ট, আজকে থেকে সব রান্না আপনি করবেন,আমি আপনার সাথে থেকে সরেজমিনে দেখে শিখবো আপনার থেকে।আমার মা তো পারলো না,আপনি না হয় সেই দায়িত্ব নেন এবার।”
সিরাজুল ইসলাম খুকখুক করে কাশি দিতে শুরু করেন।
মিরাজুল ইসলাম বললো, “তাহলে তো আর কথাই নেই,আজকে থেকে তুই রান্না করে দেখাবি কিভাবে কি করতে হয়।কথা ফাইনাল এখানেই।”
শিরিন হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলো।