আপনাতেই আমি পর্ব ৫৪
ইশিকা ইসলাম ইশা
ক্লান্ত দেহ নিয়ে বাসায় ফিরে রিদি।কয়েকদিন থেকে যেন শরীর চলছে না।তবুও মন আজ ভীষণ ভালো তাই শরীর চালানোর যেন জোর পেয়েছে। অটোরিক্সা থেকে নেমে দাড়াতেই দৌড়ে আসে নীল। রিদি অসুস্থ অবস্থায় হসপিটালে গেছে তাই চিন্তা থেকেই মূলত বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিল।রিদির আসতে দেরি হচ্ছে তাই। বেলকনিতে দাঁড়িয়ে বার বার দেখছিল।যদিও রিদিকে কল করেছিল। কিন্তু রিসিভ করে নি তাই বেশি চিন্তা হচ্ছিল। অজান্তেই রিদির জন্য নীলের মনে একটা ভালবাসার জায়গা তৈরি হয়েছে।রিদিকে তার আপন আপন লাগে।
রিদিকে আসতে দেখে ঝটপট রুম থেকে বের হয়ে আসে নীল। এসেই রিদির কোলে ফুটফুটে একটা বাচ্চা দেখে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। অজান্তেই মুখ থেকে বের হল “মাশাআল্লাহ “এতো কিউট বাচ্চা বলেই রিদির কোলে থেকে বাচ্চাটার হাত ধরতে গেলে বুঝল হাতে ক্যানোলা লাগানো। দেখেও মনে হচ্ছে অসুস্থ।কেমন রিদির বুকের লেপ্টে শান্ত হয়ে গোলগোল চোখে দেখছে।এক হাতে ধরে আছে রিদির জামার গলার অংশ অন্য হাতে ক্যানলা লাগানো । নীল কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই অটোর অপর পাশে থেকে বের হয় ডঃ মিতু।নীল কে এভাবে বিষ্ময় নিয়ে তাকিয়ে থাকতে দেখে মিতু হালকা হেসে বলে।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
আমাকে কি ভুতনীর মতো দেখাচ্ছে এখনো?
নীল হচকচিয়ে তাকাল মিতুর দিকে । হসপিটালে থাকা কালীন পরিচিত হয়েছিল মিতুর সাথে।মিতু খুব সুন্দর মিশুক একটা মেয়ে।নীল এবার তাকালো রিদি আর বাচ্চার দিকে।মিতু রিদির তাকানো দেখে আন্দাজ করতে পারল নীলের মনে কি চলছে।কারন নীল জানে মিতুর বিয়ে হয়নি।আর রিদির ব্যাপারে এই টুকু জানে যে সে ডিভোর্সী তবে রিদি তার কাছে এখন একটা রহস্য !!রিদির ব্যাপারে জানার তীব্র ইচ্ছে থাকলেও কিছু জিজ্ঞেস করছে না।যদি আবার তেমন কিছু হয়।
রিদি নীল কে আহাম্মক এরমতো দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বলে,
সরে দাঁড়া।ভেতরে যেতে দে!!এভাবে দাড়িয়ে আছিস কেন??
নীল উৎসুক হয়ে বলে,
বাচ্চাটা কি তোমার আপু!
হঠাৎ রিদির ভেতরটা হু হু করে উঠল।মনের ভেতর ক্ষতগুলো এখনো দগদগে হয়ে আছে। সন্তান হারানোর বেদনা বয়ে বেরাচ্ছে।মনে মনে ভাবল সে তো এতো ভাগ্যবতী না যে এমন ফুটফুটে একটা বাচ্চা তার থাকবে। ভাগ্য তো তার থেকে সব কেড়ে নিয়েছে আর কি কিছু বাকি আছে নেওয়ার।এখন শুধু এই প্রান টা নিলেই বাঁচি।
রিদি কথা গুলো ভেবে ছোট্ট একটা শ্বাস ফেলে। কিছু বলার আগেই নীলের আম্মু এসে রিদির কোলে বাচ্চা দেখে সেও একই কথা বলে,
রিদি মা বাবুটাকি তোমার??কি সুন্দর আল্লাহ!! মাশাআল্লাহ!! মাশাআল্লাহ!!একদম তোমার মতো মায়াবী গো!!
রিদি তাচ্ছিল্য হাসে,
আন্টি! আসলে হসপিটালে বাচ্চাটার আয়া ওকে নিয়ে এসেছিল।অনেক জ্বর। কিন্তু আয়াটা কেমন যেন একটু।মানে নাম বাবা মার নাম কিছুই সঠিক ভাবে বলতে পারছে না।তাই হসপিটাল কতৃপক্ষ তাকে বাচ্চার মা,বাবা ডেকে আনতে বলে।না হলে বাচ্চা দিবে না।তাছাড়া এতো অসুস্থ অবস্থায় বাচ্চাটাকে বাবা মা ছাড়া দেওয়া ঠিক না।
ওহহ তাহলে বাসায় নিয়ে আসলে যে!!
রিদি কিছু বলার আগেই মিতু বলে,
আসলে আন্টি!!বাচ্চাটা সাংঘাতিক!!
নীলের মা কিছুটা ভয় পেয়ে বলে,
মানে!!কি বলছ!!এতো সুন্দর একটা বাচ্চাকে!
মিতু ভয় পাওয়া দেখে হেসে নিয়ে আসা থেকে সমস্ত ঘটনা বলে।
নীলের মা হেসে বলে,
তো এই ব্যাপার!!আমার মনে হয় কোন বুদ্ধিজীবীর বাচ্চা হবে।
নীলের মায়ের কথায় বাবু ওওওওওহহহ করে উঠে।যেমন ছোট বাচ্চারা করে।
নীলের মা বেজায় খুশি হয়ে বলে,
দেখলে আমি সত্যি বলেছি তাই ও হহহ করল!!
সবাই হেসে দেয় তার কথায়। নীলের মা বাবুকে নিতে চাইলে সে যেতে চাই না।তাই রিদিকে বলে ওকে রুমে নিয়ে যাও।
নীলের মায়ের কথায় রিদি বাচ্চা টাকে নিয়ে উপরে চলে আসে।মিতু একটা ব্যাগ হাতে সেও উপরে আসে। বাচ্চাটা টুকটুক করে দেখছে আশেপাশে।তবে রিদির সাথে মিশেই আছে।রিদি বাচ্চাটাকে নিয়ে সোফায় বসে। ক্লান্ত সে।আজ সারাদিন বাচ্চাটা কোল থেকে নামেনি। অদ্ভুত এক টান রিদিকে বাধ্য করছে বাচ্চাটার মায়ায় বাঁধতে।রিদি থেকে অন্য কেউ নিলেই কেঁদে কেটে একাকার অবস্থা। বাচ্চার কান্না যেন রিদির সহ্য হচ্ছে না তাই আর কাউকে দেয়নি।নিজের কাছেই রেখেছে।
রিদি সোফায় বসে বাচ্চাটাকে বুকে জরিয়ে ধরে শান্তির নিশ্বাস ফেলে।সে যে ক্লান্ত তবুও এই বাচ্চাটা তার বুকে থাকায় শান্তি লাগছে।
মিতু রিদি আর বাচ্চাকাকে এভাবে মিশে থাকতে দেখে বলল,
আমারো মনে হচ্ছে বাচ্চাটা তোমার!! অদ্ভুত ব্যাপার!!তোমার কোলেই এতো শান্ত থাকছে।
রিদি কিছুক্ষণ বাচ্চার দিকে তাকিয়ে থেকে বলল,
বাবা মা কখন আসবে ওর কিছু বলেছে??
না!!ফোন নাম্বার বন্ধ বলছে!
তাছাড়া এই মহিলাকে আমার সুবিধার মনে হয় নি।বাচ্চা তার কাছে থাকে অথচ বাবা মার নাম ই জানে না।এটা কোন কথা!!বাবা মা কি করে তাও জানে না।
বিষয়টা অদ্ভুত না!!!
রিদি নিজেও ভেবে দেখেছে বিষয়টা একটু গন্ডগোল।তাই তো বাবা মা ছাড়া বাচ্চা দিবে না বলে জানিয়েছে।সেটা যদি হসপিটাল কতৃপক্ষ দিতেও তবুও রিদি দিত না।
লম্বা,ঘন ,কালো ,রেশমি চুল গুলে বেডের একপাশে অবহেলিত হয়ে পড়ে আছে।লম্বা চুলগুলো মেঝে ছুই ছুই প্রায়।রিদি বাবুকে বুকে নিয়ে ঘুম পারাচ্ছে।রাত বাজে তখন ৩:২০।চারদিকে শুনশান নীরবতা।পাশে নীর ঘুমাচ্ছে।রিদি গুন গুন করে গান গাইছে।মনটা তার আজ ভীষণ শান্ত। বুকের মাঝে তুলতুলে শরীরটা তার উষ্ণ স্পর্শে আরামে ঘুমাচ্ছে।আজ তো তারও এমন একটা ফুটফুটে বাবু থাকত।আচ্ছা তার কি বাবু হয়েছিল? ছেলে না মেয়ে??কি অভাগী মা সে।এটও তার জানা নেই যে তার কি বাবু হয়েছিল।
একটা দিন তার থেকে কতো কিছুই কেড়ে নিল।
সেদিন যদি সে বাসা থেকে বের না হতো তাহলে তার কোল জুড়েও এমন ফুটফুটে একটা বাচ্চা থাকত। সবটাই তার দোষ!!
কয়েক মাস আগে,
তখন রিদির ৮মাস পেরিয়ে ৯মাস চলছে। শারীরিক কন্ডিশন খুব একটা ভালো না ।ভারি শরীর নিয়ে নড়াচড়াও বেশ কষ্টকর।এদিকে তীব্রর কড়া হুকুমে তারা এখন নিচ তলায় একটা রুমে থাকে।তীব্র কোন রিস্ক নিতে চাই না তাই নিচ তলায় ই থাকছে। তীব্র নিজের রুম ছাড়া কোথাও থাকে না।তাই সবটা তার মতোই সাজানো হয়েছে।
সময়টা তখন প্রায় ১০ টা বেজে ১০মিনিট।তীব্র কিছুক্ষণ আগেই কল করে জানিয়েছে সে মিটিং এ যাবে।বার বার বলেছে সে যেন নিজের খেয়াল রাখে।তীব্রর কেন যেন মনটা কু ডাকছে।সকাল থেকে প্রায় ৪-৫বার কল করে বলেছে সে যেন নিজের খেয়াল রাখে।বাসায় তেমন কেউ নেই শুধু কাজের লোকগুলো ছাড়া।রুপ তৃপ্তি কে নিয়ে স্কুলে গেছে। তীর,আমির অফিসে।আর দাদি গেছে গ্রামে কিছু কাজে। বাসায় রিদি একা বর্তমানে।তীব্রর জরুরি মিটিং না হলে সে আসত না আজ।তবে বাসা থেকে বের হয়ে অফিস পর্যন্ত যাওয়া অবদি না হলেও ৫-৬বার কল করেছে তীব্র। রিদি ওয়াসরুমে গেলেও তাকে বলে যাওয়া লাগছে।রিদি বিরক্ত হয়ে তাকালো তীব্রর দিকে।
হয়েছে???আর কিছু? আপনার লেট হচ্ছে না??
জান আপনি কিন্তু আপনার খেয়াল রাখবেন আর আমার ছোট প্রানটারও।রিদি হাসল ভাগ্যবতী নারী সে।সম্মতি দিল।সে তাদের খেয়াল রাখবে।তীব্রর মন তবুও খচখচ করছে। হারানোর ভয়টা ঘিরে ধরেছ তাকে। যদিও রিদির অতিরিক্ত খেয়াল রাখার কারনে ডেলিভারি রিস্ক কিছুটা কমেছে। তবুও মন তো!!
তীব্রর কল কাটার ঠিক ১০মিনিট পরেই আবারো ফোন বেজে উঠে।রিদি বিরক্ত হয়ে ফোন তূলে দেখে আননোন নাম্বার।রিদি কল রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে ভেসে আসে তীব্রর কন্ঠস্বর,
“জান ভালো থাকবেন। আমার সময় শেষ।কথাটা বলেই জোরে নিঃশ্বাস নিল তীব্র।
রিদি স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।ফোন কানে রেখে ধপ করে বিছানায় বসে পড়ে।
তীব্র একটু থেমে জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিয়ে বলে,
“আপনাকে লাস্ট একবার দেখতে মন চাইছে”
এবার হু হু করে কেঁদে ওঠে রিদি।মুখ দিয়ে শব্দ বের হচ্ছে না।১০মিনিট আগেও তো কথা বলল।ওপাশ থেকে তীব্রর আওয়াজ আসছে।
জান!!নিজের খেয়াল…..
ননননা এইতো কিছুক্ষণ আগে কথা বললেন।কি হয়েছে আপনার।প্লিজ এসব বলবেন না।আমি মরে যাব আপনাকে ছাড়া।তীব্র প্লিজ কি হয়েছে বলুন। কোথায় আছেন? আমি আসছি!!হ্যালো!!তীব্র!!তীব্র!!রিদি ভারি পেট নিয়ে বাইরে গেটের কাছে আসতেই গার্ড এগিয়ে আসে।রীদিকে বিধ্বস্ত অবস্থায় দেখে অবাক হয়ে বলে,
ম্যাম আপনি ঠিক আছেন!!
রিদির মুখ থেকে কথা বের হচ্ছে না।তবুও খুব কষ্টে বলল,
গেট খুলুন বাইরে যাব।
গার্ড একে অপরের দিকে তাকিয়ে বলল,
কিন্তু আপনি এই অবস্থায় কোথায় যাবেন??
আমাকে যেতে দিন প্লিজ তীব্র কল করেছিল।ওর কিছু হয়েছে।
গার্ড চমকে উঠে,
তাৎক্ষণিক ফোন বের কল করে কাউকে। কিন্তু ফোন রিসিভ হচ্ছে না।রিদি এতোক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে পারবে না।তীব্রর তাকে দরকার।তাই গার্ডদের ওপেক্ষা করেই একাই বেরিয়ে পড়ে। এদিকে সবাই তীব্রকে ফোন করায় ব্যস্ত থাকায় রিদির চলে যাওয়া খেয়াল করল না।লিলি রোডে আসতেই একটা অটোতে উঠে পড়ে।
জলদি চলুন!!আমার হাজবেন্ড ভালো নেই!!
প্লিজ!!
আপনাতেই আমি পর্ব ৫৩
রিদি ফোন হাতে বার বার তীব্র কে কল করছে। কিন্তু ফোন রিসিভ হচ্ছে না। এদিকে হুট করে মনে হচ্ছে রিদির পেট ব্যাথা করছে। দাঁতে দাঁত চেপে ব্যাথা সহ্য করতে চেয়েও পারছে না। কাঁপছে শরীর। ব্যাথায় চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছে।অটোর হ্যান্ডেল শক্ত করে ধরে নিজেকে সামলাতে চেয়েও পারছে না।শরীর ক্রমশ খারাপ করছে।কারো কথা কানে ভেসে আসলেও মস্তিষ্ক ধরতে পারল না।ধীরে ধীরে পেটের ব্যাথায় শরীর ধরে রাখার ক্ষমতা হচ্ছে না।
আমার বাবু কে কেউ বাঁচাও!তীব্র আপনি আমাদের বাবুকে বাঁচান।প্লিজ আমাদের ছেড়ে যাবেন না।তীব্র ফিরে আসুন তীব…..
আর কিছু বলার সুযোগ হলো না রিদির। ঙ্গান হারিয়ে হেলে পড়ল পেছনে।