হ্যালো 2441139 পর্ব ৫১
রাজিয়া রহমান
রাতের শোয়ার সময় পিয়াসা আর আষাঢ় একাকী হলো।নয়তো সারাদিন পিয়াসা বাহিরে বাহিরে ছিলো যাতে আষাঢ়ের মুখোমুখি না হতে হয় তার জন্য। আবার আষাঢ় ও ছাদে ছিলো যাতে পিয়াসা রুমে নির্বিঘ্নে থাকতে পারে।
ফলশ্রুতিতে কারোরই রুমে থাকা হয় নি সারাদিন, বিশ্রাম নিতে পারে নি কেউ।
রাতে খাওয়ার পর পিয়াসা রুমে এসে বাবাকে কল করে। বাবা মা দুজনেই কল করেছিলো দিনে কিন্তু কথা বলতে পারে নি পিয়াসা।
আনোয়ার চৌধুরী ফোনের ওপাশ থেকে হ্যালো বলতেই পিয়াসার মনে হলো তার মরুর মতো শুষ্ক বুকে যেনো জলের দেখা মিললো।ভালোবাসার বৃষ্টি এসে ভরিয়ে দিয়ে গেলো পিয়াসার মন প্রাণ। অশান্ত হৃদয় প্রশান্তিতে ভরে উঠলো।
আনোয়ার চৌধুরী নরম গলায় বললো, “কেমন আছো মা?”
পিয়াসার বুক চিরে দুঃখেরা বের হয়ে আসে।চোখের সামনে লাল,নীল হয়ে ধরা দেয় এক পশলা যন্ত্রণা। এতো মধুর সুরে বাবা যখন ডাকে পিয়াসার তখন অসহ্য যন্ত্রণা হয়।একটা সময় বাবা বলে ডাকার কি আকুতি ছিলো, বাবার সাথে কথা বলার কতো আক্ষেপ ছিলো সব কিছু মনে পড়ে যায়।
ব্যাকুল হয়ে একটু কাঁদতে চায় পিয়াসা।
দুই চোখকে তার ভীষণ বেঈমান, নিষ্ঠুর মনে হয়।
এক ফোঁটা অশ্রু এলে কি এমন ক্ষতি হতো!
বরাবরের মতো শুষ্ক চোখ পিয়াসার।দেখে মনে হয় তার কোনো কষ্ট নেই,দুঃখ নেই,যন্ত্রণা নেই।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটিয়ে পিয়াসা বললো, “আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি বাবা,তোমরা কেমন আছো?”
“আমি ভালো আছি মা,তোর মা ভালো নেই।তার ধারণা তার মেয়েকে আমি হাত পা বেঁধে আটলান্টিক মহাসাগরে নিক্ষেপ করেছি।তার দিন শুরু হয় আমাকে নিয়ে রাগারাগি করে আর দিন শেষ হয় তোর জন্য কাঁদতে কাঁদতে।”
পিয়াসার সব কষ্ট যেনো এক মুহূর্তে বিলীন হয়ে গেলো। এই পৃথিবীতে যার একটা সময় কেউ-ই ছিলো না তার জন্য ভাবার মতো দু’জন মানুষ আছেন এখন।এর চাইতে খুশির আর কি হতে পারে পিয়াসার জীবনে!
পিয়াসা হাসলো।হুট করেই মনটা ফুরফুরে হয়ে গেলো। হেসে বললো, “মা’কে বলো আমি ভীষণ ভালো আছি।আমার জন্য একটুও ভাবতে হবে না মা’কে। আর আমি আমার মা’য়ের মেয়ে,আমাকে আঘাত করা এতো সহজ হবে না।”
“বলতে হবে না মা,লাউড দেওয়া আছে তোর মা শুনছে।”
শারমিন ফোন টেনে নিয়ে বললো, “তুই ভালো আছিস তো মা?এরা তোকে কোনো কষ্ট দিচ্ছে না তো!”
“মা এতো চিন্তা করছো কেনো?আমি নিজেই নিজেকে রক্ষা করতে জানি এখন তার উপর এখন তোমাদের জামাই আছে না!সে থাকতে কেউ আমাকে কিছু বলে রক্ষা পাবে?আমি বিন্দাস আছি মা।”
ইচ্ছে করেই পিয়াসা আষাঢ়কে তোমাদের জামাই বলে সম্বোধন করে যাতে করে বাবা মা বুঝতে পারে তাদের সম্পর্ক ভীষণ ভালো আছে।
শারমিন বুঝলো ও তাই।আনোয়ার চৌধুরী মুচকি হেসে চোখ ইশারা করে স্ত্রীকে বললেন,”দেখলে তো,আমি ভুল করি নি।”
উত্তরে শারমিন মুখ বাঁকিয়ে পিয়াসাকে বললো, “বাসায় আসবি না মা?তোকে ছাড়া এই বাড়ি কেমন মৃত্যুপুরী।”
“যাবো মা,আরো কয়েকটা দিন পর যাবো।আগে এখানে এদেরকে একটু নাচিয়ে নিই।”
“কাকে নাচাবি?”
“যারা এতো দিন রজনী আন্টিকে নাচিয়েছে মা।”
শারমিন বললো, “যা ভালো মনে করিস।মনে রাখিস,তোর বাবা মা সবসময় তোর পাশে আছে।কোনো বিপদ হলে সবার আগে বাবা মাকে জানাবি।আমি ওদের শিক্ষা দিয়ে ছাড়বো।”
পিয়াসা স্বস্তি নিয়ে কথা শেষ করে।
আষাঢ় রুমে ঢুকে দেখে পিয়াসা ফেসবুক স্ক্রোল করছে।তার সাথে তার বউয়ের ফেসবুকে এড নেই,কি অদ্ভুত ব্যাপার!
নিজের ফোন নিয়ে আষাঢ় ও অন্য দিকে ফিরে শুয়ে পড়লো।
হুট করেই দেখলো আষাঢ় তাকে ফ্রেন্ড রিকুয়েস্ট দিয়েছে।
পিয়াসার হাসি পায়।
আষাঢ়ের রিকুয়েস্ট একসেপ্ট না করেই আষাঢ়ের আইডি ভিজিট করে।
প্রথম পোস্ট দেখেই পিয়াসার কেমন অদ্ভুত অনুভূতি হতে থাকে।আষাঢ় গতরাতেই ম্যারিড স্ট্যাটাস দিয়ে ফেলেছে।
পিয়াসা পেছন ফিরে তাকায় এক নজর।
এই মানুষটাকে সে ভালো খারাপ কোনো কাতারেই ফেলতে পারছে না।
না পারছে এর সাথে সহজ হতে।
পিয়াসা বোকা মেয়ে না।পিয়াসা জানে জীবনে বিয়ে একবারই হয়।তা নিজের ইচ্ছেতে হোক বা বাবা মা’য়ের খুশির জন্য।
একবার কাগজে স্বাক্ষর করে যাকে স্বামী বলে আল্লাহর কাছে কবুল বলে নিয়েছে তাকে অস্বীকার করা যাবে না এই জীবনে।
তাহলে তাকে মেনে নিতে এতো দ্বন্দ্ব কেনো!
সে তো কোনো লুকোচুরি করে নি তার ব্যাপারে। সবার সামনে স্পষ্ট গলায় তাকে বউ বলে প্রায়োরিটি দিতে তার একবার ও গলা কাঁপে নি।
পিয়াসা নিজের সাথে নিজে যুদ্ধ করে খানিক সময়।
এই মানুষটাকে হাজারো মেয়ে পছন্দ করে। কোচিং-এ গিয়ে পিয়াসা সেই প্রমাণ পেয়েছে।
আষাঢ়ের ম্যারিড স্ট্যাটাসের কমেন্ট চেক করে পিয়াসা।ঠোঁটের কোণে ফুটে উঠে কেমন বিজয়ীর হাসি। হাজারো মেয়ের কমেন্ট।
এই যে এতো এতো মেয়েদের কাছে যে ড্রিম বয়,সে কিনা পিয়াসার কাছে এক ফোঁটা ভালোবাসা চায়!
পরমুহূর্তেই পিয়াসা কুঁকড়ে যায়। কালো অতীত এসে হানা দেয় পিয়াসার মানসপটে। ভেঙে চুরমার হয়ে যায় পিয়াসা আবারও।
এই ক্ষত কখনো মুছবে না।
পিয়াসা ভাবতে পারে না আর।ফেসবুক স্ক্রোলিং এ মন দেয় আবারও।
স্ক্রোল করতে করতে একটা পোস্ট সামনে আসে পিয়াসার।
এক মুহূর্তে পিয়াসার মনে হয়, এটাই দরকার তার।
পোস্টটা তেমন কিছু না,একটা চাকরির পোস্ট। একটা রেস্টুরেন্টে ওয়েটার লাগবে।নারী/পুরুষ উভয়ই প্রাধান্য পাবে।
পিয়াসার মনে হলো মহুয়া বেগমের অহংকার চূর্ণ বিচূর্ণ করে দেওয়ার জন্য এই কাজের চাইতে পারফেক্ট আর কিছুই হতে পারে না।
পিয়াসা রেস্টুরেন্টের ডিটেইলস দেখে।লোকেশন দেখে বুঝতে পারে খুব বেশি দূরে হবে না।রিকশায় ২০/২৫ মিনিট লাগবে হয়তো।
তাছাড়া পার্ট-টাইম ও করতে পারবে।
পিয়াসা এক মুহূর্ত ভেবে নেয়।সে যদি বিকেলের শিফটে জয়েন করে তাহলে যদি ঢাবিতে তার চান্স হয় সেখানে ক্লাস চলাকালীন ও করতে পারবে অথবা ঢাবিতে চান্স না পেলে প্রাইভেট ভার্সিটিতে এডমিশন নিবে। সেখানে থেকে ও পারবে।
পিয়াসা বিছানা থেকে নেমে বারান্দায় যায়।বাবার সাথে কথা বলতে হবে আগে।
আনোয়ার চৌধুরী শুয়েছেন। সবেমাত্র চোখ লেগে এসেছে সেই মুহূর্তে মেয়ের কল পেয়ে শঙ্কা জাগে তার।
কোনো বিপদ হয় নি তো!
তড়িঘড়ি করে কল রিসিভ করে হ্যালো বলেন।
বাবার হ্যালো শব্দটার মধ্যেই পিয়াসা রাজ্যের শঙ্কা অনুভব করতে পারে।
মনে মনে বলে এজন্যই তুমি এই পৃথিবীর বেস্ট বাবা।
হেসে বললো, “বাবা,একটা কথা বলার জন্য তোমাকে ডিস্টার্ব করলাম।”
“কি কথা মা?”
“আমি যদি কোনো ছোটখাটো জবে ঢুকি,লাইক কোনো রেস্টুরেন্টের ওয়েটার হিসেবে তাহলে কি তোমার খুব বেশি লজ্জা লাগবে?”
আনোয়ার চৌধুরী হেসে ফেলেন মেয়ের কথা শুনে।
“বাবা,কোনো কাজই তো ছোট না।সৎ পথে থেকে যেই কাজই তুমি কর তাই ভীষণ দামী।এতে আমার ভীষণ গর্ব হবে এই ভেবে যে আমার মেয়ে এতো বিলাসিতার মধ্যে বড় হয়েও সে অহংকারী হয় নি।বরং বিনয়ী হয়েছে।
নিজে কিছু করার ট্রাই করছে।ওয়েটারের কাজ বলে নাক সিঁটকায় নি সে।”
পিয়াসা হেসে বললো, “আই লাভ ইউ বাবা,তুমি পৃথিবীর সেরা বাবা।আমি জানতাম তুমি কখনোই আমাকে ডিমোটিভেট করবে না।”
শারমিন উৎসুক হয়ে তাকিয়ে রইলো।
কল রাখতেই আনোয়ার চৌধুরী বললেন,”আমার সন্তান অনেক বড় হয়ে গেছে শারমিন। আমার মেয়ে একটা চাকরি করতে চাইছে।”
“কিসের চাকরি?”
“ওয়েটার।”
শারমিনের মন খারাপ হয়।মেয়ের বাবার মতো সে এতো মুক্তমনা না।তাই মুখ গোমড়া করে বললো, “ওর বাবা একজন ডাক্তার, মা সহকারী প্রধান শিক্ষক। সেখানে আমার মেয়ে ওয়েটারের কাজ করতে চায়?ওর কিসের অভাব আছে?প্রতি মাসে ওর বিকাশে একটা বিগ একাউন্ট তুমি পাঠাও,ওকে তোমার ক্রেডিট কার্ড দিয়ে রাখা হয়েছে। তবুও ওকে এই চাকরি করতে হবে? ও কোন বাড়ির মেয়ে,কোন বাড়ির বউ তা ও ভুলে গেলো!”
আনোয়ার চৌধুরী হাসেন।স্ত্রীর হাত ধরে বলেন, “শারমিন, তুমি না স্কুলে বাচ্চাদের শেখাও কোনো কাজই ছোট না।সেই তোমার মুখে আজ এই কথা কি মানায় বলো!”
শারমিন অবুঝের মতো মাথা নাড়িয়ে বলেন, “পুঁথিগত কথায় জীবন চলে না সবসময় চৌধুরী। তুমি ও জানো তা।বইয় যা মানায় বাস্তবে সবসময় যে তা মানাবে এমন কোনো কথা নেই।
আমার মেয়ে,আমার পুতুলের মতো যত্ন করে গড়ে তোলা মেয়ে কি-না মানুষের জন্য খাবার নিয়ে ছোটাছুটি করবে?খাবার দিতে দেরি হলে মানুষ তাকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে কথা বলবে!
সে টেবিল পরিস্কার করবে?
প্লেট পরিস্কার করবে?
এসব কখনো আমি দুঃস্বপ্নে ও ভাবি নি।”
“শারমিন, অবুঝের মতো কথা বলো না।বরং তোমার তো খুশি হওয়া উচিত এই ভেবে যে আমাদের মেয়ে বিপুল অর্থসম্পদ, বিলাসিতায় বড় হয়েও ননীর পুতুল হয় নি।সে তোমার, আমার শিক্ষায় বাস্তবিকই শিক্ষিত হতে পেরেছে। পেরেছে বলেই তার কাছে মনে হয় এই কাজটা আমাদের স্ট্যাটাসের সাথে যায় না।
অন্য কেউ হলে হয়তো ভাবতো যার বাবা মা’য়ের এত অর্থসম্পদ আছে,শ্বশুর বাড়ি এতো অবস্থাসম্পন্ন,প্রভাবশালী। সেখানে সে রানীর হালে থাকবে।
আমার মেয়ে নিজের সেই আরাম আয়েশের চিন্তা না করে নিজেকে সাধারণ মানুষের মতো করে ভেবেছে।
সে বাবা,মা,স্বামীর উপর নির্ভরশীল নয়।সে নিজেকে স্বাবলম্বী করতে চায়।তুমি তোমার ছোট্ট মেয়েটার কনফিডেন্স,তার চিন্তা ভাবনার জন্য তোমার আনন্দিত হওয়ার কথা।”
শারমিন সব বুঝে।তবুও মা’য়ের মন।মেয়ে কষ্ট করবে তা কিছুতেই মানতে চায় না।বিলাসবহুল জীবনের সুযোগ থাকার পরেও মেয়ে পরিশ্রম করবে ভাবলেই মা’য়ের বুকে ব্যথা শুরু হয়। এই ব্যথা শুধু মায়েরাই জানবে।
পিয়াসা সাথে সাথে মেইল করে। ২০ মিনিট পরেই মেইলের রিপ্লাই পায়।আগামীকাল বিকেল চারটে থেকে তাকে জয়েন করতে বলা হয়। বাকি আলোচনা সেখানেই হবে।
হ্যালো 2441139 পর্ব ৫০
পিয়াসা আনন্দিত মনে শুয়ে পড়ে সকালের অপেক্ষা করে। কখন সে খবরটা খাওয়ার টেবিলে বোমের মতো ব্লাস্ট করবে আর কখন মহুয়া বেগমের জমিদার বংশের সব অহংকার তার পায়ের নিচে এসে গড়াগড়ি খাবে।সেই অহংকারে পা দিয়ে খণ্ডবিখণ্ড করে পিয়াসা জবে ঢুকবে।
তবেই না হবে তার রজনী আন্টির হয়ে বদলা নেওয়া!