তরঙ্গে তোমার ছোঁয়া পর্ব ৩১

তরঙ্গে তোমার ছোঁয়া পর্ব ৩১
ফারহানা নিঝুম

নিস্তব্ধ রাত। চারদিকে যেন শব্দের অস্তিত্ব পর্যন্ত হারিয়ে গেছে। বাতাস থমকে আছে, গাছের পাতাগুলো পর্যন্ত নিস্তেজ। হঠাৎ করেই সেই নিস্তব্ধতা ভেঙে এক ঝাঁক পাখির মতো ছুটে আসে ঝুমুরের কণ্ঠ।
নবীন তার মুখ চেপে ধরে, যেন যেন ঝুমুরের চিৎকার আবার বাতাসে ভেসে না যায়। কিন্তু তার অগোচরে, ঝুমুরের পিঠে কোথায় যেন অদৃশ্য এক অনুভূতি ঢুকে যায় এক ধরনের অস্বস্তি, যা স্পষ্ট না হলেও অস্বাভাবিকভাবে শরীরের প্রতিটি কোণাকুণায় ছড়িয়ে পড়ে। কিছু একটা অদ্ভুত যেন তার জামার ভেতর কুচিয়ে চলেছে। প্রথমে সে মনোযোগ দেয় না, কিন্তু তারপর এক পাঁজর কাঁপানোর মতো অনুভূতি। তেলাপোকাটি যেন পিঠের সাথে খেলতে খেলতে এক অদৃশ্য স্রোতের মতো নিচে নামে।

ঝুমুরের শরীরের ভেতরে যেন মুহূর্তের জন্য সময় থেমে যায়। তেলাপোকা তার কোমল ত্বকের স্পর্শে কোনো জাগতিক প্রলেপ রেখে যাচ্ছে। সে নিজেকে আর ধরে রাখতে পারে না, শরীরের ভেতর এক প্রচণ্ড অস্বস্তি সৃষ্টি হয় ঝুমুরের শরীর কাঁপে, আর তার হাত শক্ত করে নবীনের হাত ধরে।
নবীন কিছু বুঝে উঠতে না পারলেও ঝুমুরের চোখে তীব্র আ’তঙ্ক, চোখের কোণে যেন এক অন্ধকার আছড়ে পড়ে। সে জোরে চিৎকার করতে চায়, কিন্তু নবীনের হাতের দৃঢ় চেপে ধরায় কিছুতেই শব্দ বের হয় না।
তেলাপোকাটির চলাচল যেন রাতের অন্ধকারের একটি গাঢ় রহস্য তাও যদি এই মুহূর্তে তার প্রতি চড়াও হতে পারে, তবে আর কী? সেই ছোট্ট অশুভ প্রাণী মুহূর্তে হয়ে উঠছে এক আত’ঙ্কের ছায়া যা স্বাভাবিকতার সব রেখা ছিন্ন করে ফেলে।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

ঝুমুর কাঁপতে কাঁপতে বলল,
“নবীন, তেলাপোকা জামার ভেতর…”
তার কণ্ঠে যেন কোনো শক্তি নেই, কেবল নিঃশ্বাসে ভরা এক অপ্রতিরোধ্য আত’ঙ্ক।
নবীন তৎক্ষণাৎ জামার ভেতর হাত ঢুকিয়ে বের করে আনে তেলাপোকাটিকে, আর ঝুমুরের শরীরে আবার জীবনের স্পর্শ ফিরিয়ে দেয়। বিদ্যুৎ গতিতে দূরে সরে গেল নবীন, অপরাধী কন্ঠে বলল,
“আমি দুঃখিত ঝুমুর। তোমার অনুমতি না নিয়ে ওভাবে তেলাপোকা বের করেছি। তুমি চিৎকার করবে আর ভয়ও পাচ্ছিলে! আমি সত্যি দুঃখিত! সরি ক্ষমা করো আমাকে।”
নবীন এক মূহুর্ত অপেক্ষা করলো না, চুপচাপ বেরিয়ে গেল কিচেন থেকে।না হলো তার পানি নেওয়া। ঝুমুর ঠায় দাঁড়িয়ে আছে, লোকটা কে ভুল বুঝেছি ঝুমুর। লোকটা তো প্রথমেই বলেছিল তেলাপোকা, কিন্তু ঝুমুর গুরুত্ব দেয়নি।আর তাকে হেল্প করেছে, একদমই বাজে ভাবে ছোঁয় নি। নবীন কেনো নিজেকে অপরাধী ভাবছে?ঝুমুরের উচিত নয় কি তার সাথে কথা বলা? অবশ্যই উচিত।
সকাল সকাল ঝুমুর চেয়েছিল নবীনের সাথে কথা বলতে কিন্তু নবীন তাকে এড়িয়ে গেছে। ঝুমুর বিষয়টি বুঝতে পেরেছে।অবশ্য তার দোষ নেই, প্রথম থেকেই ঝুমুর নবীনের সঙ্গে খুব বাজে আচরণ করে।হয়তো সেই জন্য সে ভাবছে কালকে রাতের বিষয়টি নিয়ে তাকে কিছু কথা শোনাবে।

ঘুমে কাতর হয়ে আছে ফারাহ।বক্ষভাজে লেপ্টে রয়েছে তাশফিনের। উদোম গায়ে বিছানায় একে অপরের সহিতে। ঘুমের মধ্যেই হাত রাখলো তাশফিনের উন্মুক্ত বক্ষপটে।চোখ দুটো কুঁচকে এলো তার, পিটপিট করে তাকালো সে। নিজের এতটা কাছে তাশফিন কে দেখে পিলে চমকে উঠে।সরতে গিয়েও থেমে গেলো সে
ক্লিন শেভ করা গালে ভীষণ ভাবে ছুঁতে ইচ্ছে করলো।ধীরে ধীরে হাত বাড়িয়ে গাল ছুঁয়ে দিলো আলগোছে। অকস্মাৎ হাত চেপে ধরলো তাশফিন। আঁতকে উঠে ফারাহ।
“মিসেস শেখ সকাল সকাল এসব শুরু করেছেন আপনি?”
ভয়ে তটস্থ ভঙ্গিতে বলে উঠে ফারাহ।
“না মানে আসলে আমি..ওই ওই আর কি!”
“উফ্ মিসেস শেখ আপনি আমাকে ইদানিং বড্ড জ্বালা’চ্ছেন। আমি যদি জ্বা’লানো শুরু করি সইতে পারবেন তো?”
ড্যাবড্যাব করে তাকালো ফারাহ।কি ঠোঁটকাটা পুরুষ, সবসময় তাকে কায়দা করে জব্দ করে।
“আপনি না ভীষণ বাজে।”
ফিচলে হাসে তাশফিন, দু’হাতে জড়িয়ে ধরে ফারাহ কে।
“আই নো।”

লজ্জায় আড়ষ্ট হয় মেয়েটা।উঠতে দিলো না তাকে, জড়িয়ে ধরে ওভাবেই শুয়ে রইলো।
সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে গেছে স্নেহা।সে আগেভাগেই রেডি হয়ে বসে আছে। আজকে আবারো ফারাহর সঙ্গে কলেজে যাবে সে। একটা মজার বিষয় আছে, সেহেতু পাবলিক কলেজ সেই সুবাদে স্টুডেন্টদের সাথে মিশে চুপিচুপি ক্লাস করে আসলেও কেউ ধরতে পারে না। বেশ মজা লাগে স্নেহার। ফারাহর শরীর টা অনেকটা ভালো।কোমড়ের ব্যথাটা নেই এখন, থাকবে কি করে?একটা মানুষ একটু পর পর যদি খুব যত্ন নিয়ে মালিশ করে দেয় তাহলে কি করে থাকবে?তাশফিন হয়তো ভেবেছে ফারাহ কিছুই বুঝতে পারেনি। উঁহু ফারাহর শরীরে কেউ হাত রাখবে আর তা ফারাহ বুঝতে পারবে না? ফুরফুরে মেজাজে সিঁড়ি বেয়ে নিচে এলো ফারাহ। কিছুক্ষণ আগে মনটা একটু খারাপ ছিলো, কারণ তাশফিন সকাল সকাল বেরিয়ে গেছে তাই। কিন্তু তারপরেও ভেতরের আনন্দ টা মন খারাপ গুলো দূ্র করে দিয়েছে।

“চল।”
“হ্যা চল।”
ফারাহ আর স্নেহা বেরিয়ে পড়লো, ঝুমুর যাবে না।অবশ্য সে নিজের অনলাইন ক্লাস নিয়েই ব্যস্ত থাকে সর্বদা।
“ভাইয়া আপনি?”
গেটের সামনে গাড়ি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সাইফুল। সাইফুল দেখে কিছুটা অবাক হলো ফারাহ।এ সময় সে অফিসে থাকে,অথচ আজকে বাড়িতে? স্নেহা আর ফারাহ কে একসাথে দেখে মৃদু হাসলো সাইফুল।
“কলেজে যাচ্ছো? চলো আমি ড্রপ করে আসি।”
অবাক নেত্রে পল্লব ঝাপটায় ফারাহ।
“কিন্তু ভাইয়া আপনার অফিস আছে তো?আর আমরা একাই যেতে..
“আরে না না সমস্যা নেই,চলো। তাছাড়া গাড়ি থাকতে একা হেঁটে যাবে কেন?”
স্নেহা এক গাল হেসে বলল,
“হ্যা চল কষ্ট করে হেঁটে যাওয়ার কি দরকার। সাইফুল ভাইয়া আপনি বরং আমাদের পৌঁছে দিন।”
স্নেহা নাচতে নাচতে গাড়িতে উঠে গেল, শেষমেষ ফারাহও উঠে বসলো গাড়িতে।
গাড়ি চলছে আপন গতিতে,সিটে হেলান দিয়ে বসে আছে ফারাহ,হুট করেই মনে হচ্ছে তার মাথা ব্যথা ধরছে ধীরে ধীরে।ব্যাগ থেকে এক গাদা চকলেট বের করলো স্নেহা, দুটো ছিঁড়ে একটা ফারাহ কে দিলো।
“এই নে ললিতা খা।”
ফারাহ গদগদ ভঙ্গিতে চকলেট হাতে নিয়ে নিল। ওদিকে এক জোড়া শকু’নি দৃষ্টি চেয়ে আছে তার দিকে। গভীর হচ্ছে দৃষ্টি। সর্বাঙ্গে বিচরণ করছে ফারাহর। বাইরের দিকে তাকিয়ে চকলেট শেষ করে লুকিং গ্লাসের দিকে আনমনে তাকালো ফারাহ। দৃষ্টি সরিয়ে ড্রাইভিংয়ে মনোযোগ দেয় সাইফুল। কেমন অস্বস্তি লাগছে ফারাহর। সাইফুল কি তার দিকে তাকিয়ে ছিলো? আচ্ছা এই বিষয়টি নিয়ে কি তাশফিনের সাথে কথা বলা উচিত তার?

বিকেল হয়ে এসেছে,রোদটা ধীরে ধীরে নরম হয়ে আসছে। সূর্যের আলো ঝিমিয়ে পড়ে, চারপাশে ছায়া গাঢ় হতে থাকে। পাখিরা ফিরতে থাকে নীড়ে, গাছের পাতায় হালকা হাওয়া বাজে মৃদু সুরে। আকাশে লালচে সোনালি আভা ছড়িয়ে পড়ে, যেন প্রকৃতির তুলিতে আঁকা এক অপূর্ব ছবি।কখনো এই সময়টা মনে করিয়ে দেয় উদাসী ভালোবাসা, আবার কখনো করে তোলে মনটা প্রশান্ত। শহরে ব্যস্ততা একটু থেমে যায়, কিছু সময় পরেই মসজিদের মাইকে আসরের আযান শুরু হলো।রুবেনা শেখ, রিজুয়ান শেখ,রাইমা শেখ এবং আলাফ শেখ আজকে ফিরেছেন।যাক এবারে তারা কিছুটা নিশ্চিন্ত।এত দিন রাইমা র বাবার বাড়িতে জমিজমা নিয়ে কেস চলছিল। বৃদ্ধ মানুষ কিছুই করতে পারছিলেন না রাইমার বাবা ‌। মায়ের অবস্থাও খুব খারাপ ছিলো। অবশেষে মেয়ে হিসেবে পাশে দাঁড়িয়েছিল রাইমা শেখ। ভেবেছিল যা করার তাকেই করতে হবে। কিন্তু না আলাফ শেখ এবং রিজুয়ান শেখ,রুবেনা শেখ যে এভাবে পাশে দাঁড়াবেন তিনি কখনো ভাবতে পারেন নি। শেষমেষ কেসের ঝামেলা টা মিটে গেছে।
সৌহার্দ্য ফিরে গেছে নৌঘাঁটিতে।তবে তাশফিন আরো কিছু দিন থাকবে, কিন্তু কারণ কি তা সৌহার্দ্য কে জানায় নি সে। কিছুটা আশ্চর্য হলেও জিজ্ঞেস করেনি সে।

মাহির বিকেল থেকে ঘুমাচ্ছে, ছেলেটার শরীর খারাপ, এদিকে বাড়িতে কেউই নেই। নূপুর কল আর অপেক্ষা করতে পারলো না, অবশেষে কল করলো তাশফিন কে।
দু বার রিং হতেই রিসিভ করলো তাশফিন।
“হ্যা নূপুর বল।”
মাহিরের কপালে হাত রেখে নূপুর অস্থির কন্ঠে বলল,
“শোনো না ভাইয়া মাহিরের খুব জ্বর ।কি করব বুঝতে পারছি না।বাবাও বাড়িতে নেই।”
“চাচা কোথায়?”
“একটু আগেই চাচা বাজারে বেরিয়েছে।”
“আচ্ছা তুই রেডি হয়ে নে আমি কাউকে পাঠাচ্ছি।”
নূপুর চটজলদি তৈরি হয়ে নিল।মাহির কে শার্ট প্যান্ট পড়িয়ে কোলে নিয়ে সদর দরজা দিয়ে বাইরে এলো।মেরুর রঙের গাড়িটা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে নিহাল।নিহাল দেখে পিলে চমকে উঠে নূপুরের।
“নিহাল ভাইয়া আপনি?”

অল্প হাসলো নিহাল, মৃদু স্বরে বলল।
“হ্যা তাশফিন বললো ইমারজেন্সি আছে।চলো গাড়িতে উঠো তুমি।মাহির কে আমার কোলে দাও।”
ভাবনায় পড়ে গেল নূপুর,নিহালের সঙ্গে যাওয়াটা কি ঠিক হবে?নিহাল বেশ বুঝতে পারছে নূপুরের অস্বস্তি।
“নূপুর মাহির অসুস্থ,তাশফিন আমাকে ভরসা করে পাঠিয়েছে। তুমি উঠো প্লিজ।”
নূপুর দেরী করলো না, মাহির কে নিহালের কোলে দিয়ে গাড়িতে উঠে পড়ে। ঠিকঠাক বসতেই নিহাল মাহির কে ভেতরে দিল।নিজেও ড্রাইভিং সিটে বসে দ্রুত ড্রাইভ শুরু করে।
সময়টা ছয় বছর আগে।
বৃহস্পতিবার সকাল….
ভার্সিটি থেকে ফিরেছে নূপুর। আজকে উৎসব লেগেছে, সন্ধ্যার দিকে নাকি নূপুর কে দেখতে আসবে পাত্রপক্ষ। স্তম্ভিত নূপুর।কি হলো ব্যাপারটা? হঠাৎ করে তাকে বিয়ে দিতে চাইছে কেনো? রাগ টা নিজের ভেতরে রেখেই ধুমধাম পা ফেলে দোতলার দিকে চলে গেল নূপুর।
রাগ হচ্ছে প্রচুর তার,এটা কোনো কথা?ওয়াশ রুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ে নূপুর। লম্বা নিঃশ্বাস ফেলছে সে।

সাইফুল শেখ,তাকে বেশ পছন্দ করেন রুবেনা শেখ। নূপুরও‌ তাকে ভালোবাসে। কিন্তু আজ হঠাৎ অন্য কোনো পাত্র কেন আসবে তাকে দেখতে? সেগুলো ভাবতে ভাবতে আকাশ পাতাল এক করে দিচ্ছে নূপুর।
ম্লান বিকেল এক রকমের নরম, নিরব, আর খানিকটা বিষণ্ণতা মেশানো সময়। দিনের শেষভাগে সূর্যটা হেলে পড়ে পশ্চিম আকাশে, আলোটা তখন আর তত উজ্জ্বল থাকে না হালকা সোনালি আর কমলা রঙে চারপাশ ভেসে যায়।পাখিরা একে একে ফিরে আসে বাসায়, গাছের পাতায় নেমে আসে ধীর গতি। হাওয়া থাকে নরম, মাঝে মাঝে একটানা বয়ে চলে। শহরের কোলাহলও কিছুটা স্তিমিত হয়ে আসে, মানুষের মুখেও ক্লান্তির ছাপ।
নিহাল এসেছে তার মামা রবিউল ইসলাম কে নিয়ে।আপন বলতে মামা ব্যতিত কেউ নেই তার।তাশফিন গিয়ে ম্যানলি হাগ করে তাকে। বেস্ট ফ্রেন্ড তার, কিন্তু এই শুভ দিনে আরিয়ান নেই।সে খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি মিশনে রয়েছে।

তরঙ্গে তোমার ছোঁয়া পর্ব ৩০

রিজুয়ান শেখ ভীষণ পছন্দ করেন নিহাল কে,তাই তো বিয়ের প্রস্তাব দিতেই তিনি অমত করলেন না। বিষন্নতায় ডুবে আছে মুখখানি রুবেনা শেখের।শাড়ি পরেছে নূপুর, ঝুমুর তাকে নিয়ে এলো। পাত্র হিসেবে নিহাল কে দেখে পিলে চমকে উঠে তার। বিয়ের কথাবার্তা এগোয়,তবে নূপুর রাজি নয়।এমন নয় নিহাল খারাপ, কিন্তু নূপুর তো অন্য কাউকে ভালোবাসে।
পাত্রপাত্রী একে অপরের সঙ্গে আলোচনা করতে চায়। বিষয়টি জানতে পেরে খুব অবাক হলো নিহাল। আলাদা ভাবে আর কি জানতে চায় নূপুর?সে তো তার সম্পর্কে সবটাই জানে।

তরঙ্গে তোমার ছোঁয়া পর্ব ৩২