হ্যালো 2441139 পর্ব ৬০
রাজিয়া রহমান
৬ দিন শ্বশুর বাড়িতে কাটিয়ে রাতের বেলা আষাঢ় পিয়াসাকে নিয়ে ফিরছিলো।এই ৬ দিন আষাঢ়ের জীবনের সবচেয়ে সুন্দর সময় কাটিয়েছে সে।
সবচেয়ে বেশি যেই বিষয়টি আষাঢ়ের ভালো লেগেছে তা হলো শ্বশুর শাশুড়ীর মধ্যকার বন্ডিং।একে অন্যকে চোখে হারায় যেনো।
শ্বশুর যেমন কেয়ারিং, শাশুড়ী ও তেমনই সাপোর্টিং। প্রতিটি সন্তান যেমন দেখতে চায় তাদের বাবা মা’কে পিয়াসার বাবা মা তার জীবন্ত উদাহরণ।
আনোয়ার চৌধুরী ছোট থেকে বড় প্রতিটি ব্যাপারে স্ত্রীর পরামর্শ নেন।
রান্নাঘরে কাজ করার সময় কিছুক্ষণ পর পরই উঁকি মারেন,ঠান্ডা পানি,শরবত বানিয়ে দেন।
ঠিক তেমনই শারমিন আনোয়ার চৌধুরী মাঝরাতে ও যদি কোনো কিছুর নাম নেন শারমিন তাৎক্ষণিক সেটা করে দেয় স্বামীকে।
দুজনের মধ্যকার সম্পর্ক এতোটাই মধুর যে আষাঢ় রীতিমতো লজ্জা পাচ্ছিলো।সারাজীবন বাবা মা’য়ের মধ্যকার অসুস্থ সম্পর্ক দেখে আষাঢ় বড় হয়েছে। কখনো দেখে দুজন একত্রে খানিকটা সময় কাটিয়েছে।
কিছুদিন আগে বাবা যখন মা’কে নিয়ে ঘুরতে যায় আষাঢ় তখন ভেবেছিলো এবার হয়তো সব ঠিক হবে।কিন্তু কিছু ঠিক হয় নি।
আষাঢ়ের ভাবনার মধ্যে পিয়াসা আষাঢ়ের কাঁধে মাথা রাখে।আষাঢ় বাম হাতে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে পিয়াসাকে।পিয়াসার মধ্যে আজ আর কোনো জড়তা নেই।বরং স্বতঃস্ফূর্ত ভাব।বের হওয়ার আগ মুহূর্তে মা তাকে আলাদা ডেকে কিছু কথা বলেছিলো।
আলমারিতে শাড়ি ভাঁজ করতে করতে শারমিন পিয়াসাকে বললেন, “জীবন একটাই।আর এক জীবনে মানুষের বিয়ে ও একটাই।স্বামী মানে কী বল তো?”
পিয়াসা জবাব দিলো না।
শারমিন আবারও জিজ্ঞেস করলো,“আষাঢ় তোকে ভালোবাসে?”
পিয়াসা মাথা উপর নিচ করে সম্মতি জানায়।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
“কতটা ভালোবাসে?”
পিয়াসা জবাব দিতে পারে না। ইচ্ছে করে বলে যে সমুদ্রের চাইতে গভীর আষাঢ়ের ভালোবাসা কিংবা আকাশের চেয়ে অসীম।
শুধু মুখে বলে, “অনেক বেশি ভালোবাসে।আমি বুঝাতে পারবো না।”
শারমিন কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো, “তুই কী জানিস,কোথাও না কোথাও তুই ও শাহেদের মতো?”
পিয়াসার বুক কেঁপে উঠে মা’য়ের কথা শুনে। কি বললো মা এটা!
ভীষণ অপমানে পিয়াসার মুখ লাল হয়ে গেলো।
“কষ্ট লাগছে না এই কথাটা শুনে!
কিন্তু ভেবে দেখ তো,পারভীন আর শাহেদের মধ্যকার সম্পর্ক নষ্ট হওয়ার আসল কারণ কি ছিলো?”
পিয়াসা জবাব দেয় না।
“পারভীন শাহেদকে ভালোবাসলে ও শাহেদ পারভীনকে ভালোবাসে নি।পারভীন কিন্তু অপেক্ষায় ছিলো শাহেদের জন্য। ১২ বছর কম সময় না পিয়াসা।ভালোবাসাহীন একটা মুহূর্ত যেখানে এক জনমের সমান সেখানে ১ যুগ মানে কী তুই বুঝতে পারছিস নিশ্চয়!
পারভীনের ভালোবাসা শাহেদের মন গলাতে পারে নি। সৃষ্টিকর্তা কখনো কাউকে ঠকায় না পিয়াসা। তিনি পারভীনের জীবনে সাদেক আলীকে পাঠিয়েছেন।ছল করে হোক বা জোর করে হোক,সাদেক আলী পারভীনকে ছিনিয়ে নিয়ে গেছে। তুই ভেবে দেখ তো পারভীন কী আজীবন যন্ত্রণায় পুড়ে দগ্ধ হওয়ার জন্যই এসেছে? ওর কী সুখী হওয়ার অধিকার নেই বল?
শাহেদ যেমন পারভীনকে বুঝে নি ঠিক তেমনই তুই ও আষাঢ়কে বুঝতেছিস না।
একটা ছেলে কাউকে কতটা ভালোবাসলে তার কথা ভেবে সবার থেকে আলাদা হয়ে যায় ভেবেছিস?
আজ পারভীন কিন্তু সাদেকের কাছে সুখে আছে।কিন্তু শাহেদের কি অবস্থা দেখেছিস?
কে বলতে পারে আষাঢ়ের এতো ভালোবাসা, এতো যত্ন দেখে আষাঢ়কে ও অন্য কোনো মেয়ে চাইবে না?
আষাঢ়ের ক্রেজ কতটা তার ফ্যানবেজের কাছে তা আমার চাইতে তুই বেশি জানিস।
সেখানে একটা ছেলে শুধু তোকে কেন্দ্র করে ঘুরছে সর্বক্ষণ অথচ তুই?
জীবন খুবই সংক্ষিপ্ত পিয়াসা।আর তাই আমি তোর বাবাকে নিজের সবটা দিয়ে ভালোবাসি তেমনই তোর বাবাও আমাকে ভালোবাসে।যাতে মরে গেলে আমার আক্ষেপ না থাকে যে মন ভরে তাকে ভালোবাসতে পারলাম না।মানুষের জীবন সংক্ষিপ্ত। খোদা না করুক,আজ যদি একটা খারাপ কিছু হয়ে যায় আষাঢ়ের সাথে তখন মাথা ফাটিয়ে কাঁদলে ও কি তাকে ফিরে পাবি ভালোবাসার জন্য?
থাকতে মূল্য দিতে হয় পিয়াসা।হারিয়ে গেলে এরপর শাহেদের মতো পাগল হয়ে ঘুরেও লাভ হয় না।
এই যে তুই তোর পারভীনের উপর অভিমান করে আছিস কিন্তু একটা বার মন দিয়ে ভেবে দেখ।ওর আসলে কোনো দোষ ছিলো না।স্বামীর ভালোবাসা এমন এক অমূল্য জিনিস যা পাবার জন্য নারী জীবন ও দিতে পারে। সেখানে পারভীন কিন্তু ইচ্ছে করে পালায় নি।লোকে বলে ভালোবাসা ও যুদ্ধে সবকিছুই ন্যায্য বলে একটা কথা আছে।সাদেক আলী ভালোবেসে পারভীনকে জোর করে তুলে নিয়ে গেছে। সেখানে কিন্তু শাহেদের মায়ের সমর্থন ছিলো। সেখানে পারভীনের কোনো হাত ছিলো না।
সাদেক আলী তোকেও তাদের কাছে নিয়ে যেতে চেয়েছিলো কিন্তু তার আগেই তোকে আমরা লিগ্যালি নিয়ে আসি।
পারভীন পরিস্থিতির স্বীকার ছিলো।
এখনও সময় আছে মা,আষাঢ়ও এরকম পরিস্থিতির স্বীকার হওয়ার আগেই নিজের স্বামীকে ভালোবাসার চেষ্টা কর।দেখবি জীবন কতো সুন্দর!”
তাৎক্ষণিক মা’য়ের কথায় পিয়াসার কিছুটা অভিমান জন্মালেও ধীরে ধীরে মনে হতে থাকে মা ভুল কিছু বলে নি।
পিয়াসা শক্ত করে আষাঢ়ের বাহু চেপে ধরে। আষাঢ় গাড়ি থামিয়ে পিয়াসার দিকে তাকায়।পিয়াসাকে কেমন ঘোরগ্রস্ত মনে হয়।
পানির বোতল এগিয়ে দেয় আষাঢ় পিয়াসার দিকে।
পিয়াসা ঢকঢক করে পানি পান করে।
আষাঢ় চুপচাপ আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে।গতকাল বিকেলে ওই ভদ্রলোক আসার পর থেকেই পিয়াসা একটু বেশি হতাশ হয়ে আছে।
পিয়াসা আষাঢ়ের দিকে তাকায়। ভীষণ লম্বা,গুড লুকিং একটা মানুষ। যার ভয়েস অনেকটা নেশা ধরিয়ে দেয়।সে যখন ফিসফিস করে পিয়াসা বলে ডাকে তখন পিয়াসার বুকে কাঁপন ধরে যায়।
তেমনই নিশ্চয় হাজার হাজার নারীর বুকে কাঁপন ধরে তার ভিডিও দেখে। ভাবতেই পিয়াসার অহেতুক এয়াগ জন্মায়।
এই প্রথম বার পিয়াসার মনে হয় সে জেলাস ফিল করছে।
মা ভুল বলে নি।
মায়ের সব কথা সত্যি।
পিয়াসা এগিয়ে গিয়ে আষাঢ়ের হাতের উপর হাত রাখে।
আষাঢ় চমকে তাকায়। কি হয়েছে পিয়াসার?
বহু বছর পর পিয়াসার মনে হলো সে বুঝি আজকে একটু স্বাভাবিক হতে পেরেছে।
আষাঢ়ের হাতে হাত রেখে পিয়াসা বললো, “আমি আপনাকে অনেক কষ্ট দিয়েছি।আপনি কি আমাকে ক্ষমা করতে পারবেন?আমি আমার সব ভুলের জন্য ক্ষমাপ্রার্থী।”
আষাঢ় হেসে উঠে। এরকম সহজ স্বীকারোক্তি শুনে মনের গুমোট কেটে যায় আষাঢ়ের।
বাকিটা পথ পিয়াসা আষাঢ়ের বাম বাহু জড়িয়ে ধরেই বসে ছিলো। যেনো ছেড়ে দিলেই আষাঢ় হারিয়ে যাবে।
পিয়াসা কিছুতেই চায় না আনোয়ার চৌধুরীর মেয়ের পরিচয় ছাড়া অন্য কারো পরিচয় বড় হয়ে উঠুক তার আচরণে।
সত্যিই তো!
নিজের চোখের সামনেই তো দেখেছে মা বাবাকে কতো ভালোবাসে।তেমনই বাবা ও মাকে ভালোবাসে।
সেখানে সে কেনো এতো দিন একটা মিথ্যা ভয়কে বুকে নিয়ে বেঁচে ছিলো!
তার অতীতের সাথে তো এই মানুষটার কোনো হাত নেই।সবার উপর অভিমানের শাস্তি তাহলে সে কেনো পাচ্ছে?
আষাঢ় কিছুক্ষণ পর বললো, “কিছু বলবে পিয়াসা?”
পিয়াসা খানিকক্ষণ নিজের মনের সাথে যুদ্ধ করে। শেষে অভিমানকে হারিয়ে বিবেক জয়ী হয়।“আমার না একজনের সাথে দেখা করতে খুব ইচ্ছে করছে।”
“কার সাথে?”
“যিনি আমাকে জন্ম দিয়ে এই দুনিয়ায় এনেছেন।”
“তোমার মা’য়ের সাথে?”
পিয়াসা বিপাকে পড়ে যায়। সে কেনো পারভীনকে মা বলতে পারছে না?
পারভীনকে মা বলতে তার অভিমানের চাইতে বেশি ভয় কাজ করে। যদি পারভীনকে মা বলে ডাকতে গিয়ে শারমিনের মনে আঘাত লাগে?
যদি এক মুহূর্তের জন্য শারমিনের মনে হয় মেয়ে বুঝি তাকে পর করে দিলো।
আষাঢ়কে সে কথা বলতে আষাঢ় হেসে উঠে।
“কারো জায়গা কেউ ছিনিয়ে নিতে পারে না পিয়াসা।তুমি ওনাকে মা বলে ডাকলেও শারমিন আন্টির জায়গা একই থাকবে।আন্টি যদি এই ব্যাপারে কষ্ট পেতেন তাহলে নিশ্চয় উনি তোমাকে বলতেন না তোমার মা’য়ের উপর রাগ না করার কথা।”
পিয়াসা জবাব দেয় না।
“আমি তোমাকে দুই এক দিনের মধ্যে নিয়ে যাবো ওনার কাছে।”
“এখন আপনাদের বাড়িতে চলেন।সবার সাথে দেখা করতে ইচ্ছে করছে।”
“যথা আজ্ঞা মহারানী।”
পিয়াসা হেসে উঠে।
সিরাজুল ইসলাম পিয়াসাকে হাসিমুখে জড়িয়ে ধরলে ও ছেলের সাথে কথা বললেন না।
আষাঢ় এগিয়ে গিয়ে বাবাকে জড়িয়ে ধরে। সিরাজুল ইসলাম নিজের পিঠের উপর উষ্ণ জলের স্পর্শ পান।
মুহূর্তেই সব অভিমান বরফের মতো গলে গেলো।
দুপুরের খাওয়া দাওয়ার পর আষাঢ় বললো, “অনেক দিন হয়ে গেছে বাবা।আমি গিয়ে দাদীকে নিয়ে আসি।”
রজনী বললো, “তোর বাবাকে কতো দিন ধরে বলছি।যাচ্ছে না।”
“আমি কিভাবে যাবো বল?মা তো আমার সাথে কথাই বলছে না।কথা বললে না হয় বলতে পারতাম চলে আসার কথা। আমি গিয়ে নিয়ে আসতাম।উনি বলে দিছে উনি আমাদের মুখ দেখতে চান না।নয়তো নাকি ওনার মরা মুখ দেখবো।এসব কথা শুনলে কার ইচ্ছে করবে যেতে?”
“দাদী নিজে তোমাকে এই কথা বলেছে?”
“না,শিরিন বলেছে।”
“তাহলে তো হয়েই গেলো।কিছু মনে করো না বাবা,তোমার বোনের প্রতিটি রগে রগে মিথ্যা আর ষড়যন্ত্র।”
সিরাজুল ইসলাম প্রত্যুত্তরে কিছু বলেন না।
নির্জন বললো, “আমি ও যাবো তোর সাথে। আমি বাড়ির বাহিরে অপেক্ষা করবো।”
বের হওয়ার মুখে পিয়াসা বললো, “আমাকে ও নিয়ে যান।দাদীর কাছে আমার ক্ষমা চাওয়ার আছে।ওনার অনেক রাগ জমে আছে আমার উপর।”
আষাঢ় পিয়াসা আর নির্জনকে নিয়ে বের হলো।
গাড়িতে উঠতেই মিরার কল পেলো।
আষাঢ় কল রিজেক্ট করতে চাইলে পিয়াসা নিষেধ করে।
কল রিসিভ করতেই মিরা শঙ্কিত সুরে বললো, “আষাঢ় ভাই,আপনি কোথায়?”
“তোদের বাড়ির দিকে আসছি দাদীকে নিয়ে আসতে।”
“দ্রুত আসেন আষাঢ় ভাই।নানীর অবস্থা খুবই খারাপ। মা আর আপা মিলে নানীর সাথে অনেক খারাপ কাজ করছে।নানী মনে হয় মরে যাবে আষাঢ় ভাই।”
আষাঢ়ের চোয়াল শক্ত হয়ে উঠে। গাড়ির গতি বাড়াতে থাকে সেই সাথে বাড়তে থাকে তার রাগ।
আষাঢ় সিরাজুল ইসলামকে কল করে।
শিরিনদের বাড়ি যখন পৌছায় আষাঢ় তখন বিকেল হয়ে আসছে।আষাঢ় পিয়াসার হাত ধরে এগিয়ে যায়।নির্জন বাড়ির বাহিরে অপেক্ষা করে। কলিং বেল টিপ দেওয়ার আগে আষাঢ় পিয়াসাকে ইশারা করে। পিয়াসা ফোন হাতে নেয়।
কলিং বেল বাজার সাথে সাথে মিরা এসে দরজা খুলে দেয়।নানীর এই অবস্থা মিরা সহ্য করতে পারছিলো না। নানী তাদের জন্য অনেক কিছু করেছে।মা আপা সব ভুলে যেতে পারলেও মিরা ভুলতে পারে নি।আজকে যখন দেখলো নানীর অবস্থা একেবারে খারাপ তখন মিরা আর সহ্য করতে পারে নি। ভাগ্যিস আষাঢ় ভাইও আসছিলো এদিকেই।
আষাঢ়কে দেখে নিরা মহুয়া বেগমের রুমে ঢুকে মহুয়া বেগমের মুখে স্কচটেপ লাগিয়ে দিয়ে হাত বেঁধে রাখে।এরপর দরজায় তালা লাগিয়ে দেয়।
আষাঢ় ড্রয়িং রুমে বসে অপেক্ষা করছে শিরিনের জন্য। শিরিন সামনে এলো ২০ মিনিট পর।
আষাঢ় অবাক হয়ে দেখে ফুফুকে।একটা মানুষ এতটা জঘন্য হতে পারে?
কেমন খুশি খুশি ভাব মনে তার।
“দাদী কোথায়?”
“তোরে বলতে যাবো ক্যান সেই খবর? এতো দিন দাদীর কথা মনে ছিলো না?”
“মনে ছিলো কি ছিলো না সেই কৈফিয়ত আপনাকে দিতে যাবো না।দাদীকে নিয়ে আসেন।উনি বাড়ি যাবে।”
“আমার মা কোথাও যাবে না।মা আমাকে আগেই বলে দিছে উনি শেষ পর্যন্ত এখানেই থাকবেন।তোদের বাড়িতে যাবে না।”
“ফুফু,ঝামেলা কইরেন না।যদিও আপনাকে ফুফু বলতেও আমার গা গুলিয়ে উঠে। তবুও একই রক্ত তো তোমার আর আমার শরীরে তাই বলতে হচ্ছে না চাইলেও।”
নিরা তেঁতে উঠে আষাঢ়ের কথা শুনে। এগিয়ে এসে বলে, “এটা তোদের বাড়ি না।এটা আমাদের বাড়ি।এখানে সাবধানে কথা বলবি আমার মায়ের সাথে।’”
“না বললে কি করবি তুই? কি করবি বল?”
“আমি তোর মতো দুর্গন্ধযুক্ত নর্দমার সাথে কথা বলে আমার সময় নষ্ট করতে চাই না।আমি কথা বলার জন্য ও ক্লাস মেনটেইন করি।
ফুফু দাদীকে ডেকে দিন।”
“না দিলে কি করবি?আমার মা তোদের বাড়িতে নিরাপদ না।ওখানে তোর মা চাচী দুজনেই আমার মা’কে খুন করতে পারে।তোর বউ ও আমার মা’কে খুন করতে চায়। ওনার নিরাপত্তার জন্য আমি ওনাকে যেতে দিবো না।”
“ঠিক আছে।দাদীকে ডাকো।আমি ওনার মুখ থেকেই শুনবো।”
“উনি তোদের মুখদর্শন করতে চান না।”
“এখনো ঠান্ডা মাথায় কথা বলছি ফুফু।এরপর আমি উত্তেজিত হলে তোমার বাড়িঘর কিছুই আস্ত থাকবে না।”
“যা ইচ্ছে কর তুই।”
শিরিন ভেতরে ভেতরে ভয় পাচ্ছে।মহুয়া বেগমের অবস্থা ভালো না।আষাঢ় যদি রেগে যায় তাহলে ও বিপদ।তাছাড়া আর দুটো দিন গেলে মহুয়া বেগম লিখে দিবেন নিজে থেকেই।সব মানুষের কাছেই নিজের জীবন ভীষণ দামী।
আষাঢ় বসা থেকে উঠে দাঁড়ায়। পিয়াসা আষাঢ়কে এতো উত্তেজিত আগে কখনো দেখে নি।গলার স্বর চেঞ্জ হয়ে গেছে প্রচন্ড রাগে।আষাঢ় ভেতরের দিকে যেতে পা বাড়াতেই নিরা এসে সামনে দাঁড়ায়। প্রচন্ড রাগে আষাঢ় নিরাকে এক প্রকার ছুঁড়ে মারে।নিরা গিয়ে আলমারির সাথে আঘাত পায় মাথায়।
নিরার হাতের মুঠো থেকে ঝনঝন শব্দ করে চাবি পড়ে যায় নিচে।
আষাঢ় সেদিকে তাকিয়ে হেসে ফেলে।তাহলে এই ব্যাপার!
চাবিটা কুড়িয়ে নেয় পিয়াসা।
মিনি আর মিরা দুজনেই একটা রুমে বসে আছে।শিরিন বলে গেছে দুজনের কেউ-ই যাতে রুম থেকে না বের হয়।
আষাঢ় খুঁজে পায় একটা রুমের দরজায় তালা দেওয়া।
চাবি দিয়ে দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে দেখে রুম অন্ধকার। আষাঢ় লাইটের সুইচ দিতেই পিয়াসা চমকে উঠে মহুয়া বেগমের অবস্থা দেখে।
মহুয়া বেগম প্রস্রাবের মধ্যে বসে আছেন।তার হাত পিছমোড়া করে বাঁধা,মুখ বাঁধা।
আষাঢ়ের চোখ টলমল করে।
পিয়াসা আর আষাঢ়কে দেখে মহুয়া বেগমের দুই চোখ ভিজে উঠে। আষাঢ় ফোন হাতে নেয় পিয়াসা গিয়ে মহুয়া বেগমের বাঁধন খুলে দেয়।
বাহিরে শিরিনের চোটপাট শোনা যাচ্ছে। সিরাজুল ইসলাম আর মিরাজুল ইসলাম এসেছেন।
মহুয়া বেগমকে দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়।যাওয়ার সময় সিরাজুল ইসলাম শিরিনকে বলে যান,”তোর সাথে আবারও দেখা হবে আমার। সেটা তোর বাড়িতে না কিন্তু,জেলে।”
মহুয়া বেগমকে হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। নিভু নিভু চোখে তাকিয়ে দেখেন মহুয়া বেগম তার সব নাতি নাতনি,ছেলে,ছেলের বউরা সবাই কাঁদছে।
মহুয়া বেগমের ইচ্ছে করলো বলতে আমার জন্য চোখের জল ফেলো না কেউ,আমি আমার কৃতকর্মের সাজা পেয়েছি। আমার কোনো আফসোস নেই।
মহুয়া বেগমকে ইমার্জেন্সিতে নেওয়া হলো।
পিয়াসা আষাঢ়ের হাত ধরে বসে আছে। বুকের ভেতর তার না বলা যন্ত্রণা।
তার জন্যই মহুয়া বেগম ঘর ছেড়ে বের হয়েছেন রাগ করে। সে যদি সেদিন নির্জন আর মিনির বিয়ের সত্যি সবাইকে না জানাতো তাহলে কোনো ঝামেলা হতো না।
আজ যদি মহুয়া বেগমের খারাপ কিছু হয়ে যায়!
পিয়াসা আল্লাহকে ডাকে মনেপ্রাণে।
ইমার্জেন্সি থেকে ডাক্তার বের হয়ে সিরাজুল ইসলাম ও মিরাজুল ইসলাম দুই ভাইকে তার কেবিনে ডাকেন।
সিরাজুল ইসলামের বুকে ভয়ের কাঁপন।দউই ভাই দুই চেয়ারে বসেন।
ডাক্তার চশমাটা খুলে টেবিলে রাখলেন। মুখে চিন্তার রেখা।
চুপ করে থাকা দুই ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে ধীরে ধীরে বললেন,
“আপনাদের মায়ের বয়স হয়েছে। শরীর এমনিতেই দুর্বল। কিন্তু আপনারা জানেন, গত চার দিন ধরে ইনসুলিন বন্ধ থাকার কারণে উনার শরীরে কী হয়েছে?”
দুই ভাই মাথা নাড়ল না। শুধু কপাল কুঁচকে তাকিয়ে রইল।
ডাক্তার গম্ভীর স্বরে বললেন,
“উনি ডায়াবেটিক কিটোঅ্যাসিডোসিস এ চলে গেছেন। রক্তে শর্করার পরিমাণ ছিল ৩৪.৭ মিলিমোল পার লিটার। এ মাত্রা একজন সুস্থ মানুষকে কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই কোমায় নিতে পারে। উনার রক্তে কিটোন বেড়ে গেছে, শরীর অ্যাসিডিক হয়ে উঠেছে। কিডনির উপর চাপ পড়েছে, শরীর পুরোপুরি ডিহাইড্রেটেড। ইলেক্ট্রোলাইট ব্যালান্স ভেঙে গেছে।”
ডাক্তার একটু থেমে আবার বললেন,
“উনি জ্ঞান হারিয়েও যেতে পারতেন। এমনকি হার্ট অ্যাটাক বা অরগান ফেলিওরও হতে পারত। আমরা এখন IV ফ্লুইড, ইলেক্ট্রোলাইট আর ইনসুলিন দিয়ে স্ট্যাবিলাইজ করার চেষ্টা করছি। কিন্তু কিছু বলতে পারি না, এই বয়সে রিকভারিটা কঠিন হয়।”
মিরাজুল ইসলাম এবার কাঁপা গলায় বলল, “আপনি কি বলতে চাচ্ছেন কেউ যদি ইচ্ছা করে ইনসুলিন বন্ধ করে দেয়, তাহলে সেটা…..?”
ডাক্তার তাকে থামিয়ে বললেন,
হ্যালো 2441139 পর্ব ৫৯
“সেটা একটা হত্যার চেষ্টা হিসেবেই বিবেচিত হবে। এতদিনের অভ্যাস, এত স্পর্শকাতর একটা রোগ,এমনভাবে ইনসুলিন বন্ধ করে দিলে মানুষটা ধীরে ধীরে মারা যায়। আপনারা পুলিশে যোগাযোগ করুন। আমরা মেডিকেল রিপোর্ট দিচ্ছি। এতে যা যা উল্লেখ করা আছে, তাতে অপরাধ প্রমাণ হওয়া সময়ের ব্যাপার মাত্র।”
দুই ভাইয়ের চোখে জল,আর ভেতরে জমে থাকা হাজারো প্রশ্ন। কি এমন হয়েছে যার জন্য শিরিন এরকম একটা কাজ করেছে মা’য়ের সাথে?