অশ্রুজলে বোনা বিয়ে সিজন ৩ পর্ব ৪৬

অশ্রুজলে বোনা বিয়ে সিজন ৩ পর্ব ৪৬
ইয়াসমিন খন্দকার

আরুশি ও আরহাম পাশাপাশি বসে আছে। তাদের এত গুলো দিনের জমানো সব অভিমান ও দূরত্ব ঘুচতে হয়তো আরো সময় প্রয়োজন। তাই তারা নিজেদের সময় দিচ্ছে। যাতে করে এতদিনের জমানো অভিমানের বরফ গলে যায়। আরহাম আচমকা আরুশির হাতটা ধরে বলে,”তুমি আবার আমার সাথে ফিরে চলো আরুশি। আমি তোমাকে আর নিজের সন্তানকে নিয়ে একটা নতুন জীবন শুরু করতে চাই।”
আরুশি বলে,”সেটা তো আমিও চাই কিন্তু আমার ক্যারিয়ার, জাঈদের স্কুল সবই তো এখানে। এখন ঢাকায় গিয়ে নতুন পরিবেশে মানিয়ে নেয়াটা তো সহজ হবে না।”
“তুমি চিন্তা করো না। সব ব্যবস্থা আমি করে ফেলবো। ঢাকায় গিয়ে আবার সব নতুন করে শুরু করব।”
“কিন্তু তোমার ড্যাড? তিনি কি আমাদের মেনে নেবেন?”
আরহাম শক্ত কন্ঠে বলে,

“ওনার মানা না মানায় কিছুই যায় আসে না। আমরা আর ওনার বাসায় ফিরব না। আমরা আলাদা ফ্ল্যাটে উঠব।”
আফিফা খানও জাঈদকে কোলে নিয়ে সেখানে উপস্থিত হয়ে বলেন,”আমাকেও নিয়ে চল তোদের সাথে। আমিও আর ঐ লোকটার কাছে ফিরতে চাই না।”
আরহাম আরুশিকে বলে,”তুমি আর মনে কোন দ্বন্দ রেখো না। এবার আমরা ঢাকায় ফিরব। আর ফুফু, খালামনি-খালুর কেইসও রিওপেন করব।”
“আচ্ছা। আমাকে একটু মানসিকভাবে প্রস্তুত হবার সময় দেও।”
তাদের কথাবার্তার মাঝে রাজীবও সেখানে চলে আসে। রাজীব এসেই হাসিমুখে বলে,”ভাগ্য বোধহয় আমাদের উপর একটু বেশিই প্রসন্ন।”
সবাই রাজীবের দিকে তাকায়। আরুশি সকলকে রাজীবের আসল পরিচয় ও নিজের আসল মায়ের ব্যাপারে বলেছে। সব শুনে সবাই ভীষণ অবাক হয়েছে সাথে খুশিও৷ যদিওবা ক্যান্সার আক্রান্ত হয়ে আরুশির মায়ের মৃত্যুর খবরটায় খারাপ লেগেছে সবার।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

আরুশি উঠে দাঁড়িয়ে বলে,”কি হয়েছে রাজীব ভাই? তোমাকে এত খুশি খুশি লাগছে কেন?”
রাজীব হাতে একটা মিষ্টির প্যাকেট নিয়ে এগিয়ে এসে সবার হাতে মিষ্টি দিতে দিতে বলে,”এমন একটা খুশির খবর নিয়ে এসেছি যা শুনলে তোমরা সবাই চমকে যাবে। আমার ট্রান্সফার হয়ে ঢাকায় একজন এসআই হিসেবে।”
খবরটা শুনে আরুশি খুশি হয়ে বলে,”বাহ, এটা তো অনেক ভালো খবর।”
“হ্যাঁ, এতদিন খুলনায় ছিলাম তাই সেভাবে কিছু করতে পারি নি। তবে এবার ঢাকায় যাবার পর আমি তোমাদের তদন্তে সাহায্য করতে পারব। তাছাড়া সিলেটেও আমার এক চেনাজানা বন্ধু আছে। সেও আরুশি আম্মু-পাপার মৃত্যু সংক্রান্ত তথ্য দিয়া আমাদের সাহায্য করতে পারবে।”
আরহাম খুশি হয়ে বলে,”তাহলে তো আমাদের কাজটা আরোও সহজ হয়ে গেল। এখন শুধু প্রমাণ খোঁজা বাকি আছে।”

রাজীব বলে,”সেটা তোমরা আমার উপর ছেড়ে দাও৷ আমি এত গুলো বছর গোপনে তদন্ত চালিয়েছি। আর কিছু তথ্যও আমার হাতে এসেছে। এখন শুধু একটা শক্ত প্রমাণের প্রয়োজন যাতে সমস্ত সত্যটা সামনে আনা যায়। আশা করি, সেটাও খুব শীঘ্রই পেয়ে যাব।”
আরুশি বলে,”আমার আম্মু-পাপা ও বৃষ্টি আন্টিকে যে করেই হোক ন্যায়বিচার পাইয়ে দিতেই হবে। তাদের উপর আসা অভিযোগ গুলোও মিথ্যা প্রমাণিত করতে হবে।”
“এসব নিয়ে আর ভেবো না আরু। আর শুধু কটা দিনের অপেক্ষা। তারপরই সব সত্য সামনে আসবে।”

কয়েক দিন পর,
আরুশি ও আরহাম এখন জাঈদকে নিয়ে ঢাকায় একটি ফ্ল্যাটে উঠেছে। আফিফা খানও আছে তাদের সাথে। এখানেই তারা নতুন সংসার গড়েছে। আমান অবশ্য নিজের বাবা ও দাদির দেখভালের জন্য সায়রা ও নিজের মেয়ে আমিনাকে নিয়ে বাড়িতেই আছে। কারণ হাজার হোক, বাবা তো। তাই সে দায়িত্ব অবহেলা করতে পারছে না। আবার সায়রাও নিজের মামা ও নানিকে একা ছাড়তে নারাজ। সবথেকে বড় কথা নিঝুম খান তো এসবে দায়ী নয় তাই তাকে এই বয়সে খামোখা কেউ একা ছাড়তে চায়নি। এমনি আফিফা খান ও আরুশিও তার খোঁজ খবর নেন মাঝে মাঝে।
আরুশি এখানে ঢাকাতেই নতুন করে নিজের সাইকোলজি চেম্বার ওপেন করেছে। জাঈদও এখানকার একটা নামকরা ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে ভর্তি হয়েছে। সব মিলিয়ে তাদের জীবন সুন্দর ভাবেই চলছে। রাজীবও ঢাকায় বদলি নিয়ে এসে এখন তদন্ত বজায় রেখেছা। আরহাম, আরুশি, আমান সবাই এই তদন্তে নিজেদের সাধ্যমতো সাহায্য করে চলেছে। যাতে করে আসল অপরাধী দ্রুত সামনে আসে।

রাজীব আজ থানায় প্রবেশ করতেই বেশ শোরগোল শুনতে পায়। থানার ভেতরে কে বা কারা যেন অনেক অশান্তি করছে। এটা দেখে সে ভ্রু কুঁচকে ফেলে। দ্রুতবেগে থানায় প্রবেশ করে বলে,”কি হচ্ছে কি এখানে? এটা একটা থানা, কোন মাছের বাজার নয়।”
এমন সময় হঠাৎ করে সামনে দাঁড়ানো এক নারীর দিকে নজর দিতেই সে চমকে উঠল। হতবাক স্বরে বলে উঠলো,”তুমি!”
মারিয়ার নজর রাজীবের দিকে যেতেই সে স্তব্ধ হয়ে গেল। গলার স্বর শুনেই সে বুঝে গিয়েছিল। এই গলার স্বর তো সে ভুলবে না কখনোই। রাজীবের চোখে চোখ রাখার তার আজ নেই। অতীতের ভুলের জন্য সে চরম অনুতপ্ত। আর তাই তো নিজের কোলে থাকা ৫ বছরের বাচ্চাটিকে আরো শক্ত করে আকড়ে ধরে।
এরইমধ্যে থানার অন্য একজন পুলিশ কর্মকর্তা এগিয়ে এসে বলে ওঠেন,”দেখুন না স্যার, এই মহিলা কিভাবে থানায় এসে হট্টগোল করছে।”
“কি হয়েছে ওনার?”

“ওনার স্বামী কয়েক বছর আগে এক সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছে। তারপর ওনার শ্বশুর বাড়ির লোক ওনার উপর নাকি ভীষণ অত্যাচার করেন। আমরা এই নিয়ে তদন্ত করেছি কিন্তু এমন কোন তথ্য পাইনি। বরং ওনার পাড়া প্রতিবেশী আশেপাশের সবাই বলে ওনার শ্বশুর বাড়ির লোক ভীষণ ভালো।”
অতঃপর তিনি রাজীবের কানে কানে বলেন,”আর এই মেয়ের তো মানসিক সমস্যা আছে বোধহয়। রোজ রোজ থানায় এসে এই নিয়ে ঝামেলা করে।”
এরমধ্যে মারিয়া বলে ওঠে,”আমার কথাটা বিশ্বাস করুন..”
বলেই সে হঠাৎ জ্ঞান হারিয়ে পড়ে যেতে নেয় এমন সময় রাজীব মারিয়াকে আগলে নেয়। মারিয়া নিজের ছেলেকে সামলাতে পারছিল না তাই রাজীব মারিয়ার কোল থেকে তার ছেলেকে নিয়ে বলে,”ঠিক আছ তুমি?”
মারিয়া মাথা নাড়ায়। অতঃপর নিজের ছেলের দিকে তাকায়। যে হতাশ চোখে তার দিকে তাকিয়ে ছিল। রাজীব মারিয়ার ছেলের গাল টিপে দিয়ে বলে,”কি নাম ওর?”
“মাশ..মাশরাফি”
“বাহ, খুব সুন্দর নাম।”

মারিয়া হঠাৎ করে কান্না করে দেয়। আকুতির সহিত বলে,”আমার ছেলেটাকে বাঁচান রাজীব ভাই..ওরা ওকে শেষ করে দেবে…আমার নিজেকে নিয়ে কোন চিন্তা নেই কিন্তু আমার ছেলে…আমার ছেলের কোন ক্ষতি আমি মানতে পারব না। আমার ছেলেকে বাঁচান প্লিজ…”
“মারিয়া..কাম ডাউন। কি হয়েছে আমায় খুলে বলো।”

অশ্রুজলে বোনা বিয়ে সিজন ৩ পর্ব ৪৫

মারিয়া নিজের জীবনের অন্ধকার অধ্যায় সম্পর্কে বলতে শুরু করে,”আপনার সাথে করা অন্যায়ের ফলে আমি জেলে গেছিলাম। কয়েক মাস জেলে থাকার পর মুক্তি পাই। এরপর আমার বাড়ির লোক আমাকে গ্রামে নিয়ে যায়। সেখানেই একজনের সাথে আমার বিয়ে দিয়ে দেয়। প্রথম দিকে সবকিছু ভালো যাচ্ছিল..আমার স্বামীও অনেক ভালো ছিল। কিন্তু আপনার সাথে করা কর্মফল তো আমাকে পেতেই হতো..আর তাই আমার স্বামী..উনি আমাকে ছেড়ে চলে গেলেন। স্বামীর মৃত্যুর পরই আমি জানতে পারি আমি মা হতে চলেছি..কিন্তু আমার শ্বশুর বাড়ির লোক মনে করে এটা অবৈধ সন্তান আর তাই ওরা আমার উপর মানসিক ও শারীরিক নীপিড়ন শুরু করে। আমার শ্বশুরের ব্যবসা সূত্রে ঢাকায় চলে আসার পর এই মাত্রা আরো বৃদ্ধি পায়। আমার স্বামীর রেখে যাওয়া সম্পত্তি কেড়ে নেয়ার জন্য আমার দুই ভাসুর আমার আর আমার সন্তানকে মেরে ফেলারও চেষ্টা করেছে বহুবার..”
বলেই মারিয়া কান্নায় ভেঙে পড়ে।

অশ্রুজলে বোনা বিয়ে সিজন ৩ পর্ব ৪৭