হামিংবার্ড পর্ব ৫৩
তাসমিয়া তাসনিন প্রিয়া
সারাদিন স্কুল আর ক্লাসের ব্যস্ততা শেষে ক্লান্ত শরীরে বাড়ি ফিরতেই নয়নার চোখে পড়লো তালহা। বসার ঘরের সোফায় চুপচাপ বসে আছে তালহা। তার পরনে গাঢ় নীল শার্ট আর কালো জিন্স, চুলগুলো হালকা এলোমেলো, চোখেমুখে ক্লান্তির ছাপ স্পষ্ট। সময়টা তখন সন্ধ্যা নামার ঠিক আগমুহূর্ত।
রোকসানা তালহার আপ্যায়নে ব্যস্ত। ঘরে থাকা যা কিছু খাবারদাবার আছে, তা দিয়েই আপাতত অতিথি সেবার চেষ্টা করছেন।
নয়না স্কুল থেকে ফিরে ভদ্রতার সাথে তালহার কুশলাদি সেরে, নিজের ঘরে ঢুকে ফ্রেশ হতে গেল। সকালের তাড়াহুড়োয় পলাশের নম্বর লেখা কাগজটা কোথায় রেখেছে, কিছুতেই মনে করতে পারছিল না সে। পুরো পথজুড়ে সেই কাগজটার কথাই বারবার মনে পড়ছিল।
“ তারপর বলো, বেয়াইন কেমন আছেন? “
রোকসানা সোফায় বসতে বসতে জিজ্ঞেস করলেন। তালহা চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বলল,
“ আলহামদুলিল্লাহ, ভালো আছেন। ভাবি হয়তো আপনাকে কলে সবকিছু বলেছেন। আমি আসলে নয়নাকে নিতে এসেছিলাম। “
মুচকি হাসলেন রোকসানা।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
কিছুক্ষণ আগেই অরা ফোন করেছিল। তখনই তালহার বিয়ের কথা জানিয়েছে তাকে। যদিও এখনও দিন-তারিখ চূড়ান্ত হয়নি, তবে কাল থেকেই কেনাকাটার প্রস্তুতি শুরু হবে – এমনটাই সিদ্ধান্ত হয়েছে।
এই কারণেই নয়নাকে খান বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার জন্যই তালহাকে পাঠানো হয়েছে। আরিশের সময় নেই। অফিসের চাপ দিনদিন বেড়েই চলেছে। আর তাছাড়া, আরিশের যা স্বভাব, তাতে শ্বশুরবাড়ি এসে শালিকাকে নিজে হাতে আনার মতো ধৈর্য বা ইচ্ছা তার নেই বললেই চলে।
“হ্যাঁ, অরা বলেছে তুমি নয়নাকে নিতে এসেছো।”
রোকসানা হেসে বললেন।
“ও তো এখনই স্কুল থেকে ফিরেছে। একটু ফ্রেশ হয়ে আসুক, তারপর কথা বলি তোমার সঙ্গে।”
“ ঠিক আছে, আন্টি। “
“ তুমি বরং নাস্তা শেষ করো ততক্ষণে।“
তালহা মাথা নেড়ে মুচকি হাসল কেবল। রোকসানা বসা থেকে উঠে নয়নার ঘরের দিকে এগোলেন।
কোনোমতে স্কুলের ব্যাগ কাঁধ থেকে নামিয়েই কাগজটা খুঁজতে শুরু করেছে নয়না। কিন্তু দুঃখজনক ব্যাপার হলো টেবিলের ওপর থেকে শুরু করে ড্রয়ারে, ফ্লোরে কোথাও কাগজটা পাচ্ছে না সে।
“ কী রে! এখনও স্কুল ড্রেস চেঞ্জ করিসনি কেন? তালহা এসে বসে আছে , তোকে নিতে পাঠিয়েছে অরা। “
মায়ের আগমনে কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে গেছে নয়না। সোজা হয়ে দাঁড়াল, জিহ্বা দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে বলল সে,
“ এইতো ফ্রেশ হয়ে নিচ্ছি। আপু হঠাৎ নিতে পাঠালো? কোনো অনুষ্ঠান আছে? “
“ তালহার বিয়ে, শুনলাম। সেজন্য কেনাকাটা করবে বলল। ব্যাগপত্র নিয়ে যাবি, দু’দিন থাকার কথাও বলেছে অরা। “
নয়না শুধু সব কথায় হু হা করে যাচ্ছে। তার মন পড়ে আছে কাগজটা খোঁজার দিকে। পলাশের নম্বরটা হারিয়ে নয়নার মনে হচ্ছে যেন আস্ত মানুষটাকেই হারিয়ে ফেলেছে সে। বুকটা কেমন খালি খালি লাগছে।
“ কী রে? কী হয়েছে তোর?”
রোকসানা বেশ গলা উঁচিয়ে জিজ্ঞেস করলেন।
“ ফ্রেশ হয়ে আসছি, আমি। বেশি সময় লাগবে না। “
নয়না তড়িঘড়ি করে ওয়ারড্রব থেকে জামাকাপড় হাতে নিয়ে ওয়াশরুমের দিকে এগোল।
রোকসানা মল্লিক মেয়ের হাবভাব কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছেন না।
নয়না আজকাল যেন কেমন অচেনা হয়ে গেছে। আগের সেই প্রাণচঞ্চল মেয়েটা কোথায় যেন হারিয়ে গেছে। এই পরিবর্তনের কারণটা তিনি ধরতে পারছেন না ঠিকভাবে, আর সেটাই তাকে ক্রমেই চিন্তিত করে তুলছে।
সন্ধ্যা নেমেছে। শহরের ওপরে গাঢ় নীল রঙা আবরণ টেনে নিচ্ছে আকাশ, বাড়ির চারপাশে বাতিগুলো একে একে জ্বলে উঠছে। একটা শান্ত, নরম আলোয় ভরে যাচ্ছে চারদিক।
ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে আছে অরা। নিজেকে আজ বেশ পরিপাটি করে গুছিয়ে নিয়েছে।
নীল রঙের শাড়ির সঙ্গে মিলিয়ে পরেছে ম্যাচিং ব্লাউজ, গলায় হালকা ডিজাইনের ডায়মন্ড সেট, খোলা চুলে জড়ানো আছে আর্টিফিশিয়াল বেলিফুলের গাজরা। হাতে নীল কাঁচের চুড়ি, ঠোঁটে টুকটুকে লাল লিপস্টিক।
সবকিছু মিলিয়ে তাকে যেন এক অপ্সরা মনে হচ্ছে – আলোকছায়ার এই সন্ধ্যায়, যেন রূপকথা থেকে নেমে আসা কোনো চরিত্র।
“ আয়নায় কী দেখছো, হামিংবার্ড?”
আরিশের কণ্ঠ ভেসে এলো পিছন দিক থেকে।
কণ্ঠটা শুনেই উচ্ছ্বসিত হয়ে পেছনে ফিরে তাকালো অরা। আর সেই মুহূর্তেই যেন আরিশের হৃদয়ে একচিলতে ঝড় বয়ে গেল। এক মুহূর্তের জন্য থমকে গেলো সব – নিশ্বাস, স্পন্দন, সময়।
একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো সে অরার দিকে; চোখে বিস্ময়, মুগ্ধতা আর গভীর ভালোবাসার ছায়া।
আরিশের এমন অভিব্যক্তি দেখে মুচকি হেসে ওঠে অরা। ধীরে ধীরে এগিয়ে গিয়ে গলা জড়িয়ে ধরে সে, কানে কানে বলল ,
“আপনার হামিংবার্ডকেই দেখছিলাম আয়নায়।”
আরিশ তার কোমরে হাত রেখে অরাকে একটু উঁচু করে তোলে, তারপর গভীর মমতায় কপালে এক আলতো চুমু রাখে।
“আজকের পর এই রুমে আর আয়নাই থাকবে না।”
“কী!” — চমকে উঠল অরা।
“যা শুনেছ, ঠিক তাই বলেছি।”
“কিন্তু কেন?”
আরিশ চোখ সরিয়ে রাখল, যেন অভিমান লুকাতে চাইছে।
“তোমার এই সৌন্দর্য আমার আগে আয়না দেখে ফেলে—এটাই সহ্য হয় না।”
অরা হেসে উঠল জোরে। সেই হাসিতে যেন রুমটা মুহূর্তেই আলোয় ভরে গেল।
আরিশের কপাল কুঁচকে গেল, থুতনিতে হাত রেখে গম্ভীর গলায় বলল,
“হাসবে না একদম!”
“ঠিক আছে। হাসব না। যান, ফ্রেশ হয়ে আসুন।”
“দরকার নেই। চল, বেরোবো এখনই।”
অরা বিস্ময়ে চোখ বড় বড় করে বলল,
“এখন? রাতে কোথায় যাবেন?”
আরিশ একটু হাসল, চোখে মায়া মেশানো উচ্ছ্বাস,
“তোমার সঙ্গে এখনও রাতের শহর দেখা হয়নি, পাখি। লেটস গো! ”
আনন্দে উচ্ছ্বসিত হয়ে অরা এগিয়ে এসে আরিশের ঠোঁটে এক চুমু দিল। আরিশও পাল্টা চুমু দিল ঠিকই, কিন্তু তাতে অরার ঠোঁটটা কেটে গেল।
“ভালো করে চুমু খেতে পারেন না?”
কিছুটা অভিমান নিয়ে বলল অরা।
আরিশ অবাক হয়ে অরার ঠোঁটের দিকে তাকায়, কাটা দাগটা খেয়াল করে বলল,
“আমি তো আস্তেই দেই… এটা আবার কেমন করে হলো?”
“থাক, হয়েছে। চলুন এবার।” _ বলে মুখ ফিরিয়ে নিল অরা।
আরিশ ফিক করে হেসে উঠে ওর হাত ধরল।
দু’জনের হাসিমুখে, হাতে হাত রেখে তারা রুম থেকে বেরিয়ে গেল। রাতের শহরটা আজ যেন এক নতুন গল্পের সূচনা।
সন্ধ্যার ঢাকা শহর। বাতাসে হালকা গরম, আলো-ছায়ায় জ্বলজ্বল করছে রাস্তাঘাট।
অরার ইচ্ছায় আজ রিকশা চড়ে ঘুরবে তারা। তাই একটা রিকশা ঠিক করে ফেলেছে আরিশ।
তবে সমস্যাটা হলো – আরিশের জীবনে এই প্রথম রিকশায় ওঠা! ফলে খানিকটা অস্বস্তি তো থাকছেই। মাঝেমধ্যে রিকশা একটু নড়েচড়ে উঠলেই আরিশ ভয় পেয়ে যায়, দু’হাত দিয়ে শক্ত করে রিকশার হুক ধরে বসে থাকে। এই দৃশ্য দেখে অরা তো খিলখিল করে হেসেই ওঠে – তার হাসিতে যেন রিকশার চারপাশটা আরও হালকা হয়ে যায়।
রিকশা এসে থামলো সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের সামনে। চারদিকে যেন মানুষের ঢল। শুক্রবার বলে ভিড়টা স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি, দম ফেলার জায়গা নেই যেন। আরিশ রিকশা থেকে নেমে হাত বাড়িয়ে অরাকে নামতে সাহায্য করলো।
রিকশাওয়ালা মামা নিশ্চিন্তে বসে রইলেন নিজের আসনে। কারণ, আরিশ আগেই তাকে খুশি করে দিয়েছেন – সোজা হাজার দশেক টাকা দিয়ে।
মামার মুখে প্রশান্তির হাসি, আজকের দিনটায় তার আর কোনো চিন্তা নেই।
“ এখানে অনেক লোকজন, হামিংবার্ড। “
পাশাপাশি হাঁটছে ওরা। স্বাভাবিকভাবেই লোকজন অরার দিকে তাকাচ্ছে। এমন সুন্দরীর পরনে নীল শাড়ি – ঠিক যেন নীলপরি। লোকজন দেখবে এটাই স্বাভাবিক।
“ তাহলে কোথায় যাবেন? সবজায়গায় তো লোকজন। “
অরার কথার দিকে বিশেষ একটা খেয়াল নেই আরিশের। একটা ছেলেকে দেখছে সে। অরার দিকে কখন থেকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ছেলেটা। আরিশ আচমকাই ছেলেটার কাছে গিয়ে কলার চেপে ধরল। চমকাল অরা। আশেপাশের লোকজন জড়ো হয়ে গেলো।
“ হেই, ওয়াট দ্য ফাক ডু ইউ থিঙ্ক ইউ’র ডুয়িং স্টিয়ারিং অ্যাট মাই ওয়াইফ? গেট লস্ট, অ্যাসহোল!”
অরার ইচ্ছা থাকলেও আরিশকে থামানো তার পক্ষে সম্ভব হচ্ছিল না। ওই জায়গায় জমে থাকা লোকজনের কেউই আর সাহস পাচ্ছিল না তার দিকে ঝাঁপ দেওয়ার। আরিশের চোখ-মুখ থেকে যেন আগুনের শিখা বেরোচ্ছে, তার ক্রোধ একেবারে স্পষ্ট। বেচারা ছেলেটা আরিশের হাত থেকে ছুটে সরে গেল, তারপর অন্যদিকে দৌড়ে পালিয়ে গেল। ধীরে ধীরে লোকজনও সেখান থেকে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করল। একেকজন একেক রকম মিশ্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করছে – কেউ অবাক, কেউ কৌতূহলী, আবার কেউ ভাবছে এটা কতটা ঠিক বা ভুল।
অরা শুধু অসহায় চোখে আরিশের দিকে তাকিয়ে থাকে, নিজেকে সামলাতে পারছে না।
তার মনে হচ্ছে, এই ক্রোধ আর এই দৃশ্য আর কতকাল ধরে চলবে? আরিশ তার দিকে এগিয়ে বলল,
“ বাসায় যাবো। “
অরা কিছু বলল না। আরিশ অরাকে নিয়ে আবারও রিকশায় উঠে বসলো। মাঝখান দিয়ে অরার মনটা খারাপ হয়ে গেলো। মাঝে মধ্যে আরিশের এসব স্বভাব বিরক্তিকর লাগে তার।
নয়নাকে দেখে তামান্নার মুখে আনন্দের ঝিলিক ফুটে উঠল। কিছুক্ষণ আগে নয়নাকে নিয়ে খান বাড়িতে পৌঁছল তালহা। নয়না আর তামান্নাকে রেখে নিজের ঘরের দিকে এগোল সে।
“আপু, কোথায় গেছ?”
নয়না কৌতূহলী হয়ে জিজ্ঞেস করল।
“ভাবি ভাইয়ার সঙ্গে ঘুরতে বের হয়েছে, একটু পরেই ফিরে আসবে। তুমি আগে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে আয়, নয়না। তোমার জন্য রুমটা গুছিয়ে রেখেছি। আমি ততক্ষণে খাবার নিয়ে আসি।”
তামান্না বলল।
“আমি তো খেয়েই এসেছি, আপু। এখন রুমে গিয়ে ফ্রেশ হচ্ছি। আপু ফিরলে আমাকে জানিও।”
নয়না বলল।
“ঠিক আছে, যাও।”
নয়না গেস্ট রুমের দিকে এগোল আর তামান্না রান্নাঘরের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ল।
বাড়ি ফিরেই অরাকে নিয়ে হনহনিয়ে রুমে ঢুকে দরজা আঁটকে দিলো আরিশ। তার স্বামী কেনো এমন করছে বুঝেও যেন বুঝতে পারছে না অরা। রাগের মাথায় অরার শরীর থেকে শাড়িটাই খুলে ফেলে দিলো আরিশ। অরা ওড়না গায়ে পেঁচিয়ে দাঁড়াল।
“ কী হয়েছে আপনার? শাড়ি খুললেন কেন?”
অরা হতবাক হয়ে প্রশ্ন করল। আরিশ রাগে কাঁপতে কাঁপতে বলল,
“ পাগল হয়ে গেছি আমি। এই শাড়ি যত নষ্টের মূল। আর পরবে না এই শাড়ি। “
গভীর নিঃশ্বাস ছাড়ল আরিশ। নিজের রাগ নিয়ন্ত্রণ করতে হিমসিম খাচ্ছে সে।
“ শান্ত হোন একটু। এতো রাগ করলে চলে?”
আরিশ অরার কথায় কান না দিয়ে আচমকাই অরার দু’টো হাতই পেছনে চেপে ধরে, দেয়ালের সাথে ঠেসে ধরলো তাকে৷ দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়ায় অস্বস্তি লাগছে অরার। আরিশ এবার অরার হাত দুটো উঁচু করে দেয়ালের সাথে চেপে ধরে হিসহিসিয়ে বলল,
হামিংবার্ড পর্ব ৫২
“ আমি কি অহেতুক রাগ করেছি, হামিংবার্ড? তুমি দেখোনি, ওই অসভ্য ছেলেটা তোমার দিকে কীভাবে তাকিয়েছিলো। ওর চোখ দু’টো তুলে মার্বেল খেলতে পারলে কলিজা ঠান্ডা হতো আমার। “
আঁতকে উঠল অরা। কী ভয়ংকর কথাবার্তা! শুকনো ঢোক গিলে আরিশের কপালে কপাল ঠেকাল। নিচুস্বরে বলল,
“ শান্ত হোন আরিশ, প্লিজ শান্ত হোন। আমার দিকে দেখুন। আমার চোখের দিকে তাকান…….”
অরার মিষ্টি কথা আরিশের মনকে বেঁধে ফেলল। দু’জনে চোখে চোখ রেখে কিছুক্ষণ নিঃশ্বাস ফেলল, যেন শব্দহীন কিছু বোঝানোর চেষ্টা করছিল। তারপর হঠাৎ আরিশ বেগবান হয়ে অরাকে বুকে জড়িয়ে ধরল।