প্রণয়ের সন্ধিক্ষণে সিজন ২ পর্ব ৬২
আদ্রিতা নিশি
রাত পেরিয়ে সকাল হলো। সবার অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে কাঙ্খিত দিনটির দেখা মিলল। আজ শুক্রবার। অরিত্রিকা ও সারহানের আকদের দিন। আকদের আয়োজন জমজমাট নয় বরং ঘরোয়া। কাছের আত্নীয়স্বজন ছাড়া বাহিরের কাউকে বলা হয়নি। অরিত্রিকার মামা-মামীকে দুইদিন আগে আসার কথা বলা হয়েছে। তারা সকালে কল করে জানিয়েছে তাদের আসতে বিকেল হবে। কারণটা অবশ্য জানিয়েছেন, অরিত্রিকার মামাতো ভাই- বোন আফ্রিদি ও ইফা একসাথে সিলেটে ট্যুরে গেছে। সেখান থেকে দশটার দিকে বাসায় পৌঁছবে। তারপর সবাই মিলে আসবে। অরিত্রিকার আকদ যেহেতু হুট করে করা হচ্ছে তাই তেমন কেউ জানে না। অরিনের শ্বশুরবাড়ির লোকদের দাওয়াত করা হয়েছে শুধু। সারহানের মায়ের কূলে আত্নীয় নেই। তানিয়া বেগম সারহানের নানার একমাত্র মেয়ে। তানিয়া বেগমের মা – বাবা জীবিত নেই। সাথী বেগমের ক্ষেত্রেও একই। শুধু একটা ভাই আছে।
রাহা মাত্র ঘুম থেকে উঠেছে। রাতে ব্যথানাশক ঔষধ খাওয়ায় ঘুমের তীব্রতা বেড়েছিল। সচারাচর ভোর সাড়ে পাঁচটার পর ওঠে। সেই তুলনায় আজ অনেক ঘুমিয়েছে। উঠতে সাত বেজে গেছে। সে উঠতেই দেখল অরিত্রিকা ও ইশরা আগেই ঘুম থেকে উঠেছে। সে তড়িঘড়ি করে ফ্রেশ দুজনকে খুঁজতে লিভিংরুমে গেল। লিভিংরুমে পা রাখতেই দেখতে পেল পুরোটা ফাঁকা। কেউ কোথাও নেই। কিছুটা দূরে একজন সার্ভেন্টকে দেখতে পেয়ে জিজ্ঞেস করল অরিত্রিকা কোথায়? সার্ভেন্ট জবাব দিলো তিনি জানেন না। সে ভাবল হয়তো অরিত্রিকা তার মা বাবার রুমে আছে। সে আর খোঁজাখুঁজি করল না। ধীরালয়ে হাঁটতে হাঁটতে সদরদরজা পেরিয়ে বাহিরে গিয়ে বাগানের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। তখনি দৃষ্টি স্থির হলো কিছুটা দূরে দাঁড়ানো ইরফানের দিকে। মানুষটা এক দৃষ্টে বাগানের সদ্য ফোঁটা গোলাপফুলগুলোর দিকে তাকিয়ে আছে। তার কেন যেন মনে হলো মানুষটার মন ভালো নেই। সে বাড়ির দিকে এগোতে গিয়েও থেমে গেল। কিছু একটা মনে করে পা বাড়াল ইরফানের দিকে।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
“আপনার মন খারাপ ইরফান ভাইয়া?”
পরিচিত মেয়েলী কন্ঠস্বর শ্রবণেন্দ্রিয়ে প্রবেশ করতেই তড়িৎ বেগে পেছনে ফিরে তাকাল। রাহাকে নিষ্পাপ চাহনিতে তাকিয়ে থাকতে দেখে নড়েচড়ে দাঁড়াল। নির্বিকারচিত্তে জবাব দিলো;
“নাহ। তোমার কেন হঠাৎ মনে হলো আমার মন খারাপ?”
রাহা নেত্রপল্লব ঝাপটে ওষ্ঠ উল্টে বলল;
“আপনার মুখ দেখে।”
“আমার মুখে কি লিখা আছে — আমি মন খারাপ করে আছি?”
“আপনার মুখে লিখা নেই। কিন্তু বোঝা যাচ্ছে। অরিত্রিকার সারহান ভাইয়ার সাথে বিয়ে হয়ে যাচ্ছে তাই মুড অফ? অরিত্রিকাকে এখনো ভীষণ ভালোবাসেন তাই না?”
রাহার মলিন কন্ঠস্বর। ইরফান টাউজারের পকেটে দুহাত গুঁজে সটান হয়ে দাঁড়ায়। কপালে সূক্ষ্ম ভাজ ফেলে গুরুগম্ভীর কন্ঠে বলল;
“তোমাকে কে বলেছে অরিত্রিকাকে ভালোবাসি?”
রাহা স্বাভাবিক ভাবে উত্তর দেয় ;
“শুনেছি।”
“অরিত্রিকাকে আমি ভালোবাসি না। আগে ভালোবাসতাম। যখন থেকে জেনেছি সারহান অরিত্রিকাকে ভালোবাসে এবং অরিত্রিকাকেও সারহানকে ভালোবাসে। তখন থেকে নিজের অনুভূতি নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করেছি। প্রতিনিয়ত চেষ্টা করেছি অরিত্রিকাকে ভুলে যেতে।”
“তাহলে এখনো মন খারাপ করে থাকার কারণ কি?”
“একসময় ভালোবেসেছিলাম তো তাই মাঝে মধ্যে একটুআধটু মন খারাপ হয়। প্রথম ভালোবাসা কি সহজে ভোলা যায়?”
“হয়তো না।”
রাহার কেন যেন ভীষণ খারাপ লাগল। বিরসতা নিয়ে ছোট্ট করে প্রতিত্তোর করল। ইরফান রাহার ঝিমিয়ে ওঠা মুখশ্রী দেখে ঠাওর করতে পারল মন খারাপের বিষয়টা। তার ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন হলো। শান্ত কন্ঠে শুধালো;
“তোমার শরীর কেমন আছে এখন? ব্যথা কমেছে?”
রাহা বিস্মিত হলো। ড্যাবড্যাব করে তাকাল ইরফানের অতিশয় শান্ত গম্ভীর মুখের দিকে। অবিশ্বাস্য লাগল মানুষটা তার খোঁজ খবর নিচ্ছে। সে মনে মনে খুশি হলো। যথাসম্ভব মনোভাব আড়াল করে সাবলীলভাবে বলল;
“শরীর ভালো আছে। ব্যথাও কমেছে।”
“সাবধানে চলাফেরা করবে এখন থেকে। পড়ে গেলে আমি কিন্তু সবসময় থাকবো না তোমায় কোলে নিয়ে গন্তব্যে পৌঁছে দেওয়ার জন্য।”
“হু?”
“ভেতরে চলো।”
ইরফান রাহার হতবিহ্বল হয়ে যাওয়া মুখশ্রী দেখে সহালকা হেসে বলল। অতঃপর সেখান থেকে সদর দরজার দিকে হাঁটতে লাগল। রাহা থম মেরে সেখানেই দাঁড়িয়ে রইল। পরক্ষণে কথাটা গায়ে না মেখে ওষ্ঠ এলিয়ে হাসল। কেন যেন ইরফানের বলা কথাটা তার মন মস্তিষ্কে গেঁথে গেল। মনে পড়ে গেল গতরাতের সেই ঘটনাটা। মুহুর্তেই লজ্জায় আড়ষ্ট হয়ে গেল। ইশ, কি লজ্জা!
“আব্বু!”
আজমল সাহেব বসে আছেন নিজের রুমের বিছানায়। কিছুক্ষণ আগে চা, বিস্কুট খেয়ে নাস্তা সেরেছেন। এখন বাহিরের অসমাপ্ত কাজের তদারকি করবেন বলে উঠতেই নিচ্ছিলেন। ঠিক সেসময় আগমন ঘটল অরিত্রিকার। আধখোলা দরজার সামনে দাঁড়িয়ে সুমিষ্ট স্বরে বাবাকে ডেকে উঠল। আজমল সাহেব উঠতে গিয়েও বসলেন। দরজার দিকে তাকিয়ে মেয়েকে ভেতরে ডাকলেন;
“ভেতরে এসো।”
অরিত্রিকা রুমের ভেতরে প্রবেশ করে সরাসরি এগিয়ে গেল। আজমল সাহেব কোমল কন্ঠে বললেন ;
“আমার পাশে বসো।”
অরিত্রিকা মাথা নতুন করে বাবার আদেশ মেনে বসল পাশে। আজমল সাহেব মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে শান্ত কন্ঠে জিজ্ঞেস করলেন;
“কিছু বলবে?”
অরিত্রিকা মাথা দুদিকে নাড়িয়ে ক্ষীণতর স্বরে জবাব দিলো;
“উহু। তোমার সাথে দেখা করতে এসেছিলাম।”
“ওহহ। নাস্তা করেছো?”
“হ্যা। আম্মু আর বড় মা খাইয়ে দিয়েছে।”
“তোমার মামা আসবে। আফ্রিদি আর ইফা ট্যুরে গিয়েছে। ওরা আসলেই সবাই মিলে তখনি রওনা দিবে।”
আজমল সাহেব বললেন। অরিত্রিকা নিশ্চুপ। মুখশ্রী শুকনো ও মলিন। কেন যেন কান্না পাচ্ছে হঠাৎ। সে আকদ ও রিসিপশনের পর এ বাড়িতেই থাকবে তাহলে কেন এমন আজব অনুভূতি হচ্ছে? মনে হচ্ছে, অজানা অনুভূতিতে হৃদপিণ্ড ছিঁড়ে যাচ্ছে। আজমল সাহেব মেয়ের ভাবসাব বুঝলেন। আদুরে স্বরে জিজ্ঞেস করলেন;
“তুমি সারহানকে জীবনসঙ্গী হিসেবে পেয়ে খুশী তো আম্মা?”
অরিত্রিকা আবেগাপ্লুত হয়ে বাবার বাহুতে মাথা রাখল। আনন্দের অশ্রু গড়িয়ে পড়ল ডাগড় আঁখিযুগল হতে। ভেজা কন্ঠে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে বলল;
“আমি ভীষণ খুশী আব্বু উনাকে জীবনসঙ্গী হিসেবে পেয়ে। উনি অনেক ভালো আব্বু। তুমি চিন্তা করো না আমাকে নিয়ে। বিশ্বাস রাখো উনি কখনো আমায় কষ্ট দিবেন না।”
আজমল সাহেব মেয়ের কথা শুনে হাসলেন। অল্প কথায় বুঝে গেলেন মেয়ের মনে সারহানকে নিয়ে আত্মবিশ্বাস, ভালোবাসার গভীরতা। তিনি বললেন;
“দুজনে সুখী হও।”
“আব্বু? তুমি এখনো রেগে আছো আমার ওপর?”
“আমি কি আমার আম্মার ওপর রাগ করে থাকতে পারি?”
“তাহলে কি সারহান ভাইয়ের ওপর রেগে আছো?”
“আমি কারো ওপর রেগে নেই আম্মা। আমি আমার ওপর নারাজ হয়ে আছি। আমার একটা ভুল সিদ্ধান্ত তিনটে জীবন শেষ করে দিতো।”
আজমল সাহেব মন খারাপ করলেন। অরিত্রিকা সহসা বলল;
“ফুপির জন্য এসব হয়েছে।আমার মনে হয় তোমার বোন ইচ্ছাকৃত তোমাকে উল্টোপাল্টা বুঝিয়ে ইরফান ভাইয়ের সাথে আমার বিয়েটা দিতে চেয়েছিল।”
আজমল সাহেব বললেন;
“আজকের দিনে ওসব পুরনো কথা মনে করে মন খারাপ করো না।”
অরিত্রিকা ভেজা নেত্রপল্লব মুছে ওষ্ঠ উল্টে বলল ;
“ঠিক আছে।”
অরিত্রিকা সোজা হয়ে বসল। আজমল সাহেব উঠে দাঁড়ালেন। তাড়া দিয়ে বললেন;
“আমার নিচে যেতে হবে। রান্না করার লোকজন হয়তো এসে পড়েছে।”
অরিত্রিকা ও দাঁড়াল। মুচকি হেসে বলল;
“ঠিক আছে যাও। ”
আজমল সাহেব মৃদু হেসে পা বাড়ালেন বাহির যাওয়ার জন্য। অরিত্রিকাও বাবার পিছু পিছু হাঁটতে লাগল।
সকাল পেরিয়ে দুপুর আসছে। ঘড়ির কাটায় এগারোটা বেজে ওঠার আনাগোনা লক্ষণীয়। কিছুক্ষণ পূর্বে অরিত্রিকা ও সারহানের গায়ে হলুদ হয়েছে। পূর্বে করা মেহেন্দির অনুষ্ঠানের মতো এটাও ইশরার পরিকল্পনায় করা হয়েছে। তবে এবার আবির, সাদাত, অরিন, রাহা ও তিশা তাল মিলিয়েছে। বাড়ির বড়রা নিষেধ করেননি। ঘরোয়া ভাবে যেহেতু সব আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন হচ্ছে তবে কেন নিষেধ করে বাচ্চাগুলোর আনন্দ মাটি করবেন। তাই তারা অনুমতি দিয়েছেন ও আনন্দে সামিল হয়েছেন। হবু বর- বউকে বাড়ির সবাই মিলে হলুদ লাগানোর পরে বাকীরা হলুদ ও রঙ খেলেছিল। প্রায় ঘন্টাখানেক পর অরিত্রিকা ও সারহানকে আলাদা ভাবে গোসল করিয়েছিল। কিন্তু সেখানে বাঁধে আরেক বিপত্তি। অরিত্রিকাকে মেয়েরা মিলে গোসল করিয়েছিল ছাঁদে। সারহানকে ছেলেরা মিলে গোসল করাতে শুরু করলে সে গোসল না করে কোনোরকম লুকিয়ে নিজের রুমের ওয়াশরুমে গিয়ে গোসল সেড়ে নেয়। এতে সাদাত, আবির রাগে ফেটে পড়ে। ইরফান ছিল নিরুৎসাহিত। তবুও মনের ভাব বুঝতে না দিয়ে হলুদ থেকে গোসল করানো অব্দি ছিল। সারহান ইরফানকে পূর্বের মতো স্বাভাবিক আচরণ করতে দেখে খানিকটা নিশ্চিন্ত হয়েছিল।
অরিত্রিকা গোসল সেরে বসে আছে নিজের রুমের বিছানায়। পরনে হালকা গোলাপী রঙা সিল্কের শাড়ি। হাতে ম্যাচিং করা চুড়ি। গলায় ও কানে স্টোনের গহনা। রাহা এ মুহুর্তে ভীষণ ব্যস্ত। বান্ধবীর ভেজা চুল হেয়ার ড্রায়ার দিয়ে শুকিয়ে দিচ্ছে আর ইশরা অরিত্রিকার বেনারসি, গহনাসহ যাবতীয় সাজার জিনিসগুলো গুছিয়ে রাখছে। একটু পরেই পার্লার থেকে মেয়ে আসবে অরিত্রিকাকে সাজাতে। তাই সবকিছু গুছিয়ে রাখা জরুরী। তিশা এসেছে কিছুক্ষণ পূর্বে। সে চুপচাপ বসে অরিত্রিকাকে দেখছে। মনে মনে ভাবছে, কিছুদিন আগেও যে মেয়ে সিঙ্গেল ছিল আজ তার আকদ। রুদ্র ও রুহান এসেছে। তারা লিভিং রুমে বসে আছে।
“অরিত্রিকা বড় মামী সকালে গহনাগুলো দিয়েছিল সেগুলো কোথায়?”
ইশরার বেনারসিসহ যাবতীয় সাজার জিনিস গোছানো শেষ। এখন শুধু গহনাগুলো বাকী। অরিত্রিকা ইশরার কথা শুনে বলল;
“আলমারীর ভেতরে আছে।”
ইশরা কথামতো আলমারী খুলল। কয়েকটা লাল রঙা বক্স পেল গহনার। সেগুলো বের করে শাড়ির ওপর এনে রাখল। রাহা হেয়ার ড্রায়ার দিয়ে চুলগুলো শুকানোর কাজ সম্পূর্ণ করল। তারপর সেটি জায়গা মতো রেখে এসে দুঃখের সহিত বলল;
“আমার তোর জন্য ভীষণ খারাপ লাগছে।”
অরিত্রিকা কাজল কালো আঁখিযুগল মেলে চাইল। কপাল কুঁচকে আগ্রহভরা কন্ঠে জানতে চাইল ;
“কেন? ”
রাহা কোল ঘেঁষে বসল। নাটকীয় ভঙ্গিমায় বলল;
“আকদের পরেও সিঙ্গেল থাকবি। আহারে! বরের আদর না পেয়ে শুকিয়ে যাবি। আংকেল এমন কেন? একবারে অনুষ্ঠান করে বিয়ে উঠিয়ে দিলে কি হতো?”
অরিত্রিকা বিমূঢ় চাহনিতে তাকাল। এসব কি বলছে অসভ্য মেয়ে! ভালোবাসার অভাবে কেউ কি শুকিয়ে যায়? আশ্চর্য! তিশা মন খারাপ করার ভাণ করে বলল;
“অরিত্রিকার সাথে অন্যায় করা হচ্ছে। ভাইয়া কিভাবে আংকেলের কথা মেনে নিলো?”
ইশরা মুচকি হেসে বলল;
“সারহান ভাই সহজে কিভাবে ছোট মামুর কথা মেনে নিলো এটাই ভাবার বিষয়। আমি যতটুকু উনাকে চিনি সহজে এ শর্তে সহমত পোষণ করা ধাতে নেই। আকদ হয়ে যাক তারপর বোঝা যাবে। অরিত্রিকার বিয়ে উঠিয়ে না দেওয়ার কারণ অরিন আপু। অরিন আপুর বিয়ে দ্রুতই উঠিয়ে দিবে। তারপর অরিত্রিকার বিয়ে উঠিয়ে দেওয়ার কথা ভেবেছেন।”
দুজনেই একযোগে বলল;
“ওহহ আচ্ছা। এই কাহিনী। ”
ইশরা মাথা দুলিয়ে হ্যা বলল। অরিত্রিকা নির্বাক হয়ে এদের কাহিনী দেখতে লাগল।পার্লার থেকে এখনো মেয়েটি আসেনি। তাই তিনজনে গোল হয়ে বসে অরিত্রিকার সাথে গল্প করছে। হাসি -ঠাট্টা, গল্প গুজবে মাতলো তারা। এর মাঝে কোথাও থেকে অরিন এসে খবর দিলো তানিয়া বেগম অরিত্রিকা বাদে সবাইকে ডাকছেন। তারা গল্প বাদ দিয়ে অরিত্রিকাকে রেখে তানিয়া বেগমের কাছে গেল। অরিত্রিকা একা বসে রইল রুমটায়। অসহায় মুখে দৃষ্টি স্থির করল বেনারসির দিকে। ধীরে ধীরে জোড়ালো হচ্ছে কারো পায়ের ধ্বনি। হঠাৎ কারো আগমনের সংকেত পেতেই অরিত্রিকা দৃষ্টি সরিয়ে সামনে তাকাল। দেখতে পেলে শ্যামবর্ণের স্নিগ্ধ পুরুষকে। সে জড়োসড়ো হয়ে বসল। লাজুকতায় ছেঁয়ে গেল বদনসহ সর্বাঙ্গ। লজ্জা আড়ষ্টতা এড়াতে এলোমেলো দৃষ্টি ফেলে শুধালো ;
“আপনি এখানে?”
সারহান দরজা ডিঙিয়ে ভেতরে এলো। স্বাভাবিক ভাবে বলল;
“তোকে একপলক দেখে এসেছি।”
অরিত্রিকা থমকে গেল।চকিত নয়নে তাকাল সারহানের দিকে। চক্ষুদ্বয়ে খেলে গেল বিস্ময়াভাব। সে অবিশ্বাস্য ভঙ্গিতে পলক ঝাপটালো। বিস্মায়াবিষ্ট মোহে সাদা শার্ট পরিহিত মানবের দিকে অধীর আগ্রহে অপলক চেয়ে রইল। তার ওষ্ঠযুগল কিঞ্চিৎ ফাঁক হয়ে গেল। নিরবতায় মোড়া রুমের চার দেয়াল। নিস্তব্ধতায় ঢেকে এসেছে চারিপাশ কোথাও কেউ নেই। পিনপিনে নিরবতার মাঝে শোনা যাচ্ছে একে অপরের গাঢ় নিঃশ্বাসের ধ্বনি। সারহান শাণিত পদযুগল ফেলে এগিয়ে আসলো। দাঁড়াল ঠিক অরিত্রিকার সামনে। অরিত্রিকা তার দৃষ্টি সন্তর্পণে নামিয়ে নিলো। বক্ষস্থলে বইয়ে গেল শীতল এক অনুভূতি। সে দু-হাত দ্বার শাড়ির আঁচল মাথায় টেনে নিলো। ভেতর বাহিরের আড়ষ্ট ও লজ্জায় হাসফাস করে উঠল। সারহান শান্ত চাহনিতে পরখ করল তার একান্ত নিভৃতসুধার কার্যকলাপ। লক্ষ্য করল গোলাপী রঙা ঘোমটার আড়ালে লুকানো মুখাবয়ব। এ যেন এক গোলাপি সুতোর আবরণে ঢেকে রাখা সদ্য পুষ্পফটিত পদ্মফুল। এ ঘায়েল করা রুপ যেন আরেকদফা বিমোহন ধরিয়ে দিলো এক প্রেমিক পুরুষের হৃদয়ে। প্রেমিক হৃদয়ে হঠাৎ এক পশলা প্রেমময় বৃষ্টির আগমন ঘটল। মাতাল করে দিলো তাকে। মন – মস্তিষ্কে জেঁকে ধরল প্রেয়সীর পদ্মের ন্যায় স্নিগ্ধ রুপ। পুরুষসত্তা অচিরে সামলে নিলো তৎক্ষনাৎ। নিজের মাঝে গভীর অনুভূতির দ্বন্দ্ব সামলে নিলো নিমেষে। চমৎকার হাসল।
অতি শান্ত কন্ঠে বলল;
“একই অঙ্গে কতোপ্রকার সৌন্দর্য প্রকাশ পায় তোর? প্রতিবারই তুই নব রূপে আমাকে অভিভূত করিস। আজ তোকে পদ্মপুষ্পের সদৃশ মনে হচ্ছে। পদ্মপুষ্পও যেন তোর এই রূপলাবণ্যের সম্মুখে নতজানু হতে বাধ্য।”
অরিত্রিকা হতচকিত নয়নে তাকাল সারহানের দিকে। কল্পপুরুষের হাস্যজ্জ্বল মুখাবয়ব দেখে মন কুঠুরী ভালোলাগায় সিক্ত হলো। বিভ্রম নিয়ে গোলাপী ওষ্ঠযুগল এলিয়ে চমৎকার হাসল। মাথার ঘোমটাটা ছেড়ে দিলো। মেয়েলী মুখশ্রী দৃশ্যমান হলো। সারহান হাস্যরত রমণীর মুখ দেখে খেই হারাল। পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর মানবী মনে হলো। প্রেমিক পুরুষের মন বলল, এ হাসি চিরস্থায়ী হোক আমার প্রিয়তমা। সেই অভ্যন্তরীণ অকস্মাৎ গলদেশ হতে স্মিত কোমল কন্ঠে ঝড়ে পড়ল ;
“এ হাসিটুকু তোর ঠোঁটে সারাজীবন স্থায়ী হোক ফাইরুজ। পৃথিবীর সব সুখ, আনন্দ ও ভালোবাসা সৃষ্টকর্তা তোর তকদিরে রাখুক। ”
অরিত্রিকা চক্ষুদ্বয় ছলছল করে উঠল। দোদুল্যমান মনটা অজানা সুখের সাগরে নিমজ্জিত হলো। প্রাণোচ্ছল হেসে আবেগামিশ্রিত কন্ঠে বলল;
“আমার সব সুখ,আনন্দ ও ভালোবাসা আপনাকে ঘিরে। সৃষ্টিকর্তা শুধু আপনাকে আমার করে দিক। সেটাই হবে আমার কাছে পরম পাওয়া।”
“কতোটা ভালোবাসিস আমায়?”
“যতোটা ভালোবাসলে প্রেমিক পুরুষের বক্ষে মাথা রেখে তাকে নিয়ে শত- শত অভিযোগ করা যায় ততটা ভালোবাসি আপনাকে।”
অরিত্রিকা প্রাণবন্ত কন্ঠে বলল।সারহান হাসল৷ নিঃশব্দ সেই হাসি। অতঃপর ভ্রু নাচিয়ে গলা খাদে নামিয়ে মদ্যক কন্ঠে বলল;
“আর মাত্র কয়েক ঘন্টা। তারপরেই আমার বক্ষে মাথা রেখে শত-শত অভিযোগ করার লাইসেন্স পেয়ে যাবেন। অভিযোগ করার জন্য আপনি রেডি তো আমার না হওয়া বিবিজান।”
অরিত্রিকা লজ্জা পেল। নজর লুকিয়ে কোনো মতে বলল;
“আপনি এসব কি বলছেন? আব্বুকে দেওয়া কথা কি ভুলে গেছেন?”
সারহান বাঁকা হেসে বলল;
“মানুষ কথা দেয় তা না রাখার জন্য।”
অরিত্রিকা চমকে গেল। হতবাক হয়ে বলল;
“তারমানে কথা রাখবেন না।”
“দেখা যাক।”
“দেখা যাক মানে?”
অরিত্রিকা হতবুদ্ধির ন্যায় জড়বস্তুর ন্যায় বসে রইল। সারহানের ওষ্ঠকোণে ফিচেল হাসি। এর মাঝেই পার্লারের মেয়েটাকে নিয়ে হাজির হলো ইশরা ও রাহা। রুমে প্রবেশ করতেই দেখল সারহান দাঁড়িয়ে আছে। তারা অবাক হলো। সেই অবাক হওয়া মানবীদের না দেখে গটগট করে বেড়িয়ে গেল সারহান।
দুপুর দুইটা বেজে ত্রিশ মিনিট। পদচারণায় মুখরিত চৌধুরী ভিলা। পরিচিত গুটি কয়েক আত্নীয়দের চেনা মুখগুলো দৃশ্যমাণ। দুপুরে খাবারের পর্ব চুকেছে অনেকক্ষণ আগে। লিভিং রুমের পুরোটা সাজানো হয়েছে। মধ্যেখানের একপাশে সোফায় সেট করা। তার চারপাশে মেহমান ও বাড়ির লোকদের বসার জন্য চেয়ারের ব্যবস্থা করা হয়েছে। আরশাদ ও আজমল সাহেবের ইনভাইটে হাতে গোনা কয়েকজন এসেছেন। তাদের মধ্যে প্রাক্তন এমপি ও দলীয় নেতাসহ কোম্পানির কিছু কাছের মানুষ এসেছেন। উপস্থিত সবাই নিজেদের মতো চেয়ারগুলো পূর্ণ করে বসেছে। আবিরের বাবা মা ও এসেছে। অরিত্রিকার বন্ধুমহলের সবাই একসাথে বসেছে কিন্তু রাহা বসেনি। রাহার দুই চেয়ার পরে তিশা, রুদ্র ও রুহান বসেছে। সে বসেছে ইরফানের পাশে। ইচ্ছাকৃত বসেনি৷ তাড়াহুড়োয় বসে পড়েছে। সারহানের বন্ধুমহলের মধ্যে মুন এসেছে হিমিকে সঙ্গে নিয়ে। বাকীদের বললেও ছুটি না পাওয়ায় আসেনি। তবে সারহানকে বলেছে খুব শীঘ্রই দেখা করতে আসবে। কিছুটা দূরে দুজন ক্যামেরাম্যান ক্যামেরা সেট করে দাঁড়িয়ে আছেন। আজমল সাহেব তাদের এনেছেন। ঘরোয়া ভাবে অনুষ্ঠান হলেও স্মৃতি হিসেবে ছবি, ভিডিও রাখা আব্যশক।
বাড়ির কর্তা- কর্তীরা আপাতত কাজ বাদ দিয়ে চেয়ারে এসে বসেছেন। কিছুক্ষণের মধ্যে কালেমা পড়ানো হবে।
সারহান সোফায় বসেছে। তার পাশে চেয়ার নিয়ে বসেছে আবির। অনবরত বন্ধুকে উল্টোপাল্টা বুদ্ধি দিতে তৎপর সে। সারহান ও আজ অনেক ধৈর্য নিয়ে সেসব গিলে চলেছে। কিন্তু তার মন তো অন্যদিকে। গুরুগম্ভীর ভঙ্গিতে বসে বারবার ঘাড় বাঁকিয়ে তাকাচ্ছে সিঁড়ির দিকে। তৃষিত চক্ষুদ্বয় অপেক্ষা করছে প্রেয়সীকে দেখার জন্য। হৃদয় হয়ে উঠেছে ব্যাকুল। কখন এক পলকের দর্শন পাবে নববধূ রুপে অরিত্রিকার। তার চঞ্চলা হরিণীকে দেখতে কেমন লাগবে? নিশ্চয়ই একবার দেখলে চোখ ফেরানো দায় হয়ে যাবে। হৃদযন্ত্র থমকে যাবে। পুনরায় বেসামাল হয়ে যাবে।
“কিরে ওদিকে ওমন উঁকি ঝুঁকি মা*রছিস কেনো? সবাই সামনে বসে আছে একটু লজ্জা সরম কর। বর হয়ে কেউ এমন নির্লজ্জের মতো আচরণ করে?”
আবির ভণিতা করে চাপা স্বরে বলল। সারহান রাগত দৃষ্টিতে তাকাল। শক্ত কন্ঠে বলল;
“লজ্জা মেয়েদের ভূষণ। আমি কেন লজ্জা পাবো? আমি আমার বউকে দেখতে চাচ্ছি, অন্য কারো বউকে নয়। এখানে নির্লজ্জতার কি আছে?”
আবির দাঁত কেলিয়ে বলল;
“আরে ভাই রেগে যাচ্ছিস কেন?”
“চুপ থাক মাথা গরম করে দিস না।”
“আচ্ছা। ভালো কথা শোন। বউ তো একটু পরেই দেখতে পারবি। এমন লাফালাফি না করে ভদ্র ছেলের মতো বস। ”
সারহান জ্বলন্ত চাহনি প্রয়োগ করল। আবির দমে গেলেও প্রকাশ করল না। পূর্বের ন্যায় ভাব নিয়ে ফিসফিসিয়ে বলল;
“দোস্ত! আমার হিটলার শ্বশুরটার শর্তের জন্য তোর বাসরটা সাজাতে পারলাম না। আমি তো তাও আকদের পরে বউয়ের রুমে, বউয়ের পাশে ঘুমাতে পেরেছি। কিন্তু তোর ক্ষেত্রে সে সুযোগটুকুও জুটলো না রে। কি কষ্ট! হৃদয়ে ব্যথা লাগে রে।”
সারহান কুটিল হাসল। হাসি বজায় রেখে চাপা স্বরে বলল;
“আমার বাসর নিয়ে তোর ভাবতে হবে না।আমি আমারটা বুঝে নিতে পারি।”
“তোর জন্য কষ্ট হচ্ছে তাই বলছি।”
“আমার জন্য কষ্ট না পেয়ে নিজের জন্য কষ্ট পা। বিয়ে হয়েছে অথচ এখন পর্যন্ত বিবাহিত সিঙ্গেল হয়ে আছিস।”
আবির মুখ ভার করে বলল;
“আমায় খোটা দিচ্ছিস?”
সারহান গম্ভীর কন্ঠে বলল;
“হ্যা দিচ্ছি। চুপ কর নয়তো তোর পশ্চাদেশে একটা লাথি মা*রবো।”
আবির মুখ ভার করে কুলুপ এঁটে বসে রইল৷ সারহান তা দেখে নিঃশব্দে হাসল।
অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে আগমন ঘটল নববধূর। মুহুর্তে শোরগোল থেমে নেমে এলো নিস্তব্ধতার প্রহর। সবাই এক ধ্যানে তাকিয়ে রইল সিঁড়ির দিকে। সারহান ও তড়িৎ বেগে ঘাড় বাঁকিয়ে তাকায় সেদিকে। এতোক্ষণের ব্যাকুল হওয়া হৃদয় থমকে গেল। তীক্ষ্ণ চাহনি বদলে গিয়ে বিমোহের সৃষ্টি হলো। মুখাবয়ব অতিশয় শান্ত হয়ে এলো। বক্ষ স্থলে দুর্বিপাকের ন্যায় উদ্দাম বেগে ছুটে এলো অনুভূতিরা। নিভৃতসুধাকে খয়েরী রঙা বেনারসিতে দেখে যেন দিশেহারা হলো। মুগ্ধতায় ডুবে গেল তার পুরুষালিসত্তা।
অরিত্রিকা লজ্জাসংকোচ নিয়ে একপলক তাকিয়ে উপস্থিত সবাইকে দেখে নিলো। তার পরনে সারহান পছন্দ করা সেই খয়েরী রঙা বেনারসি শাড়ি। মাথায় খয়েরী রঙা বউ ওড়না। মুখশ্রীতে কৃত্রিম সাজ। সেই সাজকে ছাপিয়ে গেছে লজ্জা। গলায় স্বর্ণের সীতাহার ও কন্ঠনালীর কিছুটা নিচে স্বর্ণের হার। কানে স্বর্ণের ঝুমকো। মাথার একাংশ ও কপালের মধ্যাংশ জুড়ে স্বর্ণের টিকলি। হাতে খয়েরী চুড়ির ভাজে স্বর্ণের চুড়ি দৃশ্যমান। অরিত্রিকা শাড়িটা হাত দিয়ে ধরে হালকা উঁচু করে ধীরজ পায়ে এগিয়ে আসলো। সেই দৃশ্য যেন সারহানকে অশান্ত করে তুলল। পলকহীন চাহনিতে তাকিয়ে রইল সে।এক স্নিগ্ধময়ীর অপার সৌন্দর্যে তাকে ঘায়েল করল। মেয়েটাকে তার কাছে মনে হলো এক জীবন্ত পুতুল। এতো নিখুঁত সৌন্দর্যের অধিকারী কি কেউ হতে পারে? অবাধ্য মন জবাব দিলো না। এক নববধূ রুপে রমণী এক মুহুর্তে থমকে দিলো এক প্রেমিক পুরুষের মন।
“দোস্ত ঘাড় ব্যথা হয়ে যাবে।”
আবিরের কন্ঠস্বর কর্ণকুহরে প্রবেশ। সারহান অবাধ্য চক্ষুদ্বয় সামলে নিলো। নিজেকে সামলে দৃষ্টি সংযত করে সোজা হয়ে বসল। কিন্তু মন! মন তো এখনো বেসামাল। অরিত্রিকা এসে চুপচাপ বসল সারহানের পাশে। আড়চোখে এক পলক তাকাল পাশে বসা অফ হোয়াইট রঙের পাঞ্জাবি পরিহিত মানুষটার দিকে। দেখল মানুষটা গুরুগম্ভীর হয়ে বসে আছে। সে সন্তপর্ণে দৃষ্টি নত করে মূর্তিরন্যায় বসে রইল। সারহান পাশে বসা ভুবনমোহিনী রুপে বসে থাকা মানবীর দিকে ভুলেও তাকানোর ভুল করল না। মেয়েলী কাজল কালো আঁখিযুগলে চোখ রাখলেই হবে যেন সর্বনাশ।
সাথী বেগম মেয়েকে নববধূ রুপে দেখে স্মিত হেসে ক্ষীণ কন্ঠে বলে উঠলেন ;
প্রণয়ের সন্ধিক্ষণে সিজন ২ পর্ব ৬১
“ মাশাল্লাহ।”
তানিয়া বেগম ছেলের বউকে দেখে কোমল কন্ঠে বললেন;
“আমার ছেলে আর ছেলের বউকে দেখতে কতো সুন্দর লাগছে। মাশাল্লাহ। ”