অশ্রুজলে বোনা বিয়ে সিজন ৩ পর্ব ৪৭
ইয়াসমিন খন্দকার
আরুশি ও আরহাম জাঈদকে নিয়ে বসে আছে নিজেদের ঘরে। এতদিন পর একত্রিত হয়ে এত দিনের সব আক্ষেপ মেটাতে দুজনেই বদ্ধ পরিকর। জাঈদ আরহামের কোলে উঠে বসে আছে। আরহাম তার গরম গালে চুমু দিয়ে বলে,”তো আমার ঝটপটে ছেলেটাকে আজ এত সুইট সুইট কেন লাগছে?”
জাঈদ গাল ফুলিয়ে বলে,”পাপা..আমি নিজের ফ্রেন্ডদের খুব মিস করছি।”
আরুশি হেসে বলে,”ফ্রেন্ডদের মিস করছ নাকি তাদের নাক ফাটানো!”
আরহাম অবাক হয়ে বলে,”তাই নাকি?! আমার ছেলেটা এত বিচ্ছু!”
জাঈদ বলে ওঠে,”মাম্মা, তুমি এসব কি বলছ? আমি তো গুড বয়। শুধু একবার একটা ছেলে বলেছিল যে আমার পাপা নেই এজন্য আমি ওকে মেরেছিলাম। কিন্তু আমার পাপা তো আছে এই যে আমার পাপা।”
কথাটা শুনে আরহাম ও আরুশি একে অপরের দিকে তাকায়। আরুশির কিছুটা অপরাধবোধ হয়। আরহাম জাঈদকে নিজের বুকে আগলে নিয়ে বলে,”আমাকে তুমি অনেক মিস করেছ তাই না বাচ্চা?”
“খুব মিস করেছি তোমায় পাপা।”
“কোন ব্যাপার না। এই তো আমি তোমার পাশেই আছি। আর কখনো তোমায় ছেড়ে কোথাও যাব না। প্রমিস করলাম।”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
কিছু সময় পর জাঈদ ঘুমিয়ে যায়। আরুশি করুণ চোখে চেয়েছিল আরহামের দিকে। আরহাম এসে আরুশির কাধে হাত রেখে বলে,”অতীতকে তো আমরা বদলাতে পারবো না কিন্তু আমরা চাইলেই বর্তমান সময়টা সুন্দর ভাবে কাটাতে পারি। কি বলো?”
আরুশি বলে,”আমি এত বোকামো ও হঠকারিতা কিভাবে করলাম আরহাম? আমার জন্য তুমি নিজের ছেলের শৈশবটা দেখলে না। পিতৃত্বের অধিকার থেকে বঞ্চিত হলে। এই আক্ষেপ নিশ্চয়ই তোমার আজীবন থেকে যাবে। তোমার তো নিজের ছেলেকে হাঁটতে শেখানোর কথা ছিল..ওর সাথে সুন্দর মুহুর্ত কাটানো..ওর আধো আধো গলাত পাপা ডাকা শোনা..এসব কিছু থেকে আমি তোমায় বঞ্চিত করেছি। এর জন্য যে ভীষণ গিল্টি ফিল হচ্ছে।”
“ধুর পাগলী! কে বলেছে আমার আর কখনো এই সুযোগ আসবে না? তুমি চাইলে আমার এই আক্ষেপ মেটাতে পারো।”
“কিভাবে?”
“আমাকে আরেকটা বেবির বাচ্চা হওয়ার সৌভাগ্য দেয়ার মাধ্যমে!”
আরুশির মুখ লজ্জায় লাল হয়ে যায়। আরহাম আরুশিকে নিজের কাছে টেনে নিয়ে বলে,”এক বাচ্চার মা হয়েও এত লজ্জা আমার বউটার?”
“এতদিন পর যে আবার কখনো তোমার এই স্পর্শ, তোমার ভালোবাসা ফিরে পাব তা আমার কল্পনাতীত ছিল।”
“কিন্তু আমি জানতাম আমার আরুশি আবার আমার কাছে ফিরবেই। আমি তো নিশ্চিত ছিলাম এই ব্যাপারে। আর আমার চাওয়াই পূরণ হয়েছে। আজ সব ভুল বোঝাবুঝি, সব দূরত্ব মিটিয়ে আমরা আবার এক হয়েছি। আর কেউ চাইলেও আমাদের মাঝে কোন দূরত্ব তৈরি করতে পারবে না। আগেরবার হয়তো আমি তোমার সঙ্গ দিতে পারি নি তবে এবার আর সেই ভুলের পুনরাবৃত্তি করব না। এবার সকল মুহুর্তে আমি তোমার পাশে থাকব।”
বলেই আরহাম আরুশিকে কাছে টেনে তার কপালে চুমু খায়। অতঃপর তার ঠোঁটে ঠোঁট ডুবিয়ে দেয়। দীর্ঘ ৫ বছর পর তারা দুজন আজ এত কাছাকাছি..ধীরে ধীরে তাদের মধ্যকার দূরত্ব ঘুচে যায়। আরহামের স্পর্শগুলো আরো গভীর হয়। একে অপরের শরীর ও মনের সাথে মিশে যায় তারা।
রাজীব মারিয়া ও তার ছেলে মাশরাফিকে নিয়ে নিজের বাসায় আসে। রাজীব মারিয়াকে বলে,”আপাতত এখানে থাকো আর একদম ভয় পেয়ো না, তোমার বা তোমার বাচ্চার কিছু হবে না। তোমার মা-বাবার নাম্বার দাও আমি ওনাদের সাথে যোগাযোগ করি।”
মারিয়া বলে ওঠে,”নাহ, তার কোন প্রয়োজন নেই। আমি আর ওনাদের ঘাড়ে বোঝা হতে চাই না। আপনি যে আমার শ্বশুর বাড়ির ঐ ভয়াবহ পরিবেশ থেকে আমাকে আর আমার বাচ্চাকে বের করে এনেছেন এটাই আমার জন্য অনেক। আমি আপনাদের কারো জীবনে আরো কোন ঝামেলা তৈরি করতে চাই না। আপনি শুধু আমাকে একটা কাজের ব্যবস্থা করে দিন। আমি নিজের ছেলেকে নিয়ে এখান থেকে চলে যাব। কথা দিচ্ছি আপনাকে। আমি তো এখন শুধু নিজের ছেলের মুখের দিকে তাকিয়েই বেঁচে আছি নাহলে তো..”
কথা বলতে বলতেই কান্না করে দেয় মারিয়া। রাজীব মারিয়ার উদ্দ্যেশ্যে বলে,”এতোটা ভেঙে পড়ো না। আমি দেখছি কতটা কি করা যায় তোমার জন্য।”
এরমধ্যে হঠাৎ মারিয়ার ছেলে মাশরাফি বলে ওঠে,”আম্মু..খিদে পেয়েছে..”
মারিয়া ভীষণ লজ্জাবোধ করে। ছেলেটাকে ভালোমতো খাওয়াতেও পারে না সে। রাজীব এগিয়ে এসে মাশরাফিকে কোলে তুলে নিয়ে বলে,”বাসায় তো কিছু নেই আপাতত চলো আমি তোমায় রেস্টুরেন্ট থেকে কিছু খাইয়ে নিয়ে আসি। আর মারিয়া তোমার বিশ্রামের প্রয়োজন। দক্ষিণ দিকের ঐ রুমটায় গিয়ে বিশ্রাম করো। আমি তোমার জন্যও রেস্টুরেন্ট থেকে খাবার নিয়ে আসব।”
মারিয়া আচমকা রাজীবের পায়ের কাছে বসে পড়ে কাঁদতে থাকে৷ রাজীব অবাক হয়ে বলে,”আরে একি করছ?!”
“আপনি এতো ভালো কেন রাজীব ভাই? আমি আপনার সাথে এত অন্যায় করেছিলাম তবুও আপনি আমার জন্য এত কিছু করছেন। এসব কিছু যে আমার অপরাধবোধ আরো বাড়িয়ে দিচ্ছে!”
“শান্ত হও, এভাবে কেদো না। ভুল মানুষ মাত্রই হয়। কিন্তু সেই ভুলের প্রায়শ্চিত্ত করে জীবনে এগিয়ে যাওয়াই আমাদের কর্তব্য। তুমি আর অতীত নিয়ে পড়ে থেকো না, অতীতে যা হবার হয়েছে। এবার নিজের ছেলেকে নিয়ে একটা সুন্দর জীবনের স্বপ্ন দেখো।”
বলেই রাজীব মাশরাফিকে নিয়ে বেরিয়ে যায়। মারিয়া রাজীবের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে বলে,”এখনো আমার সব পাপের প্রায়শ্চিত্ত হয় নি রাজীব ভাই! আরু..আমার বেস্টফ্রেন্ড ওকে আমি ঠকিয়েছিলাম। ওর বিশ্বাস ভেঙে দিয়েছিলাম। আমি আবার ওর মুখোমুখি হতে চাই৷ ওর কাছে ক্ষমা চাইতে চাই। ও আমায় ক্ষমা না করলে যে আমি মরে গিয়েও শান্তি পাবো না।”
নির্ঝর খানের দিন কাটছে নিজের রুমে একাকীত্ব অবস্থায়। সায়রা মাঝে মাঝে এসে শুধু তাকে খাবার দিয়ে যায়। আমান, নিঝুম খান এবাড়িতে থেকেও তার সাথে কোন কথা বলে না। আমিনা মাঝে মাঝে এসে গল্প করে তবে তা নির্ঝর খানের মনে শান্তি আনে না। নিজের কর্মফলে তিনি এতোটাই জর্জরিত যে আপনজনের অভাব, একাকীত্ব এসব যেন তাকে ঘিরে ধরেছে। এক মুহুর্তও শান্তিতে নিঃশ্বাস নিতে পারেন না তিনি। নির্ঝর খান হতাশার শ্বাস ফেলে বলেন,”সত্যিই কি আমি এমন কোন ভুল করেছিলাম যার কারণে আজ এত বড় শাস্তি পেতে হচ্ছে আমায়?”
এই প্রশ্নের উত্তর তিনি পান না। শুধু অনুভব করেন চারপাশের স্তব্ধ পরিবেশ। তার দীর্ঘ দিনের সঙ্গী আফিফাও আজ তার পাশে নেই৷ তার জীবন যেন এক অদ্ভুত অভিশাপের চিহ্নমাত্র।
রাজীব মাশরাফিকে রেস্টুরেন্ট থেকে খাইয়ে আনে। অতঃপর মারিয়ার কাছে গিয়ে তার দিকে একটি খাবারের প্যাকেট বাড়িয়ে দিয়ে বলে,”এতে খাবার আছে খেয়ে নাও!”
মারিয়া খাবারের প্যাকেটটি নেয়। এমন সময় রাজীবের ফোন বেজে ওঠে। বিপরীত দিক থেকে রাজীবের কাছে এমন কিছু খবর আসে যা তার মন খুশি করে দেয়। রাজীব ফোন রেখে বলে,”মারিয়া, তোমার কিছু প্রয়োজন হলে পাশের ফ্ল্যাটে শ্যামলী আপু আছে ওনাকে জানিও আমি ওনাকে বলে রাখবো। আমায় এখন বের হতে হবে।”
“আচ্ছা, তবে আমার একটা অনুরোধ রাখবেন?”
“কি অনুরোধ?”
“আরুর সাথে আমার শুধু একটিবার দেখা করাবেন। আমি ওর কাছে ক্ষমা চাইব!”
রাজীব দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বলে,”ঠিক আছে, করাবো একসময়।”
ঈশান কবীরের সামনাসামনি টেবিলে বসে আছেন আদৃতা। এমন সময় সেখানে চলে আসে ঈশান কবীরের রাজনৈতিক সহযোগী আব্দুল মান্না। তিনি আসতেই আদৃতা বলে ওঠেন,”ওরা আবার আমার বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করেছে। কি ভেবেছে টা কি ওরা? আদৃতার সাথে পাঙ্গা নিয়ে পার পেয়ে যাবে? এবার ওদের সপরিবারে খতম করে দেবো।”
অশ্রুজলে বোনা বিয়ে সিজন ৩ পর্ব ৪৬
এদিকে আব্দুল মান্না একটা অবোধ্য হাসি দেন। তার বুকপকেটে একটা পেনড্রাইভ। যা তিনি সযত্নে রেখে দিয়েছেন। এই পেনড্রাইভই হয়তো শীঘ্রই সমস্ত কিছুর মোড় ঘুরিয়ে দেবে।