যতনে রাখিলাম যাতনা পর্ব ৩২

যতনে রাখিলাম যাতনা পর্ব ৩২
মম সাহা

বৃষ্টি হচ্ছে এখনো। চারপাশটা ঠান্ডা, শীতল। জানালা খোলা রাখলেই কত বেনামি বাতাস হুড়মুড়িয়ে ঢুকে যায় ঘরটায়! যেন ওদের আজ অনির্দিষ্ট গন্তব্য। যখন, যেভাবে পারছে মানুষকে ছুঁয়ে দিচ্ছি। ধরণী করছে উষ্ণতাহীন।
বাহার ভাইদের টেবিল জুড়ে খুশির মৌসুম চলছে। বনফুল, চাঁদনী, তুহিন, চেরি, টুইংকেল সকলে খেতে বসেছে। ঘূণে ধরা কাঠের টেবিলটা আজ মানুষের সমাগমে চঞ্চল হয়ে উঠেছে।
চিত্রা খাবার দিচ্ছে। তাকে জিনিসপত্র এগিয়ে-পিছিয়ে সাহায্য করে দিচ্ছেন বাহার ভাই। এই খিচুড়ির পাত্রটি আনছেন তো এই ইলিশ মাছের ভাজা এগিয়ে দিচ্ছেন। রমরমা ঘ্রাণ ছড়াচ্ছে।

চাঁদনী তো ভীষণ আপ্লূত হলো খিচুড়ি এক লোকমা মুখে দিয়েই। ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে অতি আশ্চর্যিত হয়ে বলল, “চিতা বাঘ, তুই এত স্বাদের রান্না কীভাবে শিখলি! এত সুন্দর ঘ্রাণ আর খেতেও তো কী অসাধারণ হয়েছে! আমি নিজেও এত ভালো রাঁধতে পারি না এখনো।”
চিত্রা চাঁদ আপার প্রশংসায় গাল ভরে হাসলো। ওড়না গুছিয়ে কাঁধে ফেলে উত্তর দিলো,
“আপা, মিথ্যে বলো না তো। তুমি যে কত ভালো রাঁধো তা বুঝি আমি জানি না?”
“সত্যিই বলছি, চিতা বাঘ। এত মজার রান্না আমি রাঁধতে পারি না। তাই না টুইংকেল? তুমি তো আমার রান্না খেয়েছো। তুমিই বলো আমার চেয়ে এই রান্নাটা বেশি মজা হয়েছে না?”
টুইংকেল নামের সুন্দরী মেয়েটি তখন খিচুড়িতে ফু দিচ্ছিলো ঠান্ডা হওয়ার আশায়। চাঁদনীর প্রশ্নে সে হেসে মাথা নাড়ল। প্রশংসনীয় স্বরে বলল,
“চাঁদনী আপুনি ঠিক বলেছে।”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

চিত্রা ফিচেল হাসল, “কীভাবে বুঝলে ঠিক বলেছে? তুমি তো এখনো গরমের জন্য খাবারটা মুখেই দিলে না!”
টুইংকেল এবার হেসে ফেলল। তার সাথে তাল মিলিয়ে বাকি সকলেই হাসলো।
বাহার ভাই তখন রান্নাঘর থেকে বেগুন ভাজার থালাটা নিয়ে এলেন। সকলের প্লেটে দিতে দিতে ব্যস্ত কণ্ঠে বললেন, “তুমিও খেতে বসে যাও। বাকি যাদের যা লাগবে আমি দিয়ে দিবো।”
প্রতিত্তোরে চিত্রা ডানে-বামে মাথা নাড়ালো। কিছুটা ফিসফিসিয়ে বলল,
“আরেকটু পরে বসি। ওরা খেয়ে নিক।”
বাহার ভাই মেনে নিলের। টুইংকেলের থালায় বেগুন ভাজা দিতে নিলেই মেয়েটা হাত দিয়ে থালা ঢাকল। মৃদু কণ্ঠে বলল, “আমি বেগুন খাই না। এলার্জি আছে।”

বাহার ভাই বেগুনটা সরিয়ে নিলেন। হেসে বললেন, “সরি, মিস। জানতাম না তো। আপনাকে আলু ভেজে দিই?”
টুইংকেল আরও আন্তরিক ভঙ্গিতে বলল, “একদমই না। ইলিশ মাছ আমার প্রিয়। এটা দিয়ে খেয়ে নিতে পারব।”
“আপনার বাংলা ভাষা বলার স্কিল ভীষণ স্মুথ। আপনার বাবা-মা কেউ কি বাঙালি?”
“হ্যাঁ। বাবা তো বাঙালি। চাঁদনী আপুনির আব্বুর বন্ধুই তো আমার বাবা।”
“ওহ্ নাইস। আচ্ছা খেয়ে দেখুন আমাদের চিত্রা কেমন রেঁধেছে। নিশ্চয় মন্দ হবে না। চিত্রার হাতে কখনো কোনো কিছুই মন্দ হয় না। সে রান্না হোক কিংবা কোনো মানুষের এক জীবন।”
কথা শেষ করে মানুষটা বুক ভরে শ্বাস নিলেন। যেন চিত্রার জন্য গর্বে তার বুক ভরে যাচ্ছে।
বেগুন ভাজার থালাটা রেখেই মানুষটা হাত ধুয়ে এলেন। হাতে করে নিয়ে এলেন একটি গামছাও। এসে চিত্রার ভেজা চুলগুলো পেঁচিয়ে দিতে লাগলেন গামছা দিয়ে। বললেন,

“কীভাবে যে চুল মুছো! চুল তো পুরো ভিজে। টুপটুপ করে পানি পড়ছে। ঠান্ডা লেগে যাবে তো নাকি?”
বলতে বলতে অপটু হাতে চুলে ঠিকঠাক প্যাঁচ দেওয়ার চেষ্টা করছিলেন যদিও তা পারছিলেন না। তবুও কী নিখুঁত যত্ন! প্যাঁচে খুঁত থাকলেও যত্নে কোনো খাঁদ ছিলো না।
চিত্রা সরে যেতে নিলো। সকলের সামনে বাহার ভাইয়ের এই যত্ন তাকে লজ্জায় ফেলছিল। ওদিকে চাঁদ আপাটাও মিটমিটিয়ে হাসছিলো কেমন। চিত্রা চোখ ঘুরিয়ে তাকালো বাহার ভাইয়ের দিকে। ইশারায় নিজের ভাইজানকে দেখালো।

বাহার ভাই সে ইশারাকে মোটেও গা করলেন না। উল্টো চোখ দিয়ে বুঝালেন কিছু হবে না।
তুহিন মাথা নামিয়ে এক মনে খেতে লাগলো। ভাব এমন যে, সে এখানের কিচ্ছুটিই দেখছে না। পুরে পৃথিবীর কোনো কিছু বর্তমানে তার চোখে পড়ছে না। সে পৃথিবীর বাহিরের মানুষ।
সকলের খাবার শেষ হতেই যে যার মতো গিয়ে বসে বনফুলের ঘরে। আড্ডা বসেছে। টুইংকেল যেহেতু নতুন অতিথি তাই তাকে নিয়ে রাজ্যের গল্পসল্প শুরু হয়েছে ভেতরের ঘরে। বাহিরের টেবিলে খেতে বসেছে বাহার চিত্রা। মনে হচ্ছে যেন পাখির বাসার মতন ওদের সাজানো সংসার। এতক্ষণ অতিথি আপ্যায়ন শেষ করে এবার সংসারের কর্তা-কত্রী একসাথে খাবে। খেতে খেতে হিসেব করবে সংসারের। কোথায়, কী প্রয়োজন তা আলোচনা করবে!
চিত্রা মনে মনে হাসে এসব ভেবে। লজ্জাও পায় সামান্য। মনটা বড্ড বেশরম হয়েছে। হুটহাট কীসব ভেবে ভেবে যেন চিত্রাকে লজ্জা দেয়। এই লজ্জা এমন নাজুক মেয়েটার সহ্য হয় না।
বাহার ভাই পাশটাতেই তৃপ্তি নিয়ে খিচুড়ি খাচ্ছেন। চিত্রাকে হা করে তাকিয়ে থাকতে দেখে মাথা উঁচিয়ে ইশারা করলেন, “কিছু বলবে?”

চিত্রা ডানে-বামে মাথা নাড়াল। জবাব দিল, “না।”
বাহার ভাই আবার খাওয়ায় নজর দিলেন। চিত্রা ব্যস্ত হলো মাছ বাছতে। ইলিশ মাছের এত কাটা যে সে বাছতে পারে না। মা বেছে দেন। আজ নিজেই হয়রান হচ্ছে তা বাছতে। যখন দেখলো অপারগ সে তখন মাছটা কিনারায় রেখে দিলো। বেগুন ভাজা দিয়েই খিচুড়ির এক লোকমা মুখে দিলো। অপর লোকমা মুখে দেওয়ার আগেই দেখলো নিজের প্লেট থেকে অল্প অল্প মাছ বেছে তার প্লেটে দিচ্ছেন মানুষটা। চিত্রা অবাক হলো। মুগ্ধতার অপার মহিমায় ভরে গেলো আঙিনা। বিস্ময়ের শালুক ফুটলো প্রেমের বাগানে।
মানুষটা থালার দিকে তাকিয়েই তাড়া দিলেন, “আমাকে পরেও তো দেখা যাবে। চলে যাচ্ছি না। এখানেই আছি। থাকব। আপাতত খেয়ে নাও। বেলা শেষ হলো বলে।”
চিত্রার কী যে ভীষণ সুখ হলো! তার মনে হলো সত্যিই সে সংসারে আছে। তার আর বাহার ভাইয়ের প্রেমময় সংসারে। চারপাশে অলি, প্রজাপতির গুঞ্জন যেন ছড়িয়ে গিয়েছে। বৃষ্টির শেষ কালের গা কাঁপানো বাতাসে তার শরীরটা কেঁপে কেঁপে উঠল। জীবনটাকে হঠাৎই ভার শূন্য মনে হলো। নিশি রাতের স্বপ্নের মতন সুন্দর মনে হলো।
“শীত করছে? ফ্যানটা বন্ধ করে দিই?”

কী আলগোছে লোকটা সব খেয়াল করছে! এমনকি চিত্রার শরীরের মৃদু কম্পনও অগোচর হলো না। চিত্রা মাথা নাড়ালো আবার। কোনো কথাই মুখ ফুটে বের হলো না তার। কীভাবে বের হবে? গলায় যে কান্নারা জমে গিয়েছে। সুখের এই দিনগুলোতেও তার কান্না পাচ্ছে। কী বোকা মন! সুখটাও এর কাছে অকল্পনীয় লাগছে।
বাহার ভাই নীরব চিত্রার দিকে মুখ উঠিয়ে চাইলেন। চিত্রার চোখের টলমলে অশ্রু অদেখা করার মতন নয়। একদম টল-টলে। যে কেউ দেখবে। প্রেমিক বলে হয়তো মানুষটা বেশিই দেখলেন। বা’হাতের উল্টো পিঠে সেই জলগুলে মুছে দিলেন লোকটা। নিজের প্লেট থেকে খিচুড়ি এক লোকমা তুললে ধরলেন চিত্রার ঠোঁটের কাছটায়। নীরবে, নিভৃতে তাকিয়েই ধীর স্বরে বললেন,
“অনেক কষ্ট দিয়েছি তা অস্বীকার করার জো নেই। তাই বলে সুখের দিনেও কেঁদে কেঁদে আমাকে অনুতপ্ত করাবে? জানো না, তুমি কাঁদলে প্রেমের ঋতু বসন্তও রং হারা হয়? কেঁদো না। আছি তো আমি। এই যে তোমার পাশটায়। আর কখনো ছেড়ে যাচ্ছি না। যাবো না। যদি যাই, তবে তুমি আমায় শাস্তি দিও। মেরে কেটে ফেলে দিও। তবুও কেঁদো না। আমার সহ্য হয় না।”

চিত্রা খিচুড়ি মুখে নিলো। চোখ দিয়ে অনর্গল জল বেরিয়ে এলো। এমনও সুখের দিন তার আবার ফেরত আসবে সে কি তা কখনোই ভেবেছিলো? ভেবেছিলো কি, তাকে মায়ের পর কেউ এমন করে যত্ন সহকারে খাইয়ে দিবে?
টুইংকেল পানি খেতে এসেছিলো। কিন্তু এই যুগলের একান্তই ব্যক্তিগত বোঝাপড়ার মাঝে কাঁটা হয়ে ফুটতে চায়নি বলে আর এলো না টেবিলটার কাছে। দূরে দাঁড়িয়ে থেকেই দেখলো দৃশ্যটি। যদিও এটি অন্যায় তবে তার ভীষণ ভালো লাগলো এই অন্যায় কাজটি করতে। পৃথিবীতে সচারাচর এত সুন্দর দৃশ্য দেখা যায় না। কোনো পুরুষ যত্ন করে কোনো নারীর চোখ মুছিয়ে দিচ্ছে কিংবা মুখে তুলে খাইয়ে দিচ্ছে এমন দৃশ্য পৃথিবীতে দুর্লোভ। ভালোবাসার এমন দামী বহিঃপ্রকাশ সবাই করতে পারে না।

পৃথিবীতে যতবার বৃষ্টি হবে, ততবার এই খিচুড়ির প্লেটে জমা প্রেম প্রেমিক-প্রেমিকাদের আলিঙ্গনে, যত্নে বেঁচে উঠবো। সবাই জানবে, বৃষ্টি প্রেমের মৌসুম। বৃষ্টি প্রেম নিয়ে আসে তার দাপুটে, ঝড়ের বাতাসে। বৃষ্টি ভালোবাসতে শেখায়। প্রেমিকার প্লেটে বৃষ্টি প্রেম জমায়।
লোকটার যত্ন দেখে টুইংকেল আরও দুর্বল হলো। আর বিহ্বল হলো। ভেতর ভেতর মনটা বিভ্রান্ত করল তাকে। ঈর্ষান্বিতা মন ক্ষণে ক্ষণে বলল— এই প্রেমিক চিত্রার হলো কেন? তার এমন কেউ হলো না কেন? সৌভাগ্য কেবল তার বেলাতেই কি মুখ লুকিয়ে থাকে?

যতনে রাখিলাম যাতনা পর্ব ৩১

অথচ সে তো আদতে জানেই না, চিত্রা এই প্রেমিকের জন্য কত দিন নির্বাসিত জীবন কাটিয়েছে। কত বসন্তকে ঠেলেছে পা দিয়ে। কত রাত ঘুমহীন কাটিয়েছে। কতদিন শ্বাস নিয়েছে হসপিটালের বিছানায় শুয়ে, কৃত্রিম অক্সিজেনের মাধ্যমে। চিত্রার এত ত্যাগ পৃথিবীর কেউ-ই মূলত দেখবে না। পৃথিবী কষ্ট দেখতে চায় না। পৃথিবী কেবল সুখ দেখে। এবং সেই সুখ পাওয়ার জন্য হাহাকার করে। অথচ সুখের পেছনের গল্পগুলো পৃথিবীর অজানা, অকল্পনীয়ই থাকে।

যতনে রাখিলাম যাতনা পর্ব ৩৩