শহর জুড়ে সন্ধ্যা নামুক শেষ পর্ব 

শহর জুড়ে সন্ধ্যা নামুক শেষ পর্ব 
তাসনিম জাহান রিয়া

সময়ের স্রোতে সবাই গা ভাসিয়ে দিয়েছে। প্রায় সবাই নিজ নিজ লাইফ নিয়ে ব্যস্ত। শ্রেয়সী অনুপমের সাথে চুটিয়ে সংসার করছে আর তন্ময়, অনন্যা নিজেদের যোগ্যতা প্রমাণ করতে ব্যস্ত। প্রিয়ন্তি আইএলস করছে দেশের বাইরে চলে যাওয়ার সর্বোচ্চ চেষ্টা করছে। মুহিব, ইভা আর নিতু, ফুয়াদ চুটিয়ে প্রেম করছে। মিহান আগের মতোই ছন্নছাড়া। আজকে ওদের দ্বিতীয় বর্ষের প্রথম ক্লাস। ক্লাস শেষ করেই সবাই ক্যান্টিনে বসে। তুমুল আড্ডা চলছে তাদের আর আড্ডার বিষয়বস্তু হচ্ছে শ্রেয়সী আর অনুপমের বিয়ে। আগে তো কাজি অফিসে গিয়ে কোনো রকম বিয়ে হয়েছিলো এখন বড় করে অনুষ্ঠান করা হবে। এক সপ্তাহ পরে ওদের বিয়ের প্রোগ্রাম আর এই এক সপ্তাহ ধরে চলবে ওদের বিয়ের বিভিন্ন ফাংসন। মিহান হুট করেই গুনগুনিয়ে গেয়ে ওঠে। তালে তাল মিলায় সবাই।

আমার ফটোকপি করা শিট
আমার বাসের লাস্ট সিট
আমার স্ক্র্যাচ পড়ে যাওয়া চশমার কাচ
সায়ানোফাইটিক ইট।
আমার চিনি বেশি দেয়া চা
আমার ফোনে যান্ত্রিক মা
আমার পকেট বাঁচানো ডিম ভাজা ভাত
মুখে হাসি, বুকে ঘা।
আমার অমনোযোগী ক্লাসরুম
আমার মগজে নষ্ট ধুম
আমার বাহিরে বুদ্ধ, ভিতরে হিটলার
লাশের মোড়কে ঘুম।
আমার প্রেমে ডুবে থাকা নারী
আমার বুমেরাং আহাজারি
আমার ফেলে আসা তাজা কাজলের চোখ
কবিতার মহামারী।
আমার বর্ষার ভাঙা ছাতা
আমার পেইজ শেষ হওয়া খাতা
আমার সিজিপিএ লোভে রাতজাগা পড়া
শিমুলের ঝরা পাতা।
আমার সাধুর আসরে গান
আমার জোড়াতালি দেয়া প্রাণ
আমার রাজপথে ভাঙা স্লোগানের স্বর
মিছিলের অভিযান।
আমার কলমের কালি শেষ
আমার স্বজাতি, আমার দেশ
আমার বুদ্ধিজীবীতার ভাঙা রেকর্ডার
অস্থির, জম্পেশ।
আমার পিংক ফ্লয়েডের সলো
আমার মেঘদলও খুব ভালো
আমার আর্টসেল, ব্ল্যাক, শিরোনামহীন —
তবুও ঘরে অচেনা আলো।
আমার ঘুম না আসা রাত
আমার নিঃশব্দ অভিশাপ
আমার কফির কাপের তলায় রয়ে যাওয়া
অপূর্ণ ভালোবাসার চাপ।
আমার বন্ধুরা গেছে দূরে
কারো কেউ নেই আর ফিরে
আমার আয়নায় জীর্ণ এক মুখ
ভবিষ্যতের ভাঙা সীমানা চুরে।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

একসাথে থেমে যায় সপ্তসুর। আস্তে ধীরে আশেপাশের করতালির আওয়াজে মিলিয়ে যায় গিটারের টুংটাং আওয়াজ। সবার মুখেই স্নিগ্ধ হাসি। অনেকদিন পর আড্ডা দেওয়া আর গান গাওয়ার ফলে সবার মনের মলিনতা দুর হয়ে গেছে। এই গান গাওয়াই যে তাদের শেষ গান গাওয়া এটা কী তারা ভেবেছিল। আর কখনো একসাথে আড্ডা দেওয়া হবে না গান গাওয়া হবে না এটা জানলে হয়তো কেউ কাউকে আর ছাড়তোই না।

আজকে রাতেই বের হবে সবাই। শ্রেয়সীর বন্ধুরা ঠিক করেছে তারা সবাই একসাথে যাবে। কিন্তু মাঝখানে বেগড়া দিলেন হেলাল সরকার। উনি শ্রেয়সীর সাথে যাবেন। সবার মেজাজ তো সপ্তমে বিশেষ করে মিহানের। মিহান দুই চারটা গালিও ছুড়ে দিয়েছে হেলাল সরকারের উদ্দেশ্যে। পরে শ্রেয়সীর চোখ রাঙানোতে মিহান ছোট বাচ্চাদের মতো গাল ফুলিয়ে বসে আছে। সে কতো প্লেন করে রেখেছিলো। দুষ্টু দুষ্টু গান ছেড়ে সারা রাস্তা নেচে-কুঁদে যাবে। মিহান অনুপমকে কল দেয়। সবাই মিলে হেলাল সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে। অনুপমকে থ্রেটও দিয়েছে তাদের যদি হেলাল সরকারের সাথে যেতে হয় তাহলে তারা বিয়েতেই যাবে না। অবশেষে হেলাল সরকার হার মানলেন অনুপমের কাছে। অনুপম বলেছে তার গাড়ি করে সবাইকে নিয়ে যাবে। সবার আগে অনুপমরা রওনা দেয়। কিছু পথ যেতেই তন্ময় বলে,

ঐ অনুপম ভাই এই গান ভাল্লাগে না। রোমান্টিক গানে আমাদের এলার্জি।
মিহান মাঝখান থেকে বলে উঠে, আমরা রোমান্টিকের ওপর হালকার ওপর ঝাপসা অশ্লীল গান শুনি।
অনুপম জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকায়। শ্রেয়সী ধমকে ওঠে। সে তো জানে তার বন্ধুরা কী পরিমাণ বান্দর প্রজাতির। কিন্তু শ্রেয়সীকে উল্টো ধমক দিয়ে নিতু।
এই বেডি তুই চুপ থাক। তন্ময় গানটা প্লে করে দে আমাদের মোস্ট ফেবারিট গান শুধুমাত্র অনুপম ভাই আর শ্রেয়সীকে ডেডিকেট করে।
তন্ময় প্লে করে দেয়। বেজে ওঠে হুমায়ুন ফরিদির সেই জনপ্রিয় গান।
আমি নষ্ট মনে নষ্ট চোখে দেখি তোমারে,
আজ আমার কী হয়েছে বুঝাই কেমনে।

অনুপম স্তব্ধ হয়ে তাকায় শ্রেয়সীর দিকে। ও কল্পনাও করে নাই এমন একটা গান প্লে করতে পারে। ওরা সবাই নাহয় বন্ধু অনুপম তো ওদের সিনিয়র তার তো অস্বস্তি হবেই। অনুপম বুঝতে পারলো নিজের বিপদ সে নিজেই ডেকে এনেছে এদের সাথে নিয়ে এসে। সারা রাস্তা এই অত্যাচার সহ্য করতে হবে। ওদের বন্ধুদের বিয়ে হলে ওরাও তো ঐ যে ললিতা নিয়ে এটা গান আছে ঐটা গাইতো। এরা যদি এটা প্লে করে অনুপমের গাড়ির জানালা দিয়ে পালানো ছাড়া উপায় থাকবে না।
মোটামুটি রাতে তারা বাসায় পৌছায়। শ্রেয়সীদের পৌছে দিয়ে আবার অনুপম নিজের বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। শ্রেয়সীদের বাড়িতে এসেই যে যেখানে পেরেছে সে সেখানেই ছড়িয়ে ছিটিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। আসার সময় রাস্তায় খেয়ে এসেছে তাই খাওয়া নিয়ে কোনো ঝামেলা নেই। পরেরদিন সকালে ব্রাশ করতে করতে ছেলেরা পুকুর ঘাটে গিয়ে পুকুর দেখেই ঝাপিয়ে পড়ে। ছেলেদের ঝাঁপাঝাপির শব্দে মেয়েরাও এগিয়ে আসে। সবাই পুকুর পাড় থেকে দাঁড়িয়ে পুকুরে লাফ দেয়। কিন্তু বিপত্তি বাজিয়ে দেয় ইভা। ও সাতার পারে না। লাফ দিয়ে ডুবে যেতে শুরু করলেই মুহিব এসে টেনে তুলে। তন্ময় ওদের খোঁচা মেরে বলে,
প্রেমের মরা জলে ডুবে না।

দীর্ঘ দুই ঘন্টা ঝাঁপাঝাপি করার পর হেলাল সরকারের ধমকে সবাই উঠে আসে। দীর্ঘক্ষণ পানিতে থাকায় সবার চোখ লাল হয়ে গেছে। পানি খাওয়ায় ইভার অবস্থা বেশি খারাপ। মিহান ইভার কাঁধে ধাক্কা দিয়ে বলে,
চোখ লাল কীসে?
পিরিতের বিষে নাকি অন্তরের দোষে।
কেটে গেছে ছয়দিন। শ্রেয়সীর মেহেন্দি অনুষ্ঠান, রং খেলা সব অনুষ্ঠান শেষ। কিন্তু শ্রেয়সীর বন্ধুমহল বুঝতে পারেনি আসল রং খেলা এখনো বাকি। আজকে শ্রেয়সীর গায়ে হলুদ। শহরে যেমন গায়ে হলুদের অনুষ্ঠানে অল্প অল্প হলুদ লাগিয়ে যায় গ্রামে তেমন হয় না। এখানে সাত-আট জন মহিলা মিলে হলুদ দিয়ে চুবিয়ে গোসল করায়। তারপর রাতের বেলা পাড়াপ্রতিবেশি সবাইকে দাওয়াত করে অনুষ্ঠান পালন করা হয়। শ্রেয়সীকে হলুদ রঙের শাড়ি পড়িয়ে পিড়িতে বসিয়েছে। তারপর শুরু হয় শ্রেয়সীকে হলুদে চুবানো। একেক জন ঘষে ঘষে শ্রেয়সীকে গোসল করাচ্ছে। দূর থেকে তন্ময়রা সবাই মজা নিচ্ছে। শ্রেয়সী দাঁত কটমট করে তাকায় আবার মনেমনে হাসে ও তো জানে ওদের জন্য কী অপেক্ষা করছে। আচমকাই ওদের ওপর রং গুলানো পানি ছুঁড়ে মারে বালতি ভরে। ওরা কিছু বুঝ ওঠার আগেই ওদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে শ্রেয়সীর কাজিন মহল। সবাইকে রং দিয়ে ভুত বানিয়ে দেয়। নিতু মাটিতে বসেই হাত-পা ছুঁড়ে কাঁদা শুরু করে দিয়েছে ওকে কালকে বাজে দেখতে লাগবে। সবাই গোসল শেষে শ্রেয়সীর সাথে এক দফা ঝগড়া করে নিয়েছে আগে থেকে সতর্ক না করার কারণে। গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান হয় মাঝ রাত পর্যন্ত।

পরেরদিন সকালে শুরু হয় আইভুড়ো ভাত খাওয়ার অনুষ্ঠান। শ্রেয়সীকে একটা বড় থালায় খাবার দেওয়া হয় আর এই থালা ঘিরে বসে সব আত্নীয়-স্বজন। এরপর কাড়াকাড়ি করে খাওয়া শুরু হয়। কেউ বেশি পাচ্ছে কেউ পাচ্ছে না তবে সবাই ব্যাপক আনন্দ করে। শ্রেয়সীকে সাজানো হয়। জামাই বাড়ির লোক আসে। গেইটের টাকা নিয়ে, হাত ধোয়ানোর টাকা নিয়ে, জুতা চুরি নিয়ে কয়েক দফা ঝগড়া হয়। অতঃপর আসে বিদায়ের সময়। এই মুহুর্তটাই সব থেকে কষ্টের। শ্রেয়সী কাঁদতে কাঁদতে জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। অনুপম কোলে করে শ্রেয়সীকে গাড়িতে তুলে। জ্ঞান ফিরার পর শ্রেয়সী আবার কাঁদতে শুরু করে। অনুপম মজা করে বলে,
কী জ্ঞান হারানো মেয়ে তোমার আর জ্ঞান হারানোর অভ্যাস গেলো না।

শ্রেয়সী কান্নার মাঝেও এসে ফেলে। অনুপম শ্রেয়সীর কপালে চুমু খায়। অনুপম চুমু খাওয়ার সাথে সাথেই অনুপমের কাজিন মহল হই হই করে ওঠে। ড্রাইভার একটু অন্য মনস্ক হয়ে পড়ে। গ্রামের অন্ধকার রাস্তা ভালো করে দেখা যায় না আর এই রাস্তায় ট্রাক আসতে পারে ড্রাইভার হয়তো চিন্তা করতে পারেনি। ট্রাক আর মাইক্রো সংঘর্ষ হলো। গোটা কয়েক মানুষের চিৎকার তারপর সব নিস্তব্ধ। ট্রাক একদম পিষে দিয়ে গেছে। অনুপমের কপোল গড়িয়ে রক্ত পড়ে শ্রেয়সীর মেহেদী রাঙানো হাতে। যেই হাতে শতাধিক চুমু খাওয়ার কথা ছিল অনুপমের সেই হাত অনুপমের রক্ত রাঙানো। অনুপমের তো নিজের নামের অক্ষর খোঁজা হলো না শ্রেয়সীর হাতে। তাদের তো একসাথে টোনাটুনির সংসার করা হলো না, একসাথে সমুদ্র দেখা হলো না, একসাথে পাহাড় দেখা হলো না।

কয়েক ঘন্টার ব্যবধানে মেয়ে আর মেয়ের জামাইয়ের মৃত্যুর খবরে পুরো বাড়ি স্তব্ধ। নিতু অসুস্থ হয়ে যাওয়ায় ওকে একা ফেলে কেউ আর শ্রেয়সীর সাথে যায়নি। একেবারে বউভাতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। ইতিমধ্যে শ্রেয়সীর বাবা-মা জ্ঞান হারিয়েছে। নাহিন এখনো জানে না বোনের মৃত্যুর খবর। নাহিন গিয়েছে শহরের উদ্দেশ্য বোনের শ্বশুর বাড়ির জন্য মিষ্ট, ফল-মূল আনতে। ও তো জানতে পারেনি ওর বোনের শ্বশুরবাড়ি মিষ্টি না সাদা কাফনের কাপড় নিয়ে যেতে হবে।

কেটে গেছে কয়েকটা বছর। সবাই নিজ নিজ জীবনে এগিয়ে গিয়েছে শুধু এগিয়ে যেতে পারেনি মিহান। ওতো এখনো আটকে আছে মেঘলাতে। নিতুকে ফুয়াদ নিজের কাছে নিয়ে গেছে। নিতু আর ফুয়াদ চুটিয়ে সংসার করছে। তন্ময় আর অন্যন্যা বরিশাল থাকে তন্ময়ের চাকরির সূত্রে। প্রিয়ন্তি স্কলারশিপ নিয়ে বিদেশ যাওয়ার পর আর দেশে ফেরেনি। ইভা আর মুহিবেরও বিয়ে হয়েছে। তবে এর জন্য মুহিবকে অনেক কাঠ-খড় পুড়াতে হয়েছে। মিহান বসে আছে তাদের বন্ধুমহলের প্রিয় চায়ের দোকানে। প্রতিদিন সন্ধ্যায় আসে এখানে। কিন্তু আগের মতো আড্ডা হয় না, গানের আসর জমে ওঠে না। মিহান চায়ের কাপটা রেখে ওঠে দাঁড়ায় আস্তে আস্তে মিলিয়ে যায় অন্ধকারে ভেসে আসে কবিতার কিছু লাইন।

শহর জুড়ে সন্ধ্যা নামুক পর্ব ৪৩

শহর জুড়ে সন্ধ্যা নামুক,
বন্ধুদের আবার আড্ডা জমুক।
চায়ের কাপে ধোঁয়া উড়ুক,
হাসির মাঝে গল্প গড়ুক।
বাঁধনহারা কথা চলুক,
চেনা রাস্তায় স্মৃতির ঢেউ তুলুক।
ভুলে থাকা সুরটা বাজুক,
বন্ধুত্বের গান নতুন করে সাজুক।

সমাপ্ত