প্রণয়ের সন্ধিক্ষণে সিজন ২ পর্ব ৬৩
আদ্রিতা নিশি
ঘড়ির কাটায় তিনটা ছুঁই ছুঁই। কাজি সাহেব এসেছেন কিছুক্ষণ পূর্বে। তিনি রেজিস্ট্রির জন্য যাবতীয় কাগজপত্র ও বর-কনের কিছু তথ্য নিচ্ছেন। সেই কাজে সহায়তা আরশাদ সাহেব কাজির পাশে বসে সহায়তা করছেন। প্রায় দশ মিনিট পর কার্য সম্পাদন করলেন কাজি সাহেব। মিনিট পাঁচেকের মধ্যে আকদের আনুষ্ঠানিকতা শুরু হবে। উপস্থিত সবাই অপেক্ষারত সেই শুভক্ষণের।
রাহাকে বারবার ডাকছে তার পাশে এসে বসার জন্য। কিন্তু সে বান্ধবীর কাছে না গিয়ে ঠাঁই হয়ে বসে রয়। সেথায় বসে থাকার কারণ সম্পর্কে অবগত সে। কারণ মূলত পাশে বসা নেভি ব্লু পাঞ্জাবী পরিহিত মানুষটা। সে একটু পর পর আড়চোখে তাকিয়ে ইরফানের ভাবভঙ্গি অবলোকন করছে। কেন যেন মনে হলো এ মানুষটাকে গুরুগম্ভীর ভাবে একদম মানায় না। অরিন আপুর বিয়েতে যেমন হাস্যজ্জ্বল, মিশুক আচরণ লক্ষ্য করেছিল তেমনটা মানায়। সে আনমনা হাসল। হঠাৎ মনে হলো তার পাশে বসা মানুষটাকে এ মুহুর্তে স্নিগ্ধ ও সুদর্শন লাগছে। গম্ভীর মুখাবয়বে যদি একটু হাসি ফুটতো তাহলে মারাত্মক লাগতো। তার মন গহীনে অদ্ভুত অনুভূতির সমাহার। এই প্রথম কারো ব্যক্তিত্ব তাকে কৌতূহলী ও আকর্ষিত করল। পূর্বে এমন অনুভূতির সাথে পরিচিত হয়নি সে। ইরফান চোয়াল শক্ত করে নিশ্চুপ ভঙ্গিমায় বসে আছে অথচ তার মনটা কেমন অশান্ত। চোখের সামনে নববধূ রুপে অরিত্রিকা। মেয়েটিকে অমায়িক সুন্দর লাগছে। সৌন্দর্য যেন এক কথায় ঠিকরে পড়ছে। মেয়েটা তো তার বউ হওয়ার কথা ছিল। সারহানের জায়গায় তার বসার কথা ছিল। কিন্তু ভাগ্যের উত্থানে সবকিছু এলোমেলো হয়ে গেল। সে তার দৃষ্টি সংযত করে মেঝেতে নিবদ্ধ করল। মনকে শান্ত করতে জোরে জোরে শ্বাস ফেলল। মনকে বোঝানোর চেষ্টা করল, অরিত্রিকা তার মামাতো ভাইয়ের হবু বউ।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
রাহা ইরফানের অদ্ভুত আচরণ লক্ষ্য করল। সে খানিকটা ভয় পেয়ে গেল। বিচলিত হয়ে শুধালো ;
“জোরে জোরে নিশ্বাস নিচ্ছেন কেনো? শরীর ঠিক আছে আপনার? ”
ইরফান পূর্বে খেয়াল করেছিল রাহা তার পাশে বসেছে অথচ এমন ভাব করছিল যেন দেখেনি।সে শীতল চাহনিতে তাকাল মেয়েটার উদ্বিগ্ন মুখশ্রীর দিকে। মনটা থিতিয়ে গেল আচানক। আশ্বস্ত করে বলল;
“আমি ঠিক আছি।”
রাহার উদ্বিগ্নভাব কমলো না। সন্দিহান কন্ঠে বলল;
“আপনি সত্যি ঠিক আছেন?”
ইরফান হতবাক হয়ে গেল। এই অচেনা মেয়েটা তাকে নিয়ে এতোটা চিন্তিত কেন? পূর্বে তো এহেন আচরণ করেনি। পরক্ষণেই সেই ভাবনা স্থায়ীত্ব পেল না মস্তিষ্কে। সে নিঃশব্দে অদ্ভুত হাসল। হাসি বজায় রেখে বলল;
“আমার আবার কি হবে? এই তো দিব্যি সুস্থ আছি, চলছি, ফিরছি।”
“আমার কেন যেন মনে হচ্ছে আপনি ঠিক নেই। তবুও আমার সামনে স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করছেন?”
“বাহ! আজকাল আমার ঠিক থাকা না থাকার খেয়াল রাখছো? হঠাৎ আমার জন্য এতো চিন্তা করছো কেন?”
ইরফান ভ্রু নাচিয়ে সন্দিগ্ধ কন্ঠে জিজ্ঞেস করল। রাহা থতমত খেয়ে গেল। দৃষ্টিনত করে আমতা আমতা করে বলল;
“এমনি।”
ইরফানের কপাল কুঁচকে এলো। গাম্ভীর্যভাব এঁটে বলল;
“আমার জানা মতে, অপরিচিত কেউ কোনো স্বার্থ ছাড়া কারো জন্য চিন্তা করে না। এবার সত্যি করে বলো আমাকে নিয়ে চিন্তা করছো কেন?”
“আমি আপনার অপরিচিত নই আর আমার কোনো স্বার্থ নেই। আপনাকে নিয়ে চিন্তা করছি তার কারণ আপনাকে নিয়ে কেউ চিন্তা করে না তাই।”
“আমাকে নিয়ে তোমাকে চিন্তা করতে হবে না মেয়ে।তুমি বাদেও আমাকে নিয়ে চিন্তা ভাবনা করার মানুষ আছে।”
ইরফান ভরাট কন্ঠে বলল। তার রাহার ভাবমূর্তি একদম সুবিধার লাগল না। রাহা মুখ গোমরা করে বলল;
“অতীত ভুলে বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবুন। তাহলে আর আপনাকে নিয়ে চিন্তা করব না।”
“আমাকে উপদেশ দিচ্ছো?”
“বলতে পারেন তাই।”
“এতটুকু একটা মেয়ে হয়ে আমায় উপদেশ দেওয়ার মতো দুঃসাহস করছো?আশ্চর্য!”
“আমার বয়স ঊনিশ বছর দশ মাস তেরোদিন। আমাকে ছোট বলবেন না।”
রাহা গমগমে কন্ঠে বলল। ইরফান অতিব আশ্চর্য হলো। এই মেয়েকে সে এতোদিন চুপচাপ শান্ত স্বভাবের ভেবে এসেছে অথচ তার ভাবনায় পানি ফেলে ঝাঁসির রানি বের হলো। উক্ত কথাটি আওড়াল পুনরায়। পরক্ষণে ওষ্ঠকোণে মৃদু হাসির রেখা ফুটে উঠল;
“বিয়ের বয়স পেরিয়ে যাচ্ছে। দ্রুত বিয়ে করে নাও আর হাসবেন্ডকে নিয়ে চিন্তা ভাবনা করো।”
রাহা ফটফট করে বলল;
“অরিত্রিকার বিয়ের পর আব্বুকে বলব ছেলে খুঁজতে। শুভ কাজে দেরী করা একদম উচিত নয়। শুনুন, আপনিও দ্রুত বিয়ে করুন। বিয়ে করলে আমার মতো ভদ্র, নম্র, বাঁচাল প্রকৃতির মেয়েকে করবেন। ”
কথাটা এক নাগারে বলে ক্ষ্রান্ত হলো। পরক্ষণে মনে পড়ল কি বলে ফেলেছে। সে তৎক্ষনাৎ জিভ কাটলো। ইরফান হতবিহ্বল হয়ে গেল। এই মেয়ে কি ইন্ডাইরেক্টলি তাকে বিয়ের কথা বলছে? এই ভেবে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমলো কপালে। মুহুর্তে মনে হলো মেয়েটার থেকে দ্রুত বজায় রাখা শ্রেয়। সে হম্বিতম্বি করে চেয়ার ছেড়ে উঠতে গেলে রাহার কন্ঠস্বর শুনে নির্বাক হয়ে সেথায় বসল ;
“আপনি আমাকে ভয় পেয়ে পালাচ্ছেন ভাইয়া? ভয় পাবার কোনো দরকার নেই। আমি আমার মতো স্বভাবের মেয়েকে বিয়ে করতে বলেছি। আমার কথা বলিনি। ওসব ভুল ভাবনা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে চুপচাপ বসুন।”
রাহা ওষ্ঠেকোণে চমৎকার হাসি ফুটিয়ে চেয়ে রইল ইরফানের দিকে। ইরফানের মুখে তখনও বিস্ময়ের ছাপ। চোখে একরাশ অবিশ্বাস আর ক্ষণিকের অসহায়তা। রাহা এই প্রথম দেখল, সবসময় নিজেকে সংযত রেখে চলা মানুষটি আজ নিজেই নিজের আবরণ ভেঙে দাঁড়িয়ে গেছে এক প্রান্তিক অনুভূতির দ্বারপ্রান্তে।সে বলল না কিছুই, শুধু চোখে চোখ রাখল। কিন্তু নীরবতার মাঝেই তার মনের ভাষা যেন স্পষ্ট হয়ে উঠল। ইরফানকে সে বুঝিয়ে দিতে চায় এই মুহূর্তটার সম্মুখীন হওয়া খুব প্রয়োজনীয়। অতীতকে পাশ কাটিয়ে নয় বরং তার মুখোমুখি হয়েই সামনে এগোতে হয়। নয়তো নতুন জীবন শুরু করা শুধুই এক বিভ্রম হয়ে থেকে যাবে। ইরফান নিজ চোখে দেখুক অরিত্রিকা আর সারহানের আকদ। যে দৃশ্য একসময় হৃদয়ের গভীরে ক্ষ*ত এঁকে দিয়েছিল আজ সেই ক্ষতের দগদগে মুখোমুখি হয়ে সে শিখে নিক।এই দেখাটাই হবে মানুষটার মুক্তির প্রথম ধাপ। রাহা চায়, ইরফান সেই মুহূর্তের সমস্ত কষ্ট নিজের ভেতর টেনে নিয়ে, এক দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে সব পেছনে ফেলে দিক।উনি আবার নিজেকে নিয়ে বাঁচতে শেখে ভবিষ্যতের দিকে এক নতুন পদক্ষেপ রাখে।যেখানে অতীত কেবল স্মৃতি আর নতুন জীবন তারই অপেক্ষায়।
কাজি সাহেব কাগজপত্র ঠিকঠাক করলেন। সারহান ও অরিত্রিকা পূর্বের ন্যায় বসে আছে। আবির বন্ধুর ভাবসাব দেখে অবাক হলো। সারহানের ভদ্রস্থতা তার হজম হলো না। এ মুহুর্তে সবার সামনে একটু বেশীই ভদ্র, নম্র মনে হচ্ছে। আরশাদ সাহেব আসনের স্থান থেকে চলে এসে সামনে রাখা ফাঁকা একটা চেয়ারে বসলেন। সাদাত একপাশে দাঁড়িয়ে আছে। তার দৃষ্টি জোড়া নিবদ্ধ ইশরার দিকে। মেয়েটি মিষ্টি রঙের ড্রেসে অসাধারণ লাগছে। গুলুমুলু টমেটোটার থেকে চোখ সরানো দায় হয়ে যাচ্ছে। সে বেসামাল হয়ে যায়। নিজের অনুভূতি দমন করা মুশকিল হয়ে উঠে। ইচ্ছে করে এখুনি মনের মাঝে চলমান অনুভূতির কথা উগ্রে দিতে। সে ঘন ঘন শ্বাস ফেলে। অতি কষ্টে দৃষ্টি সরিয়ে সারহান আর অরিত্রিকার দিকে তাকায়।
সবার অপেক্ষার প্রহরের সমাপ্তি ঘটিয়ে কাজি সাহেব অরিত্রিকাকে উদ্দেশ্য করে বললেন ;
“একশত এক টাকা দেনমোহর নির্ধারণ করিয়া এ বিবাহ সম্পূর্ণ করা হলো। মা কবুল বলো!”
অরিত্রিকা কেঁপে উঠল। উৎকন্ঠিত ভাব চেপে একযোগে সাবলীল এবং নম্র কন্ঠে বলল;
“কবুল,কবুল, কবুল, কবুল।”
উপস্থিত সবাই হতবাক হয়ে গেল। কবুল তিনবার বলতে হয় অথচ মেয়েটা চারবার কবুল বলল। আশ্চর্যের বিষয়!পরক্ষণে ওষ্ঠ টিপে হাসল। অরিত্রিকা লজ্জা পেল। বুঝতে পারল উত্তেজনা, উৎকন্ঠায় কি করে ফেলেছে!সে মাথা নত করে ফেলল দ্রুত। আড়ষ্টতায় তটস্থ হয়ে গেল। কাজি সাহেব হতভম্ব হয়ে গেলেন৷ এই প্রথম কোনো বউকে চারবার কবুল বলতে দেখলেন। তিনি নিজেকে সামলে নিলেন। হতভম্ব ভাব গিলে গলা খাঁকড়ি দিয়ে বললেন;
“ আলহামদুলিল্লাহ।”
সারহান অরিত্রিকার কান্ডে এক প্রকার ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গিয়েছিল। সে ভেবেছিল মেয়েটা কবুল বলতে কেঁদে কুটে একাকার করবে অথচ তার ভাবনাকে ঘোল খাইয়ে চার বার কবুল বলল! কাজি সাহেব সারহানকে কবুল বলতে বলল। সারহান নিজেকে ধাতস্ত করে তিন বার কবুল বলল। মিনিট ছয়েকের মাথায় বিয়েটা সম্পূর্ণ হয়ে গেল। কাজি সাহেব কাবিনমানা এগিয়ে দিয়ে দুজনকে সই করতে বলল। সারহান প্রথমে সই করল। তারপরে অরিত্রিকা সই করে দিলো। অদ্ভুতভাবে অরিত্রিকা কাঁদলো না, মন খারাপের আভাসিত কোনো কান্ড ও ঘটালো না।
“অবশেষ আমার না হওয়া বিবিজান থেকে বিবিজান হয়ে গেলেন। এখন কেমন বোধ করছেন মিসেস হৃদস্মিতা চৌধুরী ওরফে মিসেস অরিত্রিকা ফাইরুজ চৌধুরী?”
সারহান ফিসফিসিয়ে ধীরজ কন্ঠে বলল। অরিত্রিকা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল। পিটপিটিয়ে চাইলো। ওষ্ঠ উল্টে বলল;
“আপনি আমার নকল নামটাও মনে রেখেছেন?”
সারহান হাসল। চিরচেনা নিঃশব্দ সেই হাসি। অরিত্রিকা মুগ্ধ নয়নে দেখল। তখনি কর্ণকুহরে প্রবেশ করল পুরুষালি ভরাট কন্ঠস্বর ;
“তোর বলা সব কথাই আমার মনে আছে।”
“তাই নাকি? আপনার নিশ্চয়ই এটাও মনে আছে একদিন রাতে আপনাকে কল দিয়েছিলাম আর আপনি আমায় বাজে কথা বলেছিলেন।”
“বাজে কথা?”
“আপনি আমায় বলেছিলেন আপনার….. তীব্রতা ছিহ্। আপনি একটা অপরিচিত মেয়েকে ওসব কিভাবে বলতে পারলেন? ”
“তুই আমাকে উল্টাপাল্টা বলে জ্বালাতন করতে পারিস অথচ আমি কিছু বললেই দোষ? আমি সেদিন তোর পরিচয় জানলেও একই কথা বলতাম বুঝেছিস?”
সারহান বাঁকা হেসে বলল। অরিত্রিকা অভিমানে ওষ্ঠ উল্টালো। আবির দুজনের কথোপকথন শুনে অরিত্রিকা উদ্দেশ্য করে বলল;
“শ্যালিকা, তুমি আমার ভোলাভালা বন্ধুকে নাকি কিসব চুম্মার কথা বলেছিলে ফোনে। এটা কি ঠিক করেছো? একদম ঠিক করো নি। তবে একদিক দিয়ে ভালোই হয়েছে তুমি বুঝতে পেরেছো আমার বন্ধুর চরিত্র ফুলের মতো পবিত্র।”
অরিত্রিকা ভার কন্ঠে বলল;
“আপনার বন্ধু অনেক খারাপ ভাইয়া।”
আবির হেসে বলল ;
“তাহলে আমার বন্ধুকে বিয়ে করলে কেন?”
অরিত্রিকা ভার মুখে বলল;
“ ভালোবাসি তাই।”
“তাহলে আমার খারাপ বন্ধুকে ভালোবেসে ভালো করে দাও।”
“আমার বইয়েই গেছে।”
সারহান অপলক চেয়ে রইল তার অর্ধাঙ্গিনী রুপে রমণীর দিকে। প্রণয়ের সন্ধিক্ষণের অবসান ঘটিয়ে নতুন জীবনে পদার্পণ করল। দীর্ঘ তিন বছরের অপেক্ষার সমাপ্তি ঘটল। এক প্রেমিক পুরুষের ভালোবাসার পূর্ণতা পেল। এক চঞ্চলা অভিমানী রমণীর রাগ,ক্ষোভের পাহাড় চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে মিশে গেল প্রণয়ের পূর্ণতা নামক অতল সমুদ্রের গহ্বরে। সারহান স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। অরিত্রিকা কেমন অবলীলায় বলে দিলো তাকে ভালোবাসে। এটাই যেন দীর্ঘ সময়ের প্রতীক্ষার মিষ্টি ফল। কাজি সাহেব আরশাদ সাহেব ও আজমল সাহেবের সাথে দেখা করে প্রস্থান করলেন। প্রাক্তন এমপি ও দলীয় নেতারা নবদম্পতিকে অভিনন্দন জানিয়ে বিদায় নিলেন। উপস্থিত সবাই একে একে অভিনন্দন জানালো।
চৌধুরী বাড়ির ছোট মেয়ের আকদের পরেই আরেক চমকপ্রদ খবরে বাড়ির কর্তা – কর্তিরা বিস্মিত হয়ে গেছেন। আবিরের বাবা মা আকদ উপলক্ষে আসলেই আরেকটা কারণ ছিল চৌধুরী বাড়িতে আসার সেটা হলো আনুষ্ঠানিকতার সহিত অরিনকে তাদের বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার। কিছুক্ষণ পূর্বে আজমল সাহেব এবং আরশাদ সাহেবকে একান্তে বসার ঘরে ডেকে বসে সিদ্ধান্ত জানিয়েছেন আবিরে বাবা রফিক সাহেব। এ মুহুর্তে এমন একটা কথা শুনে তারা অবাক হয়েছিলেন। এই তো কিছুদিন আগে আকদ হলো। এতো দ্রুত কেন নিয়ে যাবেন মেয়েকে? তারা ভেবেছিলেন মাস তিনেক পর অনুষ্ঠান করে বিয়ে তুলে দিবেন।
রফিক সাহেব আরশাদ সাহেব ও আজমল সাহেবকে নির্বাক বসে থাকতে দেখে বিনয়ী স্বরে বললেন;
“ভাইজান, আমি চাইছি মাস খানেক পরে অরিন মামনীকে আমাদের বাড়িতে স্ব সম্মানের সহিত একবারে নিয়ে যেতে। আপনাদের কোনো আপত্তি আছে?”
আজমল সাহেব নিরবতা পালন করলেন। আরশাদ সাহেব সহালকা হেসে বললেন;
“আপনাদের ছেলের বউকে আপনারা নিয়ে যাবেন এতে আমাদের কোনো আপত্তি নেই। তবে এতো তাড়াহুড়ো করছেন কেন? অরিন না হয় আর মাস দুয়েক থাকুক এখানে। থার্ড ইয়ার ফাইনাল এক্সামটা দিয়ে তারপর নিয়ে যেতেন।”
রফিক সাহেব নড়েচড়ে বসলেন। বেশ গুছিয়ে জবাব দিলেন;
“বাড়ির লক্ষীকে দূরে রাখা ভালো দেখায় না। আবিরও চাইছে দ্রুত অরিনকে আমাদের বাড়িতে নিয়ে যেতে।”
কথোপকথনের মাঝে উপস্থিত হলেন চৌধুরী বাড়ির গিন্নিরা ও আবিরের মা হেনা বেগম। তারা একপাশে দাঁড়ালেন। আজমল সাহেব নিরবতা ভেঙে গম্ভীর কণ্ঠে বলে উঠলেন;
“বুঝেছি। আবির আপনাকে দ্রুত অরিনকে নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করছে। আপনার ছেলে বড্ড ধূর্ত!”
রফিক সাহেব অপ্রস্তুত হলেন। আজমল সাহেবের ধারণা একদম ঠিক। আবির তাকে দ্রুত অরিনকে ও বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার জন্য বারবার বলেছে সারহানের আকদের এক সপ্তাহ পরেই তার ঘরে বউ চাই। তিনি ছেলের ওমন কান্ড দেখে বিরক্ত হয়েছিলেন। যে ছেলে ছাত্রজীবনে কোনো মেয়ের আশেপাশে অব্দি যায়নি সেই ছেলে বউয়ের জন্য পাগলামি শুরু করেছে। তিনি ছেলেকে বুঝিয়েছেন কিন্তু কোনো সুরাহা মিলেনি। উপায়ন্তর না পেয়ে আজকে প্রস্তাব নিয়ে এসেছেন।
“কি আর বলবো ভাইজান। আমি চেয়েছিলাম আপনাদের সাথে আলোচনা করে ডেট ফিক্সড করতে। কিন্তু আমার ছেলে বুঝলে তো?”
রফিক সাহেব বললেন। আজমল সাহেব চটলেন। তবে তা বুঝতে দিলেন না। গম্ভীর কণ্ঠে বললেন;
“দুই বন্ধু একই রকম। আমার মেয়ে দুটোকে জোর করে বিয়ে করেছে। ভাগ্য করে দুটো জামাই পেয়েছি। এরা পিন্ডি চকে খাচ্ছে আমার।”
আরশাদ সাহেব চাপা ধমক দিয়ে বললেন;
“চুপ করো তুমি। বেশী বাজে না বকে বিয়ের ডেট মাস খানেক পরে ফিক্সড করো।”
“আপনি ফিক্সড করুন ডেট।”
“বুড়ো বয়সে এসে বাচ্চাদের মতো মুখ ফুলিয়ে থেকো না।”
আজমল সাহেব দীর্ঘ শ্বাস ফেললেন। অতঃপর এক মাস পর ডেট ফিক্সড করার জন্য আলোচনা শুরু করলেন। রুমের বাহিরে দাঁড়িয়ে ছিল ইশরা। এমন চমকপ্রদ খবর পেয়ে দৌড়ে গেল অরিত্রিকাকে খবরটা জানাতে।
ঘড়ির কাটা বিকেল পাঁচটা ছুঁইছুঁই। মেহমানরা ইতোমধ্যে সবাই প্রস্থান করেছেন আগেই। সার্ভেন্টরা লিভিংরুমসহ পুরো বাড়ি পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করার কাজে লেগে পড়েছে। আরশাদ সাহেব আবির সাথে কিছু জরুরী কথাবার্তা বলছেন। আজমল সাহেব আবিরের বাবা – মাকে গেট অব্দি এগিয়ে দিয়ে এসে লিভিংরুমে এসে মাত্র বসলেন। সকাল থেকে ব্যস্ত সময় পার করছেন। শরীরটা ভীষণ ক্লান্ত। গরমে নাজেহাল অবস্থা। গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে আসছে। তিনি কিচেন থেকে ইশরাকে বের হতে দেখে ডাকলেন। ইশরা ছোট মামুর কন্ঠস্বর শুনে এগিয়ে আসল। নম্র কন্ঠে জিজ্ঞেস করল;
“মামু কিছু বলবেন?”
আজমল সাহেব ক্লান্ত ভঙ্গিমায় বললেন;
“এক গ্লাস ঠান্ডা পানি নিয়ে আসো।”
ইশরা আচ্ছা বলে পানি আনতে গেল। আজমল সাহেব সোফায় গা এলিয়ে দিলেন। কিছুক্ষণ পেরোতেই পরিচিত কয়েকজনের কন্ঠস্বর শ্রবণেন্দ্রিয়ে প্রবেশ করল। তিনি ঘাড় বাঁকিয়ে তাকালেন সদর দরজার দিকে। তিনি দেখলেন অরিত্রিকার মামা – মামী ও মামাতো ভাই-বোন এসেছে। তিনি উঠে দাঁড়ালেন। খানিকটা এগিয়ে অরিত্রিকার মামার সাথে হ্যান্ডশ্যাক করে বললেন ;
“কেমন আছেন ভাইসাব?”
ইকবাল সাহেব হাত বাড়িয়ে হ্যান্ডশ্যাক করে বললেন ;
“ আলহামদুলিল্লাহ ভালো। তুমি কেমন আছো? ”
“আমিও আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি। ভাবী কেমন আছেন? ”
“ আলহামদুলিল্লাহ ভালো।”
মিতা বেগম হেসে জবাব দিলেন। আজমল সাহেব ইফা ও আফ্রিদিকে উদ্দেশ্য করে কেমন আছে জানতে চাইল। তারপর একজন সার্ভেন্টকে শরবত আনার কথা বলে সবাইকে গেস্ট রুমের দিকে নিয়ে গেলেন। শুধু বাকী রইল আফ্রিদি। সে লাগেজটা পাশে রেখে ক্লান্ত শরীরে সোফায় বসল। আজ সারাদিন জার্নি করে বিরক্ত সে। সিলেট থেকে ঢাকা ঢাকা থেকে রাজশাহী। এতোটা পথ জার্নি করে শরীরের সব শক্তি ফুরিয়ে গেছে। ইশরা পানির গ্লাস নিয়ে লিভিংরুমে আসতেই দেখল আজমল সাহেবের জায়গায় অচেনা একজন যুবক বসে আছে। সে খানিকটা ভয় পেয়ে গেল। তুবও প্রকাশ করল না। গমগমে কন্ঠে বলল ;
“এই যে মিস্টার….।”
আফ্রিদির মুখাবয়ব বিরক্তিতে কুঁচকে এলো৷ সে বিরক্তিসূচক শব্দ করে সামনে তাকাল। তাকাতেই তার দৃষ্টি এক অচেনা সুন্দরী মেয়েকে দেখে থমকে গেল। ইশরা তার দিকে এমন হা করে তাকিয়ে থাকতে দেখে অপ্রস্তুত হলো। থ্রি পিসের ওড়নাটা ভালো করে জড়িয়ে নিলো। আফ্রিদি নিজেকে ধাতস্ত করল। অতঃপর উঠে দাঁড়িয়ে ইশরার হাত থেকে পানির গ্লাসটা নিয়ে ঢকঢক করে পুরো পানি শেষ করল। ইশরা এহেন কান্ডে হতবাক হয়ে যায়।
“থ্যাংস মিস!”
আফ্রিদি পানির গ্লাসটা টি – টেবিলে রেখে মৃদু হেসে বলল। ইশরা হতবুদ্ধির ন্যায় শুধালো ;
“কেন?”
আফ্রিদির ওষ্ঠকোণে হাসি প্রসারিত হলো;
“পানি পান করানোর জন্য। আমার জন্য নিয়ে এসেছিলেন বুঝি?”
ইশরা তড়িঘড়ি করে বলল ;
“ছোট মামুর জন্য নিয়ে এসেছিলাম।”
“আজমল আংকেলের জন্য?”
“হু।”
“ তারমানে তুমি অরিত্রিকার ফুফাতো বোন। আমাকে চেনো?”
“নাহ।”
ইশারা অস্বস্তি নিয়ে ছোট্ট করে প্রতিত্তোর করল। আফ্রিদি গলা খাঁকড়ি দিয়ে বলল;
“আমি আফ্রিদি এহসান, অরিত্রিকার মামাতো ভাই।”
ইশরা সৌজন্যতা রক্ষার্থে হাসির ভাণ করে বলল;
“ওহহ।”
“তোমার নাম কি?”
“ইশরা শেখ।”
“ইশারা!”
“ইশারা নয় ইশরা। ”
ইশরা অস্বস্তি নিয়ে মিনমিন করে বলল। আফ্রিদি হাস্যরত কন্ঠে আওড়ালো ;
“ইশরা! নাইস নেম।”
ইশরা আর কোনো প্রতিত্তোর করল না। সে দ্রুত হেঁটে নিজের রুমের দিকে যেতে লাগল। তখনি আফ্রিদি পিছু ডাকল ;
“ইশারা! অরিত্রিকার রুমটা কোথায়?”
ইশরা দাঁড়িয়ে গেল। ঘাড় বাঁকিয়ে সরাসরি তাকাল আফ্রিদির হাস্যজ্জ্বল মুখে। ধীর কন্ঠে বলল;
“দ্বিতীয় তলায় পশ্চিমপাশের প্রথম রুমটা।”
আফ্রিদি মাথা চুলকে বলল;
“থ্যাংকস ইশারা।”
প্রণয়ের সন্ধিক্ষণে সিজন ২ পর্ব ৬২
ইশরার বিরক্ত লাগল। সে কথা না বাড়িয়ে সেখান থেকে প্রস্থান করল। সেই দৃশ্য দেখে আফ্রিদি আনমনা হাসল। সাদাত এতোক্ষণ দ্বিতীয় তলার করিডোরে দাঁড়িয়ে থেকে ঘটে যাওয়া ঘটনা দেখছিল। আফ্রিদিকে ইশরার সাথে কথা বলতে দেখে রাগে ফেটে পড়ল। সবচেয়ে বেশী রাগ হয়েছে ইশরার ওপর মেয়েটা কেন অচেনা একটা ছেলের সাথে কথা বলল। তার রাগ ক্রমশ বাড়তে লাগল। সে ফুঁসতে ফুঁসতে নিজের রুমের দিকে পা বাড়াল। রুমে ঢুকেই বিকট শব্দে দরজা দিলো।