মোহমায়ার বাহুডোরে পর্ব ১৫
সাদিয়া
চাকরিতে জয়েন্ট করার ৮ মাসের মাথায় প্রথম ছুটিতে বাড়ি আসে ইহাম। তখন বাবা মায়ের অনুরোধে বিয়ের জন্যে রাজি হয় সে। যদিও এই মুহূর্তে তার বিয়ের খুব একটা ইচ্ছা ছিল না। বাবা মায়ের অতিরিক্ত প্রশংসায় বিয়ের আগে মেয়ে দেখার এত ইচ্ছাও হয়নি তার। একেবারে বিয়ের দিনই বউ সাজে প্রথম দেখেছিল মায়রা কে। বাবা মায়ের পছন্দ হেলাফেলার কথা নয় তা নিশ্চিত হয়েছিল সে।
তবে যখন শুনেছিল মেয়ে ইন্টার সেকেন্ড ইয়ারে পড়ে তখনি তার মেজাজ বিগড়ায়। বাবা মা কি করে ইমম্যাচিউর একটা মেয়ের সাথে তার বিয়ে ঠিক করল? যার ১৮ ই পূরণ হতে আরো মাসেক বাকি। না পারতে কোনো রকম বিয়ে করে আবার কাজের প্রেশার দেখিয়ে ফিরেছিল ক্যাম্পে। তার সব রাগের মূল বুঝি হলো মেয়ের বয়স ১৮ হয়নি। তার কলিগ উপরমহল যদি জানে তার বউ ইন্টার পড়ুয়া তারউপর ১৮ বছরের নিচে কি ভেবে বসবে তারা? তার ব্যক্তিত্ব নিয়ে প্রশ্ন উঠবে না তখন? তাকে কি বোধগম্য হীন ভাববে? প্রবল ব্যক্তিত্ব সম্পূর্ণ ইহাম তখন হাজিবাজি চিন্তায় এরপর আর মেয়েটার সাথে কথা বলার আগ্রহ প্রকাশ পায়নি তার। নিঃসন্দেহে ভুলে বসে ছিল। অথচ এই মেয়েটার শাড়ী পরার দ্বিতীয় দর্শন কেবলই তার স্থির কায়া দিকভ্রান্ত করেছে। কঠিন আস্তরণে মুড়া তার শক্ত হৃদয় কে ব্যাকুল করছে সংগোপনেই।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
মায়রা কাঁপছে। চারপাশে তখন অসংখ্য গুলি ছুড়ার বিকট আওয়াজ কানের ভিট নাড়িয়ে দিচ্ছে। মেয়েটার ঠোঁট অনবরত কাঁপছে। চোখে পানি চিকচিক করছে। ইহাম কোমল হস্তে মায়রার মাধুরী মুখটা হাত বুলিয়ে দিয়ে উঠতে চাইলে আচমকা সে তার খাকি রঙ এর টিশার্ট টা খামছে ধরে। টইটুম্বুর পানি ভর্তি চোখ গুলি নিয়ে নিঃশব্দে কিছু বলার আকুতি জানায়। তবে শকড হয়ে আর বলতে পারছে না। ইহাম নিজ দায়িত্বেই বুঝে নেয় পরিস্থিতি টা। আবারও কপালে গাঢ় চুম্বন লেপ্টে দেয় অনিমেষ। আশ্বাস জানিয়ে চটপট বলে,
“সময় নেই হাতে মায়রা। প্লিজ আমার কথা মতো চুপটি করে এখানেই বসে থাকবে। বাহিরে কেয়ামত হলেও তুমি ঘর থেকে বের হবে না। একদম ভয় পেও না। আমাকে তেজ দেখানোর সাহস গুলি জমা করে একা বসে থাকো শুধু। কিচ্ছু হবে না। আই উইল হ্যান্ডেল। তাড়াতাড়িই ফিরব। লক্ষ্মী টা ঘর থেকে বের হবে না।”
প্রচন্ড উত্তেজনায় ইহাম খাপছাড়া কথা গুলি বলেই বুক ভরে দম নিল। তার এখন অনেক কাজ। শত্রু দুয়ারে। হিসেব টা ঠিক ভাবে না কষলে এই নির্জন জঙ্গলে ভয়াবহ কিছু হবে এটা যেন সুনিশ্চিত। সবার আগে কানে ব্লুটুথ টা গুঁজে নিজের কোমরের পিছন থেকে Glock 19 ৯mm চেম্বারিং, ১৫+১ রাউন্ড ক্যাপাসিটির পি’স্তল টা বের করে নিল। এটা সবসময় লোড থাকে। টিম মেম্বারদের কল করার আগে তার শিফুর কথা মনে হলো। মেয়েটা একা রুমে আছে। ঘুমিয়ে থাকলেও এই শব্দে জেগে উঠার সম্ভবনা বেশি। ভয়ে কি বদ্ধ রুমে কাঁদছে মেয়েটা? কল দিল ঝটপট করে শিফু কে। একবার রিং হতেই কল টা রিসিভ হলো। ওপাশের বন্ধ রুম থেকে মেয়েটা কম্পিত কন্ঠে কেঁদে কেঁদে কাতর স্বরে ডেকে উঠল “ভাইয়া।” শিফু সবসময় তাকে ভীষণ ভয় পেয়ে একটু দূরে দূরেই থাকে। বিষয়টা বুঝেও ইহাম কখনো সেই ভয় জড়তাকে কাটাতে যায় নি স্বেচ্ছাতেই। বরং এটা শিফুর জন্যেই ভালো হবে এটাই তার ধারণা। তার স্পষ্ট মনে আছে একবার মেয়েটা খেলতে গিয়ে পায়ে ব্যথা পেয়েছিল। পা কেটে রক্তও বের হয়েছে খুব। ওই কাটা পা নিয়ে তার সামনে দিয়ে আস্তে করে স্বাভাবিক ভাবেই হেটে গিয়েছে যেন সে কিছু না বলতে পারে সেই ভয়ে। এমন অনেক ঘটনায় আছে যা বুঝিয়ে দেয় ভাইকে শিফুর ভয় পাবার প্রবণতাটা। মন খুলে কথা বলা কিংবা ঝগড়াঝাঁটির মতো বেয়াদবি খুনসুটি সম্পর্ক আর দশটা পাঁচটা ভাই বোনের মতো তাদের মাঝে নেই। সেই শিফুর কাতর স্বর তাকেও নাড়িয়ে তুলল। কোমল কন্ঠে বলল,
“শিফু বোন আমার ভাইয়ার কথা শুন। চুপচাপ রুমে বসে থাকবি। কেউ ডাকলেও দরজা খুলবি না আমি বলা না পর্যন্ত। ভাইয়া আছি চিন্তা করিস না। কিচ্ছু হবে না। ভয় পাস না বোনটা।”
শিফু আর জবাব দিতে পারল না। থরথর করে কাঁপা শরীর নিয়ে এক কোণায় জড়সড় হয়ে বসে রইল মেয়েটা।
ইহাম এবার কল দিল ইবরাহিমের কাছে। সঙ্গেসঙ্গে কনফারেন্সে যোগ হলো বাকি ১৩ জনও। ইহাম ঠান্ডা মাথায় গম্ভীর সুরে সবাই কে ডাকল,
“রেডি গাইজ?”
ওপাশ থেকে এক জোটে জবাব এলো “ইয়েস ক্যাপ্টেন।”
“অল রাইট। ইবরাহিম, মইনুল, ফাহিম, সারজিদ তোমরা আমার সাথে কভার করবে। হামিদ, কিবরা, বৌলহাস আমাদের কাভার করার ফাঁকে তোমরা ছাঁদে উঠবে। আর বাকিরা তোমরা পেছন দিক থেকে আক্রমণ করবে। অবশ্যই আমার কমান্ডের অপেক্ষায়। চারিদিক অন্ধকার কুয়াশা আর ধোয়ায় কিছুই দেখা যাবে না। সবাই GPNVG-18 নাইট ভিশন গগলস, Level III kevlar Vest জ্যাকেট আর হ্যালমেট পরে নিবে। নাইট ভিশন সাপোর্টের জন্য গানে রেড ডট স্কোপ ব্যবহার করো। জলদি করো এক মিনিটও সময় নষ্ট করো না কেউ। জাস্ট দুই মিনিটে রেডি চাই। মনে রেখো এখানে শুধু আমাদের জীবন নয় কটেজের বাকি সদস্যদের লাইফ আমাদের হাতে। সো বি কেয়ারফুল। ঠিক দু মিনিটের মাঝে যার যার জায়গা থেকে আগে কাভার করো। ওল দ্যা বেষ্ট।”
থরথর করে কাঁপছে মায়রা। দরজার ফাঁক থেকে উঁকি দিয়ে আবারও ওই দুঃসাহসিক সৈনিক ক্যাপ্টেন টাকে দেখে নিল। তার হৃদয়টা যেন এই মুহূর্তে পুড়ে খা খা হয়ে যাচ্ছে। কানে ওই আদুরে আবেশমাখা কথা গুলি বারবার তার হৃদয় ঘায়েল করছে এই মুহূর্তে। ক্রন্দনরত নেত্রপল্লব মেলে ধরল ওই মানুষটার দিকে। এতক্ষণ বলা কথা গুলি কেবলই তার মাথার উপর দিয়ে গিয়েছে। শুধু এতটুক ধারণা করতে পেরেছে যা যা বলব সব সেফটির জন্যে। কিন্তু নিজে কিছুই গায়ে দিচ্ছে না কেন সে? না হেলমেট, না জ্যাকেট না গগলস। লোকটা কি এভাবেই ফাইট করবে নাকি? বুক ফেটে কান্না আসছিল মায়রার। এক অজানা শঙ্কা তাকে মুষড়ে দিচ্ছে। আধ আধ কন্ঠে ডাকবে তার আগেই ইহাম আবার বলে উঠল,
“হ্যালো তুহিন। মনোযোগ দিয়ে আগে আমার কথা শুনো। বুঝতেই পারছো কটেজে আক্রমণ হয়েছে। তোমার বন্ধুবান্ধব সবাই কে শান্ত থাকতে বলো। সবাই রুমেই বসে থাকো। কেউ ভুলেও দরজা ফাঁক করো না। প্লিজ কোনো ভুলভাল পদক্ষেপ নিয়ে আমাদের কাজ কঠিন করো না।”
তুহিনের উত্তর শুনার আসায় বসে রইল না সে। কল কেটে গান পয়েন্টে রেখে নিজের অবস্থান যেন স্থীর করল। এক হাত দরজার নবে রেখে আরেকটা হাতে পিস্তল পয়েন্টে রাখল। মায়রা কেবল দেখল লোকটা দরজা খুলে চোখের পলকে আবার সেটা বন্ধ করে দিল। আর কিছুই দেখতে পেল না। সবটা তার কাছে অগোচরে অদেখায় রয়ে গেল।
ইহাম করিডোরের হাফ দেওয়ালের পেছনে বসে নিজেকে আড়াল করল। তখনো এলোপাথাড়ি গুলি আসছেই। কিন্তু সে কোথায় গুলি ছুড়বে? অবাধ সুযোগ সুবিধা না থাকায় এই মুহূর্তে অন্ধকারে ঢিল ছুড়া তাদের ক্রান্তিকাল নিয়ে আসবে। তার সচল ধূর্ত মস্তিষ্ক তাকে খুব ভালো করে জানান দিচ্ছে ওরা এখনো কটেজ এর ভেতরে প্রবেশ করেনি। নয়তো এতক্ষণে দামামা বাজতো। ব্যবস্থা তো সে আগেই করে রেখেছিল। ঠিক তখনি বিকট করে শব্দে চারপাশটা আলোড়িত হয়ে উঠল। চোখ বন্ধ করে নিল ইহাম। বেশ বুঝতে পারল শত্রু কটেজের ভেতরে প্রবেশ করতে শুরু করেছে তাই তো গ্রেনেড টা ফাটল। শব্দ শুনে বেশ অনুধাবন করতে পারল ফ্ল্যাশব্যাং গ্রেনেড বিস্ফোরিত হয়েছে। দ্রুত একটু মাথাটা তুলে পরপর দুটো গুলি ছুড়ল। একটা ঠিক বরাবর আঘাত লাগলেও আরেকটা খুব বেশি জখম করতে পারেনি। ততক্ষণে নিচ থেকেও গুলি ছুড়া হচ্ছিল দুইপক্ষের। ইবরাহিম ততক্ষণে তার সাথেই যোগ দিয়েছে। ইহাম শান্ত কন্ঠে তর্জনী আঙ্গুল কানে চেঁপে বলল,
“ছাঁদে উঠো। ওখান থেকে আক্রমণ করো। কুইক।”
ইহাম সুরক্ষার জন্যে আগে থেকেই কটেজের বেরিয়ারে কিছু মাইন গ্রেনেড গুঁজে রেখেছিল। কিছু ক্লেমোর মাইন (M18 Claymore) ও ফ্ল্যাশব্যাং বিস্ফোরিত হওয়ার সাথে সাথে আঘাতও যে রকম ঠিকঠাক ভাবে হচ্ছে পরিবেশের খুব একটা ক্ষতিও হবে না। বন জঙ্গলে অপারেশন করার জন্যে এ গুলি খুব কার্যকর হয়। ক্লেমোর মাইনে যেরকম শত্রুকে আঘাত করবে ঠিক তেমন পিছনে খুব বেশি বিস্ফোরণও ছড়াবে না। অপরদিকে ফ্ল্যাশব্যাং ও স্মোক গ্রেনেড শত্রুকে অন্ধও বধির করার সাথে সাথে তাদের কে আক্রমণ করতেও খুব কার্যকর।
প্রচণ্ড শব্দ, একা ঘরের ভীত অবস্থায় কুঁকড়ে উঠছে মায়রা। হাত পা গুলি মৃগী রোগীর মতো থরথর করে কাঁপছে। ইহামের কথা অনুযায়ী সে বাধ্য মেয়ের মতোই খাটের পেছনে গুটিশুটি হয়ে বসে আছে। নিস্তব্ধ রাতের বিকট শব্দ গুলি যেন বুকের ভেতর কামড়ে ধরছে বিষাক্ত পোকার মতো। ঝাপসা চোখ গুলি সেই কখন থেকে ভাসমানে কি যে অবলোকন করে যাচ্ছে সে নিজেও জানে না। এই ভয়াবহ দুর্বিষহের সময়ে বারবার তার আঁখিপল্লবে ভেসে আসছে ইহামের মুখটা। ইচ্ছা হচ্ছে ছুটে গিয়ে মানুষটাকে জড়িয়ে ধরতে। কেন এই ইচ্ছা হচ্ছে তার? এটা তো তার উচিৎ নয়। অবান্তর ইচ্ছা নয়কি এসব? ওই মানুষটা তো তার খুব কাছের কেউ নয়। আর না সেরকম কোনো সম্পর্ক তৈরি হয়েছে। যে তাকে পছন্দ করে না সবসময় বিরক্ত ভাব প্রকাশ করে তার কাছে সেটা সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। তবুও কেন বারবার মনে চায় অপ্রকাশিত কিছু বুলি আওড়াতে? ছুটে বলতে চায়,
“আপনায় পছন্দ করি না, সহ্য করতে পারি না দূরে আছেন এটাই ভালো ছিল। কেন ওই আদুরে মাখা কোমল কথা গুলি বলে আমার হৃদয় ঘায়েল করলেন ক্যাপ্টেন সাহেব? এ যন্ত্রণাটুকই তো আমি সহ্য করতে পারছি না তবে এতএত বেমিল বিপরীতের মাঝে আমাদের অমিলন টা কিভাবে সহ্য করব আমি?”
মুখে হাত চেঁপে ফুঁপিয়ে উঠল মেয়েটা। আবারও বিবৎস শব্দে কেঁপে উঠল তার অন্তরআত্মা। ওই মানুষটা কি কোনো রকম সেফটি ছাড়া এভাবেই ফাইটে লেগেছে নাকি? আর বাকী সবাই কে যে এতএত নির্দেশ দিল তার বেলায়? মায়রার এই মুহূর্তে শুধু ওই মানুষটার চিন্তায় উন্মাদ উন্মাদ লাগছে। ভীতিকর এক অমঙ্গল সংশয়ে তার বুকের ভেতরটা চেঁপে আসছে। বারবার মন এত কু ডাক কেন ডাকছে? এতটা অস্থির কেন লাগছে ওই বিপরীত মেরুর মানুষটার জন্য? এক শঙ্কাপূর্ণ বার্তা যেন নিশাচর অদৃশ্য কন্ঠ তার কানে কানে কিছু বলে যাচ্ছে ফিসফিস করে।
কানে গুঁজে রাখা ব্লুটুথ ডিভাইসের মাধ্যমে ইহাম নিশ্চত হলো কটেজের পিছনের সুরঙ্গ দিয়ে বাকি সাতজন বাহিরে পৌঁছে গেছে। তারা ধীরেই এগিয়ে যাচ্ছে আক্রমণ কারী মজিদের দলের কাছে। কটেজের ভেতরে আটজন দক্ষ সৈনিকের হাতে ধরাশায়ী হচ্ছে মজিদের অসংখ্য লোক। তাদের সংখ্যাও কমে আসছে। তবুও পাল্টা আক্রমণ করতে ভুলছে না। ছাঁদে থাকা বৌলহাসের হাতের চামড়া ঘেঁষে গুলি লেগেছে। গলগল করে সেখান থেকে শোণিতের ধারা বইছে। তবুও বুঝি সে থেমে নেই। র’ক্ত ঝরা মাংস থেঁতলে যাওয়া হাত দিয়েই শ্যুট করছে অনবরত। নিজের টিমের এত সাহসী বীরদের পেয়ে এই দুঃসময়েও চিলতে হাসি ফুটে তার মুখে।
“বা’ল, এই মাঝরাতে আবার কোন বা’লেরা এত শব্দাশব্দি শুরু করছে? কার শরীরে এত পিনিক উঠছে ভায়া?”
কায়েসের কথায় অনেকে বিরক্ত হলো। জিদান প্রচণ্ড বিরক্তিতে চোখ মুখ কুঁচকে নিয়েছে। বাহিরে তখনো গুলাগুলি আর গ্রেনেড বিস্ফোরণের শব্দ আসছে মাঝেমধ্যে। এই মাঝরাতে হঠাৎ আক্রমণ, এত শব্দ তাদের হাড় কাঁপানো ভয় না হলেও ভীত। চুপচাপ সবাই বসে আছে যারযার মতো করে। এই আশঙ্কা সময়ে কায়েসের এই কথা পিত্তি জ্বালিয়ে দিল জিদানের। তিক্ত কন্ঠে বলল,
“প্লিজ কায়েস সময়টা একটু বুঝার চেষ্টা কর। সবসময় এতো হেয়ালি আর আউলফাউল কথা বলে মানুষের মেজাজ বিগড়াস না।”
কায়েস বুঝি সেটা গায়েও মাখল না। ব্যঙ্গ করে বলল,
“তোমার বা’লের মেজাজ তোমার কাছেই রাখো মগা। এসব আমি চু* না।”
জিদানও বুঝি রেগে গেল। কথা কাটাকাটি লেগে গেল। এক পর্যায়ে একেঅপরের সাথে হাতাহাতি শুরু হয়ে গেল ওদের মাঝেই। তুহিন ধমকালো সবাই কে। অসহায় কন্ঠে জানাল,
“তোদের কাছে হাত জোড় করছি আমি। দয়া করে একটু চুপ কর তোরা। নিজেদের মাঝে ঝামেলা করে এই বিপদে আর বিপদ বাড়াস না। এই মুহূর্তে অন্তত ঝামেলা করিস না। দোহাই তোদের।”
তুহিন কে কেমন অসহায় দেখাচ্ছিল। তার চোখ মুখের অবস্থা নিদারুণ। নিজেকে বদ্ধ রুমে আটকে রাখলেও তার হৃদয় বড্ড অস্থির চঞ্চল। ভেতরটা পাখিরছানার মতো ছটফট করে দাফাচ্ছে। মায়রা শিফু ওরা কি করছে? ওরা নিশ্চয় ভয়ে কাবু হয়ে বসে আছে। দুটি কি এক সাথে আছে নাকি আলাদা? মায়রা যে অতিরিক্ত শব্দ সহ্য করতে পারে না। এই ভয়ংকর আওয়াজে কিভাবে আছে মেয়েটা? আর শিফু? ওরই বা কি অবস্থা? উফ অসহ্য লাগছে তার। হাত পা মুক্ত অবস্থাতেও মনে হচ্ছে শৃঙ্খলে আবদ্ধ।
ইহাম খুব সাবধানে বাহিরে অবস্থানরত সাব্বির কে জিজ্ঞাস করল,
“সাব্বির ওরা এখন কত জন আছে?”
সাব্বির গান পয়েন্টে রেখেই আড়াল থেকে ক্ষীণ কন্ঠে জবাব দিল,
“স্যার ১২/১৩ জনের মতো।”
মেজাজ চটল মনে হয় ইহামের। মুখের বর্ণ পাল্টে গিয়েছে তার। বেজার চটে ক্ষোভ নিয়ে বলল,
“গর্দভ সঠিক কারেকশন টা দাও ননসেন্সের মতো কথা না বলে।”
“স্যরি স্যার।”
কথা বাড়াল না ইহাম। সেই ফাঁকে আরো একটা গুলি ছুড়ে আবারও বসল হাফ দেওয়ালের আড়ালে। সাব্বির গুণেগুণে বলল,
“স্যার এরা ১৬ জন আছে এখনো।”
“সবাই রেডি হও। এবার একসাথে আক্রমণ করো। এখনি।”
বলতে দেরি সবার আক্রমণের জোর আর দেরি হলো না। একের পর এক ধাওয়া পাল্টা ধাওয়ায় পরিবেশ ঘমঘম করছে। নিস্তব্ধ পরিবেশে কেবল গুলির আওয়াজ আর সাথে কিছু মানুষের চাঁপা, ভারি নিশ্বাস। দুই দিক থেকে আক্রমণ করার ফলে মজিদের লোকেরা একেবারে নিস্তেজ অবস্থা। অবশেষে অবস্থা বেগতিক পর্যায়ে পৌঁছে গেলে তারা যখন পালানোর ব্যবস্থা করল। ততক্ষণে ইহাম এরা সবাই কটেজের গেইটের সামনে চলে এসেছে। ইহাম মজিদ পাহাড়ির পিছনে ছুটতে ছুটতে চেঁচিয়ে বলল,
“কটেজের ভেতরে কেউ যাও। ফাস্ট।”
ইবরাহিম আর ইহাম ছুটছে মজিদ সহ ওর তিন সঙ্গির পিছনে। ছুটতে ছুটতে ইহাম কেবল বলেছিল,
“ইবরাহিম যাই হয়ে যাক মজিদ কে জীবিত পেতে হবে। ওর কাছে অনেক ইনফরমেশন আছে। ওর কিছু হওয়া চাই না।”
“ইয়েস স্যার।”
পথিমধ্যে আবারও এক লোক ঘায়েল হলো ইবরাহিমের গুলিতে। আরেকজন গাছের আঘাতে পিষ্ট হয়ে উল্টে পড়েছে।
“ইবরাহিম ওদের নিয়ে তুমি কটেজ যাও। সবাই কে বেঁধে একরুমে আটকে রাখো। এটা আমি সামলে নিব।”
“কিন্তু স্যার…”
“যাও।”
ইতোমধ্যে পথ থামিয়ে দিয়েছে ইবরাহিম। ক্যাপ্টেনের আদেশ অমান্য করা তো যায় না।
গাছগাছালির ফাঁকে ফাঁকে মিটমিট আলোয় ইহাম আবছায়াতেই গুলি ছুড়ল। মজিদ পাহাড়ি নিজের জান বাঁচাতে তার পাশেই দৌড়ানো সঙ্গিকে নিজের সামনে ধরল। সঙ্গেসঙ্গে লোকটার উরুর ঠিক মাঝ বরাবর গিয়ে গুলি লাগতেই গলগল করে র’ক্ত পড়া শুরু হলো। ইহাম দৌড়ে গিয়ে সেটাকে পাশ কাটিয়ে মজিদের পায়ের দিকে গুলি ছুড়তে গেলে টের পেল পি’স্তলের অবশিষ্ট বুলেট ফুরিয়েছে। উপায়ন্তর না পেয়ে পাশেই একটা পাথরের টুকরো পেয়ে সেটাই ঢিল দিল মজিদের উপর। পায়ে লেগেই বেচারা উল্টে পরল। ইহাম ধপাস করে মজিদের কলার চেঁপে বলল,
“মাদারচো* খুব শখ হয়েছিল না আমায় মারতে? অণ্ডকোষে পিরপির করছিল তাই না রে শুয়োরের’বাচ্চা?”
ইহাম একের পর এক ঘন নিশ্বাস ছুড়ছে। মজিদ সেই সুযোগে তার গালে সজোরে ঘুষি বসিয়ে দিয়ে আবার দৌড়াতে লাগল। ইহাম খানিক টলল। দীর্ঘক্ষণের যাত্রায় কি তার ক্লান্তি ধরে গেছে? সর্বনাশ ডিপার্টমেন্ট এই কথা জানলে তো তার মুখে থুথু দিবে। আবারও দৌড় লাগাল সে। মজিদ কে খাবলা দিয়ে ধরতেই মজিদ তার পেটে লাথি দিল। দুই হাত দিয়ে বুকে ধাক্কা দিয়ে নিচে ফেলে দিল। ইহাম তাল রাখতে বা হাত দিয়ে নিচের স্থান টা আঁকড়ে ধরল। এবড়োখেবড়ো ধারালো কিছুর সাথে হাত লেগে যন্ত্রণাও শুরু হলো। অনুভব করল তরল ধারার। তবে সেদিকে এক বিন্দু না মনোযোগ দিয়ে বাঘের থাবার মতো মজিদের ঘাড় চেঁপে ধরল। চোখের পলকে মুখে এলোপাথাড়ি ঘুষি বসাতে লাগল। মাথাটা খানিক নুয়িয়ে তলপেট বরাবর এক নাগাড়ে হাটুর সাহায্যে কয়েকটা আঘাত করতেই বেচারার কাহিল অবস্থা। তবুও শেষ শক্তিদিয়ে বুঝি আবারও ইহামের নাকে একটা ঘুষি দিল।
গলগল করে রক্তও বের হলো। ইহাম শুধু তাচ্ছিল্য হাসল। তার জানা আছে মজিদ পাহাড়ি এমনি এমনি পাহাড়ি হয়ে উঠেনি। গায়ে এখনো বেশ বলবান সে। ইহাম মাটিতে চেঁপে ধরে উন্মাদের মতো একের পর এক ঘুষি দিতে লাগল মজিদ কে।
রাত তখন ২ টার মতো বাজে। ইহাম আস্তেধীরে নব ঘুরিয়ে ভেতরে প্রবেশ করল। খাটের পিছন থেকে মায়রা একটু একটু করে উঁকি দেয়। ইহাম কে দেখে ধড়ফড়িয়ে উঠে। খাটের ওপাশ থেকে বের হয়ে এসেই থমকে দাঁড়ায় সে। একটু একটু করে সামনে এগিয়ে যায়। ইহামের গালের উপরি ভাগটায় লাল চটচটে হয়ে আছে। নাকের কাছে র’ক্ত। হাতের থেকেও র’ক্ত ঝড়ছে। মানুষটাকে এভাবে দেখে আঁতকে উঠল তার ভেতরটা। বুকটা মুচড়ে যেন কোনো কিছু কামড়ে ধরল। এই মানুষটা এত ব্যথা পেয়েছে? তার বুকটা এত ভার হয়ে আসছে কেন? ওই পাষাণ মানুষটার সাথে তো আর কোনো কালে কোন রকম সম্পর্কই তৈরি হয়নি তবে এত কষ্ট হচ্ছে কেন? কেন অবাধ্য ইচ্ছা জাগছে হৃদয়ে। মন চাইছে মানুষটাকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে জড়িয়ে ধরতে। কিন্তু কোথাও একটয় সংশয় একটা দ্বিধা তিক্ত একটা জড়তা তাকে বাঁধ সাধছে। মানুষটার সাথে তো আর কোনো সম্পর্ক তৈরি হলো না তবে এমন আচরণ কি করে সুভা পায় তার মাঝে? যেখানে মানুষটা তাকে অপছন্দ করে দূরে সরে থাকে সেখানে বেহলাজের মতো এগিয়ে যাওয়া কি নিজেকে অপমান করা নয়? যেচে অপমান হতে যাওয়া যৌক্তিকও নয় বোধহয়। নিজেকে দমিয়ে মেয়েটা পাথরের মতো স্তব্ধ হয়ে রইল।
“ভয় পাবার কারণ নেই। সবটা নিয়ন্ত্রণে। তুমি ঠিক আছো কি না তাই দেখতে এলাম।”
মায়রা কিছু জবাব দিতে পারল না। কেবল তাকিয়ে রইল লোকটার আঘাত প্রাপ্ত স্থান গুলির দিকে। হৃদয়টা আবারও হুহু করে উঠল তার। ইহাম ক্ষীণ কন্ঠে বলল,
“শুয়ে পড়ো মায়রা। আমার একটু কাজ আছে।”
গম্ভীর মুখে ইহাম আবারও দরজা লাগিয়ে দিয়ে চলে গেল। মায়রা হাতড়ে হাতড়ে কোনো রকম গিয়ে বিছানায় বসল। ভেতরটা ফাঁপা হয়ে আসছে। তার অদ্ভুত জ্বালা হচ্ছে বুকের ভেতর। বড্ড অস্থির অস্বস্তি তার গলা চেঁপে ধরেছে।
মানুষটা বোধহয় ঘরে ঢুকল আরো আধঘণ্টা পর। সে ঘরে আসতেই মায়রার নাকে বিদঘুটে একটা গন্ধ এলো। চিনতে বা বুঝতে অসুবিধা হলো না মানুষটা সিগারেট টেনে এসেছে। রুমটায় যেন অক্সিজেনের অভাব পড়েছে। রাগে কটমট করতে করতে মেয়েটা একই ভাবে ঠাই বসে আছে বিছানায়।
“এখনো ঘুমায়নি? রাত জাগার অভ্যাস আছে নাকি তোমার?”
মায়রা জবাব দিল না। তবে বলতে ইচ্ছা হলো,
“আপনার মতো লোক যার সাথে আছে ঘুম তার শত্রু হবে।”
ইহাম পানি ভর্তি গ্লাসটা নিয়ে শেষ করল। ফাস্টএইড বক্সটা নিয়ে আরাম করে বসল শোফায়। রাগান্বিত চোখে মায়রা দেখল শুধু। ইহাম চোখের পাতা তুলে মায়রার দিকে তাকাতেই চোখাচোখি হলো দুজনের। মেয়েটা আর চোখ সরালো না। তবে ইহাম কি ভেবে যেন মাথা ঝুঁকে হাসল। মায়রার রাগে তখন শরীর জ্বলছে। গায়ে ব্যথা র’ক্ত এখনো পড়ছে আর সে কি রকম শরীর জ্বালানো মার্কা হাসি হাসল। শয়তান, আস্তো একটা কঠিন পাষাণ মানব।
ইহাম বা হাতটা মেলে ধরল। দগদগে কাটা জায়গা দেখেই শরীরটা ঝাঁকুনি দিয়ে উঠল তার। সঙ্গেসঙ্গে নজর ফেরাতে বাধ্য হলো সে।
ইহাম গাঢ় কন্ঠে বলল,
“ত্যাড়ামি করছো মায়রা? পায়ের ব্যথা সেরে গিয়েছে? এভাবে পা ঝুলিয়ে বসে আছো কেন?”
“আপনি একটু চুপ করুন তো। এত কথা ভালো লাগে না।”
“নিজের বেলায়?”
মায়রা জবাব দিল না আড়চোখে দেখল ইহামের কাটা হাতটা। তুলোয় স্যাভলন নিয়ে আশপাশের মাটি পরিষ্কার করছে। শরীরটা আবারও কেঁপে উঠল মায়রার। ঝাড়া দিয়ে উঠতেই দৃষ্টি ঘুরালো। ডাক্তারের কাছে গেলে নিশ্চয় তিন চারটা সেলাই করে দিত এতক্ষণে ধরে বেঁধে হলেও। আচ্ছা ডিফেন্সে এরা জব করে পায়টা কি? নিজের জীবনের চেয়ে এদের দাম তাদের চাকরিই কেন? কি পায় জীবনকে মরণে ঠেলে এগিয়ে যেতে? মায়রার কাটা হাত দেখে রাগ হলো। কেন এত মেজাজ খারাপ হচ্ছে সে নিজেও ঠিক বুঝতে পারছে না।
“ভয় পাচ্ছো কি মায়রা?”
“আশ্চর্য ভয় কেন পাবো?”
“তবে একটু পরপর কাটা জায়গা দেখে শিউড়ে শিউড়ে মুখ ফেরাচ্ছো কেন?”
মায়রা কেবল বিরক্তি ভঙ্গিতে আওড়ালো “ঢং।”
ইহাম হাত পরিষ্কার করতে করতেই বলল,
“এদিকে আসো মায়রা একটু সাহায্য করো তো।”
“পারব না আমি। নিজেরটা নিজে করুন।”
“তুমি তো খুব বেয়াদব মায়রা। দেখছো এক হাতে পারছি না নিজ থেকে সাহায্য করবে সেটা তো না। আমি বলার পরও কি নিজের বেয়াদবি প্রকাশ করছো?”
“করছি। কারণ আমি বেয়াদব। আমার এসব ভালো লাগে না। কাটা ছেঁড়া দেখতে পারি না আমি।”
“একজন সেনাসদস্যের বউ এর মুখে এসব কথা মানায় না মেয়ে।”
“কি বলছেন বিড়বিড় করে? স্পষ্ট করে কথা বলতে জানেন না?”
“ঘুমিয়ে পড়ো মায়রা। রাত কয়টা বাজে দেখেছো? তর্ক না করে শুয়ে পড়ো।”
“শুয়ে পড়ো” শব্দ দুটিতে ধক করে লাগল মায়রার। হঠাৎ এক দম বন্ধকর অস্বস্তি নদীর কলকল পানির মতো করে তীর ডুবার অনুভূতি হলো অন্তঃগ্রথিতে। আগে বিষয়টায় এতটা সূক্ষ্ম চিন্তা না জন্মালেও এই নিভূত নিরালা রাতে সেটা বেশ প্রভাব খাটাচ্ছে মনে। বড্ড অস্বস্তিও দিচ্ছে বিষয়টা। সংকোচ নিয়েও তাই বলল মায়রা,
“আমি শিফুর ঘরে থাকব। আপনি আপনার রুমে থাকুন।”
সহজাত ইহামের ধাত পিছলে গেল বুঝি। সে তীক্ষ্ণ চোখে তাকালও মায়রার দিকে। মেয়েটা হুট করেই চোখের দৃষ্টিও সরিয়ে নিয়েছে তার উপর থেকে। তবুও কিছুটা সামলে রাশভারী কন্ঠে জবাব দিল,
“ও ঘুমিয়ে গিয়েছে। ওকে এখন ডাকা যাবে না। তাই তুমিও কথা না বাড়িয়ে ঘুমিয়ে যাও।”
“আপনার সাথে আমি এক ঘরে থাকব না।”
মায়রার সাফসাফ কথায় ভ্রুকুটি করে তাকাল ইহাম। অদ্ভুত কন্ঠ নিয়ে শুধালো,
“কেন? সমস্যা কোথায় শুনি? তুমি কোনো ভাবে আমাকে ভয় পাচ্ছো মায়রা?”
স্নিগ্ধ চাউনিতে মায়রা তাকালো লোকটার দিকে। ইহাম একচুলও দৃষ্টি এদিকওদিক করল না তার উপর থেকে। মায়রার ঠোঁটে আচমকা তুচ্ছ হাসি ফুটল মঞ্জুরির ন্যায়। কাটা বিঁধানোর মতো কন্ঠে বলল,
“যেখানে সম্পর্কের কোনো দাম নেই। অনিশ্চিত সম্পর্কেরর পরিণতি যেখানে বিচ্ছেদ হতে পারে সেখানে আমি আপনার সাথে কেনো এক ঘরে থাকব ক্যাপ্টেন সাহেব?”
মেজাজ এবার বেশ বিগড়ে গেল ইহামের। দাঁত খিঁচে আনল সে। চোখ বন্ধ করে হিসহিস করতে লাগল। এই মেয়েটা এতটাই বোকা? কখন কোন পরিস্থিতিতে কোন কথা বলতে হয় সেই জ্ঞান টুক কি নেই তার মাঝে? এতটাই নির্বোধ সে। ইহাম কে চোখ বন্ধ করে বসে থাকতে দেখে ঢোক গিলল মায়রা। শক্ত ভাবেই বলল,
“আমি শিফুর ঘরে যাচ্ছি।”
মায়রা উঠে দাঁড়ালো। খোঁড়াতে খোঁড়াতে কয়েক কদম এগিয়ে যেতেই ইহাম বজ্র বেগে উঠে দাঁড়ায়। লম্বা কদম ফেলে মায়রার বাহু চেঁপে খানিক নিজের কাছে আনল। মায়রা তাকাল সেদিকে। লাল লাল চোখ দিয়ে কেমন নিশপিশ করছে মানুষটা। এতটা রাগি কেন এই মানুষটা? এত বদমেজাজি? কথায় কথায় কেন রাগ এত তার? দম নিল মায়রা। ভেতরে ভয় পেলেও কন্ঠে বলল,
“ছাড়ুন আমায়।”
“এই মেয়ে এত বেশি কথা কেন বলো তুমি? বাচ্চা তো নও। বয়স হয়েছে। ১৮ না হলেও বুঝার ক্ষমতা তো আছে। এতটা রাগান্বিত করে তুলো কেন আমায়?”
“আমি আপনায় রাগাচ্ছি?”
“মায়রা চুপচাপ বিছানায় যাও।”
“না আমি শিফুর রুমে যাবো।”
চোখ বন্ধ করে মায়রার তর্কটা হজম করল সে। লম্বা লম্বা বার কয়েক নিশ্বাস নিয়ে বলল,
“তোমার শরীর ঠিক নেই। কিছুর দরকার পরলে তখন কি হবে? শিফু তোমার দেখভাল করবে? ও নিজেই তো ছোট।”
“আমার দেখভাল করতে হবে না। আমি ঠিক আছি একদম। যেতে দিন।”
“মায়রা তুমি অযথা আমার সাথে তর্ক করে মেজাজ নষ্ট করছো। যাও গিয়ে শুয়ে পড়ো।”
“আপনার সাথে তো একদমই না।”
দাঁত পিষে ইহাম মায়রা কে নিজের সাথে আরো মেশালো। কটকট করে বলল,
“কেন আমার সাথে ঘুমালে কি? কি হবে তোমার? এতই অপছন্দ নাকি তোমার আমাকে? ভুলে যেও না আমাদের সম্পর্কটা কি।”
“ভুলে আপনি গিয়েছেন মিস্টার ফাহাদ ইহাম চৌধুরী। তাই তো বিয়ের পর নিজের দায়িত্ব কর্তব্য ভুলে আপনি নিখোঁজ ছিলেন। এখন সম্পর্কের কথা বলছেন কোন মুখে?”
এই পর্যায়ে ইহাম চুপ করল। হাতের বাঁধন শিথিল করে শান্ত কন্ঠে জবাব দিল,
“দেখো মায়রা যা হয়েছে..”
“ছাড়ুন আমার হাত।”
“বাচ্চাদের মতো করছো কেন মায়রা? তোমার সাথে আমার কথা আছে। আমি বলছি..”
“আমি শুনছি না। আর শুনতেও চাই না। ছাড়ুন আমার হাত।”
নিজের স্বভাবের বাহিরে গিয়েও নরম সুরে কথা বলেছে ইহাম। তবুও মেয়েটা শুনতে চাইছে না। এবার রুক্ষ কন্ঠেই বলল,
“ছাড়ছি না।”
“হাত ছাড়ুন। আপনি কি আমায় জোর করছেন?”
“করছি।”
মায়রা তাকাল পূর্ণদৃষ্টিতে। একটু একটু করে মিশ্র অনুভূতি তাকে তেঁতো করে দিচ্ছে। আচমকা ঝোঁকের বসে বলেই ফেলল,
“জোর করে কাপুরুষেরা। আপনি কি সেটাই ক্যাপ্টেন সাহেব?”
ইহাম স্তম্ভিত হয়ে তাকাল মায়রার দিকে। চোখে মুখে কেমন বিতৃষ্ণা বিদ্বেষ ভাব। অতি নগণ্য বস্তুর মতো ঠেলে দিল তাকে। হঠাৎ কি হলো মায়রার কে জানে? এইটুক অবহেলা তার বুক ভার করে দিল। এই মুহূর্তে মানুষটাকে এভাবে বলা কি ঠিক হলো? একটু কি বেশি বলে ফেলেছে সে? এভাবে ওমন ধরনের একটা কথা বোধহয় আসলে উচিৎ ঠেকল না নিজের কাছেই। ইহাম কয়েক পল মায়রার দিকে ওমন অবজ্ঞা ভাব নিয়েই তাকিয়ে রইল। আকস্মিক জ্বলন্ত চোখে খাটের পায়ায় পরপর কয়েকটা লাথি দিল সজোরে। ভয়ে সংশয়ে মায়রা যেভাবে দাঁড়িয়ে ছিল সেভাবেই চোখ বুজল। তার কায়া তখনো স্থির অচঞ্চল। ছেলেটা তখনো ক্রোধে ফেটে যাচ্ছিল। শান্ত চোখেই মায়রা দেখল। দাঁত পিষে কিছু বলতে উদ্যত হলো পরপর নিশ্বাস নিতে নিতে। কিন্তু সেই ইচ্ছাটাও বুঝি আর হলো না তার। আক্রোশ বিষাদ নিয়ে হনহন করে ঘর থেকে বের হলো। দরজার কাছে গিয়ে বেসামাল ক্রোধের জোরে দেয়ালে বা হাত দিয়ে বিকট শব্দে একটা পাঞ্চ করেই বের হয়ে গেল। বাহির থেকে দরজা আটকানোর শব্দও ভেসে এলো প্রবল ভাবে। মায়রার গলা বসে আসছিল। ঠোঁট গুলি কাঁপছিল। স্থির আঁখিপল্লবে উঁকি দিচ্ছিল কয়েক মুক্ত দানা। দরজার কাছটায় নিচে কয়েক ফোঁটা র’ক্তের ফোঁটার দিকে আনমনে তাকিয়ে রইল সে। নিশ্চয় কাটা হাতটা দিয়ে আবারও র’ক্ত ঝড়ছে আবলিল ভাবে।
শিফু এখনো ঘুমায়নি। ভয়ে শরীর কাঁপছে তার একা রুমে। একটু আগেই ভাইয়া এসে তাকে ধাতস্থ করে গিয়েছে। বিপদমুক্ত বলে নিশ্চিন্ত থাকতে বলেছে। কম্বল মুড়ি দিয়েও ঠকঠক করে কাঁপছে সে। আচমকা দরজার কড়াঘাতে চমকে উঠল তার ছোট্ট হৃদয়টা। মৃদু আওয়াজে বারবার টোকা পরায় শিফু উঠে বসল কম্বল সরিয়ে। আস্তেধীরে গিয়ে দরজা খুলে দিতেই হুড়মুড় করে ডাকাতের মতো ঘরে প্রবেশ করল তুহিন। খানিক চমকে পিছিয়ে গেল শিফু। তুহিন চটজলদি করে দরজা লাগিয়ে পিছন ফিরল। এক বিন্দু সময় নষ্ট না করে ছেলেটা ঝাপটে বুকের মাঝে নিয়ে এলো তাকে। ঘটনার আকস্মিকতায় মেয়েটা স্তব্ধ হয়ে হাত পা ছেড়ে দাঁড়িয়ে রইল কেবল। তুহিন অধৈর্যের মতো ক্ষণে ক্ষণে তাকে আগের তুলনায় বেশি শক্ত করে চেঁপে রেখেছে। হাতের বাহুবন্ধন আরেকটু জোরালো হতেই স্তম্ভিত ফিরল শিফুর। দম বন্ধ হয়ে আসছে। অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছে মনে। শরীরটাও অবশ লাগছে। ঢের বুঝতে পারছে তার পিঠ অবধি চুল গুলির ভেতর হাত গলিয়ে দিয়েছে তুহিন। মাথার নিউরনে বুঝি টনটন ব্যথা হচ্ছে। মনে হচ্ছে নিশ্বাসটা এখনি গলা দিয়ে বের হয়ে যাবে। শিফু সময় নিয়ে লম্বা করে শ্বাস টানল। অক্সিজেনের অভাবে বুকের ছাতি ধড়ফড় করছে।
“এই শিফু? খুব ভয় পেয়েছিলে?”
নিরুত্তর শিফু তখন দিশেহারা। শরীরে উচাটন মেলে ধরা অনুভূতি সাথে মাথার ভেতর কিলবিল করা চিন্তা তাকে একেবারে নিস্তেজ অস্থির করে তুলছে। কি হচ্ছে তার সাথে? কতটুক যৌক্তিক? কতটুক উচিৎ? যৌক্তিক-অযৌক্তিক, ন্যায্য-অন্যায্য মনোভাব জাগল শিফুর মাঝে। চোখের সামনে ভেসে উঠল বাবা মায়ের মুখ। তারপরেই জ্বলজ্বল করে প্রদীপের মতো জ্বলতে দেখা গেল ভাইয়ের মুখাবয়ব টা।
তুহিন এক হাত দিয়ে শিফুর পিঠ আঁকড়ে রেখে অন্য হাত তার মাথায় রাখল। আদুরে ভঙ্গিতে হাত বুলাতে বুলাতে ক্ষীণ গলায় বলল,
“পরিস্থিতি এত বাজে ছিল যে আমি শুধু বদ্ধ রুমে তোমার জন্যে ছটফট করেছি।”
শিফু শক্ত করল নিজেকে। দুই হাত দিয়ে তুহিন কে নিজের থেকে ছাড়াল। কঠোর মুখে বলল,
“এত রাতে আপনি আমার রুমে কি করছেন তুহিন ভাইয়া?”
তুহিনের কপালে ভাজ পড়ল। শঙ্কিত নজরে সে দেখল শিফুকে। কপালের সরু ভাবটা আরো সূক্ষ্ম হয়ে উঠল। মেয়েটার কি হয়েছে? মজা করছে কি? তাকে তো কখনো ভাইয়া বলে ডাকেনি। তবে?
“শিফু আমি তোমার ভাইয়া কবে থেকে হলাম?”
তুহিনের অস্থির মুখটা দেখে শিফুর নিজের কাছে বড্ড অসহায় লাগল। কোরিয়ান ড্রামার মতো দেখতে এই তুহিন কে যে সে অপছন্দ করে তেমনটা মুটেও নয়। বরং তার উঠতি বয়সে জন্ম নেওয়া তুহিনের প্রতি অনুভূতি গুলিকে সে চিরপরিচিত চার অক্ষরে শব্দটা বসিয়েছে। তবুও কোথাও একটা কিন্তু তাকে বুঝি আগুন থেকে টেনে আনছে। বাবা সবসময় বলেন “শিফু কখনো কোনো ভুল করো না মা।” শিফু বুঝে বাবা কোন ভুলের কথা ইঙ্গিত দেয়। মা উঠতে বসতে বলেন “শিফুরে কখনো এমন কিছু করিস না যাতে তোর বাবা ভাইয়ের নাক কাটা যায়। কাউকে পছন্দ হলে ভয় না পেয়ে আমাকে বলিস আম্মা। তবুও তোকে সাবধান। আশেপাশে কত কিছু শুনা যায়।” আর ভাইয়ার কথা তো সে মনেই করল না। তার ছোট্ট হৃদয়ে এখনো এত সাহস উদিত হয়নি যে বাবা মা ভাইকে ছাপিয়ে সে অনুভূতির দাম দিবে। কান্না পেলেও শিফু বলল,
“আপনি আমার থেকে বড় তুহিন ভাই। এত রাতে একা আমার ঘরে আসা ঠিক নয়। ভাইয়া দেখলে কেলেঙ্কারি হবে। আপনি প্লিজ যান।”
তুহিন ব্যস্ত হয়ে এগিয়ে এলো। শিফুর বাহু ধরে তার দিকে ফিরিয়ে বলল,
“এই শিফু কি হলো তোমার? তুমি এত অদ্ভুত আচারণ করছো কেন? তুমি তো এমন না।”
“হাত ছাড়ুন তুহিন ভাইয়া। আপনি আমার ঘর থেকে যান।”
“শিফু কি হয়েছে তোমার প্লিজ বলবে?”
“আপনাকে আমার ভালো লাগছে না। দয়া করে আপনি এখন যান। পায়ে পড়ি আপনার যান। ভাইয়া পাশের ঘরেই আছে। জানলে কি হবে জানেন?”
“যা হবার হবে। তুমি কি ভয় পাচ্ছো শিফু?”
শিফুর বুকের ভেতর তখন ধকধক করছে। থকথকে যন্ত্রণা অনুভব করছে। সহ্য করতে না পেরে জোরে জোরে শ্বাস টেনে সে খানিক উঁচু গলাতেই বলল,
“আপনি কি যাবেন তুহিন ভাইয়া? আপনি বুঝতে পারছেন না আমার ভালো লাগছে না? অসহ্য লাগছে। তবুও দাঁড়িয়ে আছেন কেন? যান। বের হয়ে যান।”
তুহিনের গলা ধরে আসছিল। তার হঠাৎ মেয়েদের মতো কান্না পাচ্ছে কেন? এই সামান্য বিষয়ে এত কষ্ট পেয়ে যাবে সে? না। নিজেকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করে তুহিন জবাব দিল,
“ওকে। এত হাইপার হইও না। চলে যাচ্ছি আমি। গুড নাইট।”
মোহমায়ার বাহুডোরে পর্ব ১৪
শিফু কম্পিত শরীর টেনে দরজার কাছে গেল। আগে উঁকি দিয়ে দেখল আশেপাশে কেউ আছে কিনা। পরক্ষণে আবার ঘাড় বাঁকিয়ে তাকাল ঘরের ভেতর। তুহিন তখন অদ্ভুত কাতর চোখে তার দিকে তাকিয়ে আছে। তা দেখেই মেয়েটা মাথা ঘুরালো বুক ফাঁটা যন্ত্রণায়। নিঃশব্দে তুহিন মাথা নুয়ে একেবারে নিচে নামল। দরজাটা লাগিয়েই মুখ চেঁপে ফুঁপিয়ে উঠল শিফুটা।