ভিলেন ক্যান বি লাভার পর্ব ৬৩ (৩)

ভিলেন ক্যান বি লাভার পর্ব ৬৩ (৩)
মিথুবুড়ি

‘চড়ুইয়ের কিচিরমিচিরে ভোরের নীরবতা ভেঙে যায়। তারা নিজ উদ্যোগে জানান দেয়, সূর্যী মামার জাগার সময় হয়ে এসেছে। সে প্রস্তুত সোনালি আলোর কোমল হাতছানিতে জাগিয়ে তুলবে নিদ্রিত প্রকৃতিকে। বুড়িগঙ্গার পাড়জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে পাখিদের সুরেলা প্রভাতবর্ণনা,বেহালার মতো বেজে ওঠে ডানা ঝাপটানোর সেই সুর। লাড়া নিশ্চলায় আলোছায়ার ছায়া গায়ে মেখে বসে আছে আকাশের নিচে সে যেন নিজেই এক প্রহরের প্রহরী। হঠাৎ বিষন্নতা ভারে নেতিয়ে পড়া ক্লান্ত, অবসন্ন শরীর হেলে পড়ল ঘাটের শেওলা মাখানো সিঁড়িতে৷ সোনালি কুন্তলরাশি অবিন্যস্ত ভাবে ছড়িয়ে পড়ে রইল পিছলে সিঁড়িগুলোয়। উজ্জ্বল, গোলাপ বর্ণের মূখশ্রী আজ নিষ্প্রাণ, বিবর্ণ। হৃদয়ের কুঞ্জবনে প্রেমের লহরি দুঃখের সাগরে আত্মত্যাগ করে, অপরাহ্নে নীরবতা তীব্র চিৎকার করে বাজতে থাকে সেথায়।

‘লাড়া শক্ত করে চেপে ধরল বুকের সেই জায়গাটাই, যেখানে ধুক-ধুকে শব্দ ধ্বনিত হচ্ছে মাত্রাধিক। পাখির সুমধুর ক্যাচক্যাচ শব্দের সাদৃশ্যে তা যেন সুকরুণ বেহালার সুর। ঘোলাটে হয়ে আসে চক্ষুদ্বয়। ফাঁপা, বিবর্ণ দৃষ্টিতে সে নিরলস তাকিয়ে থাকে মৃদু আলোয় আলোকিত শূন্য আকাশটাই। হঠাৎ মনে হলো পশ্চিম আকাশে একটা তাঁরা জ্বলজ্বল করে জ্বলছে। সে যেন তৃষিত চোখে তাকিয়ে আছে তার দিকে! সঙ্গ দিচ্ছে! নয়ত দিনের আকাশে তাঁরা ভেসে বেড়ানোর মতো অবিশ্বাস্য কথা সে ইহজন্মে শুনেনি। লাড়া তাচ্ছিল্যে হাসল। এমন উদ্ভট কর্মকান্ড তো শুধু একজনেরই মানায়। কে আর সে!

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

‘সেই বেপরোয়া, উশৃংখল প্রেম আহসান—অফিসার প্রেম আহসান। লোকটা আর পিছু ছাড়ল না। বিশাল এক প্রাচীর তাদের মাঝে নিটল দাঁড়িয়ে, সে চাইলেও এই প্রাচীর ভেদ করে লাড়ার কাছে আসতে পারবে না। পাশে বসতে পারবে না। সবসময়ের মতো বুড়ো আঙুলের ডগা দিয়ে আলতো করে চোখের পানি মুছে দিতে পারবে না। তাই হয়ত দূর থেকে নিবিড় পর্যবেক্ষণে রাখতে মেয়েটাকে, যাতে করে কোনোরূপ ভুল পদক্ষেপ নিয়ে না নেয়। এতোক্ষণ নিজেকে সামলাতে রাখতে পারলেও এবার ব্যর্থ হয় লাড়া। কোটর ভরে ওঠে শ্রাবণের ধারায়। অনুভূতির আন্দোলনে ঝিমঝিম করে উঠে বুক। লাড়ার মানসপটে স্মৃতির ধারা হয়ে ভাসতে সাথে একটি দীর্ঘদেহী অবয়ব, টোল পড়া হাসি, লম্বাটে দু’টো হাত।

‘হঠাৎ কাঁধে কারোর স্পর্শে অন্তরাত্মা কেঁপে উঠে। থরথর করে ঝাঁকুনি খেল নারী অস্তিত্ব। একটা হাত, শক্ত, খসখসে হাত। আঙুলগুলো লম্বা, লম্বা। গতি হারায় হৃদস্পন্দন। এটা কি আদৌতেও সম্ভব? দূর্বোধ্য লাড়া কাছে বোধহয় মনে হয় সম্ভব। সহসাই মোহাচ্ছন্ন হাসিতে উদ্ভাসিত হলো ঠৌঁটের কোণ। ভুবনজয়ী হাসি দিয়ে পিছন ফিরতেই থমকাল সে। সূর্য যখন ক্লান্ত হয়ে পশ্চিম আকাশে হেলান দিয়ে সমুদ্রের অতল গহ্বরে ডুব দেয়, ঠিক সেভাবে লাড়ার চোখেমুখের উজ্জ্বলিত শিখা আষাঢ় আঁধার নিয়ে তলিয়ে গেল। কার্নিশদ্বয়ের নোনাজল মেঘের মতো ঝড়ে পড়ল গাল বেয়ে। মুখ ফিরিয়ে নেয় সে। তাকবীর নৈঃশব্দ্যে আসন পাতল লাড়ার পাশে। হাতে থাকা মদের বোতল দু’টো রাখল তাদের মাঝখানে। লাড়া ফিরে তাকাল না। শেওলা ধরা সিঁড়িতে অপার্থিব সৌন্দর্য খুঁজে পেয়েছে সে। বিরস মুখে তা দেখে যাচ্ছে অদ্ভুত ভাবে।

‘প্রলম্বিত শ্বাস ফেলল তাকবীর। মাথার কালো ক্যাপ’টা খুলে ছুঁড়ে মারল বুড়িগঙ্গার টলটলে পানিতে। মুহূর্তেই তা তলিয়ে গেল নদীগর্ভে, ঠিক যেভাবে দু’টি ভগ্নহৃদয়ের সমস্ত আশা, ভরসা, শিরা হতে হৃদয়ে বয়ে আসা ভালোবাসা, মনভর্তি প্রেমফুল, পাষন্ড বুকে সৃষ্টি মায়ার উদ্রেক, পূর্ণতার তীব্র আকাঙ্ক্ষা সমস্তটা তলিয়ে গিয়ে ঠাঁই পেয়েছে ব্যর্থতায়, শূন্যেতায়। তারা নিভৃতে বসে রইল কিছুক্ষণ। কেউ কথা বলল না কারো সাথে।
দুজনেই যেন অবগাহন করেছে বীজগণিতের কোনো জটিল অঙ্কের সমাধানে।
“কষ্ট পুষে রাখতে নেই। কষ্টের সময় কাঁদতে হয়, নিজেকে ভেঙেচুরে দিয়ে কাঁদতে হয়। তাহলেই কষ্ট ঝেড়ে ফেলা যায়। ভারাক্রান্ত মন নিয়ে জীবন পার করতে নেই। রুহের অভিশাপ লাগে। ভালো থাকার সবচে বড় টনিক হল কাঁদা। কাঁদুন, শ্রবাণের ধারা মতো। যে কাঁদতে জানে, তার কোনো কষ্ট থাকে না।

‘লাড়া মেঘ দৃষ্টিতে তাকাল তাকবীরের দিকে। জড়িয়ে আসা কণ্ঠে উলটে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিল,
“মস্তিষ্কে যে ‘সে’ নামক পোকা ঘাঁটি গেড়ে বসে আছে, তার ব্যবস্থা কি?”
‘তাকবীর পিছনের উঁচু সিঁড়িয়ে হাতের ভর দিয়ে শরীর খানিকটা এলিয়ে দিয়ে আয়েশ করে বসল। নিক্ষিপ্ত কণ্ঠের জবাব এল তার কাছে থেকে,
“শূন্য মস্তিষ্কে আবেগের আশ্রয় নিয়ে এমন অনেক পোকা ঘাঁটি গেড়ে বসে। তাই তো প্রকৃতি শূন্যেস্থান পছন্দ করে না।”
“শূণ্যস্থান পূর্ণ করতে বলছেন?”

‘তাকবীর চিবুক ফেরাল লাড়ার দিকে। ঠৌঁট বাঁকিয়ে হেসে উপরনিচ মাথা নাড়িয়ে বলল,”এক্সজেক্টলি।”
‘লাড়া ফের আকাশ পানে চেয়ে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,
“আর না। শূন্যস্থান শূন্যই থাক তবুও ভুল মানুষ দ্বারা পূর্ণতা না পাক।”
‘তাকবীর নিশ্চুপ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে লাড়ার দিকে। সূর্য এখনও সেরকম ভাবে পূর্ণ রূপে ফেরেনি। চারিপাশটাই আলোছায়া, আলোছায়া।
“সে কি তবে ভুল ছিল?”

‘তাকবীরের মুখনিঃসৃত শব্দগুলো অতি সাধারণ হলেও লাড়ার কাছে জটিল অংকের মতো লাগল। তার বুক চিঁড়ে করুণ দীর্ঘশ্বাস বেরুলো। অপ্রসন্ন প্রহরের বাস্তবতা মেনে নিয়ে লাড়া প্রসন্ন মনে বলে উঠল,
“ভুল ছিল আমার ভালোবাসা।”
‘লাড়ার চোখদুটো ছলছল করে। বড্ড উদাস, ব্যথাতুর দেখাল তার পেলব মুখ। তাকবীর বিরস মুখে তাকাল লাড়ার দিকে। কিছু বলতে যাবে তার আগেই লাড়া মেঘস্বরে বলে উঠল,

“এই অমোঘ ভালোবাসা, নিগূঢ় বন্ধন আর প্রগাঢ় অনুভূতির মধ্যেবিন্দুতে আমি নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছি।”
‘আঁচড়ে পড়া হাহাকার যেন ছড়িয়ে পড়ল নিমিষেই। তাদের ঘিরে ধরল ভয়াল নিস্তব্ধতা। তাকবীরের মুখটা পাথরের মতো শক্ত ও চোখেমুখে অনুভূতি ছোঁয়া না থাকলেও লাড়া কথাগুলো খুব গভীর ভাবে অনুভব করল সে। তার হৃৎকমলে নিরবে বহন করা যন্ত্রণা বেদনার কণ্টকময় পথ ধরে শ্রাবণ ধারার মতো বেরিয়ে আসার বায়না ধরল। শীতল আত্মব্যথা ও অভ্যন্তরীণ তোলপাড় নিয়ে তাকবীর তৎক্ষনাৎ উঠে দাঁড়াল, নিজেকে আড়াল করতে। অকস্মাৎ লাড়া তাকবীর’কে জাপ্টে ধরল। তাকবীর তাল সামলাতে না পেরে দু’কদম পিছিয়ে গেলেও পরমুহূর্তে সামলে নিল নিজেকে। কালো মেঘে ঢাকা আকাশ হতে ভাঙনের যে শব্দটা আসে, সেই শব্দগুলো বেরুতে থাকে লাড়ার অন্তরের অন্তস্তল হতে,

“রিচার্ড আমাকে ভালোবাসেনি। ভালোবাসেনি আমাকে। তার হৃদয়ে এক বিন্দু আঁচড় কাটেনি আমার ভালোবাসা। অথচ তার প্রেমে দগ্ধ হয়ে পুড়েছি আমি অজস্রবার। আমাকে কেনো ভালোবাসল না রিচার্ড? প্রেম আমাকে কেন ছেড়ে চলে গেল? কি ভুল ছিল আমার? সবাই আমাকে ছেড়ে চলে যায় কেন?”
‘থেমে, নিঃশ্বাস টেনে আবারো বলতে থাকে,
“আমি তাকে হাজার চেয়েও পেলাম না, অথচ অন্য নারীকে সে জোর করে নিজের করে নিল। সে নারীর জন্য নিজ সত্তায় পরিবর্তন এনেছে সে। অথচ আমি তাকে ঠিক সেভাবেই চেয়েছিলাম, যেভাবে চাইলে আর কোনো অভিযোগ থাকে না।”

‘তাকবীর অপ্রতিভ মুহুর্তে পড়ল। লাড়াকে ছুটাতে চাইল নিজ বাহু হতে। হোক মেয়েটা ক্ষত-বিক্ষত, ভাঙা তবুও তার
সংস্পর্শে অস্বস্তি লাগে তাকবীরের। তবে লাড়া সরে না। জোকের মতো কামড় দিয়ে ধরে রাখে তাকবীর’কে। দীর্ঘদিন ধরে বয়ে আসা অন্তর্হিত কান্না আজ পাঁজর ভেঙে বেরুয়। প্রকৃতির মতো প্রফুল্ল প্রাণ আজ বিভীষিকা। চোখের তাঁরা ফ্যাকাশে, যেন আলো নিভে গিয়েছে ভেতরের। অসহায়ের মতো গোঙানির শব্দে আওড়াতে থাকে,
“ফেন্ডস ‘রা বলে লাড়া মুভ অন কর। তাদের আমি কিভাবে বলি—যেই মানুষটার সাথে আমি গোটা একটা জীবন পার স্বপ্ন দেখেছিলাম, তাকে কি ভুলা যায়? তার সাথে আমি সংসার করতে চেয়েছিলাম, সারাটা জীবন কাটাতে চেয়েছিলাম। সে মানুষটাকে আমি কিভাবে ভুলে যায়—যার প্রতিটা তীক্ষ্ণ কথার আঁচড়ে আমার রহু পর্যন্ত কেঁদেছিল। এমন মানুষকে তো ভুলা যায় না—যাকে দু-চোখ ভরে দেখেও ছুঁতে পারিনি আমি। সে তো ভুলবার নই, যাকে আমি সবকিছুর উর্ধ্বে গিয়ে ভালোবেসেছি।”

‘লাড়া ক্রন্দরত প্রতিটি কথায় মুচড়ে যাওয়া এক অনুভূতি তাকবীরের বুকের মাঝখান দিয়ে বয়ে গেল। সে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে। কন্ঠরোধ। লাড়া অঝোরে কেঁদে যাচ্ছে। কান্নার তোড়ে শরীর কাঁপছে থরথর করে। গুমরে ওঠা যন্ত্রণায় সে আরো বলতে থাকে,

“আমি কখনো মায়ের ভালোবাসা পাইনি, বাবার ভালোবাসা পাইনি। সৃষ্টিকর্তা আমাকে প্রিয় পুরুষের একটু ভালোবাসা দিত! তার কি খুব ক্ষতি হয়ে যেত? লোকটাকে আমি মাথার তাজ করে রাখতাম। সারাজীবন খোদার আনুগত্য করতাম। তাকে পেয়ে গেলে খোদা ছাড়া আর কারোর জন্য চোখের পানি ফেলতাম না আমি। কিন্তু, সৃষ্টিকর্তা এটা কেন করল? এই না পাওয়ার ব্যাথা আমাকে সারাজীবন বহন করে যেতে , কারণ আমি মরতে পারব না। পারব না আমি নিজেকে শেষ করতে। মৃত্যুর মুহুর্তেও যে আমার চোখের তৃষার্ত দৃষ্টি তাঁর-ই সন্ধান করতে। আমার চাই না সেই মুহুর্তটা আসুক আমার জীবনে। আমি ঘৃণা করতে চাই তাকে, মুছে দিতে চাই আমার মন থেকে।”
‘মেয়েটার এহেন আহাজারিতে তাকবীরের পাষণ্ড বুকে মায়ার উদ্রেক হয়। সুনিপুণ বিষ্ময় ফুটিয়ে তুলে সে তাকাল লাড়ার দিকে। এই মেয়েটাকে নিয়ে ধারণা ছিল অন্যরকম। আর সকলের মতো সেও ভেবেছিল মেয়েটা খুব অহংকারী, কঠোর আর সূর্য রশ্মির মতো তীব্র তেজ। আজ সকল ভাবনার ওপরই পানি ঢালল লাড়া। এতোক্ষণ যাবত নিজের অনুভূতিকে সামলে রাখলে পারলেও, তার নিয়ন্ত্রণে ফাঁটল ধরালো এই মেয়ের আকাশছোঁয়া কান্না। তাকবীর ফোঁস নিশ্বাস ছেড়ে নিস্পৃহ কণ্ঠে বলল,

“বিষন্ন মনে কাউকে শান্তনা দিতে নেই। তাহলে অপরপক্ষ বিপথে পরিচালিত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।”
‘থেমে,
“শুধু বলব, মানুষের মন, মানুষের সবথেকে বড় শত্রু। একে প্রশয় দিতে নেই। বাচ্চাদের মতো ধ্বংসের আবদার করতেই থাকে।”
‘লাড়ার শরীর টলতে থাকে। তাকবীর লাড়াকে ছাড়িয়ে সোজা করে দাঁড় করায়। অতঃপর ওর দুই কাঁধে হাত রেখে গম্ভীর গলায় বলল,
“মেয়েদের ভালোবাসায় আবেগ বেশি। আর পুরুষদের ভালোবাসায় গভীরতা। আপনার এই কান্না অন্যের কান্নার কারণ হতে পারে। সুতরাং, শান্ত হোন।”

‘নদীতটে ঠান্ডা হাওয়া বইতে শুরু করল আচমকা। তাকবীর একটা মদের বোতল তুলে লাড়ার দিকে এগিয়ে দিল। লাড়া ভ্রু কুঞ্চিত করে তাকাল তাকবীরের শ্যামবর্ণে। যদিও শ্যামবর্ণ এখন কৃষ্ণবর্ণে রুপান্তরিত হয়েছে। তাকবীর ভ্রু নাচিয়ে ইশারা করল। লাড়া সঙ্গে সঙ্গে তাকবীরের হাত থেকে মদের বোতল ছিনিয়ে নিয়ে মুখে পুড়ে দিল। এক নিঃশ্বাসে শেষ করল সে সম্পূর্ণ বোতল। নিজেকে অনুভব করল ভূমিকম্পের কেন্দ্রবিন্দুতে আটকে থাকা পুরোনো ভাঙাচোরা একটা দালান। পা যেন জমাট বাঁধা ভারি সীসার মতো। পৃথিবীটা গোল হয়ে ঘুরতে তার চারপাশে। চোখের সামনে সব ঝাপসা। শরীর একবার এদিকে ছুটছে, তো আরেকবার ওদিকে। কানের ভেতর মৌমাছির মতো শোঁ, শোঁ আওয়াজ হচ্ছে। মস্তিষ্ক, নিউরন,শ্রবণ ইন্দ্রিয় ঝাঁঝরা করে দিচ্ছে মৌমাছির ঝাঁকে’রা। হঠাৎ তাকবীর উচ্চশব্দে বলে উঠল,

“মিস লাড়া, কাঁদুন, শব্দ করে কাঁদুন।”
‘লাড়া শুনলো কথাগুলো। তারপর কি জানি কি হলো। হঠাৎ লাড়া হাঁটু ভেঙে বসে পড়ল সিঁড়িতে। আকাশ পানে চেয়ে চিৎকার করতে থাকে। তার কণ্ঠনালীর রগ গুলো দৃশ্যমান হয়, ফুলেফেঁপে ওঠে। বুকের গভীর থেকে ক্ষতের আতর্নাদ চিৎকার দিয়ে বেরোয়,
“আল্লাহ! ইয়া আল্লাহ! সবটা আপনার হাতে ছিল, সবটা ছিল। আপনি চাইলেই পারতেন তাকে আমার করে দিতে। কিন্তু আপনি চাননি। তার আমার হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু আপনি তাকে আমার করে দেননি। আমি কষ্ট পেয়েছি, খুব, খুব। ইয়া রব, শুনতে পাচ্ছেন আপনি? আমি খুব কষ্ট পেয়েছি। আপনার এই নিষ্ঠুর ফয়সালা আমার মন ভেঙে দিয়েছে।”

‘তাকবীর সময় নিয়ে লাড়াকে সামলালো। তারা এখন পাশাপাশি বসে আছে। অবশিষ্ট বোতল টা আর সে খেলো না। লাড়া গিলে যাচ্ছে সেই কখন থেকে একটু, একটু করে। নেশা বেশ ভালোই চড়ে গিয়েছে। এখন আর কাঁদছে না লাড়া। বরংচ অযথা হাসছে—জোরে, জোরে, শব্দ করে, উন্মাদের মতো। তাকবীর অবশ্য বাঁধা দেয়নি। তার মাঝে আজ অদ্ভুত দৃঢ়তা। বিরহবিধুর মন’কে কি দিয়ে বুজ দিয়েছে লোকটা কে জানে।
‘লাড়া হঠাৎ বাচ্চাদের মতো কান্না শুরু করল। ঠৌঁট উলটে প্রশ্ন করে,
“রিদ, কেন আমার হলো না?”
‘তাকবীর স্নেহার্দ্র দৃষ্টিতে তাকাল লাড়ার দিকে। ইতোমধ্যে সে বুঝে গিয়েছে, মেয়েটা উপর দিয়ে যেমনই হোক, ভেতরে ভেতরে খুবই ভঙ্গুর। তাকবীর জবাব দিল নরম গলায়,

“স্রষ্টা চায়নি তাই।”
“স্রষ্টা চায়নি?”
“স্রষ্টার হুকুম ছাড়া গাছের একটা পাতাও নড়ে না। সুতরাং, আপনার-আমার চাহিদায় কিছুই হবেনা। অযথা প্রত্যাশা ছেড়ে দিন।”
‘লাড়া ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে তাকবীরের দিকে। সে শুরু থেকেই দেখে এসেছে মানুষটা তার ভালোবাসার ক্ষেত্রে কতটা ভঙ্গর, অথচ আজ?
“তাহলে স্রষ্টার হুকুমেই আমার এই পরিণতি।”
‘লাড়ার নির্বোধ প্রশ্নে তাকবীরের ঠৌঁটে এক চিলতে হাসি ফুটে। সে ঠৌঁটের কোণে হাসির রেখা ধরে রেখেই প্রত্যুত্তর করল,

“স্রষ্টার হুকুম তো অবশ্যই, তবে নিজ কর্মের ফলও বলতে পারেন।”
‘লাড়ার চোখমুখে জ্বলজ্বলে বিস্ময়,”কর্মের ফল?”
“একজন পুরুষ বিবাহিত জানা সত্ত্বেও তার প্রতি ভালোবাসায় পড়া, তা যতই হৃদয়ের তাগিদ হোক, সেটি পাপ। পবিত্র সম্পর্কের পরিধিতে এমন নিষিদ্ধ আকাঙ্ক্ষা স্রষ্টার বিধানের পরিপন্থী, আত্মার শান্তি থেকে বিচ্যুতির নাম।”
“তাহলে তো সমান পাপি আপনিও।”
‘তাকবীর মাথা দুলিয়ে কুটিল হাসল। এমন, যেন সে খুবই মজাদার কিছু শুনেছে। হঠাৎ হাসি থামাল সে। বিরস মুখে তাকাল লাড়ার দিকে, বলল,
“হ্যাঁ, তা তো অবশ্যই।”
“আপনার কষ্ট হচ্ছে না?”
“মৃত মানুষের আবার কিসের কষ্ট? কষ্ট তো শুধু জীবিতদের হয়।”
‘লাড়া নির্বাক। পলকহীন তাকিয়ে থাকে তাকবীরের চিরায়ত গম্ভীর অবয়বে। তাকবীর স্নান হাসল, হেসে নিজে থেকেই বলতে শুরু করল,

“জগতের সবচেয়ে সুন্দর ও নির্মম আফসোস কি জানেন?নিজেকে নিজ হাতে নিঃশেষ হয়ে যেতে দেখা। আপনি জানেন, আপনার ভেতরটা শূন্য। জানেন, জীবনে আর কোনও লক্ষ্য নেই, কোনও ছুটে চলার রং নেই। যেটা আপনি প্রাণপণে চেয়েছিলেন, সেটা না-পাওয়ার যন্ত্রণা আপনাকে নিঃশেষ করে দিয়েছে। আপনি জানেন, নিজেকেই আর বিশ্বাস হয় না। এখন আপনি শুধু বেঁচে আছেন,শুধু নিঃশ্বাস নিচ্ছেন৷ আর ভিতরে? সেই প্রাণবন্ত, হাসিখুশি মানুষটা,সে তো বহু আগেই হারিয়ে গেছে। চুপিচুপি। নিঃশব্দে। চিরতরে। আমি তাকবীর দেওয়ান আর নেই। আমি বাস্তবতার করুন বেড়াজালে আটকা পড়া একটি মৃত দেহ। সে দিনের প্রহরের মতো গুনছে সেই দিনটার, যেদিন সকলে আর লাশের সামনে বড়ো আফসোসের সুরে বলবে, পাগলটা অবশেষে মুক্তি পেলো।”

“আপনার উচিত সুইসাইড করা।”
‘সঙ্গে, সঙ্গে তাকবীরের মুখাবয়বে আঁধার নামে। চোখে ফুটে ওঠে অজানা ভয়। সে তড়িঘড়ি করে মাথা নেড়ে বলল,
“আত্মহত্যা করলে যে পরপারে তার সাথে দেখা হওয়ার কোনো সম্ভাবনা আর থাকল না।”
‘লাড়া মাথা ভারি ভারি লাগছে। সে শুয়ে পড়ল সিঁড়ির উপর। নিভে আসা কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল,
“এতো কষ্ট দিয়ে বাঁচা যায়?”
“শরীর কাঁটা বিঁধলে, পরবর্তীতে তাতে লবণ-মরিচ পড়লে যেমন জ্বালা ধরে, কিন্তু মরণ হয় না,ঠিক তেমনই কিছু মানুষ আমাকে এমনভাবে আঘাত করছে, যে আমি যন্ত্রণায় ছটফট করছি, তবু মরতে পারছি না। শুধু টিকে আছি, প্রতিটা নিঃশ্বাসে যন্ত্রণা বয়ে নিয়ে।”

‘তাকবীর গভীর নিঃশ্বাস নিল। থেমে, কথার শেষে আরো সংযোজন করল,
“জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত যেন একেকটা যুদ্ধ। কখনো সময়ের সঙ্গে, কখনো কাছের মানুষের, কখনো বা নিজের ভেতরের টানাপোড়েনের সাথে। আজ এমন এক মোড়ে এসে দাঁড়িয়েছি, যেখানে পাশে কেউ নেই। নিঃসঙ্গতা ঘিরে ধরেছে চারদিক, তবুও কোনো আফসোস নেই জীবনের প্রতি। বরং এখন দেখতে চাই আমার ধৈর্যের সীমা কতদূর, কতটা আমি সহ্য করতে পারি, কতটা মানিয়ে নিতে পারি এই কঠিন পৃথিবীর সাথে। মানুষের দুঃখ বুঝতে একজন মানুষ লাগে, আমার সেই মানুষটাও নেই। আর কেমনে বুঝায়, আমি কতোটা অসহায়।”

“এই পৃথিবীতে সবথেকে বেশি ঘৃণা কাকে করুন?”
“আমার নিয়তিকে।”
“তারপর?”
“আমাকে।”
“আর?”
‘তাকবীর তপ্ত শ্বাস ফেলল। বন্ধ চোখ মেলে দিল
সে চায় না লোকটার অবয়ব তার চোখের সামনে ভেসে উঠুক। শূন্য অভিব্যক্তিতে বলল,
“আমার বাবা’কে। ওহ, সে তো আমার বাপ-ই ছিল না।”
‘নেশাগ্রস্ত লাড়া একের পর এক প্রশ্ন করেই যাচ্ছে রেলগাড়ীর মতো। পাশে বসা মানবটার ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে ফের প্রশ্ন ছুড়ল,

“আর কাউকে ঘৃণা করেন নাহ?”
‘এবারের উত্তর তাকবীর আকাশের দিকে তাকিয়ে দিল,”করি।”
“কাকে?”
“আমার মা’কে।”
‘শোচনীয় বিস্ময়ে লাড়া তড়াক উঠে বসে। নেত্রে চকচকে কৌতুহল লেপটে আছে। রকেট গতিতে বলে উঠল,
“মাকে?”
‘তাকবীর উপরনিচ মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বলল।
‘লাড়া হতচকিত হয়ে ছটফটিয়ে উঠল। বলল,
“কেন?”
‘তাকবীর বিরস মুখে জবাব দেয়,

“তার উচিত হয়নি আমাকে পেলেপুষে বড় করা। তখনই নুন খাইয়ে মেরে ফেলত, তাহলে এই দুনিয়ায় না হোক, ওই দুনিয়ায় সুন্দর একটা জীবন পেতাম আমি।”
‘লাড়ার মনে সুক্ষ্ম ব্যাথা হয় তাকবীরের জন্য। লোকটার আচরণ শুরু থেকেই তার কাছে বড্ড অদ্ভুত ঠেকছে। সে ভেবেই রেখেছিল আজকের পর হয়ত তাকবীর দেওয়ান নামক কারোর অস্তিত্ব থাকবে না এই ভুবনে। তা না হলেও অন্তত কাঁদবে মানুষটা, এইটুকু আশা রেখেছিল সে। তবে তাকে অবাক করে দিয়ে তাকবীর তেমন কিছুই করছে না। উলটে, তাকে সামলাচ্ছে, শান্তনার বাণী আওড়াচ্ছে। এক অদৃশ দৃঢ়তা ভর করেছে লোকটার মাঝে। প্রতিটি কথায় অসীম পরিপক্কতা, চিবুকে জেগে থাকা এক নির্মল দৃঢ়তা। অভিব্যক্তি পাথরের ন্যায় শক্ত, কণ্ঠস্বর ইস্পাতের মতো ধারালো—আর ঠোঁটে? আজও, সবসময়ের মতো সেই অমলিন, অমায়িক হাসি।

‘লাড়া তাচ্ছিল্যে হেসে বড়ো আফসোসের সুরে বলল,
“আপনার তো তবুও ভাই আছে, আমার তো কেউ রইল না। আমার ড্যাড বর্তমানে কোথায় সেটাও আমি জানি না।”
‘তাকবীর প্রশ্নের পিঠে প্রশ্ন ছুড়ল তৎক্ষনাৎ,”আমার ভাই?”
‘লাড়া চেয়ে থাকে তাকবীরের দিকে, তবে কিছু বলতে পারে না। তাকবীর চমৎকার হাসল। অনড়ভাবে মাথা নাড়াতে নাড়াতে বলল,

“তা অবশ্য ঠিক। আমার ভাই, আমার রক্ত আছে এখনো। হয়ত এই রক্তের টানের জন্যই আমি এখনও বেঁচে আছি। বেচারা চাইলেও আমাকে মারতে পারছে না। মাঝেমাঝে মনে হয়, আমার থেকেও দুঃখী ও। তাই তো নিঃশব্দে সরে এলাম। খুশি থাকুক ওরা। সুখী হোক আমার ভাই আর আমার শখের নারী।”
‘হঠাৎ, আবারও প্রেমো বেদনায় বুঁদ হয়ে ওঠে লাড়া। নেশার ঘোরে হাত-পা ছুড়ে কাঁদতে থাকে সে। এবার আর বুঝে উঠতে পারে না তাকবীর, কীভাবে সামলাবে এই মেয়েকে। লাড়া বাচ্চাদের মতো ঠৌঁট উলটে কাঁদতে কাঁদতে বলে,
“কিভাবে আমি সহ্য করব?”

‘তাকবীর ঠান্ডা মাথায় লাড়াকে হ্যান্ডেল করার চেষ্টা করল। বলল,
“নিজের সহ্যশক্তি কতটা, তা বোঝার জন্যও কষ্ট পাওয়াটা দরকার। আর সবচেয়ে মূল্যবান কথা হল,ওজনের বেশি কোনো কষ্টই খোদা কাউকে দেন না। যে যতটা সহ্য করতে পারে, তাকেই ততটা দেন তিনি।”
‘লাড়া তবুও ফ্যারফ্যার করে কাঁদতে। তাকবীরের কথার পৃষ্ঠে সৃষ্টি হয় তার নতুন প্রশ্ন।
“আপনি এখনও বেঁচে আছেন কেন? এই পৃথিবীতে আপনার আপন বলতে তো আর কেউ রইল না।”
‘তাকবীর লাড়া কাছ থেকে সরে এসে সোজা হয়ে বসল। আড়চোখে লাড়ার দিকে তাকিয়ে বলল,
“সত্যি বলব, হাসবেন না তো?”

‘লাড়ার বিলম্বহীন জবাব,”হাসব না।”
‘তাকবীর চোখ বুজল। সঙ্গে সঙ্গেই তার মানসপটে ভেসে উঠল লালচুলে এক রুশকন্যা। ঠোঁটের কোণে মোহাচ্ছন্ন হাসি ফুটে উঠল। চোখ বুঁজে প্রেমের সাগরে ভেসে সে নিঃসঙ্কোচে বলে উঠল,
“আমার এলোকেশীর জন্য।”
‘লাড়া এবার কোনো ঘুরপাক না খেয়ে সোজাসাপ্টা বলল,
“তার আসার সম্ভাবনা যে একেবারেই ক্ষীণ।”

‘তবে তাকবীরের কণ্ঠে ছিল আত্মবিশ্বাসের দৃঢ়তা। সে নিশ্চিন্ত কণ্ঠে বলল,
“আমার বিশ্বাস, সে আসবেই। আমাদের মাঝখানে যে এখনও অনেক হিসেব-নিকেশ বাকি রয়ে গেছে।”
“হিসেব-নিকেশ?” লাড়া ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল।
“সেসব বাদ দিন। যখন বলেছি সত্য বলব, তখন সত্যই বলছি—আমি বেঁচে আছি কেবল এটা দেখার জন্য, কে আগে আসে—সে, না মালাকুল মউত।”
‘লাড়া শব্দ করে হেসে উঠল। তাকবীর একবারও ফিরে তাকাল না। সে অপলক চেয়ে রইল, সূর্য কীভাবে ধীরে ধীরে মাথা তুলছে। সূর্যাস্তের ক্ষীণ আলোয় দাঁড়িয়ে, অস্পষ্ট স্বরে নিজের মতো করে বলে উঠল,
“ধ্বংসের শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়েও আমি আমার ধ্বংসকারীকেই ভালোবাসি।”

‘তাকবীর একটা ভাড়া গাড়িতে লাড়া’কে হোটেলে পাঠিয়ে দিল। সে এখন দাঁড়িয়ে আছে ঘাটের ধারে বিশাল এক বটগাছের ছায়ায়। রোদের কাঁপা কাঁপা আলো যেন তার মুখের ক্লান্তি, ভেতরের ধ্বংস দেখতে পাচ্ছে স্পষ্টভাবে। তাকবীর চুপচাপ তাকিয়ে আছে নিজের ছায়ার দিকে। শূন্যতা ও আত্মসমালোচনার এক নিঃশব্দ প্রতিবিম্ব মাটিতে। মানুষ যখন একা হয়ে যায়, তখন আর কেউ তাকে রুখে রাখতে পারে না নিজের সত্যের মুখোমুখি হওয়া থেকে। তাকবীর আজ দাঁড়িয়েছে সেই সত্যের সামনে। যদিও সে একটুও প্রস্তুত ছিল না। এই প্রস্তুতির কোনো প্রার্থনা সে করেনি কখনো। তার চোখ থেকে টপটপ করে ঝরে পড়ছে নিঃশব্দ অশ্রু। হঠাৎ, তার ভেতরে জমে থাকা সমস্ত নীরব যন্ত্রণা ছিঁড়ে বেরিয়ে এলো। সে আকাশের দিকে তাকিয়ে অভিমান ভরা কণ্ঠে চিৎকার করে উঠল,
“সেই রঙ প্রিয় কেন করলে খোদা, যে রঙ গায়ে মাখে না।”

‘ভেঙে পড়ল তাকবীর। মাটিতে মুখ গুঁজে হাউমাউ করে, চিৎকার করে কাঁদে লোকটা। ঠিক যেমন করে কাঁদে কেউ প্রিয়জনকে হারিয়ে। তার বাবার মৃত্যুদিনেও চোখের জল ফেলেনি এই পুরুষ, শেষবার এভাবে ভেঙে পড়েছিল মায়ের বিদায়ে। আজ আবারও সেভাবে কাঁদছে তার শখের নারীকে হারিয়ে। তাকবীর আচরণে পাগলের ছাপ। ক্ষতবিক্ষত হৃদয়ের রক্তাক্ত হিংস্রতা যেন ফুটে উঠল তার দৃষ্টিতে। দু’হাত মুষ্টিবদ্ধ করে একের পর এক আঘাত করতে থাকে নিজের মাথায়। ভোরের স্তব্ধ মাটিতে টপ টপ করে ঝরে পড়ে তার চোখের জল। হিংস্র আর্তনাদের মতো চিৎকার করে যায় শুধু। চোখের পানির সাথে পাল্লা ধরে চিৎকার করে যাচ্ছে। বহুদিন ধরে জমে থাকা যন্ত্রণাগুলো একে একে দল বেঁধে বেরিয়ে আসে বুক ফুঁড়ে। তাকবীরের কণ্ঠ ফেটে যায়, গলা রুদ্ধ হয়ে আসে, তবুও সে থামে না। তার কান্নার চিৎকারে কাছে বসে থাকা পাখিরা উড়ে যায় ঘাট থেকে ভীত হয়ে।

‘ঠিক তখনই হঠাৎ দমকা হাওয়া। মনে হয় এই ভোরে বৃষ্টি নামবে। বাতাসের তীব্রতায় সমস্ত কিছু উড়ে যাচ্ছে, নদীতে উঠেছে জলোচ্ছ্বাস। ঝড় আর ঢেউয়ের মাঝে মাটিতে লুটিয়ে পড়া এক ব্যর্থ প্রেমিক নিজেকে আঘাত করে চলেছে বারবার। বুক চিড়ে বের করে দিচ্ছে জমে থাকা অভিমান। মাটিতে মাথা গুঁজে, শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে ঘুষি মারতে থাকে তাকবীর। তার বুকের ভেতরটা ফেটে যাচ্ছে। মৃত্যু যন্ত্রণায় ছটফট করছে সে। আজ চোখের জল যেন ফুরোয় না। কণ্ঠস্বর ভেঙে যায়, তবু কাঁদে নির্লজ্জ লোকটা। চিৎকার করে কাঁদে, শুধু কাঁদে। সমাজের চোখে পুরুষের এ কান্না লজ্জার। কিন্তু তাকবীরের আজ কোনো লজ্জা নেই। তাকবীর বারবার চিৎকার করে বলতে থাকে,

ভিলেন ক্যান বি লাভার পর্ব ৬৩ (২)

“কত রাত জেগে থাকলাম তোমার পাহারায়। বোকা আমি শুধু বাইরে দিয়েই পাহাড়া দিয়ে গেলাম। অথচ, ভিতরে ভিতরে আমার এলোকেশী মত্ত হয়েছিল তো অন্যতে।”
‘তখনই দূর থেকে বাতাসের মধ্যে হতে ভেসে আসে মেয়েলি কণ্ঠস্বর। কেউ খুব উদগ্রীব হয়ে ডাকল,
“মিনিস্টার সাহেব!”

ভিলেন ক্যান বি লাভার পর্ব ৬৩ (৪)