হামিংবার্ড পর্ব ৫৫
তাসমিয়া তাসনিন প্রিয়া
আরিশের জন্য অপেক্ষা করতে করতে ক্লান্ত শরীরে ঘুমিয়ে গিয়েছিল অরা। আরিশ বাসায় ফিরে মেয়েটাকে আর ডাকাডাকি না করেই ফ্রেশ হতে গেছে। অরা কখনো এরকম ঘুমিয়ে যায় না। তাই ব্যাপারটা অস্বাভাবিক লেগেছে আরিশের। ওয়াশরুম থেকে কেবল একটা তোয়ালে পরে বের হ’য়েছে সে। অরা গুটিশুটি হয়ে শুয়ে, ঘুমিয়ে আছে। ধীরপায়ে এগিয়ে গিয়ে তার পাশে বসলো আরিশ। মুখের ওপর পড়ে থাকা এলোমেলো চুলগুলো সরিয়ে দিলো। মেয়েটাকে জোর করে কীভাবে তার জীবনে আনলো সেসব ভাবনা মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। যতই হোক, লম্বা একটা বয়সের পার্থক্য। দুজনের মন-মানসিকতার পার্থক্য আছে। সবকিছুই বিপরীত। তবুও অরা সব মানিয়ে আছে। দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল আরিশ। মাঝে মধ্যে নিজের ওপর রাগ হয়। নিজের অসুস্থতার জন্য অরার সাথে হয়তো বেশিই অন্যায় করে ফেলেছে সে।
“ আপনি কখন এলেন?”
আচমকা অরার কণ্ঠস্বর শুনে নড়েচড়ে উঠল আরিশ। ভাবনায় মশগুল হয়ে ছিলো সে। অরা বড়ো বড়ো চোখ করে তার উন্মুক্ত শরীরের দিকে তাকিয়ে আছে। প্রসস্থ বুকে পানির ফোঁটাগুলো দেখে অরার যেন গলা শুকিয়ে আসছে আজ। নিজের অজান্তেই আরিশের বুকে হাত রাখলো সে। আরিশের শরীরে কম্পন অনুভূত হলো। অবাক দৃষ্টিতে অরার দিকে দৃষ্টিপাত করতেই হাত সরিয়ে ফেলল সে।
“ না মানে…. আসলে… পানি ছিলো তো তাই আরকি!”
আমতা আমতা করে বললো অরা। আরিশ অরাকে ধরে বসিয়ে ফেলল। ঠোঁটের কোণে তার দুষ্ট হাসির ঝিলিক। এক ঝটকায় অরাকে কোলে নিয়ে ড্রেসিং টেবিলের ওপর বসাল।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
“ আরে এখানে তো জিনিসপত্র রাখা আছে! বসানোর আর জায়গা পেলেন না!”
“ থাকুক। অযুহাত না দিয়ে সরাসরি বললেই পারো, আমার প্রতি আকর্ষিত হচ্ছিলে তুমি। “
“ কই? কখ..ন? মো..টেও না…”
আরিশ অরার থুতনি চেপে ধরে, কোমরে কঠিনভাবে স্পর্শ করে বলল,
“ মিথ্যা বলবে না। আই হেইট লাইস, হামিংবার্ড।”
অরা লজ্জায় মাথা নিচু করে ফেলল। আরিশের চোখমুখ বদলাচ্ছে। বহুদিন পর নিজের ভেতর নিয়ন্ত্রণহীন এক আরিশকে অনুভব করছে সে।
“ চেঞ্জ করে নিন। “
“ পরে করবো। “
“ কিন্তু…. “
অরা কথা শেষ করতে পারে না। আরিশের আগ্রাসী চুম্বনে বেসামাল হয়ে ওঠে সে। একদিকে যন্ত্রণা অন্য দিকে ভালোবাসার সুখ– দুই অনুভব করতে থাকে অরা। আরিশ যখন তাকে মুক্ত করে তখন ঠোঁট থেকে শুরু করে গলা, ঘাড়ে মৃদু জ্বলুনি টের পায় অরা।
“ ডিনার শেষ করে, তোমাকে খাবো। “
অরা আয়নায় নিজের দিকে তাকাল। গলায় নজর পড়তেই লজ্জায় ওড়না দিয়ে তা ঢেকে ফেলল।
“ আপনি আর বদলালেন না। “
“ আমি বদলালে তোমার ভালো লাগবে? “
“ নাহ। আপনি যেমন আছেন তাতেই সুখ, তাতেই আমার অসুখ। আমি এই সুখ অসুখ নিয়েই ভালো আছি। “
আরিশ পোশাক পরে নিলো এরমধ্যে।
“ তা ঠিক আছে। তোমার শরীর খারাপ বললে না কেন? আগামীকাল ডাক্তার আসবে বাসায়। যা যা সমস্যা সবকিছু বলবে উনাকে। “
“ তেমন কিছু হয়নি তো। এমনি ক্লান্ত লাগছিল। শরীরে ব্যথা….”
“ যাইহোক ডাক্তার বুঝবে। তবে হ্যাঁ মহিলা ডাক্তার আসবে। তাই কোনো সংকোচ করবে না। “
“ আচ্ছা। “
আরিশ আরকিছু না বলে অরাকে কোলে তুলে নিয়ে ঘর থেকে বেরুলো। অরা আরিশের হাবভাব বুঝতে পারছে না। কোলে করে কোথায় যাচ্ছে সে?”
“ এভাবে কোথায় যাচ্ছি? “
“ ডাইনিং রুমে। “
“ কী!”
“ জি। “
“ না মানে কেউ দেখে ফেলবে! লজ্জা…… “
“ অসুস্থ বউকে হাঁটতে দেওয়া যাবে না। লাজলজ্জা আপাতত একপাশে রাখো। তাছাড়া কোলেই নিয়েছি, অন্যকিছু করছি না। চুপচাপ চলো, খাবার খেয়ে নিবে। “
অরা আর কথা বাড়ালো না। কারণ আরিশ বরাবরই জেদি, একরোখা মানুষ। যা বলে তাই করে। কিছু বলেও ফেরানো যাবে না তাকে।
বৃষ্টিস্নাত সকাল। আড়মোড়া ভেঙে শোয়া থেকে উঠে বসলো মেহরাব। হাই তুলতে তুলতে ফোন হাতে নিয়ে, ঘাটাঘাটি করে দেখলো – গতকাল রাতে সাবিহা কল করেছিল। চমকাল মেহরাব। কল দিলো কখন? আর রিসিভও তো হয়েছে! তারমানে সে ঘুমের ঘোরেই সাবিহার সাথে কথা বলেছে কলে। কিন্তু কী বলেছে সেসব তো মনে নেই! তড়িঘড়ি করে সাবিহার নম্বরে কল দিলো সে। কিন্তু কল ঢুকলো না। নম্বর বন্ধ বলছে। চিন্তায় পড় গেলো মেহরাব। হয়তো ঘুমের ঘোরে এমনকিছু বলে ফেলেছে যার জন্য মেয়েটা রাগ করেছে। এমনিতেই সাবিহার রাগ বেশি। দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল মেহরাব। কী করবে এখন তাই ভাবতে লাগলো।
রোদের তাপে ঝলসে উঠেছে শহর। পিচঢালা রাস্তায় সূর্যের আলো ফুটেছে আগুনের রেখার মতো। হালকা ধুলোর আস্তরণে ধূসর ছোপ ছোপ ছায়া। গাড়ির হর্ণ আর মানুষের হাঁটার তাড়া মিলে দুপুরটা যেন হাঁফানো শহরের একটা ক্লান্ত শ্বাস।
দু’দিন হলো খান বাড়িতে আছে নয়না। বোনের সাথে ভালোই সময় কাটছে তার। সকালবেলা তামান্নার সাথে টুকটাক জিনিসপত্র কিনতে বাইরে গিয়েছিল নয়না। তখনই অরার জন্য একটা ব্রেসলেট কিনে এনেছে সে৷ ছোটো থেকে অরা সব সময় নিজের পছন্দের জিনিসটা নয়নাকে দিয়ে দিতো। আসলে অরার প্রিয় জিনিসপত্রের দিকেই নয়নার নজর থাকতো। তাই বোনের কথা ভেবে সব সময় নিজের জিনিসপত্র দিয়ে দিতো সে।
“ কী রে? ভাত খাবি কখন? বেলা তো কম হলোনা। না খেয়ে থাকলে চলবে?”
ড্রইং রুমে বসে আছে নয়না। হাতে ব্রেসলেটটা। বোনের কথাই ভাবছিল সে। বাইরে থেকে খেয়ে এসেছে বলে দুপুরের খাওয়াদাওয়া করেনি এখনও।
“ পেট ভরে আছে, আপু। পরে খাবো। তুমি এদিকে এসো। “
অরাকে পাশে বসাল নয়না। বোনের দিকে তাকিয়ে আছে সে।
“ বল, কী হয়েছে? কেউ কিছু বলেছে তোকে? “
“ আরে না। এ বাড়ির সবাই খুব ভালো। তোমার জন্য একটা জিনিস কিনে এনেছি, দেখো তো। পছন্দ হয়েছ?”
অরার হাতে ব্রেসলেট পরিয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করলো নয়না। ছোটো বোনের থেকে ব্রেসলেট পেয়ে খুব খুশি হলো অরা। আনন্দে জড়িয়ে ধরে বলল সে,
“ খুব পছন্দ হয়েছে, সোনা। আমার বোনটা বড়ো হয়ে গেছে। “
“ এহহ… আমি বড়ো হইনি। আমি ছোটই থাকতে চাই আপু। ঠিক এভাবে, তোমার আদেরর ছোটো বোন হয়ে। “
হেসে বলল অরা,
“ পাগলি একটা। সকালে তালহা গিয়ে দিয়ে আসবে তোকে। বিয়ে তো তিনদিন পর। পরশু আবার গিয়ে নিয়ে আসবে, কী বলিস?”
“ হ্যাঁ সেটাই ভালো হবে। জামাকাপড়ও গোছানো বাকি৷ বিয়েতে কী কী পরবো, সেসব। “
“ বিয়েতে কী পরবি সেসব তোকে ভাবতে হবে না। তোর ভাইয়া বলেছে সব কিনে দেবে। “
নয়নার ভীষণ আনন্দ হচ্ছে। আরিশ যে এভাবে তাদের পরিবারকে আপন করে নিবে সেটা কখনোই ভাবেনি সে।
“ ওকে, আপু। তুমি খেয়েছো দুপুরে? “
“ হ্যাঁ। ডাক্তার আসবে এখন। আরিশ কল দিয়ে বলল। “
“ কী হয়েছে তোমার? “
আতংকিত হয়ে জিজ্ঞেস করলো নয়না। অরা তাকে স্বান্তনা দিয়ে বলে,
“ তেমন কিছু না। মনে হয় শরীর দূর্বল। কেমন অশান্তি লাগছে আজকাল। জ্বরও আসে মাঝে মধ্যে। “
“ তাহলে ভালোই হবে, ডাক্তার এলে কী হয়েছে জানা যাবে। “
অরা বসা থেকে উঠে অন্যদিকে এগোতে এগোতে বলে,
“ হ্যাঁ, আমি ঘরে গেলাম। “
“ আচ্ছা, আপু। যাও। ডাক্তার এলে,আমি তোমার ঘরে নিয়ে যাবো। “
“ ঠিক আছে। “
ডাক্তারের অপেক্ষায় নয়না বসে রইলো, ড্রইং রুমে।
আকাশি ব্লাইন্ড ফাঁক করে রোদ এসে পড়েছে রুমের মেঝেতে। চারপাশ জুড়ে শীতল, ঘন নীরবতা। কেবিনে বসে আছে তেজরিন খান আরিশ। চোখে গাঢ় একাগ্রতা, ঠোঁটের কোণে চাপা এক দৃঢ়তা।
কালো শার্টের ওপর ধূসর ওয়েস্টকোট, গলায় সিল্কের টাই—পরিপাটি, অথচ অনায়াস স্টাইল। হাতে এক কাপ কালো কফি, যেটা ঠান্ডা হয়ে গেছে কখন, হয়তো খেয়ালই নেই। সামনে টেবিলে ছড়িয়ে থাকা কিছু কনফিডেনশিয়াল ফাইল। একের পর এক সাইন করছে সে, মাঝে মাঝে চোখ তুলে তাকাচ্ছে ওয়াল জুড়ে লাগানো বিশাল স্ক্রিনে, যেখানে রিয়েলটাইম রিপোর্ট ভেসে উঠছে।
রুমের একপাশে দাঁড়িয়ে সেক্রেটারি ফাইজা বলল,
“সার, আগামীকাল ইনভেস্টর মিটিং…”
আরিশ চোখ না তুলে উত্তর দিল,
“স্লাইড রিভিউ করেছি আমি। বাকি অংশ কাল দেখবো।”
ফাইজা মুহূর্তখানেক থমকে থাকল, তারপর সামান্য মাথা নেড়ে বলল,
“জ্বি, ঠিক আছে সার।”
আরিশ তখনো চোখ সরায়নি স্ক্রিন থেকে। কনফিডেনশিয়াল রিপোর্টে ভেসে উঠছে প্রতিটি শেয়ারের আপডেট, ইনফ্রা প্রজেক্টের টাইমলাইন, এবং লেনদেনের হিসাব। ভ্রু কুঁচকে গেলো এক জায়গায়, যেন কিছু একটা তার পরিকল্পনার বাইরে যাচ্ছে।
চোখ নামিয়ে কলমটা আবার তুলে নিলো সে।
টেবিলের ডান পাশে রাখা ইন্টারকমের বোতাম টিপে বলল,
“তালহাকে বলুন, আমার কেবিনে আসতে।”
ফাইজা ইতস্তত করে জিজ্ঞেস করল,
“স্যার, উনি তো এখন ক্লায়েন্ট মিটিংয়ে…”
“তবে যখনই ফ্রি হবে, সরাসরি এখানে আসতে বলবেন ।”
তার স্বর শান্ত, কিন্তু গভীর।
রুম জুড়ে আবারও নেমে এলো সেই নিঃশব্দ, শীতল ভার। আরিশ তার আঙুলে ঘুরাতে লাগল সোনালি রিংটা। ঠিক তখনই, ফোনটা ভাইব্রেট করতে শুরু করল।
স্ক্রিনে ভেসে উঠল এক নাম— হামিংবার্ড কলিং…
ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসি ফুটে উঠলো। পরক্ষণেই আরিশ খান থমকে গেলো। সচারাচর অফিসে থাকাকালীন অরা কল করে না। ডাক্তার হয়তো এমনকিছু বলেছে যার জন্য অরা আরিশকে কল করতে বাধ্য হয়েছে।
“ ফাইজা আপনি এখন যেতে পারেন। “
“ জি,স্যার। “
নিশ্বব্দে কেবিন থেকে বেরিয়ে গেলো ফাইজা। আরিশ দ্রুত কল রিসিভ করলো।
আরিশ কল রিসিভ করতেই ঠুকরে কেঁদে উঠল অরা। তার এমন আচরণে আরিশের যেন প্রাণপাখি বের হয়ে যাওয়ার উপক্রম হলো।
“ পাখি? কী হয়েছে তোমার? এভাবে কাঁদছ কেন? ডাক্তার কী বলেছে?”
“ আমার ভয় লাগছে… “
“ এমন করে না, জান। শান্ত হও। আমি এখুনি আসছি। তুমি শুধু বলো, তোমার কী হয়েছে? “
“ আমার না-কি ডেঙ্গু জ্বর হয়েছে। ডাক্তার পুরোপুরি শিওর না। কিছু টেস্ট করাতে হবে বললেন। আমি সিরিঞ্জ ভয় পাই…. আমার…. “
আরিশ ইতিমধ্যে অফিস থেকে বেরিয়ে গেছে। তাকে এভাবে পাগলের মতো ছুটে বেরোতে দেখে সবাই কাজকর্ম রেখে নিজেদের মধ্যে কথা বলতে শুরু করেছে।
“ আমি বাসায় আসতেছি। তুমি চুপচাপ শুয়ে থাকো। ডাক্তারের সাথে আমি কথা বলে নিচ্ছি। “
“ আচ্ছা। “
কল কেটে দিয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ল অরা। ডাক্তার শেলিনা আক্তার অরার সামনে বসে আছেন। বুঝতেই পারছেন, স্বামীর খুব আদরের বউ। নয়তো এতটুকুতে কেউ এমন করে? যদিও অনেক মেয়েরাই ইনজেকশন ভয় পায়৷
“ মিসেস খান, আমি তাহলে এখন আসছি। আপনার হাসবেন্ড সম্ভবত পরে কথা বলে নিবেন আমার সাথে। “
অরা নড়েচড়ে উঠল। চোখমুখ মুছে বলল,
“ হ্যাঁ উনি কথা বলবেন, বললেন। পথে আছে উনি, কিছুক্ষণের মধ্যেই বাসায় পৌছেঁ যাবেন। “
“ তাহলে একটু অপেক্ষা করি। উনার সাথে কথা বলে যাবো। আগামীকালই টেস্টগুলো করতে হবে। মনে হচ্ছে, দীর্ঘদিন ধরেই ডেঙ্গুতে ভুগছেন। দ্রুত চিকিৎসা নিতে হবে। “
অরা চুপ করে রইলো। স্যালাইন, ইনজেকশনে খুব ভয় তার। শেষমেশ সে-সবই জুটবে তার কপালে। এটা ভাবতেই মনটা খারাপ লাগছে তার। সামনে বাড়িতে বিয়ে। এখন যদি সে অসুস্থ হয়ে পড়ে থাকে তাহলে কী চলে?
“ মিসেস খান একটা কথা বলবো?”
“ হুম… বলুন। “
হামিংবার্ড পর্ব ৫৪
“ আপনি খুব ভাগ্যবতী। আপনার স্বামী আপানাকে হয়তো মাথায় তুলে রাখে। “
“ মাথায় তুলে রাখে না, কোলে তুলে রাখে সারাক্ষণ। তার রাগ, শয়তানি সম্পর্কে তো জানেন না, তাই এমন বললেন। “
মনে মনে কথাগুলো আওড়াল অরা৷ তবে মুখে কিছু বলতে পারলোনা। কেবল মুচকি হাসল।