মোহমায়ার বাহুডোরে পর্ব ২৪
সাদিয়া
খুব নিরিবিলি নিরালা জায়গায় ক্যান্টনমেন্টের এক কোনায় দাঁড়িয়ে ইহাম সিগারেট খাচ্ছে। এটা তার তিন নাম্বার সিগারেট ফুঁকছে সে এই মুহূর্তে। মনটা বড্ড অস্থির চঞ্চল। তবুও নিজের ভেতরের অনুভূতি টা একান্ত নিজের। নিজেকে প্রমাণ করা কোনো কালেই সে কারো কাছে দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করেনি। ভেতরের অনুভূতি টা অন্যকে জানানোর মাঝে নিজের স্বকীয়তা হারানোর ধারনা পোষণ করে সে। সেই সাথে দুর্বলতারও জানান দেয়। এটা তার পারসোনালিটি নাকি চাঁপা স্বভাবের ফল কোনটা তা নিজে কোনোদিন খুঁজার চেষ্টাও করেনি।
কিন্তু এই মুহূর্তে আর পারছে না। স্ত্রী নামক এক নারী তাকে নিদারুণ ভাবে অস্থির করে তুলেছে। আজ এক সপ্তাহ হয় সে চট্টগ্রাম ফিরেছে একা একা। তবুও ওই বেয়াদব স্ত্রী নামক মেয়েটা তাকে একটিবার কল দেয়নি। সে না হয় একটু রাগ দেখিয়ে কিংবা ভেতরের ক্ষোভে কথা বন্ধ রেখেছে। তবে মেয়েটা কি পারত না? আচ্ছা মেয়েটার কি তার কথা একবারও মনে পড়ছে না নাকি? এই যে নিজে নিজেই কথা বন্ধ রেখেছে অথচ নিজেই অস্থির হচ্ছে। ভেতরের তৃষ্ণা অনুভব করলেও নিবারণের ফায়দা নেই। তাকে এই অস্থিরতার আগুনে না ফেলে মেয়েটা ২ মাসের জন্য আসলেই বা কি এমন হতো? মেয়েটার কি একটুও খারাপ লাগছে না?
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
যদিও সে সবটা জেনে পারিপার্শ্বিক দিক উপলব্ধি করেও কেবল নিজের স্বার্থের দিক টাকে আমলে নিচ্ছে। তার যে কষ্ট হচ্ছে তার বেলায়? নিজের স্বস্তির প্রশান্তির কথা কে না ভাবতে চায়? এই যে এখন তার ভেতরটা জ্বলছে মায়রা নামক এক যন্ত্রণায়। তবুও নিজের কঠিন চাঁপা স্বভাবটার জন্যে এই মুহূর্তে তার মন চায়ছে সবটা আরামে উগলে দিতে। বরং অস্বস্তি কাটাতে সিগারেট টা শেষ করল। প্যান্টের প্যাকেট থেকে ফোন টা বের করে ফেসবুকে ঢুকে। মায়রার আইডিতে যেতেই কপালে সরুসরু অনেক গুলি ভাঁজের আবির্ভাব ঘটল তার। ভ্রুদ্বয়ের মাঝে কুঞ্চন রেখা টেনেই সে স্টোরিতে প্রবেশ করল। দেখো বেয়াদব মেয়ে স্বামীকে জ্বলন্ত আগুনে ফেলে সে কিভাবে রংঢং করে ছবি তুলে। তাও আবার শাড়ি পড়ে সেটা স্টোরিতে দেয়। গবেট মেয়েটাকে মন চাইছে ঠাস ঠাস করে কয়েকটা লাগাতে। এদিকে সে যন্ত্রণায় কাহিল আর ওদিকে মহারাণী আয়েশ করে। কপাল কুঁচকে দাঁত চেঁপে সে চেক করল মায়রা লাইনে নেই ২ ঘন্টা যাবত। তাই দ্রুতই কল দিল ফোনে। মেয়েটা তাকে পাগল করেই ছাড়বে।
মায়রা তখন খুব মনোযোগ দিয়ে বইয়ের মুখ ডুবিয়ে রেখেছে। মা বিকেলের নাস্তা দিয়ে গিয়েছে সেই কখন অথচ সে মুখেও নিচ্ছে না। গরম গরম সিঙ্গারা এখন প্রায় ঠান্ডা। তবুও মুখ তুলছে না সে। আচমকা ফোন বেজে উঠতেই মনোযোগ বিচ্ছিন্ন হলো। খুব বেশি বিরক্তও হলো না সে। বরং তার চাল কাজে লেগেছে বলে ঠোঁটে ফুটল বক্র হাসি। মনে মনে ভেবেই নিয়েছে এখন ইহামই কল দিয়েছে তাকে। ব্যাটাকে কল দেওয়াবে বলেই তো ইচ্ছা করে স্টোরিতে নিজের ছবি দিয়েছে শাড়ি পড়া। লোকটা দেখবে, জ্বলবে তাকে বকার জন্যে হলেও কল দিবে।
মায়রা টেবিল ছেড়ে উঠল। বিছানার উপর পড়ে থাকা ফোনের দিকে ঝুঁকে “পাষাণ ক্যাপ্টেন” নামটা দেখে মুচকি হাসল সে। টেবিলের মাঝ থেকে সিঙ্গারার প্লেট টা নিয়ে গিয়ে বিছানায় বসল। হাতে একটা সিঙ্গারা তুলে নিয়েই ফোন রিসিভ করল। “হ্যাঁলো” বলেই আয়েশ করে কামড় বসালো সিঙ্গারার পেটে। ওপাশ থেকে ঝড়ের গতিতে ক্ষিপ্র সুরে বলে উঠল ইহাম,
“আমাকে তো এমনিতেই জ্বালিয়ে মা’রছিস তাহলে সব দিক থেকে পু’ড়িয়ে শেষ করে দিতে চাইছিস কেন বল তো?”
আচমকা মাগামাথার মাঝখানে এমন একটা কথা শুনে থমকে গিয়েছে মায়রা। চোখের পলক নিশ্চল রেখেই মুখের খাবার টুক চিবাতে ভুলেছে সে।
“বেয়াদব মেয়ে কথা বলবি? নাকি এসে কানের নিচে দুইটা দিতে হবে?”
ইহাম যে রাগে হিসহিস করছে তা বেশ টের পাচ্ছে মায়রা। মানুষটা কে কি খুব রাগিয়ে দিয়েছে সে? তা না হলে তো তুইতোকারি করতো না। আর কি বলল জ্বালানো পু’ড়ানোর কথা? মানুষটা কি তার জন্যে জ্বলে পু’ড়ে যাচ্ছে? মায়রা ঢ্যাবঢ্যাব চোখে কিছু একটা দেখে দ্রুত মুখের খাবারটা চিবালো। ওপাশ থেকে লম্বা একটা দীর্ঘশ্বাসের আভাস পেল সে। সে চুপচাপ সবটা বুঝার জন্যেই ইচ্ছা করেই নীরব রইল।
ইহামের ভেতরটা তপ্ত। সে মনে করল এভাবে বলে ফেলায় মায়রা বোধহয় রাগে চুপ করে আছে। সন্ধ্যা নেমে আসছে। আশপাশ শান্ত স্নিগ্ধ। তবে তার ভেতরটা চঞ্চল, উদগ্রীব। নিজে নিজে বিরক্ত প্রকাশ করে চোখ মুখ নিঃশব্দে কুঁচকে নিয়েছে সে। পরক্ষণে ধারালো শীতল কন্ঠে ডেকে উঠল “মায়রা” বলে।
হুট করে ওমন মোলায়েম মধুর ডাক সরাসরি অন্তর বিঁধ করল মায়রার। চোখ গুলি বিস্ময়ে রসগোল্লা হলো। শরীরের লোমকূপ গুলিও খাড়া হয়ে উঠল। গলায় খাবারটা কি আটকে গিয়েছে ওই শীতল জমে যাওয়া কন্ঠে? তার মনে হচ্ছে গলায় কিছু একটা বিঁধে আছে। ঢোক গিলতে যে তার বড্ড কষ্ট হচ্ছে।
“কেন নিঃশব্দে আমাকে এভাবে যন্ত্রণা দিচ্ছো মায়রা? তোমার ধারনা আছে আমার ভেতর ঘর তুমি কতটা জ্বালিয়ে কয়লা করছো? তুমি কি আমাকে বুঝবে না নাকি?”
মায়রা থমকে গিয়েছে। ফুরিয়ে গিয়েছে যেন তার শব্দমালা। অতি বিস্ময়ে চোখ দুটি বড় বড় হয়েছে। সেই সাথে শরীরটাও কাটা দিয়ে উঠেছে ওই কথায় রেশে। সর্বাঙ্গে যেন একটা শীতল হাওয়া ছুটে গেল তার। টানটান ভ্রুদ্বয় নিয়ে হঠাৎ মন আওড়ে দিল “লোকটাকে আমি যন্ত্রণা দিচ্ছি? আমি জ্বালিয়ে কয়লা করে দিচ্ছি? কই এক সাপ্তাহ হয় আমি কথাই বলিনি তাহলে কিভাবে জ্বালাতন করলাম? তবে কি দূরত্ব কথা বলে? তারাই কি চুপিচুপি কিছু যন্ত্রণা দিয়ে এসেছে মানুষটাকে? আমার অনুপস্থিতিই লোকটাকে পু’ড়াচ্ছে?” হৃদয় ছোঁয়া এই ভাবনা গুলি মনে উদিত হলেই স্তম্ভিত হয়ে যায় মায়রা। এক আনন্দময় অনুভূতি মুহূর্তেই পুলকিত করে তুলে তাকে। এই ইহাম কেই তো সে চায়। তবে লোকটা কখনোই এক ভাবনা কিংবা এক মর্জিতে থাকে না।
কখনো মখমলের মতো তুলতুলে তো কখনো কঠিন কথায় বিঁধ করে তো আবার নিজের রাগের মাঝে হিংস্রতাও বিলিয়ে দেয়। লোকটা নিজের অনুভূতি গুলি প্রকাশ করতে চায় না। আবার কখনো সখনো স্বল্প বাক্যে তুলেও ধরতে চায়। কিন্তু স্বভাবসুলভ লোকটা আয়েশ ভাবে তা ফুটিয়ে তুলে না। এই যেমন অল্প বাক্যে অল্প একটু অনুভূতি তুলে ধরল। একটু রুক্ষ হলেও ভণিতা নেই। সব কথা সোজাসাপ্টা। রাগী হলেও মন নরম আছে। যদিও সেটা প্রকাশ করতে চায় না রগচটা লোকটা। ডিফেন্সের সব লোকই এমন হয় নাকি? রুক্ষতার আড়ালে কোমলতা লুকিয়ে রাখে? মায়রা ম্লান হাসল নিঃশব্দে। সম্পর্কটা যেমন সময়ের উপর ছেড়ে দিয়েছে সে।
তার কোমল মনের দৃঢ় ভাবটা তাকে উপলব্ধি করিয়েছে মানুষটার মনে সে জায়গা দখল করে নিয়েছে। সেটা আজ হোক কিংবা গতকাল। একটা সম্পর্ক যত খারাপই হোক না কেন তার স্বল্প বুদ্ধি তাকে জানান দিয়েছে অল্প একটু সময় দেওয়ার। সময়ের সাথে কত অসম্ভব ঘটনাই তো ঘটে যায়। কত অস্বাদনও স্বাদন হয়। যাকে পছন্দ করে মনের গভীর থেকে স্বামী হিসেবে মেনে নিয়েছে তার জন্যে কিছুদিন না হয় সময় ব্যয় করেই দেখল। পরিণতি যদি স্বস্তির আর প্রত্যাশিত হয় তবে একটু সময় ব্যয় বড় কোনো বিষয় না। হুটহাট যেকোনো সিদ্ধান্ত সে নিতে শিখেনি। এটা তার বাবা মহিন সাহেব পছন্দ করেন না। তিনি সবসময় বলেন,
“পথ চলার ক্ষেত্রে জীবনের যে কোনো সিদ্ধান্ত আস্তেধীরে নিতে হয়। সিদ্ধান্ত সহজ হোক বা কঠিন, ছোট হোক কিংবা বড় সেটা সর্বদা সময় নিয়ে ভেবেচিন্তে ধীরেসুস্থে নিতে হয়। এর প্রভাব জীবনে পড়বেই। মনে রেখো একটা সঠিক সিদ্ধান্তই পারে জীবনকে সুন্দর থেকে সুন্দরতম করতে। একটু সময় নিয়ে হলেও উত্তম সিদ্ধান্ত টাই গ্রহণ করা উচিৎ যে কোনো কাজে। কারণ জীবনের সাথে সিদ্ধান্ত ওতপ্রোত ভাবে জড়িত।”
হঠাৎ তিরিক্ষি গলায় ওপাশ থেকে বলে উঠল ইহাম,
“এই মাথামোটা বলদ মুখে কি অজগর ঢুকেছে? কথা বলছিস না যে? আমি কি বলছি শুনা যাচ্ছে না?”
“আপনি কিন্তু আমাকে তুইতোকারি করছেন। রাগ ঝাড়তে এতদিন পর কল দিয়েছেন আমায়? তাহলে কিন্তু আমি এসব সহ্য করব না। ফোন রাখছি।”
আবারও ফোঁস করে নিশ্বাস ফেলার ধ্বনি শুনেই মায়রা ঠৌঁট টিপে হেসে উঠল।
“হাতি কাঁদায় পড়লে চামচিকাও লাথি মারে।”
“কি বিড়বিড় করছেন? স্পষ্ট করে বলুন।”
“আমি বললেই কি তুমি শুনো আমার কথা?”
“শুনি না বলছেন? যতটুক শুনি তা কি ঢের নয় বলুন? আপনি তো কানাকড়িও আমার কথা শুনতে চান না ক্যাপ্টেন সাহেব।”
“তুমি মনে হয় বলতে আসো কথা। গত সাতদিনে একটাবার কল এসেছে তোমার ফোন থেকে?”
“আমি দেইনি আপনিও দেন নি। সমানসমান কাটকাট।”
“বাহহ দ্যাটস গুড। এই না হলে পিচ্চি বউ।”
মায়রা ঠোঁট টিপে হেসে উঠল। হাতের সিঙ্গারা টা এবার পুরোপুরি ঠান্ডা হয়েছে। সেই যে এক কামড় বসিয়েছিল এরপর ইহামের কথার ধরনে আর ইচ্ছা হয়নি কামড় দেওয়ার। বরং লোকটার অস্থিরতা উপভোগ করা তার কাছে বেশি মজার লাগল। ইশশ লোকটা মনে হচ্ছে জ্বলে পু’ড়ে যাচ্ছে।
“তো পিচ্চিকে কল দিয়েছেন কেন? কে বলেছে কল দিতে? সাত দিন গিয়েছে আরো সাত মাস যাক সেটা তো আপনাকে দিয়ে ভালোই পারা যাবে। রাখছি আমি।”
“খবরদার কল রাখবে না। কথা আছে তোমার সাথে আমার।”
লোকটার কড়া গলার কথা শুনেও হাসি পেল তার। কারণ তার খুব ভালো করেই জানা আছে মানুষটা কি নিয়ে কথা বলছে। এর জন্যে দুই একটা বকা শুনলেও তার কিচ্ছুটি যায় আসবে না। বরঞ্চ আরো উপভোগ করবে। কারণ সেগুলি হবে লোকটার ভেতর থেকে নির্গত জ্বলনের অগ্নিফুলিঙ্গ।
“কি কথা?”
ওপাশ থেকে লোকটার শান্ত দৃঢ় কন্ঠ শুনা গেল। সরল অথচ তীক্ষ্ণ কন্ঠে শুধালো,
“তোমাকে ফেসবুকে ছবি দিতে বারণ করেছিলাম মায়রা। এগুলি আমার একদম পছন্দ না। কেন দিলে তবে?”
মায়রা নিঃশব্দে হাসল। তার খুব বলতে ইচ্ছা হলো “আপনার জন্যেই তো দিয়েছি। আপনি ইচ্ছা করে কল দেন নি তাই বাধ্য করেছি। জানি তো বকার জন্যে হলেও ঠিকি কল দিবেন।” তবে মুখে বলল “আমার ফোন, আমার ছবি আমার ফেসবুকে তাই ইচ্ছাটাও আমার।”
বাঁকা কথা শুনে মুহূর্তে চটে গেল ইহাম। দাঁত কেটে ক্রোধ পিষল। এই বেয়াদব মেয়ে কখনো সোজা হবে না। এর বদলে তাকেই পাগল করে ছাড়বে।
“ছবি দিয়েছো তো দিয়েছো তাও আবার শাড়ী পরা ছবি দিয়েছো। কোন সাহসে করলে এটা? আচ্ছা আমাকে কি জ্বালিয়ে জ্বালিয়ে পাগল করে দিতে চাইছো মায়রা?”
এক শীতল আধুত অনুভূতিতে মায়রার গা ভেসে উঠল। ঠোঁটের কোণায় একটা তৃপ্তির হাসি যত্ন করেই ফুটে উঠল অচিরে। মৃদু আওয়াজে ঠোঁট চিঁড়ে বের হয়ে এলো “আমি আপনার দুর্বলতা বুঝে গিয়েছি ক্যাপ্টেন সাহেব। আপনাকে তবে জ্বালিয়ে জ্বালিয়ে আপনার অনুভূতি স্বীকার করাব আমি। করতেই হবে আপনাকে।”
“এই বেয়াদব মেয়ে বিড়বিড় করে কি বলছো? স্পষ্ট ভাবে কথা বলো।”
ইহামের চিবিয়ে বলা কথায় মজা পেল মায়রা। কন্ঠ খাদে নামিয়ে ফিসফিস আওয়াজে বলল,
“আপনাকে কি আমি খুব জ্বালাতন করছি বলুন না ক্যাপ্টেন সাহেব। কিভাবে জ্বালাতন করছি?”
“আমাকে বেশি জ্বালাতে যেও না মেয়ে। সামনে থাকলে আমার আগুনে আমি তোমাকেও জ্বালিয়ে পুড়িয়ে শেষ করব কিন্তু।”
“তবে আমি কি আপনার জন্যে অপেক্ষা করব?”
মায়রার লঘু আওয়াজে বলা কথা শুনে স্তব্ধ হলো ইহাম। কপালে কয়েকটা সরু রেখা দেখা গেল। মেয়েটা অন্য সুরে কথা বলছে কেন? অল্প সময় নিয়ে চিন্তা করল ইহাম। শান্ত স্বরে শুধালো,
“জ্বলার জন্যে তুমি মনে হয় োখুব আগ্রহী মায়রা?”
“কেন নয়?”
“বেশি বেড়েছো বলে মনে হচ্ছে।”
“কোন দিক দিয়ে?”
এক গালে বক্র হাসল ইহাম। তার চতুর মস্তিষ্ক তাকে কিছু ইঙ্গিত দিচ্ছে। সে চাইছে না পরীক্ষার আগে মেয়েটার পাগল মাথা আরো বিগড়ে যাক। তাই কথার মালা আরো দীর্ঘ না করে ইতি টানবার প্রস্তুতি নিল। শান্ত তীক্ষ্ণ কন্ঠে জানাল,
“আজেবাজে মতলব রেখে পরীক্ষা চলে আসছে তার প্রস্তুতি নাও। তুমি যে গাধা তাতে A+ তো আর পাবে না। কিন্তু 4.70 এর উপরে যদি পয়েন্ট না আসে তবে তুমি বুঝছে ভয়ংকর জিনিসটা কি। তাই নজরটা এখন পড়াশুনায় দাও। আর শেষ একটা কথা। লাস্ট ওয়ার্নিং দিচ্ছি। ভুলেও যদি শাড়ি পড়া ছবি ফেসবুকে দিতে দেখে…”
“তো? করবেন কি আপনি? দূর থেকে আর কিই বা করতে পারবেন?”
মায়রার কোমল কন্ঠে হেয়ালিপনার কথা গুলি সহ্য করতে পারল না ইহাম। তার ভেতরের অনাকাঙ্ক্ষিত অস্থিরতা তাকে কাবু করে নিচ্ছে। এই মুহূর্তে যা অসম্ভব সেই স্পৃহা শুধুমাত্র মেয়েটার কন্ঠে জাগছে। এভাবে কেন কথা বলছে সে? তাকে জ্বালিয়ে ভস্ম না করে কি এই মেয়েটা শান্ত হবে না নাকি? দিনদিন মেয়েটা তাকে ইচ্ছাকৃত অনিচ্ছাকৃত অস্থির ব্যাকুল করে তুলছে। মেজাজ তার তুঙ্গে উঠল। রাগে ফোঁসফোঁস করে জানাল,
“আরেকবার শুধু দিয়ে দেখিস, পৃথিবীর যে প্রান্তে থাকি একেবারে তোকে জানে মে’রে তবেই আসব।”
খট করে কল কাটার শব্দ হলো। মায়রা খানিক ভয়ও পেল লোকটার কথায়। এত রেগে গিয়েছে মানুষটা? তাকে জানে মারার হুমকিও দিল? বিস্ময়ের ভাব কাটাতেই ব্যাপারটায় ভীষণ মজা পেয়ে হেসে উঠল মায়রা। লোকটা যে নাস্তানাবুদ হচ্ছে তা প্রস্ফুটন সুস্পষ্ট। এক জাদুকরী তৃপ্তিতে আবারও বেখেয়ালি হাসল সে।
ক্যাম্পের ভেতরে তখন ইহাম অন্যান্য সৈনিকদের টেনিং দেওয়াতে ব্যস্ত। এই মুহূর্তে নিজের মায়ের কল পেয়ে চিন্তিত হলো সে। কপাল কুঞ্চন করে শঙ্কিত ভাবটা আরো গাঢ় করল। এই অসময়ে মায়ের ফোন কেন এলো? তিনি তো তাকে ডিউটি টাইমে কখনো কল দেন না। কিছু হলো না তো আবার ওদিকে?
ইহাম একটু দূরে নীরব জায়গায় দাঁড়িয়ে কল রিসিভ করল। পরনে তার ইউনিফর্ম এর প্যান্ট আর খাকি রঙ এর টিশার্ট। প্রস্ত বুকটা টানটান করে পেশিবহুল হাত গুলি দৃশ্যায়ন করে ধীর রুপে দাঁড়াল। সংশয় জড়ানো কন্ঠে সালাম দিল। ওপাশ থেকে শিরিন বেগম সালাম এর জবাব নিতেই এবার মোটা গলায় প্রশ্ন করল ইহাম,
“কি হয়েছে মা? ডিউটি টাইমে কল দিলে যে ওদিকে সব ঠিকঠাক।”
আমতাআমতা করে শিরিন বেগম উত্তর দিলেন,
“এদিকে সব ঠিকঠাক আছে বাবা। আসলে একটা প্রয়োজনে তোকে কল করেছিলাম। খুব দরকার।”
“কি হয়েছে মা? ডিউটিতে আছি তাড়াতাড়ি বলো। সিরিয়াস কিছু নয়তো?”
শিরিন বেগম নিজের ছেলেকেই ভয় পাচ্ছেন। অবশ্য ছেলে বড় হয়েছে বিচক্ষণ বুদ্ধিমান ব্যাটাছেলে। তাই যে কোনো বিষয়ে ছেলের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। এমনকি কখনো কখনো কোনো বিষয়ে মা বাবা দুজনই তাকে খানিক ভয়ই পান। কথাটা বলতে তিনি ইতস্তত বোধই করছেন। ছেলে যে রগচটা। যদি মুখের উপর না করে দেয় তখন? তা না হ্যাঁ করানো তো অসম্ভব। তবুও জোর দিয়ে বললেন তিনি,
“আসলে তোর খালাতো ভাই হিমেলের বিয়ে। তোর খালামনি দাওয়াত দিয়েছে। বলেছে যে করেই হোক ফেণীতে যেতে হবে।”
“মা, দাওয়াত দিয়েছে যাও। এটা আমাকে জিজ্ঞেস করে যেতে হবে কেন?”
ওপাশের শিরিন বেগম চুপ রইল। চিন্তা করলেন কিভাবে বলা কথাটা। উনাকে চুপ থাকতে দেখে ইহাম ধারালো গলায় বলে উঠল,
“মা তুমি কি কোনো ভাবে আমাকে বিয়েতে যেতে কল দিয়েছো? দেখে আমি আমার বাপের চাকরি করি না যে দুদিন পর পর ছুটি পাবো। দেশের জন্যে কাজ করি। চাইলেই সব সম্ভব হয় না মা।”
“আরে না। তোকে যেতে বলছি না। আমি তো জানি এখন চাইলেও ছুটি পাবি না।”
“তো এখন কল দিয়েছো কেন? তুমি জানো না অন টিউটিতে আছি।”
“রাগ করিস না। আসলে বাবা আমি চাইছিলাম আমাদের সাথে মায়রাকেও নিয়ে যাই। তোর খালামনিও খুব করে বলেছে।”
এবার ইহামের রাগই হলো। মেজাজ গরমের মাত্রা অনুযায়ী তড়তড় করে বাড়ল। কপাল আরো কুঁচকে এলো তার। চোখ সরু করে গম্ভীর কন্ঠে জানাল,
“পাগল হয়েছো মা? ওকে নিয়ে যেতে হবে কেন? আর দুই মাস বাকি আছে ওর ফাইনাল এক্সাম এর। আর তুমি বলছো ওকে নিয়ে বিয়ে খেতে যাবে? ওর যেতে হবে না তোমরা যাও।”
“আরে শুন। তিন দিন এর তো ব্যাপার। এত রাগ করার কি আছে? নিয়ে যাই মেয়েটাকে। ওরও ভালো লাগবে।”
মেজাজ খারাপই লাগছে ইহামের। দুপুরের রোদে শরীর জ্বলছে নাকি রাগে বুঝতে পারছে না। মায়রা কে নিয়ে ওই ফেণী যাবে তার মা? দেখে রাখতে পারবে ওই মেয়েকে? পড়াশুনা রেখে এখন বিয়ে খাওয়ার কি আছে?
মায়ের জোর গলায় অনুরোধ কিছুই শুনল না ইহাম। তার এক কথা। মায়রা কে যেন নিয়ে যাওয়া না হয়। অন্তত সে তো জানে এর প্রকৃত কারণ। যদিও বা সে থাকত তবে আলাদা একটা কথা ছিল। কিন্তু এভাবে মায়রা কে এখানে কিছুতেই পাঠানো যাবে না। তাও আবার হালিমা আন্টির বাড়িতে। যদি আবার কিছু একটা হয়? না কোনো দরকারই নেই ওই মেয়ের যাওয়ার।
“মা শুধুশুধু এটা নিয়ে কথা বাড়িও না তো। মায়রা যাবে না। ওকে এসবে টেনো না। তোমরা বিয়ে খেয়ে এসো। ওকে নিয়ে আমি অন্য সময় যাবো।”
“তোর কোনো কথাই আমি এবার শুনব না ইহাম। মেয়েটা সারাক্ষণ পড়তে পড়তে নাকি এখন মাথা ব্যথা করে। একটু ঘুরে আসলে ওরও ভালো লাগবে। তিন দিনে পড়ার এমন কোনো ক্ষতি হয়ে যাবে না। আমরা কাল রওনা হবো রাখছি এখন।”
মোহমায়ার বাহুডোরে পর্ব ২৩
মায়ের কল কাটতেই সূক্ষ্ম উদ্বিগ্ন এক ভাব ঝুঁকে বসল তার আঙ্গিনায়। কপালের চিকন রেখা আরো গাঢ় হলো। ভেতরের উদবেগ তাকে অস্থিরই করল প্রবল ভাবে। তার মূল চিন্তার বিষয়ই তো হালিমা আন্টির ছোট ছেলে হাসিবুল্লাহ কে নিয়ে। শালা আবুল টা এক নাম্বারে লুচ্চা। মেয়ে দেখলেই চুকচুকানি বাড়ে। তার অনুপস্থিতিতে যদি মায়রার সাথে কোনো অভদ্রতা অসভ্যতা করে ওই হাদারাম আবুল টা? ফিচেল মেজাজের সাথে দুশ্চিন্তা সংশয় মিলে মিশে একাকার হয়ে বিতৃষ্ণা বিরক্তির স্কেল তড়তড় করে বাড়ল।