মোহমায়ার বাহুডোরে পর্ব ৩৩
সাদিয়া
মানুষে গিজগিজ করছে বাড়িটা। আকবর পাটোয়ারি গ্রামে বিশাল আলিশান বাড়ি তৈরি করেছেন। যদিও উনার বসবাস ঢাকায়। তবুও গ্রামের মানুষের কাছে নিজেকে বিত্তশালী প্রমান করার জন্যে বছরের একবার গ্রামের বাড়িতে আসবেন বলে তৈরি করেছেন বিশাল বিলাস শান্তির সম্রাজ্য। গ্রামে এক নামে বাচ্চা থেকে বুড়ো সবাই উনাকে চিনেন। তাই বাড়ি তৈরির ক্ষেত্রে শহরের আধুনিকতার ছোঁয়া দিতে কোনো কার্পণ্যতা হয়নি।
দিশেহারার মতো অস্থির ভাবে ছটফট করতে লাগল ইহাম। তার কলিজা ক্ষণে ক্ষণে কেঁপে উঠছে সুচালো আতঙ্কে। ফলাঘাতের মতো তীব্র যন্ত্রণায় পিষ্ট হচ্ছে তার কঠিন বক্ষস্থল। দুমড়েমুচড়ে ছারখার হয়ে যাচ্ছে ভেতরটা। কেমন উদভ্রান্তের মতো অস্থির হয়ে গেল তার ব্যতিব্যস্ত চিত্ত এক ঘূর্ণমান দুশ্চিন্তায়। মাথার ভিতর পোকার মতো কিলবিল করতে লাগল একমাত্র মায়রা। কোথায় গেল মেয়েটা? এত বড় বাড়িতে কোথায় আছে সে? কোন বিপদ হলো মেয়েটার?
ইহামের পাশ থেকে ইবরাহিমকেও এবার চিন্তিত আর বিষণ্ণ দেখাল। ইহামের ছটফট ভাব তাকে ঘাবড়ে দিচ্ছে। সবসময় শান্ত স্থির থাকা মানুষটার হঠাৎ কি হলো? আজ পর্যন্ত যতগুলি অপারেশন টিম লিডার হয়েছে ক্যাপ্টেন ফাহাদ ইহাম চৌধুরী সে সর্বদা দেখে আসছে মানুষটা কেমন দৃঢ় বিচক্ষণতার সাথে সততা দিয়ে নিজের দায়িত্ব পালন করেছে। তবে এখন কি হলো? এমন পাগলের মতো অস্থির অস্থির করছে যে? হঠাৎ এই ছটফটানির মানে কি?
“ক্যাপ্টেন কি হয়েছে? আপনাকে এত অস্থির দেখাচ্ছে কেন?”
তৎক্ষণাৎ ইহাম কোনো জবাব দিতে পারল না। একদম উন্মাদের মতো সে ছটফট করে দিক বেদিক তাকাল। নজর চারিদিকে বুলিয়ে কোনো কূলকিনারা পেল না। কি করবে না করবে তাও বুঝে উঠতে পারছে না। মাথায় কেবল একটাই চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছিল যে করেই হোক মায়রা কে ঠিকঠাক ভাবে ফিরে পেতে হবে।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
“স্যার কি হয়েছে আপনার? কি হয়েছে বলুন না আমার চিন্তা হচ্ছে।”
“প্ল্যান চেঞ্জ।”
“মানে? কি বলছেন ক্যাপ্টেন?”
“এখন কথা বাড়ানোর সময় নয় ইবরাহিম। সবাই কে জানিয়ে দাও কথাটা। আযহার পাটোয়ারি সম্ভবত মায়রা কে কিডন্যাপ করেছে। জানি না কোথায় আছে। যে রকম প্ল্যান করেছিলাম তার কিছুই হবে না। সবাই কে এলার্ট করে দাও। আর ফোনে নজর রাখতে বলো। আমার হিডেন ক্যামেরার মাধ্যমে আশা করি গন্তব্যস্থলে পৌঁছে যেতে পারবে।”
“ওকে ক্যাপ্টেন।”
“শুনো ইবরাহিম বাড়ির প্রতিটা সিসি ক্যামেরা গিয়ে চেক করো। কোথাও না কোথাও তো মায়রা কে দেখা যাবে। ওর লাস্ট প্লেইস কোথায় জানাও আমায়। তাড়াতাড়ি যাও ইবরাহিম সময় নেই। ফাস্ট।”
শেষের শব্দটা বেশ জোর দিয়ে বলল ইহাম। ভেতরের তীব্র আতঙ্ক শঙ্কা যেন প্রকাশ পাচ্ছে তার গলায়। “এখুনি যাচ্ছি” বলে ইবরাহিম ছুটে গেল নিজের দায়িত্বের দিকে। লম্বা লম্বা শ্বাস টানল ইহাম। মস্তিষ্ক ফাঁকা লাগছে তার। সবসময় ধৈর্য নিয়ে সব পরিস্থিতি মোকাবিলা করা এই মানুষটা ধৈর্য ধরে সংযম করতে পারছে না নিজেকে। তার ভেতরটা ভীষন অস্থিরঅস্থির করছে। নিজেকে যেন অসহায় ফীল করছে বড্ড। মাথাতেও কিছু আসছে না কোথা থেকে কি শুরু করবে। চিন্তা চেতনার সবটা জুড়ে যেন গেড়ে গেছে কেবল মায়রা। “মেয়েটার বিপদ” এই ভাবনাটা আতঙ্কে তাকে আরো দিশেহারা করে দিচ্ছে। বড় বড় কদম ফেলে যেতে যেতে এদিক ওদিক করে তাকাল। সবার আগে ম্যাসেজ আসা নাম্বারটায় কল লাগাটা। তার ধারনার মতোই বন্ধ পেল নাম্বারটা। দ্রুত নাম্বারটা কপি করে লোকশন জানাতে বলে কাউকে সেন্ট করল হাটতে হাটতেই। পরক্ষণে কল দিল শিফুর নাম্বারে।
“ভাইয়া পেলে ভাবি কে?”
“কোথায় আছিস শিফু?”
“বাগানের এই দিকটায় ভাইয়া।”
“তুই থাক আমি আসছি।”
গট করে কল কেটে দৌড়ে গেল বাগানের দিকে। শিফু এক পাশেই দাঁড়িয়ে ফোন টিপছে।
“মায়রা কে শেষ কখন কোথায় দেখেছিলি শিফু?”
“এই দশ মিনিট আগেই ভাইয়া। উপরের দু তলাতেই দেখেছিলাম।”
হাপাচ্ছে ইহাম। তবুও গরম চোখে দাঁত কেটে জিজ্ঞাস করল,
“তোকে বলেছিলাম না মায়রা কে নিয়ে সবসময় মার সাথে থাকবি?”
“আম্মুরর সাথেই ছিলাম।” ভাইয়ের কথায় মাথা নুয়ে নেয় শিফু। গলা নরম করল খানিক “উপরের একটা ঘরে আমি আর ভাবি আম্মুর সঙ্গে বসে ছিলাম। এরপর হাসিব ভাই এসে ডাকায় আমি তার সাথে চলে গিয়েছিলাম। এরপর আর দেখিনি।”
ক্লান্ত ভঙ্গিতে ইহাম মুখ ঢেকে হাল ছেড়ে দেওয়ার মতো হেলে দাঁড়ায়। দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। তার চোখে মুখে স্পষ্ট অসহায়ত্বের ছাপ ফুটে উঠেছে। সেই সাথে ভীত সংশয় ভাব। তাকে এভাবে দেখে শিফু চিন্তিত হয়ে প্রশ্ন করে,
“কি হয়েছে ভাইয়া?”
“কিছু না। তুই উপরে যা মার সাথে থাকবি। একটুও যেন এদিকওদিক যাবি না। মায়রার কথা জিজ্ঞেস করলে মা কে বলবি ও আমার সাথে আছে।”
“কিন্তু ভাইয়া…”
“যা বললাম তা কর।” ইহামের লাল চোখ আর গম্ভীর কন্ঠ শুনে ভয় পায় শিফু। তার মন বলে কিছু একটা হয়েছে। ভাইয়া কে একদম তার স্বাভাবিক লাগছে না। “তাড়াতাড়ি যা।” ইহামের ধমকে আর কিছু বলে না শিফু। চুপচাপ পা বাড়ায়।
পাগলপ্রায়ের মতো ইহাম যখন শ্বাসরুদ্ধ অবস্থায় এদিকওদিক তাকিয়ে পা বাড়ায়। তখন হাসিবুল্লাহ কে হেসে হেসে একটা মেয়ের সাথে কথা বলতে দেখে সে। ক্রুদ্ধ হয়ে সে হিংস্র অভিমুখে এসে সোজা গিয়ে হাসিবুল্লাহর পাঞ্জাবীর কলার চেঁপে ধরল। কোনো রকম বাক্য বিনিময় ছাড়াই টেনে হিচড়ে নিয়ে এলো মেয়েটার পাশ থেকে। হঠাৎ ইহামের এমন আক্রমণে রীতিমতো থ মেরে গিয়েছে হাসিবুল্লাহ। নতুন আতঙ্কে বুক চিপে উঠল তার। আবার কি হয়েছে? ইহাম ভাই তাকে এবার কোথায় নিয়ে যায়? সে তো কিছু করেও নি। মায়রার থেকে চল্লিশ হাত দূরে থাকে। তবে এমন আচারণ এর কি মানে?
“ভাই কি হয়েছে? ছাড়ো আমায়। মানুষ দেখছে।”
ভয় নিয়ে হলেও হাসিবুল্লাহ প্রশ্ন করে তবে উত্তর দেয় না ইহাম। একটা খালি জায়গা দেখেই কলারটা আরো শক্ত করে চেঁপে ধরল সে। হিসহিস করে ক্ষোভ নিয়ে বলল,
“মায়রা কোথায়?”
একে তো কলার এভাবে ধরায় দম আটকে আসছে তার। এরউপর ইহামের মুখে মায়রার খুঁজ শুনে একদম নিশ্বাস আটকে আসার মতো অবস্থা। সে কি করে জানবে ইহাম ভাইয়ের বউ কোথায়? সেদিনের পর থেকে তো ভাবি বলেও ডাকতে ভয় পায়। তবুও কেন তার কাছে নিজের বউয়ের খুঁজ চালায় ইাহাম ভাই? বেচারার অবস্থা নাজেহাল। ফান্দে পড়িয়া বগা কান্দে রে অবস্থার মতো করে জবাব দেয়,
“তোমার বউ কোথায় সেটা আমি কি করে জানব ভাই?”
“ভালোয় ভালোয় বল কিন্তু মায়রা কোথায়।”
ইহামের হিংস্র লাল চোখ আর দাঁত পিষা ভাব দেখে দম যায় যায় অবস্থা। গলার কাছে এত শক্ত বন্ধনে এবার কাঁদোকাঁদো অভিনয় করে জবাব দেয় হাসিবুল্লাহ,
“বিশ্বাস করো ভাই আমি জানি না তোমার বউ কোথায়। সেদিনের পর থেকে তো নিজের কিউট ভাবিকেও আম্মাজান ডাকি। তাইলে আমি কেমনে জানব তোমার বউ আছে কোথায়? আমি কিছু করিনি ভাই। এ কোন ধরনের অত্যাচার শুরু করলা তুমি আমার উপরে?”
“তুই কেন মায়রার কাছ থেকে শিফুকে ডেকে নিয়ে গিয়েছিলি তখন?”
ভয়ার্ত দেখালো হাসিবুল্লাহ মুখাবয়ব। সেই সাথে করুণ ভাব। এ কোন পাল্লায় পরল সে? শিফুকে ডেকে নিয়ে আসার সাথে মায়রার কি সম্পর্কে? কোথাকার কোন হিসেবে ইহাম ভাই সমীকরণ মিলাতে চাইছে? শুকনো ঢোক গিলল হাসিবুল্লাহ। বেচারা কিছু না করেও পড়েছে দারুণ ফ্যাসাদে। কাতর কন্ঠে জিজ্ঞাস করল,
“ভাই আমি কেবল শিফুকে ডেকে নিয়ে এসেছিলাম একটা মেয়ের নাম্বার জোগাড় করে দিতে। তোমার বউয়ের আশেপাশেও আমি ছিলাম না ভাই। আমার কোনো দোষ নেই। দয়া করে আমায় ক্ষেমা দাও।”
“সে আমি কিছু জানি না। এই বাড়ির প্রত্যেকটা রুমে রুমে গিয়ে মায়রা কে খুঁজ করবি। একটা রুমও যদি বাদ পড়ে আমি তোকো চিবিয়ে খাবো। দরজা না খুললে বারবার ধাক্কাবি। তবুও বাড়ির একটা ঘরও যেন বাদ না থাকে।”
ইহামের চিবিয়ে বলা কথায় এবার ঘাবড়ায় হাসিবুল্লাহ। খুব বিপাকেই পড়ল সে। এবার সত্যিকারের অসহায়ের ভাব ফুটে উঠল তার মাঝে। কোন উন্মাদের খপ্পরে পড়ল সে? সবসময় নানী মার মুখে শুনে এসেছে ইহাম ঘরবন্ধী হবে না কোনো কালেও, তার বউয়ের খুব কষ্ট হবে, বউ কে বোধহয় সময়ও দিবে না হ্যানত্যান। অথচ তারা জানেও না এই বেডা কত বউ পাগলা। করুন কন্ঠে বলে হাসিবুল্লাহ,
“ভাই তোমার বউ কে একটা কল দিতেই পারো। বাড়িসুদ্ধ তন্নতন্ন করার কি মানে?”
“মায়রা কে কেউ একজন তুলে নিয়ে গিয়েছে। আর তোর দায়িত্ব হলো সবকটা ঘরে ইনিয়েবিনিয়ে ঢুকে চেক করা। ঢুকতে না দিলে পায়ে ধরে বসে থাকবি। তবুও যেই কাজ দিলাম সেটাই করবি।”
ইহাম সময় নষ্ট না করে পা বাড়ায়। এদিকে হাসিবুল্লাহ পুরা তাজ্জব বনে গিয়েছে। টাস্কি খাওয়ার মতো স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে সে। চোখ গুলি কেবল বিস্ময়ে বড়বড় হয়ে আছে। এটা কি বলে গেল ইহাম ভাই? তুলে নিয়ে গিয়েছে? মানে মায়রাকে তুলে নিয়ে গিয়েছে আর তাকে খুঁজার দায়িত্ব পড়ল কিনা তার উপর? তার শতকথক ভাবনার মাঝে ভারি কন্ঠে ইহামের কথা শুনা গেল,
“আমাদের বাড়ির কেউ যদি জিজ্ঞাস করে মায়রার কথা তাহলে বলবি আমার সাথে আছে।”
এরপর আর দেখা গেল না ইহাম কে। যেন চোখের পলকে কোথাও মিলিয়ে গিয়েছে। অতি বিস্ময়ে হাসিবুল্লাহ তখনো হা করে তাকিয়ে আছে। মানে ভাবা যায় মায়রা নিখোঁজ তাকে দায়িত্ব দিয়ে গেল খুঁজার আবার বলে গেল কেউ জিজ্ঞাস করলে যেন বলে মায়রা ইহামের সাথে? নির্বোধের মতো মাথা ঝাঁকালো হাসিবুল্লাহ। এ যেন ডেঞ্জারাস ব্যাপারস্যাপার।
“হ্যাঁলো, ক্যাপ্টেন আপনার কথা মতো সব গুলো সিসি চেক করেছি। ম্যাডাম কে বাহিরে নিয়ে যাওয়া হয়নি। সন্দেহ জনক গেইটের কাছে কিছু দেখাও যায়নি।”
ইহাম বেশ ধারনা করেছে মায়রা কে অন্যত্র নিয়ে যাওয়া হয়নি। এখনো এই বাড়িতেই আছে সে কোথাও না কোথাও। তাই তো ঝামেলার ভয়ে হাসিবুল্লাহ কেই খুঁজবার দায়িত্ব দেওয়া হলো। নিজের টিম মেম্বারদের কাউকে এই দায়িত্ব দিলে হিতে বিপরীত হতে পারে ভেবেই এই পদক্ষেপ।
“বাকি ক্যামেরা গুলিকে চেক করোনি? শেষবার কোথায় দেখা গিয়েছিল মায়রা কে?”
“রুমের ভেতরের ক্যামেরা গুলির দায়িত্ব এখানে নেই ক্যাপ্টেন। ও গুলি বাড়ির ভেতরের কারো কাছে থাকবে হয়তো। তবে শেষবার নিচতলায় একটা মহিলার সাথে কোথাও যেতে দেখা গিয়েছে ম্যাডাম কে।”
“তাড়াতাড়ি ফুটেজ টা পাঠাও আমায়। হাড়িআপ।”
ইহামের উত্তেজিত কন্ঠের তেজে কেঁপে উঠে ইবরাহিম। যেন দূর থেকেই সে আঁচ করতে পেরেছে ওই লোকটার ভেতরকার উন্মাদনা। দ্রুত কল কেটে মেইলে পাঠিয়ে দিল সেই ফুটেজ টা।
ইহাম অস্থির ভঙ্গিতে স্কিনে তাকিয়ে আছে। মায়রার মুখটা দেখে আবারও নতুন করে হাহাকার তৈরি হলো তার ভেতরটায়। বুকটা চিঁড়ে আসছে মায়রার অনুপস্থিতির যন্ত্রণা টুক। এই অল্প সময়ে বেশ গাঢ় ভাবে উপলব্ধি করতে পেরেছে তার জীবনে মায়রার গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানটুক। ভালোবাসে কিনা তার জানা নেই। জানতে চায়ও না। তার চাওয়া কেবল একটাই মায়রা। এই অগভীর সময়ে না পাওয়ার দহনটুকু, ভেতরের অস্থির ছটফটানি আর প্রতি নিশ্বাসের যন্ত্রণা টুক তাকে জানান দিয়েছে জীবনে মায়রা কে চাওয়ার প্রবণতা টা। ভেতর ঘর তীব্র থেকে তীব্রতর দাবানলে ছারখার হয়ে যাচ্ছে। অস্ফুটবাক্যে বিড়বিড় করল “কোথায় তুই মায়রা?” কতটা অসহায় বোধ নিয়ে কথাটা আওড়ালো তা যেন কেবল তার অন্তঃস্থলেই লুকায়িত।
অস্পষ্ট চোখে আস্তেধীরে মায়রা চোখ খুলল। মৃদু আলোতে ঝাপসা কিছু দেখতে পেল সে। চোখ গুলি এখনো বন্ধ হয়ে আসতে চাইছে। মাথাটাও ঝিম ধরে আছে। ঝাপসা চোখ গুলি হাত দিয়ে পরিষ্কার করতে গিয়ে অনুভব করল তার হাত বাঁধা। মুহূর্তে কপাল কুঁচকে এলো অজানা ভয় আর সন্দেহে। চোখ গুলি টানটান করে দেখার চেষ্টা করল আশপাশটা। কি হয়েছে কোথায় আছে তাও অনুধাবন করার অভিপ্রায় চালালো।
বাড়িটা ঘুরতেই সে শাশুড়ির পাশ থেকে উঠেছিল। এক পর্যায়ে একটা মহিলা এসে বললেন, তার স্বামী ইহাম চৌধুরী নাকি নীচে তাকে ডাকছে। মহিলাটার পিছে পিছে নিচে গিয়েছিল সে। একটা রুম দেখিয়ে তিনিও চলে যান। রুমের ভেতর ঢুকে কাউকেই দেখতে পেল না। কোথাও ইহাম ছিল না। ঘর থেকে বের হওয়ার আগেই কেউ যেন তার মুখ চেঁপে ধরেছিল। এর পর আর কিছুই মনে নেই তার।
এদিকওদিক তাকিয়ে কয়েকজন পুরুষকে দেখেই থমকে যায় মায়রা। অগোছালো এলোমেলো অপরিচ্ছন্ন বিশাল ঘরটায় একটামাত্র লাইটের আলো খুব বেশি আলোকিত করতে পারেনি। চারপাশে বড় বড় অপ্রয়োজনীয় জিনিস ছড়িয়েছিটিয়ে রয়েছে। দেখে বুঝায় যাচ্ছে স্টোররুমের মতো কিছুটা। তার সামনেই বাঁকা হাসি দিয়ে চেয়ারে বসে আছে একটা লোক। কয়েকটা ছেলে দাঁড়িয়ে আছে লোকটার পিছনে। তার মুখেও কাপড় বাঁধা। নিজের এই করুণ দশায় লোকগুলির সামনে এভাবে নিজেকে বড্ড অসহায় অনুভব করল সে। আতঙ্কিত নজরে প্রশ্নাত্মক চাউনি দিল লোকটার উপর। তার অসহায় নজর যেন বলে দিতে চাইছে “আমাকে এভাবে বেঁধে রেখেছেন কেন? কি দোষ আমার?” কিন্তু মুখে পট্টি বাঁধায় সেই সুযোগ নেই। শুধু শারীরিক আর আত্মীক যন্ত্রণায় চূর্ণবিচূর্ণ হলো সে।
“এতক্ষণে আপনার জ্ঞান ফেরার সময় হলো মিসেস ফাহাদ ইহাম চৌধুরী? সেই কখন থেকে আপনার অপেক্ষায় বসে আছি।”
বলেই লোকটা ফিচেল হাসল। চোখের চাউনি গভীর ভাবে বিশ্রী ভাব ফুটিয়ে আনে। ঠোঁটের কোণায় শয়তানি হাসিটা মোটেও সুবিধার লাগে না তার। তবে তার মস্তিষ্ক এতটুক ধারনা দেয় লোকটার সাথে তার নিজেস্ব কোনো শত্রুতা থেকে নয় বরং স্বামীর সূত্রে তাকে ধরে নিয়ে এসেছে। নয়তো এই অপরিচিত জায়গায় তার শত্রু আসবে কোথা থেকে? তখনি তার মনে আসে ইহামের কথা। লোকটা তো এখানে কাজের জন্যেই এসেছে এই কারণেই কি বারবার তাকে বলেছিল শাশুড়ি আর শিফুর কাছাকাছি থাকতে? আগে থেকেই কি বিপদের আঁচ করতে পেরেছিল মানুষটা? নয়তো এত বার ইঙ্গিত করে সাবধান করত না। ইহামের কথা ভেবে এবার তার খুব খারাপ আর অনুশোচনা হলো। লোকটা একটু কঠিন হলেও সর্বদা সঠিক। বরং সে নিজেই জেদ দেখিয়ে লোকটার কথা অমান্য করে সবসময়। একটুও বুঝতে চায় না লোকটার কথার পৃষ্ঠের গভীরতা। কিন্তু কোথায় সে? তীব্র আতঙ্কে যখন সে অস্থির তখন তার ছটফটানি দেখে সামনের লোকটা পাশের একজন কে বলল,
“ম্যাডামের মুখটা খুলে দে রে।”
কথা অনুযায়ী মায়রা মুখ খুলতেই প্রাণ ভরে শ্বাস টানে। ভেতরে দম নিয়ে তৎক্ষণাৎ বলে উঠে, “কারা আপনারা? কেন তুলে এনেছেন আমায়?” কোনো জবাব আসল না অপর পাশের লোকগুলির থেকে। বরঞ্চ তাদের ফিচেল হাসির প্রস্থতা দেখে ঘাবড়ে গেল সে। বিশ্রী হাসিটা সুবিধার ঠেকল না বিধায় শক্তি দিয়ে চেঁচিয়ে উঠল। “কেউ আছেন? সাহায্য করুন আমায়। এরা আমায় এখানে আটকে রেখেছে। শুনছেন? কেউ আছেন? সাহায্য করুন।” বলতে বলতে ফুঁপিয়ে উঠল মায়রা। তার এই কর্মকাণ্ডে লোকগুলি ভড়কালো না বরঞ্চ শান্ত নির্জীব রইল। অতঃপর চেয়ারে বসে থাকা লোকটা আবারও পাশের একজন কে ব্যঙ্গার্থ সুরে বলে উঠল,
“এই মিসেস চৌধুরীর চিল্লানো শেষ হলে কেউ এক বোতল পানি দিস। সারাদিন চেঁচালেও যে কোনো মানুষ আসতে পারবেনা সেটা কেউ বুঝা উনাকে।”
ওদের এমন বিদঘুটে হাসি দেখে কেঁপে উঠল মায়রার কোমল চিত্ত। আতঙ্ক শঙ্কায় নিঃশব্দে ফুঁপিয়ে উঠল সে। মনস্পটে ভেসে উঠল ইহামের গম্ভীর কঠিন মুখখানি। বড্ড আদরে আবগে মনে মনে আওড়ালো, “কোথায় কঠিন সেই মানবটা? আসছে না কেন এখনো? কখন আসবে? আদৌও কি আর কখনো ওই লোকটার দর্শন পাবে সে?”
দিকশূন্য হয়ে যখন থমকে যাওয়া নিশ্বাস নিয়ে ইহাম এদিকওদিক করে ওই মহিলাটা কে খুঁজে চলছে তখন টুং করে ম্যাসেজ আসার শব্দ জলদি করে সেটা ওপেন করে। একটু আগে যাকে লোকেশন ট্র্যাক করতে ম্যাসেজ দিয়েছিল তার থেকেই রিপ্লে আসছে। বন্ধ ওই সীমের শেষ লোকেশন এই বাড়িতেই ছিল দেখে আরো উদগ্রীব হয়ে উঠে ইহাম। যেন যত দ্রুত সম্ভব ওই মেয়েটাকে তার সামনে চায় সে। যদি পারে এই বিশাল শান্তির সাম্রাজ্য তছনছ করে এখনি নিয়ে আসে তার ব্যক্তিগত নারী টিকে।
পথে হাসিবুল্লাহ কে দেখেই এক প্রকার টেনে নিয়ে যায় তাকে। একটু নীরব জায়গা পেয়েই জিজ্ঞেস করে,
“সব গুলি রুমে গিয়েছিলি তো হাসিবুল্লাহ?”
“এখনো কয়েকটা রুম বাকি আছে ভাই। আর নীচের একটা রুমে দেখলাম তালা ঝুলছে। যে কটা রুম খুলা সব গুলিতেই জোরজবরদস্তি করে ঢোকার চেষ্টা করছি ভাই।”
“মনে রাখিস যদি মায়রা কে না পাই আগে তোর হিসাব চুকাবো।”
অসহায় করুন ভাব ফুটে হাসিবুল্লাহর মুখে। দারুন ফ্যাসাদে আটকে গিয়েছে সে। কোন কুক্ষণে যে একদিন মায়রার হাত ধরতে গিয়েছিল সে। তার শাস্তিই বুঝি পাচ্ছে এখন।”
“ভাই আমার প্রাণের ভাইজান। আমার কোনো দোষ নাই। দয়া কইরা আমারে নিস্তার দাও।”
“চুপ” দাঁতে দাঁত চেঁপে বলে ইহাম, “তাড়াতাড়ি তোর আম্মাজান কে খুঁজ হাসিবুল্লাহ।”
ওর সাথে বেকার কথা বলে সময় নষ্ট করার মতো সময় নেই ইহামের। শুধু হাসিবুল্লাহ টা কে একটু ভয় দেখিয়ে কাজ করানোর চেষ্টা করছে। বেচারা আহাম্মক হয়ে গেল। কাঁদোকাঁদো কাঁদোকাঁদো গলায় বলল,
“হো ভাই। তুমি আমার ভাইজান আর তোমার বউ লাগে আমার আম্মাজান।”
ইহাম এদিকওদিক তাকালেই সেই মহিলাটিকে দেখতে পেল। ফোনের স্কিনে তাকিয়ে আবারও শিওর হয়ে সে ছুটে গেল মহিলার কাছে। তিনি তখন আরেকজনের সাথে গল্পে মশগুল। সাজপোশাকে বুঝা যায় বিয়ে বাড়িতে আমন্ত্রিত।
“এক্সকিউজ মি।”
“জ্বি আমাকে বলছেন?”
“হ্যাঁ মিসেস। প্লিজ একটু বলবেন কিছুক্ষণ আগে একটা মেরুন রঙ এর শাড়ি পরা মেয়েটা আপনার সাথে কোথায় গিয়েছিল?”
মহিলাটি খানিক ভেবে জবাব দেয়, “সে আমি জানি না। আমাকে তো একজন খুব করে বলল ওই মেয়েটার হাজবেন্ট নাকি তাকে ওই রুমে ডাকছে কিছুর জন্যে।” হাত দিয়ে তিনি ইশারা করলেন একটা রুমের দিকে। “আমি কেবল ওকে রুমের কাছে রেখেই চলে এসেছিলাম।”
“থ্যাংকস” জবাবে ইহাম দ্রুত সেখানে চলে যায়। দরজা ধাক্কা দিয়ে খেয়াল করে ভেতর থেকে বন্ধ। খুব ধাক্কা ধাক্কি করার পর একজন বৃদ্ধা এসে খুলে দিলেন দরজা। জিজ্ঞেস করলেন,
“কি চাই?”
“দাদি ভেতরে একটু আসতে দিবেন? ঘরে কি কোনো মেরুন কালার শাড়ি পরা মেয়ে আছে?”
“না বাপু এখানে আসা যাবে না। আমার নাতনি তার বাবুকে দুধ খাওয়ায়। তুমি এখন যাও।”
“প্লিজ একটু চেক করেই চলে যাবো।”
“ভারি অসভ্য ছেলে তো তুমি। বললাম দুধ খাওয়াচ্ছে তবুও বলছো দেখবে। যাও তো যাও।”
ইহাম দ্রুত ব্যস্ত গলায় বলে উঠল “আচ্ছা ঘরে মেরুন কালার শাড়ি পরা কোনো মেয়ে আছে? কিংবা এসেছিল?”
“না বাপু। বললাম তো নেই।”
বৃদ্ধা বিরক্ত হয়ে দরজা লাগিয়ে দিল। একদম মস্তিষ্ক শূন্যের মতো ইহাম এদিকওদিক করে চোখ বুলায়। ভেতরের ভয় তার আরো ঝেঁকে বসে। নিজেকে এত শূন্য আর শ্রান্তিহীন লাগছে যা বলে বুঝানোর মতো না। চুপচাপ থাকলেও তার ভেতরটা যে ঝড়ে লণ্ডভণ্ড হয়ে যাচ্ছে সেটা কাউকে বুঝাতে পারছে না। বারবার মায়রার কথা মনে হতেই নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছিল সে নিঃশব্দে। কেবল মাত্র মায়রা কে খুঁজে পাওয়ার ইচ্ছাটুক তার মাঝে প্রবল ভাবে ঝেঁকে বসেছে। যেমন অসহায় বোধ করছিল তেমনি নিজের উপরই রাগ হলো। সে তো জানে মেয়েটা একটু অবুঝ টাইপের। তার উচিৎ ছিল না কাল রাতের ঘটনা রাতেই মিটিয়ে নেওয়ার? নয়তো সকালেও কেন এত ইগো নিয়ে বসে ছিল? তার কি আরেকটু দায়িত্বশীল হওয়া উচিৎ ছিল না? এখন কোন বিপদের মাঝেই বা আছে? ততক্ষণে তাকে আরো ব্যথিত করল কাল রাতের কথা গুলি। মায়রা কে না সে আশ্বাস দিয়েছিল সব ধরনের বিপদ থেকে তাকে নিরাপদ রাখবে? কোনো আঁচ লাগতে দিবে না?
তবে কোথায় সেই কথার মর্মার্থ? কোথায় তার আত্ম অহমিকা? কিসের গৌরব? মেয়েটা যে কোন ভয়ংকর বিপদের মুখে আছে এখন? আর সে কিছুই করতে পারছে না। বুক চিঁড়ে বের হয় ইহামের বুকের তপ্ত যন্ত্রণা। মেয়েটা কেন তার কথা শুনল না এ ভেবেই অধৈর্য হচ্ছে। এখন কোথায় আছে সে?
তখনি আবারও টুং করে শব্দ হয় ফোনটা। দ্রুত চেক করে তা। ফোনের স্কিনে তাকাতেই একেবারে স্তব্ধ নির্বাক হয়ে যায় সে। বিমূঢ় নেত্রপল্লব মেলে দেখে মায়রার বিধ্বস্ত ছবিটা। হাত পা মুখ বাঁধা, চুল শাড়ি এলোমেলো, মুখে ঘাম আর কান্নার নোনাপানি চিটচিটে হয়ে আছে। বুক মুচড়ে উঠে তার। নিশ্বাস আটকে গলা শুকিয়ে যায়। মাথা চক্কর দিয়ে উঠল নির্নিমেষ। এই যেন কেউ তার কলিজায় টান দিয়েছে। তছনছ করার তীব্র আকাঙ্ক্ষা তাকে ছটফট করে তুলে। ইচ্ছা হয় দুনিয়া উল্টে মায়রা কে নিজের সামনে নিয়ে আসতে। ওই করুন মুখশ্রী টা দেখে অগ্নিগিরির মতো টগবগ করে উঠে তার ভেতরের লাভা। রাগে প্রতিহিংসা চোখ মুহূর্তে লাল হয়ে আসে। তীব্র আক্রোশে দাঁতে দাঁত পিষে নিজেকে ধারালো করে। মনে হচ্ছে সম্পূর্ণ বাড়িটা ঝলসে দিতে। আযহার পাটোয়ারির সাহস কত সরাসরি তার কলিজায় হাত দেয়? উপায়ন্তর না পেয়ে ভেতরের উত্তেজনায় বিকট ভাবে চেঁচিয়ে উঠে খোলা মাঠে। তার ওই হিংস্র স্বরে চিৎকার করায় আশেপাশের অনেক মানুষ তার দিকে কেমন বিস্ময় আর আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে আছে। হঠাৎ এভাবে পাগলের মতো চিৎকার করছে কেন মানুষটা, এটাই যেন সবার ভাবনা। তবে তাতে ইহামের বিন্দুমাত্র কোনো হেলদোল নেই। নেই কোনো তোয়াক্কা। তার ভেতর থেকে তীব্র কন্ঠে আলোড়ন তুলছিল কেবল মায়রা।
নিজেকে একটু সময় দিয়ে সবটা চিন্তা করার চেষ্টা চালায় সে। বড্ড বিচলিত আর উদ্রেক ভাব তার হৃদয়কে জ্বালিয়ে খাখ করে দিচ্ছে। একে একে সব মিলানোর চেষ্টা করে। প্রথমে আসা তার ফোনে ম্যাসেজ, এরপর সিসি ক্যামেরা থেকে পাওয়া ওই মহিলার ছবি, বক্তব্য, লাস্ট লোকেশন, তারপর ওই ঘরের ভেতরের বৃদ্ধার কথা সব একত্র করে সে। সব মিলিয়ে মনে হয় তাকে বিভ্রান্তে ফেলতেই এমন ছক করেছে আযহার পাটোয়ারি। শেয়ানা মাল কি আর এমনি এমনি হয়েছে? রাগে শরীর জ্বলে যাচ্ছে তার।
মোহমায়ার বাহুডোরে পর্ব ৩২
নিশ্বাস দিয়েও যেন আগুন ঝরছে। ইবরাহিম কে ডেকেছে। গুরুত্বপূর্ণ একটা আলোচনা করা দরকার। তার উদ্দেশ্য যে করেই হোক মায়রা কে অক্ষত পাওয়া সেই সাথে আযহার পাটোয়ারির নিঃশেষ। বড় মাপের এক ক্রিমিনাল সে। অস্থির চিন্তায় যখন সে দাপাচ্ছে পায়চারি করতে করতে তখনি মনে পড়ে হাসিবুল্লাহর কথাটা। একটা রুমে তালা ঝুলানো? মাথায় একটু চাঁপ দিতেই স্মরণে আসে মহিলাটি যেই ঘরের কথা বলেছিল সেই ঘরের পাশেই তে একটা রুম তালাবন্ধ দেখেছে সে। কোনো একটা সূত্র কি তবে আছেই? চোয়াল শক্ত হয়ে আসে। চোখের দৃষ্টি দিয়ে নির্গত হয় অগ্নিফুলিঙ্গ। ভেতর চিঁড়ে বের হয়ে আসা তপ্ত নিশ্বাস যেন কেবলি ধ্বংসের অভিপ্রায়।